তেইশতম বসন্ত পর্ব-০৯

0
33

তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ৯
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

পাহাড় চূড়া থেকে বার্তা খুশবু অব্দি পৌঁছেছে কিনা কে জানে? ডিউটি টাইমে ফোন হাতে নেওয়া যায় না।আফতাব নিজে হেয়ালি করলে বাকিদের কি হবে?সবাই তারই আন্ডারে।খুশবু আর তার বাবা মা মেসেজ পেলো কিনা এই চিন্তা করতে করতে আরো পাঁচ দিন এখানেই অতিবাহিত হয়েছে।আর মাত্র তিনদিন।তাদের ডিউটি টাইম কমিয়ে আনা হয়েছে।এই খবরে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আফতাব।যাক আর অপেক্ষা করতে হবে না খুশবুকে।এবার সরাসরি গিয়ে বলে দিবে নিজের অনুভূতিগুলো।যা এতদিনের দুরত্বে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে নিয়েছে হৃদ গহ্বরে।

ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে খুশবু।আজকাল তার প্রতিদিনের রুটিন এটা। অপেক্ষাটা দিনকেদিন বেড়েই চলেছে।আফতাব এর অনুপস্থিতি অনুভুতির চার দেয়ালে মেখে আছে। কেউ কোনোদিন এতটা বিশেষ অনুভব করায়নি। স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তোলেনি চিত্তকে।তার চরিত্রের দিকে অজান্তে আকৃষ্ট হতে থাকা খুশবুর হৃদয় প্রশান্ত হলো মেসেজ দেখে।কি সুন্দর করে লিখেছে!খুব করে জবাব দিতে ইচ্ছে হলো সেও আফতাব এর কথাই ভেবে চলেছে।তার মন মস্তিষ্কও অবিরত ভাবনায় ডুবে।সাহস হলো না।

ফিরতি প্রশ্ন করলো, -“কেমন আছেন?”

ঘন্টা খানেক পেরোলো কিন্তু জবাব আসেনি। বোধগম্য হলো সেখানে নেটওয়ার্ক এর ত্রুটি। পা বাড়িয়ে আবারো টিলায় গিয়ে বসেছে।তবে একাকী। আফতাবদের বাড়িতে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো একবার।মুখটা ভার হয়ে আছে।পবন অনুভব করতে করতে ফোন আসে।স্ক্রিনে ভাসলো বাবার নাম।দ্রুত ফোন রিসিভ করলো।

লোকমান চৌধুরী বললেন, -“কেমন আছো মা?”

-“ভালো আছি বাবা।তোমরা?”

-“আমরাও ভালো আছি।”

মন খারাপের সুরে খুশবু প্রশ্ন করে, -“আসবে না?”

-“না বরং তোমরা ফিরে এসো।অনেকদিন থাকলে।তোমার নানুকে নিয়ে ঢাকা এসো।তোমার রেজাল্ট আগামীকাল দিবে শুনলাম। এরপরই ভর্তি হয়ে যাবে।”

ফিরে আসার কথায় বাঁধ সাধে হৃদয়।সরাসরি বারণ করছে।যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।আফতাব ফিরে যদি অপেক্ষারত না পায় তাকে?এরূপ চিন্তা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো।

-“ক’দিন পর আসলে হয়না বাবা?”

-“তোমার মা রাগারাগি করছেন। অনেকদিনতো থাকলে।আবার পরীক্ষা শেষে যেয়ো।আগামীকাল নানুকে নিয়ে চলে এসো।আমি ফাহাদকে বলে দিচ্ছি টিকেট করতে কেমন?”

নত কণ্ঠে খুশবু জবাব দেয়, -“হুম”

-“মন খারাপ করেনা মা।রাখছি”

-“আচ্ছা”

আকস্মিক ঠোঁট ভেঙে কান্না আসলো।চঞ্চল হৃদয়।কেমন যেনো দম বন্ধ ভাবটা এসে হানা দিচ্ছে। সত্যিই ফিরে যেতে হবে?আফতাব ফিরে এসে খুশবুকে না পেলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে অনেক।কত আশাআকাঙ্ক্ষা নিয়ে বলে গিয়েছিল।ভরসার বাণী ছুঁড়ে বলেছিলো তার বিশ্বাস খুশবু অপেক্ষা করবে।

খুকখুক কাশির আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো খুশবুর। তড়িৎ গতিতে মুখ ঘুরায় পেছনে। রফিকুজ্জামান মির্জা দাঁড়িয়ে আছেন।আফতাব এর বাবা। খানিকটা ভীত হলো।উঠে দাঁড়াতে চাইলে থামিয়ে দিলেন তিনি।

বললেন, -“থাক থাক।বসেই থাকো”

-“না আংকেল সমস্যা নেই।” বলে উঠে দাঁড়ায়।

রফিকুজ্জামান দুহাত পেছনে বেঁধে দাঁড়ান। খুশবু জড়োসড়ো হয়ে তার ঠিক সাথেই দাঁড়িয়ে।তিনি প্রশ্ন করলেন,

-“ভালো আছো?সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছি তুমি কিছু মনে করেছিলে?”

