তেইশতম বসন্ত পর্ব-২৯+৩০

0
26

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ২৯
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

হৃদয়ে চঞ্চলতা নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নোমান।এর আগে এমন অনুভূতির সৃষ্টি হয়নি কখনও।এক কঠোর মানবের বক্ষ পিঞ্জিরার অভ্যন্তরে একদল প্রজাপতি উড়ছে এপাড়-ওপাড়।নিজেকে পরিপাটি করার দিকে তেমন নজর দেয়নি সে। এমনেতেই যেভাবে থাকে সেরকম ভাবেই।শুধু পরিবর্তন হয়েছে ভঙ্গিমা।অনেকটা নার্ভাস সে।প্রথম প্রেমানুভব বুঝি এমনই হয়? ক্যাম্পাসের দাবাং ছেলেটার মধ্যে আজ মৃদু অস্থিরতা। মুখখানায় কোনো কঠোরতা নেই।চুপচাপ গাছের নিচে বসে আছে।এখানেই আসার কথা সেই আগন্তুক মেয়ের।যার নাম পরিচয় কোনোটাই জানা হয়নি।কিন্তু তবে হৃদয়ে সুপ্ত অনুভুতি জাগ্রত করেছে অজান্তেই।প্রথমবার প্রেম অনুভূতি এটাই যেনো শেষ হয়।

জিনিয়ার হাত পা থরথর করে কাপছে।নোমানের মতই বদলে গেছে তার মুখ আর দেহ ভঙ্গি।পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করা মেয়েটি ভয়ে কাতর।যেতেই হবে তার।যে করেই হোক।দুজন মুখোমুখি হওয়ার পর পরিস্থিতি কি হবে কে জানে। সীমাকে দূরত্বে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেলো গাছ তলায়।নোমান বসে আছে চুপচাপ।তার সামনে দাঁড়ালো আড়ষ্ট হয়ে।

নোমান জিনিয়াকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে,

-“কি চাই?”

-“ক..কিছু না”

-“এখানে কি করছো তাহলে?নিজের কাজে যাও”

-“আপনিইতো ডাকলেন”

আশ্চর্যে কপালের মধ্যিখানে গাঢ় ভাজ পড়ে।সে ডেকেছে?জিনিয়াকে কেনো ডাকবে সে?বললো,

-“আমি তোমাকে কেনো ডাকতে যাবো?”

ভয়ে ভয়ে জিনিয়া সত্য বলার জন্য উদ্যত হলো।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-“আমিই সেই যার জন্য আপনি এখানে বসে ছিলেন।”

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত পড়লো বাক্যটি। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায় নোমান।চোখে মুখে বিস্ময়,রাগ।মাঝে মাঝে হতবিহ্বল দৃষ্টির ঝলকানি।কথাটি শোনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না নোমান দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আন্দাজও করতে পারেনি।

কিছু সময় ব্যতীত করে নোমান বজ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“তুমি কি মজা করছো আমার সাথে?”

অপরাধীর ন্যায় মাথা দোলায় জিনিয়া।না সূচক উত্তর ইঙ্গিত করছে।দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরলো নোমান।অন্তরে জ্বলজ্বল করা সুপ্ত অনুভূতিতে কেউ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঝলসে দিচ্ছে সবটুকু।

জিনিয়া পরাজিত কণ্ঠে বলে,

– “আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমার ইন্টেশন আপনার ক্ষতি করার ছিলো না।”

গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে নোমান বললো,

– “কি ইন্টেশন ছিলো তাহলে তোমার? হ্যাঁ!আমাকে ভালোবাসার জালে ফেলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যাবে।বলো?”

-“ না না একদম না”

-“কি শত্রুতা তোমার সাথে আমার?কেনো করলে এই কাজটা!আমি রাজনীতি করি সেটা তোমার অপছন্দ।হতেই পারে। দ্যাটস নট এ বিগ ডিল।তাই প্রতিশোধ পরায়ন হবে?আমাকে নিয়ে খেলবে?”

-“আমার এমন কোনো ইন্টেশন ছিলো না আমি সত্যিই বলছি।আপনার উপর রাগ ছিলো।চেয়েছিলাম আপনাকে আচ্ছামত কথা শুনিয়ে আইডি বন্ধ করে দিবো।কিন্তু….”

নোমান তুচ্ছ হাসে।বলে,

– “কিন্তু!কিন্তু ভেবেছো একটু ইমোশনালি হার্ট করলে কেমন হয়?এতে মজা বেশি পাবে তাই না?”

-“না”

-“তো বলো কি শত্রুতা তোমার সাথে আমার বলো? আমি কখনও তোমাকে অসম্মান করেছি?”

