তেইশতম বসন্ত পর্ব-১৯

0
10

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ১৯
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

পাহাড়ে বসন্তের প্রথম বৃষ্টি, চূড়া বেয়ে নামছে সুরের ইতিকথা।চা-বাগানের পাতায় পাতায় মৃদু বর্ষণের সুরেলা সঙ্গীত বেজে উঠে দুর দিগন্ত হতে।ঘ্রাণে মাতোয়ারা সর্বখান। নীরবতার মাঝে জেগে ওঠে অনুভূতির একদল। নীরদের কোলে বয়ে বেড়াচ্ছে শীতলতা,প্রকৃতির বুকে আঁচড়ে পড়া ব্যাকুলতা।নদী-ঝর্না মিলে দূরে কোথাও গায় বৃষ্টির গাঁথা, সৃষ্টির বুকে ফুটে ওঠেছে নীলাভ স্বপ্ন। শৃঙ্গের ধারে ছুঁয়ে যায় বদলের ছোঁয়া,সবুজের আঁচলে মিশে সেই মোহনা।বসন্তের ক্রান্তিলগ্নে এই বৃষ্টিতে প্রাণ জেগেছে নতুন,মাটিতে বাজে সজীবতার কীর্তন।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে পাহাড়ের বুকে রাত হতে। গাছপালা ভিজে একাকার।এবারে আফতাবকে টেনে তুলে আবদার করলো খুশবু।গতকাল টয় ট্রেন দেখেছে রিসোর্টে।এই ট্রেনটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে।বিনোদনের একটি অংশ। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বরাবরই আছে আফতাব এর।খুশবুর তা নেই।বাহু ঝাঁকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়া আফতাবকে।গায়ে দেওয়া পাতলা ব্ল্যাংকেট টেনে ধরলো।বললো,

-“আপনি দিনদিন ভারী অলস হচ্ছেন।ঘুরতে এসে পরে পরে ঘুমোচ্ছেন!”

পিটপিট করে চাইলো আফতাব। হেঁচকা টানে খুশবুকে তলিয়ে ফেললো নিজের বক্ষ গহ্বরে।সাদা ব্ল্যাঙ্কেট টেনে জড়িয়ে নেয়।

কি ভেবেছে বুকের উষ্ণতায় ভুলে যাবে টয় ট্রেন এর কথা?একদমই না।কয়েকদফা আফতাব এর বুকে আঘাত করলো। বললো,

-“উঠুন!আমি টয় ট্রেনে চড়ে বন জঙ্গল দেখবো।”

আফতাব খুশবুর কেশমালায় মুখ গুঁজে।মাতাল করা সুবাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করলো।নিস্তেজ অনুভূত হলো কায়া। নেশাতুর চোখে খুশবুর পানে চেয়ে বললো,

-“খুশবুর খুশবুতে নিস্তেজ অনুভব করছি….ভালোবাসার ঝলক দেখিয়ে সতেজ করে তুলুন।”

-“ভালোবাসা ইনভিজিবল।দেখা যায় না।”

-“আমার বিবর্ণ চেহারায় কোমল অধরের পরশ দিতেই পারেন।”

খুশবু মুখ নামিয়ে নেয়।একাজ তার দ্বারা হবেনা।আফতাব কোমরের দিকে আরো একটু আঁকড়ে ধরে বললো,

-“দেরি হচ্ছে খুশবু।যাবেন না?দ্রুত কাজটা সেরে ফেলুন।”

-“আপনি উঠুন এসব ভন্ডামি বাদ দিয়ে।” জোর গলায় বলে উঠলো খুশবু।

আফতাব নাছোড়বান্দার হয়ে গেলো যেনো।ভালোবাসা ছাড়া দেহে জোর পাচ্ছে না।এমন একটা ভাবভঙ্গি ধরে রইলো। খুশবু বললো,

-“উঠবেন না?”

