তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৮

0
11

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৮
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

-“আমি কথা বলি সাহির এর সাথে?”

খুশবুর উদ্দেশ্যে আফতাব বলে উঠলো।দুজনের মাঝে দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যেই আবার ফোন বেজেছে।কি চায় এই ছেলে? খুশবুর মাথায় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েই চলেছে।আফতাব এর আবদার এলো গম্ভীর গলায়।ফুর্তি নেই আওয়াজে আগের মতন।খুশবু বিনাবাক্যে ফোন এগিয়ে দেয়। ট্রাউজারের পকেটে এক হাত গুঁজে অন্যহাতে ফোন কানে চাপলো।কণ্ঠের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

-“হ্যালো”

সাহির অন্যপাশ থেকে প্রশ্ন করে, -“কে?”

-“আমি আফতাব।”

-“এটা খুশবুর নাম্বার।”

-“আমি জানি এটা খুশবুর নাম্বার।আমি খুশবুর হাসবেন্ড।”

সাহির এর মস্তিষ্কে কি চলে সে নিজেও অবগত নয়।আনচান করছে পুরো দেহটাই।অহেতুক ফোন করে খুশবুকে বিরক্ত করার ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।সে কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বে আফতাব বললো,

-“আপনাকে আমি চিনি।আপনার প্রতি কোনো ক্ষোভ আক্রোশ ছাড়া বলছি আর ফোন করবেন না খুশবুকে প্লিজ।”

-“আপনি জানেন খুশবু….”

-“খুশবুকে আর কল করবেন না”

-“আমার কথাটা….”

-“খুশবুকে আর কল করবেন না”

সাহির থেমে থাকার পাত্র নয়।অপমান করা হয়েছে তাকে।এই লোকটার নাম নিয়েই। প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে লাগলো দেহে।দুজনের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি করতে বললো,

-“লোভে পড়ে আপনাকে বিয়ে করেছে”

-“খুশবুকে আর কল করবেন না”

এবারও আফতাব একই জবাব দিলো।কণ্ঠে মাত্রাতিরিক্ত রুষ্ঠতা।এই একটা বাক্যেই সে আটকে আছে।যত যাই হোক খুশবুকে কল করা যাবে না। খুশবু এক ধ্যানে আফতাব এর চাপা জেদী রূপটা দেখছে।

সাহির বললো, -“আপনি কি ভাবছেন এই সম্পর্কে আপনারা ভালো থাকবেন?”

-“খুশবুকে আর কল করবেন না।রাখছি”

বলে ফোন কেটে দিলো আফতাব।ফোন খুশবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে আপাত দৃষ্টি রাখে মুখখানায়। বোকার মতন চেয়ে আছে মেয়েটি। চট করে ধরে ফেললো এখনই কিছু বলবে।আফতাব এর আগাম ধারণা সঠিক প্রমাণিত করে খুশবু বললো,

-“ভাবলাম আচ্ছামত গালিগালাজ করবেন।সিনেমার নায়কদের মতন হুমকি ধামকি দিবেন।আপনার নব্বই দশকের টেপ রেকর্ডার একটা বাক্যে হ্যাং খেয়ে গিয়েছে ‘ খুশবুকে আর কল করবেন না’।এটা কিছু হলো?এর চেয়ে আমি সেদিন ওকে ধোলাই দিয়েছি। ডোজ বোধহয় কম হয়ে গেছে তাই বেহায়ার মতন আবার ফোন করেছে।ভাবা যায় একটা মানুষ এত অপমান হওয়ার পরও ফোন করে?”

-“কিছু মানুষ থাকে নাছোড়বান্দা।” আফতাব জবাব দিলো।

-“এই আপনি রাগ করেছেন?এমন মূর্তি হয়ে আছেন যে?”

আফতাব খুশবুর প্রশ্নের জবাবে ফিরতি প্রশ্ন করে,

-“আপনিতো তাকে এখন ভালোবাসেন না,তাই না?”

