তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৪

0
169

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৪
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

-“আপনারা যদি সম্মতি দেন আমরা এগোতে চাচ্ছি নতুন সম্পর্কে।আর যদি সময় চান সেটায়ও কোনো সমস্যা নেই।আমার ছেলের সম্পর্কে যা জানার জেনে নিন।মেয়ে দিবেন।খুব বিশাল একটা ব্যাপার। যাচাই বাছাই অবশ্যই দরকার আছে।”

রফিকুজ্জামান বললেন লোকমান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে।মেয়েকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।জিতুর কাছ থেকে আগেই খবর নেওয়া হয়েছে।খারাপ কিছুই জানা যায়নি আফতাব এর বিষয়ে।মেয়ের বাবা হিসেবে যতটুকু সন্তুষ্টি দরকার ঠিক ততটুকু পেয়েছেন।সংকোচ শুধু এক জায়গায় রয়ে যায়।আর্মি, পুলিশরা দায়িত্বের কাছে হেরে যায়।

লোকমান চৌধুরী জবাব দিলেন,

-“আফতাব আর খুশবু হ্যাঁ বললে আমার আর আমার পরিবারের কোনো আপত্তি নেই ভাইজান”

রফিকুজ্জামান মির্জা জবাব দিলেন,

– “আমার ছেলের সম্মতি আছে। খুশবু রাজি হলে আমরা আর বেশি দেরি করবো না।আপনারা আলাদাভাবে কথা বলে নিন নাহয়?”

লোকমান চৌধুরী মাথা নাড়লেন।আফতাব এবং খুশবু চলে এসেছে।সবকিছু কেমন যেনো দ্রুত দ্রুত মনে হচ্ছে।যদিও ভিন্নমত নেই।ফাহাদ আর লোকমান চৌধুরী উঠে গেলেন খুশবুকে নিয়ে।নায়লা বেগম এবং জরিনা বেগম মেহমানদের রাতের খাবার পরিবেশন করছেন।

ফাহাদ ঘরে এসেই বোনের দিকে আপাত দৃষ্টিতে চায়।কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে?সারা জীবন শাকচুন্নি বলে ডেকে আসা মেয়েটাকে তার চোখে সুন্দর লাগছে?ভাইয়ের ভালোবাসা জেগে উঠলো নাতো?ফাহাদ লোকমান চৌধুরীর দিকে চেয়ে বলল,

-“বাবা আমি খুশবুর সাথে কথা বলি?….তুমি নাহয় মেহমানদের দেখো।”

এসেছিলেন মেয়ের সর্বশেষ মতামত জানতে।ছেলের দিকে একবার চাইলেন।বুঝতে পারলেন ভাইয়ের কাছে যা বলবে সেটা বাবার সামনে নাও বলতে পারে। সংকোচ করতে পারে হ্যাঁ না বলতে।ফাহাদের কথামত এসেও বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

খুশবু নিজের আগের রূপে ফিরে এসেছে। মাথা থেকে কাপড় ফেলে দিলো।দুহাত পেছনে বিছানায় ঠেকিয়ে বসেছে বিছানায়।বললো,

-“ফর্মালিটি করো না।কি বলবে দ্রুত বলো?”

ফাহাদের বোন ভাইয়ের ভালোবাসা যতটুকু এসেছিল সব হাওয়া হয়ে গেলো?এই মেয়ের জন্য আদর মায়া দেখাবে?বাবা আর বাকিদের সামনে ইদুরের বাচ্চার মতন থাকে।এখন হয়ে উঠেছে বাঘিনী।

-“বিয়ে হতে চলেছে তোর।নিজেকে একটু পরিপাটি কর।আর কত অগোছালো থাকবি?”

দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে খুশবু জবাব দিলো,

-“চৌধুরী সাহেব?খুশবু চৌধুরী এমনি এলোমেলো থাকবে।যে পরিপাটি করতে আসবে তাকেও এলোমেলো করে দেবে।আর বিয়ে? দ্যাটস নট এ বিগ ডিল।সবাই করে।তুমিও করবে একদিন”

কপাল কুঁচকায় ফাহাদ। ত্বরিত উত্তর দিলো,

– “নির্লজ্জ কোথাকার!এখন বল বিয়েতে রাজি কিনা তুই?”

