তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১০

0
19

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১০
লেখিকা- রিয়া খান

মিশান আবার হেসে দিলো জোরে,
‘‘স্যার আমাকে ভয় দেখানোর দরকার নেই, মৃত্যু দেখে মিশান ভয় পায় না। বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই এই পৃথিবীতে। মারবেন ই যখন আর কটাদিন পর মারবেন। এখনো অনেক ব্র‍্যান্ডের মদ খাওয়া বাকি আছে স্যার।
উত্তর কুরিয়া থেকে কিম-জং-উন সাহেব আমার জন্য ২৫০ বছর পুরোনো মদ পাঠাবে বলেছে, আমি সেটা খাওয়ার পর ই মরতে চাই স্যার।”
তীব্র রাগী নিশ্বাস ছেড়ে, উচ্চস্বরে ধমক দিলো,
‘‘অই চুপ! আর একটা শব্দ না! মেরে ফেলবো কিন্তু।”
‘‘স্যার আপনি এতো চেতেন কেনো কথায় কথায়? রাগ তো আমারও আছে কিন্তু এইভাবে কথায় কথায় চেতে উঠার বদঅভ্যেসটা নেই। তবে আপনার
নামের সাথে চালচলনও মিল আছে, দুটোই তীব্র। তবে ভালো কিছু না, নেগেটিভ সাইড টাই তীব্র আপনার।”
মিশানকে যতোই থামতে বলছে ততোই কথা বাড়াচ্ছে, তীব্র এবার একটা বক্স থেকে স্কস্টিপ বের করে মিশানের মুখে আটকে দিলো, এখন আর চাইলেও কথা বলতে পারবে না।
কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে বার বার ব্যর্থ হয়ে চুপ হয়ে গেলো আপনা আপনিই। চুপ থাকতে থাকতে এক পর্যায় ঘুমিয়ে গেল।
তীব্র রাগের মাথায় মিশানকে জেলে ভরতে চাইলেও এখন মাথা ঠান্ডা করে ভাবলো জেলে নেয়া যাবে না। এমনিতেই রাত দিন পেছনে সাংবাদিক পড়ে থাকে, মেয়ে মানুষ এভাবে ধরে নিয়ে জেলে ভরলে নানান রকম নিউজ হয়ে যাবে। মিশানের ক্ষতি হওয়ার মতো তো কিছু নেই ই, তবে ওর জন্য ওর মামার প্রেজটিজ নষ্ট হবে। নানান দিক চিন্তা করেই আর জেলে নিলো না।
নিজের হোম এরিয়া থেকে দূরে গাড়িটা থামিয়ে তীব্র গাড়ির বাইরে থেকে লক করে রেখে বাড়ি চলে গেল।
মিশান গাড়ির ভেতরেই গভীর শান্তিময় ঘুম দিয়েছে।
আর তীব্র নিজের বাড়ি গিয়ে রোজকার রুটিন অনুযায়ী কাজ করছে।
‘‘আপিইই অই আপিইই!
আপিইইই!”
ভোর বেলা সেই দুঃস্বপ্নের আনাগোনা দেখা গেল। নিশানের সেই মায়াবী কন্ঠস্বর মিশানের দিকে মায়াবীচোখে তাকিয়ে মাধুর্য মিশিয়ে ডাকছে ওকে।
‘‘অই আপিইই তুমি কবে ফিরবে? আমার রোজ রোজ ভিডিও কল ভালো লাগে না, দেখো আমি মরে গেলে তখন তোমার ঠিকি সময় হবে। আচ্ছা আপি তুমি এটা বলো, তোমার কাছে আমি বড় নাকি তোমার জব বড়? মানলাম এই পেশাটা আমিই তোমাকে বেছে নিতে বলেছিলাম।কিন্তু তুমি তো জানো আপিই আমার সময়ের স্কেল কতটা নিচে নেমে এসেছে, কোনো একদিন দেখবে আমি আর ঘুম থেকে উঠছি না। আমি বলে দিলাম তোমায় দেখো, মৃত্যুর আগে আমি যদি তোমায় দেখতে না পাই, তাহলে তুমিও আমাকে শেষ দেখা দেখতে পারবে না, আমার জানাজার শেষে তুমি ফ্লাইটের টিকিট পাবে। তুমি তো বলেছিলে আপি একটা সুন্দর মৃত্যু দেবে আমাকে! আপিই কথা বলো, চুপ করে আছো কেনো? আপিইই! এই আপিইইইইই!”
