তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১৩

0
19

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১৩
লেখিকা- রিয়া খান

গান পয়েন্টে থেকে রিফাত প্রচুর পরিমাণে ভয় পেয়ে যায়, তীব্র বাঁকা হাসি দিয়ে গান সরিয়ে নেয়।
‘‘কিছু কিছু জায়গায় আমি মানুষকে সুযোগ দেই, তোমাকেও দিচ্ছি।
দুটো অপশন দিচ্ছি তোমাকে,
১.তোমার কুকর্মের কথা সবার সামনে স্বীকার করবে। এতে কি হবে জানো, তোমার মৃত্যুর ডেট টা একটু পেছাবে, আর তোমার পরিবার তোমার জন্য লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে, লোকের কাছে কথা শুনতে হবে। তোমার পেনশনের টাকা, মাসিক রেশন এগুলো অফ হয়ে যাবে, যার ফলে তোমার পরিবারের না খেয়ে রাস্তায় নামতে হবে।
২.এক্ষুণি তুমি আমার সামনে সুইসাইড করবে, এতে কি হবে জানো? তোমার কুকর্ম গুলোও তোমার সাথে আত্মহত্যা করবে, তোমার কবরের মাটিতে দেহের সাথে গোপনীয়তাও চাপা পড়বে। তোমার পরিবারের মানসম্মানও নষ্ট হবে না। পেনশনের টাকা, রেশন এগুলোও বন্ধ হবে না।’’
রিফাত সোজা তীব্রর পায়ে ধরল, কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘‘স্যার সরি স্যার আমায় ক্ষমা করে দিন আমি সব খুলে বলব আপনাকে, যা যা জানি সব বলব আপনাকে। প্লিজ স্যার ক্ষমা করে দিন একটা সুযোগ দিন, আমি শুধরে যাবো স্যার।’’
‘‘আমাকে মারার জন্য কত টাকা পেয়েছো?’’
‘‘দশ লাখ এডভান্স দিয়েছে স্যার। কাজ শেষ হলে আরো দেবে বলেছিল।’’
‘‘ওরি বাবা, তুমি তো ভাই আমার থেকেও বড়লোক হয়ে গেছো।’’
‘‘আমার যে সিক্রেট ডকুমেন্টগুলো সেগুলো পাচার করে কত পেয়েছিলে?’’
‘‘৬লাখ।’’
‘‘কিন্তু রিফাত আমি যদি তোমায় ছেড়ে দেই তাহলে ওরা তো তোমাকে ছাড়বে না, তুমি তো বিশ্বাসের যোগ্যতায় রাখো না।
কি করি বলো তো তোমায় নিয়ে?
ঠিক এই কারণেই আমি দুদিন পর পর বডিগার্ড চেঞ্জ করি যেনো কারো মরতে না হয় আমার হাতে।
শুধু তুমিই এতোদিন ধরে লাস্টিং করেছিলে। একেই বলে ভাগ্য, জানো তো?’’
রিফাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে তীব্র কোমরে হাতের কব্জি গেড়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ভাষণ দিচ্ছে, এই সুযোগে রিফাত ভেতর থেকে পিস্তল বের করে উঠে দাঁড়িয়ে তীব্রর দিকে গান পয়েন্ট করে।
এই দৃশ্য দেখে তীব্র রাগান্বিত বা আতংকিত কোনো রিয়্যাকশন না দিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।
‘‘বিনাশ কালে বিপরীত বুদ্ধি!’’
