তেইশতম বসন্ত পর্ব-২০

0
11

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ২০
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

দিবা ঘেরা বিষাদ।মনটা আজ কেন যে অন্ধকারে,হৃদয়ের কথা বোঝে না পরিস্থিতি।দায়িত্ব নামক একটা শব্দ আছে,যা কোমল হৃদয়ে ভারী পাথরের মতোন পড়ে আছে।কষ্ট শুধু জমা হয় একাকারে।উজ্জ্বল দিবার আলোয় আঁধারের পথে হাঁটছে খুশবু।কোথাও নেই আশার আলো,মনের মাঝে বিষাদের দহন।চারিদিকে কেবলই শূন্যতা আর কালো।অপেক্ষার প্রহর গোনে এই পাশাপাশি সময়টা এখানেই থেমে যাক।মন যে কেঁদে উঠতে চাইছে বারবার।ফের সুখের দেখা মিলবে কবে?এই ভাবনায় বুকটা ভেঙে চৌচির।

ঘন্টাখানেক হলো ফিরে এসেছে আফতাব খুশবু।নায়লা বেগম,লোকমান চৌধুরী,ফাহাদ এবং জরিনা বেগমও আফতাবদের বাড়িতেই উপস্থিত।মা ও শ্বাশুরির মাঝখানে বসে তাদের গল্পে মগ্ন হতে চেয়েও পারছে না।মন বলছে প্রতিটা সেকেন্ড যেনো দরকারি।আগামীকাল আফতাব চলে যাবে।দুর হতে খুশবুর অন্যমনস্কতা দেখতে পায় আফতাব।এসে শালীন সুরে বলে উঠলো,

-“আমার ইউনিফর্ম কি আপনি রেখেছেন?আমি পাচ্ছি না।”

নায়লা বেগম আফতাব এর দিকে চাইলেন।আপনি ডাকটা কেমন যেনো শোনালো তার কানে। সচরাচর বুজুর্গ এবং অপরিচিতদেরকেই আপনি ডাকে মানায়।কিন্তু নিজের স্ত্রীকে?

খুশবু অবাক হয়ে চাইলো আফতাব এর চোখের দিকে।ইউনিফর্ম কোথায় সেটা খুশবু নিজেও জানে না। বললো,

-“আমিতো রাখিনি”

আফতাব জবাব দিলো,

– “আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আলমারিতেও নেই।আমার প্যাকিং বাকি এখনও….”

-“কিন্তু আমি আপনার ইউনিফর্ম দেখিনি।এসে কোথায় রেখেছিলেন।”

মনে মনে গাধা মেয়ে উপাধি দেওয়া শেষ।ভনিতা করে হেসে আফতাব দাঁত খিঁচিয়ে বললো,

-“আপনিই রেখেছেন খুশবু”

খুশবুর কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বে নায়লা বেগম বলে উঠলেন,

-“খুশবু?যাও সাহায্য করো আফতাবকে।”

মায়ের তুমি তুমি ডাকে বরাবরই অবাক হচ্ছে খুশবু।কি মধুর আওয়াজ।আগে শুধু ধমকের উপর রাখতো।বিয়েটা করে বোধহয় ভালোই হয়েছে।

আফতাব এর পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে আকস্মিক থেমে যায়।সামনে থাকা আফতাবকে ব্রেক কষতে দেখে খুশবু নিজেও দাঁড়িয়ে পড়লো।আশপাশে চোখ গিয়েছে।ইউনিফর্ম তার যথাযথ জায়গায়।আফতাব কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়।মুখ কুচকে এসেছে তার।বললো,

-“আমার ইশারা বুঝেন না?”

-“কখন কি ইশারা করলেন?”

-“আপনার মুখ দেখে বুঝে গেলাম আপনি মা আর শ্বাশুরি মায়ের সাথে আড্ডায় ইন্টারেস্টেড না।আপনার এখন আমাকে চাই।অথচ আপনি এটা বুঝলেন না কাজের বাহানায় আপনাকে আমি ডাকছি।”

খুশবু দাঁত বের করে হেসে বললো,

-“ছোটোবেলা থেকেই আমার বুদ্ধি-শুদ্ধি কম।”

-“তাতো কমই…আচ্ছা আপনার বাবা যে বললেন আপনার এক্সাম।আপনি ঢাকা যাবেন?”