স্বতঃস্ফূর্তভাবে খুশবুর কাছ থেকে জবাব দিলো,- “না একদম বাসি না।উল্টো রাগ হয়।”

আফতাব দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলো।কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব রেখে খুশবুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে আরো এক ইচ্ছে জাগলো। পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো করে দেওয়ার। হাত বাড়িয়ে মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে চুলগুলো একহাতে এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

-“তাহলে ঐ মানুষটাকে এত ইম্পর্ট্যান্স দেওয়ার দরকার নেই।রাগ, ঘৃণারও দরকার নেই।”

-“আমিতো ঘৃণা করবো।আমার ঘৃণায় অনেক জোর।”

-“আর ভালোবাসায়?”

-“একবার ভালোবাসায় হেরে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার হয়তো আপনি হারতে দিবেন না।”

মুখ লটকে জবাব দেয় খুশবু।আফতাব খুশবুর মাথার পেছনে হাত রেখে কপালে চুমু একে দিয়ে বলে,

-“দিবো না…. কি রেঁধেছেন আমার জন্য?”

মুখমণ্ডল আর চিত্তের রূপ বদলাতে যেনো সেকেন্ডের সময়টাও নেয় না।কিছু সময় পূর্বে রাগী,তারপর মলিন এখন হুট করে উৎসুক হয়ে উঠে খুশবু। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো চেহারায়।বললো,

-“মাটন বিরিয়ানি।খেতে আসুন”

খাবার টেবিলে খাবারের ঘ্রাণ ভাসছে। সুঘ্রাণে আন্দাজ করা গেলো খাবারের স্বাদ।রুমানা মির্জা বলেছিলেন আফতাব ফিরলেই যেনো প্রথম রান্নাটা করে।আজ করলো সবে ডানে বায়ে সাহায্যের হাত নিয়ে।রফিকুজ্জামান মির্জা খাবার মুখে পুরে নিয়ে অনেক সময় বাদে প্রতিক্রিয়া দেন।হাত তুলে নিঃশব্দে খুশবুকে ডেকে হাত মুঠ করে কিছু টাকা খুশবুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

-“খাবার খুব সুস্বাদু হয়েছে।এটা তোমার উপহার”

খুশবু আফতাব এর দিকে চাইলো।চোখ বুঁজে আশ্বাস দিয়ে ইশারা করলো নিয়ে নিতে।রুমানা মির্জা বললেন,

-“তাহলে আফতাব এর ছুটি শেষ হওয়ার আগে আগেই রিসিপশনের ডেট পাকা করি।”

আফতাব মায়ের এমন কথায় বললো, -“মা বেশি ঝামেলা করো না।কাছের কিছু মানুষকে নিয়ে ছোট আয়োজন করলে ভালো হয়।”

-“সেটা আমরা আমাদের বুঝমত করে নিবো।তুমি আর খুশবু আজই চলে যাও শপিংয়ে।নিজেদের মতন কাপড় পছন্দ করে আনো।”

-“তোমরা যাবে না?”

-“আমরা বুড়ো মানুষ গিয়ে কি করবো?তোমরাই যাও।আমরা অনুষ্ঠান এর বিষয়টা সামলাচ্ছি।…. আফতাবের বাবা আপনি বেয়াই সাহেবের সাথে কথা বলুন। আর তাদের আত্মীয়দের দাওয়াত করে ফেলুন।”