শেষ ডাকটা নিশান অনেক জোরে দেয়ায় মিশান চমকে উঠে। সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খোলার পর অনুভব করছে ওর হৃদস্পন্দন হচ্ছে অতি মাত্রায়, এটা দুঃস্বপ্ন দেখার ফলেই হচ্ছে।
মাথাটাইও খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো মিশানের হাতে হ্যান্ডকাপ লাগানো।
একটা গাড়িতে বসে আছে।
হ্যান্ডকাপ থেকে নিজের হাত বের করার বৃথা চেষ্টা কিছুক্ষণ চালালো তাতে কোনো লাভ হলো না। কিন্তু মিশানের এখন বাইরে বের হতে হবে যে করেই হোক।অনেক বেলা হয়ে গেছে, বাড়িতে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পারলে মামা রাগ করতে পারে। না পারছে হ্যান্ডকাপ থেকে হাত বের করতে, না পারছে গাড়ির ভেতরে থেকে নিজেকে বের করতে।
পকেটে হাত দিয়ে নিজের মোবাইলটা খুঁজছে, মোবাইল পকেটে নেই।
এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজাখুঁজি করছে এক সময় ফোন টা গাড়ির পেছনের সিটে দেখতে পেল।
রাতে অনেকবার কল আসার কারণে তীব্র বিরক্ত হয়ে ফোন অফ করে ঢিল মেরে পেছনের সিটে দিয়েছে। অনেক কষ্টে নিজের ফোন টা পেছনের দিকে ঝুঁকে হাতে তুলে নেয়। ভাগ্যিস হাতটা সামনের দিকে রেখে আটকে দিয়েছিলো যদি হাত পেছনে নিয়ে আটকে রাখতো তাহলে কোনো ভাবেই সম্ভব হতো না।
ফোন সুইচ অন করে দ্বীপকে কল দেয়।
‘‘মিশান কোথায় তুই?”
‘‘আরে জানিনা কার গাড়িতে আটকা পড়ে আছি। গাড়ির মালিককেও দেখতে পাচ্ছি না, হাতে হ্যান্ডকাপ পড়ানো। হয়তো কোনো পুলিশের কাজ হবে। বের হবো কিভাবে বুঝতে পারছি না, বাইরে থেকে লক করা। উইন্ডো গ্লাস সরিয়ে বের হতে পারবো কিন্তু ব্যালেন্স কন্ট্রোল করতে না পারলে গায়ে ব্যাথা পাবো, বিশেষ করে মাথায়।”
‘‘আচ্ছা তুই লোকেশন টা বল আমি আসছি।”
‘‘আরে ভাইরে কোথায় রেখেছে নিজেও জানি না আশেপাশে কোনো শপিং স্টোরও দেখছি না, চারপাশে পুরোনো কিছু ভাঙাচোরা গাড়ি দেখতে পাচ্ছি আর দুই পাশে বিশাল এরিয়া জুড়ে প্রাচীন কালের ভাংগাচোরা কিছু বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছি,আদৌ ঢাকায় আছি কিনা সন্দেহ।কোনো মানুষ তো দূরে থাক একটা পাখিও দেখতে পাচ্ছি না। আমার ফোনে লোকেশন অন করা, তুই ট্র‍্যাক করে আয়।”
‘‘ওকে ওকে তুই শান্ত হ, আমি আসছি।”
‘‘আচ্ছা আয়।”
দ্বীপ লোকেশন ট্র‍্যাক করে মিশানের দিকে আসতে নিল। আসতে আসতেই দেখতে পেল এটা ঢাকার ভেতরেই কোনো এক প্রত্যন্ত এলাকা, অনেকটা ভূতুরে পরিবেশ। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েই গেল, মিশান গ্লাস ওপেন করে বের হতে লাগলো বাইরে থেকে দ্বীপ ওকে ধরে নামালো।
