তেইশতম বসন্ত পর্ব-২১

0
25

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ২১
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

ঠিক বিশ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে খুশবুর। দৃষ্টিতে এখনও কিছু পরিষ্কার নয়। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।কি হয়েছিলো?কি হচ্ছে হিসাব মেলাতে চাইছে।ইতিমধ্যে তন্নী তার পাশে। ক্যান্টিনে উপস্থিত আরো অনেকেই ঘেরাও করে আছে।একজন শিক্ষক দ্রুত পায়ে আসলেন ডাক্তার নিয়ে।তন্নী খুশবুর বাড়ির কাউকে চেনে না।নাই কারো নাম্বার আছে।কিভাবে জানাবে তার অসুস্থতার কথা?ডাক্তার খুশবুর পালস চেক করতে নিলে তড়াক করে উঠে বসে খুশবু।হাত ঝাড়া দেয়।দ্রুত গতিতে এই সমাগমের মধ্যে উঠে দাঁড়াতে চাইলো।তবে টালমাটাল হয়ে পড়ে যাচ্ছে বারবার।মাথা ঠিক নেই।অবস্থা নাজেহাল।কি থেকে কি করবে?হুট করে পিত্তি জ্বলে।বাড়ি যেতে হবে।আশপাশে সবাইকে সরিয়ে চলে যেতে চাইলে তন্নী হাত টেনে ধরে।

বলে, -“কোথায় যাচ্ছিস?”

-“আমি বাড়ি যাবো…”

-“তোর এক্সাম?”

খুশবু চিৎকার করে বললো,

– “দিবো না কোনো এক্সাম আমি।তুই দেখলি না টিভিতে কি বললো? ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জার অবস্থা আশঙ্কাজনক।আমার স্বামী উনি।”

তন্নী বিস্মিত হয়।তবে হাত ছাড়লো না।খুশবু আরেকদফা চেঁচিয়ে বললো,

-“আমার হাত ছাড়!”

-“খুশবু আমার কথা শোন।এভাবে গেলে বিপদ হবে।পরীক্ষাটা শেষ হলে নাহয়…”

কান্না ভেঙে পড়ে খুশবু। ভঙ্গুর কণ্ঠে বলতে লাগলো,

-“তুই পরীক্ষার চিন্তা করছিস!জীবনে অনেকবার পরীক্ষা দিতে পারবো।আমার মানুষটার কিছু হয়ে গেলে তাকে ফিরে পাবো না।তুই জানিস না সে আমার জন্য কত কিছু করেছে।আমি একটা নিছক পরীক্ষার জন্য তাকে এই অবস্থায় একা ফেলে রাখবো?….আর কী বিপদ হবে!আমি যথেষ্ট স্ট্রং আছি বাড়ি ফেরার জন্য!আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।”

ব্যাগে আছে বোধহয় একশত টাকা।তবে পায়ে শক্তি দেই।সেখানে গুরুত্ব না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দরজা টপকে বেরিয়ে গেলো খুশবু।রিকশা নিতে হবে। ভাড়া চেয়ে বসলেন দেড়শত টাকা। খুশবু ভাড়া নিয়ে মাথা ঘামালো না।অর্ধেক রাস্তা যেতেই মাকে কল করে।বলে,

-“মা একশত টাকা নিয়ে বাড়ির নিচে দাঁড়াও।”

মেয়ের গলার স্বর অস্থির।তাছাড়াও এখন তার পরীক্ষার সময়।টাকা নিয়ে বাড়ির নিচে আসবে? স্বভাবতই প্রশ্ন করেন,

-“টাকা নিয়ে দাঁড়াবো মানে?কি হয়েছে?তুই পরীক্ষা দিতে যাসনি?”

-“মা এখন এসব প্রশ্ন উত্তরের সময় না। ভাইয়াকে কল করো এক্ষুনি সিলেটের জন্য ফ্লাইট বুক করতে বলো।আমি বাসে সময় অপচয় করতে চাই না।সিলেট যাবো আমি।বাড়ি ফিরেই বেরোবো।”

-“খুশবু কি হয়েছে তোর?”