__________

উৎসবমুখর হয়ে উঠলো ঘর।সময় স্বল্পতার কারণে দ্রুত আয়োজন করতে হয়েছে। ঘর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে হল বুক করা হয়।জিতু,জরিনা বেগম,লোকমান চৌধুরী,নায়লা বেগম এবং ফাহাদ রওনা হয়েছেন সিলেটের উদ্দেশ্যে। আফতাবের বাড়িতে মেহমান এর আনাগোনা নেই বললেই চলে।অনেকেই দেখে গেছেন খুশবুকে।এখন একেবারে রিসিপশনেই আসবেন।আফতাব তার সিনিয়র অফিসার্স,আরিফ এবং টিমের কয়েকজনকে দাওয়াত করেছে।বাকিরা আসবেন রফিকুজ্জামান মির্জার নিমন্ত্রণে।

আগামীকাল রিসিপশন।বাড়ি পুরোটাই জঞ্জাল।একের পর এক মানুষ আসছেন কাজ নিয়ে।রফিকুজ্জামান মির্জা নিজেই সব তদারকী করছেন।সাথে খুঁজে চলেছেন আফতাবকে। খুশবুরও একই দশা।তাকেও জানায়নি।পরশুদিন শপিং করতে যাওয়ার কথা ছিলো সেটা আর হয়ে ওঠেনি।আজ যাওয়ার কথা।তবে ক্যাপ্টেন সাহেবের হদিস মিললে তবে না?সন্ধ্যা ঘনাতে শুরু করলো।ফোন করেছে কয়েকবার।রিসিভ করেনি উল্টো কেটে দিয়েছে।

আফতাব ফিরলো রাত নয়টায়।বাবা মায়ের সাথে দেখা করে খুশবু কিছুক্ষন পূর্বেই ঘরে এসেছে। আফতাবকে ঘরের দিকে আসতে দেখেই সং সেজে দাঁড়িয়ে পড়লো সামনে। কোমরে হাত রেখে বললো,

-“মনে আছে শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিলো?দেখেন আমি কিন্তু পুরোনো কাপড় পড়ে নিজের রিসিপশনে আসবো না।আপনার আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু আছে?রাতের বাজে কয়টা?”

সামান্য একটা বিষয়ে এমন হাইপার হতে দেখে হেসে উঠে আফতাব।তার হাসি দেখে আরো মেজাজ বিগড়ে গেলো খুশবুর।বললো,

-“ভুল করেছেন ক্ষমা না চেয়ে হাসছেন!”

গলার স্বর উঁচু হলে খুশবুর মুখে হাত রেখে থামিয়ে দিলো তাকে।বললো,

-“চুপ!”

হাত সরিয়ে একটি বিশাল আকৃতির ব্যাগ নিয়ে এলো। খুশবুর হাত টেনে নিয়ে ঘরে আনে।দুহাত কাঁধে রেখে বিছানায় বসিয়ে ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“এই নিন”

খুশবু প্রশ্ন করলো, -“কি এটা?”

-“বউ আমার পছন্দের,বউয়ের পোশাকও আমিই পছন্দ করে এনেছি।”

খুশবু ব্যাগ খুলে দেখত লাগলো।গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা বেরিয়ে আসলো।গোলাপী রঙে সাদা স্টোনের কাজটা বেশ ফুটে উঠেছে।জাঁকজমকপূর্ণ নয় তবে সুন্দর। খুশবুর রংটা ভীষণ পছন্দের।

আফতাব বললো, – “আমার মনে হয় এই গোলাপি রংটা আপনার জন্যই তৈরি।”

খুশবু প্রশ্ন করলো,- “এমনটা কেনো?”

-“স্নিগ্ধ রং আর আপনি”

খুশবু মুচকি হেসে বলে উঠলো, -“আমাকে নিলেন না কেনো?”

-“দেখতে চেয়েছি আমার পছন্দের বউয়ের আমার পছন্দ, পছন্দ কিনা?”

মাথার অনেকখানি উপর দিয়ে গেলো কথাটা। হাবাগোবা সুরতে চেয়ে আছে আফতাব এর দিকে।কি বললো?মেলাতে চেয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার তারে।

-“আপনাকে বলেছি না সোজাসুজি কথা বলবেন।কিসব বললেন কিছুই বুঝলাম না”

আফতাব হেসে জবাব দিলো, -“আমার পছন্দ আপনার পছন্দ হয়েছে?”

