তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৭

0
10

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৭
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন,

“অপেক্ষার সময়গুলোই বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসার প্রকৃত মুল্য, জীবনের সার্থকতা অপেক্ষার মধ্যেই নিহিত।”

অপেক্ষার পথ দীর্ঘ।হৃদপিণ্ড ভরা ব্যাকুলতা।আকাশের তারা গোনা,চাঁদের আলোয় পথ খোঁজা ব্যতীত-তো সময় পেরোচ্ছে না।কারো আগমনের আশাতে দীর্ঘ এগারোটি রাত পোহায় প্রতীক্ষায়।বাতাসে মিশে থাকা ঘ্রাণ যেখানে সর্ব সতেজতা ছিলো সেটি বিষিয়ে তুলছে হৃদয়কে।দিন কাটে, রাতও ফুরায়। স্বস্তির অনুভব হারিয়ে গেছে যেনো। বুট জুতোর ধ্বনি শুনতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী সে।আনচান করছে এগারোদিন যাবত। বিশ্রামহীন নেত্রদ্বয় কখনো ফোনে আবার কখনও টিলার দিকে।নৈরাশ এর তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই পেলো না। মুঠোফোনে দুয়েক মিনিটের কথোপকথন উপশম করতে পারছে না কিছুতেই।ফিরে এলেই স্বস্তি মিলবে।

-“ভাইয়া তোমরা কেনো আসছো না?আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয়না তোমাদের?”

ফাহাদ বোনের কথার জবাবে বললো,

-“আসবো-তো।তোর রিসিপশনের ডেট পড়ুক তখনই আসবো।”

-“রিসিপশন ছাড়া আসা যায় না? নানী ঢাকায় কি পেয়েছে?মিষ্টি মন্ডা?সেও আসেনা।”

ফাহাদ খুশবুর কণ্ঠের অস্থিরতা বুঝতে পারলো।একা একা নিশ্চয়ই ভালো নেই সে। আফতাবও নেই তার সাথে।ফাহাদ বললো,

-“আমরা সবাই একসাথে আসবো।নানীকে একা ছাড়া যাবে বল?আর তার চেয়ে বড় কথা আমার ঘাড়ে এখন ডাবল খাটনি।চাকরি আর বাবাকে সাহায্য দুটো একসাথে করতে হয়।যদি নতুন চাকরি না হতো আমি চলে আসতাম।”

-“তুমি জিতু মামার সাথে পাঠিয়ে দাও নানীকে।আমার ভালো লাগছে না একদম।দমবন্ধ লাগছে!”

চিন্তিত হলো ফাহাদ।কিছু সময় নিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“তোর শ্বশুর শ্বাশুরি তোকে সময় দেয় না?না মানে এত অস্থির কেনো তুই?সব ঠিক আছে সেখানে?”

খুশবু ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো,

-“তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে আমাকে খুশি রাখার।বাবা আমার পছন্দ অপছন্দ সব খেয়াল রাখছেন।মা আমাকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন।আমাকে সারাদিন সময় দেন দুজন।…..তাদের কোনো দোষ নেই।দোষ আমার!আমি নিজেকে একা ভাবছি।মনকে মানাতে পারছি না”

-“আফতাব আসলে ঠিক হয়ে যাবে সব।আর আমি নানীকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।চিন্তা করিস না।”

কখনো কখনো বাচ্চামোতে উপনীত হয় খুশবু।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।অন্তত কেউ কাছে থাকুক। শ্বশুর শ্বাশুরির কথা ভেবেও উদাস হলো মন।কত কিছুই না করছে তারা খুশবুর মন ভালো রাখার জন্য।কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। লাভ না হওয়ার পেছনে তাদের ছেলেই দায়ী।বারবার রাগ হয় খুশবুর।তবে রাতে যখন ক্লান্ত কণ্ঠে ‘খুশবু’ ডাক শুনে সমস্ত রাগ ধুলোয় মিশে যায়।

রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ঘরে এসেছে খুশবু।জমিয়ে আড্ডা দিয়ে এলো রুমানা মির্জা এবং রফিকুজ্জামান মির্জার সাথে।কিছুটা ভালো লাগছে।সিদ্ধান্ত নিলো ঘরে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। ফোনের দ্বারে কাছেও যাবে না।বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ফোন বাজে।আফতাব কল করেছে।ফোন রিসিভ করে নরম গলায় খুশবু বললো,

-“হ্যালো”

-“ঘুমোচ্ছিলেন?”

