তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১৫

0
92

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১৫
লেখিকা- রিয়া খান

জীবনের এই একটা যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য মিশান বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে আছে তবুও বিন্দু মাত্র শক্ত হয় নি।
মিশানের থেকে নিশান অনেকটাই শক্ত। মিশান একটুতেই ভেঙে পড়লেও নিশান ভেঙে না পড়ে আশার আলো দেখতে চায়। কুয়েত যাওয়ার পর মিশানের কাজ শেষ করে যখন অবসর হয় ততোটুকু সময় নিশানের সাথে কথা বলে কাটিয়ে দেয়, এমনও কিছু অভিজান থাকে যেখানে মোবাইল নেয়া বারণ থাকে। কিন্তু এ বারণ মিশান শোনার মানুষ না। চান্স পেলেই কাজের সময় নিশানকে ভিডিও কল দিয়ে দেখায় কোন অবস্থায় আছে, কি করছে, এই ব্যাপার গুলো নিশানের কাছে খুব এডভেঞ্চার লাগে, খুব মজা পায়। নিশান যখন মন থেকে হাসে মিশান তখন বুঝতে পারে, নিশানের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি মানে মিশানের বুকে এক টুকরো প্রশান্তি।
নিশানের সময় কম সে কারণে মিশান ওর জন্য উন্মাদ না, মিশান ছোটো বেলা থেকেই নিশানকে চোখে হারায়।
কাউকে কথা দিয়েছিল, যতক্ষণ মিশানের শ্বাস প্রশ্বাস চলবে নিশানের কোনো চাহিদা অপূর্ণ, আর মন খারাপ তো থাকতেই দেবে না।
সময় যেতে থাকে ক্রমাগত।
নিশানের চিন্তায় চিন্তায় ঠিকমতো ঘুম হয় না, আজে বাজে স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ছিটকে উঠে, সাথে সাথে নিশানকে ফোন দিয়ে ওর কন্ঠ শুনে শান্ত হতো। আতংকে আতংকে দিন যাচ্ছিল মিশানের।
বাংলাশের থেকে যে টিম গিয়েছিল তাদের লিডারশীপ ছিলো মিশান ও আরো দুজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেইন।
প্রথম প্রথম খুব বেশি খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে সয়ে যায়, যখন তখন নিশানের সাথে ভিডিও কলে কথা হচ্ছে ওকে সুস্থ দেখাচ্ছে আর বাড়ির প্রত্যেকেই নিশানের খেয়াল দেখভাল আগের থেকে আরো বেশি করে যেনো, মিশান কখনো আঙুল তুলে বলতে না পারে তার বোনের যত্নের কোথাও ত্রুটি ছিল।
তার উপর দ্বীপের এক্সট্রা কেয়ারিং তো আছেই। অফিস থেকে ফিরেই নিশান আর তাপসিনকে সাথে নিয়ে তিনজনে মিলে ঘুরাঘুরি করে, এতে নিশানও স্বাভাবিক থাকে। কখনো মন খারাপ থাকতে দেয় না কেউ, ভিডিও কলে নিশানকে কখনো মন খারাপ করে থাকতে দেখলে মিশান দেউলিয়া হয়ে যায় ওকে হাসানোর জন্য, কখনো পাগলের মতো উদ্ভট সব কান্ড করে বসে, জোক্সস বলে, জুনিয়রদের করা কিছু বোকামি শেয়ার করে, সাথে সাথে নিশান হেসে গড়িয়ে পড়ে বাচ্চাদের মতো।
সময় ও পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে এক বছর চলে যায়, এক বছর পর সবাই দুই মাসের ছুটি পায়।
দেশে ফেরার আগে সবার জন্য এত্ত এত্ত শপিং আর নিশানের জন্য কতকিছুই যে নিয়েছে সেগুলো বলা বাহুল্য ।
এয়ারপোর্টে পৌঁছাতেই যখন দুই বোনের দেখা হয় মিশান ঝাপটে জড়িয়ে ধরে নিশানকে, খুশিতে কেঁদে দেয়, পুরো এক বছর পর নিশানকে জড়িয়ে ধরতে পারছে।
দু মাস মিশান নিশানের সাথে বেশ ভালো সময় কাটায়। নিশানের ইচ্ছে হয় দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবে, বলা দেরি কিন্তু মিশানের সেটা পূরণ করা দেরি হয় নি। মিশান, নিশান, দ্বীপ তিনজনে মিলে ঘুরতে চলে যায়। মৃত্যুর আগে নিশান বলতে পারবে না কোনো ইচ্ছা বাদ আছে যেটা মিশান পূরণ করতে পারবে না, শুধু একটা ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেছে যার জন্য মিশানের আজ এই পরিণতি!
