তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১৪

0
21

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১৪
লেখিকা- রিয়া খান

মিশান দাঁত কিড়িমিড়ি করতে করতে বলল,
‘‘এনিভার্সারি? তাই না? এনিভার্সারি গিফট দিচ্ছি একটা।’’
চোখ গরম করে তাকিয়ে হাঁটু দিয়ে তীব্রর বুকে বেশ জোরে একটা কিক মারল।
তীব্র মিশানের গলায় টিপ দিয়ে ধরল,
‘‘তোর সাহস কি করে হলো আমাকে লাত্থি মারার?’’
‘‘আপনার সাহস কি করে হয় আমার উপর এভাবে আসার? এসবের মানে কি?’’
তীব্র সোফার একপাশে ভালোমতো বসে বলল,
‘‘মোবাইলে এস প্ল্যানার থেকে হঠাৎ নোটিফিকেশন এলো আজকে আমাদের বিয়ের এক বছর পূরণ হলো, তাই তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো আমি খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে আসিনি।’’
মিশান একটা রাগী নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘‘দেখুন স্যার, এসব ভং আমার সাথে করবেন না। নিজে বিয়ের গোষ্ঠীর ষষ্ঠী পুজো করুন। নেক্সট টাইম যদি এই টপিক উঠেছে না, একদম জানে মেরে দেবো। দুদিন আগে আমাকে মারার জন্য ফাঁদ পেতেছিল, হায়াতটা লিখা ছিল বলে মরে যাই নি।’’
‘‘ওটা না করলে তো তুমি আমি দুজনেই ফেঁসে যেতাম। তোমাকে যে আগে থেকে বলে রাখবো আমি, সেই পরিস্থিতিও নেই। কারণ তুমি তো সাইকো, ভালোভাবে বললে কি বুঝতে? ধরা দিতে?’’
মিশান চোখ বড় বড় করে তীব্রর দিকে তাকিয়েই আছে।
‘‘ওই যে এমনিতেই চোখ বেড়ালের মতো তার ওপর প্যাঁচার মতো বড় বড় করে তাকাচ্ছে। চোখ ছোটো কর!’’ (ধমকের স্বরে)
তীব্রর ধমক খেয়ে মিশান বলে উঠল,
‘‘মেইন ভিলেন টা যে আপনি সেটা মিশান ছাড়া আর কেউ জানে না তাই না?’’
তীব্র শয়তানি হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘‘ইয়েসস!’’
‘‘আপনার কপালে কঠিন মৃত্যু আছে বলে দিলাম। নেক্সট টাইম বাঁচার চান্স নেই।পুরো পরিবার সহ মেরে দেবো।’’
গম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে রাগী রাগী ভাব নিয়ে তীব্র বলল,
‘‘দেখ মিশান, তুই ভালো করেই জানিস আমার একটা থাপ্পড়ের ওজন কত। সো কথা কেয়ারফুললি বল।’’
কথাটা শুনে মিশান অবুঝের মতো তাকিয়ে নিজের গালে হাত দিয়ে বসে রইল।
‘‘সিগারেট আছে তোর কাছে?’’
মিশান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো,
‘‘ধার দে, আমার গুলো শেষ। সকালে শোধ দিয়ে দিচ্ছি।’’
মিশান সিগারেট বের করে দিলো, লাইটার নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো তীব্র।
‘‘কেনো বিয়ে করেছেন আমায়?’’
‘‘এক প্রশ্ন একবার দুইবার ভালো লাগে এর বেশি না।’’
‘‘শুধু নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে নিজের কাজ উশুল করছেন। আর কত মানুষ মারলে আপনি থামবেন? কেনো করাচ্ছেন এগুলো আমায় দিয়ে?
আমার জীবন তো এমনিতেই নষ্ট, তার উপর আমায় দিয়ে এসব করান, এসব বাদ ই দিলাম এগুলো মিশানের অভ্যস্ততায় এসে গেছে। কিন্তু আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেনো?
আমার বেঁচে থাকার সমস্ত শক্তি বিনাশ করতে হলো আপনার? মানলাম আমার দু/একটা দুর্বলতা আছে, তাই বলে যা ইচ্ছে করাবেন?
খুব কি প্রয়োজন ছিল আমার এক গ্লাস জীবনে এক বালতি বিষ ঢালার?’’
