তেইশতম বসন্ত পর্ব-২২

0
45

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ২২
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

মানুষতো!নিদ্রা যখন চোখে হানা দেয় তখন অতল গহ্বরে টেনে নিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়।অজান্তে। শেষরাতে চোখ লেগে এসেছিলো খুশবুর।যেখানে পণ করেছিলো কিছুতেই ঘুমোবে না।এই শহরটা শান্তির; এই শহরটা শীতলতার।ঠান্ডা পবনের সাথে মিলে মিশে আসছে আযানের ধ্বনি।ফজরের ওয়াক্ত।কর্ণপাত হলে লাফ দিয়ে উঠে খুশবু।ঘুম থেকে উঠার পরপরই মস্তিষ্ক সতেজ করতে কিছুটা সময় নেয়।আজ তেমন কিছুই হলো না। তাড়াহুড়োয় আফতাব এর বুকে হাত রাখলো। মসৃণ ললাটে চিন্তার ভাঁজ। হ্যাঁ! নিঃশ্বাস চলছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস সেও ফেলে।চুল বাঁধতে বাঁধতে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামায আদায় করেছে। ততক্ষণে ভোরের আলোর সহিত পাখির কিচিরমিচির ডাক আসছে।খুশবু আফতাব এর কাছে এসে বসলো। ঠোঁটজোড়া রুক্ষ লাগছে তার।পরপর নজর যায় হাতের দিকে।পুরো শরীরটাই শুষ্ক। ড্রয়ার থেকে নোটবুক বের করে দেখলো তার পরবর্তী কাজ কি?

ডাক্তারের বলা কথা অনুযায়ী পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে এনেছে।মুখ আর দেহের উন্মুক্ত অংশ ভালোভাবে মুছে দিলো।লিপ বাম এনে ঠোঁটে ছোঁয়ায়।পরপর মশ্চোরাইজার এনে হাতে পায়ে দিলো।সকালের কাজ আপাতত শেষ।সকাল দশটায় এসে নার্স তার কাজ করবেন।খুশবু আফতাব এর গালে গাঢ় চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললো,

-“ভালোবাসা দিলাম…আঘাত যথেষ্ট পেয়েছেন।”

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুশবু।বলে ফিসফিস করে,

-“আপনার বাবা মায়ের অবস্থাও ভালো না।আমি এখন সকালের নাস্তা তৈরি করতে যাবো।সুযোগ বুঝে আমার ঘাড়ে সব দায়িত্ব ফেলে দিলেন তাই না? সুদে আসলে সব হিসেব হবে বলে রাখলাম।”

কোনো নড়চড় করলো না আফতাব।কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না।মূর্তির ন্যায় নিথর পড়ে আছে।খুশবু তৃতীয়বার বলে,

-“আমি জানি আপনি আমার কথা শুনছেন।আমি ভেঙে পড়ার আগে জেগে উঠে আমাকে সামলে নিয়েন।বেশি দেরি করলে আপনার লস।কম বয়সে বউ হারাবেন।”

আফতাব এর দেহ স্থির।তবে হৃদপিণ্ড মস্তিষ্ক সচল।শ্রবণ ইন্দ্রিয় ভেদ মস্তিষ্কে গিয়ে এক মিষ্টি আওয়াজ বাড়ি খাচ্ছে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অচল,তবে অনুভব শক্তি এখনও সচল।হৃদপিণ্ডের গতি বাড়লো।ভ্রম ভ্রম লাগছে বিশ্রব্ধ সর্বাঙ্গে।নিঃশ্বাসের বেড়ে যাওয়া গতি দেখলো না খুশবু।জানলো না তাকে অনুভব এখনও করছে আফতাব।

খুশবু কোমরে আঁচল গুঁজে দাঁড়ায়। শ্বাশুরি মা উঠার পূর্বেই রিতা খালার সাথে মিলে রান্নাটা দেখবে।তার অবস্থা নেই এখন রান্না বান্না দেখার। অপরিপক্ক হাতে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে খুশবু ভাবলো তার কি অবস্থা আছে সব সামলে নেওয়ার?

মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে উঠে।আঁচলে মুখ গুঁজে আছে রিতা খালা।খুশবু তার দিকে চাইতেই চোখ মুছে ঝটপট।তবে ধরা পড়েছে। খুশবু বললো,

-“কাদছেন কেনো আপনি?”