-“হ্যাঁ রাজি তবে একটা শর্ত আছে।”

রাজি তবে শর্ত আছে।দুটো দু রকম কথা।দুরকম চিন্তা।ফাহাদ কোমরে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চায়,

-“কি শর্ত?… দেখ উল্টো পাল্টা কোনো কথা বলবি না।”

-“কোনো উল্টো পাল্টা কথা না।তোমার আর বাবার টাকা বাঁচানোর প্ল্যান করেছি।শুনবে?”

-“জ্বি ম্যাডাম শুনান।উদ্ধার করুন আমার কান-কে”

মুখো ভঙ্গি অদ্ভুত করে খুশবু বললো,

-“আমার এই জমকালো আয়োজন পছন্দ না।ভারী কাপড়, গয়না।আর সবচেয়ে বড় কথা একগাদা মানুষের হাউকাউ,জাস্ট অসহ্য! আমি একদম সাদামাটা বিয়ে করবো।একটা শাড়ি পড়বো কবুল বলবো।শেষ!”

-“হ্যাঁ বললেই হলো!ছেলের ফ্যামিলি মানবে?”

-“সেই দায়িত্ব তোমার।”

বলে আলগোছে ঠোঁট টিপে হাসলো।সে আফতাবকে আগেই জানিয়েছে।কোনো ঝামেলা যেনো না হয় বিয়েতে।হুমকি দিয়েছে।তাকে মিথ্যে বলার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আফতাব মানতে বাধ্য।

খাবার টেবিলে খুশবুকে ডেকেছেন রফিকুজ্জামান।সবাই একসাথে বসে খাওয়া দাওয়ার পর্ব মেটাবেন।খুশবু আবারো লাজুক রূপে।আফতাব এর পাশে বসানো হয় তাকে।খুশবু পড়লো মহাবিপদে।খাবার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়ার জিনিস।এত এত গুরুজন এর মধ্যে বসে মনমতো খাওয়া যায়? শাড়ির কারণে চেয়ারে দু পা ভাঁজ করে বসার উপায়টাও নেই।না দিয়েছেন প্লেটে একগাদা খাবার।এগুলো না খেয়ে উঠা যাবে না।মাথার কাপড়টাও স্থির নেই।ফসকে পড়ছে বারবার।জ্বালা আর জ্বালা!আফতাব এর দেহ থেকে পারফিউম এর ঘ্রাণ ভেসে আসছে।ঠিক পাশাপাশি কয়েক ইঞ্চি দুরত্বে বসা।নিজের ঘাড়কে কোনরকম কন্ট্রোল করে রাখলো।ভুল করেও যেনো ডান দিকে না ঘুরে।

রফিকুজ্জামান বললেন, -“আপনারা যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতাম।”

লোকমান সাহেব সম্মতি জানান তৎক্ষনাৎ।বলেন,

-“জ্বি অবশ্যই।”

-“আপনারা জানেন আমার ছেলে ছুটি পায় খুব কম।যেহেতু আমরা সকলেই চাচ্ছি বিয়েটা সাদামাটা ভাবে হোক তাহলে আগামীকাল শুক্রবার।শুভ কাজটা সেরে ফেললে কেমন হয়?”

________

আত্মাটা আর নিজের জায়গায় নেই। উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক মৌমাছির মতন।খুশবু এক ধ্যানে ফ্যানের দিকে চেয়ে রয়ে মনে মনে একই প্রশ্ন আওড়াচ্ছে, ‘এ্যাহ্! এত দ্রুততো বিয়ে চাইনি।কি থেকে কি হয়ে গেলো’। ভেবেছিলো কয়েকদিন সময় পাবে।নিজেকে মানিয়ে নিবে পরিস্থিতির সাথে।সেই সুযোগ কোথায়? ক্যাপ্টেন আর তার পরিবারের বেশ তাড়া।তার কাজ নিয়ে যত ঝামেলা?এর মানে কি আজই খুশবুর শেষ দিন এই বাড়িতে?কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো! জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক চায়।মাকে দেখেছে মুখ গোমড়া করে থাকতে।বাবা ভাই ব্যস্ততায় ঘিরে গেছে।জরিনা বেগম কাছের আত্মীয়দের ফোন করতে ব্যস্ত।

চিন্তা আরো বাড়াতে ফোন বাজে। আফতাবরা হোটেলে পৌঁছে গেছে।ফোন করেছে সে-ই।

-“খুশবু?”