-“না” নত গলায় বলল জিনিয়া।

নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নোমান।জ্বলে যাচ্ছে পুরো দেহ।রাগ তরতর করে বাড়ছে মাথায়।এখানে এই মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে নিশ্চয়ই এমন কিছু করে বসবে যা ভালো দেখাবে না।তর্জনী আঙ্গুল তুলে রক্তচক্ষু হয়ে জিনিয়াকে বললো,

-“একদম ভালো করোনি কাজটা”

বলে চলে যেতে চাইলে জিনিয়া নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে নোমানের হাত টেনে ধরলো।নোমান থেমে যায়।কপালের রগ ফুটে উঠেছে।ধরে রাখা হাতের দিকে চাইতেই জিনিয়া তড়িৎ গতিতে হাত ছেড়ে দিলো।

-“দ্বিতীয়বার আমার চোখের সামনে পড়বে না তুমি”

_________

-“কতটা ভালোবাসে এই অধম নিষ্ঠুর মানুষটা তার প্রিয় মানুষকে সেটা চেয়েও বোঝাতে পারবো না।হরিদ্বর্ণ জীবনে যে খুশবু ছড়িয়ে সতেজ করেছে আমায়।আমাকে অজান্তেই পূর্ণতা দিয়েছে।আমাকে এত এত ভালোবাসা উজাড় করার যোগ্য করেছে।যাকে আমি এক পড়ন্ত বিকেলে পেয়েছিলাম।বুকের বাম দিকে হৃদয়ের ঊর্ধ্বগতির সুর শুনেছিলাম।তাকে কাছে পেয়েও আমি দূরে।আমার ছেলেটার আজ এক মাস তিনদিন।আমি তাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারিনি আরিফ!আমি আমার স্ত্রীকে বোঝাতে পারিনি আমি কতটা খুশি।আমি তাকে বলতে পারিনি তার বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার সব দায়িত্ব পালন করতে এসেছে সে।আমি নিষ্ঠুর একজন লোক! জঘণ্যের তালিকায় প্রথম।স্বামী হিসেবে আমি ব্যর্থ।যে চেয়েও পারেনি স্ত্রীর খারাপ সময়ে পাশে থাকতে।”

পাহাড় যেনো আকাশ ছুঁই ছুঁই।বুকের মধ্যে দেশকে আগলে নিয়ে পেরোচ্ছে জীবনের চাকা।প্রতিরোধে সর্বদা প্রস্তুত কেনো পারেনা বুকের মাঝে পড়ে থাকা হৃদয়ের আবেগ প্রতিরোধ করতে?পাহাড়ের কোলে কাটে শীতের রাত।নিশ্ছিদ্র পাহারায় চোখে জ্বলে জ্যোতি।পাহাড়ি পথ, কঠিন চড়াই।কাঁধে ওজনদায়ক অস্ত্র। মনে সাহস অটল।দেশের জন্য জীবন, নিবেদন স্বতন্ত্র।ডাকে পিছুটান।সাথে প্রিয়জনের স্মৃতি মন কেড়ে নিতে সদা প্রস্তুত।তবুও দায়িত্ব মানে না কোনো আবেগ অনুভূতি। আর্মির জীবন এক মহাকাব্য! অমর তাদের ত্যাগ।

কান্নায় ভেঙে পড়া আফতাব এর চোখের দিকে চেয়ে আছে আরিফ।বুক থেকে ধুকধুক আওয়াজ বেরিয়ে আসছে।যেদিন তার ছেলে আসে এই পৃথিবীতে কাদেনি সে। উল্টো উচ্ছ্বাস জ্ঞাপন করেছে।টিমের সব মেম্বারদেরকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে।মাথা নুয়ে ক্লান্ত বসে থাকা মানুষটির কাঁধে হাত রাখলো।বললো,

-“কি করবে আফতাব?আমি বলি চলে যাও।আমি সব সামলে নিবো।”

লালাভ চোখজোড়া তুলে আফতাব ভারী গলায় বললো,

-“বললেই যাওয়া যায়?বললেই ময়দান ছেড়ে পালানো আমাদের ধর্ম?”

-“তুমি সহ্যও করতে পারছো না”

-“না পারছি না।পাগল মনে হচ্ছে নিজেকে।একবার ছাড়া পেতাম এই দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে?এখনই এই মুহূর্তে ছুট লাগাতাম আমার প্রাণের দিকে।যা আমি ফেলে এসেছি।আমি এই মুহূর্তে একজন প্রাণহীন মানব শরীর মাত্র।”

বন্ধুর মতো বন্ধু হলে কি লাগে?আরিফ যেনো পরম যত্নে আফতাব এর মাথায় হাত রাখলো।এই যন্ত্রণা সে নিজেও বুঝে।তখন আফতাব ছিলো তার পাশে।সাহস দিয়ে বললো,

-“আর মাত্র সাতটা দিন ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জা।দায়িত্ব পালন শেষে এক সেকেন্ড দেরি করবে না।দৌঁড়ে পালাবে।একদম দৌঁড়ে”

-“ততদিনে হৃদয়ের শক্তি হারাবো;দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়বে।আমার মন শরীর সবটাই চাচ্ছে এক্ষণ এই মুহূর্তে আমার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিতে।আমি কি পারবো না আরিফ?আমাকে একবার এনে দিতে পারবে কেউ আমার স্ত্রী আর সন্তানকে আমার চোখের কাছে? কয়েক সেকেন্ডের জন্য!জাস্ট ফর এ সেকেন্ড!”

