তেইশতম বসন্ত পর্ব-১১

0
174

তেইশতম বসন্ত
পরিসংখ্যা ১১
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

-“সেনাবাহিনী?…. ওরাতো বেশিরভাগ সময় ডিউটিরত থাকে।নিজের পরিবারকে সময় দিতে পারেনা ঠিকঠাকমত।এদিক ওদিক বদলি হতে থাকে”

জিতুর মাধ্যমে লোকমান চৌধুরী অব্দি এই খবর পৌঁছে গেছে।জরিনা বেগম আর জিতু উভয়েই খুব করে চাচ্ছে তারা আফতাব এর ব্যাপারে এগোক। খুশবুও সবার অজান্তে এক পায়ে রাজি।কিন্তু লোকমান চৌধুরীর মনে শঙ্কা।মেয়ের কাঁধে অধিক দায়িত্ব পড়ে যাবে।তাল মেলাতে পারবে তাদের সাথে?

জরিনা বেগম বললেন,

-“জামাই তুমি এখনই এতদূর কেন ভাবতে শুরু করলা?আগে ফুয়ার বাপের লগে কথা কও।তারপর কপালে যা আছে।”

-“কথা বলাকে যদি সম্মতি হিসেবে ধরে নেন তারা?”

-“আমার লগে কয়বার কথা হইছিলো পোলার মায়ের।শিক্ষিত পরিবার আর কথাবার্তাও সুন্দর।তুমি আগে থিকাই পরিষ্কার কইরা মাতবা যেনো ভুল বুঝে।”

উদ্বেগ কাটছে না লোকমান চৌধুরী এর।একবার স্ত্রীর দিকে চাইলেন।তার হাবভাব বলছে এক পায়ে রাজি সে। পূর্ণবার জরিনা বেগমের দিকে চেয়ে বললেন,

-“খুশবু রাজি হবে?”

নায়লা বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,

-“কেনো রাজি হবে না?আমরা কি ওর মত না নিয়েই বিয়ে দেবো?নাকি জোর করে দেবো। তেইশ বছরে পা রাখলো।এমনতো না যে অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছি।যথেষ্ট আর সঠিক বয়স ওর।”

মেয়েদের বিয়ে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা বেশি।সাথে সমাজের ভয়। একটু উনিশ বিশ হলেই দুর্নাম রটাতে ছাড়েনা।বিয়ের ক্ষেত্রে কিছু কূটনী নারীদের কূটনামী উচ্চ পর্যায়ে চলে যায়।নায়লা বেগম চলা ফেরা করেন এদের সাথেই।হরেক মানুষের হরেক রূপ দেখেছেন।সব দিক বিবেচনা করে নিজের পক্ষ রাখলেন তবে সামান্য মেজাজি হয়েই।

কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকা খুশবুর পিঠ বরাবর ছোট্ট একটা কিল পড়লো।পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন জনাব ফাহাদ চৌধুরী।নড়েচড়ে উঠলো খুশবু।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

-“কি?”

ফাহাদ তাচ্ছিল্য করে বললো,

-“তোর যে শরম লজ্জা নেই কতবার প্রমাণ করবি?বিয়ের আলাপ শুনছিস?তাও নিজের বিয়ের?”

-“শুনতে দোষ কি?”

খুশবুর জবাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফাহাদ।চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে।খুশবু আবার বললো,

-“বিয়ে সামাজিক রীতি সামাজিক অপরাধ নয়।আমার মনে হয় তোমার বোঝার ভুল ভাইয়া”

এবার সত্যি সত্যিই নিশ্চিত ফাহাদ নিজে বেশি লাজুক। খুশবুর ভাগের লাজটা বোধহয় ভুল করে তার মধ্যে ট্রান্সফার হয়েছে।বোনের বিয়ের আলোচনায় বড় ভাই হয়ে বড়দের মধ্যে যেতে অস্বস্তিবোধ করছিলো।নিজের বিয়ে হলে অক্কা পাবে বলে ভেবে নিলো।

ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তিনটে মিসড কল। মেসেঞ্জারে।ফাহাদ এটাও জানে কে এই ফোনকলের মালিক।খুশবু আর পরিবারের মানুষ থেকে দূরত্ব নিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।কল ব্যাক করতেই বিষাদময় কন্ঠ ভেসে আসলো,

-“আপনি বলেছিলেন আমাদের সাথে ঘুরবেন আর কয়দিন।অথচ আপনি চলে গেলেন।আমি কত প্ল্যান করে রেখেছিলাম জানেন।তার মধ্যে আপনাকে মেসেজ করেও পাওয়া গেলো না।”

নেহার কথার জবাবে ঠোঁট টিপে হাসলো।খানিক বাদে উত্তর দিলো,

– “একটা ইন্টার্ভিউ ছিলো।সরি”

-“সরি বললেই কি?আমার প্ল্যানগুলো যে পাঞ্চার হয়ে গেলো?”

-“মনে হচ্ছে খুব শীগ্রই আমরা আবার সিলেটগামী হবো।ততদিন অপেক্ষা করো?”

-“সত্যিতো?”

-“হ্যাঁ আশা করা যায়।”

নেহা ফাহাদের কথাই মেনে নিলো।হাসি মুখে জানালো,

-“ঠিক আছে আশা করলাম।”

-“বোকা মেয়ে!রাখছি।পড়ে কথা হবে।”

লোকটা প্রতিবার এভাবে এড়িয়ে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে যায় নেহাকে।একদিন মাত্র লম্বা সময় কথা হয়েছিলো তাদের মধ্যে।আর কক্ষনো না।দুয়েক বাক্য,বড়জোর পাঁচ ছয় বাক্য। ব্যাস! এই পর্যন্তই।গায়ে পড়া স্বভাব দেখাবে বলে নেহা নিজে থেকে কথা এগোতে পারে না।

দরজার দিকে বহুক্ষণ যাবৎ চাহনি নিবদ্ধ ছিলো খুশবুর।এখনই আসবে বাবা।আর এখনই তার ওয়াল্ড ক্লাস অভিনয় শুরু করতে হবে পুরোনো দিনের নায়িকাদের মতন।কিন্তু এখনো কেনো আগমন ঘটলো না। পদচারণ এর ধ্বনি কানে এসে বাজলেই উঠে দাঁড়ায় খুশবু।অহেতুক এদিক ওদিক হাতড়ে টেবিলের উপর রাখা বই খাতা গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

লোকমান চৌধুরী দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে করতে মেয়েকে ডাকলেন,

-“খুশবু?”

নাদান মুখখানা বাবার দিকে তুলে জবাব দেয়, -“জ্বি বাবা?”

বিছানার এক কোণে বসে মেয়েকে ডাকলেন।বললেন,

-“এখানে এসে বসো।তোমার সাথে কথা বলবো”

নিজের অভ্যন্তরীণ দুষ্টুমিকে দমিয়ে রেখে আলাভেলা মুখে এসে বসলো বাবার কাছে।লোকমান চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

-“আমি কথা প্যাঁচাবো না।বড় হয়েছো মা।যদিও আমাদের কাছে সবসময় ছোটই থাকবে।তারপরও তোমার একটা ভবিষ্যৎ আছে।এক না একদিন বিয়ের প্রসঙ্গ উঠবেই।আজই উঠেছে।তোমার মায়ের আর আমার মনে হচ্ছে এটাই ঠিক সময়।……তো আমি জানতে চাচ্ছিলাম যদি আমরা তোমার জন্য পাত্র দেখি তোমার কোনো সমস্যা আছে?”

