তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-১৮

0
16

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ১৮
লেখিকা- রিয়া খান

কম্বল মুড়িয়ে সোফাতে ঘুমাচ্ছে মিশান, বেলা ১২ টা বেজে গেছে, তীব্র বাইরে থেকে কাজ শেষ দিয়ে গেস্ট হাউজে ফিরে দেখে মিশান এখনো ঘুমাচ্ছে। ও যে কাজে এখানে এসেছিলো সে কাজ টা হয়ে গেছে যার জন্য ঢাকায় ফিরে যাবে এখন। মিশানের মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে চেহারা দেখে বুঝতে পারলো বেশ লম্বা ঘুম ই দিয়েছে।
হাতে জলন্ত সিগারেট ছিলো, মাথায় কুবুদ্ধি আঁটতেই মিশানের ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট ঢুকিয়ে দিলো, ঘুমের মাঝে নিশ্বাস নেয়ার সময় সিগারেটে টান লেগে ধোঁয়া ঢুকে যায় মিশানের গলায়, ঘুম ভেঙে গিয়ে উঠে বসে অনবরত কাশতে থাকে। তীব্র ইচ্ছে করে এমন করেছে সেটা বুঝতে পারলো, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মিশান বলে উঠল,
‘‘মানুষের মধ্যে সামান্য মনুষ্যত্ববোধ থাকে, আপনার মধ্যে ছিটেফোঁটাও নেই তার। অমানুষ কোথাকার!’’
‘‘ঘুম থেকে উঠেই কি আমার মারের পুজো করতে চাস? দেবো?’’
মিশান চোখ গরম করে তাকালো।
‘‘যাহ ফ্রেশ হয়ে আয় আমার কাজ শেষ ঢাকায় ফিরতে হবে।’’
‘‘কাজ শেষ চলে যান আমার জন্য অপেক্ষা করছেন কেনো? ঘুম ভাঙলে আমিও চলে যেতাম।’’
‘‘একসাথে গেলে কি সমস্যা আছে?’’
‘‘আমার কোনোকিছুতেই কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা যতো আপনার।’’
‘‘ফ্রেশ হয়ে আসো, ওয়াশরুমে নিমের ডাল আছে তোমার জন্য, ওটা দিয়ে ব্রাশ করে নাও।’’
মিশান কম্বলের নিচে থেকে বেরিয়ে
গায়ের জ্যাকেট টা খুলে সোফার উপর রেখে দিয়ে, ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
তীব্র নিজের কিছু জিনিস গুছিয়ে নিল।
মিশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রেডি হলো।
‘‘স্যার আমার সানগ্লাস টা ভেঙে গেছে কিভাবে জানি না।’’
তীব্র টিজ মেরে বলল,
‘‘তুমি ঠিক আছো তো?’’
মিশান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো,
‘‘আমার টা নাও, ঢাকায় গিয়ে ফেরত দিয়ে দেবে।’’
মিশান বিড়বিড় করে বলল,
‘‘হাড়কিপ্টে কোথাকার!’’
‘‘কিছু বললে?’’
‘‘আপনার এমন অসীম আত্মত্যাগে আমি ধন্য স্যার।’’
‘‘চলো।’’
মাথায় ক্যাপ পড়তে পড়তে মিশান বেরিয়ে পড়লো, তীব্রও বেরিয়ে গেল।
বাইরে ফরেস্ট অফিসার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
মিশান পেছনে বসলো, ফরেস্ট অফিসার ড্রাইভ করছিলো, তীব্র তাঁর পাশে বসেছিলো।
‘‘স্যার ম্যাডামকে নিয়ে এসেছিলেন যখন দুটো দিন থেকে ঘুরে যেতেন।’’
‘‘ঘুরার অনেক সময় আছে, এখন না।আর উনি ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র, সোলমেট না।’’
‘‘ওহ সরি স্যার! মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে।’’
‘‘হতেই পারে আসার সময় এক্কা যাওয়ার সময় দুক্কা, প্রশ্ন জাগতেই পারে মনে। আসলে ওর সাথে রাতে দেখা হয়েছিল তাই বললাম হোটেল তো এখান থেকে দূরে, রাত হয়েছে বেশ, আমার সাথে এখানে থেকে যেতে।’’
‘‘তা স্যার ওদিকের কি অবস্থা দেখলেন?
