তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৩

0
154

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৩
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

-“আসসালামু আলাইকুম নানু”

জরিনা বেগম কন্ঠস্বরটা চিনলেন না।নানু ডাকার আর কে আছে ফাহাদ আর খুশবু ছাড়া? এতো অপরিচিত আওয়াজ।বাটন ফোন একেবারে কানের সাথে চেপে জবাব নিলেন সালামের।বললেন,

-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কে?”

দুষ্টুমির ভূত তার নিজেরও চেপেছে। আফতাব বললো,

-“আমাকে চিনলেন না?”

-“নাতো”

-“নাতনির সাথে বিয়ে ঠিক করছেন অথচ হবু নাতজামাই এর কন্ঠটাও চিনেন না।এটা কি ঠিক?”

ফিক করে হেসে ফেলেন জরিনা বেগম।কিছুটা বিস্মিতও হন।বুঝতে বাকি রইলো না কার ফোন।ইদানিং কথা হয়েছে আফতাব এর বাবা মায়ের সাথে ফোনে।জানতে পেরেছে তাদের ছেলে সম্পর্কে অনেক কিছু।

-“ওহ আচ্ছা আচ্ছা!তুমি আফতাব নি?”

-“জ্বি”

-“আমারে ফোন দিলায় যে?কিছু কইবা?”

-“আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে নানু।আমি জানি এই কাজটা আপনি ছাড়া কেউ করতে পারবেন না।”

পুরুষ মানুষ প্রেমে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?মনের মাঝারে এই প্রশ্ন ড্রাম বাজাচ্ছে।তাহলে সেও অভিনয় করলো?এটা কি করে সম্ভব!তার বাবা নিজে প্রস্তাব দিয়েছে।ঢাকা আসবে বলে জানিয়েছে।হুট করে মত পরিবর্তন হলো কেনো?তাহলে কি আরো একবার হৃদয় ভাঙবে?ঠাসাঠাসি করে নিজের জায়গা করে নেওয়া ক্যাপ্টেন সাহেবও সাহিরের মতই হবে?এসব চিন্তা ভাবনা দুটো দিন যাবত।খুশবু ভেবে নিয়েছিলো আফতাব হয়তো দুষ্টুমি করছে।মজা করছে তার সাথে।কিন্তু তার এই চিন্তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো।কোনো হদিস নেই লোকটার দু’দিন যাবত। খুশবু খুশবু বলে মুখে ফেনা তোলা লোক একবারের জন্য কল করেনি।মেসেজ করেনি।মেয়ে দেখতে গিয়েছে বুঝি?বিয়েটাও করে নিয়েছে নাকি!রাগ হলো খুশবুর।হাত মুঠ করে বসে রইলো।এভাবেই আছে ঘরের মধ্যে দুইদিন।বের হয়নি।খাবার ছাড়া তার মুখ বাড়ির মানুষ দেখেছে কিনা সন্দেহ।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজটা একেবারে মস্তিষ্কে এসে বারি খায়।মেজাজ আরো খানিক বিগড়ে গেছে।উঠে দরজা খুললো রুক্ষ মুখে।জরিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন।খুশবু স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

-“কি চাই?”

জরিনা বেগম খুশবুকে টপকে ভেতরে এসে পড়েন।নিজ থেকে খুশবুর আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করলেন।একটাই শাড়ি তার আলমারিতে।বললেন,

-“তোর আর কোনো শাড়ি নাই?”

খুশবু বললো, – “নেই! শাড়ি কেনো বের করছো?”