তীব্র রহস্যময় হাসি দিয়ে মিশানের কাঁধে হাত রাখতে রাখতে বলল,
‘‘মিশান! তুমি সেই পুতুল যাকে আমি ইচ্ছে মতো নাচাতে পারি। কারণ তুমি বাধ্য আমার কথা শুনতে! না চাইতেও উঠতে বসতে হবে। আর পুতুল মানেই তাকে নিয়ে খেলা করা। আমাদের বিয়েটাও একটা খেলা।’’
কথাটা বলেই কিটকিটে হাসি দিয়ে উঠল তীব্র,
‘‘তীব্র নিজের প্রয়োজনে শুধু অপরকে ব্যবহার করতে জানে, এর থেকে বেশি কিছু নয়। আমি হলাম আইনের লোক আমি যদি এরকম হারে মানুষ নিজের হাতে মারি তাহলে আমার নাম বেশি হবে, কিন্তু তুমি তো ক্রিমিনাল তোমাকে দিয়ে যদি মারি তাহলে আমি অন্তত মুখ ফুটে বলতে পারবো খুনটা আমি করি নি, ব্যাপারটা হলো গিয়ে আমার মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো না। আবার তুমি যদি ধরা খাও তাহলে তোমার তেমন কোনো নাম হবে না, কারণ তুমি তো প্রফেশনাল কিলার। এক বোতল মদ পেলেই তুমি তার বিনিময়ে মানুষ মেরে দাও। মোরাল অফ দ্যা স্টোরি হলো, এই যে তুমি যে অকাজ কুকাজ করো এগুলো তো আমি জানি, তারপরেও মুখ বন্ধ রেখেছি কারণ আমার মুখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে তুমি আমার কাজ গুলো করে দিচ্ছো, বাই এনি চান্স যদি তুমি অন্য কারো কাছে ধরা খাও, তবুও তুমি সেফ বিকয তোমাকে বাঁচানোর জন্য এসপি সাফওয়ান রেজা তীব্র সর্বদা এক্টিভ।’’
তোমার পেছনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
‘‘পেছনে! বুঝেছি,
সেটা আমিও জানি স্যার, কিন্তু বিয়েটা কোনো বাধ্যতামূলক পন্থা নয়, আমি এমনিতেও আপনার কাজ করে দিতাম, তাই বলে ওভাবে চাপে ফেলে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন আমায়?’’
মিশান কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
‘‘কেনো করলেন স্যার? আমি যতদূর জানি আমি আপনার উপকার ছাড়া ক্ষতি করি নি কখনো। যতোবার আপনাকে মারার চেষ্টা করেছি শুধু আপনার উপর রাগ থেকেই সেটা করতে গিয়েছি আলাদা কোনো স্বার্থ নেই। আমি জানি আপনি মরলে আমার লস আছে, কিন্তু স্যার ভেবে দেখুন আপনি সব সময় ইচ্ছে করে আমায় লেগপুল করেন, মারেন,বিপদে ফেলেন, সেগুলো কি আমি আদৌ ডিজার্ব করি?’’
তীব্র অন্য দিকে তাকিয়ে গলায় হাল্কা কাশি দিয়ে পাল্টি মেরে নরম স্বরে উত্তরে বলল,
‘‘শোন মিশান, আমি তোকে মন থেকে ভালোবাসি বলে বিয়ে করেছি। তোর মনে হতেই পারে শুধু নিজের প্রয়োজনে তোকে আমি ব্যবহার করছি। কিন্তু আসলেই আমি তোকে ভালোবাসি।
তোর মতো হাজারটা মিশান আমার পায়ের নিচে পড়ে থাকে, সময় নেই আমার। এমনকি আমি শুধু মুখ দিয়ে হ্যাঁ বলবো প্রতিরাতে একজন করে ভার্জিন নারী আমার বিছানায় স্ব ইচ্ছাই আসবে, সেই ক্ষমতা তীব্রর আছে।
এই মুহুর্তে আমি চাইলে অই বিছানায় তোকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারবো, তুই আমাকে বাঁধাও দিতে পারবি না ঠেকানো তো দূর।