চোখ নামিয়ে খুশবু ধীরে দুদিকে মাথা দোলায়।না বোধক উত্তর আসে তার তরফ থেকে।লোকমান চৌধুরী পূনরায় প্রশ্ন করলেন,

-“তোমার কোনো পছন্দ আছে?”

মন চিৎকার করে বলতে লাগলো যাকে আজকাল পছন্দ হচ্ছে তাকেই আপনারা এই বাড়ির জামাই বানানোর পরিকল্পনায় আছেন।মুখে আসন্ন হাঁসিটা টুপ করে গিলে ফেলে।আবারো মাথা দোলায় ‘না’ সূচক উত্তর দিয়ে।

লোকমান চৌধুরী হেসে বললেন,

-“তাহলে আমরা তোমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করি কেমন?যখন ভাগ্যে আছে তখনই হবে।তুমি কিছু বলবে মা?”

অন্তরে শয়তানি আর মুখে অবুঝ ভঙ্গি টেনে বললো,

-“তোমরা যা ভালো মনে করো তাই।”

মেয়ের জবাবে অনুগ্রাহী লোকমান চৌধুরী। হাঁসি মুখেই বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।নায়লা বেগম বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনেছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।লোকমান চৌধুরী বাহিরে এসে জিতুর কাছ থেকে নাম্বার চেয়েছেন আফতাব এর বাবার।আগামীকাল ফোন করে আলাপনের চিন্তা ভাবনা।

__

আফতাব শান্ত।উগ্র মেজাজ তার মধ্যে কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।তার বাবা মা নিজেই গর্ব করে বলেন।তাদের ছেলের চোখ জমিনের দিকে রেখে হাঁটার স্বভাব।তেমন কারো সাথে মেলামেশা নেই বললেই চলে।এতবছর এক জায়গায় থাকা স্বত্ত্বেও তাকে চেনে খুব কম মানুষই আছে।বাবার সুবাদে কয়েকবার নাম শুনেছে মানুষ।তাছাড়া অস্তিত্ব থাকা স্বত্বেও অদৃশ্য মানুষের ন্যায় চলাচল তার।আজ নরম এই মনটা শক্ত পাথর হয়ে উঠলো।ঘামছে গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডিউটিরত অবস্থায়।বাবার বার্তা এসেছিল সময় পূর্বে। সাফ বাক্যে জানিয়েছেন যে,

-“আগামী ছুটিতে আমরা মেয়ে দেখতে যাবো।নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তারপরই আসবে।”

জবাব দেবার একফোঁটা ইচ্ছে নেই।চুপচাপ দেখেও না দেখার ভান করে আছে।তবে মনকে মানানো যায়? খুশবু মেয়েটাও আবোলতাবোল বকছে দুদিন যাবৎ। কথায় কথায় একই গান তার।বাবা যাকে বলে তাকেই বিয়ে করে ফেলার জন্য খোঁচাখুঁচি করে।ইচ্ছেকৃত জ্বালাতন করছে তাকে।খুব গৌণভাবে নিচ্ছে।বিষয়টা অতটাও অকিঞ্চিত্কর নয়।তার উপরও এক প্রকার রাগ দেখিয়েই নীরবতাকেই নিজের করে নেয়।

পরপর আরো একটি বার্তা,

-“আপনি রেগে আছেন ক্যাপ্টেন?শুনুন রাগ ভালো না। আপনিই বলেছেন রাগ মানুষকে ধ্বংস করে।”

কিছু মানুষ হুট করেই আসে।এসে জড়িয়ে যায় সর্বত্র জুড়ে।বিরাজমান থাকে।থমথমে মুখে বিরাগে ধূসর ঠোঁটে চিরে এক টুকরো উদিত হয়।পরিকল্পনায় লেগে পড়ে ঝিকুট। ভবিষ্যতে খুশবুকে নিজের করে নিলে মেয়েটা তাকে পদে-পদে ভোগাবে।