-“আজকে তোরে পাত্রপক্ষ দেখতে আইবো।”

খুশবু ভাবনা চিন্তাবিহীন জবাব দিলো,

-“আমি বিয়ে করবো না।”

জরিনা বেগম জবাব দেন,

– “এটা অন্য পাত্র।ওই আর্মিটা না। দেখতে মেলা সুন্দর। তোগো ঢাকার।”

আকাশ ভেঙে পড়ে খুশবুর মাথায়।এটাই জানতে চাচ্ছিলো।জানলো।তবে এইভাবে?নতুন পাত্র!এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে আফতাব যা বলেছে তাই সত্যি।বিছানায় বসে পড়ে খুশবু।মন তোড়জোড় করে অমান্য করছে বিষয়টা।হাইপার হয়ে উঠছে সে।কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-“আর্মি,পুলিশ,গোয়েন্দা,চোর,বাটপার আমি কাউকেই বিয়ে করবো না।সবাইকে জানিয়ে দাও”

-“তোর মা তোর ঠ্যাং ভাঙবো।এই শাড়ির লগে কানের দুল,গলার সেট বাইর কর।”

-“নানী যাও এখান থেকে।আমার একদম ভালো লাগছে না এসব।”

জরিনা বেগম শাড়িটা বিছানার উপরে রাখলেন।হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।ভারী সুন্দর। খুশবুর দিকে চেয়ে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলেন।মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বললেন,

-“বিকালে আইবো ওরা।তৈরি হইয়া থাকিস।”

_______

‘সুদূর শহরে দেখা হবে
স্পর্শে মিলবে হৃদয় পীড়ার উপশম।
পথ যতই দীর্ঘ হোক,ভালোবাসা সাহস জোগায়,
কাছে যাবার স্বপ্নে প্রজাপতির ন্যায় উড়ে বেড়ায়
অন্তর।

স্মৃতির পটে আঁকা যত মুহূর্তের ছবি,
থাকুক কিছু বাঁধা,
তার সান্নিধ্যে পাবো সুখের অমৃতসুধা।

দূরত্ব যতই হোক, হৃদয় তো সর্বক্ষণ কাছেই থাকে,
অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা, সব দূরত্ব ম্লান হয়ে যাক।
অপেক্ষায় কাটছে প্রতিটি প্রহর,
খানিক বাদেই পাবো জীবনের আসল সুর।’

মনে মনে ছন্দ বুনে নিলো।কালো রংয়ের গাড়ীর কাঁচ চিরে হরিদ্রাবর্ণ রৌদ্রোভা শ্যামলা মুখখানায় এসে সরাসরি পড়লো।ক্ষুদ্র ঝলমলে দু নেত্রদ্বয়।মনের গভীরে জ্বলছে ভালোবাসার প্রদীপ।যেনো অতিক্রম হওয়া প্রতিটি ধূসর রাস্তা একটু একটু করে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে।মুখে এসে পড়া হাসিগুলো মনে চেপে রাখা।উপভোগ করছে আফতাব।জানালা দিয়ে প্রকৃতির সবুজ ছোঁয়া।নির্মল সাইসাই বাতাস।দ্রুততার সাথে সঙ্গীত শুনিয়ে যাচ্ছে।প্রতি ধাপ, প্রতি চাকা ধেয়ে যাচ্ছে তার ক্যামেলিয়া ফুলের দিকে।সুদূর শহরে মিলনের আশায় মনটা উদ্ভাসিত;অমৃতীয়।

বিরহের রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলোর ন্যায় মুখোমুখি হবে তখন কি প্রতিক্রিয়া হবে খুশবুর?আরো খানিক অধর দুটো প্রসারিত হয় এই ভাবনায়।ফোনটা হাতে নিলো আফতাব।মেসেজ লিখলো,

-“কেমন আছেন খুশবু?”

সেতো সর্বদা ফোন নিয়ে প্রস্তুত থাকে।আজও ছিলো।কয়েক মিনিট অপেক্ষা করিয়ে উত্তর দিলো,

-“কেনো মেসেজ করেছেন?”

-“আপনার কথা মনে পড়লো তাই করলাম।”

জেদী মুখখানা নিয়ে দ্রুত হাত চালায়।লিখে,

-“আমাকে মনে করা লাগবে না।ফোন মেসেজ করবেন না একদম”

ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে আফতাব।বিপরীতে জবাব পাঠায়,

-“কেনো রাগ করছেন?নিজেই বলেছেন বিয়ে করে নিতে বাবা মায়ের পছন্দে।তাইতো করছি।এখন আবার রাগও নিজেই দেখাচ্ছেন।”

ক্ষীণ খুশবু।অনেকটা সময় অতিবাহিত করে নরম হলো।ছলছল করতে শুরু করছে নয়ন।হুট করে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। অনুভূতি জাগ্রত হতে এত অল্প সময় নিলো আফতাব এর প্রতি?একটু দেরীতে হলে বোধহয় আজ এমন খারাপ লাগতো না।বললো,

-“আপনি সত্যিই বিয়ে করবেন ওই উপশহরের মেয়েকে?”