-“হ্যাঁ হয়েছে।অনেক অনেক সুন্দর।”

হাঁটু গেঁড়ে জমিনে বসলো আফতাব। লেহেঙ্গাটি সরিয়ে দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো,

-“কথা দিয়েছিলাম পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবো।নিজেকে বেশি ক্লান্ত করবেন না আগামীকাল।সবচেয়ে সুন্দর দুটো দিন কাটাতে যাচ্ছি আপনাকে নিয়ে।যেখানে পাহাড় আর অরণ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।”

পার্লারের অত ভারী মেকআপ আফতাব এর পছন্দ নয়। মেকআপ এর নিচে নাকি আসল চেহারাটাই হারিয়ে যায়।কিন্তু তার কথায় কি চলে? খুশবুকে সাজানোর জন্য যে মেয়েদেরকে আনা হয়েছে তাদের দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলে আফতাব।চোখে মুখে চরম বিরক্তি।আর এই বিরক্তি দেখে খুশবু বেশ মজা পাচ্ছে।হেসে ফেলছে তার সামনে ইচ্ছেকৃত।আফতাব খুশবুকে মেসেজ করে জানিয়েছে যেনো অতিরিক্ত ঘষামাজা না করা হয়।আদেশের আভাস পেলো কিছুটা তার মেসেজে।শ্রদ্ধেয় স্বামীর আদেশ মোতাবেক সেও কথার হেরফের করেনি।একদম স্বল্প সাজে তৈরি।বিপত্তি বাঁধলো এবারও।আফতাব এর সামনে যেতে হবে তবে লজ্জা নামক বস্তুটাকে কোথায় বস্তাবদ্ধ করবে বুঝে উঠতে পারল না।এই না বোঝার মাঝেই আফতাব ঘরে এসে হাজির। ক্যাটক্যাটে আওয়াজে বলছে,

-“ক্রিম পাউডার মাখতে দুই ঘন্টা সময় নিলো।কে জানে আমার বউকে কি বানিয়েছে!”

বলতে বলতে সামনে চোখ যায়।বউকে কি বানিয়েছে সেটা সরেজমিনে দেখে থমকে দাঁড়ালো।মুগ্ধ হয় দৃষ্টি।ভাবনায় আসে একটি মানুষ কতভাবে বিমোহিত করতে পারে?কদম আপনাআপনি এগোয়। খুশবুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে কাছ থেকে আরো গাঢ় দৃষ্টি ফেলে।নত মুখখানা শীতল দুহাতের সাহায্যে তুলে বললো,

-“খুশবু নামে অধ্যাতিক প্রেমে লিপ্ত অন্তর মাঝেমধ্যেই অবিশ্বাস করে বসে। সত্যিই এতো সুন্দর ফুলটাকে চিরকালের জন্য নিজের করে পেয়ে গেছি?”

_________

সিলেট শহর থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরত্বে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের টিলার চূড়ায় অবস্থিত আছে এক সৌন্দর্যের স্বর্গভূমির। ‘শুকতারা প্রকৃতি নিবাস’ নামের মতনই মাধুর্য ছড়ানো সবখানে।সবুজের সমারোহের মাঝেই আকাশচুম্বী পাহাড় তার ঠিক কাছাকাছি সুরমা নদী।শহরের বুকে অন্নপূর্ণা।এইতো ঘন্টাখানেক আগে শুদ্ধ প্রেমিক পুরুষের কণ্ঠে অদ্ভুত কিছু কথা শুনেছিলো,

‘ আগে প্রতি শুক্রবার ছায়াছবি দেখতাম।
সেখানে প্রায়ই দেখানো হতো বড়লোক নায়িকা আর নিম্নবিত্ত নায়ক।
মেয়ের বাবা কিছুতেই মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইতেন না।
ওই সিনেমা ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগতো
সেখানে নায়ক নায়িকাকে নিয়ে পালিয়ে যেতো।
চলুন পালাই!’