-“পারবে আফতাব।তুমি আগামী এক সপ্তাহ তোমার ছেলের নাম ভাবো।ওকে নিয়ে কত আহ্লাদ করবে ওসব নিয়ে ভাবো।সময় এমনেতেই কেটে যাবে।”

আফতাব শুনলো না।উঠে গেলো পাহাড়ের চূড়ার দিকে। সংকীর্ণ উঁচু নিচু ভূমি কষ্ট দিবে সেদিকে খেয়াল না করেই শুয়ে পড়ে।এই নির্জন রাতের পাহাড় চূড়া।চাঁদের আলোয় মায়ার ছোঁয়া।নীরব প্রান্তরে বাতাস বাতাস মাখামাখি করছে সর্বাঙ্গে।স্বপ্নের মতন রাত ঘনিয়ে আসছে নিশি।তারার মিছিলে আকাশ পূর্ণ।মনের মধ্যে আর্তনাদের ঢেউ।

রাত কাটলো প্রাণহীন প্রতিমার মতো করেই।প্রকৃতির বুকে পাখপাখালি মিষ্টি সুরে গান গাইছে।ঘুমিয়ে পড়েছিল ভোর রাতে। তখনই কেউ একজন আসে বার্তা নিয়ে। আফতাবকে ডাকলো।ধাক্কা দিলো ঘুম থেকে তুলতে।আফতাব চোখ মেলে দেখলো আরিফকে।একলাফে উঠে বসে।কোনো বিপদ হলো নাতো আবার?

-“কি হয়েছে আরিফ?”

আরিফ জবাব দেয়,

-“একটা দুঃসংবাদ আছে”

রুহ কেঁপে উঠে আফতাব এর। হন্তদন্ত কণ্ঠে জানতে চায়,

-“কি!কি দুঃসংবাদ”

-“আমাদের আরো আঠারোদিন এখানে থাকতে হবে”

বিমূর্ত আফতাব।কাতর চক্ষু।এই সংবাদে আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।বুক খাঁ খাঁ করছে।চোখ নামিয়ে ভাবনায় ডুব দেয় আফতাব।আরিফ পাশে বসলো।একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“এখন তোমার কাজ কি জানো?”

আফতাব চোখ তুলে চায়।জিজ্ঞাসু তার দৃষ্টি।আর কি?এখন আর কি কাজ তার?আরিফ হেসে বলে,

-“তোমার কাজ হচ্ছে দিনের এই আলোয় আমরা যে পথে এসেছি সেটা সেফ।হাত মুখ ধোয়ার কোনো দরকার নেই।সকালের নাস্তারও কোনো প্রয়োজন নেই।সোজা বরাবর পথ ধরে কোনোদিকে না তাকিয়ে নিচে চলে যাওয়া।এক দৌঁড়ে গাড়িতে উঠে বসা”

-“মানে!”

-“মানে ক্যাপ্টেন আফতাব মির্জা আপনার আপনার আবেগের মূল্য দেওয়া হয়েছে।পাহাড়ের নিচে দক্ষিণ দিকে আপনার জন্য জিপ দাঁড়িয়ে থাকবে।নোটিস এসেছে আপনার জন্য।আপনি বাড়ি ফিরতে পারেন।”

-“কিহ!”

-“কি আবার কি?বাংলা কথা বুঝো না। কাম অন স্ট্যান্ড আপ। দৌঁড় লাগাও।যত সময় এখানে অপচয় করবে তোমারই লস। হারি আপ!”

মস্তিষ্ক যতটুকু বুঝলো ঠিক ততটুকু কাজে লাগিয়েছে।এক সেকেন্ড,এক মুহুর্ত দেরি করেনি। দক্ষিণের দিকের রাস্তা আফতাব এর মুখস্ত।দিনের আলোয় সমস্যা যতটুকু হওয়ার কথা সেটাও হবে না।এক উন্মাদ কিশোরের মত দৌঁড় লাগালো।যাওয়ার পূর্বে মনে করে ফোন নিয়ে গেছে।পেছন থেকে অস্পষ্ট আওয়াজ ভাসে আরিফের।সে বলছে,

-“আরেহ আস্তে যাও। দৌঁড়াতে বলেছি বলে দৌঁড়াবে নাকি?”

বিপরীতে পাহাড়ে শুনা যায় আফতাব এর কণ্ঠের গুঞ্জন,

-“কিচ্ছু হবেনা আরিফ।আমি জানি এই আমিটাকে সহি সালামতে তার ছেলের কাছে পেশ করতে হবে”

আরিফ শেষ কথাগুলো শুনেনি।হাসলো আনমনে।সেও যাবে কিছুদিন পর তার স্ত্রী আর মেয়ের কাছে।আশায় বুক বাঁধে শেষ প্রহর প্রাণ। ফিরছে সে শেষ হতে চলেছে প্রতীক্ষা।নির্জন রাতের পাহাড় চূড়া ফেলে আপনজনের কোলাহলে।লাফিয়ে নামতে নামতে চোখ ভিজেছে কয়েক দফা।বুকের গতি ঠিক নেই।যেনো খুশির সিন্দুক পেয়েছে।দ্রুত না করলেই হারাবে। হাঁপিয়ে উঠেছে।হাঁটুতে দুহাত রেখে ঝুঁকে গিয়ে নিজেকে শান্ত করেছে কয়েক সেকেন্ডে।আবারো পা জোড়া চললো।ভাবলো আকাশকুসুম ভাবনা।দুটো পাখা থাকলে মন্দ হতো না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়েছে।গাড়িতে বসে নিজেকে শান্ত করেছে।ঘামে মোটা ইউনিফর্মটাও চুপচুপে।মুখ কালচে হয়ে আছে।পায়ের ব্যথা টনটন করতে লাগলো।কেউ জানে না আফতাব আসছে।সদর দরজা খোলা।ভেতরেই দেখতে পেলো কিছু মেহমান।হঠাৎ আফতাবকে দেখতে পেয়ে রুমানা মির্জা চমকে উঠেন।একলাফে উঠে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন বুকে।মাকে জড়িয়ে চুমু খেলো কপালে।আরেকটু হলে কেঁদে ফেলবেন রুমানা মির্জা।মাকে সামলে মেহমানদের সালাম জানায়।খুশবু নেই এখানে। মেহমানদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন,