-“নাহ তবে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।”

-“আচ্ছা”

খুশবু বললো, -“আসবেন না?”

আফতাব চুপ রইলো।খানিক বাদে জবাব দিলো,

-“দেরি হবে আরো”

-“আর কতদিন বলুনতো!আজ বাদে কাল বারোদিন হয়ে যাবে।আমার ভালো লাগছে না।”

-“কি করবো খুশবু?আমার হাতে কিছু আছে?…তবে আপনার জন্য উপহার পাঠিয়েছি।”

-“আমার উপহার লাগবে না”

-“আমাকে লাগবে?”

-“আপনাকেও লাগবে না। থাকুন নিজের কাজ নিয়ে।”

-“পাঁচ মিনিট পর টিলার উপর থেকে খয়েরী রঙের বক্সটা নিয়ে আসবেন।আমি আরো অনেকগুলো পাথর কালেক্ট করেছি।এগুলো আগেরগুলোর চেয়ে বেশি সুন্দর।আবার স্ট্যাম্পও আছে বিভিন্ন দেশের।রাখি কাজ আছে আমার।…মনে করে নিয়ে নিবেন কিন্তু”

বলে ফোন কেটে দিলো আফতাব।আজ মনে হলো পুরো খুশবুকেই এড়িয়ে গেলো সে। টিলার দ্বারের লাইট নষ্ট হয়ে গেছে। বিদঘুটে আধাঁরে ঘেরা চারিপাশ।সৌন্দর্যের লীলাভূমিকে ভয়ানক ভূতুড়ে দেখাচ্ছে আজ।বাড়িতে গিফট দিলে কি হতো? ঘুরেফিরে ওই আধাঁর টিলার উপরেই রাখতে হলো?

শ্বশুর শ্বাশুরির চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো মাথায় ওড়না টেনে।মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটে আর কতটুকু বোঝা যায়?ঢোক গিলে এক এক কদম এগিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ভয় আর বেয়ে উঠার ফলে বুক ধড়ফড় করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।জমিনে লাইট দিয়ে দেখতে লাগলো কোথায় সেই খয়েরী বক্স? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে আতকে উঠলো।পেছন থেকে দুটো হাত তাকে কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। বিমূঢ় খুশবু লাফিয়ে উঠলো।চেঁচামেচি শুরু করে কনুই দিয়ে আঘাত করতে শুরু করেছে পেছনে।নিশপিশ করছে।এখনও মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারেনি!

-“ছাড় আমাকে অসভ্য ছ্যাঁচড়া!”

বলে চিৎকার করলে মুখ চেপে ধরে।কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিসানি ভেসে এলো।পুরুষালি কণ্ঠে বললো,

-“ মান সম্মান কিছু রাখবেন না?এভাবে চেঁচায় কেউ? পাড়ার মানুষ কি ভাববে হুম?”

পরিচিত আওয়াজে স্থির হয়ে গেলো খুশবু। অনুভব করতে লাগলো প্রতিটি নিঃশ্বাস। শব্দভান্ডারে শূন্যতা।কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারছে না।অন্যদিকে আফতাব যত্নে আগলে রেখেছে বাহুডোরে।চোখ বুঁজে খুশবু নিচ্ছে ক্যামেলিয়া ফুলের।অনেক সময় হিমায়িত থেকে ঘুরে তাকালো খুশবু। বললো,

-“মিথ্যে বললেন কেনো?”

-“সারপ্রাইজ দিলাম”

-“ভয় পেয়েছিলাম।”

আফতাব হেসে বলে,

– “ভেবেছিলেন কোনো বখাটে লোক আপনার সাথে অসভ্যতামো করছে?….এত সাহস আছে কারো?”

-“আছেতো…আপনার। আপনিওতো বখাটে। ভোলাভালা এক মেয়েকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছেন।”

আফতাব কথার বিপরীতে কিছু বলতে চাচ্ছিলো। বাঁধা এলো খুশবুর তরফ থেকে।বুকে জড়িয়ে পড়েছে মেয়েটি।দুহাতে আফতাবের পিঠের দিকের ইউনিফর্ম খামচে ধরে আছে বল প্রয়োগ করে।মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো।আফতাব এর ঠোঁটে ফুটলো অসীম হাসি।বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে নিজেও হাতের বাঁধন দৃঢ় করে। শূন্যে ভাসায় খুশবুকে।

-“আমাকে মিস করছিলেন?”