-“প্লীজ মা! যা বলছি করো।”

বলে ফোন কেটে দেয় খুশবু। চিত্ত চিৎকার করে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। নেত্র সম্মুখে ভাসছে আফতাব এর মুখখানা।শুরু থেকে তাদের শেষ দেখা অব্দি সব মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভাসছে কেনো?তার সরলতা হৃদয়কে কতটা প্রভাবিত করেছে?তার ভালোবাসায় এখন মন মস্তিষ্ক সবটাই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।রিকশার গতিও যেনো অনেকটা কম। বারবার বললো ‘চাচা দ্রুত চালান’।রিকশা চালক একবার চাইলেন খুশবুর দিকে।যথাসম্ভব দ্রুত চালিয়ে গন্তব্যে এনে হাজির করেছে।দরজায় মা দাঁড়িয়ে।খুশবু নেমে গেলো।মায়ের হাত থেকে টাকা নিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দৌঁড়ে এসে মাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাদতে শুরু করলো।

নায়লা বেগম মেয়ের এমন কান্ড দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন।জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন,

-“কি হয়েছে খুশবু কাদছিস কেনো?”

-“মা?…মা সিলেটে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে…সেখানে…সেখানে উনি আহত হয়েছেন.. গুরুতর আহত।টিভিতে বলছে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক!”

-“উনি? কে?”

-“আফতাব”

আকাশ ভেঙে পড়লো নায়লা বেগমের মাথায়।থ হয়ে গেছেন মেয়ের কথায়।তারও বুক কাপতে শুরু করেছে।খুশবু আবার বললো,

-“আমাকে ওনার কাছে নিয়ে যাও মা।আমি গেলে উনি ঠিক হয়ে যাবেন জানি।আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলো”

ফাহাদ ফিরে এসেছে সাথে লোকমান চৌধুরী। এয়ার টিকেট যত তাড়াতাড়ি বুক করা যায় চেষ্টা করছে ফাহাদ। খুশবুকে সামলানো যাচ্ছে না। ছটফট করছে থেকে থেকে।আফতাব এর বন্ধ নাম্বারে পাগলের মতোন ফোন মিলিয়ে যাচ্ছে।এই ভ্রান্ত আশায় যদি ধরে?যদি বলে সে ঠিক আছে।ফাহাদ অনেক চেষ্টা করে সন্ধ্যা সাতটার দুটো টিকেট ম্যানেজ করতে পারলো।এখানে মানুষ চারজন।খুশবু যাচ্ছে।সিদ্ধান্ত হলো খুশবুর সাথে ফাহাদকে পাঠানো হবে।লোকমান চৌধুরী এবং নায়লা বেগম আগামী টিকেট পেলেই চলে আসবেন।এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লো ফাহাদ খুশবু।

দুই ঘন্টার মধ্যে সিলেট শহরে উপস্থিত খুশবু ফাহাদ। এয়ারপোর্ট থেকে জিতুর সাথে সরাসরি হাসপাতালে চলে গেলো। যেখানে আফতাবসহ বাকিদের চিকিৎসা চলছে। হইচই সবখানে। ডিফেন্সের পাঁচটি গাড়ি দাঁড়ানো বাহিরে।হতাহতদের পরিবারের উপস্থিতি পরিবেশ আরো গুরুগম্ভীর করে তুলেছে।উপস্থিত রফিকুজ্জামান মির্জা এবং রুমানা মির্জাও।গম্ভীর লোকটা আজও গম্ভীর।মাথা নামিয়ে রেখেছেন।রুমানা মির্জা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে।যেনো এক শক্ত মূর্তি সে। খুশবু দৌঁড়ে গেলো। খুশবুর কাদো কাদো মুখ দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া দিলেন না রুমানা মির্জা।যেনো ভুলে গিয়েছেন কথা বলতে। খুশবু শ্বাশুরিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“মা”

রুমানা মির্জা অনেক সময় পর শীতল নিস্তেজ গলায় বললেন,

-“আমার বাচ্চাটা জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ছে।”

রুহ কাপিয়ে তোলার মতন বাক্য।আরো শক্ত করে খামচে ধরে রুমানা মির্জাকে।আকস্মিক তিনি নড়েচড়ে উঠলেন। খুশবুকে সরিয়ে চাইলেন স্বামীর দিকে।তর্জনী আঙ্গুল তুলে তাকে দেখিয়ে বললেন,

-“এইযে এই লোকটার কারণে…এই লোকটার জেদের কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।আমার শান্ত সরল ছেলেটা বাবার এক কথায় রাজি হয়েছে।কোনোদিন উফটুকু করেনি।আমি হাজারবার বারণ করেছি তাকে।ওকে দিও না যেতে।অন্য কোনো পেশায় যাক।শুনেনি আমার কথা!আমি সারাজীবন দরজায় দাঁড়িয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে পাড় করেছি। বৃদ্ধ বয়সে আমার ছেলের জন্য।আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয় এই লোকের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ।”