-“না আংকেল।আমি কিছু মনে করিনি।”

-“তোমার নামটা জানতে পারি মামনি?”

এমন ভারী গলায় মামনি ডাকটা শুনে ভীষন অদ্ভুত লাগছে।আফতাব বলেছিলো তার বাবা ভীষণ রাগী।যদি নাম জেনে বাড়িতে বিচার দেয়?জবাব না দেওয়াটাও অভদ্রতা।খুশবু গলা ভিজিয়ে বললো,

-“খুশ…খুশবু চৌধুরী আমার নাম।”

রফিকুজ্জামান জবাব দেন, -“সুন্দর নাম।তোমার বাবা- মা কি করেন?”

-“ঢাকায় বাবার নিজস্ব বিজনেস।মা গৃহিণী।”

রফিকুজ্জামান খুশবুর দিকে চাইলেন।অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।স্মিথ হাসলেন যেনো ভয়টা কেটে যায় তার।জানতে চাইলেন,

-“তুমি কি ভয় পাচ্ছো আমি প্রশ্ন করছি বলে?”

খুশবু মাথা দোলায়।না বোধক উত্তর দেয়।ভয় পেলেই কি মুখ ফুটে বলে দেওয়া যায়?রফিকুজ্জামান আবার প্রশ্ন করেন,

-“কতদিন আছো সিলেটে?আমাদের বাসায় আসবে কেমন? ঘুরে যেয়ো।”

-“বাবা ফোন করেছিলেন আংকেল।আমরা আগামীকাল ফিরে যাবো।”

-“ওহ আচ্ছা সমস্যা নেই।আবার আসলে আমাদের বাসায় তোমাদের সকলের দাওয়াত।জিতু তোমার কি হয়?”

-“মামা”

-“চিনি আমি তাকে।সেও আমার পরিবারকে চেনে।আচ্ছা আসি।ভালো থাকবে।”

-“জ্বি আংকেল। আসসালামু আলাইকুম”

পরপর দুবার এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়যায় অবস্থা।সাথে আগামীকাল ফিরে যেতে হবে।সব কিছুর মিশ্র অনুভূতি।কপালের ঘাম ওড়নার সাহায্যে মুছে নিলো খুশবু।জরিনা বেগমের ডাক পড়ে জানালা দিয়ে।দিনের আলো হারিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নামছে ধীরেধীরে। চুল খোলা করে বাহিরে ঘোরাফেরা না করার কঠোর আদেশ।নেমে ঘরে চলে আসে।এসেই জানালো জরিনা বেগমকে।সে রাজি হয় বিনাবাক্যে।অনেকদিন ঢাকা যাওয়া হয় না।এবার সব আত্মীয়দের সাথে দেখাও হবে।খুব উৎসাহের সাথে আলমারি থেকে কাপড় বের করে নিজের ব্যাগে গোছাতে শুরু করলেন।সাথে ফাহাদকে অনলাইনে টিকেট করার কথা জানিয়েছে লোকমান চৌধুরী।আদেশ মোতাবেক সে আগামীকাল দুপুর তিনটের টিকেট করেছে।সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো যে খুশবু সস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাচ্ছে না।

-“আমার ব্যস্ত শহরে ফিরে যেতে হচ্ছে ক্যাপ্টেন।বাবার আদেশের কাছে বাধ্য আমি”

সিলেটের প্রাকৃতিতে ফাল্গুনের ঘ্রাণ অনন্যসুলভ;অসাধারণ। হাওড়ায় খেলা-মেলা করতে গিয়ে উড়ন্ত পাখির গানে হৃদয় হারায়।কিছু সুন্দর মুহূর্তের জলরাশি পেছনে ফেলে এগোনোর পীড়া ভিন্ন।কালো ধোঁয়ায় অদৃশ্য করে নিচ্ছে সবটাই।বসন্তের আগমনীর এই সুর যেনো অপূর্ণ মনে হচ্ছে।শান্তির নগরীতে প্রাকৃতির সহিত নতুন স্পর্শানুভূতি,ভাবনা আরও বেগ পেয়েছে।সৌন্দর্যে মাত পায়ে দুজনের মধ্যেকার আলাপনের সুরূ কি তবে এখানেই নিরূদ্ধ? কিন্তু জীবনের গতিপথের রুখ পরিবর্তন হলে কিছু গল্প সম্পূর্ণ রয়ে যায়।

