তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৫

0
52

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৫
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

কাঁধে যখন নির্ভয়ে মাথা রাখলো ঠিক তখন মনে সর্ব সুখের আভাস হয়।স্বল্প সময়ের প্রণয়,পরিণয়। অনুভূতি সীমাহীন।বুক কেঁপে উঠে পহেলা স্পর্শে।নরম ফোলা গালে স্পর্শ লেগেছে এলোমেলো কেশমালা সরাতে গিয়ে।শ্যামলা পৃষ্ঠে শহুরে আলো পড়েছে।বুঝলো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রা শেষ।পাহাড়ের শহরে হাজির। গিয়েছিলো একা,দোকা হয়ে ফিরেছে।এই নগরে এসে গর্ববোধ হচ্ছে।নিয়ে ফিরেছে তাকে যাকে এইতো কিছুদিন আগে মনে জায়গা দিয়েছিলো। একেবারের জন্য,সবসময়;সারাজীবনের জন্য।

আরো আধ ঘন্টার রাস্তা পাড় করে বাড়ি ফিরে আফতাবরা।খুশবু গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।রুমানা মির্জা একেবারে বাড়ি ফিরেই ডাকতে বলেছেন।রফিকুজ্জামান মির্জা এবং রুমানা মির্জা বেরিয়ে গেলেন।আফতাব গালে হাত ফেরিয়ে নরম গলায় ডাকে,

-“আপনার বাড়ি এসে গেছে”

গায়ে কয়েকবার ঝাঁকুনি পড়ে।চোখ বোজা এবং ভ্রুদ্বয় উচুঁ করে খুশবু মৃদু আওয়াজ করলো,

-“হুম?”

-“বাড়ি এসে গেছি”

কথাটা এবার স্পষ্ট কর্ণপাত হয়। তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে খুশবু। হন্তদন্ত হয়ে মাথায় কাপড় টানলো।এদিক ওদিক চাইতে লাগলো ঘাড় ঘুরিয়ে।এসে গেছে এই বিষয়টা এখনও পুরোপুরি মস্তিষ্কে ধারণ হয়নি।

আফতাব বেরোয়।দরজা ধরে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে হাত এগিয়ে দিলো।বললো,

-“আসুন”

দ্বিধাহীন চিত্তে হাত ধরেছে।শক্ত করে।যাওয়ার পথে উঁকি দিয়ে নানী বাড়িটাও দেখে নিলো। আধাঁর সেখানে।আফতাব হাসে।আর বলে,

-“সেখানে কেউ নেই এখন।”

মুখটা মিয়ে গেলো খুশবুর।মামী তার বাবা বাড়িতে আর জিতু মামা,নানী ঢাকায়।টুকটুক করে হেঁটে প্রবেশ করে নিজের নতুন ঘরে,নতুন পরিবারে।রুমানা মির্জা দাঁড়িয়ে আছেন সাথেই রফিকুজ্জামান মির্জা পেছনে দুহাত বেঁধে।ঢুলুঢুলু হয়ে হেঁটে আসা খুশবু নিজেকে সামলায়।লজ্জায় হাতটা ছেড়ে দিলো।ভালো দেখায় নাকি শ্বশুর শ্বাশুরির সামনে এভাবে হাতে হাত রেখে আসা? খুশবুকে দেখে দুজনই অমায়িক হাসেন।তাদের পেছনেই একটি মধ্যবয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে।হয়তো এবাড়িতেই থাকেন।

রুমানা মির্জা বললেন,

– “এসো মা।ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নাও।কত ধকল গেলো আজ আবার জার্নি।”

খুশবু মাথা দোলায়।পাশ থেকে রিতা খালা বলে উঠলেন,

-“এই নতুন বউ? মেলা সুন্দর ছোট সাহেব।একদম পুতুলের মতন আপনার লগে মানাইছে।”

আফতাবসহ বাকিরা খানিক হাসে।হাসতে পারলো না খুশবু।প্রশংসার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দিতে জানে না সে।থতমত খেয়ে যায়।তার মাঝে অপরিচিত মানুষ।অপরিচিত জায়গা।

আফতাব এর হাত ধরে এসেছে তার পিছু পিছু যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। রুমানা মির্জা ছেলেকে বললেন খুশবুকে নিয়ে ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে।নিজেকে রোবট মনে হলো খুশবুর।কখনো এর পিছনে কখনো ওর পেছনে।মাথা চলছে না।এখন ক্যাপ্টেন সাহেবের ঘর দেখার পালা।আফতাব দরজা খুলে বললো,

-“আসুন আপনার চিরস্থায়ী কামরায় কদম রেখে সুবাসিত করুন।”

খুশবু বলে উঠলো,

-“আপনার মনে হয়না আপনি অনেক ফিল্মি?”