-“বাবার বাধ্য সন্তান হয়ে করতেই হবে খুশবু।”

আর কোনো জবাব এলো না।আফতাব চিন্তিত খানিকটা।তবে এই চিন্তা আর খুশবুর রাগ দীর্ঘসময়ের নয় মাত্র কয়েক ঘন্টার।

দুপুর পেরিয়ে অপরাহ্নের শুরু। নায়লা বেগম তোড়জোড় শুরু করেছেন। দূর থেকে আসছে মানুষগুলো। তাদের জন্য খাবার আর বিশ্রামের আয়োজন দেখতে হবে।যদিও হোটেলে উঠবেন।খুন্তি চলছে আর সাথে মুখটাও।বিড়বিড় করে মেয়েকে বকে যাচ্ছেন।দুদিন যাবত মেয়ের ভাবসাব ভালো না।কারো সাথেই ঠিক মত কথা বলে না।ক্লাসে যায় না।ঘরে দরজা আটকে বসে থাকার স্বভাব পুরোনো।লোকমান সাহেব আর ফাহাদ থাকলে আর এই কাজটা করতে পারতো না।তারাও ব্যবসায়িক কাজ থেকে ফিরবেন কিছু সময় পর।শহরের বাহিরে গিয়েছিলেন বাবা ছেলে।এই নিয়েও নায়লা বেগমের কিছু রাগ আছে।একা সব সামলানো যায়?কাজ শেষে মেয়ের ঘরে গিয়ে হাজির হলেন।

রাগ দেখিয়ে বললেন, -“তৈরি হ”

মুখ বেজার।চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে।চাইছে না তৈরি হতে কিছুতেই।সে কি আর মাকে বলা যাবে? দুঃখী মনের আর্তনাদ মাকে শোনালে মা আরো ক্ষেপে যাবেন।

তারপরও কিছু বলতে চাইলো, -“মা”

ঠিক তখনই কুকারের সিটি বাজে।নায়লা বেগম ঝাঁঝালো গলায় বললেন,

– “এমন ভাব করছিস যেনো তোকে জিজ্ঞাসা করেই ছেলে পক্ষকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে।দেবদাসী সেজে বসে আছিস!দ্রুত তৈরি হ।আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।”

শাড়িটা পড়তে জানে খুশবু।মায়ের কাছে দেখে কয়েকবার পড়েছে।চেষ্টা করতে করতে হয়ে গেছে শেখা।মনের মধ্যে ভারী ওজনের পাথর রেখে তৈরি হলো। সান্ত্বনা দিলো নিজেকে।দেখে যাক।পড়ে না করে দিবে।বাবাকে যে করেই হোক বোঝাবে।তবে অস্থিরতা যে কমছে না?

________

আফতাব এর পরিবার হাজির।লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে।হোটেল থেকে খুশবুদের বাড়িতে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়েছে।রফিকুজ্জামান মির্জা হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে হাঁসি মুখে প্রবেশ করলেন সিটিং এরিয়াতে।সাথে এসেছে জিতু।লোকমান চৌধুরী, নায়লা বেগম,ফাহাদ সকলেই তাদের সবিনয়ে তাদের স্বাগত জানায়।সালাম বিনিময়ের পর টুকটাক কথা চলছে তাদের মধ্যে।সবার মধ্যে চুপচাপ আফতাব।চোখ ঘোরাচ্ছে চারিদিকে।দুহাত মুঠ করে নির্বিকার।এই সাজানো গোছানো পরিপাটি ঘরের কোণে কোথাও কি খুশবু মেখে আছে?হয়তো পুরো ঘর জুড়েই। কোথায় আছে সে?আদৌ কি প্রস্তুত তাদের সামনে আসার জন্য?নাকি রাগে,অভিমানে গজগজ করছে।বিশ্বাস করেছে কি জরিনা বেগমের কথা?যেটা আফতাব শিখিয়ে দিয়েছিলো তাকে?কে জানে!কে জানে দুজন মুখোমুখি হলে কি অবস্থা হবে?আফতাব কি প্রতিক্রিয়া দেবে সে নিজেই জানে না।অহেতুক সকলের সামনে হেঁসে না ফেললেই হয়।