কোনো হায় হ্যালো ছাড়াই খুশবু বলে উঠলো,

-“সবকিছু অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?আমার ভয় করছে।”

-“আপনি ভয় পান?”

গলা ভিজিয়ে খুশবু বললো,

– “চিন্তা হচ্ছে সাথে নার্ভাসনেস।অনবরত ঘামছি।”

-“প্রতিটা অনুভূতিকে পজিটিভলি নেওয়া যায় না?এই ভয়কে ভয় না পেয়ে উপভোগ করতেও পারেন।এটা আমাকে পাওয়ার অস্থিরতা,আমার জীবনে জুড়ে নিজের নতুন জীবনকে আপন করে নেওয়ার চঞ্চলতা।”

ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো খুশবু। কারণ তার আফতাব এর বলা বাক্যসমূহ নয় বরং তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ, অতি মাত্রায় প্রগাঢ় কন্ঠস্বর।এত পরিবর্তন ধরলো কি করে কে জানে?সমক্ষ অন্তরে গিয়ে আঘাত হানছে।প্রেমে পড়ার মহুর্তের মধ্য দিয়ে আগেও যাওয়া হয়েছে।সেটা অনেক ভিন্ন ছিলো।বিবাহে পবিত্রতা আছে।এই কারণে বুঝি অস্থিরতম অনুভুতিরা দ্বিগুণ?

-“কিছু কথা বলতে ফোন করেছিলাম”

অস্পষ্ট স্বরে খুশবু বললো,- “হুম?”

স্বরের গভীরতা কমে ঐকান্তিক হয়ে উঠে,

-“কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমার হতে চলেছেন।আমার মনে হয় কথাগুলো বলা উচিত।”

-“শুনছি”

-“আপনার অনুভুতিগুলো আমার জন্য এখনও পরিপক্ক নয়।আমি সেটা জানি এবং বুঝি।কিন্তু এতে আমার কোনো খেদ নেই।”

খুশবু নিজের হয়ে ঝটপট উত্তর দিলো,

-“হয়তো আমার অনুভূতিগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে?হয়তো ধীরেধীরে বৃদ্ধি পাবে।”

-“বুঝদার হচ্ছেন কিন্তু!”

বলে হেসে ফেলে আফতাব। খুশবু আর কোনো জবাব দিলো না।আবার নির্বিকার রূপে ফিরে গেলো।নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলেছে।ব্যাস!এবার মুখে তালা আটলো।

-“সম্পর্কে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয় খুশবু। স্যাক্রিফাইস করা মানেই হেরে যাওয়া না।আমার কাজের ক্ষেত্রে প্রায় আমাদের মধ্যে দূরত্ব থাকবে।তবে এই দূরত্ব যেনো ভালোবাসা না কমায় এক বিন্দু।অপেক্ষার যন্ত্রণা আর খাঁটি করবে বন্ধন। বউ রূপে আমি আপনাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবো না।সেটা আপনাআপনি হয়ে যাবেন আপনি।তবে পুরোটা পরিবর্তন হবেন না খুশবু।আপনার বাচ্চামো,আপনার রাগ,আপনার অভিমান সবটা আমার জন্য জমা রাখবেন।সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেন।আমার আর আমার পরিবারের দিক থেকে।পড়ালেখা করতে চান?করুন।চাকরি করতে চান?করতে পারবেন কোনো সমস্যা নেই।আপনার ঘর আপনার বাড়ি যা ইচ্ছে করবেন।শুধু বলবো আমার কাছে একান্তে নিজেকে অগোছালো রূপে উপস্থাপন করলেও বাহিরে নিজেকে গোছানো দেখাবেন।হাজার মানুষ হাজার মুখ আর সেই মুখে হাজার কথা।আপনাকে কেউ কোনো কটু কথা বলবে আমি সহ্য করবো না।আর যদি আপনার বিনা দোষে বলে?আমি আছি ডিফেন্ড করার জন্য। নিশ্চিত থাকুন।আমার বাবা মায়ের কোনো মেয়ে নেই।মেয়েরা নাকি মায়ের মতন যত্ন করে?আপনি আপনার বাবা মায়ের সাথে যেমন তেমন থাকতে পারবেন আমার বাবা মায়ের সাথে?একটুও মনে করবেন না তারা আপনার শ্বশুর শ্বাশুরি।”