-“আসলেই?কই আমার তো মনে হয়না।”

-“আমার মনে হয়।”

বলে ঘরে ঢুকে গেলো খুশবু। আফতাবকে পেছনে ফেলে।আফতাব কিছুটা বিষম খায়।খুশবু ঠিক ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছে।ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণ করলো পুরো ঘরটা।আর আফতাব খুশবুকে।

কিছু সময় বাদে আফতাব বললো,

– “লজ্জার কোনো লক্ষণ দেখছি না যে আপনার মাঝে?”

খুশবু কপাল কুঁচকে তাকায়।বলে,

-“বিয়ে হয়েছে এখন থেকে এই ঘরেই থাকতে হবে। আই নো দ্যাট। লজ্জার কি আছে?”

খুশবুর সরাসরি বাক্য শুনে ভ্রু উঁচু করে চাইলো।লজ্জা পায় না?একেবারেই পায় না?সেটা পরীক্ষা করার জন্যই মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো আফতাব। দৃষ্টি বিনিময় হয়।নরম গালে হাত রেখে শীতল চাহনী ছুঁড়ে আফতাব। ত্বরিত কপালে অধর ছোঁয়ালো।খুশবু চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে।নিঃশ্বাস আটকে রাখার একটা বাজে স্বভাব।এবারও হলো তাই।এখনও ললাটে ঠোঁটজোড়া অবস্থানরত।অনুভব করলো নতুন অনুভূতি।অস্থিরতা আর প্রগাঢ় ভালোবাসা মিশ্রিত।

-“এবার?”

এক ঝটকায় সরে গেলো খুশবু।পেছনে সরে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-“ওয়াশরুম কোথায়?আমি ফ্রেশ হবো”

লজ্জা পরীক্ষায় পাশ করেছে খুশবু।মৃদু শব্দ করে হেসে ওয়াশরুম দেখিয়ে দেয়।নিজে থেকে লাগেজ তুলে একটি শাড়ি বের করে বললো,

-“শাড়িই পড়তে হবে তেমন কোনো কথা নেই।কিন্তু হ্যাঁ আমি যখন বাড়িতে ফিরবো আপনাকে যেনো শাড়ি পরিহিত দরজার দ্বারে পাই।”

মুখ লটকে খুশবু প্রশ্ন করে,

-“আর যখন থাকবেন না?আমার একা একা থাকতে হবে তখন?”

খুশবুর মাথায় হাত রেখে আফতাব বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,

– “আমার মা আছে।বাবা আছে। দু কদম হাঁটলে আপনার নানুমনি আছে মামা মামী আছে।”

খাবারের পর্ব চুকে দ্রুত।আজ ঠিকঠাকমত খাবার পেটে পড়েনি। বিয়েতো বিয়েই।আহামরি কি?এটা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বিয়ে করে ফেলা খুশবুর মাথায় তালগোল পাকিয়েছে কিছুটা।ঘরে এসে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে।বিয়ের আগে তার বিছানা তার রাজত্ব ছিলো।এখন?তাও আবার একটা পুরুষ মানুষ।যদিও এখন আফতাব অপরিচিত কেউ নয়।আফতাব ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজা বন্ধের আওয়াজে ভড়কে উঠে খুশবু।

তার ভীত মুখখানা দেখে আফতাব দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,

-“ভয় পেয়েছেন?”

-“হুম?…নাহ!”

খুশবুর দিকে চাইলো আফতাব। মুখশ্রী জুড়ে অস্বচ্ছন্দ্য তার ফুলের। জড়তা কাটাতে সময় লাগবে।আফতাব মুখ ঘুরিয়ে ওয়াল ঘড়ির দিকে চাইলো।কখন রাত্রির একটা বেজে গেছে হুশ নেই।খোলা জানালা বেয়ে হাওয়া এসে শুভ্র পর্দাকে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুশবুর দুহাত ধরে বলে উঠে,

-“নতুন জায়গায় খারাপ লাগছে?”