বিয়ে শাদী করে পড়ালেখা চাঙ্গে তুলে ফেলেছে খুশবু।মনে পড়তেই মাথায় বাজ পড়লো যেনো।আবার এখন পড়ালেখাও করতে হবে?না করলে হয়না!অন্য মন বলে উঠলো আর তো মাত্র এক বছর।এরপর তথাকথিত গ্র্যাজুয়েট এর উপাধি নিয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে পারবে।

-“বলছেন না যে?”

-“বাবা মা যদি অনুমতি দেন তাহলে যাবো।”

-“পড়ালেখার বিষয়ে আমার বাবা ভীষণ স্ট্রিকড।আপনি অবশ্যই পরীক্ষা দেবেন।আমার মনে হচ্ছে বাবা আপনাকে ঢাকা নিয়ে যেতে চান।বলতে দ্বিধাবোধ করছেন।তাকে বলে দিবেন কোনো সংকোচ যেনো না করে।”

-“সত্যিই ঢাকা যাবো?”

খুশবুর গালে হাত রেখে আফতাব ঠান্ডা সুরে বলে,

-“আমি জানি আমার ক্যামেলিয়ার আমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে।ঢাকা গেলে অন্তত সময় পাড় হবে আপনার।ব্যস্ত থাকবেন।”

আফতাবকে জ্বালাতন করার উদ্দেশ্যে খুশবু বললো,

-“সেখানে সাহির নামক আপদটা আছে যে?”

-“সাহিরকে শায়েস্তা করার জন্য আমার অনুপস্থিতিতে আপনার বড় ভাইও আছে।তার সাথে আমার অলরেডি কথা হয়েছে।”

-“আমার ভাইকেও হাত করে নিয়েছেন?”

-“করবো না? আফটার অল সমন্ধি হয় আমার”

নীরব রাত, নক্ষত্রহীন আসমান।
আসন্ন একাকীত্বের ছায়া ধীরে ধীরে ঘেরাও করছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।প্রতিটা ঘন্টা যেনো সেকেন্ডের গতিতে যেতে লাগলো।হারানো সুরে ঢুকরে কাঁদায় অন্তর।অসীম শূন্যতা যেনো হাত তুলে আগামবার্তা জানাচ্ছে।

রাতটা কাটলো নির্ঘুম।ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠা খুশবুকে সামলে আফতাব এর চোখজোড়াও জ্বলজ্বল করছে।কি করে সামলাবে একে?যেনো হারিয়ে যাচ্ছে সে।এই বিলাপে মগ্ন খুশবু।কত বোঝালো?ফোন করবে,ভিডিও কলে আসবে।লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না।শেষমেশ বললো একদিন ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে।এটাই তাদের জীবনের নিয়ম।

ধীরেধীরে সকালের সূর্য ফুটে উঠে।সকাল ছয়টায় বেরোচ্ছে আফতাব।তৈরি খুশবুকে না জাগিয়েই।তৈরি হয়ে সব গোছগাছ করে নিলো।বাহিরে জিপ রেডি।আধ ঘন্টার মধ্যে বেরোবে। খুশবুকে ডাকলো। খুশবু একলাফে উঠে বসে।আবোলতাবোল বলে উঠে,

-“রাতটা শেষ হয়ে গেছে তাই না?আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?যাওয়ার সময় হয়ে গেছে?”

খিঁচে চোখ বন্ধ করে নেয় আফতাব।বুকটা ধ্বক করে উঠে। খুশবুর কন্ঠস্বরে চরম আকুতি।হাহাকার শুরু হলো অন্তরে।একপা বিছানায় মুড়িয়ে বসে খুশবুকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। বললো,

-“আছি আর কিছুক্ষণ”

খুশবু নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।বলে,

-“যাবেন না প্লীজ।আরেকটা দিন থেকে যান।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

-“এতটা মায়ায় জড়াবেন না খুশবু।আমার জন্য কাজে মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।”

-“আপনি একটা কাজ করুন না!যখন আপনার নাইট ডিউটি না থাকবে আপনি বাড়ি চলে আসবেন।আবার চলে যাবেন।এভাবে হয়না?”