আগের গুলো থেকে তো কোনো তথ্য বের করা গেল না।’’
‘‘নেক্সট উইকে বান্দরবন যাবো, তারপর দেখছি ব্যাপারটা।’’
‘‘আমি কি বনবিভাগে জানিয়ে রাখব স্যার?’’
‘‘নাহ দরকার নেই।’’
‘‘ওকে স্যার।’’
এয়ারপোর্টে এসে দুজনে নেমে গেল, ফরেস্ট অফিসার বিদায় নিল।
‘‘স্যার খিদে পেয়েছে অনেক। আপনিতো সকালে পেট পুজো করে নিয়েছেন।’’
‘‘এয়ারপোর্টের রেস্টুরেন্টে চলো, আমিও খাইনি এখনো। সকালে উঠেই কাজে চলে গিয়েছিলাম।’’
দুজনে রেস্টুরেন্টের ভেতর গেল, একটা খালি টেবিলের কাছে গিয়ে তীব্র সৌজন্যতা দেখিয়ে চেয়ার টান দিয়ে মিশানকে বসতে বলল।
মিশান পেছন ঘুরেও দেখল না, চেয়ার নিজের দিকে টান না দিয়েই বসতে গিয়ে ধপাস করে নিচে পড়ে যায়, মিশানের পড়ে যাওয়া দেখে তীব্র বেক্কল হয়ে গেল।
মিশান ঠোঁট উল্টে তীব্রর দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
‘‘এটা আপনার ম্যারিজ এনিভার্সারি গিফট ছিল তাই না? সব সময় ফাজলামো ভালো লাগে না স্যার।’’
‘‘আরে আমি কি করলাম? তুমি দেখে বসবে না? চেয়ার টেনে দিয়েছি বলে এগিয়েও দিতে হবে?’’
তীব্র মিশানের হাত ধরে উঠাল।
‘‘আপনি ইচ্ছে করে আমায় ফেলে দিয়েছেন! সব সময় আমার বেইজ্জতি করেন পাব্লিক প্লেসে। আজকে এরকম জায়গায় আপনি বাড়াবাড়ি না করলেও পারতেন।’’
তীব্র মিশানের কাঁধে আলতো ভাবে হাত রাখতে রাখতে বলল,
‘‘মিশান তুমি ভুল বুঝছো, আমার এরকম কোনো ইচ্ছা ছিল না।আমি বুঝতে পারি নি চেয়ার টেনে দিলে এগিয়েও দিতে হয়।
মাথা ঠান্ডা করো।
তোমার খিদে পেয়েছে অনেক, বসে খাও।’’
মিশান কাঁধে থেকে তীব্রর হাত সরিয়ে বলল,
‘‘না আমি খাবোনা এখানে,বাইরের ফুটপাতের খাবার খাবো। আর আপনার সাথে যাবোও না।’’
এটা বলেই মিশান উল্টো হাঁটা, তীব্র মিশানের পেছনে ছুটে গিয়ে ওর হাতের ডানা ধরল।
‘‘আরে মিশান তুমি ভুল বুঝছো খামোখা, আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আচ্ছা আমি আমার এই কাজে অনুতপ্ত, দয়া করে আসো সিনক্রিয়েট করো না, আশেপাশে কত মানুষ তাকিয়ে আছে।’’
‘‘এর শোধ আমি নেবো স্যার।’’
‘‘ঠিক আছে নিও, আমি পারমিশন দিলাম। এখন আসো খাই, প্লেন চলে গেলে খাবে? নাকি প্লেনের ভেতর যে খেতে দেয় সেটার জন্য অপেক্ষা করছো?