-“বাবা হয়েছো।তাও আবার ছেলের বাবা।কি সৌভাগ্য তোমার।অভিনন্দন।”

আরেকজন বললো,

-“তোমার যে অবস্থা ছিল আমরাতো ভয় পেয়েছিলাম”

তৃতীয়জন বলে উঠলো,

-“সত্যিই বংশ প্রদীপ জন্ম দিয়েছে তোমার বউ লক্ষী এই ঘরের।”

সবার কথা শুনলো।হাসলো খুব তাচ্ছিল্য করেই।এদের চিনে আফতাব।এলাকার বিজ্ঞ নারীগণ।আফতাব বললো,

-“বেয়াদবি ক্ষমা করবেন আন্টি।আমি যখন কোমায় ছিলাম তখন আমার এই বউটাই আপনাদের চোখে অলক্ষ্মী ছিলো তাই না?”

নারীগণ একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।জবাব নেই তাদের কাছে।আফতাব আবার বললো,

-“কারো জীবনের বিপর্যয়ের দায় অন্য কোনো ব্যক্তির উপর ফেলা যায় না।আমার মধ্যে হয়তো কোনো কমতি ছিলো যে এত কঠোর ট্রেনিং এর পরও শত্রু মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজের বিপদ ঘটিয়েছি।আমিতো গর্বিত।আমার স্ত্রী যে কিনা তার বাবার বাসায় রাজকন্যার মত ছিল সে তার সবকিছু ত্যাগ করে আমার আর আমার পরিবারের সেবা করেছে। হয়তো আপনারা সেসব দেখেননি তাই ওর মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন।…. আমি এসব বলে আপনাদের লজ্জায় ফেলতে চাইনি।কিন্তু হুট করে আপনাদের বদলে যাওয়া মতবাদ শুনে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না।আর বারবার উল্লেখ করছেন ছেলে সন্তান জন্ম দিয়েছে বলে সে লক্ষী?সে আমার ঘরের রানী এমনেতেই।কন্যা জন্ম দিক আর পুত্র।সন্তান জন্ম না দিলেও তার স্থান কেউ নিতে পারতো না।”

সবাই ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

-“এই ছেলে কারো সামনে চোখ তুলে তাকাতো না।আজ এতবড় কথা! বউ কি জাদু করেছে কে জানে?”

কথার বিপরীতে আফতাব মাথা নুয়ে রাখলো।আর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।ঠিক তখনই একটি গম্ভীর আওয়াজ শুনা যায়।পেছনে দুহাত বেঁধে রফিকুজ্জামান মির্জা এগিয়ে আসেন।বলেন,

-“ঠিক বলেছেন আমার ছেলে কারো সামনে চোখ তুলে কথা বলতো না।এটা আমার পারিবারিক শিক্ষা।কারো সাথে কখনও বেয়াদবি যেনো না হয়।তাই বলে আফতাব মির্জা বোবা নয়।সভ্যতা শিখিয়েছি পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেও শিখিয়েছি।সেখানে যদি তার স্ত্রীকে তিরস্কার করা হয় আমার ছেলে অবশ্যই কথা বলবে।চুপচাপ শান্ত মানুষকে দুর্বল ভাবা আমাদের সমাজের ভুল”

চলবে…..

#তেইশতম_বসন্ত
পরিসংখ্যা ৩০
লেখনীতে – Azyah(সূচনা)

স্বর্গের রোদ্দুর নেমে এসেছে পৃথিবীর কোলে।তাকে প্রথমবার দেখে হৃদয় আনন্দে ভোলে।স্বপ্নের পরশে স্নিগ্ধ, মাতৃত্বের বৃত্তে বাঁধা এই ছোট্ট প্রাণ।নবীন সূর্যের প্রজ্জ্বলিত আলোর ন্যায় আবার চাঁদের মত শুভ্র মূখখানা।ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আফতাব।সে যেনো চোখের তারা,জ্যোৎস্নার আলো ছায়া।প্রথম স্পর্শে আবারো একবার জীবনের অর্থ খুঁজে পেলো।তার মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।তার নয়নজোড়া খোলা।চেয়ে আছে ঘাড় বাঁকা করে। এ কে নতুন মানুষ এলো?আফতাব এর হৃদপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পায়।কাছে গিয়ে ঝুঁকে বসলো।পৃথিবীর যত্নে ছোট্ট হাতের স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠলো কায়া।মায়ার মেঘে মিশে গেছে হৃদয়ের আলোড়ন বর্ষ।হাসি ফুটলো গাল জুড়ে।চিনে গেছে তার রক্তের বাঁধন?হৃদয়ের ক্যানভাসে কতরুপ ছবি এঁকেছিলো আফতাব।তার সন্তানের মুখ খানা সব চিত্রের চেয়ে সর্বোত্তম।আরো খানিক ঝুঁকে আসলে দুটো ছোট্ট হাত বাবার গাল আঁকড়ে ধরে।আফতাব খুশির ভারে বুঝি আবার অশ্রু বিসর্জন দিবে।নত কণ্ঠে ডাকলো।

-“বাবা?”