রিতা খালা কান্নারত চোখে তাকায়।বলে,

-“ছোট ভাইজান সুস্থ হইয়া যাইবোতো?”

-“হতে হবে খালা” স্মিত হেসে জবাব দেয় খুশবু।

-“বউ তোমার অনেক কষ্ট হইতাছে না?এই কারণে এমন চুপচাপ হইয়া গেছো? ছোটভাইজান মেলা ভালো মানুষ।নতুন বিয়া হইছে মাত্র।আর এখনই!”

খুশবু বলে উঠলো, – “আপনার ছোটভাইজান ভালো বলেই আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।আপনিও কান্না থামান।কান্না করার মতোন কিছু হয়েছে?ডাক্তার বলেছেন উনি ঠিক হয়ে যাবেন।”

নাস্তা তৈরি করেই টেবিলে এনে রাখলো খুশবু।এখনই বেরোবেন রফিকুজ্জামান।নাস্তা করে একটু প্রকৃতির বাতাস খেতে যাবেন।তার প্রতিদিনের নিয়ম।কয়েকবার সঙ্গী হয়েছিলো খুশবুও।নতুন আসা নার্সকে রিতা খালা নাস্তা দিয়ে এসেছেন।খুশবু শ্বশুর শ্বাশুরির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।খুব করে জানে ওনারা খেতে আসবেন না।জোর করে ডেকে আনা ছাড়া উপায় নেই।যাওয়ার পথে বারান্দায় নজর পড়তেই চমকে উঠে।সোফায় বসে আছেন রফিকুজ্জামান মির্জা।হাত মুঠ করে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।এমন দৃশ্য খুশবু এগিয়ে গেলো।ডাকলো,

-“বাবা?”

দুয়েকবার ডাকে সাড়া দেন রফিকুজ্জামান মির্জা।বয়সের ছাপে আধ পাকা চোখের পাপড়ি পিটপিট করেন। ঘাড়ে হাত রাখতেই খুশবু বুঝলো ঘাড় ব্যাথা উঠেছে তার।প্রশ্ন করলো,

-“আপনি সারারাত এখানেই ছিলেন বাবা?”

রফিকুজ্জামান এর ভারী কন্ঠ আজ নমনীয় শোনালো।তিনি বললেন,

-“বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।”

সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা।হাতে অথবা টেবিলে কোনো বই নেই।ছেলের চিন্তায় আর স্ত্রীর প্রগাঢ় অভিমানে এখানে রাত্রি যাপন করেছেন তিনি।খুশবু আর কিছু বললো না এই ব্যাপারে শুধু বললো,

-“নাস্তা দিয়েছি টেবিলে।খেয়ে ঘাড় ব্যথার ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন নাহয়”

চার কদম এগোতেই রফিকুজ্জামান মির্জা বলে উঠলেন,

-“তোমরা পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।তোমার নতুন জীবন নষ্ট হওয়ার পেছনে আমি অনেকাংশে দায়ী।”

বারবার কেনো মানুষগুলো দুর্বল করে তুলে?নিজেকে কতবার জুড়বে খুশবু?রফিকুজ্জামান মির্জাকে ভারী গম্ভীর ব্যক্তিত্বে মানায়।আফতাব বলেছিলো এই মানুষটা তার আইডল।ভালোবাসার পাশাপাশি তাকে মানে খুব।তার কোনো কথা এই জীবনে অমান্য করেছে কিনা জানা নেই।খুশবু লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ফেলে দেয়।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রফিকুজ্জামান মির্জার উদ্দেশ্যে বললো,

-“আপনার সিদ্ধান্তে আপনার ছেলে খুশি ছিলো বাবা।আপনি জেনেশুনে নিজের ছেলের জীবনে আধাঁর নামাতে চাইবেন?…. কখনোই না।আপনি মায়ের কথায় নিজেকে দোষারোপ করছেন?সে এখন তার ছেলের শোকে মূহ্যমান।ওই দুঃখগুলো আপনার প্রতি রাগ হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।একটু সময় দেন।উনি সুস্থ হয়ে উঠলে মা-ও আবার আগের মত হয়ে যাবে।”