বিষম খেয়ে আছে শ্বাশুরির কথায়।মায়ের মন।সান্ত্বনা দিয়ে কোনো লাভ হবে না।তার দিক থেকে সেই সঠিক।তার বলা কথার মাঝে এক রত্তি ভুল নেই।আজ খুশবুর মনে হলো হেঁয়ালি জীবনটা এবারে বাদ দিতেই হবে। দূর্বলতা গ্রাস করতে দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।নিজের ঘাড়ে আফতাব এর পাশাপাশি তার পরিবারের দায়িত্বের ভার অনুভব করলো।রুমানা মির্জার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

-“এগুলো বলবেন না মা।আপনার ছেলের কিছু হবে না।মায়ের দুআ সৃষ্টিকর্তার দরবারে সাথেসাথে কবুল হয়।আপনি দুআ করুন।উনি সুস্থ হয়ে তার পরিবারকে এভাবে ভঙ্গুর হতে দেখে তাহলে…..”

-“আমি আমার ছেলেকে চাই!যে করেই হোক।এর আগে আমি কারো কোনো কথা শুনবো না।একটা ছেলে আমার।আমার আর কিছুই নেই জীবনে।”

_______

বন্দুকের গুলি ছুঁয়ে না গেলেও পাশে থাকা সহকর্মী আরিফকে রক্ষা করে ফিরতি গুলি ছুঁড়তে গিয়ে পা পিছলে যায় আফতাব এর।মাথার পিছনের দিকটায় গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত।আঘাত যেনতেন নয়। পাহাড়ী এলাকায় সংকীর্ণ পাথরের সাথে সজোড়ে বারি লেগেছে।মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।ডাক্তারি ভাষায় একে টিবিআই অর্থাৎ ট্রোমাটিকাল ব্রেইন ইঞ্জুরি বলা হয়ে থাকে। ডাক্তারদের একদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর পর সকলকে বাঁচানো গেলেও আফতাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার কোনো তথ্য আসেনি।ডাক্তারকে চেম্বারে যেতে দেখলে খুশবু উঠে দাঁড়ালো।সাথে রফিকুজ্জামান মির্জাও। খুশবু থেমে যায়।বলে,

-“বেয়াদবি মনে হলে ক্ষমা করবেন বাবা।আমি ডাক্তারের সাথে আলাদাভাবে একটু কথা বলতে চাই।আপনি নাহয়?”

রফিকুজ্জামান মির্জা নিঃশব্দে অনুমতি দিলেন।পিছু হটে গেলেন। খুশবুর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ফাহাদ।বলে,

-“তুই থাক আমি কথা বলে আসি”

-“না ভাইয়া!আমি যাবো।তুমি থাকো এখানে।”

-“পাকামো করিস না।”

-“নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত করেছি ভাইয়া।আমাকে যেতে দাও।”

বলে খুশবু দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো ক্যাবিনে।সেখানে আরো সেনা কর্মকর্তা আছেন।সাথে আরিফও। খুশবুকে দেখে চিনতে ভুল করেনি সে।আরিফ সেফ আছে।তার কিছুই হয়নি। খুশবুকে দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো।কেমন যেনো অপরাধী মনে হচ্ছে আরিফকে নিজের কাছে।কিছুই করতে পারলো না সে?বারবার ভেঙে পড়া মনকে কতভাবে সামলাবে জানে না খুশবু।বুকে সব ভয় ভীতি চেপে বসলো চেয়ারে।বললো,

-“ডক্টর….”

পেছন থেকে আরিফ বলে উঠলো,

– “উনি ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জার স্ত্রী।”

খুশবু বলে,

– “ ডক্টর যা হয়েছে সবটা আমাকে খুলে বলুন।”

ডক্টর বললেন,

– “ওয়েল মিসেস মির্জা আঘাত স্বল্প নয়।মাথায় আঘাত পেয়েছেন উনি। ট্রোমাটিকাল ব্রেইন ইঞ্জুরি।আমরা আশঙ্কা করছি….”

ডক্টর বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। নিশ্চয়ই তার মাঝেও আবেগপ্রবণতা আছে।খুশবু উদ্যমী গলায় প্রশ্ন করলো,

-“কি আশঙ্কা করছেন?”