আসো খাবে।’’
মিশান ঝাঁকি দিয়ে তীব্রর হাত গায়ে থেকে ছাড়িয়ে বলে,
‘‘আপনি ঘুরে ফিরে কেনো এই হাতের ডানাতে ধরেন? কত ব্যাথা এইখানে জানেন?’’
‘‘ওরে আমার মা রে, মাফ কর, আইসা খা।’’
মিশানকে বলে কয়ে শান্ত করে নিয়ে খেতে বসলো।
বরাবরের মতোই মিশানের প্রচণ্ড খিদে পেলেও খুব একটা খেতে পারে না। বেশ ভালো রকম খাবার ই অর্ডার করা হয়েছিল, তীব্র চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, মিশান একটু খেয়েই হাঁপিয়ে গেছে।
ঘুরে ফিরে তীব্র মিশানের উপকার করলেও ওদের সম্পর্ক দা আর মাছ।এরকম হওয়ার কারণ আছে।
তীব্র স্বভাবগতই তেঁতো টাইপের, ও ভালো কথা বললেও মনে হয় ঝগড়া করার চেষ্টা করছে, তার উপর একরোখা ত্যাড়ামো স্বভাব তো আছেই, নিজে বেয়াদবি করবে, অথচ ওর সাথে অন্য কেউ বেয়াদবি করলে সেটা মানতে পারে না।
মুখে মধু লাগিয়ে কথা বলা তীব্রর ক্যারেকটারে লিখা নেই, আর কেউ ওর সামনে সাধু সাজবে এ রকমটাও তীব্রর কাছে খুবই বিরক্ত লাগে।
আর এদিকে মিশান, পুরোটা তীব্রর মতো না হলেও বেশ কিছু জায়গায় তীব্রর মতো। যেমন ঘাড় ত্যাড়ামো, তাতলামো , একটুতেই রেগে যাওয়া। কিন্তু গলে যেতেও টাইম লাগে না, তীব্র মিশানকে ভালো কথা বলেই হোক আর ধমক দিয়েই হোক শান্ত করতে টাইম লাগে না। মিশানের সাথে কেবল তীব্রই পারে।
মাঝে মাঝে তীব্রর কিছু কথাতে মিশান অমত প্রকাশের সাথে বেশ তাতলামো করে, যেটা তীব্রর একদম ই পছন্দ না, আর এই কারণেই মিশানকে অপমান করে বসে, আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মিশানকে ছোটো খাটো বিপদে ফেলে দেয়, এতে মিশান রেগে গিয়ে তীব্রকে মারতে চায়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে তীব্রকে মারার, কিন্তু তীব্রকে মারা তো এতো সহজ না। এখানে দুজন দুজনের উপর দিয়ে। মিশানকে বিপদে ফেলে তীব্র কি মজা পায়, সে উত্তর অজানা।
নিজের কাজ দশটা করিয়ে মিশানের কাজ একটা সফল হয়, এটাতে মিশান দ্বীমত প্রকাশ করে। এতো গুলো মানুষ মেরে মিশান মাঝে মাঝে তীব্রকে সন্দেহ করে, কোনো ভাবে তো ও কোনো নিরপরাধ মানুষকে মারছে না?
ওদের ক্রাইম কি সেটা তীব্র কখনো মিশানকে জানায় না।শুধু নাম, এড্রেস আর ছবি দিয়ে দেয় তাকে মারার জন্য।
তীব্রর প্রতিটা কথায় রহস্য ঢুকিয়ে দেয়ার স্বভাব টা খুবই বিরক্ত লাগে মিশানের কাছে। এমনিতেই মিশানের স্বভাব খিটখিটে তার উপর সব সময় তীব্রর নানা রকম ব্ল্যাকমেইল, প্যারা সহ্য করতে হয় দাঁতে কামড় দিয়ে।
‘‘তোমার হাতের ব্যাথাটা কি একটুও কমে নি?’’