দু মাস কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় হয়, যাওয়ার আগে নিশানকে ব্ল্যাড দিয়ে যায়, ডক্টরের থেকে শুনে যায় ওর কি অবস্থা ।
মিশান এবার যাওয়ার সময় আগের বারের থেকে বেশি ভেঙে পড়ছিল, খুব জোরে জোরে কান্না করে নিশানকে জড়িয়ে ধরে।
কুয়েতে ফেরার পর মিশানকে খুব একটা ডিপ্রেসড দেখায়, হয়তো নিশানের ব্যাপারে কিছু একটা চেপে বসে মাথায়,
একা থাকলেই বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতো, কেমন যেনো নির্লিপ্ততা কাজ করে মিশানের চেহারায়। নিশানের সাথে যখন কথা বলতে যায় বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। সব সময় উদাসীন হয়ে থাকতো।
সময় যতো যায় মিশানের রাতের মস্তিষ্কে দুঃস্বপ্নরা পার্মানেন্টলি বাসা বাঁধতে থাকে।অনেক গুলো গুলির আওয়াজ যানবাহনের আওয়াজ, একটা অন্য রকম নারী কণ্ঠ থেকে একবার মিশান একবার নিশান বলে ডাকে কেউ, আবার নিশানের কণ্ঠের আপিই ডাক শুনতে পায়, কখনো আবার একটা পুরুষ কন্ঠ সুন্দর করে মাধুর্য মিশিয়ে মিশানের নাম উচ্চারণ করে। এগুলো এমন ভাবে অনুভূত হতো যেনো সবটা বাস্তবে ঘটছে ।
ঘুম থেকে ছিটকে উঠে বসে থাকতো স্বপ্নের কাহিনী দেখে, মাথা প্রচণ্ড ব্যাথা করতো অসহ্য রকমের।
ডিপ্রেশন থেকে মিশান কোনো কাজ ঠিক মতো করতে পারে না। নিজেকে পুরো পাগল পাগল লাগে।
সিনিয়রদের অনেক কথা শুনতে হয় কাজের কাজ না করতে পারায়। কুয়েতের এক সামরিকের সাথে মিশানের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল, তার সাথে নিজের ডিপ্রেশনের কারণটা শেয়ার করে, সে মিশানকে জানায় এলকোহলের মাধ্যমে ডিপ্রেশন কমে আসবে। রেড ওয়াইন খেলে হাইপার টেনশন কমে আসে।
ঘোরের মধ্যে ঘুমও ভালো হবে।
ভুল মানুষের সঙ্গ ও ভুল উপদেশের বশীভূত হয়ে, মিশান একটু একটু করে এলকোহল এডিকটেড হতে শুরু করে, তার সাজেশন মতো রেড ওয়াইন দিয়েই মিশানের নেশার যাত্রা শুরু হয় ।
প্রায় দু মাস কেটে যায় এভাবে।
একদিন মিশানদের ক্যাম্পে হঠাৎ করে উপস্থিত হয় তীব্র ও সাথে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। এখানকার পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে আসে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সেটা তাঁরা দুজনই ভালো জানে।
সিনিয়র অফিসার আসার কারণে মিশানরা পুরো টিম তাদের অভিনন্দনের সাথে স্বাগতম করে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তীব্রর সাথে ওদের তিন ক্যাপ্টেইনের পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই দিন ই মিশান তীব্রর একে অপরের সাথে প্রথম দেখা সাক্ষাৎ হয় ।
মিশান তীব্রকে সেদিন স্বাভাবিক নজরে দেখলেও তীব্র কেমন যেনো রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে উপর থেকে নিচ।
দুদিন পর,
মিশান মাঝরাতে বারে বসে ড্রিঙ্ক করায় নিমজ্জিত আছে, এমন সময় সামনের চেয়ারে হুট করে পায়ের উপর পা তুলে বসে তীব্র। মিশান নেশার ঘোরে থাকলেও আশেপাশে কি হচ্ছে তা বুঝতে পারছে।
‘‘হাই!’’