তোর মতো আইডেন্টিটিলেস মেয়ে আমার পাশে মানাবে না জেনেও আমি তোকে সেই জায়গাটা দিয়েছি। মানলাম রেগে গেলে কনট্রোল করতে না পারলে তোকে দু চারটা থাপ্পড় মারি, অনেক সময় ইচ্ছে করে বিপদে ফেলি কিন্তু এগুলো আমি তোর ভালোর জন্যই করি। এখন না বুঝলেও একটা সময় বুঝবি।
ওভার অল আমি তোকে ভালোইবাসি।
লোহার কিছু তৈরী করতে গেলে তাকে আলতো হাতে শেইফ দেয়া যায় না, প্রকন্ড তাপে দগ্ধ করে অনবরত পেটানোর পর সেই লোহা খাটি ও ধারালো বস্তুতে পরিণত হয়।
ভেবে দেখো দুজনে মিলে মিশে কাজ করলে আমাদের দুজনেরই লাভ। তোমার একটা তীব্র দরকার, আমার একটা মিশান দরকার। তুমিও তেজস্ক্রিয় আমিও তেজস্ক্রিয় দুজনে এক হলে ইলেকট্রন বিনিময়ের মতো আমরা একে অপরের কাজ করবো। তাই এসব বিবাধ ঝামেলা না পাকানোই ভালো। আমারো একটা মিশন আছে তোমারও একটা মিশন আছে। খামোখা বোকামি করে নিচে নামিস না। আমি যেভাবে যা ডিরেকশন দিচ্ছি তাই করে যা ভালো তোর ই।’’
‘‘হয়েছে থামুন এবার প্লিজ। অনেক ভালোবাসা হয়েছে, আরে বস্ এরকম করে বললে ইমোশনাল হয়ে যাব তো।ফালতু কথা বার্তা।’’
পুরোটা বলার আগেই কথা থেমে গেল, মনে মনে বলল,
‘‘নো মিশান নো! এই লোকটাকে তেঁতো কথা শুনানো যাবে না, তোর এখন একে দরকার। মাথা ঠান্ডা কর।
প্রয়োজনে মিলমিশ দিয়ে থাক,কাজের কাজ হয়ে গেলে ভোকাট্টা, নাহ আমার কাজ শেষ না হওয়া অব্ধি এর উপর ভুলেও এট্যাক করা যাবে না।
মিশান মাথা ঠান্ডা মাথা ঠান্ডা!’’
তীব্র মিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পারল মিশান মনে মনে কি ভাবছে, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু রহস্যময় হাসি দিলো।
‘‘এখন বলো তো মিশান আমি এখানে কি করে জানলে?’’
‘‘আপনার ফ্লাইটের আগেই আমি জানতে পেরেছি এখানে আসছেন।’’
‘‘কার থেকে জানলে?’’
‘‘নাম মনে নেই।’’
‘‘আমিই বা কি বোকা, এই প্রশ্ন করছি কেনো। তোমার তো চামচা একটাই।
আজকে রাস্তার অই মারার ফাঁদটা বুঝে উঠতে পারি নি, একটু এক্সপ্লেইন করো তো শুনি।’’
‘‘অই লাইলন সুতার মধ্যে আপনার পা উষ্টা খেয়ে সামনের দিকে পরে যেতেন।একটা গর্ত করে পাতা দিয়ে যে ঢেকে রেখেছিলাম, আপনি অই গর্তে পড়ে যেতেন তখন আপনার ঘাড়ের মধ্যে ছুরি মারতাম।’’
‘‘ওরে খোদা! কঠিন চাল ছিল। এই মিশান হাজার হলেও আমি তোমার হাজবেন্ড, মানো আর না মানো।
এরকম কাজ আর করো না। আমি এমনিতেও মৃত্যু দেখে ভয় পাই। আর সব কথার বড় কথা, তুই গাড়ী থেকে পালানোর সময় অই দুই পুলিশকে মেরেছিস কেনো?’’
‘‘মারবো না আবার? ওরা আমাকে ফলো করেছে সকাল থেকে, আমি সংক্রান্ত সব জেনে গেছে, যদি সবাইকে বলে দেয় আমার পরিচয়, তাই মেরে দিয়েছি । আপনিই তো ওদের পাঠিয়েছিলেন তাই না?’’