দুরকাশে লোচন তুলে দেখলো আকাশের সাদা নীরদ কৃষ্ণাভ রূপ ধারণ করছে। শৃঙ্গের সাথে সজোরে আঘাত লাগছে যেনো।উচু মুকুট ঢেকে ফেলছে বারেবারে এসে এই শির উচু করে ঔদ্ধত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। উঁচু-নিচু তাঁদের গড়ন।কখনো জেদ প্রকাশ করে ধস নামিয়ে।কখনো নিজের শক্ত ভয়ঙ্কর রূপে ভূত করে প্রাণীকুলকে।কি যেনো আছে সেখানে!কোনো অদ্ভুত এক শক্তি। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর মতন করে টেনে টেনে নিয়ে যায় তাদের এই মোহ- মায়া।একে অপরের কাঁধে হাত রেখে আলাদা করে রেখেছে দুটো স্বদেশকে।কদম বাড়ালেই অন্য ভূখণ্ড।এখানেই দেশরক্ষীদের আনাগোনা।পাহাড়ের ধ্বনি অসাধারণ! সেই অদ্ভুত শান্তির সাথে প্রকৃতির সব সাঙ্ঘাতিক সংলাপ।বাতাসের স্পর্শে সুবিচিত একটি রূপ, আত্মসমীক্ষায় উৎসাহিত করে।পাহাড়ের গভীর গর্জন, প্রাকৃতিক সুরে মন আবিষ্ট, সাহিত্যিক ছন্দে এক মোহনীয় কবিতা।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলে আফতাব মুঠোফোন বের করে নিলো।সুন্দর করে চারিদিকের ভিডিও ধারণ করে পাঠিয়ে দিলো খুশবুর হোয়াটস অ্যাপে।লিখলো,

-“নিসর্গের নাট্যমঁচ দেখছেন?কি চমৎকারভাবে সাজিয়েছে নিজেকে?মেঘেরা ভাসছে দলে দলে। পাহাড়েরও জুটি আছে।গাছপালা সবার জোড় আছে।অথচ আমি এক অনুকংপায়ী পুরুষ নিঃসঙ্গ এখানে”

ত্বরিতে জবাব আসে, -“সঙ্গী হিসেবে কাকে চাচ্ছেন?”

জ্ঞানত চাতুর্য সহকারে আফতাব প্রতিভাষে বলে উঠলো,

-“এক সুরভী ক্যামেলিয়া পুষ্পের সঙ্গ চাচ্ছি”

-“বর্ষণমুখর অখিলপানে দৃষ্টিপাত করে চেয়ে নিন।দেখুন আপনার প্রার্থনারা স্বীকৃতি পায় কিনা?”

-“সম্ভব যদি কেউ স্বীকৃতি প্রদানের জন্য নিজ থেকে কদম এগোয়।”

খুশবু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।তার কাব্যিক জ্ঞানের দৌড় এই পর্যন্তই।আর পেরে উঠা সম্ভব না।পারেনা ছন্দে ছন্দে মেলাতে।মস্তিষ্ক সৃষ্টিশীল নয়। জবাবে টুকটুক করে লিখে ফেললো,

-“কদম এগোনোর চেষ্টা করা হবে। টাটা বাড়ি গিয়ে আবার আপনার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা হবে।”

আফতাব এর কপালে মধ্যিখানে তিন তিনটে গাঢ় ভাঁজ পড়লো।উত্তরে বলল,

-“বড্ড জ্বালাতন করেন কিন্তু খুশবু।”

-“বেশ করি!”