রিফাত একটু বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল, হাত কাঁপছে, তীব্রর চোখের দিকে তাকাতেই ভয় হচ্ছে। কারণ তীব্রকে বদ করা এতো সহজ না। তীব্রর এরকম হাসির যথেষ্ট কারণ আছে হয়তো।
তীব্র রহস্যময় ভাবে রিফাতের নাম উচ্চারণ করে বলল,
‘‘রিফাত! আমি চাইলে তোমাকে ব্যবহার করে সব আপডেট নিতে পারবো এই ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু আমি তা করবো না। কারণ পরিক্ষায় নকল করা আর দেখাদেখি করে লিখা আমার কাছে দুটোই সমান সমান। অন্যের বুদ্ধিতে আমি তীব্র চলি না। আমার এই মাথাটা যতোদিন আছে ততোদিন ইনশাআল্লাহ কারো বুদ্ধি পরামর্শ দিক নির্দেশ লাগবে না, যা করছি আর যা করবো সবটা নিজের চেষ্টাই নিজের বুদ্ধিতে। তাই তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই ।
এখন মেইন পয়েন্টে আসি, তুমি এক কাজ করো তোমার বাড়িতে একটা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো তো তোমার ছেলে কোথায়? বাড়িতে কল দিলে ওরা বলবে ছেলে কোচিংয়ে আছে।
রাত আট তাই মেবি কোচিং শেষ তোমার ছেলের, কিন্তু কোচিংয়ে কল দিয়ে হয়তো অন্য কোনো নিউজ শুনতে হবে।’’
‘‘মানেহ! আমার ছেলের কোনো ক্ষতি করবেন না জানে মেরে ফেলবো।’’
‘‘আমি কি একটাবারও বলেছি ওর ক্ষতি করবো? আমিতো জাস্ট বলতে চেয়েছিলাম তোমার ছেলের জীবন তোমার এই পিস্তলের মধ্যে আটকে আছে। তুমিও বুলেট বের করে দিবে, তোমার ছেলের প্রাণও বেরিয়ে যাবে।’’
এটা শুনে রিফাতের হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল।
তীব্র কিটকিটে হাসি দিয়ে বলল,
‘‘গ্র‍্যাভেটি ডাজন্ট ওয়ার্ক আনটিল ইউ লুক ডাওন। প্রবাদ টা শুনেছো কখনো?’’
তীব্র কিটকিটে হাসি হেসেই যাচ্ছে।
‘‘স্যার প্লিজ স্যার সরি স্যার। ক্ষমা করুন, আপনার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি স্যার।’’
তীব্র নীরবে মাথা নাড়িয়ে হাসতে হাসতে ছাদের রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকায়।
বাইশ তলার উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরিয়ে উঠে, শহরের বিশাল অংশ দেখা যাচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে।
‘‘ব্যাপার টা একটু সহজ করে দিচ্ছি, তোমাকে এতো কষ্ট দিয়ে মারবো না, খামোখা হাত নোংরা করার মানেই হয় না। তুমি বরং এই রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে লাফ দাও, ভাগ্য ভালো থাকলে হাত পা ভাঙলেও বেঁচে থাকার চান্স আছে।
যদিও এখানে বেঁচে থাকার চান্স ০.০০০০০০০০০১%।’’
রিফাত অসহায়ের মতো তাকিয়ে বলল,
‘‘স্যার ক্ষমা করুন প্লিজ! দোহায় লাগে আপনার।’’
‘‘তোমার বউ আজকে বাসন্তী কালার থ্রী-পিচ পড়েছে তাই না?’’
রিফাত থমকে গেল।
‘‘ডোন্ট ওরি, শপিং করছে এই টাওয়ারের সেকেন্ড ফ্লোরে।’’
রিফাত নিরব হয়ে আছে,
‘‘আমার হাতে সময় নেই, যা করার তাড়াতাড়ি করো।’’
রিফাত কাঁদতে কাঁদতে রেলিংয়ের উপর উঠে দাঁড়াল, চোখ বন্ধ করে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেল, তীব্র সাইকোর মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো রিফাতের পড়ে যাওয়া। এরপর রিল্যাক্সে সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।
দ্বীপ অফিস শেষে বাড়ি না গিয়ে মিশানকে দেখতে যায়।
মিশান বারান্দায় ফ্লোরে বসে মদের বোতল থেকে মদ ঢেলে ঢেলে খাচ্ছে। দ্বীপ মিশানের পাশে এসে বসল,
‘‘এতো আগেই ভোজন শুরু করে দিয়েছিস?’’