বুকে পাথর রেখে আফতাব বললো,

– “হয় না খুশবু”

খুশবু লম্বা শ্বাস টেনে নেয়।ফের ছেড়ে দেয়।যা করছে নিতান্তই ছেলেমানুষী। আসলেই এভাবে চলবে না।চলে না।জীবন তার মোতাবেক চলবে না।আফতাব এর দিকে ফোলা চোখে চাইলো।লোকটার মুখ সবসময়ই মায়া মায়া লাগে।আজ ফ্যাকাশে লাগছে।এগিয়ে এসে চুমু খায় গালে।জড়িয়ে বললো,

-“ভালোবাসা দিয়েছি।এই লোভে দ্রুত ফিরে আসবেন।আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে আগে।”

আফতাব জবাব দিলো না কোনো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসলো বিনিময়ে।তেইশ বছরের এক বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছে।যে হাতে পায়ে বড় হলেও স্বভাবে হয়নি।

________

বিকেলের বাসেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে খুশবু আর তার পরিবার।অল্পতে মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া মন খুশবুর।রুমানা মির্জা এবং রফিকুজ্জামান মির্জাকে বিদায় দিতেও ভীষণ খারাপ লেগেছিলো।কিন্তু তিনদিন বাদেই পরীক্ষা।মাথায় বারেবারে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে, আফতাবের চলে যাওয়া সব মিলিয়ে পড়ালেখা গেছে ভেস্তে।বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে কেটে যাবে আরো একদিন।পড়বে কখন?এই ছোট্ট মাথায় এত চিন্তা নিতে ভালো লাগেনা। ফোনে আফতাবকে একের পর এক মেসেজ করেই যাচ্ছে খুশবু।জবাব পায়নি।লোকটা এমনই।কাজে মশগুল হয়ে যায় সাথে সাথে।

নিজের বাড়িতে কদম রাখতেই ফোন বেজে উঠলো।মেসেজ এসেছে।আফতাব লিখেছে,

-“সকালে কল করবো বউ।নাইট ডিউটি পড়েছে।খেয়ে নিবেন।বিশ্রাম নিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগী হবেন।এক আকাশসম ভালোবাসি”

রাত তিনটে বেজেছে ঢাকা ফিরতে।আফতাব এর মেসেজে হৃদয় শান্ত হলো।এত রাতে ডিউটি? নিশ্চয়ই অনেক খাটুনি যাচ্ছে তার দেহের উপর দিয়ে।খুশবু জবাবে লিখলো,

-“নিজের যত্ন নিবেন।আর যখন এক মুহূর্তের জন্য ফ্রি হবেন আমাকে কল করবেন।”

মন মাথা উভয়ই ঠান্ডা করা প্রয়োজন। শ্বশুরবাড়িতে নাক কাটা যাবে ভালো রেজাল্ট না করলে।একটা বিবাহিত নারীর কত দিকে খেয়াল রাখতে হয়!এসব ভাবতে ভাবতে আবারো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে খুশবু।নিজেকে একবার আয়নায় দেখলো।নাকে সাদা রঙের নাকফুল ঝলকাচ্ছে।হাতে চুড়ি।মুখের মাঝে মেয়ে থেকে নারী হওয়ার সব চিত্রই ফুটে উঠলো যেনো।জীবন মোড় ঘুরিয়ে সুন্দরতম রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাকে যেখানে বিচ্ছেদ এর পীড়া থাকলেও বিশ্বাসঘাতকতার ভয় নেই।

দুপুর বারোটায় ঘুম ভেঙেছে।আজ শুক্রবার।বাবা এবং ভাই উভয়েই বাসায়।নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে খুশবু।হেলেদুলে উঁকি দিলো ফাহাদের ঘরে।দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে দেখলো ভাইয়ের অমনোযোগী রূপ।বিছানায় ফাইল ছড়ানো।বালিশে ল্যাপটপ রাখা।কিন্তু সে যে তার ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করছে।আজ খুশবুর উপস্থিতিটা ধরতে পারলো না যে?