হ্যান্ডকাপ গুলো নিয়ে পড়লো বিপদে।
পরিচিত এক স্টিলের দোকানে গিয়ে হাত থেকে হ্যান্ডকাপ কাটিয়ে নিল।
এবার শান্তি শান্তি লাগছে।
বাড়ি যাওয়ার পর ইন্নোসেন্ট ভাব নিয়ে রইল সবার সামনে। এরকম একটা বিপদে পড়েছিল সেটা কেবল মিশান আর দ্বীপের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। রাতের ঘটনার কথা তো বাদ ই দিলাম।
দ্বীপ সব সময় মিশানের আদ্য অন্ত খবর জানে, বিপদে পড়লে মিশানকে বাঁচানোর জন্য দ্বীপ ই ভরসা। দুজনে সমবয়সী বলে একে অপরের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। মিশানের মামা প্রতিমাসে যে পরিমাণে হাত খরচের টাকা ওকে দেয় সেটা একজন মেয়ের বিলাসিতা করে ঘুরা ফেরা করার মতো এমাউন্ট হলেও তাতে মিশানের পোষায় না, মামা তো টাকা দেয়ই সেই সাথে মামীও চুপ করে নিজের ভাগ থেকে মিশানকে টাকা দেয়। এগুলো মিশান উড়িয়েই ফুরায়। ওর মদের খরচ ম্যাক্সিমামটা দ্বীপ বহন করে।
মিশানের ভেতরের যন্ত্রণা, দ্বীপ প্রতি সেকেন্ডে ফিল করতে পারে বলেই ওকে কখনো বাঁধা দেয় না।
‘‘মিমি খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দাও তো।”
বহুদিন পর মিশানের মুখে খাবার চাওয়ার ডাক শুনে মামী তৎক্ষণাৎ খাবার রেডি করে নিজের হাতে। সেই যে রাতে বিদেয় দিয়েছিলো মিশান এসে ডাক দেয়ায় তার প্রাণ ফিরে এল যেনো।
পরিচয় বিহীন একটা মেয়েকে কেউ এতোটা ভালোবাসতে পারে সেটা মিশানের মামীকে না দেখলে বুঝা যেতো না।মামী খাবার নিয়ে আসতে না আসতেই মিশান ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে, মাথায় দু মগ পানি ঢেলেই চেঞ্জ করে বেরিয়ে পড়ে ।
হঠাৎ আজ কি করে এতো খিদে খিদে লাগছে নিজেও জানে না মিশান।
মামী এত্ত এত্ত খাবার দিয়ে ডাইনিং ভরে ফেলেছে।
মিশানেরও খাবার দেখে আরো খিদে বেড়ে গেল। বেশি করে খাবার প্লেটে তুলে দু তিন লোকমা খেতেই পেট যেনো ফুল হয়ে গেলো। চার নাম্বার লোকমা অনেক কষ্টে গিললেও পাঁচ নাম্বার টা আর গেল না ভেতরে।
খাবার খেতে না পেরে প্লেটের উপর হাত ধুয়ে উঠে চলে গেল।
মামী মুখ শুকনো করে মিশানের দিকে তাকিয়ে রইল,
কাজের বুয়াও একই ভাবে তাকিয়ে থেকে বনিতা বেগমের কানে কানে বলল,
‘‘আপামণি, মন খারাপ করিয়েন না একখানা কথা বলতাম। আম্মাজানের তো আবার কোনো রোগ হইলো না?”