সি. এন. জির সাইসাই বাতাসে মাথায় বুদ্ধি ফিরে এলো।এত সময় ঘুমে হতবুদ্ধি হয়ে ছিলো খুশবু। মস্তিষ্কের সিস্টেমে ঝামেলা চলছে এখন অব্দি।সন্ধ্যা অব্দি ভারী লেহেঙ্গা পড়ে পুরো রিসিপশনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো খুশবু। সাজ ছাড়িয়ে ঘুমে ঢলে পড়লেই তাকে জোর করে জাগানো হয়।অদ্ভুত বাক্য ছুঁড়ে উদ্ভট কান্ডও ঘটানো হলো। অর্ধঘুম এক রমণীকে টেনে হিঁচড়ে সিএনজিতে বসিয়ে দেওয়া হলো।ঠান্ডায় কুঁকড়ে উঠতেই পাশে জড়িয়ে থাকা মানুষের শার্ট খামচে ধরলো। ধিমা গলায় জানতে চাইলো,

-“কোথায় যাচ্ছি?”

সিএনজি চালকের দৃষ্টি লক্ষ্য করে আফতাব খুশবুর কানের কাছে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে।বলে,

-“পালিয়ে যাচ্ছি আপনাকে নিয়ে”

যতটা নিস্তেজ আফতাব ঠিক তার বিপরীতমুখী খুশবু।পুরোপুরি জেগে উঠেছে সে।আশপাশে চোখ বুলিয়েছে ইতিমধ্যে।উদ্দীপিত আওয়াজে বলে উঠলো,

-“আধ বুড়ো বয়সে ভীমরতি?”

-“এই আধবুড়ো লোকটা আপনার স্বামী…তাছাড়াও সেনাসদস্যের বউ হয়েছেন জীবনে এডভেঞ্চার না হলে হয় বলুন?”

-“তা কোথায় যাচ্ছি এডভেঞ্চার করতে?”

-“গিয়েই দেখে নিয়েন।”

“বাসায় কেউ জানে?”

-“নাহ”

খুশবু ভীত সুরে আওড়ায়, -“আপনার মাথাটা কি পুরোটাই গেছে?আমাদের সকালে বাড়িতে না দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফতাব।তার বুকের কাছটায় থেকে খুব ভালোভাবে অনুভব করলো খুশবু।কি যেনো এই ফেলা নিঃশ্বাসে।যেনো বোঝা হালকা করলো,

-“হোক!….জীবনে মাঝেমধ্যে পাগলামো করতে হবে।নিরামিষ-একঘেয়ে জীবন আর কত?যখন উপভোগ করতে যাই তখন কেউ না কেউ এসে বলবে এসব ঠিক না তুমি একজন সেনাসদস্য।এসব আমাকে মানায় না।এমনভাবে বাঁধা সৃষ্টি করে রেখেছে এখন পদে পদে কাজ করতে গেলে অন্তত দুইবার ভাবতে হয়।তাই আমি ভেবেছি আগামী দু’দিন সব বাঁধা অতিক্রম করে আপনাকে নিয়ে কাটাবো।আমার পেশা ভুলে একজন সাধারণ মানুষের জীবন কাটাবো।”

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এসেছে প্রতিটি বাক্য। একধ্যানে আফতাব এর দিকে তাকিয়ে আছে খুশবু। লোকটার মধ্যে মায়ার পাশাপাশি চাপা আর্তনাদও আছে বটে।একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে তারা কি সেটা পারে?এবারে খুশবু আফতাবকে ভরসার হাত এগিয়ে দেয়। প্রখর অধিকারবোধ দেখিয়ে আঙুলের ভাঁজে আঙ্গুল রেখে বললো,