-“ওনার কন্ডিশন অনুযায়ী…. একচুয়ালী অপারেশনের পর উনি কোনো রিস্পনস করেননি।নব্বই শতাংশ চান্স আছে….. হয়তো উনি কোমায় চলে যেতে পারেন…”

স্তব্ধ হয় সম্পূর্ণ কায়া।আশপাশে আরিফ জানতে চাইছে ডাক্তারের কাছে চিন্তিত কণ্ঠে।তার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার জানাচ্ছেন কোমা সচরাচর তিন ধরনের হয়।স্বল্প মেয়াদী,মাঝারি মেয়াদী আর দীর্ঘমেয়াদী।কয়েক দিন থেকে হতে পারে এক সপ্তাহ,সপ্তাহ থেকে মাস নয়তো মাস থেকে বছরের থেকেও কিছু বেশি সময়।সবটাই শুনছে খুশবু।চোখ জোড়া নেতানো।তাদের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে এদিক ওদিক বারি খাচ্ছে।শুনেও যেনো শুনছে না।সব শেষে ডাক্তার বললেন সঠিক চিকিৎসা তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে।আরিফ শেষ প্রশ্নে জানতে চায়,

-“আফতাব সুস্থ হয়ে যাবেতো?”

ডাক্তারের জবাব দেওয়ার পূর্বে খুশবু কঠিন হয়ে উঠে।ছলছল করছে চোখ।কিন্তু বেয়ে পড়ছে না অশ্রুদানা।সে প্রশ্ন করে,

-“সে বেঁচে থাকবেতো?”

ডক্টর জবাব দিলেন, – “জ্বি”

খুশবু উঠে দাঁড়ায়।বলে,

– “আমার পরিবারের কাউকে এই বিষয়টা জানাবেন না প্লীজ।এটা একটা রিকোয়েস্ট।”

বলে বেরিয়ে যায় খুশবু।তার পিছু আসলো আরিফ। খুশবুকে ডেকে বললো,

-“ভাবি”

-“জ্বি”

-“সবাইকে না জানালেও সবাই জেনে যাবে।”

প্রাণহীন মুখ খুশবুর।বললো,

-“আমি সামলে নিবো।”

-“কিন্তু আপনি?”

-“আমি?আমি ক্যাপ্টেনকে আমার জীবনে সবভাবে রাখতে রাজি।জেগে থাকুক আর ঘুমিয়ে শুধু থাকুক আমার কাছে।যতদিন তার নিঃশ্বাস চলবে ততদিন আমারটাও চলবে।” শেষবাক্যে চোখের জল আর বাঁধ মানলো না।অকপটে চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়েছে।

_______

-“তুই কি চাস?তুই কেনো ছটফট করছিস হাসপাতালে যাওয়ার জন্য?”

নোমানের বাজখাই গলায় একদমই ভীত হলো না নেহা।যখন থেকে খবর এসেছে আফতাব এর সেও নোমানের সাথে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে আছে।

-“খুশবু আপুর হাসবেন্ড এর এই অবস্থা।যাওয়া উচিত তাই না?”

নোমান বললো,

-“হ্যাঁ যাওয়া উচিত।আমি যাচ্ছিতো।আর কারো প্রয়োজন নেই।”

-“আমাকে নিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তোমার?”

তর্ক করছে নেহা।নোমানের রাগ বাড়লো।ফাহাদের কল আসার পর থেকে সে তরিহরি করে সব কাজ একত্র করে নিচ্ছে।বেরোবে পাঁচ দশ মিনিটে।নোমান নেহার দিকে চায় রেগে।বলে,

-“দেখ নেহা আমি তোর বড় ভাই।তোর বয়স আমি অনেক আগে পাড় করে এসেছি।তোর যে মতিগতি আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।আমার খারাপ তালিকায় নিজের নাম উঠাস না।”

-“আমার মতিগতি ভালো না?”