‘‘হুম, খিদে পেয়েছিল অনেক।’’
‘‘খিদে পেয়েছে তার জন্য বাসায় অনেক শুকনো খাবার আছে। আর একটু অপেক্ষা করলেই হতো, আমি খাবার এনেছি। যা খাবার খেয়ে নে।’’
‘‘কি এনেছিস?’’
‘‘তন্দুর রুটি, কালা ভুনা, বুটের ডাল।’’
‘‘খাবার ভালো, কিন্তু এখন খাওয়ার মুড নেই।’’
‘‘মিশান এভাবে কেনো শেষ করছিস নিজেকে?’’
‘‘আজ দেরি করে এসেছিস, আর বাড়ি ফিরবি কখন?’’
‘‘বাড়ি যাবো না আজ। এখানেই থাকবো।’’
‘‘কি হয়েছে?’’
দ্বীপ সিগারেট ধরাতে ধরাতে উত্তর দিলো,
‘‘কিছু নাহ।’’
‘‘তুই বলবি আর আমি বিশ্বাস করবো?মিমি কিন্তু আমায় বলেছে সকালে নাকি তুই না খেয়ে বেরিয়েছিস। মিমি তোকে কল করছে তুই রিসিভ করছিস না।’’
দ্বীপ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘‘আর কি বলেছে?’’
মিশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো,
‘‘অইতো, ছেলের বয়স বাড়লে বাবা মায়েদের যে চিন্তা আকাঙ্ক্ষা থাকে সেটাও বলল। তোকে বুঝাতে বলল।’’
‘‘এখন তুই কি বলতে চাচ্ছিস?’’
মিশান ছলছল চোখে মাথা নিচু করে মলিন হেসে বলল,
‘‘দেখ দ্বীপ মামা মিমি তোর জন্য যে ডিসিশন নেবে সেটাই তোর জন্য সঠিক। সো তাদের কথা শোন। তাদের পছন্দে বিয়েটা করে নে। দ্বীপ তুই ভেবে দেখ তুই যার কথা ভেবে নিজের সময় পার করছিস, সে কেবলই তোর অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। মেনে নে এটা নিশান আর ফিরবে না। ও মরে গেছে।
ওর কোনো অস্তিত্বই নেই।’’
‘‘হুমহ! তুই বলছিস এই কথা? তুই মেনে নিতে পেরেছিস মিশান?
মদ খাচ্ছিস কেনো? তুই কি এরকম ছিলি মিশান? কষ্ট চাপা দিয়ে রাখতে পারিস না কেনো? সব ভুলে থাকার জন্য কেনো তুই এলকোহল নিয়ে পড়ে থাকিস?’’
‘‘দ্বীপ তুই আর আমি ভীন্ন কথা। আমার কথা বাদ দে। আমি ছোটো বেলা থেকেই অ্যাবনরমাল। বাবা মা নেই, একটা মাত্র বোন ছিল, জীবনে সুখের একটা বিন্দু ছিল, আমার ভাগ্য খারাপ তাই হারিয়ে গেছি। তুই আমি এক না রে দ্বীপ।’’
‘‘নিশান আমার বিয়ে করা বউ। আমার প্রথম ভালোবাসা ও। আর তুই বলছিস ওকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে ভালোবাসতে? মিশান তুই অন্তত আমার অবস্থাটা বুঝবি। এমন নির্বোধের মতো কথা বলিস না।’’
‘‘নিশান বেঁচে থাকলে কখনোই আমি তোকে অন্য কার হতে দিতাম না। আর বিয়ের কথা বলছিস?