ঘরে ঢুকে ফাহাদের কাঁধে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে কয়েকবার খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করলো,

-“এই?কার কথা ভাবছো তুমি?….প্রেমে ট্রেমে পড়লে নাতো আবার?”

সহসা চমকে উঠলো ফাহাদ।খুশবু পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল নেই।প্রেমে পড়লে নাতো আবার?প্রশ্নে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়।জবাবে বলে,

-“তোর কাছে যত আজগুবি কথা।”

-“আজগুবি কেনো?প্রেমে পড়লেতো ভালো।বাবাকে বলে চার হাত এক করে দিবো শীগ্রই।আমি কূটনী ননদের মতন বাঁধা হবো না।উল্টো সাহায্য করবো তোমার বিয়ে হতে।”

এসব প্রেম ট্রেম,বিয়ের আলাপ কেনো জুড়ে বসলো খুশবু?আবার নির্লজ্জের মতন ভাইকে বলে যাচ্ছে।খানিক রাগী চোখে তাকায় ফাহাদ।এসব শুনতে ভালো লাগছে না তার। বললো,

-“বেশি পেঁকেছিস!…পড়ালেখার কোনো গতি হলো তোর?ফেইল মেরে নিজের সাথেসাথে আমাদের নাম ডোবানোর ইচ্ছে আছে নাকি শ্বশুরবাড়িতে?”

খুশবু ধপাস করে বসে পড়লো বিছানায়।দেহ তেইশ বছরের হলেও অন্তরাত্মা আশি বছরের বৃদ্ধার ন্যায় হয়ে গেছে।বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বসে থাকতে ভালো লাগেনা।শুয়ে পড়লে ভালো লাগতো। আপাতত এই ফাইলের গোডাউন বিছানায় শুতে ইচ্ছে হচ্ছে না। খুশবু বললো,

-“চাকরি পেয়েছো এবার বিয়ে করে ফেললেই পারো।অন্তত এখন তোমার আর এই বাহানা থাকবে না যে বেকার ছেলেকে মেয়ে দিবে কে?”

আরো তেঁতে উঠলো ফাহাদ।একদম শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না এসব।বিয়ে শাদী,প্রেম পিরিতি শব্দগুলো সহ্য সীমার বাহিরে মনে হচ্ছে কেনো জেনো।গলার আওয়াজ তুলে বললো,

-“বাদ দিবি এসব!পেয়েছিস কি?সেই কখন থেকে একই কথা বলে যাচ্ছিস।করবো না বিয়ে খুশি?”

খুশবু ফাহাদের মুখপানে চেয়ে রইলো।এটা বিরক্তির আক্রোশ নয়।বিগত পুরোটা জীবন কাটিয়েছে এই মানুষটার সঙ্গে।কখন সে বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে কখন উদ্বেগে খুব করেই বুঝে খুশবু।ফাহাদের পুরো মুখ জুড়ে অস্থিরতা দেখা গেলো। দুষ্টুমি ফাজলামো দূরে রেখে খুশবু প্রশ্ন করলো,

-“কিছু হয়েছে তোমার?”

ফাহাদ সরাসরি স্পষ্ট জবাব দেয়,

-“কিছুই হয়নি।”

-“তোমাকে আমি এভাবে কখনো চেঁচাতে দেখিনি ভাইয়া।আমার মন বলছে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে এখানে।”

-“আমি নিজে একটা ঝামেলা!খুশি?যা ভাই নিজে পড়তে বোস আমাকে কাজ করতে দে।”