বনিতা বেগম চোখ বড় বড় করে তাকালো কাজের বুয়ার দিকে।
‘‘আপামণি রাগ করিয়েন না, আমি যা বলি একটু মন দিয়া শুনেন, আপনিই দেখেন বড় আম্মাজান আগে কি সুন্দর নাদুসনুদুস আছিলো, যা দিতেন তাই খাইতোও, কিন্তু ছোটো আম্মাজান মরার আগে দিয়া যে একবার দেশে আসছিলো তখন থেইকা খেয়াল করছি বড় আম্মাজান কম খায়। মাস খানেক থাইকাও গেল, প্রতিবার ছোটো আম্মাজানরে রক্ত দিলেও সেবার আর দিলো না। আর যখন দেশে আসলো তখন থেইকা ভালোমতো দেখলাম বড় আম্মাজান আগের মতো খায় না, দিন যত যাইতেছে ততোই তাঁর শরীর জানি কেমন হইয়া যাইতেছে। আমার কি মনে হয় জানেন আপামণি? বড় আম্মাজান জানে তাঁর রোগের কতা। বছর হইয়া আইলো কতাটা আমি বলমু বলমু কইরা বলা হয় নাই, আইজ বইলাই দিলাম। বিষয়টা মাথায় নিয়া দেখেন আপামণি।”
বনিতা বেগম কথাটা ফেলতে গিয়েও ফেলল না, কারণ কথাটা সত্যিই মিলে যাচ্ছে।
মিশান আগে খুব একটা হাসিখুশি না থাকলেও নিশানের জন্য ওর হাসি খুশি
থাকতে হতো। কিন্তু বনিতা বেগম ভেবে দেখলো মিশান নিশান মারা যাওয়ার আগে থেকেই কেমন যেনো নির্লিপ্ত হয়ে আসছিলো। তারমানে মিশানের সত্যিই কিছু হলো না তো!
নানান কথা ভেবে নানা রকম দুশ্চিন্তা করছে। নিশানকে মিশানের থেকে বেশি ভালবাসতো, নিশান চলে যাওয়ার পর মিশানের থেকে বেশি মামীই ভেঙে পড়ে। এখন যদি মিশানেরও কিছু হয় তাহলে বড্ড কোণঠাসা হয়ে পড়বেন উনি।
মিশান নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিলো, মামী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিশানের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণে থেকে পানি মুছে সরে গেল।
এবেলা বাড়িতে থেকে, বিকেলের দিকে বের হলো, হাঁটতে হাঁটতে সেই স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো যেখানে রোজ আসে।
পায়ের জুতো খুলে ফুটপাতে বসতে না বসতেই টুকটুকি চা নিয়ে হাজির।
এক কাপ চা নিয়ে মুখে দেবে তখনি তমাল এসে দাঁড়ায় সামনে। সেই সকাল থেকে একটু পর পর এখানে রাউন্ড দিয়ে যাচ্ছে। এখন মিশানকে দেখে দৌড়ে কাছে আসে।
চেহারায় একটা নার্ভাস নার্ভাস ভাব বিরাজ করছে।
‘‘ম্যাডাম আপনি এসেছেন, আমি সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি।”
মিশান মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
‘‘আরে এসব প্রেম ট্রেম আমার দ্বারা হবে না, আমি বিবাহিত।”
‘‘ম্যাডাম আমি সে কথা বলছি না।”
‘‘তাহলে?”
ভয়ার্ত কন্ঠে তমাল বলল,”
‘‘ম্যাডাম জোবায়ের?”
‘‘জোবায়ের কে?”
‘‘ম্যাডাম আপনার কি মনে নেই? গত কাল নিজেই ওর কথা জিজ্ঞেস করলেন, রাতে একসাথে বারে গেলাম।”
‘‘মনে নেই।”
‘‘ম্যাডাম রাতে যে আপনি বললেন ওকে মেরে ফেলেছেন?”