একটা মাতাল হাসির সাথে মিশান উত্তর দিলো,
‘‘হ্যালো স্যার!’’
‘‘কেমন আছো?’’
মিশান মলিন হেসে, মাতাল কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘‘দেখতেই তো পাচ্ছেন স্যার!’’
আচ্ছা স্যার আপনিও কি আমার মতোই আছেন? বারে তো কোনো স্বাভাবিক মানুষ আসে না। তবে হ্যাঁ এখানে দুই ক্যাটাগরি মানুষ আসে মানে মত্ততাবিশিষ্ট দুই ধরণের ১. আমার মত বদ্ধ উন্মাদ যারা জীবনের কাছে হেরে গিয়ে শেষ সময় বিসর্গ ব্যাঞ্জন ভুলে এখানে আসি মদে মত্ত হতে।
২.আরেকদল হলো উল্লাসী শ্রেণির, যারা নিজেদের আনন্দের সুখটাকে আরো উল্লাসিত করার জন্য মদের সাথে মত্ত হয়।
তো স্যার আপনি কোনটা?
তীব্র রহস্যমাখা হাসি দিয়ে বলল,
‘‘কোনোটাই না।’’
‘‘এটা আবার কেমন কথা স্যার! এটা হয়?এখানে কোনো স্বাভাবিক মানুষ আসে না স্যার। কাহিনী কি বলে ফেলুন। দেখে মনে হচ্ছে আমার মতোই জীবনের কাছে হেরে যাওয়া যোদ্ধা। স্যার বন্ধু মনে করে নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন।’’
‘‘আমি এখানে তোমার সাথে একটা ডিল করতে এসেছি।’’
‘‘কি ডিল স্যার? মানুষ মারা থেকে শুরু করে মিশান সব ডিল করে, বলে ফেলুন।’’
কথাটা মিশান নেশার ঘোরে বলে ফেলল, অভিনয় এমন ভাবে করল যেনো সিরিয়াল কিলার।
তীব্র মিশানের দিকে মাথা ঝুঁকে বলে,
‘‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। বিয়ে করবে আমায়?’’
এটা শুনে মিশানের হেচকি উঠে গেল।
নেশার ঘোরেই কথাটা শুনে বেশ বড় মাপের ভোল্টেজ খেলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
‘‘স্যা…….ররর কি বলছেন!’’