-“তারা আমাকে মেয়ে ভাবলে আমি অবশ্যই…..”

-“সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না।আমার বাবা আর আপনার বাবাকে একসঙ্গে একই পাল্লায় মেপেছি।দুজনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখতে পাইনি।আপনার মা বুঝি একটু রাগী?আমার মাও মোটামুটি রাগী।মায়েরা যেমন হয় আরকি।ব্যাস!”

-“হুম”

-“স্বার্থপরের মতন নিজের কথাগুলোতো বললাম।আপনার দিকটা চিন্তা করছি না কেনো জানেন?”

-“কারণ আপনাকে পুরোটাই আমি নিজে সামলাবো।কিছুটা আপনার মত করে।কিছুটা আমার মতন করে”

কথাগুলো হিমশীতল হাওয়ার মতন। কোথাও আকুলতা, কোথাও অস্থিরতা আবার কোথাও স্পষ্টবাদীতা ছোঁয়া। অতটা অবুঝ নয় খুশবু।মাঝেমধ্যে জেদের বশে ভুলভাল কান্ড ঘটিয়ে ফেলে।সেই ভুলভাল কান্ডে তেমন ক্ষতি কারোই হয়নি।প্রভাব ফেলতে পারেনা তেমন। একঘেঁয়েমি জীবন।এই জীবনে বন্ধু আছে তবে কাছের নয়।পরিবারের মানুষ ছাড়া বাহিরের জগতের প্রতি কোনো আগ্রহ নেয় খুশবুর।

আকস্মিক কর্ণপাত হলো একটি প্রশ্ন,

-“ভালোবাসেন?একটু?এক বিন্দু?”

খুশবু মুচকি হেসে জবাব দিলো,

– “বাসি না।একটুও না।এক বিন্দুও না”

-“বিয়েটা ক্যানসেল করে নেই।নিজের শহরে ফিরে গিয়ে বাবার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করে নিবো”

-“হতে পারেন আপনি সবার চোখে সেনাবাহিনীর সম্মানীয় একজন সদস্য।আমার চোখে সবসময় সাধারণ একজন মানুষ থাকবেন।আপনার রাইফেল নিয়ে আপনার খুলিটা উড়িয়ে দিবো।রাখছি”

-“আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।বিয়েটা হোক!”

___________

মহেন্দ্রক্ষণ বলেই সম্বোধন করা যায় এই সময়টাকে।সকাল সকাল শাড়ি এসেছে আফতাবদের তরফ থেকে।রুমানা মির্জা নিয়ে এসেছেন পুত্রবধূর জন্যে।সাথে কিছু গহনা। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া ঢাকা আসায় মনমতো কিছুই করতে পারছেন না।জানিয়েছেন সিলেট গেলে অন্তত রিসেপশনটা করবেন।এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে কে জানতো?লোকমান সাহেব এর মুখটা ভার হয়ে আছে সকাল থেকেই। খুশবুর চাচাতো বোন এসে বসলো হাতে মেহেদী দিতে।মেয়েটাকে তেমন একটা পছন্দ নয় খুশবুর। গায়ে পড়া স্বভাব আছে। খুশবুর মামীর মন ভীষণ খারাপ।জিতুর সাথে কেনো আসলো না এই নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন।বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলো না।

খুশবুর চাচাতো বোন নীলা বলে উঠলো,- “এই জিজু দেখতে কেমন রে?”

এসব ঢঙ্গি ডাকে মেজাজ বিগড়ে যায় খুশবুর।কপাল কুঁচকে বললো,

-“ভাইয়া অথবা দুলাভাই ডাক।জিজু কি হ্যাঁ?”