আফতাব নিজের গাল এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“উঠবো তবে আমার পাওনা আদায় হলে।”

খামচি দেওয়ার বাজে একটা স্বভাব আছে খুশবুর।কতবার তার বড় ভাই এমন কীর্তি কলাপের স্বীকার হয়েছে তার হিসেব নেই।শয়তানি হাসি ফুটলো খুশবুর মুখে।ভালোবাসার সাথে আঘাতের ব্যালেন্স মন্দ হয়না।মিথ্যে হেঁসে এগিয়ে রাখা গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মিষ্ট পরশে বিগলিত সমীপেই হাতে ধারালো নখ ছুরির মতন বিধে গেলো।আফতাবের প্রতিক্রিয়া শূন্য হওয়ার মতন অবস্থা।এই সুযোগে খুশবু উঠে গিয়ে বললো,

-“আপনার জীবনের আর্মি আমি।আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করার প্র্যাকটিস করুন।তাহলে ভালোবাসা পাবেন।নয়তো আঘাত।আমার খামচি দেওয়ার সাথেসাথে কামড়ে দেওয়ার গুণটাও আছে।”

আফতাব হাতের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো,

-“রাক্ষসী নারী…”

-“হ্যাঁ কখনো কখনো মাঝরাতে রক্ত পিপাসু হয়ে পড়ি। ঘাড় থেকে রক্ত শুষে খেয়ে তৃপ্তি পাই।সাবধানে থাকবেন।”

আফতাব এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।ঠোঁটের কোণে অল্পস্বল্প হাসি।আসতে আসতে একেবারে কাছে এসেই দাঁড়ালো।থুতনি চেপে আচমকা ঠোঁটে চুমু খেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিলো খুশবুকে।এটাই প্রথম আর সরাসরি ছুঁয়েছে আফতাব। ঢুলুঢুলু অবস্থা খুশবুর।ঝড়ের গতিতে এসে নিঃশ্বাস কেড়ে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে।কয়েক সেকেন্ড পর কানের পেছনে চুল গুঁজে গিয়ে কানের কাছে এসে বলতে লাগলো,

-“রক্ত শুষে নেওয়ার পূর্বে এভাবে চুমু খেলে আমি বিনা দ্বিধায়,বিনা বাঁধায় এক পায়ে রক্ত দান করতে রাজি।”

স্নিগ্ধ এই সম্পৃক্তি।একে অপরের সহিত হৃদসঙ্গম এর শব্দহীন প্রয়াস।আফতাব জানে খুশবুর অন্তরের সমস্তটা।ধীরেধীরে তার মাঝে পুষ্পের ন্যায় প্রস্ফুটিত হচ্ছে ভালোবাসা।স্বীকার করতে শব্দের অভাববোধ করছে।কখনো কখনো মনে হয় কেমন যেনো এক ছন্নছাড়া ভাব হয়ে যাচ্ছে দুজনার মাঝে।এই দূরত্ব ভুগিয়েছে;ভবিষ্যতেও ভোগাবে।একটা যথাযথ পরিকল্পনা প্রয়োজন। খুশবুর হৃদয় না আবার তিক্ততায় ভরে উঠে ভবিষ্যতে।দূরত্ব হৃদয়ের মাঝে সীমারেখা না এটে ফেলে? খুশবুর মায়া মুখে চোখ গেলেই হাহাকার করে আফতাব এর হৃদয়।কেমন জীবন?চাইলেও এই মানুষটাকে জড়িয়ে ধরা যাবে না। চাইলেই কোলে মাথা রেখে খোশগল্প করা যাবে না।এই জীবনে,এই পেশায় পরিকল্পনা চলে না।এখানে ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই।আবেগ, অনুভূতি সবটাই তুচ্ছ।হৃদয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভুগলে চোখ চিরে দু ফোঁটা জল গড়ানোও বারণ।অন্তর চিৎকার করে মাঝেমধ্যে জানাতে চায় ভালোবাসার গভীরত্ব।এই হৃদয় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত তার মোহে। তা হয়ে ওঠে না। ভালোবাসায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে দূরত্ব সহ্য করতে পারবে না এই মেয়েটি।তবে দূরে থাকা যে আফতাব এর জন্য অসহনীয়।মস্তিষ্কে ফ্যাসাদ!