-“খারাপ…না মানে অপরিচিত জায়গা..তো”

-“পরিচিত জায়গায় যাবেন?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় খুশবু।এই মানুষটা কাছে থাকলে আবার অন্য রকম অস্থিরতা হানা দিতে লাগে।এখন প্রশ্নের উত্তর জানা মুখ্য।

-“কোথায়?”

চঞ্চল দেখালো আফতাবকে।দ্রুত জবাব দিলো,

-“এক মিনিট।আগে দেখে আসি আমার বাবা মা কি করে”

মিনিট খানেক বাদে ফিরে এলো আফতাব।ফের আঙুলের ভাঁজে হাত ঠেকিয়ে সাথে নিয়ে যেতে লাগলো। খুশবু কিছু বলতে চাইলে আফতাব ইশারা করে চুপ থাকতে।ঠোঁটে আঙুল রেখে ভারী আদেশ দিলো।নির্বিকার খুশবু আবারো আফতাব এর পিছু পিছু। হাঁটতে হাঁটতে এবার ঘরের বাহিরে এসেছে।গতি টিলার দিকে।এবার বোধগম্য হলো কোথায় যাওয়া হচ্ছে তাহলে।হাতে হাত রেখে কসরত করে উঠে দাঁড়ায় টিলায়।ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে খুশবু।তার মধ্যে দেখলো আফতাব এর অদ্ভুত কান্ড।কোনো শব্দ বাক্য ছাড়াই খোলা ঘাসে শুয়ে পড়লো।হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

-“আসুন”

চকিত চাহনি দিয়ে খুশবু বলে, -“এখানে?”

-“হ্যাঁ।আমার ডিউটি যখন বর্ডারে পড়ে তখন আমি প্রায় উচু পাহাড়ে এভাবে হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছি।যতবার সুযোগ পেয়েছি।এভাবে আকাশটাকে অনেক কাছে মনে হয় খুশবু।আসুন”

খুশবু পা গুটিয়ে বসলো।তবে তাকে বসতে বলা হয়নি। আকস্মিক হাত টেনে নেয় আফতাব।কিছুটা আফতাব এর দিকে ঘুরে বসে থাকা খুশবু থুবড়ে পড়েছে বুকে। নাকটা বোধহয় গেলো।আর লজ্জা!সে আকাশ পরিমাণ।মুখ তুলে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সাহস নেই। খুশবুকে দুহাতের সাহায্যে পুরোপুরি আঁকড়ে নিয়ে অনুভব করলো মেয়েটি কাপছে অনবরত।দেহ সংঘর্ষটা সহ্য করে উঠতে পারেনি।মুখ লুকিয়ে আছে।তীব্র ভালো লাগায় আবেশিত আফতাব এর হৃদয় ক্ষ্যান্ত হয়। চেয়েছিলো বউ রূপে সর্বপ্রথম জড়িয়ে ধরতে।সে কি আর মুরব্বীদের সামনে সম্ভব?ডান দিকে গুটিসুটি হয়ে থাকা খুশবুর মুখ তুলে প্রশ্ন করলো,

-“কাপছেন কেনো?”

জবাব এলো না।আসবে না জেনেও প্রশ্ন করেছে। খুশবুর ঘন নিঃশ্বাস বুকে এসে পড়ছে। অদ্ভুত রকমের শীতলতা দিচ্ছে।মাথার উপর সম্পূর্ণ খোলা অম্বর। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সুবিশাল শশাঙ্ক।

আফতাব বলে, -“এভাবে জড়ো হয়ে থেকে কত সুন্দর দৃশ্য মিস করছেন খুশবু জানেন?আকাশপানে চেয়ে দেখুন একবার।”

খুশবু ধীরে ধীরে মুখ তোলে।ঠিকঠাক হয়ে শোয়।আফতাব এর বাহুতে মাথা রাখা অবস্থায় চোখ তুলে আকাশপানে।তেমন কিছুইতো দেখতে পেলো না।আকাশের চিরচারিত দৃশ্য।আফতাব আবার বলে উঠে,

-“নরওয়েতে নর্দার্ন লাইটস দেখা যায়।আকাশ ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ নেয়।এক ধ্যানে চেয়ে থাকুন নিষ্পলক।চোখ ধাঁধিয়ে উঠবে মনে হবে বাংলাদেশে বসে নর্দান লাইটস দেখছেন।”