-“এটা আজকালের ট্রেন্ডি ডাক।”

-“ট্রেন্ড ফলো করতে হবেনা এত”

নীলা হাসলো।বললো, -“মোটা অংকের টাকা ছাড়া ঘরে আসতে দেওয়া হবেনা বলে দিলাম।আমি জিজুকে খাইয়ে দিবো।হাত ধুইয়ে দিবো।”

খুশবু ফোস করে উঠে।নাক ফোলাতে ফোলাতে মনে মনে বললো,

-“আর তোর মাথায় হাঁড়ি ভাঙবো আমি।”

নীলা মেহেদী দিতে দিতে খুশবুর পানে চেয়ে বললো, -“কিছু বললি?”

-“নাহ! কিন্তু ওসব করতে যাবি না।ওরা আদিখ্যেতা পছন্দ করেনা।ওনার বাবা খুব রাগী।সাথে উনিও রাগী।তুই কি চাস ভরা মজলিশে তোকে তুলে আছাড় দিক?”

এইদিকটা সামলে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে হাজির হলো হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে।কেমন যেনো লজ্জা লজ্জা লাগছে।আবার ইচ্ছে হচ্ছে অনুভুতি প্রকাশ করতে।তারা কাজে ব্যস্ত।নায়লা বেগম খুশবুর পাসপোর্ট বের করছেন। ডোমেস্টিক ফ্লাইটে যাবে তারা।রফিকুজ্জামান মির্জা আর রুমানা মির্জা চান না নতুন বউকে জার্নি করাতে।বাবা ব্যস্ত ফোন কথা বলতে।তবে একেকজনের মুখ দেখার মতন নয়।নেতিয়ে থাকা ফুলের মতোন অবস্থা।নিজের সমস্ত অসস্তি দূরে ঠেলে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়লো।ঠোঁট কামড়ে জড়িয়ে ধরলো দুজনকে।কেউ কোনো কথা বলেনি।শাসনে বড় হয়েছে বলে কি ভালোবাসা নেই নাকি?নায়লা বেগমের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে কয়েকফোঁটা।লোকমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন।বুঝানোর ভঙ্গিতে অনেক বুঝ দিলেন।সাবধান করলেন দুজনে।খুশবু কাঁদেনি।নিঃশ্বাস রুখে কান্না দমিয়ে রেখেছে।সর্বশেষ বললো,

-“আমি খুশি।তোমরা কেনো মন খারাপ করছো বলো?এভাবে কাঁদলে আমি গিয়েও শান্তি পাবো না।”

তার ছোট্ট মেয়ের বুঝদার এর মতন কথা শুনে দুজনেই হাসেন।আড়ালে ছিলো ফাহাদ।শুনছে,দেখছে।ভেতরে আসেনি।তবে তার ঝগড়ার সঙ্গী শেষমেশ বিদায় হচ্ছে।খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করবে না।হাত পা খামচে দিবে না অহেতুক।বিরক্ত করবে না।মাঝেমধ্যে আসবে।মেহমান হয়ে।হয়তো অনেকটা বদলে যাবে।আগের মত কিছুই থাকবে না।

______

লোকে বলে শ্যামলা মানুষকে সাদা রঙে মানায় না। আফতাব সেই উক্তি যুক্তি সবটাই যেনো ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। মায়ময় মুখ তার।ছোটছোট চুল। দাড়ি আছে অত্যন্ত অল্প।সাদা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে নিজের বধূকে নিতে। খুশবু পাশাপাশি বসে।মাথায় মায়ের বিয়ের ওড়না।আর পরনে শ্বাশুড়ি মায়ের দেওয়া শাড়ি। লজ্জিত-স্তম্ভিত। আড়চোখে আফতাবকে দেখতে একেবারেই ভুল করেনি।ভেতরটা কেমন যেনো অস্থিরতায় ভরে উঠলো।বুক কাপছে দুরুদুরু।বিয়েটা হচ্ছে অবশেষে না? বখাটে লোকটার সাথে।যে বলেছে সত্য বলেছে এই পৃথিবীতে মানুষের সাথে দেখা কোনো না কোনো কারণে হয়।নাহয় কেনো যেতো সাদা পাথর?কেনো বুকে ধাক্কা দেওয়ার মতো উদ্ভট কান্ড ঘটাতো? কেনোই বা নিজের আইডি কার্ডটা ফেলে আসতো?পাহাড়ের শহরে টেনে নিয়ে ভাগ্য কাগজে কলমে মিলন লিখেছে।পূর্বের খারাপ কিছুই মনে পড়লো না আর খুশবুর।অশ্রু ঝড়িয়ে ‘ কবুল’ বলে আফতাবকে পুরোটাই কবুল করে নেয়।আফতাব অন্তরের চাপা উচ্ছ্বাস অপ্রকাশিত রেখে ক্যামেলিয়া ফুলকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নিলো।