কথাটি কর্ণপাত হয়েছে।শিশু অবুঝ।মাথা নড়চড় করতে শুরু করলো।খামচে ধরছে আফতাব এর মুখ।এই স্পর্শ উপস্থাপন করার কোনো ভাষা নেই কোনো বাক্য কোনো শব্দ নেই।আফতাব ছেলের কপালে চুমু খায়,পরপর গালে এবং হাতে।কাতর কন্ঠে বলে,

-“তোমার সাথে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়।
তোমার আলোর পরশে জীবন অপার মুক্তায়।”

অবুঝ বালক তার বাবার কথা বুঝেনি। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে।পুরো মুখে চোখ বুলাচ্ছে।আফতাব খুশবুর পানে চাইলো।স্মিত হেসে বললো,

-“তোমার মা ঘুমোচ্ছে আর তুমি জেগে আছো কেনো বাবা?”

চোখ উল্টে চাইলো বাবার এমন প্রশ্নে।এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে হয়তো।আফতাব আদর দেয় আর কয়েক দফা। আফতাব দেরি করলো না ঝড়ের গতিতে কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে আসে।

মা হওয়ার পর নারীর রূপ যেনো নতুন।প্রকৃতির সুষমা পায় তার মধ্যে গুণ।চোখে তার মমতার নীলাভ আভা।ঘুমন্ত অবস্থায় অজ্ঞাত হাসিতে ফুটে ওঠে চিরন্তন ভালোবাসা। নিশ্চয়ই কোনো ভালো স্বপ্ন দেখছে?গর্ভধারণের ক্লান্তির রেশ বেশ।তবে আছে মায়ের মুখে স্নিগ্ধতা।এলোমেলো চুলের ভাঁজে লেগে থাকা শিশুর স্পর্শ।বদলে যাওয়া শরীর এর মন।তবু মায়ের রূপে খুশবুর মাঝে চিরন্তন মোহমায়া।এই সৌন্দর্য যেনো অনন্তের রূপ।মা হওয়ার পর তার একান্ত নারী পেয়েছে নতুন ছন্দের ধূপ। মুগ্ধ হলো এই রূপে প্রেমিক হৃদয়।

আফতাব ফ্রেশ হয়েই কোলে তুলেছে ছেলেকে।বিছানায় আধশোয়া হয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো একহাতে।অন্যহাত খুশবুর কোমল চুলে।ঘুমাক একটু। নিশ্চয়ই এই পুঁচকেকে সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত?

আফতাব ছেলেকে প্রশ্ন করলো, -“আম্মুকে কি বিরক্ত করো বাবা?এই অবেলায় ঘুমোচ্ছে যে?”

আফতাব এর বক্ষে নড়েচড়ে উঠলো তার পুত্র। বারবার মাথা তুলে দেখতে চাইছে নতুন মুখ।তবে এখনো অপরিপক্ক তার ঘাড়।বলে নেই তেমন।আফতাব সাহায্য করলো তাকে। ঘাড়ের দিকে হাত রেখে সামান্য তুলে ধরলো।কাতর কন্ঠস্বর,

-“চিনতে পারছো?আমি তোমার বাবা।একজন খারাপ বাবা! যে তার প্রথম স্পর্শ তার প্রথম সন্তানকে ছোঁয়াতে পারেনি।”

গোলাকৃতির চোখ আফতাবে নিবদ্ধ।তার মায়ের কোনো খেয়াল নেই।সে ঘুমোচ্ছে নির্বিকার।ঘন নিঃশ্বাস জানাচ্ছে কতটা ক্লান্ত সে।আফতাব পূনরায় প্রশ্ন করলো,

-“আমাকে অনুভব করতে পারছো?”

খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলো তার পুত্রধন।শক্ত চুমু বসায় আফতাব তার নরম তুলোর মত গালে।পুরো মায়ের মত হয়েছে দেখতে।ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে খুশবুর দিকে যায় আফতাব।ঘুমন্ত খুশবুকে তুলে পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো।বিরক্তি ফুটে খুশবুর মুখে।এত টানা হেঁচড়া পছন্দ হচ্ছেনা বোধহয়।আরো এক নিষ্পাপ মুখে অনবরত ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে লাগলো।যতক্ষণ ইচ্ছে।খুশবু নড়েচড়ে উঠে।চোখ খুলে কিছুটা।অর্ধ খোলা চোখ পুরোটা খুলে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছে।নিষ্পলক বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইলো।আফতাব হেসে অধরে শক্ত চুমু খেয়ে বললো,

-“আমার ছেলেকে একা ফেলে নাক ডেকে ঘুমানো হচ্ছে?”