সেটা কেবল তুই আর আমি জানি আর কেউ জানে না, এই বিয়ের ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ। নতুন করে জীবন সাজা দ্বীপ।’’
মিশানের সাথে কথায় মিলছেনা বলে দ্বীপ চোখের পানি মুছতে মুছতে অন্য রুমে চলে গেল।
মিশান ওর নিজের মতো আবার ড্রিঙ্ক করায় মন দিলো।
এমনিতেই নিশানকে ভুলতে পারছে না, তারওপর দ্বীপ আরো অতীত মনে করিয়ে দিলো।
নিচে এতো এতো গাড়ি রিফাতের ডেড বডির চারপাশ ঘেরাও করেছে।
কোলাহলময় চারপাশ, পুলিশ এসেছে অনেক গুলো।
পাশেই তীব্র পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মৃত লাশটা দেখছে, এর মধ্যে সাংবাদিক এসে হাজির, জানাজানিও হয়ে গেল রিফাত তীব্রর বডি গার্ড ছিল।
একজন সাংবাদিক তীব্রর সামনে স্পিকার ধরে প্রশ্ন করলো,
‘‘স্যার আপনার কি মনে হয় এটা আত্মহত্যা নাকি হত্যা?’’
‘‘আই থিংক এটা আত্মহত্যাই হবে, কয আমি বেশ কিছুদিন ধরে ওকে খুব ডিপ্রেসড দেখছিলাম। সব কিছুতে আনমনা, ওর মনটা কোথাও একটা হারিয়ে থাকতো।
আজকে আমি এখানে শপিংয়ে এসেছিলাম। হঠাৎ রিফাত বলল, স্যার আমি একটু আসছি। তারপর কি হয়েছে সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।
একদল লোক নাকি বেশ উপর থেকে পড়তে দেখেছে। তবুও দেখা যাক ময়না তদন্তে কি রিপোর্ট আসে, মার্ডার নাকি সুইসাইড সেটা বুঝাই যাবে তখন।’’
গুছিয়ে গুছিয়ে উত্তর দিয়ে সাংবাদিক থামিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লাশটা উঠিয়ে নেয়া হলো।
তীব্র ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল।
রিফাতকে কাবু করতে তীব্র ওকে যেসব কথা বলছিল
ওর ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সেগুলো কেবলই রিফাতকে বিব্রত করার জন্য বলেছিল।
রিফাত মনে করেছিলো তীব্র ওর বউ আর ছেলেকে কিডন্যাপ করেছে, কিন্তু তীব্র এগুলো আন্দাজিই ঢিল ছুড়েছিলো ।
রিফাতকে লাইনে আনার জন্য।
বোকা রিফাত তীব্রর কথা বিশ্বাস করে গিলে নেয়।
সকাল বেলা তীব্র অফিস যাচ্ছিল হঠাৎ দেখে রাস্তায় দীপ্তি দাঁড়িয়ে আছে।
ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে, গ্লাস সরিয়ে মাথা বের করে দীপ্তিকে ডাক দিলো।
‘‘দীপ্তি।’’
দীপ্তি তীব্রর দিকে তাকালো,
‘‘এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’’
‘‘আমার গাড়ি টায় সমস্যা হয়েছে, ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করাতে নিয়ে গেছে।’’
‘‘গাড়িতে উঠো লিফট দেই।’’
‘‘না সমস্যা নেই তুমি যাও।’’
‘‘আরে আসো, তোমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।’’
দীপ্তি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ওর ক্লাসের টাইম হয়ে এসেছে প্রায়, বাধ্য হয়ে তীব্রর গাড়িতে উঠতে হলো।
তীব্রর পাশের সীটে গুঁটিশুঁটি মেরে বসলো।
‘‘হলিক্রসের ব্যাপার টা বুঝলাম না, স্টুডেন্টের সাথেও টিচার ম্যাডামদেরও বিধবা বানিয়ে রেখেছে কেনো?’’
‘‘কেনো দেখতে খারাপ লাগছে কি?’’