-“অবশ্যই ভালো না।আমি জানি তোর ছটফট কি জন্য?কার জন্য।”

নেহার জেদী মুখখানা মিয়ে এসেছে। কিছুটা ভীত হয়।অনেকটা দিন যাবত দূরে সবকিছু থেকে।পরীক্ষার নামে রীতিমত অত্যাচার চালানো হচ্ছে তার উপর।মানসিক অত্যাচার।দূরত্ব কাবু করছে নেহাকে।আরো তৃষ্ণা বাড়াচ্ছে ফাহাদের কন্ঠ শোনার।কথা বলার তার সাথে।পড়ালেখায় মন বসছে না।নোমান জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বললো,

-“ভালো হবে নিজেকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে নে।”

আকার ইঙ্গিতে কথা চললো নোমান আর নেহার মধ্যে।নেহা প্রথমবার খুব সাহস করে বলে উঠলো,

-“আমি জানি ভাইয়া তুমিও এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না যে সিদ্ধান্তে তোমার বোন ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট পাবে।”

চকিত চাহনি নোমানের।ছোট মুখে বড় কথা বলে পিঠ দেখিয়ে চলে গেলো। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে?

__________

স্নিগ্ধ কামরার পুরো নকশা বদলে গেলো।বিছানার ডান পাশে জায়গা হলো আফতাব এর নড়চড়হীন দেহটার।মাথার পুরোটা অংশে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ পেঁচানো।শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য ভেন্টিলেটর লাগানো হয়েছে।নাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব রাখা হয়েছে খাবার ও পানীয়র জন্য।সাথে চব্বিশ ঘন্টা দেখভালের জন্য একজন নার্স।সবার শেষে ঘরে প্রবেশ করলো খুশবু।বুকে জড়িয়ে এনেছে রক্তাক্ত ইউনিফর্ম।কাউকে ধরতে দেয়নি সে এটা।নিজের কাছে রেখেছে যতনে।রুমানা মির্জা কোনো প্রকার কথা বলছেন না কারো সাথে। নিশ্চুপ রফিকুজ্জামান মির্জাও।লোকমান চৌধুরী এবং নায়লা বেগম তাদের দুজনকে সামলাতে সামলাতে মেয়ের দিকে চাইলেন।দেখলেন মেয়ের মুখ অবয়ব।বোকাসোকা অবোধ খুশবুটাকে খুঁজে পাচ্ছেন না আর। মেয়েটি কাদছে না একেবারেই।চোখের পলকে নিজেকে শক্ত করে নিলো?

জরিনা বেগম কাছে আসলেন।প্রশ্ন করলেন,

– “একা সামলাইতে পারবি?”

খুশবু নির্নিমেষ জবাব দেয়,

– “পারবো”

-“বেশি রাইতে….”

-“জেগে থাকবো সারারাত।যাও তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। ওনার কিছুই হয়নি।চিন্তার কারণ নেই”

জরিনা বেগমও অবাক হন খুশবুর এই রূপে।যে মেয়ে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ঠোঁট চেপে কাদতো সে আজ এত স্বাভাবিক?ডাক্তারের কাছ থেকে মোটামুটি সব জেনে এসেছে।কাগজে কলমে লিখে এনেছে। মোবাইলে প্রতি ঘন্টার এলার্ম দেওয়া।ওকুপেশন ও স্পিচ থেরাপি দিতে হবে আফতাবকে।সাথে শরীরের পেশী ও সংযোজনস্থলগুলো সচল রাখার জন্য ফিজিওথেরাপি।সে জন্য নার্স আছেন।পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব আছে এখানে অনেক।নিয়মিত হার্ট রেট,ব্লাড প্রেসার চেক করা।পজিশন চেঞ্জ, সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম প্রতিক্রিয়ার দিকে খেয়াল রাখা। কোমায় থাকা ব্যক্তি অনেকক্ষেত্রে শব্দ শুনতে পায়।তবে প্রতিক্রিয়া দিতে পারেনা।তার কাছে গিয়ে কথা বলা তাকে প্রতিক্রিয়া দিতে সাহায্য করে।অনেকটা সুস্থ হতেও।সবকিছুর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে খুশবু।

খুশবু দরজা বন্ধ করে দেয়। বাতি নেভালো না।জানালার দ্বারে পর্দা টানতে গিয়ে একবার চাইলো টিলার দিকে।স্মিত হাসলো।ফিরে আসে আফতাব এর কাছে।পাশে বসে চোখে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো।ধীরে ধীরে পুরো মুখে। জলে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে নেত্র।তারপরও নিজেকে দমালো।বুকে হাত রেখে নিঃশ্বাসের উঠা নামা ঠিকঠাক আছে কিনা নিশ্চিত করে আলতো করে বুকে আলগা করে মাথা রাখে।

-“আপনাকে কাছে চেয়েছিলাম……”

চলবে…