নাক টেনে মাথা দুদিকে দোলায় খুশবু।তার উত্তর হচ্ছে না।মিথ্যে বলছে সে।সরাসরি স্বীকার করতে কার্পণ্য বোধ করছে বুঝি?

-“অবশ্যই স্মরণ করেছেন আমায়….যেহেতু আমায় ভেবে অস্থির ছিলেন সেহেতু আপনার অনুভূতিগুলো আমার জন্য আরো গাঢ়তর হয়েছে।ভালোবাসার দ্বিতীয় ধাপ।আর মনে হয় না কোনো অপরিপক্ক অনুভব আছে আপনার মাঝে।”

খুশবু অস্পষ্ট গলায় বললো,

– “এত ভারী ভারী কথা বলবেন না।আমার বুঝতে সময় লাগে;সমস্যা হয়।”

সশব্দে হেসে উঠে আফতাব।হাসির ঝংকার আর বুকের কম্পন কাছ থেকেই অনুভব করে আরো গুটিয়ে নিলো নিজেকে। যেখানে অপেক্ষার বিরহে কেটেছে দিন সেখানে অনুভূতি কাঁচা হতেই পারেনা। খুশবুকে নামিয়ে দিলো আফতাব।মাথা থেকে ক্যাপ নামিয়ে খুশবুর মাথায় দিয়ে গাল আলতো হাতে চেপে ধরে চুমু খেলো। প্রখর দৃষ্টি স্থাপন করলো খুশবুর মুখশ্রীর দিকে।এইতো এখনই ঢেকে যাবে নেত্র পল্লব দ্বারা।ঠোঁট কামড়ে লাজুক দেখাবে নিজেকে। থুতনির অংশটুকু কুচকে যাবে অনেকটা।হাত দুটোকে কি করবে বুঝতে না পেরে কচলাতে শুরু করবে।এর চেয়ে মোহনীয় রূপ যেনো হয়না।চোখে ধারণে শান্তি পেলে।অল্প সময়ে পুরো খুশবুকেই মুখস্ত করে ফেলেছে আফতাব।

-“বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবো নাকি?”

খুশবু হুট করে প্রশ্ন করে বসলো, -“আমার পাথর?”

-“আমি এসেছি আপনার তারপরও পাথর লাগবে?”

-“হ্যাঁ লাগবে।”

স্মিত হেসে আফতাব বললো, – “ব্যাগে আছে।চলুন”

সদর দরজা খোলা দেখে রফিকুজ্জামান চিন্তিত হয়ে পড়েন।মাত্রই তদারকী করতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।তখন পুত্র আর পুত্রবধূকে আসতে দেখে অনেকটা অবাক হন।আফতাব জুতো খুলে এগিয়ে গেলো।

-“আসসালামু আলাইকুম বাবা”

-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।তুমি আসবে জানাও নি কেনো?”

বলে খুশবুর দিকে চাইলেন। সবসময়ের মতন মাথায় কাপড় টানতে টানতে বোকা মুখে বলে উঠলো,

-“আমিও জানতাম না।মাত্র জানলাম”

বাবা ছেলে একত্রে হেসে উঠে খুশবুর জবাবে।হাসলো কেনো সেটা খুশবুর বোধগম্য হয়নি।সে কি ভুল কিছু বলেছে?দুজনের দিকে চোরা দৃষ্টি রেখে ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টায়।লাভ হচ্ছে না একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার আর একজন বর্তমান ক্যাপ্টেন এর চোখ আর নীরবতার ভাসা বুঝলো না।নিজেকে অধম উপাধি দিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায়।দীর্ঘ পাঁচ দিন পর রান্নার কাজে হাত দিতে দিয়েছিলো রুমানা মির্জা। কোথায় কি রাখা আছে জানিয়ে দিয়েছেন।তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন আগেই।রাতের খাবার গরম করতে উঁকি দিয়ে দেখলো রফিকুজ্জামান আছেন কিনা।নাহ নেই! গলার স্বর কিছুটা উচুঁ করে বললো,

-“খাবার গরম করছি।ফ্রেশ হয়ে আসুন”