খুশবুর মস্তিষ্ক সজাগ হলো।হাত বাড়িয়ে দেয় আফতাব এর গালে। বারবার ছুঁয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে।হাতের চুড়িগুলো ঝংকার তুলছে।আফতাব হাতটা ধরে ফেললো।বললো,

-“আপনি কি জানেন আপনার চুড়ির আওয়াজ আমার অন্তরে অন্য রকম শিহরণ জাগায়?আর এইযে নাকে মুক্তোর মত জ্বলজ্বল করা নাকফুল?আমার চোখের জ্যোতি।”

খুশবুর ঠোঁট মৃদু কেঁপে উঠলো।সে নিঃশব্দ।আফতাব পূনরায় প্রশ্ন করে,

-“কি বিশ্বাস হচ্ছে না এসেছি?”

খুশবু মাথা দোলায় দুদিকে।আফতাব আরো শক্ত করে খুশবুকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,

-“মধ্যম উঁচু পাহাড় থেকে দাপিয়ে নেমে এসেছি।কারণ স্বপ্নে আমার ছেলে এসে আমায় নালিশ করে গিয়েছিল”

-“কি নালিশ?”

-“এইযে তার গুণধর মা তাকে রেখে মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে।”

খুশবু সামান্য মাথা তুলে বসলো। আফতাবকে সম্পুর্ণরূপে নিজের সঙ্গে জরিয়ে অভিমানী সুরে বলতে লাগলো,

-“আপনি জানেন আপনার ছেলে আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয়না।সারারাত ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে।আমার চুল টেনে ধরে। কোল থেকে নামিয়ে দিলেই হাত পা ছুড়তে থাকে।বাকি সবার কোলে থাকে শুধু দশ মিনিটের জন্য।সারাদিন আমার সাথে।আমার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে দেখুন। জনাবকে নিয়ে বসাও যায় না।হেঁটে হেঁটে তাকে ঘুম পাড়াতে হয়।”

সব অভিযোগ শুনলো আফতাব।চোখে চোখ রেখে বললো,

-“তুমি ওর মা-তো।আরাম পায় তোমার উষ্ণতায়”

সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ছেলের পেছনে এত এত খাটুনি গেছে যে খুশবু ভুলতে বসেছিলো সে মা হয়েছে এক নব্য প্রাণের।অনুভব করার সময় অব্দি নেই।আফতাব তাকে অনুভব করালো।খুশবু কিছুক্ষন চুপ রয়ে বললো,

-“আমার জানেন বিশ্বাস হয়না।কিন্তু ওকে যতবার বুকে তুলে নিয়েছি হাত পা কেঁপেছে।আপনার কথা মনে পড়েছে।আমি ভয় পাচ্ছিলাম কিভাবে ওর দায়িত্ব পালন করবো?যদি ভুল করে বসি?”

-“আমি এসে গেছিতো।এখন আর কোনো ভয় নেই।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে ছেলেকে কোলে নেয় খুশবু।পরপর আফতাব এর বুকে মাথা রেখে বললো,

-“ব্যাঙ এর মত লাফায় আপনার ছেলে।”

শব্দ করে হাসে আফতাব।বলে,

-“এই ব্যাঙ এর কোনো নাম রেখেছেন কি?”

খুশবু জবাবে বলে,

-“জন্ম থেকে শুরু করে সবকিছু সে আমার কাছ থেকে পেয়েছে।নামটা নাহয় ওর বাবাই রাখুক?”

-“তাহলে বাবা তার সাথে মিলিয়ে নাম রাখবে।”

খুশবু দুষ্টু হেসে জবাব দেয়,

-“যান দিলাম নাহয় একটা সুযোগ। এমনিতেও তার বাবা এবাড়ির মেহমান। কালেভদ্রে তাকে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়।”

-“ভবিষ্যত সেনা সদস্যের নাম হবে তাহলে আফওয়ান আফতাব মির্জা।”

নামের দিকে খেয়াল নেই খুশবুর। ভবিষ্যত সেনা সদস্য শুনে চটে গেলো।চোখ রাঙিয়ে তাকায় আফতাব এর দিকে।পরপর ড্যাবড্যাব করে চেয়ে তাদের দুজনকে দেখা ছেলের দিকে।ছেলেকে শাসিয়ে খুশবু বললো,

-“শুনো ব্যাঙ তোমার বাবা লোকটা মোটেও সুবিধার নয়।রাত বিরাতে আমাকে ফোন করে বিরক্ত করতো।শেষমেশ বিয়ে করেছে ভুলিয়ে ভালিয়ে।তোমাকে নয়মাস আমি গর্ভে ধারণ করেছি।কত বিরক্ত করেছো আমাকে তুমি জানো?আর তোমার বাবা ঢ্যাং ঢ্যাং করে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে বেরিয়েছে।এখন বলো তোমার বিবেক কি বলে?তুমি কার কথা শুনবে?”

আফতাব ফোড়ন কেটে বলে,

– “এতটুকু বাচ্চার বিবেক? মা হয়ে মাথার ভিতরে শর্ট সার্কিট হয়েছে নাকি খুশ?”

-“আপনি চুপ থাকুন”

-“শুনবে….আপনার সব কথা আমি আর সে একত্রে মাথা পেতে নিবো”

খুশবু আর কোনো জবাব দিলো না।দুষ্টুমিতে মেতে গেলো আফওয়ান এর সাথে।সেও মায়ের সাথে সায় দিচ্ছে।সাথে আফতাব এর হাতের আদুরে পরশ সাদরে গ্রহণ করছে।আফতাব খুশবুর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-“কোনো অভিমান নেই?”