নিষ্পলক চাইলো খুশবু।একেবারে আকাশের গভীর অব্দি দেখার চেষ্টা করছে।প্রতিটি মেঘের বিশ্লেষণ করতে চাইছে।অন্যদিকে আকাশ দেখতে মগ্ন খুশবুকে দেখতে মগ্ন আফতাব।নিজেকে বিশ্বাস করানোর পালা। স্বপ্ন নয় এটা বাস্তব।এই জায়গা তাদের সম্পর্কের সম্পর্কের সূচনা।পরিচয় এখান থেকেই।একেক অপরের দর্শন।আজ নতুন রূপে,নতুন বন্ধনে।মায়া মায়া মুখটার দিকে চেয়ে হিমশীতল কণ্ঠে আপনাআপনি বলে উঠলো,

-“আমার সাদামাটা জীবনে জড়ানোর জন্য ধন্যবাদ”

বসন্তের বাতাসে সুগন্ধ লেপ্টে আছে এখানে।রাতের খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের বুকে সদ্য একে অপরের হয়ে যাওয়া কপোত কপোতী শুয়ে।প্রকৃতির এই রূপ যেন চেয়ে কম নয়।তারা ভরা আকাশে চাঁদের মিষ্টি আলো,প্রেমের মেলায় মিশে।শীতল এই রাত,
প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠে মধুর স্বপ্নের ঘাট।নীরবতার মাঝে হৃদয় মাঝারে কথা বলছে।
এই বসন্তের রঙে, মুগ্ধ এই প্রান্তর,
প্রকৃতির মায়ায় বেঁধে রাখে প্রেমের অন্তর।

লাজুক নত চোখগুলো দেখে আরো কত কাব্য রচনা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।তবে শব্দ মেলাতে পারলো না আফতাব।চাওয়ার সাথেসাথে পেয়ে যাওয়ার সুখ সামলে উঠতে পারছে না হৃদয়। দুহাতে আরো জড়িয়ে নিলো খুশবুকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“অতীতের সব ক্লেশ দুর হয়ে তেইশতম বসন্ত এক ঝাঁক সুখ এনে দিয়েছে।…আমার হৃদ বাগানে সদ্য প্রস্ফুটিত ক্যামেলিয়া ফুলকে ভালোবাসি।সে এই বাগের রানী।”

রাতের প্রহর গুনছে আফতাব।তার প্রণয়িনী বুকে মাথা রেখে আরামে ঘুমিয়ে।শক্ত জমিনে তার তেমন কিছুই আসে যায় না।বলিষ্ঠ বুকে মাথা ঠেকিয়ে তন্দ্রার রাজ্যে বিভোর।ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা চোখে মুখে ঝাপটে পড়লো।তাড়াহুড়ো শুরু করলো আফতাব।আর থাকা যাবে না এভাবে। খুশবুকে জাগানোর চেষ্টা করলো কয়েক দফা ডেকে।মেয়েটি নাছোড়বান্দা।উঠছে না কিছুতেই।উল্টো টি শার্ট খামচে ধরে মুখ কুচকে রইলো।আফতাব হাত ছাড়ায়। সাবধানতাসহিত পাঁজা কোলে তুলে নিলো খুশবুকে।ধীরে ধীরে পা এগিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়।

________

-“খুশবু আপুর বিয়ে হয়ে গেছে?”

ফাহাদ মলিন স্বরে জবাব দিলো, -“হুম”

আওয়াজের ধাঁচ ধরতে পেরেছে নেহা।বোনের বিয়েতে ব্যস্ত ছিলো তাই পাওয়া যায়নি।প্রশ্ন করলো,

-“আপনার মন খারাপ?”

মাত্র খুশবুর ঘর থেকে এলো।ভালো লাগছে না কিছুই।নিয়মগুলো কেনো মন মোতাবেক হয় না?সমাজের রীতি অনুযায়ী সব মেয়েকে চলে যেতে হয়। খাঁখাঁ করছে অন্তর।বোনটাকে বলা হলো না তার ভাইয়ের মন কত বিষন্ন তার বিদায়ে।বারান্দায় দেয়ালে পিঠ বসে আছে।এক হাত ঠেকানো পায়ের হাঁটুতে।অন্যহাতে ফোন।

মিথ্যে জবাব দিলো, -“না আমার মন ভালো”

-“জানেন আমার ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু স্বীকার করেনা।শুধু শুধু ঝগড়া করে।রাগ দেখায়।কিন্তু অনেকদিন পরপর যখন বাড়ি ফিরে আমাকেই খুঁজে সর্বপ্রথম।আপনিও খুশবু আপুকে মিস করছেন স্বীকার করছেন না।….মন খারাপ করে কি লাভ বলেন?আজকাল সোশাল মিডিয়া এর যুগ।যখন তখন ভিডিও কলে দেখে নিবেন।ঝগড়া করবেন নাহয়?মন খারাপ করে বসে থাকলে চলবে?”