-“আর এই কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করবো ক্যাপ্টেন থুক্কু মিস্টার আফতাব মির্জা।”

নিদ্রা ভঙ্গ হয় পাখির কিচিরমিচির ডাকে।গতরাতে আধাঁর স্তব্ধ রাস্তা পেরিয়ে কখন কটেজে এসে পৌঁছেছে তার কোনো হদিস নেই খুশবুর।ঘুম নেশার মতন লেপ্টে ছিল চোখে।চারিদিকের পরিবেশ লক্ষ্য না করেই পাড়ি জমায় তন্দ্রা রাজ্যে।

ঘুমন্ত আফতাবকে রেখেই স্লিপার পড়ে পর্দা মেলে দাঁড়ায় খুশবু।তৎক্ষনাৎ চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো।নেত্র সম্মুখে এই চিত্র মস্তিষ্ক শূন্যে করে তুললো মুহূর্তেই।সবুজের আবেশে মগ্ন পাহাড়,মেঘের কোল ঘেষে যেনো কোনো এক রূপকথা।ফুলের বাগানে রঙের খেলা, সুবাস মাখা বায়ু অবাক একজোড়া নেত্রকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলছে।নিবিড় নীরবতা, বন-জঙ্গলের ছায়ায় পাখিদের ডাক শ্রবণইন্দ্রিয় ধাতস্ত করলো।সূর্যোদয়ের আলোয় পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে ঝর্নার ন্যায় সমতলে পতিত হচ্ছে।চারপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়, যার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় সুরমা স্রোতস্বিনী নদী। নদীর স্বচ্ছ জল এবং পাথুরে তীর দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতির আঁকা এক অনন্য চিত্রকর্ম।

ফুলের গন্ধ এবং বাগানের নীরবতা এক স্বর্গীয় অনুভব করতে করতেই দেহ শীতল হলো।সম্পূর্ণ নারী কায়া পুরুষালি দেহের মাঝে ঢাকা পড়ে গেছে।ধ্যান ভঙ্গ হয় খুশবুর।কানের কাছে ঘুমঘুম রাশভারী কন্ঠস্বরে প্রশ্ন আসে,

-“কোনটা বেশি সুন্দর?এই নিসর্গ নাকি নিসর্গে মায়া ছড়ানো আমার ক্যামেলিয়া ফুল?”

বাতাবরণ আর আফতাব উভয়ের স্নিগ্ধ আবেশে আবেশিত হয় খুশবু।দেহ হালকা হালকা অনুভব হচ্ছে।মাথা এলিয়ে দিলো কিছুটা পেছনের দিকে। দূর পাহাড় চূড়ায় চাহনি আবদ্ধ করে জবাব দিলো,

-“নিঃসন্দেহে এই নিসর্গ সুন্দর।আপনার ক্যামেলিয়া অত বিশেষ কেউ নয়”

-“মনে আছে বলেছিলাম নির্বিশেষে মন মজেছে গল্প তাহলে অনেকদূর এগোবে?”

-“হুম”

-“গল্প আমাদের একে অপরের ঠিক এতটা কাছাকাছি এনেছে যে কেউ চাইলেই দূরত্ব সম্ভব না।বিয়ে হয়েছে। আগামীতে বাবা মা হবো।দায়িত্ব আসবে।ধীরেধীরে বয়স বাড়বে।ছেলেমেয়ের বিয়ে শাদী দিতে হবে। বুড়ো হয়ে আবার এখানে দুজন ফিরে আসবো।একে অপরের সাথে সময় কাটাবো।দেখবেন আমাদের বৃদ্ধ বয়সের বসন্ত নতুন ভালো লাগা বয়ে আনবে।”