কিছুক্ষণ থেমে থেকে মিশান ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘‘আপনি বেশি খেয়েছেন তাই না স্যার?আপনার পিনিক ধরে গেছে! চলুন আপনাকে আমি হোটেলে দিয়ে আসি স্যার। আমার কিন্তু পিনিক হয় নি স্যার।
আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি কিন্তু হেল্পটা করতে রাজি হোতাম না। এই কারণেই করছি আপনি হলেন বাঙালী তার উপর আমার সিনিয়র।
উঠুন স্যার দিয়ে আসি আপনাকে। ’’
তীব্র ফরমাল হাসি দিয়ে মিশানের দিকে পলক বিহীন নজরে তাকিয়ে রইল।
‘‘চলো দিয়ে আসো আমায়।’’
‘‘ওকে স্যার ওয়েট।’’
সামনে যতোটুকু মদ ছিল সবটুকু খেয়ে নিল। এরপর টেবিলের উপর হাত রেখে ভর করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মিশান।
নিজের ব্যালেন্স কনট্রোল করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তীব্র মিশানের এক হাত নিয়ে নিজের কাঁধের উপর দিলো আর নিজের এক হাত দিয়ে মিশানের কোমর ধরলো।
এরপর ওকে ধরে নিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলো তীব্র।
‘‘স্যার আপনি ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন তো? আমাকে ভালো করে ধরুন, না হলে পড়ে যাবেন। আর একটু রাস্তা বাকি হোটেলে এসে গেছি প্রায়। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আমি আপনাকে সেইফলি পৌঁছে দেবো।’’
একের পর এক মিশান বক বক করেই যাচ্ছে। তীব্র মিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে তুচ্ছরূপে হেসে দিলো, এরপর মিশানকে গাড়িতে নিয়ে বসলো।
সারারাস্তা মিশানের বকবক শুনতে শুনতে তীব্রর কান শেষ।
হোটেলের সামনে আসতেই, ওকে ধরে নিয়ে তীব্র নিজের রুমের দিকে নিল।
হোটেল স্টাফকে লেবু ও আদার রসের সাথে হাল্কা মধু মিশিয়ে আনার অর্ডার করলো।
সোফায় বসাতে না বসাতেই মিশান ঢলে পড়ে ।
স্টাফ লেবু ও আদা মিশ্রিত রস আনার পর পর ই তীব্র মিশানকে ধরে জোর করে খাওয়ালো। খাওয়ানোর মিনিট খানেক পর ই মিশান নিতে না পেরে বমি করা শুরু করে দেয়।
অনেক্ষণ ধরে বমি করতে করতে মিশান হাঁপিয়ে যায়। অস্থির হয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিতে থাকে, মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায় বমির পর। তীব্র মিশানকে ধরে রাখে যেনো উপুড় হয়ে পড়ে না যায়।।
বেশ কিছুক্ষণ পর মিশান স্বাভাবিক একটা অবস্থায় এলেও অস্থিরতা কমছে না। জায়গাটা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করে দিতেই মিশানকে এক কাপ আদা চা দেয়া হয় যেটা খেয়ে হাল্কা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আসে ।
মিশান তীব্রর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
‘‘স্যার আমি এখানে কেনো এসেছি?’’
‘‘আমি নিয়ে এসেছি?’’
‘‘কিন্তু কেনো স্যার?’’
‘‘বিয়ে করার জন্য।’’
মিশান মাথা ঝাঁকি দিয়ে আতংকিত হয়ে উঠে, কি সব বলছে। একটা লোককে চেনা নেই জানা নেই তাকে বিয়ে করা সম্ভব কি করে!
‘‘স্যা স্যার কি যা তা বলছেন। না আপনি আমাকে চেনেন, নাতো আমি আপনাকে চিনি।’’
‘‘চেনার জন্য অনেক সময় আছে। বিয়ে করে নাও তারপর অঢেল সময় পাবে আমাকে চেনার।’’
‘‘কি বলছেন স্যার! এটা হয় না। আমি কখনো বিয়ে করবো না। এটা অসম্ভব স্যার। স্যার আপনি মজা করছেন তাই না? সিনিয়র হয়ে জুনিয়রদের সাথে মজা করতেই পারেন কিন্তু এই সব বিষয়ে না স্যার প্লিজ!’’