‘‘অই তোর মাথা ঠিক আছে? আমি কাউকে পাঠায় নি। আমার কি ফাউ কাজের সময় আছে? কেউ যেনো আমাকে সন্দেহ না করে সেজন্য একটা বানোয়াট গল্প বানিয়েছিলাম যে একজনকে সন্দেহ হচ্ছে তাই তার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছি। এর বেশি কিছু নয়। খামোখা নিরীহ দুজন মানুষকে মেরেছিস।’’
‘‘বেশ করেছি, আমি জিজ্ঞেস করার পর ওরা পাকনামি করে স্বীকার করেছিলো কেনো? হিরো সাজতে চেয়েছিল? দিয়েছি বানিয়ে হিরো, সবাই শহীদ বলবে এখন।’’
‘‘নেক্সট টাইম এভাবে নিরীহ কাউকে মারবি না। ’’
তীব্রর সাথে কথা বলার কোনো রুচি মিশানের ভেতর আসছে না।
ভালোমতো গুঁটিশুঁটি মেরে বসে, জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট্টো একটা মদের বোতল বের করে মিশান গিলতে শুরু করল।
তীব্র মিশানের থেকে নজর ফিরিয়ে উঠে গিয়ে বিছানায় চলে যায়।
স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়ে যায়।
মিশান দম ধরে বসে বসে বোতল খালি করে নিল।
সম্পূর্ণ নিজের অনিচ্ছাতে তীব্রকে বিয়ে করতে হয়েছে। না তো কখনো তীব্রকে ভালোবেসেছে, আর কখনো ভালোবাসার চেষ্টাও করবে না। মিশানকে তীব্র জোর করে বিয়ে করলেও তার পেছনে কি কারণ সেটা তীব্রই ভালো জানে। মিশান আজও জানে না তীব্র ওকে কেনো বিয়ে করেছে, যতোবার প্রশ্ন করেছে তীব্র ততোবারই উল্টা পাল্টা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মিশান এইটুকু বুঝে তীব্র ওকে নিজের কাজে ব্যবহার করার জন্য বিয়ে নামক শব্দ দিয়ে বেঁধে দিয়েছে, মিশান এটাও জানে না তীব্রর পরিবারে কে কে আছে, ওর বাড়ি কোথায়।
মিশানের দুর্বলতাকে আঘাত করে ধরে রাখে ওকে। তীব্র যে মিশানকে ভালোবাসে সেটা নয়, ওর আলাদা কোনো উদ্দেশ্য আছে যেটা শুধু তীব্রই ভালো জানে।
সেনাবাহিনী থেকে সিরিয়াল কিলার হওয়ার গল্পটা খুব আজব প্রকৃতির মনে হলেও,মিশানের জীবনের বেগ ওকে
বাধ্য করেছে এই পথে আসতে।
মিশানের এই পথে আসার মূল কারণ নিশান ছিল।
আজকে মিশানের সেই অন্ধকার অতীতের একটা ছোট্ট অংশ ঘুরে দেখা যাক।
নিশান মিশানের ছোট্ট বোন। কত বছরের ছোটো সেটা সঠিক মিশানের মনে নেই।
তবে যতোটুকু মনে পড়ে মিশান ভালো মতো কথা বলতে পারে বুঝতে পারে সব কিছু তখন নিশান কয়েক মাসের বাচ্চা ছিল। আনুমানিক সাড়ে চার/ পাঁচ বছরের ছোটো হবে।
সেই ছোটো বেলা থেকে মিশান নিশানকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতো।
নিশান যখন এইটে পড়ে তখন ওর প্রচুর জ্বর হতে থাকে, ঘন ঘন অসুস্থ হতে থাকে, কিছু খেতে পারতো না, বমি হতো আর বমির সাথে ব্ল্যাড বেরিয়ে আসতো যে ব্ল্যাড টাটকা রক্ত না, অনেকটা দুর্গন্ধময় রক্ত।
এরপর অনেক ভালো ভালো ডাক্তার দেখানো হয় কিন্তু কোথাও এক্সাক্টলি রোগ ধরা পড়ছিলো না, অনেক বড় বড় ডক্টর দেখানোর পর জানতে পারে নিশানের ব্ল্যাড সেল গুলো বছরের পর বছর ক্ষয় হতে হতে এমন পর্যায় এসে গেছে।