__________

ভয়ঙ্কর পর্বত চূড়া।দায়িত্বের রাইফেল কাঁধে তুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।মাথার উপরেই বিশাল এক অখিল।মেঘে ঢাকা।পিচ্ছিল রাস্তা।ভেজা পুরো ইউনিফর্মটা। পক্ষীরাজেরা নিজেদের বাঁচাতে গাছের আড়ালে লুকালেও পারছে না মানব দেহগুলো।আজ বর্ডারে কড়া গার্ড।এক্সট্রা টিম নিয়োগ করা হয়েছে।চারিদিকে সিকিউরিটি এলার্ট। ওয়াকিটকি চলছে অনবরত। যতটুকু সম্ভব একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষুদ্র চেষ্টা।সবকিছু কন্ট্রোলের দায়িত্বে আফতাব এবং আরিফ।দায়িত্ব আর স্থান আগেই বণ্টন করে দিয়েছে সে।পুরো টিম এর ঢাল হয়ে বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে রাইফেল হাতে নিজের নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে।

আকস্মিক রাইফেল নামালো আফতাব।মনটা ভার ভার লাগছে এই আকাশের মতনই।একটু সুখ দরকার।পকেট থেকে পলি তে মোড়ানো একটি ছোট্ট ছবি বের করলো। খুশবুর ছবি।রাতের আঁধারে স্পষ্ট না হলেও অনুভব করতে পারছে তার সম্পূর্ণ মুখ অবয়ব। বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়ায় নির্জীব ছবিটাতে।চোখের পাপড়ি ভেজা বৃষ্টির পানিতে। আকস্মিক হাওয়ায় ছবিটা উড়ে চলে যায় দূরে।ভড়কে উঠলো আফতাব। হৃদয় কেড়ে নেওয়ার মতন অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।দ্রুত টর্চ নিয়ে অভিযান চালালো।সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছে ছবিটা।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বুক পকেটে রেখে আনমনে আওড়ায়,

-“আপনি এখানেই থাকুন।আপনার জায়গা হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি-ই।”

পেছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করলো,

– “খুব ভালোবাসো ভাবিকে তাই না।”

আফতাব ছোট্ট করে জবাব দেয়,

-“হুম”

-“সেও কি এতটাই ভালোবাসে?”

আফতাব হাসলো।হাতে তুলে নিলো ভারী রাইফেলটা। পা পিছলে যাচ্ছে বারবার।এরকম উচুঁ নিচু জায়গায় ব্যালেন্স রাখাও একটা টাস্ক। নিজের অভিজ্ঞতার জেরে সেটাও পেরেছে আফতাব।আরিফ এর জবাবে বললো,

-“নারী সবসময় মুখে স্বীকার করেনা সে তোমাকে ভালোবাসে।তবে লক্ষ্য করলে দেখবে তার ঝুঁকে যাওয়া নেত্রপল্লবে,তার হাসিতে,তার চাহনিতে,তার যত্নে,তার কথার ভঙ্গিতে সবখানে ভালোবাসার ছড়াছড়ি”

এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়াতো আর কিছুই নেই?আছে কি?এখন ইচ্ছে হচ্ছে জড়িয়ে ধরতে খুশবুকে।আনচান করছে অন্তর।অস্থির হয়ে উঠছে।কি করছে?কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে।সম্ভব না কোনোভাবেই।আজ অনেক কাজ।ফোন করাও সম্ভব হবেনা।ভাবনার ব্যাঘাত ঘটলো সামনে থেকে আসা অদ্ভুত আলোর প্রতিফলনে।নিজেদের অন্যমনস্কতা ভুলে হুট করে এলার্ট হয় সকলে। ওয়াকিটকিতে সকলকে জানিয়ে দেওয়া হয়।এলার্ট করা হয়।কোনো পূর্ব বার্তা ছাড়াই গোলাগুলির শব্দ শোনা গেলো দুর হতে।

__________

পড়ালেখা নিয়ে একদিনের জন্য খুব সিরিয়াস হয়েছিলো সে।সেই একটা দিনই।একদিনের প্রিপারেশনে পরীক্ষার হলে যেতে হচ্ছে।তার মতে পরীক্ষার আগের কয়েক ঘন্টা যা পড়া হয় সেগুলো মনে থাকে বেশি।কে যায় গাধার মতন সারাবছর পড়তে?পরীক্ষার আগের রাত হলো সবচেয়ে উত্তম।একরাতে পুরো সিলেবাস মস্তিষ্কে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানেই টুকে টুকে রাখলো।গাড়ীর এসি বাড়িয়ে ফাহাদের দিকে চায় খুশবু।গোলগাল গুমোট মুখ দেখে বলে,

-“জামাই বিদেশ আমার মুখ লটকে আছো তুমি।কেনো বলোতো?”