_________

স্বপরিবারে খুশবুর রিসিপশনে দাওয়াত করেছিলো নোমানকে।সে আসেনি। ব্যস্ততায় ফোন করা হয়নি আর।পাশাপাশি নেহার বিষয়টাও ভাবাচ্ছে।কোনো কল নেই কোনো মেসেজ নেই।দিনে নিয়মমতো একবার হলে অন্তত একটা মেসেজ করতো।চারদিন যাবত তাও বন্ধ।অনলাইনেও পাওয়া যায় না তাকে।

চিন্তা ভাবনা শেষে ফাহাদ সিদ্ধান্ত নিলো নিজে থেকেই কল করে খোঁজ নেবে।ডায়াল করে নেহার নাম্বারে।অন্যপাশ থেকে ভদ্র মহিলা বলে উঠেন ‘এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নম্বরটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না’।ফাহাদ আরো কয়েকবার চেষ্টা করে একই জবাব শুনতে পায়।মনের এক কোণে চিন্তার রেশ।অত্যন্ত একটিভ একটা মেয়ে সোশাল মিডিয়াতে।যেনো ইন্টারনেট জগৎ বিহীন একদিন তার জীবনে অনেক কিছু।সেখানে চারটি দিন অনেককিছু।কোনো বিপদ হলো নাতো?সবশেষে ফোন মেলায় হোয়াটস অ্যাপে।এখানে রিং হলো।রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে পুরুষালি আওয়াজ শুনতে পেলো ফাহাদ।

-“হ্যালো?”

রাশভারী গলায় জবাব এলো, -“নোমান বলছি”

একটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো ফাহাদ।নেহার ফোন নোমান রিসিভ করবে কল্পনাও করতে পারেনি। এমতাবস্থায় কোনো জবাব এলো না ফাহাদের তরফ থেকে।নোমান কিছু সময় অপেক্ষা করে বললো,

-“কিছু বলবি ফাহাদ?”

-“নাহ! মানে খুশবুর রিসিপশনে এলি না যে?”

-“একটু ব্যস্ত ছিলাম”

নোমান কখনোই এত ভারী গলায় কথা বলেনা। কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছে ফাহাদের প্রতি।এরমধ্যে অসস্তিকর একটি পরিবেশ বিরাজ করলো।ফাহাদ জবাব দিলো,

-“তোকে কল করেও পেলাম না….”

-“তুই কোথায়?”

-“আছি নানী বাড়িতেই।সিলেট”

-“বিকেলের দিকে ক্যাম্পাসে আসিস”

______

ফাগুনের রাতে মেঘহীন গগনে নক্ষত্রের মেলা বসেছে।পর্বত ঘেঁষে অমৃতাংশু’র বিস্তৃত জ্যোতি।শীতল বাতাসে মিশে অনুরাগের সুর, রাত্রী জাগা পাখির কলরব।জ্যোৎস্নার লহর দৃষ্টি ইন্দ্রিয় মত্ত করছে।পাহাড়ের চূড়ায় বসে দুজোড়া চোখ মন্ত্রমুগ্ধ। পাশেই জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা যেন মিলে মিশে এক মোহে।বসন্তের প্রকৃতির কোলে শান্তি, হৃদয়ে অনুরণন।

আফতাব খুশবুর কটেজটা সবচেয়ে উঁচু টিলায়। নির্জনতায় ঘেরা প্রশান্তির এক পরিবেশ। কোথাও কোনো কোলাহল নেই।নেই যান্ত্রিক কোনো ছাপ।আছে স্নিগ্ধতা, মোহমুগ্ধ ঘ্রাণ। উচুঁ সুবিশাল গাছের ডালে কাঠের নির্মিত দোলনা বাতাসে আপনাআপনি দোল খাচ্ছে। সমতল ভূমি থেকে এতটা উচ্চতায় পবন হিমশীতল। গাঢ় নীল রঙের চাদরে খুশবুকে ঠাঁয় দিয়েছে বুকে।তার পেছনে এক প্রাচীরের মতন। উঁচু টিলার প্রান্তে বসে চন্দ্রবিলাসে মত্ত। চাঁদটা ঠিক তাদের মুখোমুখি।খুশবু এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো।করে বসলো বিচিত্র এক প্রশ্ন,

-“কথা দিয়ে কথা রাখছেন,বিনা কারণে ভালোবেসে যাচ্ছেন।বিনিময়ে কিছুই চাইছেন না।এমনটা কেনো?”