ওকে বাঁচানোর রাস্তা তখন একটাই মিনিমাম ছিল প্রতিমাসে একবার ম্যাক্সিমাম দুই মাসে একবার যে করেই হোক ওর ব্ল্যাড চেঞ্জ করতে হবে। এরপর ডক্টরের রুটিন অনুযায়ী নিশানকে প্রতিমাসেই ব্ল্যাড দেয়া হতো।
ব্ল্যাড খোঁজাখুঁজি নিয়ে কোনো সমস্যা হতো না, কারণ মামা সেনাবাহিনীর ছিল। সেনাবাহিনীর ম্যাক্সিমাম লোকই ব্ল্যাড চাওয়ার আগে দিয়ে দিতো আপসে।
মিশান নিশান দুজনের ব্ল্যাড গ্রুপ এক হওয়ায় মিশান নিজেও তিন মাস পর পর ব্ল্যাড দিতো। মোট কথা এভাবেই নিশানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল।
ডক্টর বলেছিলো এই প্রসেসে নিশানকে কয়েক বছর বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিন্তু অনেক বছর না। তবুও চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি মিশানের মামা।
আর টাকা পয়সার ব্যাপারটা তো আছেই।
সব সময় মামা বড় এমাউন্টের টাকা নিশানের পেছনে খরচ করতো বিধায় মিশানের কাছে ব্যাপারটা চোখে লাগতো, যার জন্য ও নিজের স্বপ্ন ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।
মিশানের স্কুল কলেজ দুটোই ছিল ক্যান্টনমেন্ট।
বুয়েটে নেভাল আর্কিটেকচার এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট থেকে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর লাভের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য না ছুটে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেইন পদে নিয়োগ দেয়ার কথা শুনে মামার কথা মতো বিএমএ প্রশিক্ষণের পর সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে ক্যাপ্টেইন পদবীধারী হয়।
এছাড়াও মিশান কখনো সেনাবাহিনীতে আসতে চায় নি। মিশানের চাল চলন ওর হাইট ওয়েট ফিটনেস দেখে মামা প্রায় ই বলতো আর্মি জয়েন করার জন্য। কিন্তু মিশান সেসব কানে নিতো না।
চেয়েছিলো স্নাতক শেষ হতেই কোনো রকম একটা চাকরী নিতে, যাতে নিশানের ওষুধপাতি আর ডক্টরের খরচ কিছুটা বহন করতে পারে, যদিও স্টুডেন্ট লাইফে মিশান অনেক রকম পার টাইম জব করেছে যার জন্য ওর ম্যাক্সিমাম কাজের উপর আর দুনিয়ার হাল চালের উপর বিশাল অভিজ্ঞতা আছে।
স্নাতক লাভের পর নিশান মিশানকে কথার ছলে বলে উঠে,
‘‘আপি আমার না একটা জিনিস খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুমি সেনাবাহিনীর পোশাক পড়া থাকবে, মাঠে প্যারড করবে একটা দলকে লিড করবে। ওপস যা লাগবে না তোমাকে! পুরো হিরোর মতো লাগবে আমার আপিকে। তারপর দেশের বাইরে যে মিশনে পাঠায়, তুমি যুদ্ধ করে বিজয় তুলে আনবে, আমি বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলবো এটা আমার বোন। আমার আপিই!’’
মিশান নিশানের গালে হাত রেখে মলিন হেসে বলল,
‘‘আমার বোনের একটা ইচ্ছে হয়েছে, সেটা মিশান বেঁচে থাকতে অপূর্ণ থাকে কি করে?’’
নিশান চমৎকৃত হাসি দিয়ে বলে,
‘‘আপিইই সত্যি তুমি আমার জন্য আর্মি জয়েন করবে?’’
‘‘অবশ্যই, আজ অব্দি তোর কোন ইচ্ছে তোর বোন পূরণ করে নি?’’