__

গাছ গাছলিতে ঘেরাও পাহাড়ের হৃদয়ে একটি স্নিগ্ধ সকাল সৃষ্টি হলো। প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা এবং স্নিগ্ধতা নিয়ে আসা এই সকালে স্নান করছে সূর্যের আলো।বোনা বিশাল গাছের বাসায় সমাহিত হলো, মৃত্তিকা সৃষ্টি করছে মধুর গন্ধ। হাওয়ায় ভাসমান পাখিদের সুরের সঙ্গীত।গত রাত্তিরের বৃষ্টির ঝরা বনে আরও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড়ানোর সুযোগ দিয়েছে, সৃষ্টিতে মেঘের গল্প সৃজন করছে।নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস পেতে, জীবনের নতুন একটি দিন চালু করে আফতাব এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে।

অপলক আকাশের দিকে চেয়ে আফতাব আনমনে মিলিয়ে নিলো ছন্দ,

“প্রকৃতির বসন্তে মেঘের আবাসে,
গাছ গাছালি মেলে পড়ে প্রেমের আবেগে।
মেঘের পথে পথিক প্রহরে,
আলোর অন্য সৃষ্টির সাথে খেলা”

একলাফে উঠে বসলো।আড়মোড়া দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছে।ফোনটা বন্ধ।কয়েকদিন ব্যাটারির সাথে কোনরকম যোগাড়-যন্ত্র করে চলতে পারলেও শেষ দিনটায় এসে ফোন সাথ দিলো না।বন্ধ হয়ে গেছে।আজকের দিনটায় বন্ধ হওয়ার দরকার ছিলো?কিছুক্ষন পর নেমে যাবে এই উঁচু অঞ্চল থেকে।ফিরবে ক্যাম্পে।তারপর হয়তো সুযোগ মিলবে একটু বাড়ি যাওয়ার।

আরিফকে ডেকে বলল, -“সব রেডি?”

দূর থেকে কাজ করতে করতে আরিফ হাত তুলে থামস আপ দেখালো।বোঝায় সব রেডি।আধ ঘণ্টার মধ্যে রওনা হবে শহরের উদ্দেশ্যে। সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আফতাব মনে মনে আওড়ালো,

-“অনেক বেশি অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি খুশবু।আপনার কাছে ফিরছি শীগ্রই।”

সব ঠিকঠাক করে পুরো টিম এক সিরিয়ালে নিচের দিকে পা বাড়ায়।দুর্গম পথ।সাবধানতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়াকিটকিতে বার্তা পাঠানোর চেষ্টায় আছে আফতাব। সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলো না তখনও। দেশরক্ষার পাশাপাশি তার তদারকিতে যে সৈন্যদল আছে তাদের দায়িত্বটাও আছে কাধে। কমান্ড দিতে দিতে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে সক্ষম হয়।জিপ তৈরি তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য।বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য মেজর মান্নান খান এসেছেন।স্যালুট জানিয়ে রওনা হয় ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।

এসেই সময় সুযোগ বুঝে ফোন চার্জ হতে দিয়েছে।পরপর এক ঘণ্টার লম্বা মিটিং।মেজর মান্নান এসে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে চলে যাওয়ার সাথেসাথেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আফতাব।অনেকদিন নরম বিছানায় পিঠ ঠেকানো হয়না।শরীরে সয়ে গেছে।তারপরও মাঝেমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

ফোন হাতে নিয়েই খুশবুর মেসেজ চোখে পড়তে সব ভালো লাগা ধুলোয় মিশে যায়।মুখে কালো আঁধার ঘনালো।ভাবলো এক্ষুনি ফোন করা উচিত!তার পূর্বেই বাবাকে একটা মেসেজ দিয়ে ফেললো।পরপর ফোন মেলায় খুশবুর নাম্বারে।

একবার রিং হওয়ার সাথেসাথে ফোন ধরে খুশবু।বলে উঠলো দ্রুত কণ্ঠে,

-“হ্যালো”

গম্ভির গলায় আফতাব জবাব দেয়, -“চলে গেলেন?”