খুশবুর চঞ্চল মুখপানে চেয়ে ভাবছে আফতাব। আধাঁর ঘনাচ্ছে চোখে মুখে।সে মহাখুশি। ডাগর ডাগর আঁখিতে পরিবেশকে ধারণ করতে ব্যস্ত।হাত উচুঁ করে দেখাচ্ছে আফতাবকে।কিন্তু আফতাব এর ধ্যান সেখানে নেই।তার মধ্যে চলছে অন্যকিছু।এই দিনগুলো শেষ হলেই ফিরে যেতে হবে তার।এরপর কবে ফিরবে জানা নেই।

খুশবু ফিরে চাইলো।আফতাব তার গম্ভীর মুখ শুধরে হাসি উপহার দিলে তাকে।আহ্লাদী হয়ে বুকের সাথে ঘেঁষে বসে খুশবু।প্রশ্ন করে,

-“আপনার মুখের উপর বারোটা বেজে ছিলো কেনো?”

-“কই?” ঠান্ডা স্বরে বললো আফতাব।

-“আমি চারিপাশ দেখছি বলে কি ভেবেছেন আপনার উপর খেয়াল নেই আমার?আনমনা হয়ে ছিলেন দেখেছি আমি”

-“শুনেছিলাম বউদের চার চোখ।বিশেষ করে স্বামীর ক্ষেত্রে।আপনি সেটা প্রমাণ করে দিলেন।”

খুশবু আবার ফিরে চায় আফতাব এর দিকে।চোখ ছোটছোট করে চেয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে বললো,

-“স্বামীকে চোখে চোখে রাখতে হয়।পুরুষ মানুষের মন কখন উড়াল দেয় বলা যায় না।”

আফতাব হাসলো।সন্দেহ করা যেনো নারীদের একটা স্বভাব।তার মা-ও কম যায় না।কলেজ জীবনে একটা মেয়ের সাথে দাঁড়াতে দেখে এক সপ্তাহ সন্দেহ করেছে। খুশবু বাদ যাবে কেনো?সেও করুক।আফতাব জবাবে বলে,

-“তাহলে বেঁধে ফেলুন একেবারে?যেনো চাইলেও হাতছাড়া না হই”

নির্বোধের মতন চাইলো খুশবু। হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে।এই লোকতো আগেই বাঁধা পরে আছে।আর কত বাঁধবে?তারপরও তার কথার অর্থ জানার ইচ্ছে হলো।প্রশ্ন করলো,

-“কিভাবে বাঁধবো?দড়ি নাকি শিকলে?”

আফতাব ঘন নিঃশ্বাস খুশবুর মুখের উপর ফেলে বললো,

-“গভীরতম ভালোবাসায়”

এবারও জিজ্ঞাসু দৃষ্টি খুশবুর।টয় ট্রেনটা নিজের স্থান অনুযায়ী বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলছে।পাখির কুহুকুহু ডাকে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে তুলছে অনেকটাই। খুশবুর পানে চেয়ে আফতাব বুঝতে পারলো এই ছোট মস্তিষ্কে কথা ঢুকেনি।ফিরতি প্রশ্ন করার পূর্বেই আফতাব ব্যাকুল গলায় বলে উঠে,

-“এইতো কিছু সময়,কিছু ঘন্টা।আবার দূরত্ব আসবে খুশবু।আর এই কঠিন বাস্তব আমার আপনার উভয়ের মানতে হবে। লুকোচুরির কিছু নেই।আমি আমার সাথে এক আকাশসম অনুভূতি নিয়ে যেতে চাই।আপনার মাঝে ডুবে দূরত্বের পীড়া ভুলতে চাচ্ছি।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে চাচ্ছি।মুগ্ধ হতে চাচ্ছি খুশবুতে।আপনার নিবিড়-অত্যুষ্ণ নিঃশ্বাস আমাকে অন্তত বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে সেখানে।নয়তো মৃত্যু….”

খুশবু হাত বাড়িয়ে আফতাব এর ঠোঁটের উপর রাখলো।এসব অলুক্ষণে কথাবার্তা শুনতে চাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই চোখ টলমল করতে শুরু করেছে।ওই এক ভরসার স্থানে মুখ লুকায়।নয়তো কেঁদে ফেলবে।আফতাব প্রশ্ন করলো,

-“ভালোবাসেন?”