মিশান যেনো আকাশ থেকে ভেঙে পড়ল এটা শুনে, বিকৃত মুখে তাকিয়ে বলল,
‘‘কিহ!”
‘‘ম্যাডাম আসল ঘটনা আপনিই জানেন, রাতে আমাকে বাইক দিয়ে পাঠালেন, আমি বারের সামনে এসে দেখি আপনি জোবায়ের কেউ নেই।
আমি অনেকবার আপনাদের ফোনে কল দেই, কেউ রেসপন্স দিচ্ছিলেন না। হঠাৎ আপনি রিসিভ করে বললেন ওকে মেরে দিয়েছেন।”
‘‘অই কাকে কি বলছিস সারারাত স্বপ্ন দেখেছিস? বারের ভেতরে গিয়েছিলিস?বাইরে খুঁজলে পাবি কি করে, আমি ছিলাম ভেতরে।”
‘‘ম্যাডাম আমি ভেতরেও গিয়েছিলাম ওখানে কোথাও ছিলেন না, আর আপনি নিজেই বলেছিলেন আপনি জোবায়েরকে মেরে ফেলেছেন।”
‘‘বলতেই পারি, নেশার ঘোরে মানুষ কতোকিছুই বলে, আমিও বলেছি। তাই বলে তো এটা নয় যে আমি মেরেছি। ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখ অই ছেলে কোথায় গিয়েছে, আর যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে চুপ করে থাক নাহলে পুরো কেস খাবি বললাম, লাইফ একদম শেষ হয়ে যাবে। যা বলছি শোন ভালো মতো, পুলিশ যদি এসে তোকে ধরে তাহলে তুই একদম চুপ করে থাকবি, যদি খুব প্রেশার করে ভয় দেখায়, তাহলে বলবি তুই জানিস না, রাতে তুই আমার সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলিস, তারপর যা দেখার আমি দেখে নিবো। পুলিশদের আমার কাছে পাঠিয়ে দিস।”
তমাল চুপ করে রইল, মিশান পুরো গোলকধাঁধা পাকিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায়।পুরো বাপারটা বুঝার জন্য ঘোরের মাঝে পড়ে গেল।
‘‘অই কি বলেছি ঢুকেছে মাথায়?
তমাল ছিটকে গেল। মিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে অন্যদিকে যেতে লাগল।”
মিশান কোনো পাত্তা না দিয়ে ওর হাতে থাকা ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমুক বসালো।
তীব্র কলম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অফসেট পেপারের উপর কিছু একটা আঁকিঝুঁকি করে সলভ করার চেষ্টা করছে। টেবিলের অপর পাশে রাসেল বসে আছে।
‘‘রাসেল রিপন হায়দার কি ঢাকায় আছে নাকি গেছে?”
‘‘স্যার আপনি তাকে চলে যাওয়ার পর পর ই সে বাস ধরে চলে যায়, যখন তাকে ঢাকায় থাকতে বলেন কল দিয়ে জানতে পারি সে অলরেডি অর্ধেক পথ চলে গিয়েছে।”
‘‘তাকে ইমিডিয়েটলি আমার সাথে দেখা করতে বলো আবার। আজ রাতে তো সম্ভব হবে না। কাল ভোরেই উনার সাথে দেখা টা যেনো হয়।”
‘‘ওকে স্যার আমি জানাচ্ছি এক্ষুণি।”
‘‘হুম।”
রাসেল তীব্রর কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
সিগারেট টানতে টানতে কেসটা সলভ করার চেষ্টা করল। এতো মাথা খাটিয়েও তিনটে মৃত্যুর হিসেব এক করতে পেরেছে সবে মাত্র, আরো যে কত গুলো খুন হয়েছে সেগুলোর হিসেব মিলছে না, এতো গুলো মার্ডার হয়েছে সব কটা ছেলে একটা মেয়েরও মৃত্যুর কোনো খবর এখনো আসে নি। নিজস্ব কোনো শত্রুতা থেকে হচ্ছে এমন নাকি কোনো প্রফেশনাল কিলার, নাকি কোনো সাইকো কিলার!