এত ভারী ভারী কথা খুশবু বলছে।তার নিজের উপর বিশ্বাস হচ্ছে না।নিজের চেয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব কেই বা চেনে?রফিকুজ্জামান মির্জাকে নাস্তা দিতে দিতে দেখলো খুশবুর বাবা মা এবং জরিনা বেগম এসেছেন।ভালোই হলো।রুমানা মির্জা অন্তত মেহমান দেখে খাবারকে সরাসরি না করতে পারবেন না। কৌশলে মা আর নানীকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেয় ঘরে।

নার্সকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো খুশবু।নার্স নিজের কাজ করছেন।ইনজেকশন পুশ করে হাত ধরতে যায় আফতাব এর।তখনই খুশবু বলে উঠে,

-“কি করতে হবে?আমাকে বলুন।”

-“আপনি পারবেন?উনার হাতের পায়ের এক্সারসাইজ করাতে হবে।উঠানামা করিয়ে।”

খুশবু গিয়ে আফতাব এর হাত ধরে বললো, -“কিভাবে করতে হবে বলুন।”

নার্স হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয়।সাথে মুচকি হাসে। বউ জাতি।স্বামীকে কোনো পর নারী স্পর্শ করবে সহ্য করতে পারলো না।বুঝতে চাইলো না সেটা তার কাজ।নার্সের কাজ শেষ করে তিনি চলে যান।খুশবু আফতাব এর হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাত রেখে আবারো কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

-“আপনাকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে এটা আমি মোটেও সহ্য করবো না।দরকার পড়লে সব শিখে অলরাউন্ডার হয়ে যাবো।”

পুরো মুখে নরম হাতের বিচরণ চালায় খুশবু।আবার বলে,

-“আজ প্রথমবার এই বাড়ির বউ হবার আসল দায়িত্ব পালন করেছি।নাস্তা তৈরি করে বাবা মাকে খাইয়ে আসলাম। তৈরিও কিন্তু আমিই করেছি।তাই আপনার কাছে আসতে দেরি হলো।একটু পর দুপুরের খাবারের আয়োজন দেখতে হবে।”

পরপর আবার বলে খুশবু, – “আপনি জানেন না আমি কত অলস।আপনার কারণে এত দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে।আপনাকে বেশি বেশি ভালোবাসতে হচ্ছে। সবেতো শুরু।দেখে নিয়েন ক্লান্ত না হয়ে যাই আবার।”

______

-“কেমন আছেন খুশবু আপু?”

দুপুরের দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো খুশবু।মা আর ছেলেকে একা সময় দিয়েছে।অনেক সময় ঘরবন্দী ছিলেন রুমানা মির্জা।নিজে থেকেই আফতাব এর ঘরে এসে বসেছেন।হয়তো খুশবু সামনে থাকলে মন খুলে কাদতে পারবেন না।বলতে পারবেন না মনের কথাগুলো।তাই তাদের আলাদা সময় দিয়ে এসেছে এখানে।

কন্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো।পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলো নেহাকে।অনেকটা অবাক খুশবু। কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো মেয়েটির।হাতে ফাইল।খুশবু সবিনয়ে হেঁসে বললো,

-“নেহা তুমি এখানে?কেমন আছো?”

নেহা জবাব দেয়, -“আমি ভালো আছি।আপনি…মানে ঠিক আছেনতো?”

-“এইতো…”

-“কিভাবে কি হয়ে গেলো আপু তাই না?আপনি যে এখনও এত শক্ত আছে দেখে ভালো লাগছে।”

খুশবু এসব শুনতে চায় না।ভদ্রভাবে এড়িয়ে গেলো কথা।বারান্দার সোফায় বসতে বলে নেহাকে।এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে তাকে এগিয়ে দেয়।প্রশ্ন করে,

-“একা এসেছো?তোমার ভাই বা পরিবারের কেউ আসেনি?”