-“আপনার মতন করে কখনও ভালোবাসতে পারবো না কখনো।আপনি পুরোটাই বরফে ঢাকা এক শীতল পাহাড়।তবে এগারোদিনের দূরত্বে বুঝেছি আপনাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

________

গতকাল লজ্জাজনিত কারণে সাক্ষাত হয়নি নোমানের সাথে।তবে এভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়না বন্ধুকে।তাই নিজেকে সামলে বেরিয়ে পড়লো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে।কে জানে কি বলবে নোমান?কি চলছে তার মনে?তার আওয়াজ সর্বদা স্বতঃস্ফূর্ত থাকে।অনেকদিনের বন্ধুত্ব। কন্ঠস্বর চালচলন প্রায় মুখস্ত।কিন্তু এবারে কথা বলার ধাঁচ ভিন্ন আর রুক্ষ মনে হয়েছে।নেহার সাথে আলাপ কি অনুচিত ছিলো তাহলে?

গাছ তলায় বেঞ্চির নিচে আড়াআড়িভাবে বসে আছে নোমান।পাশেই তার আরো কয়েকজন জুনিয়র ছেলে।বন্ধুরা তেমন কেউই নেই।সকলেই মাস্টার্স শেষ করে যারযার মতন চলে গেছে। রাজনীতির ডায় হার্ট ফ্যানগুলোও জীবনের চাকার সাথে এগিয়ে পলিটিকাল লাইন থেকে দূরে।

দূর হতে বন্ধুকে আসতে দেখে হাত তুললো।বাকিদের জন্য যেনো ইশারাই যথেষ্ট।একে একে সকলে চলে গেছে। ফাহাদ নোমানের সামনে এসে দাঁড়ালো।নোমান তাকে বসতে বলে পেছনে থাকা চা ওয়ালা মামাকে বললো,

-“দুই কাপ চা দেন মামা”

পূনরায় ফাহাদের দিকে চেয়ে মলিন হেসে বললো,

-“বোস”

চা আসতে আসতে দুজনের মধ্যেই নীরবতা।তেমন কিছুই হয়নি।তবে ভাবতে গেলে অনেক কিছুই ঘটেছে।ফাহাদের নিজের একজন ছোট বোন আছে।সেও নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখতো না বিষয়টাকে।নোমান কথা শুরু করলো।বললো,

-“চুপ হয়ে আছিস যে?”

ফাহাদ চট করে প্রশ্ন করে,

-“তুই কি আমার উপর কোনো কারণে রাগ?না মানে আমার ফোন রিসিভ করলিনা।নেহাকে আমি কল করেছিলা…”

নোমান চোখ নামিয়ে হাসে।বলে,

-“রাগ করার মতন কিছু করেছিস কি?”

ফাহাদ চুপ হয়ে গেলো বলতে বলতে।বন্ধুর চোখে চোখ মেলানোর মতন সাহস নেই।তার পাশে রাখা চা ঠান্ডা হচ্ছে।সেখানে কোনো হুশ নেই।সে চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে।নোমান অনেকটা সময় পর বলে উঠলো,

-“নেহার ফোন আমি নিয়ে নিয়েছি।ওর পরীক্ষা আগামীকাল থেকে।”

যেমনটা ধারণা করেছিলো সেটাই।নেহার বিষয় উঠতেই কেমন যেন হৃদয় ছলাৎ করে উঠলো।বুঝে উঠতে পারলো না ফাহাদ।জবাবে বললো,

-“ভালো করেছিস।পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া উচিত।”

-“ওর বয়সটা কম… এই বয়সে এমন অনেককিছু করতে ইচ্ছে হবে যা ওর জন্য মঙ্গলজনক নয়।”

আরো নত হলো ফাহাদের নেত্র।নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে।নোমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো,

-“বোনের বিয়ে দিলি। চাকরি পেয়েছিস।নিজে বিয়েটা কবে করছিস?”

ফাহাদ স্মিত হেসে বললো,

-“এখনও এসব নিয়ে কিছু ভাবছি না ভাই।তুই বল! তোর কি প্ল্যান?”