বলে উধাও হয়ে গেলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দর্শন হয়েছে অনেকদিন বাদে।আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইতেই চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো। মুখপৃষ্ট জ্বলে উঠলো।সেখানে সিলেটে প্রশান্তির বৃষ্টি হচ্ছে।আর এখানে?একই আকাশ একই দেশ।আবহাওয়া ভিন্ন।আবহাওয়া পরিবর্তন ও ভিন্নতার এরও যথেষ্ট কারণ আছে।কিন্তু খুশবু জানতে ইচ্ছুক নয়। ভাগ্য সহায় যে তাদের ডিপার্টমেন্টে এসি নামক যান্ত্রিক বস্তুটা আছে।নাহয় এই গরম সিদ্ধ করে ফেলতো তাকে।সিড়ি বেয়ে উপরে দিকে উঠতে গেলেই থমকে গেলো। সাহির বসে আছে তার বন্ধুদের সাথে। হাস্যোজ্জ্বল বদন।দুষ্টুমিতে মেতে ছিলো এমন ভাবভঙ্গি।

খুশবু এর মাঝে অদ্ভুতভাবে কোনো দুঃখানুভব হচ্ছে না। সোজাসুজি এড়িয়ে যেতে চাইলে তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে,

-“ভাবি!”

তিন সিড়ি উপরে উঠে থেমে যায় খুশবু।তার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই জানতো তাদের সম্পর্কের কথা। দুষ্টুমির ছলে ‘ভাবি’ বলে ডাকা হতো প্রায়শই।এখন এই ডাকটা বিষের মতন মনে হচ্ছে।পিছু ফিরে চোখ পাকিয়ে চাইলে সাহির উঠে দাঁড়ায়।

পায়ের গতি বাড়িয়ে খুশবু এর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-“তোমার সাথে কথা আছে আমার”

এক সেকেন্ডও সময় না নিয়ে খুশবু জবাব দেয়,

-“আমার কোনো কথা নেই তোমার সাথে।”

সাহির পিছু ফিরে একবার বন্ধুদের দেখে নিলো। মৃদু গলায় বলল,

-“দুদিন আগে আমার পেছনে নির্লজ্জের মতন ঘুরেছ।সময় চেয়েছো।এখন রূপ বদলালো কেনো?ফোন দিয়ে বিরক্তও করো না।”

-“কারণ এতদিন আমি যেসব সন্দেহ তোমাকে করে এসেছি সবটা তুমি হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছিলে। উপলব্ধি করলাম সবটাই সত্য ছিলো।একজনকে ভালোবাসার দাবি করে অন্য মেয়েদের সাথে তোমার রসালো আলাপ চলে।তাই আমি সরে এসেছি।তুমিতো এটাই চেয়েছিলে।”

সাহির খুশবুর কথার ধাঁচে অবাক। আগে অল্প সময় চাইতো তার কাছে।গলার আওয়াজ শুনতে চাইতো।এই খুশবু সেই খুশবু নয়।ভিন্নতা এসেছে তার মধ্যে।সাহির অনুভূতিহীন তার প্রতি।জবাব দেয়,

-“হ্যাঁ এটাই চেয়েছিলাম।”

-“যা চেয়েছো তা হয়েছে।এখন আমি কথা বাড়ানোর কোনো স্কোপ বাকি আছে বলে মনে করছি না।আসি সাহির।”

ছলে বলে জানতে এসেছিল এই মেয়ের মাঝে হঠাৎ কি করে পরিবর্তন হলো।জানতে পারল না। অন্যথা যেতে দিলো তাকে।খুশবু যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়ে একবার পিছু ফিরে চায়।বলে উঠে,

-“একজন মানুষের প্রতিই সৎ থাকতে শিখো।নাহয় ভবিষ্যতে অনেক পস্তাতে হবে।”

সাহির হেঁসে অপমানের সুরে সবাইকে শুনিয়ে বলে উঠে,

-“যে মেয়ে আমার কাছে একটুখানি ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতো আজ তার রং বদলেছে।মুখে এত বড়বড় কথা।হাস্যকর!”