তীব্র রহস্যময় হাসি দিয়ে মিশানের পাশে বসে নিজের মোবাইল টা বের করে একটা ভিডিও প্লে করে মিশানের সামনে ধরল, ভিডিওটা দেখে মিশানের আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কলিজাতে কাঁপুনি উঠে গেছে।
কিছুদিন আগে মিশান বার থেকে ক্যাম্পে ফিরছিলো, সেদিন ড্রিঙ্ক খুব একটা করে নি, হাল্কা পাতলাই করেছিল।
কিছুটা পথ যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় একটা ছেলের সাথে কথার মনমালিন্য হওয়াই মিশান রেগে গিয়ে ছেলেটার মাথার মধ্যে একটা বড় পাথর দিয়ে আঘাত করে, এমন ভাবে আঘাত করে ছেলেটার রুহু সাথে সাথেই বেরিয়ে যায়।
মিশান বুঝতে পারে নি এভাবে ছেলেটার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। কি করবে বুঝতে পারে না।
ক্যাম্পটা কাছে ছিলো মিশান দৌড়ে ক্যাম্পে যায়, সেখান থেকে একটা বড় দড়ি আর প্লাস্টিক কাগজ নিয়ে আসে
এরপর ছেলেটাকে সেটাতে প্যাকেট করে একটা বড় পাথরের সাথে কোমরে বেঁধে কিছুটা দুরত্বে বড় নদী থাকায় সেখানে ফেলে দেয়। এরপর রাস্তায় যে রক্ত লেগে থাকে মিশান সে জায়গাটার রক্ত ভালোমতো পরিষ্কার করে ফেলে যেনো কোথাও কোনো প্রমাণ না থাকে।
কিন্তু এদিকে বড় প্রমাণ তীব্রর কাছে জমা পড়ে গেছে, এসব কর্মকান্ডের ভিডিও রেকর্ড তীব্রর ফোনে, যেটা এখন মিশান দেখে ওর হৃদস্পন্দন হাইপার হয়ে গেছে। ভয়ে চুপসে গেছে। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠে আছে।
তীব্র কিছু না বলে ভিডিও শেষ হতেই আরেকটা ভিডিও প্লে করলো, যেখানে বারে বসে ওর ড্রিঙ্ক করার ভিডিও করা হয়েছে। মিশান এসব দেখে পুরো পাথর।বুঝতে পারছে না তীব্র কেনো ওর পিছু লেগেছে, এসব করে কি লাভ?
তীব্র এবার হাল্কা গলায় কাশি দিয়ে বলল,
‘‘চিন্তা করো না, এগুলো আমি আর তুমি ছাড়া কেউ জানে না। তুমি চাইলে কেউ জানবেও না যদি আমার কথা মতো কাজ করো। আর যদি না করো তবে তোমার জন্য গ্র‍্যান্ড শনি অপেক্ষা করছে। এই ভিডিও সোজা মিডিয়ার কাছে চলে যাবে কুয়েত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই জানাজানি হবে, এরপর তোমার চাকরি চলে তো যাবেই সাথে কুয়েতেই তোমার যাবৎ জীবন কারাদণ্ড হবে, হতেও পারে মৃত্যু দন্ডও দেবে।
এগুলো তো কিছুই না, আসল ঘটনা ঘটবে মেইন জায়গায়। তোমার একমাত্র বোন নিশান যাকে তুমি এত্ত এত্ত ভালোবাসো, আর তোমার বোন তো কথায় নেই। সেই বোন যখন দেখবে তার বোনের এই অবস্থা, হয়তো সে সবটা দেখেও বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সমাজের লোক তো আর অবিশ্বাস করবে না।প্রতিনিয়ত তোমার বোনের আসতে যেতে অপমানিত লাঞ্ছিত হতে হবে সব জায়গায়। তোমার মামার মাথা নিচু হয়ে যাবে সমাজে, ভালো ভেবে দুটো মেয়েকে নিজের ঘরে তোলে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করার পরিণাম কিনা শেষে এই ভাবে পেতে হলো। আর বাকিদের কথা বাদ ই দিলাম।
মোরাল অফ দ্যা স্টোরি হলো, তোমার বোনের হায়াত এমনিতেই কম,তোমার টেনশনে তার হায়াত আরো কমে তো আসবেই, তার সাথে কুয়েতের জেলে বসে বোনের সাথে মৃত্যুর আগে শেষ দেখা হবে না। ভেতরে একটা তৃষ্ণা নিয়ে মরতে হবে তোমার বোনের।’’
কথা গুলো বলে তীব্র থেমে গেল, মিশানের মস্তিষ্ক এক্টিভ করে দিয়ে ভাবার সুযোগ দিলো কিছুক্ষণ। মিশান অঝোরে ঠোঁট কাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
মিশানের মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছে যে করেই হোক নিশানের মৃত্যুর আগে পাশে থাকতে হবে, না হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
‘‘এবার বলো তো, আমার প্রস্তাবে কি তুমি রাজি নাকি রাজি না?’’