‘‘না তা না, তোমাকে দেখতে ভালোই লাগছে। তুমি তো সুন্দর সাদাতে বেশ মানায়।’’
কথাটা শুনে দীপ্তি লজ্জা পেয়ে গেল, তীব্র আড়চোখে খেয়াল করল ড্রাইভার মিটমিট করে হাসছে।
তীব্র আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল, দীপ্তিও চুপ করে বসে আছে, অনেক লজ্জা লাগছে এভাবে তীব্রর পাশে বসে থাকতে। অথচ একটা সময় তীব্রর সাথে কত দুষ্টুমি করতো, তীব্র হাজার রাগ করলেও দীপ্তি কখনো রাগ করতো না।
দীপ্তির সাথে পরিচয় হয় ওদের বাবার সুত্রেই। দ্বীপ্তি ছিলো ময়মনসিংহ ক্যাডেটের স্টুডেন্ট, আর তীব্র মির্জাপুর ক্যাডেট। তীব্র ওর থেকে সিনিয়র হলেও
ছোটো বেলা থেকে দীপ্তি ওর বড় ভাইয়ের দেখাদেখি তীব্রকে নাম ধরে ডাকে।
ছুটিতে এসে প্রতিবার তীব্রর সাথে দেখা করতে চলে আসতো, যেহেতু ওরা একই কোয়াটারে থাকতো, না চাইতেও দেখা হয়ে যেতো দুজনের।
সময়ের সাথে সম্পর্কের অনুভূতি গুলোও
বদলে আসে, তীব্র বুঝতো দীপ্তি ওকে পছন্দ করে কিন্তু পাত্তা দিতো না, হয়তো নিজেও পছন্দ করতো সে সময়। কিন্তু দুবছর ধরে তীব্র দীপ্তির সামনে একবারও আসে নি, একটা খোঁজও নেয় নি, তার যথেষ্ট কারণও আছে। দীপ্তি ঠিকি তীব্রর মায়ের থেকে খোঁজ নেয় ওর।
চুপচাপ নিরবতার মাঝেই হলিক্রসের সামনে এসে গেল, দীপ্তি গাড়ি থেকে নামার আগে বলল,
‘‘থ্যাংকস।’’
‘‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’’
‘‘আসি তাহলে, দেখা হবে আবার।’’
‘‘অবশ্যই।’’
গাড়ি থেকে নামতে যাবে তখন ঘাড় ঘুরিয়ে তীব্রকে ডাকল,
‘‘তীব্র।’’
‘‘বলো।’’
‘‘যদি কিছু মনে না করো, আজ সন্ধ্যায় তোমার টাইম হবে? এক কাপ কফির জন্য?’’
‘‘দীপ্তি প্লিজ কিছু মনে করো না, আমি একটুপর চট্টগ্রাম রওনা হবো, তবে আমি কথা দিচ্ছি ফিরে এসে অবশ্যই হবে।’’
‘‘ইটস ওকে নো প্রবলেম।’’
‘‘তুমি তো এখন আমাদের বাড়িতেও আসো না। মা তোমার কথা খুব বলে, সময় করে একদিন বাড়িতে আসো।’’
‘‘যাবো অবশ্যই, আসলে সময় হয় না। তোমাদের বাড়িতে গেলে আমার সময় করেই যেতে হবে, কারণ আংকেল আন্টির সাথে আমার আড্ডা প্রচুর জমে উঠে।’’
‘‘ঠিক আছে আসো তাহলে এখন।’’
দীপ্তি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘‘আল্লাহ হাফেজ।’’
‘‘আল্লাহ হাফেজ।’’
দীপ্তি চলে যাওয়ার পর ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো, তীব্র ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
‘‘যা ভেবে হাসছো সেরকম কিছু না। তুমি গ্যাঞ্জাম পাকাবা মিঞাঁ।’’
‘‘স্যার আমি কি করলাম আবার?’’
‘‘চামচামি বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যাও।’’
‘‘স্যার আপনি শুধু ভুল বুঝেন আমাকে, আমি কি দিপ্তী ম্যাডামকে নিয়ে কিছু বলেছি?’’