ফাহাদ প্রশ্নের উত্তরে উল্টো প্রশ্ন করে বসে,

-“তোর জামাই বিদেশ?”

-“বিদেশ মানে বিদেশের কাছাকাছিইতো।বর্ডারে না?”

-“কোথা থেকে বানাস এসব কথা! লজ্জাতো নেই তার মাঝে কথার কোনো আগা মাথাও নেই।”

-“তোমাকে আমি অবজার্ভ করছি গতদিন থেকে। দেবদাস হয়ে ঘুরার রহস্যটা জেনেই ছাড়বো।”

কথা বলতে বলতে খুশবুর ভার্সিটি এসে গেছে।তার সাথে সাথে ফাহাদও নামলো।তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এক লম্বা চওড়া আদেশের লিস্ট ধরিয়ে দিলো তাকে।সরাসরি যেনো পরীক্ষার হলে যাওয়া হয়।আর এক্সাম হল থেকে সোজা গেটে।সাহির নামক আপদটার সাথে দেখা হলে যেনো না তাকানো হয়।ছুটির আধ ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে ফাহাদ।তখন অফিসে তার লাঞ্চ ব্রেক
তাকে বাড়ি দিয়েই তবেই আবার অফিসে ফিরবে। আদেশের বিপরীতে ফাহাদকে মুখ ভেঙ্গিয়ে গেটের ভিতরে দৌঁড় লাগায় খুশবু।ফাহাদ বিরস মুখে চেয়ে আছে।কেউ বলবে ওর বিয়ে হয়েছে?স্বভাব আচরণে মানসিক রোগী বলে যে কেউ উপাধি দিয়ে দেবে।

খুশবুর তেমন কোনো বন্ধু নেই।আছে পরিচিত কয়েকজন।সেই কয়েকজনের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে।কেউ পরিবারের দায়িত্বে পড়া ছেড়ে দিয়েছে আবার কেউ এক বছর পিছিয়ে। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে তন্নীর সাথে দেখা হলো।অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় একে অপরের সাথে কুশল বিনিময় করে তন্নী বললো,

-“এই খুশবু চল ট্রিট দিবি ক্যান্টিনে।বিয়েতে দাওয়াত করলি না।এখন আমাকে খাওয়াতে হবে।”

খুশবু ঘড়ি দেখলো।পরীক্ষা শুরু হতে আরো আধ ঘন্টা নাকি।তাই তন্নীকে নিয়ে চলে গেলো ক্যান্টিনে।এসে বললো,

-“কি খাবি বল?”

-“ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর কাছ থেকে ছোটখাটো ট্রিট নিবো না।পকেট ভারি আছে তো নাকি?”

খুশবু হেসে জবাব দিলো,

-“যা ইচ্ছে নে।”

খাবার নিয়ে টেবিলে বসতেই চোখ গেলো ক্যান্টিনে থাকা বড় এলিডি টিভির দিকে।খবর চলছে।ব্রেকিং নিউজে সিলেট নামটা আসতেই খুশবুর মনোযোগ আকর্ষণ হয়।হাসি মুখে চেয়ে রইলো টিভির দিকে।সংবাদ পাঠ করা ভদ্র মহিলা জানান দিলেন, সিলেট সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত একজন,বিজিবির ক্যাপ্টেন সহ বাকি আটজন সেনা সদস্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গুরুতর আহতের তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। খুশবু একলাফে উঠে দাঁড়ায়।টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সরাসরি।বুক কাপতে শুরু করেছে তার।তালিকার নামগুলো দেখার চোখ চেয়ে আছে। সর্বপ্রথম নামটা ভেসে আসে ‘ ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জা’।শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেললো খুশবু।ইতিমধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আধাঁর ঘনাচ্ছে দৃষ্টি সম্মুখে।আকস্মিক জ্ঞান হারিয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ে।

চলবে…