মিশান নিরুত্তর হয়ে রইল,
‘‘যাও তোমাকে চাপে ফেলবো না, তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি।
আমাদের এই বিয়ের ব্যাপারটা কেউ জানবে না, যদি তুমি কাউকে না জানাও, জানাবে কি জানাবে না সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার।
বিয়ের পর আমাদের মাঝে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক মানে শারীরিক সম্পর্ক হবে না, তুমি চাইলে হতে পারে। আমি কথা দিচ্ছি আমি কখনো এই ব্যাপারে কোনো প্রেশার করবো না। আর লাস্ট হলো, বিয়ে করছি বলে এই না যে আমার সাথে সংসার করতে হবে। খুব প্রয়োজন হলে তোমাকে আমি একটা বাড়িই কিনে দেবো কিন্তু সংসার করা সম্ভব না তুমি তোমার মতো থাকবে আমি আমার মতো থাকবো, শুধু আমি তোমাকে মাঝে মাঝে দু একটা কাজ দেবো সেগুলো তুমি করে দেবে, এর বেশি কিছু নয়। কাজ গুলো কঠিন কিছুও নয়, তোমার সাধ্যের মধ্যেই হবে। এবার বলো তুমি কি রাজি আছো কি নেই?’’
না চাইতেও মিশান নিশানের কথা চিন্তা করে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
সব কিছুই যে তীব্রর আগে থেকেই প্ল্যান করা সেটা বুঝাই যাচ্ছে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেই বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আর আব্দুর রহমান সাথে একজন আলেম নিয়ে এসেছে। সব এমন ভাবে প্ল্যান করা ছিল যে তীব্র একটা ইশারা দিলেই সবাই হাজির হবে। এমনকি বিয়ের কাগজ পত্রও দেশ থেকে রেডি করে নেয়া হয়েছিলো।
প্রথমে মিশানের সাইন নিলো বিয়ের কাগজে।
এরপর আলেম ধর্ম মতে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দিলো, দুজনের বিয়ে ধর্মীয় ভাবে সম্পন্ন হয়ে গেলো। আইনগত ভাবে বৈধ তখনি হবে দেশে ফিরে যখন কাগজটা কোর্টে নিয়ে স্ট্যাম্প মেরে নিয়ে আসবে।
বিয়ে হওয়া শেষে সবাই বেরিয়েও গেল। শুধু তীব্র রয়ে গেল।
‘‘তুমি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাও। আমার আজকের মতো কাজ শেষ।দেখা হবে আবার,আপাততো আল্লাহ হাফেজ। ’’
কথা শেষ দিয়ে তীব্র বিয়ের কাগজটা ওর সুটকেসের ভেতর ভরে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মিশান সোফাতেই বসে রইল পাথর হয়ে।
নিজের সাথে কি হলো নিজেও বুঝতে পারছে না।
চুপচাপ চোখে পানি ফেলতে ফেলতে রাতের শেষে ভোরের একটু আগ দিয়ে সোফাতেই ঘুমিয়ে যায়।
অনেক বেলা হওয়ার পর মিশানের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠার পর একটা ব্যাপার আজব লাগলো, বেশ গভীর ঘুম দেয়া সত্ত্বেও আজ কোনো দুঃস্বপ্ন দেখলো না। এদিক ওদিক তাকিয়ে থেকে দেখে মনে পড়ে গেলো রাতের ঘটনা গুলো স্বাভাবিক নিয়মে সব স্মৃতির মতো এটাও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মিশান