চোখ কপালে উঠেছে আফতাব এর। মনেমনে ‘বাব্বাহ!এগারো বারো দিনে সংসারের হাল ধরতেও শুরু করেছে?’ বলে উঠলো।দ্রুত পায়ে জুতোর মাটি ঝেড়ে ফেলে ঘরের দিকে দৌঁড় লাগায়।ফ্রেশ হয়ে এসে দেখবে রান্নাঘরে খুশবুকে গিন্নী রূপে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।ঝড়ের গতিতে গেলো। বিশ মিনিটে গোসল সেরে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ফিরে এসেছে।কোনোদিকে চাইলো না।চুলোয় খাবার গরম করতে থাকা খুশবুকে আবারো জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে।বরাবরের মতন ভয় পেয়ে বুকে থুথু ছিটিয়ে নিলো।

আফতাব প্রশ্ন করলো,

-“কি আয়োজন হচ্ছে?”

-“ভাত বসিয়েছি।সাথে চিংড়ি দোপেঁয়াজা আর গরুর গোশত আপনাদের স্পেশাল সাতকরা দিয়ে।”

-“আপনি রান্না জানেন?”

-“একটু আধটু।তরকারি মা আর খালা মিলে রান্না করেছেন।আমি হেল্প করেছি।আর ভাত মাত্র বসালাম। মা বলেছিলো আপনি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খেতে পছন্দ করেন।”

এক নিঃশ্বাসে সব কথা বললো খুশবু।তার পছন্দ অপছন্দ খেয়াল রেখেছে নিজের সাধ্যমতো।যা যা করেছে অবলীলায় সবটাই বলে ফেললো।আফতাব মুখ তোলে।কানের লতিতে ঠোঁট প্রায় ছুঁই ছুঁই।নিম্ন স্বরে বললো,

-“বউ রূপে অসাধারণ লাগছে আপনাকে।আরো বেশি বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

থেমে যাওয়া হাত তরকারি পুড়িয়ে ফেলছিলো।আফতাব দ্রুত হাতে চুলো বন্ধ করে দিলো।বললো,

-“ঘনিষ্ঠতায় অভ্যস্ত হন।এভাবে হুটহাট স্ট্যাচু হয়ে গেলে হবে? বি একটিভ খুশবু।”

লাজুক হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো খুশবু। তাড়াহুড়ো শুরু করলো।খাবার সব পাত্রে রেখে টেবিলে সাজায়।আফতাব টেবিলে এসে বসে।নিজ হাতে প্লেটে খাবার তুলে দিতেই আফতাব প্রশ্ন করলো,

-“পাক্কা গৃহিণী হচ্ছেন কিন্তু।আমার অনুপস্থিতিতে কে শেখালো এসব?”

-“আমার আমার মা’কে দেখেছি সবসময় বাবার পাতে খাবার দিতো প্রথমে।তারপর ভাইয়া আর আমার প্লেটে। এবাড়িতেও দেখেছি মা বাবাকে খাবার বেড়ে দিয়েই তারপর নিজের প্লেটে খাবার তোলেন।তাদের দেখে দেখে আমিও শুরু করলাম।আমি ঐতিহ্য ধরে রাখছি। পরে যদি আবার বলেন আপনার বউ আপনার যত্ন করে না?”

-“যত্ন করেনা?যাক ভালোই হয়েছে শিখেছেন।….আপনি খেয়েছেন?”

-“হ্যাঁ।”

-“আমি খাইয়ে দিলে খাবেন?”

-“ক্ষিদে নেই আমার”

-“একটু?”

আফতাব এর আবদার নাকোচ করতে পারলো না।বহুদিন পর এসেছে। এগারোদিন নয় যেনো এগারো বছর।মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে।

আফতাব ঘরে ফিরেই সটাং হয়ে শুয়ে পড়লো।চোখ মুখ কুচকে নিচ্ছে মাঝেমধ্যেই।বাড়ি ফিরলেই কেমন যেনো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।সব ক্লান্তি আর অঙ্গের পীড়া অনুভব করতে শুরু করে।ক্যাম্পের শক্ত বিছানায় এমনটা হয়না,সারারাত জেগেও টলমল করেনা চোখ।বাড়ির ঘ্রাণে অন্যরকম নেশা।শরীর ছেড়ে দেয় একেবারে।পুরো বাড়ির বাতি নিভিয়ে খুশবুও ঘরে এসেছে। আফতাবকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে পায়ের দ্রুততা বাড়িয়ে সামনে এসে প্রশ্ন করলো,

-“এই আপনার কি খারাপ লাগছে?”