‘‘কিছু না বললেও তোমার রিয়্যাকশন দেখে সব বুঝা যায়।’’
‘‘কিছু বলার রইল না স্যার।’’
‘‘হুমমম। অবশ্য দিপ্তী মেয়েটা ভালোই, মা খুব পছন্দ করে ওকে চান্স একটা নেয়াই যায়।’’
‘‘আমিও সেটাই ভাবছি স্যার। এমনিতেও আপনি চার পাঁচটা বউ ডিজার্ব করেন।’’
‘‘একটাই মানুষ নিতে পারে না চার পাঁচটা!’’
‘‘সেটা যে নিতে পারে না তার অক্ষমতা। কিন্তু আপনার জন্য জায়েজ স্যার।’’
‘‘থুহ! রাখো তোমার বকবকানি। তুমি আমার পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছো, হতে পারে তোমার ফোনে রেকর্ডার অন, ভালো হয়ে যাও। গাড়ির স্পীড বাড়াও একটা জায়গায় যেতে হবে তো।’’
‘‘স্যার চট্টগ্রামের রাস্তা তো বিশাল এতোক্ষণ ভরে যাবো কি করে? তার উপর ওদিকে পাহাড়ি রাস্তায় কিভাবে ড্রাইভ করবো।’’
‘‘তুমি এখন অফিস যাও পরের টা পরে দেখব।’’
‘‘ঠিক আছে স্যার।’’
‘‘বাই দি ওয়ে আমি তোমাকে সাথে নিচ্ছিনা, একাই যাবো।’’
‘‘কিন্তু কেনো স্যার?’’
‘‘সেটা না জানলেও হবে, তুমি ধরে নাও যতোদিন আমি চট্টগ্রাম থাকবো ততোদিন তোমার ছুটি। আমি যাবোই ছদ্মবেশে, সাথে কাউকে নেয়া যাবে না।
আমি একা গেলে যদি বিপদে পড়ি তাহলে নিজেকে সেইফ করতে পারবো, তোমাকে নিয়ে বিপদ বাড়াতে চাই না। তুমি যা নব ঢোকসা, ভুঁড়ি নিয়ে দৌড়াতেও পারবে না।’’
‘‘স্যার সারাপথ আপনি আমাকে অপমান করে কথা বলেন, সেই জন্য আপনার কপাল জুড়ে আসে না।’’
‘‘তুমি যে প্রতি সেকেন্ডে আমাকে অভিশাপ দাও আর আমার বিরুদ্ধে চামচামি করো সেই জন্য জুড়ে আসে না।’’
‘‘হি হি হি।’’
‘‘তোমার হাসিটা খুবই বিকট। আমার সামনে এভাবে হাসতে বারণ করেছি কতবার?’’
‘‘সরি স্যার। মাথা ঠান্ডা করুন, এতো রাগ ভালো না, আপনার হার্টে প্রবলেম আছে ভুলে যাবেন না।’’
‘‘ওহো ভালোকথা মনে করেছো ওষুধ খাওয়া হয় নি সকালে।’’
‘‘ওষুধ দেবো বের করে?’’
‘‘অফিস গিয়ে খাবো।’’
আব্দুর রহমান তাড়াতাড়ি গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে গেল।
অফিসে গিয়ে কিছু কাজ সেড়ে সিনিয়রদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে , বেরিয়ে পড়ল বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে।
রাত প্রায় দশটার দিকে,
তীব্র বন জংগলের ভেতর একা একা বিচরণ করছিল। পাহাড়ি রাস্তা উঁচু নিচু খাদ তার ওপর অঢেল গাছপালা ও তার লতাপাতায় ছেয়ে আছে চারপাশ। পাহাড়ি এলাকা বলে হয়তো একটু আঁধারেই চারপাশ অন্ধকার ছেয়ে নেয়।
না আছে ল্যাম্পপোস্ট না আছে আকাশে চাঁদের আলো। ভরা অমাবস্যাতিথি!