কার রক্তের তেজস্ক্রিয়তার জন্য মাশুল গুনছে এতো গুলো মানুষ! এরা কি বিনা অপরাধে মরছে, নাকি ভালো মুখোশের আড়ালের রূপটার জন্যই এমন পরিণাম তাদের। এইটুকু তো ভালোমতো শিউর যারা মরেছে তাদের অতীতের ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা কালো মিলিয়েই।
রাতের বেলা মাইকেল জ্যাকসনের মতো নাচার প্রচেষ্টা করতে করতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে মিশান, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ নাম ধরে ডাক দিলো,
‘‘মিশান!”
মিশান পেছনের দিকে ঘুরলো, ঘুরেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ি করে মামা যাচ্ছিল, মিশানকে এভাবে রাস্তায় দেখে গাড়ি থামিয়ে ওকে ডাকলো।
‘‘মামাহ! আসসালামু আলাইকুম।”
‘‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, এভাবে হাঁটছো কেনো তুমি?”
‘‘না মামা মানে একটু প্যারড করার চেষ্টা করছিলাম, সেই যে আর্মিতে থাকা কালিন রোজ করতাম, তাই আজকে একটু করতে মন চাইল আরকি।”
‘‘গাড়িতে উঠো আসো।”
‘‘মামা এসেই তো গেছি প্রায়, এইটুকুর জন্য কি গাড়িতে উঠবো, আপনি যান আমি আসছি।”
‘‘তুমি এতো রাতে কোথা থেকে ফিরছো?”
‘‘অই তো মামাহ এদিক থেকেই ফিরছিলাম, দ্বীপের ওখানে গিয়েছিলাম, বাড়িতে বোরিং লাগছিলো, তাপসিনের প্রাইভেট চলছিলো, ওতো ব্যস্ত তাই আর কি।”
‘‘তাই বলে এভাবে হেঁটে? বাড়ির গাড়ি নিলে কি হতো?”
‘‘সমস্যা নেই মামা, হাঁটলে শরীর টা ভালো লাগে।”
‘‘ঠিক আছে বাড়ি আসো কথা হবে রাস্তায় কোথাও দাঁড়িয়ে পড়ো না।”
‘‘ঠিক আছে মামা!”
মামা চলে যেতেই মিশান লম্বা শ্বাস নিল। কতগুলো মিথ্যে কথা বলতে হলো একসাথে।
দুটো বছর ধরে পদে পদে মামার সাথে মিথ্যে বলতে বলতে মিশান এখন মিথ্যে বলার উপর ডক্টরেট করে ফেলেছে।
বাড়িতে ঢুকার জন্য পা ফেলবে পেছন থেকে দ্বীপ বাইক নিয়ে বাড়ির সামনে হাজির।মিশান দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাইক থেকে নামতে নামতে মিশানকে বলল,
‘‘কোথাও যাবি নাকি ফিরলি?”
‘‘তোর অফিসে গিয়েছিলাম।”
‘‘ওহ, চল ঘুরে আসি লং ড্রাইভে?”
‘‘নাহ মামার সামনে পড়েছিলাম একটু আগে, রাস্তায় কোথাও না দাঁড়িয়ে বাড়িতে ঢুকতে বলেছে, সেখানে এভাবে গেটের সামনে থেকে হাওয়া হলে আবার একশো একটা কৈফিয়ত দিতে হবে।”
‘‘ঠিক আছে ভেতরে চল তাহলে।”
মামা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরেই আছে, ভাগ্যিস ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো না। না হলে ডাক দিয়ে পাশে বসিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতো। মিশান আর দ্বীপ তাপসিন তিনজনের রুমই পাশাপাশি, দ্বীপ তাপসিন আগে একরুমেই থাকতো, দ্বীপ জব শুরু করার পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে, কারণ তাপসিন রাত জেগে লাইট জ্বালিয়ে পড়ে, আর দ্বীপ অফিস থেকে টায়ার্ড হয়ে ফিরে ঘুমাতে যায় লাইট অন থাকলে ঘুম হয় না।
তাপসিন আর দ্বীপের রুমের মাঝখানে মিশানের রুম।
মিশান নিজের ঘরে না গিয়ে তাপসিনের ঘরে এন্ট্রি নেয়। সারাদিনে আজকে তাপসিনকে ডিস্টার্ব করা হয় নি।
‘‘কিরে পড়ছিস?”