আফতাব জবাব দিলো, -“আলসেমি লাগছে।”

-“বাহ্ রে! আপনাদেরও আলসেমি লাগে?আমি আরো ভাবলাম আপনারা টুয়েন্টি ফোর সেভেন একটিভ।”

-“সেটা কর্মস্থলে।বাড়িতে আমি চরম অলস।”

খুশবু মুখ ভেংচি কেটে বলে,

-“মনের শয়তানি!”

আফতাব এর ঘরে কোনো বারান্দা নেই।এই নিয়ে মন বড় উশখুশ করছিলো খুশবুর।বারান্দা ছাড়া দমবন্ধকর লাগে।তবে খাবার ঘরের ঠিক সামনে সুবিশাল খোলা বারান্দা আছে।সেখানে আর কতবার যাওয়া যায়?একা যেতে ভয়ও করে।আফতাব এর ইচ্ছে হলো সেখানেই কিছু সময় কাটাতে। প্রিয়তমার সাথে সময় কাটানোর ভাবনায় অলসতা কাটে চাঙ্গা হয় দেহ।ভাবনার সাথেসাথেই খুশবুকে নিয়ে উপস্থিত বারান্দায়।সোফায় গা এলিয়ে বসে। খুশবু আফতাব এর বরাবর সোফার দিকে কদম এগোলে হাত ধরে কোলে টেনে নেয়।দুহাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,

-“কাছাকাছি থাকুন।সময় খুব কম পাই আপনার সাথে।”

-“তাই বলে এভাবে?”

-“হুম এভাবেই…কিছুক্ষন থাকবো এখানে।তারপর গিয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়বো আপনাকে জড়িয়ে।”

জবাব দিলো না আর খুশবু।সব খারাপ লাগা দূর হয়ে গেছে দুয়েক ঘন্টায়। উপলব্ধি করতে পারলো হৃদয়ের চাওয়া এতটুকুই ছিলো। চাঁদ আজ তাদের দুজনকে একে অপরের নিকটে দেখে লুকোচুরি খেলছে অপার আকাশে। চারু মুখমণ্ডলে দৃষ্টি সর্বাঙ্গীণ নিবদ্ধ।গলায় থাকা চিকন সোনালী চেইন ছাদের আলোয় দ্যুতিমান।খুশবুর নেত্রে চঞ্চলতা,মুখ অবয়ব স্থির।পরিস্থিতি সামলে উঠার জন্য পরিমিত নয়।চুপচাপ অক্ষি পল্লব নুয়ে এড়ানোর ভুলভাল চেষ্টা আরো আবেদনময়ী করে তুলছে তাকে। আকস্মিক মৃদু ব্যস্ত হলো শ্বাস-প্রশ্বাস। অধীরতার ঊর্ধ্বগতি। ভিন্নধর্মী আকর্ষণ অনুভব হতে শুরু করলো।সরু-চিকন অধর ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা জ্ঞাপন করছে।অধিকার থাকা স্বত্বেও মস্তিষ্ক বাঁধা প্রদান করছে।দীর্ঘসময়ের অপেক্ষা আর বাকবিতন্ড থামলো সরু অধরের ডান কোণ ছুঁয়ে।পুরুষ মানুষের ধৈর্য প্রিয় নারীর সান্নিধ্যে অত্যন্ত কম।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আফতাব বললো,

-“এতটা সময় হৃদয় রীতিমত বিদ্রোহ করছিলো”

পরপর হতাশ গলায় বললো,

-“আমার চাকরিটা ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলেছে।অনুশাসন বউয়ের সাথে রোমান্টিক হতেও বাঁধা দেয়!মনে হচ্ছিলো অভদ্রতামি করে ফেলছি!”

_______

-“তোর সামনে পরীক্ষা।খেয়াল আছে কোনো?কি পেয়েছিস এই ফোনে?” নোমান রাগী গলায় বললো নেহার উদ্দেশ্যে।

-“তুই কি পেয়েছিস রাজনীতিতে?”

খাবার টেবিলে পুরো পরিবার অনেকদিন পর একসাথে।নেহার মা ঝুমা আক্তার ছেলের রাজনীতিতে কখনোই সায় দেননি। দিবেনও না।স্বামীকে পারেনি ছেলেকে চেয়েছিলো এসব থেকে দূরে রাখতে। তা আর হচ্ছে কোথায়?