কোনোভাবেই এই টপিক মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। যেকোনো বিষয় ইচ্ছে করে ভুলে যাওয়ার প্রবল ক্ষমতাধারী মিশান আজ ব্যর্থ হচ্ছে একটা রাতের ছোট্টো অংশ ভুলে যেতে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে রাতে রুমের বিভিন্ন জায়গায় তীব্রর কিছু কাপড় ছিল আর ওর সুটকেস টা ছিল, এখন সেগুলোর কিচ্ছুই দেখতে পাচ্ছে না। রুমে কোথাও তীব্রর কোনো জিনিস নেই।
মিশান অনেকটা অবাক হয়ে গেল। সোফা থেকে পা নামিয়ে এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে ভাল মতো তাকাতাকি করে। তীব্রও নেই। পকেটে থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখতে গিয়ে দেখে ১১ টা বাজে। যেটা দেখে মিশান উত্তেজিত হয়ে যায়।
বারোটার মধ্যে টিমের সবাইকে রেডি রাখতে হবে মিশনে যাওয়ার জন্য।
আর এক সেকেন্ড লেট না করে মিশান উঠেই রুম থেকে বেরিয়ে দৌড়।
অনেকে ওর দৌড় দেখে বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
একটা গাড়ী ধরে সোজা ক্যাম্পে চলে গেল, গিয়ে দেখে সবাই প্রায় রেডি, মিশান তোড়জোড় করে রেডি হতে হতে কাঁটাই কাঁটাই ১২ টা বেজে যায়।
কুয়েতের আরেকজন বন্ধু ছিলো মিশানের, যার সাথে থাকতে থাকতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়, নাম আছিয়া।
সবার সামনে লাইনে দাঁড়াতে যাবে তখন
আছিয়া মিশানকে একটা স্যান্ডউইচ আর একটা পানির বোতল এগিয়ে দেয়।
মিশান সেটা খেতে খেতে দাঁড়িয়ে পড়ে।
সময় যাচ্ছিল তো যাচ্ছিল, বিস্বাদ বিষণ্ণতার মধ্য দিয়ে।
বিয়ের রাতের পর তীব্রর দেখা মিলে নি আর। একটা খোঁজও নেয় নি মিশানের।
মিশান বুঝতে পারছিলো না সেদিন যা হয়েছে সেগুলো আদৌও ঘটেছিলো নাকি অতিরিক্ত নেশার ফলে সৃষ্ট মস্তিষ্কের বিভ্রম। যদি বিভ্রম ই হয়, তাহলে হোটেলে কি করে গেল, নিজেকে হোটেলের রুমেই বা কেনো আবিষ্কার করল।
কথাটা না কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে, নাতো নিজের মাথায় নিতে পারছে,
মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে মিশানের।
মাস তিনেক পর ছয় মাসের অন্তর
একমাসের ছুটি পায়। সবার সাথে দেশে ফেরা হলো, বাড়ির প্রত্যেকেই অনেক খুশি মিশানকে কাছে পেয়ে। নিশান তো মিশানকে সব সময় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।
কিন্তু এবার মিশান যেনো কেমন উদাসীন উদাসীন ছিল। ওর চেহারাতে একটা বিষন্ন ছাপ, নির্লিপ্ততা ঘিরে বসেছে। ঠিক আগের মতো খেতে পারে না বেশি, একটুতেই পেট ভরে যায়।
মিশানকে দেখে নিশান বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে ওর জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না এই বিষয়ে। মিশান প্রকাশ করে না কিছুই। দ্বীপও ভালো মতো বুঝতে পারে মিশানের কিছু একটা হয়েছে।
মামা মামী মিশানের শুকিয়ে যাওয়া এভাবে কম খাওয়ার কারণ হিসেবে ধরে নেয় হয়তো সেখানে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, সময়ের খাওয়া সময় মতো খেতে পারে না বলেই খাওয়াতে অরুচি ভর করেছে।