‘‘কমবে কি করে, আপনি তো বেঁচে আছেন। আপনি মরলেই আমার হাত ব্যাথা কেনো জীবনের সব ব্যাথা দূর হয়ে যাবে।’’
‘‘এতো খেপা ধরে আছো কেনো? এই বিপদ টাই আমি তোমাকে ফেলতে চাই নি। বাধ্য হয়ে এমন করতে হয়েছে, আমি রাতের পর রাত চিন্তা করেছি কোনো ভাবে এই ব্যাপার টা পাশ কাটিয়ে উঠা যায় কিনা। কিন্তু সব এংগেল থেকে প্রশ্ন ঘুরে দাঁড়ায়। আমি যদি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ফাঁসাতে যেতাম তাহলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তো। একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়ে যেতো যে আমি একজনের অপরাধ অন্যজনের কাঁধে দিয়েছি, এতে আমি ফেঁসে যেতাম সাথে তুমিও ফেঁসে যেতে।
এমনকি কেসটাও আমি নিতে চাই নি, এই কেসটা যেনো নিতে না হয় তার জন্য আমি আমার পোস্টিংয়ের জন্য এপ্লিকেশন করি আগে। পারমিশন লেটার পেয়েও কোনো লাভ হলো না।
তবুও আমাকে টার্গেট করা হলো কেসটা নেয়ার জন্য।
আমি আমার সিনিয়রদের সাথে যতোই তাতলামো করিনা কেনো, দিন শেষে আমি তাদের কাছে ধরা-বাঁধা।
রাতের পর রাত চিন্তা করেছি কিভাবে কেসটা সলভ করা যায়, কিভাবে ঘুরালে এরা তোমাকে পেয়েও হারাবে। একটা প্ল্যান বাস্তবায়নের থেকে সেই প্ল্যান টা তৈরী সব থেকে বেশি কঠিন জানো সেটা?
খামোখা ভুল বুঝে রাগ পোষে রাখছ।’’
‘‘আমি কি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি এতো এক্সপ্লেইনেশন?
যা করেছেন, তা তো হয়েই গেছে। থামুন না এবার, একটু বিরতি দিন।’’
তীব্র লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্লেনের জানালার বাইরের দৃশ্যে দৃষ্টি ফেলল।
মিশান শরীর ছেড়ে আয়েশ করে বসে রইল। ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু একটু ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতেই দুঃস্বপ্ন চোখে কাঁটা দিয়ে উঠে।
ঘুম না আসার জন্য গান শুনতে গেল, কিন্তু বিরক্ত লাগছে গান শুনতে, ফোন টিপতেও বিরক্ত লাগছে, তীব্রর সাথে যে একটু কথা বলবে তাও বিরক্ত লাগছে।
তীব্রর সাথে কথা বলা মানেই, বিনা কারণে মাথা গরম করা। তীব্রর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা প্রয়োজন ছাড়া মিশানের সাথে কথা বলার কোনো প্রকার ইন্টারেস্ট ওর মধ্যে নেই।
এয়ারপোর্টে আব্দুর রহমান অপেক্ষা করছিল গাড়ি নিয়ে, তীব্র পৌঁছাতেই গাড়িতে উঠল।
মিশানকে উঠতে বললে মিশান বলল অন্য গাড়ি করে যাবে তীব্র চোখ গরম করে তাকাতেই মিশান উঠে বসল ।
আব্দুর রহমান দাঁত কেলিয়ে তীব্রর উদ্দেশ্যে বলল,
‘‘স্যার বিবাহ বার্ষিকীর শুভ শুভেচ্ছা।’’
‘‘কাল রাতে আমার বিবাহ বার্ষিকীর উপহার হিসেবে আমার মৃত্যু পাঠিয়েছিলে?’’