নোমান চোখ নামিয়ে ঠাণ্ডা গলায় মায়ের জবাবে বলে,

-“ওকে লাই দিও না মা।আমি ওর ভালোর জন্য বলছি।”

-“আমি ওকে লাই দেই না।কিন্তু হ্যাঁ তোর বাপ চাচারা তোকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। মাস্টার্স শেষ করেছিস এখন কি দরকার হলে থাকার? চাকরির জন্য এপ্লাই কর।নিজের ভবিষ্যৎ গড়।এসব রাজনীতিতে কোনো ভরসা নেই।”

পুরুষেরা ঘরের কর্তা।গর্জে বেড়ান প্রায়শই।তবে খাবার টেবিলে তাদের চলে না।এখানে নারীরা নিজেদের রাগ,মান অভিমান সব প্রকাশ করেন।নোমানের বাবা এবং ছোট চাচা নিশ্চুপ খাবার খেয়ে যাচ্ছেন।নোমান বললো,

-“আমার স্টার্ট আপ প্ল্যান আছে একটা।কিছুদিনের মধ্যেই বিজনেস শুরু করার পরিকল্পনা।ততদিন মাথা ঠাণ্ডা রাখো। মেয়ের দিকে একটু নজর দাও।সারাদিন ফোন আর ফোন!”

রাত এগারোটায় ফাহাদকে কল করবে কি করবে না দ্বন্দ্ব চলছে মস্তিষ্কে।রাতের বেলা লোকটাকে কল করা উচিত হবে?জিজ্ঞেস করেছিলো কেনো ভয় পাই?সে কি আমার প্রেমিক?এরপর ফোনে কথা বলার সাহস হয়নি।তাকে ভালো লাগে নেহার মনে প্রাণে মেনে নিয়েছে।তবে ফাহাদের দিকটা এখনও ধোঁয়াশা।তেমন কোনো উৎসাহ অথবা নিরুৎসাহ দেখা যায়নি তার মধ্যে।

দরজায় দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হতেই লাফিয়ে উঠে নেহা। চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে,

-“কে?”

-“আমি”

নোমানের আওয়াজ ভাসলো।এই হলো আরেক লোক!ভাই থেকে শত্রুর রূপ ধারণ করেছে।এখন তার বিতৃষ্ণা নেহার ফোনের দিকে।দ্রুত ফোনের সেটিংয়ে গিয়ে সিম অফ করে দিলো। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করেছে।ফোন লক করে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

-“কি হয়েছে ভাইয়া?”

-“তোর ফোন কোথায়?”

ফোন কোথায় জানতে চাওয়া আত্মা কাপিয়ে তোলে।ঢোক গিলে বললো,

-“ওইতো টেবিলের উপরে।”

-“এক সপ্তাহ পর তোর এইচ এস সি পরীক্ষা। ফোন তোর কাছে থাকবে না।দে ফোনটা।”

-“এটা কেমন কথা ভাইয়া!” উত্তেজিত গলায় বললো নেহা।

-“কেমন কথা মানে কি?পরীক্ষার পর ফোনের মধ্যে ঢুকে বসে থাকিস।”

বলে ঘরে ঢুকে গেলো।নেহা ফোন দিতে রাজি নয়।তার এই ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করেই নোমান ফোন হাতে তুলে নেয়।রাগে ফুঁসতে শুরু করলো নেহা। দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নোমান বললো,

-“তোর ভালোর জন্য করছি কাজটা।এই ফোন আগামীকাল বিকেলে পাবি।এখন ঘুমো।রাত জাগা যাবেনা।সকাল সাতটায় উঠে পড়তে বসবি।আমি পড়াবো।তোর পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত এখানেই আছি।”

নোমান বেরিয়ে যেতে দরজা জোরেশোরে বন্ধ করে নেহা।ঠোঁট উল্টে বসে রইলো বিছানায়।এমন করছে কেনো নোমান! আগেতো কখনো তার কোনো বিষয়ে জোর প্রয়োগ করেনি?বরং বুঝিয়েছে নয়তো বকে দিয়েছে।জোর জবরদস্তি কক্ষনো করেনি।হুট করে বদলে গেলো কেনো স্বভাব?ভীষণ খারাপ লাগছে নেহার।বাড়ির বাইরে যেতে পারেনা বাবা চাচাদের জন্য।ভাই এবার ফোনটা নিয়ে গেলো।এখানে একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো।তার চেয়ে বড় বিষয় মাঝেমধ্যে ফাহাদের সাথে দুয়েক আলাপ ভীষণ স্বস্তি দিতো।সেটাও হলো না।কান্না পাচ্ছে নেহার।