-“আমার প্ল্যান আগেরটাই।”

-“স্টার্ট আপ?”

-“আগামীকাল উদ্ভোধন।চলে আসিস।নাকি ঢাকা চলে যাবি?”

অনেক সময় পর নোমানকে স্বাভাবিক মনে হলো।তাই ফাহাদ তার লটকে থাকা মুখ ঠিক করে।আগ্রহী ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

-“না আছি।আগামীকাল কখন আসবো?জানাস কিন্তু।সময়মতো হাজির পাবি আমাকে।”

বাড়ি থেকে ফোন এসেছে ফাহাদের।বাবা জানিয়েছেন কিছু উপহার কিনবেন আফতাব এর পরিবারের জন্য।ফাহাদ উঠে দাঁড়ালো।বিদায় জানিয়ে যাওয়ার পূর্বে নোমান জিজ্ঞেস করে বসে,

-“তুই আর নেহা কি একে অপরকে ভালো…. মানে পছন্দ করিস?”

পা জোড়া থমকে যায় ফাহাদের।এইতো স্বাভাবিক হয়েছিলো নোমান আর তার মধ্যে সবটা। আবারও এই প্রশ্নে অস্থির অনুভব করছে।ফিরে চাইলো নোমান পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে।সরাসরি প্রশ্ন করেছে।ফাহাদ নত সুরে জবাব দেয়,

-“এমন কিছুই না”

-“আমি জানি তুই এমন কিছুই করবি না যাতে করে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।”

ফাহাদ উপর নিচ মাথা দোলায়। ‘ আসি’ বলে চলে গেলো।তবে তার চোখে স্পষ্ট দেখেছে। আভাস পেয়েছে নোমান।কেমন যেনো সবটা উল্টো হয়ে গেলো।বন্ধুর বোন হিসেবে খুশবুর প্রতি তার মধ্যে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র অনুভূতিতে ধামাচাপা দিয়েছিলো সে।তার বিয়ের পর ওই ভালো লাগাটাও দাফন করেছিলো জমিনে।স্বল্প ভালো লাগা ছিলো।অতটা মাথা চাড়া দেয়নি।বিয়েতেও যায়নি নোমান। বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো আঁচ আসুক সে চায় নি।সেখানে কিনা তার বন্ধুর চোখে নিজের বোনের জন্য মায়া দেখতে পাচ্ছে?নিজেকে নিয়েই ভাবছে নোমান।সে কি বিষয়টা মানতে পারছে না?জেদ তুলছে?ঠিক তখনই ধ্যান ভাঙলো মেয়েলি ক্যাটক্যাটে কণ্ঠে।

খুব তাচ্ছিল্য করে কাউকে বলে যাচ্ছে,

– “আজকাল রাজনীতি করা সব ছেলেই নিজেকে নেতা ভাবে।দুইদিন হয়না রাজনীতিতে চেলাপেলা নিয়ে ঘুরতে শুরু করে।যেনো তারাই রাজা।দেখিস না আশপাশে?মানুষের কি ভাব!”

নোমানের মেজাজ বিগড়ে গেলো।দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা তাদের ক্যাম্পাসের।তাকেই উদ্দেশ্যে করে শুনিয়ে এসব বলে চলেছে।পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলো তার দিকে।

_________

বৃষ্টিস্নাত রাত,

ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে আছে পারিপার্শ্বিক বাতাবরণ।মেঘের চাদরে মোড়ানো চাঁদের আলো সাথ দিচ্ছে কৃত্রিম মরিচা আলো-কে।মন হারাচ্ছে প্রিয় রূপে, মিশে একাকার ধূসর রাতে।যেনো এক মিলনের উৎসব।উৎযাপন করছে সারা প্রকৃতি।রিমঝিম বৃষ্টির শব্দে মুগ্ধতা জড়ানো।বছরের প্রথম বৃষ্টি।চোখের সম্মুখে যে চোখ আছে?সেখানে সুখের রোয়া।নিঃশ্বাস হারাতে বসেছে এক পুরুষালি হৃদয়।প্রেমজলের স্রোতে ভেসে, সুখের সুরে বাঁধছে।পাহাড়ের আঁচলে মিশে গোপন গল্প বুনছে।প্রিয়তমার চোখের আলোতে রাত্রি আরও মধুর।একে অপরের মাঝে স্বর্গীয় সুখ খুঁজে পাওয়ার অস্থিরতা।মেঘলা আকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের ঝলকানি।মাটির ঘ্রাণ ভেসে আসে খোলা জানালা হতে।পর্দা নড়ছে অনবরত।কম্পিত দেহখানা সামলে কানে কানে প্রেমের মিষ্টি ভাষা আওড়ে আফতাব বললো,