মলিন হয়ে আসে খুশবুর মুখশ্রী। অনুতপ্ত হয়ে গেলো।জবাবে কিছু বলতে পারছে না।আফতাব বললো,

-“খুশবু?”

-“বাবা ফিরে আসতে বলেছিলো।”

-“আমাকে মিস করেছেন?”

হৃদয়ে এক ধরনের অদ্ভুত বিচলন অনুভব হলো এই প্রশ্নে।নিজের ঘরে এসে বিগত দুদিন যাবৎ অস্থির সময় কাটাচ্ছিলো। আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার পরও খুশির আমেজ লক্ষ্য করা যায়নি তার মধ্যে।নিজের শহর,নিজের ঘরে এসেও দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে যেনো এই মুহূর্তে রেহাই পেলো।কিন্তু জবাব কি দেবে?

আফতাব পুনর্বার প্রশ্ন করে, -“বলুন?”

ত্যাড়া জবাব দিলো খুশবু।বললো, -“না করিনি”

আফতাব এর হাসিটা যান্ত্রিক ফোনের আড়ালেই রয়ে গেলো। জবাব দিলো,

-“ মিথ্যে বলছেন কেনো?”

গলার জোর বাড়িয়ে খুশবু বললো, “মোটেও না।আমি কেনো মিস করবো আপনাকে?আপনিই উল্টো আমাকে স্মরণ করে মেসেজ করেছেন।”

-“ধমকাচ্ছেন আমাকে?”

-“হ্যাঁ।জানেন কি হয়েছে?”

আরিফের দিকে চাইলো আফতাব।চোখ বন্ধ করে কান পেতে আছে।তার ভাবসাব ভালোই বুঝলো।উঠে বেরিয়ে গেলো টেন্ট এর বাহিরে। হাঁটতে হাঁটতে বললো,

-“না জানালে কিভাবে জানবো খুশবু?”

-“আপনার বাবার সাথে ফেরার দিন আবার দেখা হয়েছে।উনি আমাকে আমার জিজ্ঞেস করেছেন আবার আমার বাবা কি করেন সেটাও জানতে চেয়েছেন।”

আফতাব পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই অবাক হয়।পরপর দুবার?তার বাবা অহেতুক কারো সাথে খোশগল্প করেনা।অবশ্যই কিছু চলছে তার মস্তিষ্কে।নাহয় অযথা খুশবুকে প্রশ্ন করার অর্থ কি?এটাই এবার বাড়ি গিয়ে জানতে হবে।

খুশবুকে বললো,

-“টেনশন করার কিছুই নেই।আর এখন বিচারও দিতে পারবে না বাবা। কারণ আপনি এখন ঢাকায়।”

-“ওনাকে দেখলেই ভয় হয় আমার!”

-“আপনি এসব বাদ দিন!আমাকে বলুন আপনাকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?এইযে অনুমতি না নিয়ে পালিয়েছেন?”

-“আমি কি ইচ্ছে করে এসেছি নাকি?পরশুদিন এসেছি।পরদিন আমার রেজাল্ট দিলো।এরপর আজ গিয়ে চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হয়ে এসেছি।কত কত কাজ ছিলো।”

-“কেমন হয়েছে রেজাল্ট?”

-“মন মত হয়নি” মিনমিনে গলায় জবাব দিলো খুশবু।

-“সমস্যা নেই।আগামী বছর হবে।”

আকস্মিক নীরবতায় ঘিরে যায় দুই প্রান্ত। উভয়েই চুপ বনে গেলো। চিত্তের অনুভবেরা বিশ্রামহীন। ক্ষণেক্ষণে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে কণ্ঠনালীতে সমস্ত শব্দের ভান্ডার।একই নৌকায় ভাসতে থাকা দু’জন মানব মানবীর মধ্যে ভাবনা প্রকাশে এক অদৃশ্য সংকোচ।কিছু একটা বলতে চেয়েও বললো না আফতাব।বাবাকে যে কথা দিয়ে গিয়েছিল সেটা পূরণ করতে হবে।

অনেক সময়ের নীরবতা খুশবু ভাঙলো।বললো,

-“বাড়িতে গিয়েছেন নাকি….”