_________

-“এইযে অনেকদিন বাদে ছোট সাহেবরে দেইখা নতুন বউয়ের মুখে হাসি ফুটছে।

রিতা খালার এরূপ মন্তব্যে লজ্জায় কুপোকাত হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো।আফতাব কোনো জবাব দিলো না।তার মন এখন পরোটা আর ডিম ভাজিতে।রফিকুজ্জামান সকাল সকাল নাস্তা সেরে হাঁটতে গিয়েছেন।আজ খুশবুকে নেন নি সাথে। এ ক’দিন বেচারির মন ভালো করতে সাথে নিয়ে যেতেন। হাঁটলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে এই অজুহাতে বউ শ্বশুরের সম্পর্কে কিছুটা বোঝাপড়া এসেছে।আগের তুলনায় একটু কম ভয় পায় তাকে খুশবু।বিয়ের প্রথম ক’দিন চোখ তুলেও চাইতো না।

ছেলেকে হুট করে সকাল সকাল চোখের সামনে পেয়ে রুমানা মির্জার মন আনন্দে ভরে উঠে।আজ বিশেষ আয়োজন করবেন।পাশাপাশি রিসিপশনের ডেটটাও ফিক্স করবেন।রিতা খালার কথার জবাবে রুমানা মির্জা বললেন,

-“স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যত মজবুত হবে তত ভালো তাই না?”

রিতা খালা সায় দিলেন।জবাব দিলেন,

-“একদম ঠিক কথা কইছেন।”

দুপুরের খাবারের আয়োজনে শ্বাশুরির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় খুশবু। মিনমিন করে আবদার করলো আজ রান্না সে করতে চায়।চোখে মুখে সংকোচ।কি ভাববেন সে? রান্নাই বা কেমন হবে।তার দ্বিধা ভেঙে রুমানা মির্জা সম্মতি দেন।সাহায্য করবেন বলে জানান।চিন্তা অনুযায়ী আফতাব এর পছন্দের খাবার তৈরি করার আয়োজন শুরু হলো।অনেককিছু জানে আবার অনেককিছু জানে না খুশবু।রুমানা মির্জা এবং রিতা খালার সাহায্যে দেড় ঘন্টার যুদ্ধ শেষে মাটন বিরিয়ানি তৈরি।ক্লান্ত হয়ে গেছে খুশবু।ইতিমধ্যে আফতাব কয়েকবার রান্না ঘরের আশপাশে ঘুরে গেলেও খুশবুর কোনো ইয়াত্তা নেই।সে নিজের কাজে মগ্ন।ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে।রুমানা মির্জা বললেন,

-“যাও গোসল করে এসো।আমি খাবার সার্ভ করছি টেবিলে।”

খুশবু চলে যাওয়ার পর রিতা খালা রুমানা মির্জার উদ্দেশ্যে বললো,

-“আমি আরো ভাবলাম বাচ্চা ফুরি।সংসার সামলাইতে পারবো না।আজকালকের ফুয়া ফুরিরা কিছুই জানে না।কিন্তু নতুন বউয়ের আগ্রহ আছে কিন্তু।”

-“তাইতো ওকে টুকটাক কাজে সায় দেই।ভুল করলে কিছু বলি না।ভুল করতে করতেই শিখবে।” বলে আরো একটু লবণ দিলেন বিরিয়ানিতে।খুশবু পরিমাণে কম লবণ দিয়েছিলো।

আফতাবকে জানালার দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যায় খুশবু।ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো।এই সাহিরটা আবার কল করছে কেনো?ফোনের আওয়াজে আফতাব ঘুরে চাইলো। খুশবু ফোন কেটে দেয়।আবার ফোন আসে। খুশবু আবারো কেটে দিলো।আফতাব কাছে এসে জানতে চাইলো,

-“কে কল করছে?”

খুশবু কিছুটা নত গলায় বললো,

-“সাহির”

আফতাব এর মুখে গম্ভীরতার ছাপ স্পষ্ট।ছোট্ট জবাব এসেছে অনেক সময় বাদে।তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে ভারী কণ্ঠে শুধু বললো,

-“ওহ”

চলবে….