‘‘কি বলছেন স্যার, মৃত্যু কেনো হবে?
ম্যাডাম বলল আপনি কোথায় আমি শুধু বলেছি আপনি চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, বর্ডারের ওখানে কাজ আছে।’’
‘‘আমি কি একটা বারও ম্যাডামকে মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে বলেছি? দেখলে মিশান তোমার চামচা তোমার বিরুদ্ধে কতবড় কথা বলেছে।’’
‘‘স্যার আপনার কথার ধরণে আমরা বুঝতে পারি। যারা আপনার কথায় বিব্রত হয়, তাদের বিব্রত করুন।’’
‘‘তুমি একটা আস্ত বেয়াদব, কোথায় কোন কথা বলতে হয় সেই জ্ঞানও তোমার মধ্যে নেই। মুখ বন্ধ রাখো না হলে খবর আছে।’’
‘‘সরি স্যার!’’
স্যার আপনার নতুন বডিগার্ড এসেছে। সকালে আমাকে কল দিয়েছিল, মনে হয় অফিস থেকেই আমার নাম্বারটা দিয়েছে।
‘‘ভালো।’’
তীব্র সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল। এমন সময় ফোন বেজে উঠল,
আননোওন নাম্বার থেকে কল এসেছে। তীব্র রিসিভ করে ফোন কানে নিল,
‘‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।’’
‘‘ওয়ালাইকুম আসসালাম তীব্র, আমি দীপ্তি।’’
‘‘হুম বলো,’’
‘‘তুমি কি ফিরেছো?’’
‘‘হ্যাঁ মাত্র ফিরলাম, কেনো কি হয়েছে?’’
‘‘আজকে কি কোনো ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে?’’
‘‘আরে তুমি বলো না, কোনো প্রয়োজন কিনা?’’
‘‘না মানে কোনো কাজ যদি না থাকে তাহলে দেখা করতে পারবে?’’
‘‘আমি এক ঘন্টা পরে কল দিচ্ছি তোমায়।’’
‘‘ওকে।’’
‘‘হুম রাখছি এখন।’’
ফোন রেখে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মিশানের দিকে তাকালো, মিশান চুপচাপ ফোনে ফেসবুক চালানোতে মন দিয়েছে।এতোক্ষণ তীব্রর দিকে কোনো হেলদুল নেই ওর।
‘‘স্যার আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।’’
‘‘এটা কোথায়?’’
‘‘এখানে নামিয়ে দিন কাজ আছে।’’
‘‘বাড়ির সামনে যাবে গাড়ি।’’
‘‘স্যার প্লিজ!’’
‘‘রহমান গাড়ি থামাও।’’
রহমান গাড়ি থামাতেই মিশান সানগ্লাস খুলে তীব্রর দিকে দিলো।
‘‘স্যার আপনার সানগ্লাস। মাথায় ক্যাপ আছে চোখ নাক অর্ধেক ঢাকা পড়েই থাকে ক্যাপের নিচে। সমস্যা হবে না।’’
তীব্র সানগ্লাস হাত নিল। গাড়ি থেকে মিশান বেরিয়ে যেতেই আবার তীব্রর দিকে তাকালো,
‘‘স্যার!’’
‘‘বলো।’’
‘‘কিছু টাকার দরকার ছিল।’’
‘‘কত?’’
‘‘হাজার দশেক হলেই চলবে।’’
তীব্র পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে কয়েকটা হাজার টাকার নোট বের করলো, সব গুলো নোট গণনা করার পর একটা এক হাজার টাকার নোট বাম হাতে উঠিয়ে মিশানের দিকে বাড়িয়ে দিলো,
‘‘স্যার এটা এক হাজার টাকা।’’
‘‘টাকা নেই আমার কাছে, আপাততো এটা রাখো, বাকি টাকা পরে দেবো।’’
‘‘মানি ব্যাগে এতোগুলো টাকা আর বলছেন টাকা নেই!’’