সবার সামনে এমন অপমানে ভেতরটা হুহু করে উঠে।অজান্তেই চোখ বেয়ে টুপটাপ পানি ঝরতে শুরু করলো।নিজেকে নিজে শাসাচ্ছে। ঠিকইতো বলেছে সাহির।কতই না বেহায়াপনা করেছে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।তার এই শাস্তিটা প্রাপ্য ছিল। বান্ধবী ফাইজার ডাকেও থামলো না তার কদম।সোজা বাড়ি গিয়ে মন মস্তিষ্ক ঠান্ডা হবে।

বাড়ি ফিরে ব্যাগ বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে।মুখটা অত্যন্ত তৈলাক্ত হয়ে উঠেছে। জ্বলছে মুখ গরমে।নতুন বইয়ের ভারে কাঁধে টনটন ব্যথাও অনুভব করলো খুশবু।সাথে মনের ক্ষত।সবটা মিলিয়ে বিভৎস অবস্থা।হাতের গতি বাড়িয়ে সব কাজ করছে।জেদ তুলছে নির্জীব বস্তুর উপর।কাপড় বদলে মুখে কয়েকদফা পানির ঝাপটা দিলো।এসির ওন করে রুমের সব পর্দা টেনে আবছা অন্ধকার করে বিছানায় অর্ধ শুয়ে মাথা ঠেকায় বিছানার হার্ড বোর্ডে।ছোটোবেলা থেকে সহনশক্তি কম তার। জনসম্মুখে অপমানজনক কথাবার্তা সহ্য করতে পারেনা কখনোই।তাই এড়িয়ে চলে এসব কোলাহল।বন্ধুদের মধ্যেও টেনে রেখেছে ব্যারিকেট।সীমার বাহিরে কোনোটাই পছন্দ না।কিন্তু নিজেই নিজের সম্মানের সীমা লংঘন করেছিলো সাহির এর কাছে।তাই আজ সাহস পেয়েছে সে।নিজের উপর জেদ নিয়ে খুশবু চোয়াল শক্ত করে চোখ বুজে আছে।ঠান্ডা বাতাস যদি মাথা ঠাণ্ডা করতে পারে?ক্ষতি কি?

বাড়ি ফিরে কখন ঘুমিয়েছে হদিস নেই। পড়ন্ত সন্ধ্যায় খুশবুর কথা মনে পড়ে কারো।টুপ করে কল মেলালে স্বাধের ঘুমটা উড়াল দিলো। হাতড়ে ফোন তুললো খুশবু।ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,

-“হ্যালো”

কন্ঠধ্বনি সারাদিনের ধকল চমৎকারভাবে কাটিয়ে তুললো।ভেজা চুল আর ভেজা ইউনিফর্ম।সাথে ঘোরালো আওয়াজ শীতল করে তুললো আফতাব এর চিত্ত।বুক ভরে লম্বা নিঃশ্বাস টানলো।প্রেম সাগরে ডুবে মাতাল এর তালিকায় নাম উঠতে দেরি নেই। হৃদপিণ্ডের অত্যধিক গতিকে দমিয়ে জবাব দেয়,

-“ভর সন্ধ্যায় ঘুমোচ্ছেন?”

ফোন কানে ধরে উল্টো ঘুরে আরাম করে শোয়।বলে,

-“টায়ার্ড ছিলাম।কখন ঘুমিয়েছি জানি না”

-“আমি লাইনে আছি।গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসুন নাহয়?”

খুশবু সরাসরি জবাব দিলো, -“না এখন না।”

একহাতে চুল মুছতে মুছতে আফতাব প্রশ্ন করে,

-“তা কি করলেন আজ ভার্সিটিতে?”

আফতাব এর প্রশ্নে পিত্তি জ্বলে উঠে। ঘুমেরা দৌড় লাগিয়ে পালালো। তন্দ্রার প্রকোপে ভুলতে বসেছিলো আজকের ঘটনা।হঠাৎ মনে পড়ে। খুশবুর নীরবতায় আফতাব আবারো প্রশ্ন করে,

-“কি হলো?”