দু পরিবারের আলাপ আলোচনার মধ্যে জরিনা বেগম বলে উঠলেন,

-“আমি খুশবুরে নিয়া আসি”

আফতাব তাকিয়ে রইলো জরিনা বেগমের দিকে।হেঁটে গিয়ে বাম দিকের রুমটায় প্রবেশ করেছেন।এটাই খুশবুর ঘর হয়তো।দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো।অনুভব করলো হৃদয়ের স্পন্দন হুট করেই বেড়ে গেছে।চোখ নামিয়ে বসে রইলো আফতাব।

বেশি সময় সেটা সম্ভব হয়নি।কারো কদমের আভাসে নয়ন উঠেছে।ফুলে থাকা মুখটা দেখে থমকে গেলো। গোলাপি রঙের শাড়িতে মোড়ানো একটা পুতুলের ন্যায় মনে হলো তাকে।তবে পুতুলের মন খারাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।দৃষ্টি প্রসারিত হতে থাকে।পুরোপুরি পলকহীন-প্রতিক্রিয়াহীন।আশপাশ,পরিস্থিতির কোনো খেয়াল নেই।শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে চেয়ে আছে।খুশবু একটাবার চোখ তুলে নি।চোখ নুয়ে সালাম জানিয়েছে।নজর সকলের পায়ের দিকে।সোফায় বসে পড়লো চোয়াল শক্ত করে।কত সময় চোখ নামিয়ে রাখা যায়?

রফিকুজ্জামান প্রশ্ন করলেন, -“কেমন আছো খুশবু?”

আওয়াজটা পরিচিত মনে হলো।সাত পাঁচ না ভেবে চোখ তুলে তাকায়। বৈদ্যুতিক শক খেলো যেনো। জবাব না দিয়েই বিশাল চোখে চেয়ে রইলো রফিকুজ্জামান এর দিকে।পরপর চোখ যায় পাশে।সাহেব সেজে বসে থাকা আফতাবকে দেখে এবারে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব।তালগোল পেকে গেছে ইতিমধ্যে মাথায়।রফিকুজ্জামান প্রশ্ন করেছিলেন সেটা ভুলে গেছে। আফতাব কপালে আঙুল চালাচ্ছে নিচে চেয়ে। হাঁসি কন্ট্রোল করার তুখোড় চেষ্টা। খুশবুর শরীরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।

নায়লা বেগম মেয়ের এমন অদ্ভুত চাহনিতে কেশে উঠলেন।বললেন,

-“কি হলো খুশবু?তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে”

নিজেকে সামলায় খুশবু।মিনমিনে গলায় বলে উঠে,

-“দুঃখিত…..আমি ভালো..আছি”

-“আরেহ কোনো সমস্যা নেই।তুমি হয়তো নার্ভাস।”

নার্ভাসনেস নামক খারাপ জিনিসটা আজকে বাঁচিয়ে দিলো তাকে।ক্ষণিকের অস্থিরতা আর বিস্ময় কেটেছে।এবার রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।সামনেই চায়ের গরম কাপ। দাঁতে দাঁত চেপে ইচ্ছে করছে যে এই পুরো কাপটা আফতাব এর মাথায় ঢেলে দিক। রুমানা মির্জা খুশবুকে কিছু সাধারণ প্রশ্ন করলেন।পাশাপাশি আফতাব সম্পর্কেও জেনে নেন খুশবুর বাবা মা।জানতে চাইলেন তার বিষয়ে। তার যেনো কোনো অসস্তি না হয় তাই বেশি প্রশ্ন উত্তর করেননি।

তিনি নায়লা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,

– “আমাদের তো খুশবুকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে আপা।কিন্তু সংসার ওরা করবে।….. নিজেরা যদি কথা বলে নিতো তাহলে ভালো হতো না?”