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই তীব্র চলন থামিয়ে দিলো, কি মনে করে যেনো সামনে এগুচ্ছে না।
নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল, অত:পর চোখ কুঁচকে নিখুঁত ভাবে সামনের দিকে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করলো, মিনিট দুয়েক পর লম্বা কদম ফেলে কিছু একটা কিছু ডিঙিয়ে গেলো। বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
‘‘মিশান খান! বরাবরের মতোই আইডিয়া ফ্লপ!’’
কোথায় তুমি, বেরিয়ে আসো,একটু মুখ দর্শন দাও।
আশে পাশে থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। তীব্র উল্টো ঘুরে চলে যেতে শুরু করলো, এমন সময় কেউ এসে এট্যাক করার আগেই তীব্র তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে।
ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে আন্দাজ ঠিক, এটা মিশান ই।
তীব্র সিগারেটের ধোঁয়া সবটকু মিশানের উপর ছাড়লো।
‘‘এসব ফ্লপ প্ল্যান কেনো করো? আজ অব্ধি কতবার চেষ্টা করেছো আমাকে মারার জন্য বলতো? ক্লান্ত লাগে না? এতো মনোবল কোথা থেকে আসে?’’
‘‘জাহান্নাম থেকে, আপনি জেনে কি করবেন?’’
‘‘ওকে চালিয়ে যাও তোমার প্রচেষ্টা, আই উইশ একদিন সফল হবে। এখন ব্যর্থ চেষ্টা আর চালিও না। কিছুদিন রেস্ট নাও।’’
‘‘রেস্ট আমি সেদিনই নেবো যেদিন পৃথিবীতে আপনার অস্তিত্ব মাটিতে মিশে যাবে।’’
‘‘ইশসস! তোমার এই ইচ্ছাটা না কোনোদিন পুরণ হবে না। কারণ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আর যাই হোক তোমার আগে আমি মরবো না।’’
মিশান ডেভিল স্মাইল দিয়ে হাত থেকে ছুরি ঢিল মেরে ফেলে দিয়ে বলল,
‘‘স্যার! সেটাতো সময় এলেই বুঝা যাবে।’’
‘‘বার বার তুমি হেরে যাও আমার কাছে, তোমার জায়গায় আমি থাকলে লজ্জায় মরে যেতাম। বিশাল লজ্জার ব্যাপার!’’
‘‘অই যে স্যার কথায় আছে না প্রচেষ্টার মৃত্যু নেই, তেমন প্রচেষ্টায় লজ্জাও নেই। মরতে তো আপনাকে হবেই, তাও আমার হাতেই।’’
তীব্র পাত্তা না দিয়ে উল্টো ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না, আমার সাথে আসো রাত হয়েছে অনেক।
‘‘স্যার লাগবে না, আমি এখানেই রাত কাটাতে পারবো।’’
তীব্র চলন থামিয়ে বলল,
‘‘এটা ঢাকা শহর না, চট্টগ্রামের বিশাল একটা পাহাড়, এখানে মানুষ ছাড়াও অনেক কিছু থাকে। মানুষ দেখে তো ভয় পাও না অন্ততপক্ষে জন্তু জানুয়ার দেখে ভয় করো। ওরা তোমার থেকেও হিংস্র।’’
জন্তু জানুয়ারের নাম শুনে ভেতরে ভয় জমাট করলো, মিশান সামান্য কুকুর দেখেই যে লেভেলের ভয় পায়, মাঝে মাঝে কুকুরের দৌড়ানি খেয়ে যা অবস্থা হয়, তার উপর পাহাড়ি এলাকায় কুকুরের থেকে শেয়াল থাকে বেশি যেগুলো দেখে মিশান আরো ভয় পায়। সেনাবাহিনীতে থাকতে এরকম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে বহুবার।
অতীত মনে করে তীব্রর প্রতি রাগ ভুলে ধীর পায়ে ওর পিছু পিছু ফলো করল।
বনের ভিতর একটা ফরেস্ট অফিস ছিল যার একটা গেস্ট হাউজও আছে সেখানেই মূলত তীব্রর রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু এই গেস্ট হাউজে একটাই বেড রুম।যেহেতু তীব্র মিশানকে নিয়ে এসেছে, ওকে নিয়েই থাকতে হবে।
‘‘মিশান’’
‘‘শুনছি।’’
‘‘আজকে আমার সাথে এক ঘরে তোমার রাত কাটাতে হবে।’’
‘‘অসম্ভব।’’
‘‘তাহলে একটা বালিশ দিচ্ছি বাইরেই ঘুমাও, ভয় পেলে ডাক দিও, ঘর থেকে বেরিয়ে তোমাকে কোম্পানি দেবো।’’
‘‘আজব তো! বাইরেই যদি ঘুমাই তাহলে আমাকে এখানে আনলেন কেনো?’’