আকাশ ডাকছে।আফতাব টেন্ট থেকে মুখ বের করে একবার দেখে নেয় অবস্থা।রাতে ডিউটি আছে তার।যতটুকু সময় পাচ্ছে মনটা প্রশান্ত করুক এখানে।ফোন স্পিকারে রেখে ইউনিফর্ম খুলে দড়িতে ঝুলিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ে আফতাব।এখনও মেয়েটার নীরবতা কাঁটছে না।মাথার পেছনে হাত ঠেকিয়ে আবার জানতে চায়,

-“কিছু হয়েছে খুশবু?”

-“হুম”

-“কি হয়েছে?”

আমতা আমতা স্বরে খুশবু জানতে চাইলো,

-“আচ্ছা?আমি আপনার সাথে আমার সব কথা শেয়ার করতে পারি?”

আফতাব নরম গলায় জবাব দেয়, -“শুধু আমার সাথেই পারেন।”

-“আপনি জাজ করবেন আমায়?”

-“একদমই না।”

-“সব কথা বাবা মাকে বলা যায় না।আবার ভাইয়াকেও না।আমি মানুষ খুঁজে পাইনা আমার কথাগুলো বলার জন্য।অনেকেই অনিহা প্রকাশ করে।আবার অনেকে অহেতুক কথা ভেবে হাসাহাসি করে।আর কারো কারো কাছেতো কোনো কথা সেফ থাকে না। রটিয়ে বেড়ায় সবখানে।”

কথাগুলো বলার সময় খুশবুর গলার স্বর বাচ্চাদের ন্যায় হয়ে উঠেছে।বেশ উপলব্ধি করলো আফতাব।অভিমান জানাচ্ছে তার কাছে।আফতাব বলে উঠলো,

-“আমাকে কথা জমা রাখার সিন্দুক হিসেবে ধরে নিন।যখন যা ইচ্ছে হবে এই সিন্দুকে এনে জমিয়ে রাখবেন।যার চাবি আপনার কাছে থাকবে…..আর সিন্দুকের মালিকতো আপনি নিজেই”

কথার অর্থটা ঠিক ধরতে পারেনি খুশবু।বোঝার চেষ্টাও করেনি আফতাব এর আশ্বাসে নিজের কথাগুলো এক এক করে বলতে শুরু করে।প্রথমেই বললো,

-“আমি একজনকে ভালোবাসতাম।সে আমার ভার্সিটির সিনিয়র।”

হাসি মুখে আধার নামতে বেশি একটা সময় নেয়নি।আফতাব এর সম্পূর্ণ মুখশ্রী মিয়ে গেলো।জবাবে ধিরো গলায় বলল,

-“হুম?….তারপর?”

-“আমাদের সম্পর্কের শুরুতে সে আমাকে ভালোবাসতো।কিন্তু ধীরেধীরে যত সময় যায় আমাকে ইগনোর করতে শুরু করে।তারপর একদিন তাকে আমি একটা মেয়ের হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।আমি জানতে চাইলে সে আমাকে বলে ওই মেয়েটা ওর ফ্রেন্ড।আমি বিশ্বাস করতে চাইনি।ঠিক সেদিন থেকে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করলো।আর ব্যবহার খারাপের মাত্রাটা দিনদিন বাড়তে শুরু করে।তাকে কোনো প্রশ্ন করা যেতো না।সময় চাইলে সময় দিতে চাইতো না।কথা বলতে চাইতো না।আলগোছে অপমান করত। বারবার ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিতো।এর মাঝে আমি তাকে আরো মেয়েদের সাথে দেখেছি।যতবার প্রশ্ন করেছি সে একই কথা বলতো সবাই তার ফ্রেন্ড।তারপর কয়েকমাস পর বিনা কারণে সে আমাকে বললো আমাদের আর সম্পর্ক এগোনো ঠিক হবেনা।সে ব্রেক আপ চায়।তার কাছে সম্পর্কটা একটা খেলা হলেও আমি সিরিয়াস ছিলাম।আমি ভালবাসতাম তাকে।”