-“আপনার সামনে আমার যে রূপটা প্রকাশ পাচ্ছে সেটা এই পৃথিবীর কেউ হয়তো কখনো দেখবে না।কল্পনাও করতে পারবে না।স্বামী স্ত্রী সম্পর্কটা সেভাবেই তৈরি করা”

আবেশে নিমজ্জিত খুশবু নড়েচড়ে উঠলো।চোখ মেলে চাওয়ার সাহস নেই।আফতাব এর চোখে আজ অগাধ আকুলতা দেখেছে। সম্পুর্ণ ভিন্ন একটা মানুষ।নিজেকে সপে দিয়ে ঘোরে আচ্ছন্ন মেয়েটি অনুভব করছে আফতাব এর ভালোবাসার ঘনত্ব।তার এই ভিন্ন রূপে নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে দিয়ে শীতল অনুভূত হয় সর্বাঙ্গে।বুকের মধ্যে চলা ঝড় হয়তো থামবে না আজ রাত্তিরে।বাহির থেকে আসা মরিচা বাতির আলো যেনো লাজ আরো বাড়িয়ে তুললো।মুখ ঘুরিয়ে ফেলে তৎক্ষনাৎ। গালে আফতাব হাত রাখতেই আরো চুপসে গেলো যেনো।কপালে চুমু খেয়ে আফতাব রয়ে যায় সেখানেই।নিজের সম্পূর্ণ কপালের ভার রাখলো খুশবুর ললাটে।রক্তিম বর্ণ ধারণ করা মুখটা দেখে দিলো আরো একবার মাদকতা পূর্ণ নয়নে।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“আপনার থেকে দূরে থাকা আরো অসম্ভব হয়ে পড়বে….আমাকে পুরোপুরি বশ না করলেই পারতেন।”

খুশবুর নরম গালে রুক্ষ গাল লেপ্টে আছে। ক্ষণিক বাদে ভেজা অনুভব করলো। চট করে মুখ তুলে চায় আফতাব।বিচলিত হলো চোখ বেয়ে জল গড়াতে দেখে।অশান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

-“কাঁদছেন কেনো?”

পুরুষালি ভারে পৃষ্ট হয়ে থাকা কায়ার পীড়ার চেয়ে হৃদয়ের আর্তনাদ বাড়িয়ে চড়িয়ে কষ্ট দিচ্ছে।এই সুন্দর মুহূর্তে ‘দূরত্ব’ শব্দটি না তুললেই নয়?আফতাব এর প্রশ্নে কান্নার জোর বাড়লো।আফতাব পুনর্বার প্রশ্ন করে,

-“ভালোবাসা কম হয়ে গেছে?এই কারণে কাঁদছেন?বলুন এক্ষুনি বলুন।আপনার খেদমতে বাকি রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে রাজি।”

হাসানোর চেষ্টা ব্যর্থ।উল্টো রেগে গেলো খুশবু। নাক ফুলিয়ে গোলগোল চোখে চেয়ে বললো,

-“একদম বাজে কথা বলবেন না!”

-“বাজে?কিসের বাজে কথা?আপনার পুরো অধিকার আছে ভালোবাসা আর আদর পাওয়ার।সুযোগ বুঝে লুফে নিন।বখাটে লোকটা আজ মন খুলে উজাড় করেছে,করবে।”

নিজের বাজে স্বভাবের প্রমাণ দিয়ে আবার খামচে দিলো আফতাব এর উন্মুক্ত বাহু। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,

-“আপনি কোথাও যাচ্ছেন না! কোথাও না!আমার চোখের সামনে;আমার কাছে থাকবেন”

আফতাব দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো কাছাকাছি এসে ঘোর কণ্ঠে বললো,

-“কাছেই-তো আছি।”

-“আমি চাকরির কথা বলেছি।আপনার চাকরি করা লাগবে না।বেকার থাকবেন”

আফতাব খুশবুর ঘাড়ে মুখ গুঁজে।বলে উঠে,

-“তারপর দুজন মিলে সিলেটের রাস্তায় ভিক্ষা করবো।দিন আনবো দিন খাবো।”

-“সেটাই সই!”