হঠাৎ করে পেছন থেকে মিশানের কন্ঠ শোনে ছিটকে যায় তাপসিন।
‘‘হুম আপি।”
‘‘তোর চেহারা কেমন চোরের মতো হচ্ছে দিন দিন, ব্যাপার কি?”
‘‘কি বলছো আপি, চোরের মতো লাগবে কেনো!”
‘‘কি সাবজেক্ট পড়ছিস?”
‘‘ম্যা ম্যাথ।”
‘‘ম্যাথ নিয়ে বসলে, তোর খাতা কই? শুধু বই নিয়ে বসে আছিস কেনো? দেখি কোন অধ্যায় পড়ছিস।”
কথাটা বলতে বলতে মিশান তাপসিনের সামনে থেকে বই তুলে নিতে লাগলো, বই টা খোলার আগেই তাপসিন বই ধরে বলে।
‘‘আপিই বই হাতে নেয়ার কি হলো, টেবিলে রেখেই দেখো না।আমি তো সুত্র মুখস্ত করছিলাম।”
মিশান সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠস্বরে বলল,
‘‘বইটা ছাড় তাপসিন।”
তাপসিন বই ছেড়ে দিলো। মিশান বই হাতে নিয়ে কয়েক পাতা উল্টাতেই দেখতে পেলো একটা সিগারেট লুকিয়ে রেখেছে বইয়ের ভেতর। চোখ গরম করে তাপসিনের দিকে তাকিয়ে দেখে তাপসিন ভয়ে মুখ শুকনো করে আছে।
‘‘ স স সরি আপি! আর হবে না।”
কোনো উত্তর না দিয়ে সিগারেট সেই একই জায়গায় রেখে বইটা বন্ধ করে ওর হাতে দিলো। তাপসিন মিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, মিশান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলো, তাপসিন ভয়ে শেষ, কথাটা দ্বীপকে বলে না দেয় আবার।
মিশান পিছু ঘুরে বলল,
‘‘ড্রয়িংরুমে মামা বসে আছে, এটা এখন ধরাস না, বাইরে স্মেইল চলে যাবে।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল, তাপসিন হাঁপ ছেড়ে নিশ্বাস নিল। ভেবেছিলো মিশান আগের মতো ব্ল্যাক মেইল করবে।
তাপসিন আগে অন্য রকম ছিলো,একটু কিছু হলেই বাবা মাকে বলে দিতো। দ্বীপ মিশান কোনো ভুল করলে বাবাকে বলে দিতো। ওর জন্য প্রচুর বকা খেতে হয়েছে।
ছোটো বেলা থেকেই তাপসিন অমনটা ছিল। সব সময় বাবা মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো সারাক্ষণ বই খাতাতে মুখ ডুবিয়ে রাখা, একটু কিছু হলেই বাবা মায়ের কাছে ছুটে যাওয়া। সর্বদা মিশান দ্বীপের বিরোধিতা করা এগুলোই ছিলো ওর ধর্ম।
ওর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে মাঝে মাঝে দ্বীপ মিশান কৌশলে মারতো ওকে।
ওকে লাইনে আনার জন্য দ্বীপ মিশান ওর দুর্বলতা খুঁজে যেটা দিয়ে ওকে কাবু করে রাখবে।
একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে সিগারেট খাচ্ছিলো সেটা ভিডিও করে অনবরত তাপসিনকে ব্লাক মেইল করে, এরপর ধরা খায় গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে গিয়ে। মাঝে মাঝে পড়া ফাঁকি দিয়েও ধরা খায়। একে একে ওর নানান রকম দুর্বলতা প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে ওকে ব্লাক মেইলের উপর রেখে আস্তে আস্তে নিজেদের সঙ্গে আনে।