বয়স বেশি না নেহার।ইন্টার পরীক্ষা দিবে সবে।তার উদ্দেশ্য ফাহাদকে বোঝানো।আর ভঙ্গি বাচ্চাদের ন্যায়।সে হয়তো ভুলে গেছে তাদের বয়সের ব্যবধান।এত বড় একটা ছেলেকে বোঝাচ্ছে।হাসলো ফাহাদ।ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,

-“কি দিন পড়লো!পুঁচকে একটা মেয়ে দামড়া একজন লোককে জ্ঞান দিচ্ছে।”

নাকটা ফেঁপে উঠলো নেহার।পুঁচকে মেয়ে বলছে তাকে?এই বয়সে নিজেদের ম্যাচিওর দাবি করা মেয়েগুলোর ন্যায় নেহা বলে উঠলো,

-“আপনি জানেন না মেয়েরা অল্প বয়সে বুঝদার হয়ে উঠে?”

নেহার গলার স্বরে তেজ স্পষ্ট।ফাহাদ অনেক সময় বাদে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। পা জোড়া সোজা করে জমিনে রেখেছে।আরেকটু আয়েশ করে বসলো।বললো,

-“একে বুঝদার নয় অকাল পক্ক বলে”

-“এভাবে বলবেন না।আমি যথেষ্ট ম্যাচিওর।”

-“আমিও তো সেটাই বললাম…. ম্যাচিওর অর্থ পরিণত,পরিপক্ক।”

-“অকাল পক্ক বলেছেন।”

ফাহাদ নেহাকে রাগানোর উদ্দেশ্যে আরো উদ্যত হয়।বলে,

-“বয়স কত মেয়ে তোমার?হবে সতেরো আঠারো এর কাছাকাছি।এই বয়সে ম্যাচিওরিটি দেখালে অকাল পক্ক বলবো নাতো কি বলবো?”

নেহা চোয়াল শক্ত করে।এরকম কথাবার্তা সহ্য হচ্ছে না। অষ্টাদশী কন্যার জেদ চাপছে।কেউ রাগিয়ে তুলছে জেনেও রেগে যায়।কিছুটা রাগী গলায় বললো,

-“ভালো!অকাল পক্কই ভালো।আজকাল মানুষের ভালো করতে নেই।রাখি”

এবারে শব্দ করে হাসে ফাহাদ। তীর তাহলে ঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে। খুশবু ব্যতীত অন্য কাউকে অযথা রাগিয়ে দিয়ে বেশ অনুভব করছে।রাখি বলেও ফোন কাটলো না।ফাহাদ বললো,

-“ফোন কাটো”

-“কাটছি”

-“আর শুনো জবাব পাইনি আমি।আজ ছাড় দিলাম।তবে একটা এডভাইস দিবো।”

-“কি এডভাইস?”

-“বয়সটা তোমার ভুল করার। যাই করবে বুঝে শুনে করবে।”

_________

স্নিগ্ধ প্রভাত শুভ্র আভা ছড়াতে শুরু করেছে।সূর্য ওঠে নীরবে হাসছে।প্রকৃতির মাঝে নতুনত্ব।পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ সরাসরি কানে এসে বারি খায়। বক্ষস্থলে কর্তৃত্ব বিস্তার করে আছে ক্যামেলিয়া ফুল।এই বাগান তার।মালকিন সে এখানকার।সকাল সকাল জেগে উঠার অভ্যেস আফতাব এর।এটাও জানে সেই অভ্যাসটা খুশবু রানীর নেই।সে শ্রমবিমুখ, আরামপ্রিয়। ধীরেধীরে চোখ খুলে চায় আফতাব।সরাসরি দৃষ্টি গেলো ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা খুশবুর পানে।চুলগুলো মুখের কাছে এসে বিরক্ত করছে।হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিলো। তৎক্ষনাৎ লোভ জাগে। বিয়ে হওয়ার সাথেসাথে যেনো প্রেম আরো দরদর করে বেড়ে উঠেছে। সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জ্ঞাপন করছে।নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন ছুড়লো, একবার কপোলে অধর ছুঁয়ে দেক?সেতো পর নয়। রীতিনীতি মেনে বিয়ে করা বউ।ভাবনার পরবর্তী ক্ষণে এগিয়ে যায় আফতাব।ঠোঁট ছোঁয়ায় গালে।বিপত্তি বাঁধলো।লুকিয়ে প্রেম প্রেম ভাবটা প্রকাশ করতেই ধরা পড়লো।জেগে গেছে খুশবু। আফতাবকে কাছাকাছি দেখে চোখ বড় বড় করে চাইলো।