নায়লা বেগম সম্মতি দিলেন। খুশবুর উদ্দেশ্যে বললেন,

-“খুশবু? যাও মা।আমি বারান্দায় চা পাঠাচ্ছি তোমাদের জন্য।”

মায়ের মুখে এত মিষ্টি কথা হজম হচ্ছে না।সেতো সর্বক্ষণ রেগে থাকেন।ফাহাদ দুষ্টুমির সুরে বলে মায়ের মাথায় আগুন জ্বলে থাকে সবসময়।আর বাড়ির বাকিরা ফায়ার ব্রিগেড।আবার কখনও কখনও কেরোসিন এর কাজটাও করা হয়।

সবার দৃষ্টির অগোচরে নায়লা বেগম খুশবুর উদ্দেশ্যে বললেন,

– “বোকার মতন কোনো কথা বলবি না।যা যা জিজ্ঞেস করবে ভালোভাবে উত্তর দিবি।”

খুশবু মাথা দোলায়। হেঁটে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে,

– “সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে বারান্দা থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দিবো।কাহিনী খতম সেখানেই!”

কোনোদিকে না চেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে খুশবু।পেছন পেছন আফতাব।বারান্দার পরিবেশ মনোরম। খুশবুর আবদারে বড় খোলা বারান্দার ফ্ল্যাট কিনেছিলেন লোকমান সাহেব বছর সাতেক আগে।মেয়ের ভাষ্যমতে বাড়িতে বারান্দা বড় না হলে নাকি বাড়ি আর বাড়ি মনে হয়না। এমনটা কেনো?সেটা আজও জানা যায়নি।রেলিঙে হাত রেখে অন্যদিকে চেয়ে রইলো।আফতাব হেসে জানতে চাইলো,

-“শুনলাম আমাকে বারান্দা থেকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা।”

-“আপনি আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না!”

ধমকের সুর।আফতাব কোনোভাবে হাসি চেপে রাখতে পারছে না।জবাব দিলো,

-“আচ্ছা আপনি বলুন আমি শুনি।”

মুখ ঘুরিয়ে তাকায় খুশবু। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিলো।ইউনিফর্মে দেখেছে,বাড়ির কাপড়ে দেখেছে।আজ বেশভূষা ফরমাল।নিজেকে পরিপাটি করে তবেই এসেছেন জনাব।তাতে খুশবুর কি!এখন তার রাগটাই মুখ্য।

-“এতবড় ধোঁকা কিভাবে দিলেন?মিথ্যে কেনো বললেন আমাকে?আমি বিয়ে করবো না।আপনাকে রিজেক্ট করলাম!”

-“উহু! এসেছি যখন নিজের করে নিয়ে যাবো।”

বিপরীতে কোনো উত্তর দিতে পারলো না খুশবু।আফতাব এর দৃষ্টি শীতল হয়। মুগ্ধতার ছড়াছড়ি এই নেত্রে।পকেটে হাত গুঁজে এক ধ্যানে চেয়ে আছে।ভিন্নতা দু নয়নে।ব্যাকুলতা স্পষ্ট।যা হুট করেই অস্থির করে তুললো।ভুলতে বসেছিলো তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে এসেছে।হলে হতেও পারে আফতাব তার হবু স্বামী।

-“আপনার দেখানো পথে চলেছি।মনে করে দেখেন আপনিও ঠিক এই কাজটা করতে চাইছিলেন আমার সাথে।”

নিজের কাছেই ধরা খেয়ে গেলো।এবার বুঝতে পারছে আফতাব এর কেমন অনুভূত হচ্ছিলো।চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আফতাব দুয়েক কদম এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।কাছ থেকে দেখতে চায় পুরো খুশবুকে।বারবার চোখের পলক ফেলছে।লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাতে শুরু করলো।দেহ ভঙ্গিমা সেটাই বলছে।