বিয়ে শেষে সবাই একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে থাকলে আফতাব সাবধানে খুশবুর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো একটা শব্দ,

-“আমার”

খুশবু এলোমেলো নিঃশ্বাস ফেলে। কান্নাগুলো গলায় আটকে আসছে।কাঁপুনি দিয়ে উঠলো সর্বাঙ্গ নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায়।আড়চোখে চাওয়ার সুযোগ সাহস কিছুই নেই এবার।জড়সড় হয়ে বসে রইলো একেবারে।

নাক লাল করে ফেলেছে খুশবু। কাঁদবে না বলে কেঁদেই যাচ্ছে।কতবার চাইলো আফতাব মেয়েটার কান্না থামাতে।ইশারা করলো।সে ইশারা বুঝলে না?এবার মেয়ের বিদায়ের পালা। একাই যাচ্ছে তারা।জিতু থেকে যাবেন কিছুদিন ঢাকায়।শক্ত মুখে আর্তনাদ চেপে মেয়েকে বিদায় দিয়েছেন লোকমান চৌধুরী এবং নায়লা বেগম। ফাহাদ এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিতে গেছে তাদেরকে।একবারে চলে যাওয়ার পূর্বে বোনকে জড়িয়ে ধরলো আলতো করে।

আফতাব আর তার বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে মিনমিনে গলায় বললো,

-“একটু অবুঝ।ভুল করলে ক্ষমা করে দেবেন।”

রফিকুজ্জামান ফাহাদের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন,

– “ঘরের মেয়েরা একটু আহ্লাদী আর একটু অবুঝ হয়।সেটা ব্যাপার না। বউ নয় মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি।তুমি চিন্তা করো না ইয়াং ম্যান!”

খুশবুর ঠোঁট কাপছে।ফাহাদ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।তবে কাদলো না।আধ ঘন্টার মাঝেই ফ্লাইটে চেপেছে খুশবু আফতাব আর তার বাবা মা।আগে পরের সিট।রুমানা মির্জা এবং রফিকুজ্জামান মির্জা সামনের সিটে বসেছেন। আফতাব খুশবু পেছনে।বিমানের জানালা দিয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে খুশবু বাহিরে চেয়ে রইলো।একটু পরই টেক অফ করবে।আফতাব এর সরু দৃষ্টি মন খারাপ করে বসে থাকা খুশবু অর্থাৎ তার স্ত্রীর দিকে।এতটাই মন খারাপে মগ্ন সে সদ্য স্বামীর দিকে কোনো খেয়াল নেই।

হাতের কব্জি বেয়ে বলিষ্ঠ পাঁচ আঙ্গুল খুশবুর হাতে এসে ঠেকেছে। ধীরেধীরে প্রতিটি আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে হাতটা নিজের জায়গা করে নিলো। শীতল হাতের স্পর্শ।খুশবু এক ধ্যানে চেয়ে রইলো হাতটার দিকে।কি সুন্দর আঁকড়ে রয়েছে?হাত ধরাটাও এত সুন্দর হয় বুঝি?এত অনুভূতির দোলা দেয়? মিলিত দুটো ভিন্ন হাতের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কানের কাছে আবারো ভারী নিঃশ্বাস পড়লো।

-“ঠিক কতটা ভালোবাসলে নিজেকে জাহানের সবচেয়ে সুখী নারী হিসেবে মেনে নিবেন?”

চলবে….