-“কি করছেন!”

আফতাব এরূপ ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে ছিটকে যায়নি বরং কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোর লাগানো গলায় জবাব দিলো,

-“বউকে ভালোবাসি।”

দুহাত তুলে আফতাব এর মুখের উপর রাখলো খুশবু।সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

-“নির্লজ্জ!ঘুমন্ত অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছেন।”

-“আ’ম প্রাউড অফ মায়সেলফ।জীবনে প্রথমবার কেউ আমায় নির্লজ্জ বলেছে।”

ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টায় লিপ্ত খুশবু।তার সহায় হলো আফতাব এর ফোন। বিদঘুটে আওয়াজে বেজে উঠেছে।একলাফে উঠে দাঁড়ালো।ফোন এর দিকে চেয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলো।ফোন রিসিভ করে বললো,

-“ইয়েস স্যার”

অন্যপাশ থেকে কি বাক্য এসেছে কে জানে।খুশবু জানার ইচ্ছায় চেয়ে আছে।আফতাব হু হা করছে।কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।কপালে চিন্তার রেখা।দুয়েক মিনিট কথা বলে মলিন দৃষ্টি ছুঁড়ে খুশবুর দিকে।এমন চাহনিতে বুকটা ধ্বক করে উঠলো।আফতাব নত দৃষ্টিতে আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে ইউনিফর্ম বের করে বিছানায় রাখলো।ঠিক তাই!যেমনটা ভেবেছিলো সেটাই।

মিনমিনে গলায় আফতাব বললো, “

-যেতে হবে”

ঠিক তখনই রুমানা মির্জা এসে দরজা নক করলেন।খুশবু জবাব দেওয়ার সুযোগ পায়নি। থম মেরে ছিলো।রুমানা মির্জার ডাকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো।দ্রুত হাতে বিছানা গুছিয়ে নেয়।নাস্তার জন্য ডাকতে এসেছিলেন।আফতাব খুশবু ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিলো।ইতিমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে আফতাব এর ইমারজেন্সি ডাক পড়েছে ক্যাম্পে।কিছু করার নেই।খুশবু মুখটা শক্ত পাথরের ন্যায় করে আছে।আফতাব ঘরে ফিরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে রাগে আগুনের গোলা হয়ে থাকা খুশবুর দিকে চায়।

কাছে এসে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালো।বললো,

-“এক সপ্তাহে ফিরে আসার চেষ্টা করবো।”

অগ্নিচক্ষু করে চাইলো খুশবু।জবাব দিলো না কোনো।আফতাব বলে,

-“আচ্ছা পাঁচ দিন?”

রাগ কমেনি খুশবুর।আরো যেনো বেড়ে চলেছে।পাঁচ দিন!পাঁচ দিন মুখের কথা?আফতাব বললো,

-“আচ্ছা ফাইনাল তিনদিন।হাত পা জোড় করে বলবো স্যার আমাকে ছেড়ে দিন আমার নতুন বউ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

খুশবু তেড়ে এসে বললো,

– “ওখানেই থেকে যাবেন।আসা লাগবে না!”

ঠোঁট টিপে হাসে আফতাব।তার এই হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।শরীর জ্বলছে দাউদাউ করে।কতক্ষন হয়েছে বিয়ের।এখনই চলে যাবে। খুশবুকে এমন আগুনের গোলা হতে দেখে জড়িয়ে ধরলো আফতাব।তাতে খুশবুর রাগ যদি কমে?সেটা হয়নি। কাঁধে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করে বলছে,

-“কয়েক ঘন্টার বউকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে।পৃথিবীতে এত নিষ্ঠুর মানুষ হতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারছি না।…ছিঃ!”

চলবে…