অর্ধ গ্লাস পানি পান করে নেহা জবাব দেয়,

-“না আপু।একাই এসেছি।”

কথাটি মুখ ফুলিয়ে বলে নেহা।খুশবু লক্ষ্য করলো তাকে। গুমোট একটা ভাব মুখে।খুশবু ফের প্রশ্ন করে,

-“এখনতো দুপুরের খাবারের সময় আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে হবে কিন্তু।”

-“আপু আমার ক্ষিদে নেই”

-“এটা কেমন কথা ক্ষিদে নেই।খেয়েই যাবে”

ঠোঁট কামড়ে ধরলো নেহা।এই মুহূর্তে কথাটি বলা ঠিক হবে কিনা?এসেছে এক ঝলক ফাহাদের দর্শন এর জন্য।খুশবু প্রশ্ন করলো,

-“একা কিভাবে এলে?না মানে বাড়ি চিনতে সমস্যা হয়নি।”

-“পরীক্ষা শেষ করে এসেছি আপু। দুটো কারনে।ভাইয়াকে দেখার ইচ্ছা আর দ্বিতীয়ত….”

কথা পূর্ণ করার আগেই ফাহাদের কন্ঠস্বর। খুশবুকে ডাকছে।আওয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো বারান্দায়। নেহা ছটফট করে উঠলো। আড়ষ্ট হয়ে বসলো মাথা নত করে।মা ডাকছে তাকে এটা বলতে এসে নেহার দেখা মিলবে এটা কল্পনাতেও আসেনি ফাহাদের। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।অবাক হয়ে চেয়ে রইলো নেহার দিকে।কি বলতে এসেছে ভুলে গেছে।দুজনের মধ্যে নেহার বিড়ম্বনায় পড়া মুখ আর ফাহাদের আশ্চর্য্য ভঙ্গি পরখ করছে খুশবু।

ফাহাদ নিজেকে স্বাভাবিক করে।সামনে এসে দাঁড়িয়ে নেহাকে সরাসরি প্রশ্ন করলো,

-“তুমি এখানে?”

কেমন যেনো অভিমানী সুর টেনে নেহা জবাব দেয়, -“আপুর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

-“তোমার ভাই জানে?” রাগী গলায় প্রশ্ন করলো ফাহাদ।

-“নাহ” সঙ্গেসঙ্গে জবাব দেয় নেহা।

গলার তেজ বাড়িয়ে ফাহাদ বলে, -“না জানিয়ে চলে এসেছো তুমি।খুব সাহসতো তোমার!”

খুশবু দুজনের আক্রোশের আগামাথা কিছুই বুঝলো না।ভাইয়ের এমন আচরণের বিপরীতে বললো,

-“তুমি ওর সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো ভাইয়া? ও আমাদের গেস্ট।”

ফাহাদ মুখ শক্ত করে নিলো।চলে গেলো সেখান থেকে।হুট করে মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কারণ সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। খুশবুরও নির্ঘাত এইটাই প্রশ্ন?কেনো রেগে গেলো।নেহাকে হুট করে এখানে দেখে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি ফাহাদ।

ফাহাদের রাগের জেরে কথাগুলো গিলে নিয়েছে নেহা।আর বলার সাহস নেই। খুশবুর জোর জবরদস্তিতে দুপুরের খাবারটা খেয়ে তবেই যেতে হবে।পরীক্ষা শেষে কোচিং কামাই করে এসেছিল এখানে।মনে উদ্যমী সাহস নিয়ে।সাহস সব হাওয়ায় মেঘের সাথে ভাসমান আপাতত।

খুশবু ফাহাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।মুখ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো,

-“নেহাকে বাড়ি দিয়ে এসো”

এই কথাটির জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না ফাহাদ।বাড়ি দিয়ে আসতে হবে?নোমান জানলে পরিস্থিতি আর বিগড়াবে।

-“তোদের ড্রাইভার থাকলে তাকে দিয়ে পাঠিয়ে দে।আমার কাজ আছে।”

সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুশবু বলে,

-“কাজ? কোথাও দেখছি না কাজ আমি।বসেই আছো।যাও ভাইয়া দিয়ে এসো।বরং আমার অনেক কাজ আছে।প্লিজ! মেয়েটাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না।”

এরপর বারেবারে না করেও লাভ হলো না।খুশবু কোনোভাবে একা ছাড়বে না ওকে।এমনকি ড্রাইভারও নেই।নার্সকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।অবস্থা সম্পূর্ণ ফাহাদের ইচ্ছের বিপক্ষে।উঠে গেলো নেহাকে নিয়ে।পাশাপাশি দূরত্ব নিয়ে হাঁটছে দুজন।একবারের জন্য তাকায়নি। টিলা থেকে নেমে সিএনজি নিয়ে উঠে বসলো। বিস্তর ফারাক দুজনের বসার স্থানে। এতোটা নীরবতা অপরিচিত মানুষের মাঝেও থাকে না।ফাহাদের মনে প্রশ্ন জাগলো।কি হয়েছে এমন? কিছুইতো না।তাহলে?এরূপ ব্যবহার কেনো?