রাত দুইটা বাজে,
রিপন হায়দার বাস গাড়িতে ঢাকার দিকে আসছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিনের মতো আজও একই রকম ঘটনা ঘটছে। একই জায়গা থেকে যাত্রীদের নেমে যাওয়া গাড়ি ফাঁকা হয়ে যাওয়া,সব মিলে যাচ্ছে।
সেদিনের মতোও আজ গাড়িতে ঘুমাচ্ছে রিপন হায়দার, ঘুম ভাঙতেই সেই নীল চোখ বিশিষ্ট মানব। রিপন হায়দার আজ আর ভয়ে কাবু হয়ে রইল না, উঠে দাঁড়িয়ে সোজা ড্রাইভারের কাছে গিয়ে গাড়ি থামাতে বলে, গাড়ি থামাতেই সে গাড়ি থেকে নেমে যায়, যেটা রিপন হায়দারের চরম ভুল কাজ হয়।
গাড়ি থেকে নামতেই গাড়ি চলে যায়, জায়গা একদম ফাঁকা ।
হাই ওয়ে দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দু একটা উত্তর বঙ্গের গাড়ি যাচ্ছে, এসব গাড়ির সামনে দাঁড়ালেও থামবে না উল্টো পিষে রেখে যাবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ অপেক্ষা করলো কিন্তু লাভ হলো না কোনো।
মোবাইল বের করে কাউকে কল করতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে মাথার মধ্যে কেউ আঘাত করল, হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে গেল, রিপন হায়দার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মাথা উঠিয়ে দেখতে পেল এটাই সেই মানুষ টা যে বাসে ছিল, তবে এই মূহুর্তে অই নীল চোখ জোড়া দেখা যাচ্ছে না, চোখে সানগ্লাস পড়া।
ভয়ার্তস্বরে রিপন হায়দার বলে উঠল,
‘‘কে কেহ তুমি?”
মানুষটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে আরেকটা আঘাত রিপন হায়দারকে করতে যাবে এর আগেই, চারপাশ থেকে অনেক গুলো লাল রঙের টার্গেট লাইট মানুষটাকে ফোকাস করল।
বুঝতে পারল চারদিকে পুলিশের লোক ঘেরাও করে নিয়েছে। এমন একটা অবস্থা যে এখান থেকে পালানোটাও সম্ভব না।
হাত থেকে লাঠি টা ফেলে দিয়ে হাত উঁচু করে সারেন্ডার করল।
একগুচ্ছ কালো কালো ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে তীব্র নির্ভীক গতীতে মানুষটার কাছে এসে দাঁড়াল,
‘‘কারো দাদা কোনো এক কালে একটা প্রবাদ বানিয়ে রেখে গিয়েছিল, যখন দেখবে দাবার গুটি এগুচ্ছে না বুঝে নিও তুমি বিনাশের পদতলে, যখন দেখবে সৈন্য সব বিলিন হয়ে যাচ্ছে বুঝে নিও ‘ইউর টাইম ইজ আপ!’
অনেক গুলো মাস ধরে মানুষের অপেক্ষার অবসান ঘটলো, কে এই মুখোশের আড়ালে? আমি তো বস্ আগে থেকেই জানতাম শুধু প্রমাণ খুঁজছিলাম, আর আজ হাতে নাতে প্রমাণ এসে হাজির!”

কানের কাছে গিয়ে দাঁত চেপে বলল,
‘‘বলেছিলাম না? যেদিন ছাই দিয়ে ধরবো, সেদিন ই বুঝবি তীব্র ঠিক কতোটা তীব্রতর হতে পারে।”

(চলবে)