‘‘এগুলো রাতে লাগবে, দেয়া যাবে না এখন।’’
মিশান অসহায়ের মতো এক হাজার টাকাটাই নিল। যাহা পাবে হাতে, তাহাই যাবে সাথে।
টাকাটা দিয়েই তীব্র ওর মতো চলে গেল।
মিশান ওর নিজের মতোই হাঁটতে লাগল।
গাড়িটা এখানে থামিয়েছে কারণ রাস্তায় ও তমালকে দেখতে পেয়েছিল। তীব্রর গাড়ি চলে যাওয়ার পর মিশান দৌড়ে গিয়ে তমালের পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো। তমাল ছিটকে গিয়ে পাশ ফিরে দেখে এটা মিশান, মিশান তমালের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে দেয়।
‘‘হেই ব্রো, কেমন আছো?’’
‘‘তুমি কোথা থেকে অবতরণ হলে?’’
‘‘মন খারাপ কেনো? বন্ধু মরে গেছে বলে?’’
‘‘কাটা ঘাঁ তে নুনেরছিটে দিও না তো।’’
‘‘সামান্য বন্ধুর জন্য তোমার এতো মন খারাপ? আর ভাবো আমার কি অবস্থা?’’
‘‘তোমার কি হয়েছে?’’
‘‘তোমার অই বন্ধু আমার একমাত্র বোনকে মেরেছে, তাও টাকার লোভে।’’
‘‘কি বলছো! জোবায়ের অনেক ভালো ছেলে।’’
‘‘আমার বোনও ওকে ভালোই মনে করেছিল, বিশ্বাস করে নিজের বন্ধুও বানিয়েছিল, কিন্তু তোমার অই বন্ধু আমার বোনটাকে মারতে সাহায্য করেছে।
তাই আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।’’
‘‘কি করেছে ও?’’
‘‘নিশানকে চেনো?’’
তমাল খানিকটা চিন্তিতো স্বরে উত্তর দিলো,
‘‘নিশান?’’
‘‘নাম শুনেছো হয়তো।’’
‘‘নাম না শুধু, ছবিও হয়তো দেখেছি।’’
‘‘চোখ টা আমার মতো।’’
তমাল মিশানের চোখের দিকে তাকালো,
‘‘হ্যাঁ এরকম হাল্কা নীলচে ছিল, শুনেছিলাম ওর নাকি একটা রোগ ছিল, প্রতি মাসে ব্ল্যাড চেঞ্জ করতে হতো। জোবায়ের বলেছিল, ও সেই রোগে মারা গেছে।’’
‘‘ওর রোগ ছিল কিন্তু, রোগে মারা যায় নি। ওকে মারা হয়েছে।’’
‘‘কিভাবে?’’
মিশান তমালকে সবটা খুলে বলল, সেদিনের ঘটনা।
নিশান থানায় যাওয়ার সময় ওর সাথে জোবায়ের ই গিয়েছিলো। আর নিশানের খোঁজ জোবায়েরই দিয়েছিল ছেলেগুলোকে। যে স্থানে ওকে মারা হয় অই জায়গাটার খোঁজ জোবায়ের ই দিয়েছিল।
অনেক সুন্দর ও আকর্ষিত উপমা দিয়ে
জোবায়ের অই স্থানটার সম্পর্কিত উপস্থাপন করেছিল নিশানের সামনে। যার জন্য নিশানের মনে ইচ্ছে জাগে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার। জোবায়েরের ফাঁদে পা দিয়ে নিশান দ্বীপকে নিয়ে সেই ফাঁদ পাতানো জায়গায় যায় যেখানে সুন্দর দৃশ্য ও মনোরম পরিবেশের সাথে মৃত্যুটাও ছিল!