খুশবু ধীরে সুস্থে জবাব দিলো,

– “ছিলো।খুব কান্না করেছিলাম যখন আপনাকে ছাড়া আমার হাসপাতালে যেতে হয়েছিলো। ব্যথায় কাতরে আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি। পাইনি।সেদিন মন অভিমানে ভরপুর ছিলো।তারপর আপনার রূপে আমি এই ব্যাঙকে পাই।যখনই মন কেঁদে উঠতো তখনই সে খিলখিল করে হাসতো।ওর হাসি দেখে আর অশ্রু ঝরে?”

-“আর এখন?”

-“এখন দ্বিগুণ সুখ ক্যাপ্টেন।পূর্ণ পূর্ণ লাগছে সবটা।নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে আফওয়ান মির্জার মা হয়ে”

খুশবু আবার জিজ্ঞেস করলো,

– “আবারো কি চলে যাবেন?”

-“দেশের সেবা শেষে এখন বউ বাচ্চার সেবা করতে এসেছি।এত শীগ্রই তো যাচ্ছি না।”

_________

-“এগুলো কি ধরনের ফাজলামো!”

পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে জিনিয়া।সামনেই নোমান।জিনিয়ার মুখে শয়তানি হাসি।নোমানের পেছনে দাঁড়িয়ে জিনিয়ার ছোটবেলার দুই বন্ধু সাগর আর শুভ্র। নোমানকে অনেকটা জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে।বাড়ি ফেরার পথে তাকে বাধ্য করা হয় তাদের দুজনের সাথে আসতে।বিনিময়ে ছুরি দেখানো হয়েছিলো তাকে।ভর দুপুরে নির্জন জায়গায় ছুরি দেখে নূন্যতম জীবনের ভয় পেয়ে জীবন উৎসর্গ করতে এসে দেখলো জিনিয়ার মুখ।অংক মিলেছে।হিসাব একদম বরাবর।

জিনিয়া বললো,- “কিসের এত জেদ আপনার?”

-“এসব ছাড়ো। তুমি কি এনি হাও আমাকে তুলে এনেছো?”

ফিক করে হেসে জিনিয়া বললো,

– “হ্যাঁ! হাও সিনেম্যাটিক!”

নোমান রাগের বশে পিছনে ঘুরে তাকায়।এই ছিলো পাতি মাস্তান।সাগর আর শুভ্রর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

-“কোন ক্যাম্পাস!কাকে ভয় দেখিয়েছিস জানিস!এমন পেটানো পেটাবে আমার লোকজন নাড়ি ভুঁড়িও অবশিষ্ট থাকবে না।”

শুভ্র জবাব দেয়,

– “আমাদেরও জানের আর প্রেমের ভয় আছে।আমার হবু শ্বশুরকে জিনিয়া কল করে আমার নামে উল্টোপাল্টা বলবে বলে হুমকি দিয়েছিলো।বাধ্য হয়ে আপনাকে তুলে আনলাম। এমনেতেই আমরা ভালো ঘরের ছেলে”

নোমান ঘুরে তাকায় জিনিয়ার দিকে।বলে উঠে,

-“সিরিয়াসলি!”

-“ইয়েস সিরিয়াসলি!তো নেতা সাহেব?আপনি ভয়ও পান?বেশ মজারতো ব্যাপারটা।”

নোমান হাত তুলে বললো, -“তোমার ড্রামা শেষ?”

-“না না এখনও শেষ হয়নি।শুনুন আমার কথা।”

-“আমি তোমার সাথে কোনো রকমের কথা বলতে ইচ্ছুক নই।”

-“আমার সাথে বলা লাগবে না।আমার বাবার সাথে বলুন।অনেক তিরিং বিড়িং করেছেন।এবার সোজাসুজি বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবেন। ঘাড়ত্যাড়ামো করবেন না একদম।বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন বিয়ে করতে চান।”

অট্টহাসিতে কেঁপে উঠলো ছোট্ট ছিমছাম রেস্তোরা।যেনো কোনো কৌতুক বলেছে জিনিয়া।হাসি থামিয়ে নোমান প্রশ্ন করে,

-“মজা করছো তাই না?”

-“মজা কেনো করবো?আপনি ভালোবাসেন না?”

-“আমি সেই আগন্তুক মেয়েটাকে ভালোবাসি।তোমাকে নয়”

-“আমিই সেই আগন্তুক।”

-“ধোঁকাধারীর সম্পর্ক টিকে না।”

-“আপনি টিকিয়ে নিবেন যেভাবে নিজের দলটাকে টিকিয়ে রেখেছেন।আর হ্যাঁ আমার মনে হলো আপনাকে বিয়ে করলে একটা রিয়েল লাইফ এডভেঞ্চার হবে।”

-“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে জিনিয়া!”