-“আপনার শহরে আসব বলে পথে নামি।
প্রতিটি মাইল পেরিয়ে যে ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম তার চেয়ে দ্বিগুণ পেয়েছি।আপনাকে ভীষণ রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে।”

আরো একটুখানি ঘাড় নত হয় খুশবুর।কই রাগ দেখিয়ে ঝাঁঝালো দুটো কথা শোনাবে? তা না উল্টো লজ্জায় নেতিয়ে পড়ছে।এতদিন ছিলো না এই লজ্জাটা। আফতাবতো এমনই ছিলো শুরু থেকে।তবে কেনো এই ক্ষণে খুশবুর মধ্যে বৈচিত্র্য?হৃদয়ের স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতিও।

-“কষ্ট পেয়েছিলেন?”

খুশবু মাথা দোলায়।না বোধক উত্তর দেয়।আফতাব ফের প্রশ্ন করলো,

-“মুখ ফোলা ছিলো কেনো?বিষন্নতার ছাপ ছিলো কেনো?”

কোনো বাকবিতন্ড ছাড়াই খুশবুর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো,

-“আমি ভেবেছিলাম আবারো….”

-“আবারো আপনার সাথে অন্যায় হবে?অতীতের কিছু রিপিট হবে?”

খুশবুর অর্ধেক বাক্য পূর্ণ করলো আফতাব।অবাক হয়ে খুশবু।খুব সহজেই বুঝে ফেললো না?কি অবলীলায় ধরে ফেললো মনের কথা।

-“আমার বাবার বন্ধুর মেয়েটাও কিন্তু খারাপ ছিলো না।”

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতে আর কি প্রয়োজন?কটমট করে চায় খুশবু।কিসের লজ্জা?কিসের কি?অথচ আফতাব নির্লজ্জের মতো হাসছে।নাক ফুলিয়ে বলতে লাগলো,

-“তাহলে কষ্ট করে পাঁচ ছয় ঘন্টা জার্নি করে ঢাকা কেনো আসলেন?ঘরের কাছে মেয়ে থাকতে আমার কাছে কেনো এসেছেন?”

-“কাছে?আমিতো আপনার থেকে অন্তত এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে”

মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো খুশবু।আফতাব লজ্জা দেওয়া আর জ্বালাতন করার উদ্দেশ্যে বললো,

-“আমার ডিকশনারিতে কাছে বলতে নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাসের সংঘর্ষকে বোঝায়”

এমনেতেই নিজের অনুভূতিগুলো সামাল দিতে পারছে না খুশবু।কখনো ভয়,কখনো চিন্তা,পাশাপাশি অস্থিরতা,রাগ, নিজস্ব লজ্জাতো আছেই।তার মধ্যে নতুন পন্থা অবলম্বন করছে আফতাব। লজ্জাহীনভাবে লজ্জা দিয়ে দিলো।একটু পরে না খুশবুর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

-“মানুষের মুখে শুনেছি সেনা সদস্যরা নিজের স্ত্রীদেরকে অনেক ভালোবাসে।আমার প্র্যাকটিক্যালি প্রমাণ দরকার।মুখের কথায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়না।আপনাকে বিয়েটা করে নেই তাহলে?আপনার মধ্যে স্ত্রী হওয়ার সর্ব গুণ আছে।এইযে নির্ভয়ে একজন আর্মি অফিসারকে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন, শাসাচ্ছেন,চোখ দেখাচ্ছেন।এগুলো সবই বউদের গুণ”

এবারও কোনো জবাব দিলো না খুশবু।চুপসে রইলো। শব্দগুলো গলায় আটকে আটকে যাচ্ছে।মাথার কাপড়টা ফসকে পড়েছে নিচে।আফতাব হাত বাড়িয়ে মাথায় টেনে দিলো আবারো।গভীর নিচু কণ্ঠে খুশবুর দিকে চেয়ে বললো,

“লজ্জা যদি নারীর ভূষণ হয়?তাহলে ধৈর্য পুরুষের মাথার মুকুট”

চলবে…