-“রাগ কমবে কি করলে?”

-“আপনি আমার সাথে সবসময় থাকলে”

ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলে আরো একবার খুশবুকে। ঘাড়ে আলতো আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায়। মোহিত স্পর্শে।রাগী নিঃশ্বাস মিয়ে এসেছে মিনিট খানেকের মাঝে।সময়ের সাথেসাথে পুরো অমর্ষ বিলীন হয়ে গেলো খুশবুর।সুন্দর সূচনা প্রণয়ের। সম্পর্কের বাঁধন শক্তিশালী হয়ে উঠে। খুশবুতে ডুবে নিজেকে পেয়েছে যেনো। ভবিষ্যত দূরত্বের পীড়া ভুলে খুশবু ভাসমান প্রেম সাগরে।

প্রভাতের প্রারম্ভে গুমোট পরিস্থিতি।বাহিরে চেয়ে মনেই হচ্ছে না দিবার প্রহর। তমসাচ্ছন্ন সায়াহ্নের মতন পরিবেশ।গুমোট মুখটা খুশবুরও।মুখ ফুলে আছে।গালের উভয়প্রান্তে লাল আভা।ভেজা চুল বেয়ে টপটপ পানি গড়াচ্ছে।এতে তার কোনো হেলদোল নেই।ঠোঁট উল্টে বারান্দার দিকে চেয়ে। মেঘগুলোকে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে দেখছে।মনে হচ্ছে তাদের মুক্ত।তার মেজাজ কেনো খারাপ সে নিজেও জানে না। ইংরেজিতে ‘মুড সুইং’ বলে একে।সেটাই বোধহয় হচ্ছে তার সাথে।বসে রইলো ঠাঁয়।বিছানা ভিজে একাকার চুলের পানিতে।আফতাব ঘাড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো এই অবস্থা।পায়ের দ্রুততা বাড়িয়ে এসে বললো,

-“চুল মুছছেন না কেনো?”

-“মন চাচ্ছে না তাই”

-“আবার রেগে আছেন?”

-“নাহ!”

আফতাব তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এলো। খুশবুর পিঠ ঘেঁষে বসে চুল মুছে দিতে দিতে বললো,

-“ভেজা চুলে আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে?”

-“ফালতু কথা বললে আপনার মাথা ফাটিয়ে দিবো আমি!”

-“এমা!….আচ্ছা সরি।এখন থেকে দূরে দূরে থাকবো কেমন?”

খুশবু আকস্মিক বলে উঠলো,

– “থাকবেনইতো! দূরেই তো যাচ্ছেন।কবে আসবেন সেটার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।”

-“আচ্ছা রাগটা তাহলে এই কারণে?”

-“চুপ থাকুন!আপনার কথা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

ঠোঁট টিপে হেসে উঠলো আফতাব।ভালো করে চুল মুছে খুশবুকে টেনে দাঁড় করায়।আচমকা কোলে তুলে নিলো তাকে।বাহিরেই টিলার দ্বারপ্রান্তে একটি বড় দোলনা আছে।সেখানে গিয়ে বসে পড়লো।তার বউ মুখ ফেরায় না।অভিমান হয়েছে তার।সাথে আকাশেরও।দোলনার হাতলে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে টেনে নিলো খুশবুকে।আধ ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো। গালে হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,

-“জানেন খুশবু? প্রকৃতির বাতাসে হৃদয়ের রোগ সেরে যায়।আর দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়।যখন হুট করে আমাকে চোখের সামনে পাবেন সেই আনন্দ হবে অমুল্য।তৃপ্ত হবে হৃদয়।”

চলবে…