জংগলের ভেতর ই ঘুমাতাম।
‘‘তো কি করবো? আমার তো এতো দরদ উতলায় নি তোমার জন্য ঘর ছেড়ে নিজে বাইরে ঘুমাবো।’’
মিশান একটু বিব্রতভাবে উত্তর দিলো,
‘‘ঠি ঠিক আছে কিন্তু আপনি আমার সাথে কোনো মিসবিহেভ করবেন না!’’
‘‘দুনিয়াতে তো মেয়ে কম পড়েছে, তোমাকে ঘুরে দেখতে যাবো আমি। বাই দি ওয়ে সানগ্লাস পড়ো, তোমার অই বিড়াল চোখ সুস্থ মানুষ দেখলে ভয় পাবে।’’

মিশান কোনো উত্তর না দিয়ে দাঁত কিড়িমিড়ি করতে করতে সানগ্লাস পড়ে নিলো।
গেস্ট হাউজের ভেতর যেতেই একজন স্টাফ রাতের খাবার দিয়ে গেল।
রুমটা বেশ বড় দুটো রুম এক করলে যতবড় হয় তার থেকেও বড়। ভেতরে ডেকোরেশনটাও বেশ সুন্দর, বড় একটা কাঠের খাট, সুদর্শনীয় কিছু আকর্ষণীয় ফার্নিচার। ইউনিক ডিজাইনের সোফা। রুমের সাথে একটা এটাস্ট বাথরুম।
ভেতরের পরিবেশটা বেশ ভালো লাগলো
তীব্র ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো,
মিশানকে খেতে বললে মিশান খায় না।
খাওয়া শেষ করে তীব্র সুন্দর করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
‘‘খাট টা বড় আছে দু জন দু প্রান্তে ঘুমালে কারো গায়ে কারো স্পর্শ লাগবে না।’’
মিশান হাতে বালিশ তুলে নিতে নিতে বলল,
‘‘বয়েই গেছে আমার, আপনার সাথে বেড শেয়ার করতে। আমি সোফায় ঘুমাবো।’’
‘‘এজ ইউর উইশ।’’
‘‘হুম, আপনাকে দিয়ে কোনো ভরসা নেই।চালাকি সব জায়গায় চললেও আমার সাথে চলবে না।’’
তীব্র টিটকারি হাসি দিয়ে বলল,
‘‘গুড নাইট।’’
মিশান লাইট অফ করে দিয়ে সোফায় বালিশ রেখে নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়ে।
তীব্র শুয়ে শুয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে।
মাঝ রাতে মিশান ঘুমে বিভোর, যে সময়টাতে দুঃস্বপ্নরা ভীড় জমানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। এমন সময় মিশান ওর গালের উপর গরম বাতাস অনুভব করল, চোখ খুলবে খুলবে করে খোলা হচ্ছে না, গরম বাতাসটার বেগ যেনো বেড়েই চলেছে। মিশান সাথে সাথে চোখ খুলে তাকায়, দেখে ওর উপর তীব্র প্রায় ভর করে শুয়ে পড়বে পড়বে এরকম অবস্থা, বড় বড় করে তীব্রর দিকে তাকাতেই তীব্র বলে উঠে,
‘‘Happy oh sorry! Sad First Marriage Anniversary!’’

(চলবে)