-“যে যার জন্য বরাদ্দ তাকে ভালোবাসতে কারণের প্রয়োজন নেই।আর যাকে মনে প্রাণে ভালোবাসা যায় তার জন্য সবটুকু উজাড় করতে ক্ষতি কি?”

-“আপনার কখনো রাগ হয়না?আর কষ্ট? কোনোটাইতো মুখ দেখে বোঝা যায়না।”

আফতাব জবাবে স্মিত হেসে বলে,

-“চেষ্টাতো অগোচরে করছেন।একদিন ঠিক বুঝে যাবেন।”

-“চেষ্টা করছি তবে আমি জানতে চাই।আপনার পছন্দ অপছন্দ….”

খুশবু আগ্রহ প্রকাশ করছে।তার এই চঞ্চলতাকে ধামাচাপা দিলো না আর।সাদরে গ্রহন করলো তার আবদার।কয়েক বাক্যে নিজেকে ব্যক্ত করে বলতে লাগলো,

-“সৃষ্টির সবকিছুই আমার পছন্দ।রাগ?…উম হয়।তবে রাগ-কষ্টের ঝড় নিজের মধ্যেই উঠে আবার নিজের মধ্যেই থেমে যায়।এতে কারো ক্ষতি হয়না কেউ জানেও না।”

-“আমারতো জানা উচিত তাই না?….আচ্ছা আপনি আপনার জীবনে শতভাগ খুশি?”

-“সীমান্তে সীমান্তে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।অনেক অফিসারদের দেখেছি ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে।নিজের জীবনের সব রং হারাতে দেখেছি।পাগলপ্রায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে একাকিত্বে।আমি যখন একাকীত্বের লাগাম ধরতে শুরু করলাম?তখন আর বেদনা আমাকে হাতছানি দেয়নি।পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্টতো আছে খুশবু।তবে আপনাকে পেয়ে আমি শতভাগ সুখী।”

খুশবু কান পেতে শুনলো।খুব কাছ থেকে নিঃশ্বাসের সাথে কন্ঠধ্বনি অনুভব করছে।সাথে তার সরল সাজানো কথা।নীলাভ চাদরের উঠে যাওয়া সুতো বিরস মুখে টানতে টানতে খুশবু বললো,

-“আমার কখনো কখনো মনে হয় আমি আপনার অগাধ ভালোবাসার মূল্য দিতে পারছি না।”

-“কেনো মনে হয়?”

-“ভাইয়া আমাকে বলে আমার মস্তিষ্ক ছোট। ঢিলেমি করে সব কাজে। একটু স্লো বটে।আপনি হুট করে ভালোবাসা দিয়ে চলে যান আমি ভাবতেই থাকি”

বয়স বাইশ পেরিয়েছে।শাড়ি পড়ে সেজেগুজে থাকলে পাঁকা গৃহিণীর চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয়না।অন্যদের সামনে চুপচাপ থাকলেও আফতাব এর উপর জোর খাটিয়ে কথা বলা মেয়েটা মাঝেসাঝে বাচ্চাদের মতন করে কথা বলে। আহ্লাদী মনে হয় তাকে।

গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় আফতাব।হলদে আলোয় চোখের মনিযুগল জ্বলজ্বল করছে।মোহগ্রস্ত হয় পদে পদে।হৃদয় ঝংকার তুলে। পলকহীন চেয়ে বললো,

-“আপনার ভাবুক চোখে আমি স্বর্গ দেখি”

চলবে…