কান্না দমানো নেহা ঠোঁট কামড়ে বসে।অযথা কান্না পাচ্ছে তার।পাশে বসা মানুষ কত নিষ্ঠুর।কথাও বলেনা।কিশোরী মনে আঘাত হানছে বারবার বিষয়টা। সিএনজির দামাল হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নেহার।মাথায় কাপড় টেনে লাগাম টানলো অবাধ্য কেশের।অন্তরের জ্বালায় বাঁচে না।আবার চুলের জ্বালা কে পোহাবে?এবারে চোখ ফিরলো ফাহাদের।চাইলো মুখ ফুলিয়ে রাখা নীরব মেয়ের অভিমুখে।মায়া অনুভব করলো হঠাৎ করে। অসস্তিকর পরিবেশে চোখ এদিক ওদিক ঘোরানোটাও বেশ নজর কাড়ছে।

-“তোমাকে বাড়ির কিছু পথ আগে নামিয়ে দিবো।”

ফাহাদের গলার স্বরে কান খাড়া হলো নেহার।স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলো,

-“কেনো?”

পূনরায় রাগ চড়াও হলো মাথায়।কঠিন স্বরে প্রত্যুত্তর দেয়,

-“বাসায় জানিয়ে এসেছো?…আম ড্যাম শিউর জানাও নি।তার মধ্যে একটা ছেলের সাথে বাড়ি যাচ্ছো।তোমার মনে হয় কেউ এই বিষয়গুলো ভালো চোখে দেখবে?”

-“যার চোখ খারাপ সেতো খারাপ চোখেই দেখবে।”

-“অল্প বয়সে অনেক বড় বড় কথা বলো তুমি
আমি যা বলেছি তাই হবে।”

কোনো উত্তর দিলো না নেহা।বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ ফিরিয়ে নিলো।ফাহাদ আবার চেঁচায়,

-“মাথা ভেতরে আনো।বড় গাড়ি এসে মাথাটা সাথে নিয়ে যাবে।দেহটা রয়ে যাবে।”

-“যা ইচ্ছে হোক! আপনার কি?”

কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেলো ফাহাদের মুখটা। লিলিপুটের মতন মেয়ের কি জেদ!কিন্তু কেনো?তার জেদটা আবার কি কারণে?

-“নেহা তর্ক করবে না।ঠিক হয়ে বসো”

নেহা কথা শুনলো শেষবারে।ঠিক হয়ে বসলো।তাদের এলাকার বাহিরে এসে সিএনজি থামবে পাঁচ মিনিটে।এর আগে নেহা বললো,

-“আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম।ভেবেছিলাম শান্ত শিষ্ট পুরুষ মানুষ আপনি।তবে আমি ভুল আপনিও আমার বাবা, চাচ্চু আর ভাইয়ার মতন বদমেজাজি।আমি কি আপনার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করেছি?আপনি এমন রিয়েক্ট করছেন যেনো আমি আপনার কত জনমের শত্রু।আমি মানুষটা যে এতদিন যাবত গায়েব কোনো খোঁজ নেওয়ারও চেষ্টা করলেন না।আছি না মরে গেছি সেটাও জানার ইচ্ছে আপনার মধ্যে নেই।অন্তত মানবতা দেখিয়ে খোঁজ নিতে পারতেন।সবাই আজকাল শুধু বয়সের অজুহাত দেখায়।ভাইয়া ঠিক বলেছে আমি ভুল পথে পা বাড়িয়েছি।আপনার মতন মানুষ আমার মতন একটা মেয়ের জন্য কেনো চিন্তা করবে?কি আছে আমার মাঝে?না আছি রূপে না আছি গুণে।শুধু অযথা বকবক করি।”