নিশান মিশানের গলা জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে বলল,
‘‘আমার সোনা আপি। পৃথিবীর বেস্ট আপি টা আমার।’’
মিশান নিশানের স্বপ্ন পূরণ করে দেয় একজন উচ্চপদের আর্মি অফিসার হয়ে।
নিশানের সাথে পরিবারের প্রত্যেকেই খুব
গর্ব করতো মিশানকে নিয়ে ।
সময় বেশ ভালোই যাচ্ছিল, মিশান ওর বেতনের টাকা গুলো দু ভাগে ভাগ করতো একটা অংশ নিশানের চিকিৎসার জন্য আরেকটা অংশ জমিয়ে নিশানকে প্রায় ই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
দেশের বাইরেও নিশানের বেশ পছন্দের কয়েকটা জায়গাতে ওকে ঘুরিয়ে এনেছে।
মোট কথা নিজের রক্ত ঘামে পরিণত করে নিশানের সব ইচ্ছে পূরণ করতে থাকে।
নিশানের এতো অসুস্থতার মাঝেও কখনো পড়ালেখা বাদ দেয় নি, কারণ নিশানের ইচ্ছে ছিলো ও জার্নালিজম নিয়ে পড়বে।ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট করার পর নিশানকে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেয়।
এর মাঝে দ্বীপ নিশানের প্রেম হয়ে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। নিশান দ্বীপের প্রেম কাহিনী কেবলই মিশান জানতো, বাড়ির কেউ জানতো না, জানলেও কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু মিশান জানাতে দেয় নি, কারণ মামা মামী দুজনেই মিশান নিশানকে বড্ড ভালোবাসতো, একেতে নিশানের হাতে সময় কম তার শোকে মামী উদাস হয়ে থাকে, প্রতিরাতে নিশানের জন্য নামাজ পড়ে কান্না করে যেন আল্লাহ ওর হায়াতটা বাড়িয়ে দেয়।
এখন যদি জানে দ্বীপের সাথে ওর সম্পর্ক, হয়তো ওদের বিয়ে দিতেও রাজি হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় নিশান যখন পরপারে চলে যাবে তখন হয়তো মাস খানেক পর কিছুটা হলেও শোক কমে আসবে মামা মামীর ভেতর। কিন্তু যদি দ্বীপের সাথে ওর সম্পর্ককে ফেলে পরপারে যায় তাহলে মামী নিশানকে হারানো আর দ্বীপের ভেতরে হয়ে থাকা ক্ষত কোনোটাই চোখে দেখে সহ্য করতে পারবে না। যতবার দ্বীপের দিকে তাকাবে ভেতর কষ্টে ছিঁড়ে যাবে। একদিকে নিশানকে হারানোর বেদনা আরেক দিকে দ্বীপের বুক ফাঁকা হওয়ার আর্তনাদ দুটো একসাথে নিতে না পেরে মামীর কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সেটা ভেবেই মিশান কাউকে কিচ্ছু জানাতে দেয় নি।
সময় যত যেতে থাকে নিশানের আয়ু কমে আসে, মিশানের চাকরী জীবনের কয় বছর যেতে না যেতেই এরমধ্যে ওর কুয়েতে দু বছরের মিশনের লিস্টে মিশানের নাম আসে। যেটা কোনো ভাবেই নাকোজ করা যায় না। মামাও অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো লাভ হয় না।
না চাইতেও বাধ্য হয়ে যেতে হয়। মিশান ভেঙে পড়লে নিশান ওকে অনেক বুঝায়,
‘‘আপিইইইইই এই আপিইইইইই তুমি কাঁদছো কেনো বলো তো? আল্লাহ এতোটা নিষ্ঠুর হয় নি তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নেবে তোমার অগোচরে। তুমি দেখো তুমি ফেরা অব্ধি আমি বেঁচে থাকবো ভালোমতো, আর তুমি ফেরার পরও অনেক দিন বেঁচে থাকবো। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে দেখো। তুমি তো আমায় কথা দিয়েছো একটা সুন্দর দিনকে সাক্ষী রাখবে আমার মৃত্যুর। তুমি তো বলেছো সব থেকে সুন্দর দিনে আমার মৃত্যু হবে। আর তোমার সব ভবিষ্যৎ বাণী কিন্তু মিলে যায়। এখন কথা হলো
যে সময় আমার আপিই থাকবে না সেখানে আমার দিনটা সুন্দর কি করে হয় বলো তো? আর সে দিনে আমার কি করে মৃত্যু হবে? আপিইই প্লিজ কান্না থামিয়ে আমার সাথে ভালোমতো দুটো কথা বলো। ’’