এই তিনমাসে তীব্র কোনো যোগাযোগ করে নি মিশানের সাথে। দেশে আসার পর পর তীব্র মিশানের বাংলাদেশি নাম্বারে কল দেয়, মিশান অবাক হয় এই নাম্বার কি করে পেলো তীব্র। কথার মাঝে তীব্র মিশানকে জানায় সাতদিন পর দেখা করবে ওর সাথে, জায়গার নাম ও সময় দুটোই বলে দিলো।
রাত হলে কেমন যেনো ভেতরটা ছটফট করে। কারণ টা হয়তো দেশে এসে নেশা করতে না পারার জন্য। মিশান মাঝ রাতে নিশানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, সেই সময় দ্বীপ নিজের ঘরে ল্যাপটপে কাজ করছিল, বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে গেলো এরকম শব্দ পেয়ে দ্বীপ মিশানের পিছু নেয়।
যেতে যেতে মিশান বারে গিয়ে ড্রিঙ্ক করা শুরু করে, এই দৃশ্য দেখে দ্বীপ পুরো বরফ হয়ে যায়, মিশান ড্রিঙ্ক করে এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে পারে না। দ্বীপ সাথে সাথে মিশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিশান মাথা উঁচু করে দ্বীপকে দেখে কোনো পরোয়া না করে নিজের কাজে মন দিলো। দ্বীপ নিরাশ হয়ে বসে পড়লো মিশানের সামনে,
‘‘মিশান! একি হাল তোর? এসব কবে থেকে খাস? কি লাভ হয় খেয়ে?’’
মিশান নিরুত্তর,
‘‘মিশান প্লিজ বল, কেনো এমন করছিস?তুই আর মদ! এই দিন দেখতে বেঁচেছিলাম? মিশান বোন আমার, প্লিজ বল কি হয়েছে তোর? কোন কারণে তুই এসব খাস? তোর চেহারা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো, এরকম কিছু একটা ব্যাপার আছে, তবুও নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম আর যাই হোক তুই এই সবের কাছে আসবি না।’’
মিশান তুচ্ছ হাসি দিয়ে বলল,
‘‘আমার জন্মটাই একটা কুফা! শুধু হারাতে এসেছি পৃথিবীতে। একে একে সব হারিয়ে যাচ্ছি। বাবা-মা, এরা আদৌ আছে কি নেই, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেও পাচ্ছি না। শুধু এইটুকুই মনে পড়ে, এক নারীকন্ঠী বলেছিল ‘Mishan beta tum zara apna akh bandh karlo, maine avi atyho.Tabtak apna behen ko sambalke rakh na.’
সেই দিন থেকে চোখ বন্ধ করে যখনি চোখ খুলে তাকাচ্ছি
প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে হারিয়ে যাচ্ছি একজন একজন করে। ’’
‘‘মিশান শান্ত হ বোন, তাই বলে এভাবে এলকোহল!’’
‘‘জীবনে আর আছে কি, নিশান চলে গেলে আমার বাঁচার স্বাদও চলে যাবে, তাই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
‘‘সত্যি করে বল মিশান কি হয়েছে তোর?
নিশানের কন্ডিশন অতোটাও খারাপ হয় নি যার জন্য তুই নেশা করে কষ্ট বুলাবি। বল কি হয়েছে তোর?’’
মিশান চুপ করে রইল। দ্বীপ বেশ কিছুক্ষণ ভরে জিজ্ঞেস করার পর মিশান কেঁদে দিলো, ওর কান্না দেখে দ্বীপ আরো উদ্বেগ হয়ে পড়লো,
মিশান কাঁদছে তো কাঁদছেই কিছু আর বলছে না।

(চলবে)