নীরবে চোখ বুজে খুশবুর প্রত্যেকটা শব্দ শুনছে।ধ্বান্ত চারিদিক। শব্দহীন;শ্রান্ত।হিমেল কুণ্ডলীর ঝাঁপটা পড়ছে বারেবারে খোলা সুঠাম দেহে।খুশবু এবং নিজের অগোচরে খারাপ লাগা ঘিরেছে ধৈর্যশীল মানবকেও।

-“শুনছেন?”

“হুম।বলুন?এরপর কি হলো?”

কণ্ঠের মলিনতা মধ্যেই খুশবু বলে,

-“আমি তখন পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম।বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।অল্প বয়সী মেয়েদের মতন উদ্ভট পাগলামো করেছি।যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তাকে চাইতাম। বেহায়াপনা করেছি তার কাছে।এখন যখন আমি তাকে চাই না।মনে মনে ঘৃণার জন্ম নিয়েছে।বুঝতে পেরেছি সে আসলে আমাকে কক্ষনো ভালোবাসেনি।তারপরও আমার পিছু ছাড়লো না।আজ আমাকে সবার সামনে অপমান করেছে।তার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করছিলো।ওরা ভাবছে নির্দোষ একজনকে এভাবে অপমান করা খুবই ভালো কাজ।”

উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে আফতাব।অধির হৃদয়কে বোঝালো।এতে খুশবুর যে কোনো দোষ নেই।আফতাব ধীরো গভীর গলায় শুধায়,

-“তাকে আর ভালোবাসেন?”

-“একদম বাসি না।আমি খুব করে চাইতাম জানেন?একটা প্রবল বেগে ঝড় আসুক।এক নিমিষে সবটা ধুয়ে মুছে যাক হৃদয় থেকে।ভাগ্য সহায় হয়েছে আমার।স্বল্প সময়ে জোর জবরদস্তির সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পেরেছি।ভাইয়া বুঝিয়েছে আমাকে।আর….”

-“আর?”

আফতাব এর জন্য তার সুপ্ত অনুভূতিটা অন্তরেই চেপে রাখলো। ত্বরিত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।বলে,

-“আর কিছুই না।বলুন আপনি আমাকে জাজ করবেন?আমার কোনো দোষ ছিল?”

আফতাব জানতে চাইলো, -“অতীত এর ভুলে যান।ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন।কিছু পরিস্হিতি আর কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আসে আমাদের শিক্ষা দিতে।”

-“ভুলেই গেছি।”

-“হালকা অনুভব করছেন খুশবু?”

-“হ্যাঁ”

খুশবুর চটপট জবাবে মুখের বিলীন হওয়া হাঁসি দ্বিতীয়বার ফিরে আসে।কখনো বুঝদার আবার কখনও অবুঝ।দুটো চরিত্র দেখেছে আফতাব খুশবুর মাঝে।

“আমাকে যে অনুভব করতে শুরু করেছেন সেটা স্বীকার করতে কতদিন সময় নেবেন?”

নীরব রইলো খুশবু।যেখানে ‘আর’ এর পরবর্তী বাক্যসমূহ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল সেখানে আফতাব এর নামটাই আসতো। পদে পদে নির্বিশেষ খুশবুকে বিশেষ অনুভবের মধ্য দিয়ে ভাসানো পুরুষকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি এখনও।সাহস হয়না।এটাকি লাজ?নাকি ভিন্ন কোনো সংকোচ।নির্বাক অনুল্লেখ ভাষা বুঝে নিয়ে আফতাব বলে উঠে,

“নব্য এই বসন্তের আগমনে পুরোনো সর্ব ঋতুর গ্লানি মিটে যাক।”

চলবে…