মিশান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিশানকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
ওদিকে দ্বীপও মন খারাপ করে বসে থাকে, বেশ কয়েকদিন ধরে মিশানকে দ্বীপ একটা বিষয়ে চাপ দিচ্ছে, সেটা হলো দ্বীপ নিশানকে বিয়ে করতে চায়।
মিশান রাজি হতে না চাইলেও এবার রাজি হয়। কারণ মিশান চলে যাচ্ছে মানে নিশানকে সব সময় গাইড করে রাখার মতো দ্বীপ ই একমাত্র ভরসা। মামা মামী আর কতক্ষণ পিছু পিছু ছুটবে।
লিস্টে নাম আসার পর পর তিন মাসের ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে হয়, ট্রেনিংয়ে। যাওয়ার কিছুদিন আগে কাজী অফিসে নিশান আর দ্বীপের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
নিশানের পক্ষের ওর বোন মিশান ই ছিল, আর দ্বীপের পক্ষে আরেকজন সাক্ষী জোগাড় করে নিজেদের মাঝে বিয়ে কমপ্লিট।
এ তিনটে মাস ট্রেনিংয়ের সময় মামার মাধ্যমে নিশানকে সাথে রাখার পারমিশন নেয়। মিশান খুব বেশি কেয়ারে রাখতো নিশানকে। নিশানের চেহারাটা মিশানের থেকে বেশি সুন্দর আর মায়াবী ছিলো দেখতে। যত দিন যাচ্ছিল নিশানের রূপে যেনো উজ্জ্বলতা বেড়েই চলছিলো, আর মায়াটা বেশি কাড়ছিলো। ওর চোখের দিকে তাকালে অন্যরকম মায়া কাজ করতো। হয়তো শেষের সময় ছিলো বলেই উপরওয়ালা হায়াত বাদে সব কিছু ওকে ঢেলে দিচ্ছিলো।
এরপর আসে সেই দিন যে দিনে মিশানকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়, ভেতরে হাজারটা কু ডাকছিলো, মাথা ভরা টেনশন কাজ করছিলো শুধু নিশানকে নিয়ে।
ফিরে এসে আদৌ সুস্থভাবে নিশানকে দেখতে পারবে তো! কলিজাটা ছিঁড়ে আসছিলো, প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে বুক ফেটে আসছিল। কখনো কল্পনা করেনি নিশানকে ছাড়া এভাবে এতোদিনের জন্য এতোদূর যেতে হবে।
থাকবে কি করে নিশানকে ছাড়া! নিশানই ই যে ওর সব কিছু।
প্রথম প্রথম যখন সেনাবাহিনীর ট্রেনিংয়ের জন্য মিশানের সেনাবাহিনী ক্যাম্পে রাত কাটাতে হয়েছে তখন নিশান মিশানের জন্য পাগল হয়ে যেতো, আর মিশানের উন্মাদনার তো কথায় নেই।যেখানে বাইরের লোক এলাউ না সেখানে সিনিয়রদের থেকে ফেভার নিয়ে মিশানের সাথে যেনো রাতে নিশানকে থাকতে দেয় সেই পারমিশনের ব্যবস্থা করে দেয় মামা।
মামার খাতিরেই সাধারণত ও সুযোগটা পেয়েছিল।
নিশান মিশানকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারতো না বলেই ব্যাকুল হতো বোনের জন্য। মিশানের থেকে নিশানই বেশি ভালোবাসতো ।
বিকেলের দিকে মিশানের কাছে চলে যেতো মামার সাথে।
আর মিশানের ট্রেনিং যেন ভালোমতো হয় সে জন্য নিশান ছোটো হয়েও অনবরত মোটিভেট করতো ওকে।
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েও দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। যদি কোনো ভাবে নিশানকে সাথে নিয়ে যেতে পারতো তবে হয়তো ওর কোনো কষ্টই হতো না। কিন্তু নিশানকে নেয়ার মতো কোনো পারমিশন মিশান পায় নি, কারণ সেরকম কোনো সিস্টেম ই নেই।
একটা অনিশ্চিত সময়ের মাঝে নিশানকে রেখে চলে যেতে হচ্ছে, জানা নেই কি হবে পরবর্তী সময়গুলোতে।
বুকে পাথর রেখে বোনকে ছেড়ে যেতে হলো। মিশানের মতো আরো অনেকেই আছে, পুরো একটা টিম যাচ্ছে। সবারই মন খারাপ, কিন্তু মিশানের মতো এতোটা মন খারাপ কারো নয়।
প্লেনে বসে কারো সাথে কোনো কথা বলে নি। অনবরত চোখের পানি ঝরেই যাচ্ছিল, মনে হচ্ছে কিছু একটা জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যেটা কখনো খুঁজে পাবে না। নিয়তির কাছে বড্ড অসহায়, না চাইতেও চোরাবালিতে পা রাখতে হচ্ছে ডুবে যাবে জেনেও।

(চলবে)