একটু থেমে নেহা আবার বললো, – “আপনি জানতে চেয়েছিলেন না আপনি বিশেষ কেউ কিনা?আজকের ব্যবহারের পর আপনি একদম বিশেষ কেউ না।”

বলে নেমে গেলো সিএনজি থেকে।রাগের বশে ব্যাগ থেকে যত টাকা বের করতে পেরেছে চালককে দিলো।ফাহাদ এখনও চুপচাপ। দপদপ করে হেঁটে যাওয়া মেয়ের দিকে চেয়ে আছে। সাঙ্ঘাতিক রাগ!এত খারাপ ব্যবহারওতো করেনি।উল্টো সে এক ঝুড়ি অভিমান হাতে ধরিয়ে চলে গেলো।বিষন্ন অনুভব করলো ফাহাদ।ওর মুখটা চোখে ভাসতেই খারাপ লাগছে।মেয়েগুলো অন্তরাত্মায় কম্পন ধরানোর মতন কথা বলে। নেহাও করলো তাই। ফাহাদ নিজেই আড়াল হতে চাইছে।কাঁচা অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে নাতো?

-“উনিতো মাত্র একশ টাকা দিয়া গেলো স্যার”

সিএনজি চালকের কথা শুনে হুশে ফেরে ফাহাদ।বলে,

-“আপনি গাড়ি ঘোরান। ভাড়া নিয়ে ভাবতে হবে না।আমি দিবো”

_______

ছেলে এত বছর যাবত কাজ করে সেনাবাহিনীতে।কই তখনতো এত বড় বিপদ হলো না?নতুন বউয়ের কদম পরতে না পরতেই এত বড় দুর্ঘটনা।বউটা আসলেই অলক্ষ্মী। কুসংস্কারে ডুবে থাকা এখনও সমাজের একাংশ।উন্নত দেশের মাঝে এখনও উন্নতি হয়নি মানুষের ঘুণে ধরা মস্তিষ্কের।এত এত দুঃখের মাঝেও খুশবুকে কথা শোনাতে ছাড়লো না পাড়ার লোকজন।তার কদম নাকি অশুভ এই বাড়ির জন্য।আফতাব এর জীবনে কলঙ্ক হয়ে এসেছে।

ভেঙে যাওয়া অন্তরকে আরো ভেঙে দিলো।এমনেতেই কমতি ছিলো না বেদনার আরো জুড়েছে এসে মানুষের কথাবার্তা।যে কথার কোনো অর্থ নেই। কাদতে চেয়েও কান্না আসেনি। জ্যোস্না রাতে আফতাব এর বুকে মাথা পেতে বলে উঠলো,

-“আপনি বলেছিলেন আমার রাগ,অভিমান,কান্না সব আপনার কাছে জমা রাখতে।বাহিরের কেউ যেনো আমার উপর আঙ্গুল তুলতে না পারে।আমি কতটা দমিয়ে রেখেছি জানেন?আমি সবার সামনে এখন একটি শক্ত স্তম্ভ।আপনি বলেছিলেন বিনা দোষে আমাকে কেউ কিছু বললে আপনি প্রতিবাদ করবেন।কই করলেন না প্রতিবাদ?আমাকে ওরা কতকিছু বললো!আমি আমার কথা রাখছি।কোনো বোকামো করছি না। কান্না করছি না, ভেঙেও পড়ছি না।আপনি কেনো রাখছেন না?”

শ্রবণ ইন্দ্রিয় বেয়ে মস্তিষ্কে পুনর্বার আঘাত হানে প্রতিটি বাক্য।বুকের ডান পাশে মাথা পেতে থাকা খুশবু কি জানে বাম দিকের হৃদপিন্ড কতটা ছটফট করছে?একটু ছুঁয়ে দিতে চাইছে। সান্ত্বনা দিতে চাইছে।অনেক ভালোবাসতে চাইছে।এই চাওয়াগুলো সবই ব্যর্থ।আজ নিজের দেহ নিজের মধ্যে নেই।ইচ্ছায় চালাতে পারছে না কোনো অঙ্গ।ক্যামেলিয়া ফুলের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে অন্তরের নীরব চিৎকার মিয়ে আসছে।

চলবে……