কথা পূর্ণ করার পূর্বেই আফতাব জবাব দেয়, -“ক্যাম্পে আছি।”

-“যাবেন না?” শীতল গলায় জানতে চায় খুশবু।

-“যাবো।কিন্তু গিয়েতো আপনাকে আর পাবো না।”

__

জরিনা বেগম লং জার্নি করে অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।অনেকদিন পর বাসে চড়ে ধকল সহ্য করতে পারেনি বৃদ্ধ দুর্বল কায়া।দুদিন সম্পূর্ণ বিছানায় বিশ্রাম করে আজ হাঁটা চলা শুরু করেন।তিনদিন হতে চলল ঢাকা এসেছেন।এখানে জীবনটা ভিন্ন।সবকিছুই যান্ত্রিক।সাদা টেইলসে মোড়ানো জমিন সাথে আধুনিকতার ছোঁয়া দেয়ালে দেয়ালে।টিনের ঘরে থেকে অভ্যস্ত মানুষের এসব বিলাসিতা সয় না।আহামরি বিলাসবহুল জীবন যাপন করে না লোকমান চৌধুরী আর নায়লা বেগম।প্রয়োজনের তাগিদে যতটুকু জরুরি ততটুকুই।তবে জরিনা বেগমের কাছে এগুলোই বেশি বেশি মনে হয়।

সুপারি কাটতে কাটতে নায়লা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,

– “নায়লা?”

-“জ্বি খালা?”

-“মাইয়াটাতো বড় হইলো।কি ভাবছিস?”

নায়লা বেগম তার খালার কথার অর্থ বুঝতে সক্ষম।কাপড় ভাজ করতে করতে জবাব দেন,

-“আমিতো ভাবতে চাই।ওর বাবা বলে অনার্সটা পাশ করুক তারপর।”

-“আজকালের যুগে ভালো দামান পাওয়া কষ্টের।জামাইর কথাও ঠিক আছে।নিজের আদরের ফুরি নিজের কাছে রাখতে চায়।…..কিন্তু যুগ যে খারাপ পড়ছে”

নায়লা বেগম হতাশ গলায় জবাব দেন,

-“আমিও বুঝি খালা।কিন্তু ওর বাবাকে কে বোঝাবে?উপর উপর দিয়ে ছেলে মেয়েকে রাগী ভাব দেখায় কিন্তু ঠিক তার চেয়ে বেশি দুর্বল সে ফাহাদ আর খুশবুর প্রতি।”

জরিনা বেগম হাসলেন।তারও অজানা নয়।লোকমান চৌধুরীকে সেই মেয়ের জামাই হিসেবে সর্বপ্রথম পছন্দ করেছিলেন।উত্তরে বললেন,

-“বাপের ভালোবাসা কারো সাধ্য আছে কিছু কওয়ার?”

কথার ছলে সব কাপড় ভাঁজ করে নিয়েছেন নায়লা বেগম।কাজ শেষ করে জরিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“আপনার জানাশোনা কোনো ছেলে আছে?”

-“আছে বইলাই খুশবুর বিয়ার কথা তুলছি।শুধু আছেই না।বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে গেছে আকার ইঙ্গিতে।”

কথাটি কর্ণপাত হয় খুশবুর।ফ্রিজ থেকে পানি নিতে এসে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে শুনেই হাত পা বরফের ন্যায় জমতে শুরু করলো।পানির বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে।মায়ের চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে খুশবু।একের পর এক ঝামেলার মধ্যে অনুভব করলো নিজেকে।বিয়ের প্রস্তাব এসেছে।অবশ্যই খুশবুর জন্য।বিয়ে শব্দটা আসতেই মাথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।পানির বোতল পড়ে আছে টেবিলের এক কোণে।গলা শুকিয়ে কাঠ।মায়ের চোখ পাকিয়ে তাকানোর ভয়ে বাহিরে গিয়ে বাকি কথাগুলো শুনতে পারছে না।

অন্যদিকে নায়লা বেগম অধির আগ্রহী স্বরে জানতে চান, -“ছেলে কি করে খালা? কোথায় থাকে?আপনার পরিচিত?”

-“থাম থাম!এত পাগল হইস না।”

-“আহা বলেন না খালা।ছেলে ভালো হলে আমরা এগোতে পারি।”

জরিনা বেগম নিচু গলায় বললেন,

-“আমারার ঘরের কান্ধাত বাড়ি।জিতুরে চিনে ভালোমত।আমিও চিনি। ফুয়ার বাপে জিতুরে জিগাইছিলো তোরা কই থাকোস,কি করস না করস।আকার ইঙ্গিতে বুঝাইছে বিয়ে শাদী দিবো নাকি খুশবুরে।”

নায়লা বেগম জানতে চান, -“কি করে ছেলে?”

-“আর্মি আর্মি।ওর বাপও আর্মিতে আছিলো। এতকিছু জানি না জিতুরে ফোন দিয়া জাইনা নিস”

চলবে….