-“ভালোয় ভালোয় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েন।বিনিময়ে আগন্তুক সেজে আপনাকে জ্বালানোর কারণে ক্ষমা চেয়ে নিবো”

রাত হতে চললো।নোমানের ফোন বন্ধ।বাড়ির সকলেই অনেক টেনশনে।আজ হরতাল সারা সিলেট শহরে। জনমানব শূন্য বলা চলে।এই অবস্থায় ছেলের ফোন বন্ধ পাওয়া দুশ্চিন্তার বিষয়। বাস জ্বালানো থেকে শুরু করে হানাহানির খবর পাওয়া গেছে।আহত অনেকে।মায়ের চিন্তা দেখে কিছুতেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না নেহা। তারও বুক কাপছে।ফোন করলো একের পর এক নোমানের সহচরদের।কারো কাছ থেকেই খোঁজ পাওয়া যায়নি।এরপর কল আসে ফাহাদের।কল রিসিভ হতেই ফাহাদ জানতে চাইলো,

-“ফোন ব্যস্ত ছিলো কেনো বাঁদর মেয়ে?”

চিন্তিত গলায় নেহা বলে, – “ভাইয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না।ফোন অফ তার আড়াই ঘন্টা যাবত।সবাইকে কল করে খোঁজ নিচ্ছিলাম।বাড়ির সকলে চিন্তিত।”

ফাহাদ স্বাভাবিক সুরেই প্রশ্ন করে, – “আর তুমি?”

-“কেমন প্রশ্ন করলেন?আজ হরতাল এর এমন পরিবেশে ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।আমি চিন্তিত হবো না?”

-“হুউউম খুবই চিন্তার বিষয়।এসো দুজনে মিলে চিন্তা করি”

অবাক হলো নেহা।প্রশ্ন করলো,

-“আপনার চিন্তা হচ্ছে না?এত স্বাভাবিক কিভাবে আপনি?”

-“তোমার ভাইয়ের জন্য চিন্তা করে কি করবো বলো?সে তো আমাদের বিয়েতে মূল বাঁধা।হতে দিবে কিনা সেটাও শিউর নয়।”

আকস্মিক কেঁদে উঠে নেহা।ফাহাদের কথা আরো ভয় বাড়াচ্ছে তার।এত স্বাভাবিক কি করে থাকে মানুষ?নোমান তার বন্ধু।একটুও চিন্তা হচ্ছে না?

-“এই মেয়ে এই কান্না করছো কেনো?”

-“ভাইয়া ঠিক আছে তো?”

-“এসো তোমাকে একটা সিক্রেট বলি।কান পেতে শুনো”

-“কি?”

-“তোমার ভাই এই হরতাল এর গমগমে পরিস্থিতিতে তোমার ভাবির সাথে ডেটে গিয়েছে।তোমরা যেনো বিরক্ত না করো তাই ফোন অফ।কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে বুঝোইতো”

বোকার মত কথাগুলো শুনে গেলো নেহা। কোনোটাই মাথার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।ছাড়া ছাড়া কথা শুনছে।আসল রহস্য জানতে একের পর এক প্রশ্ন করে ফাহাদকে।ফাহাদ প্রথমে খানিক বিরক্ত হলেও আজ নেহার প্রত্যেকটি কথার জবাব দেয়।কোনো প্রকার হুমকি ধামকি ছাড়াই।শেষমেশ বললো,

-“আর অযথা কান্না করবে না।এসব কান্না টান্না আমার সহ্য হয় না একদম”

________

মাঝরাতে ফুঁপিয়ে কান্নার ধ্বনি শুনা গেলো।অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে থেকে যেনো কোনো আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে।অর্ধ ঘুমে খুশবু হাত দিয়ে হাতড়ে দেখলো বিছানা।ভড়কে উঠে।বিগত একমাস যাবত এটা তার অভ্যাস।বুকে ভয়ের দানা তরতর করে বাড়ছে।ছেলে কোথায় তার।হঠাৎ চোখ মেলে তাকাতেই জানালার পাশে অবয়ব এর দেখা মেলে।টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই আফতাব ঘুরে দ্রুত চোখ মুছে হাসি মুখে ফিরে তাকায় আর বলে,

-“বাবা ছেলে একান্ত কিছু সময় পাড় করছিলাম”

খুশবু আফতাব এর ভাঙ্গা কন্ঠস্বর ধরে ফেললো।সাবধানে নেমে এলো বিছানা থেকে।আধাঁর আর আলোর মাঝামাঝি ঘরের পরিবেশ।আফতাব এর গালের কোণে এক বিন্দু অশ্রু দানা মুছে দিয়ে বললো,

-“বিরক্ত করলাম বুঝি?”

আফতাব এর মুখটা মলিন দেখাচ্ছে।চোখে চোখে লুকোচুরি খেলছে।বুঝতে দিতে চাইলো না সে এতক্ষণ ছেলেকে বুকে নিয়ে কাদছিলো।নিরুত্তর আফতাবকে আবারো খুশবু বলে,

-“জানেন আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে?”

-“কেমন?”

-“ছিঁচকাঁদুনে শিশুর মত।আমি জানতাম না আপনি কাঁদতেও জানেন?”

আফতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“আমার অনুভূতির ভার অন্তর নিতে পারছে না চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।কঠোর থেকে কঠোর পুরুষ তার সন্তানের কাছে অত্যন্ত দুর্বল।আর এই দুর্বলতা লজ্জার নয় বরং সৌভাগ্যের। আমিও ভীষণ দুর্বল খুশবু আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে।আর আমার পুরুষত্বে কোনো প্রকার আঁচ আসছে না সেটা স্বীকার করতে।একদম নাহ!”

চলবে…