মিশানের কথা শুনে তমালের মন গলে গেল। ছেলেটা যতোটা বোকা ততোটাই ভালো মনের। মিশানের কষ্টটা বুঝতে পারলো স্পষ্ট। এই মুহুর্তে মনে হলো জোবায়েরকে মেরে ভালো করেছে।
‘‘আচ্ছা মিশান তাহলে আমি পুলিশ কেস কেনো খেলাম না? আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিলো, তুমি যা যা বলতে বলেছিলে আমি তাই ই বলেছি।তারপর ওরা আমায় চলে যেতে বলল, কেউ একটু সন্দেহও করল না।’’
‘‘সন্দেহ কি করে করবে বলো? বারের অপজিটে যে সিসি ক্যামেরা ছিল জানো?’’
‘‘না তো!’’
‘‘বাইরে বের হওয়ার পর তোমাকে আমার বাইক নিয়ে বাম দিকে পাঠিয়ে দেই, আর জোবায়েরকে ওর বাইক নিয়ে ডান দিকে পাঠিয়ে দেই, আর আমি বারের ভেতর ঢুকে যাই। অই বার থেকে ডান পাশের রোডে এক কিলোমিটার দূরে আরেকটা সিসি ক্যামেরা আছে, সেখানেও দেখা গেছে জোবায়ের একা একা বাইক চালিয়ে কোথাও যাচ্ছে।
আর আমি বারের পেছনের গেট দিয়ে অন্য রোডের উপর দিয়ে শর্টকাটে গিয়ে দাঁড়াই, আর সেখানে জোবায়ের এসে আমায় পিক করে, আমি ওর সাথে চলে যাই। জায়গামতো গিয়ে মেরে ফেলে দেই। আর তোমাকে আমি বাইকটা যেখানে রাখতে বলেছিলাম সেখানেও সিসি ক্যামেরা আছে, যে টাইমে তুমি ওখানে পৌঁছাও সেই সময়ে জোবায়ের মৃত্যুর কোলে ঘুমায়!’’
‘‘বাবারে এটাতো হরর মুভি বানিয়ে দিয়েছ। আল্লাহ গো কি প্ল্যান! আচ্ছা আমি তো জোবায়েরের ফ্রেন্ড তাহলে তুমি আমাকেও তো ফাঁসাতে পারতে, ছেড়ে দিলে কেনো?’’
‘‘কারণ তুমি গুড বয়, কারো ক্ষতি করো না। তুমি যে পুলিশের সামনে মুখ খুলবে না সেটাও আমি জানতাম। আর মুখ খুললেও তোমাকে ফাঁসাতে আমার ওয়ান টু সেকেন্ডও লাগবে না।’’
‘‘আজ সকালেও ভাবছিলাম থানায় গিয়ে পুলিশকে সবটা খুলে বলে আসি, কিন্তু তোমার ট্রাজেডি স্টোরি শুনে মনে হলো, জোবায়েরের এই শাস্তিই প্রাপ্য ছিল।’’
‘‘চলো তোমার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ট্রিট দেই।’’
‘‘আমার টিউশনির বেতন টা এখনো পাইনি, কয়দিন পরে যাই?’’
‘‘আরে তোমার বেতন দিয়ে আমি কি করবো। ট্রিট আমার পক্ষ থেকে।’’
‘‘তুমি খাওয়াবে?’’
‘‘হুম।’’
‘‘কি খাওয়াবে?’’
‘‘এক হাজার টাকার মধ্যে যা খাবে তাই, এক হাজার টাকার উপর গেলে জরিমানা তুমি দেবে।’’
‘‘আমি কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন টিক্কা আর কোকাকোলা খাবো।’’
‘‘ওকে ব্রো ডান!’’
তমালকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ানো শেষে
মিশান বাড়ির দিকে গেল। বাড়ির সামনে থেকে একটা দশ টাকার প্রাণ জুস কিনে খেতে খেতে ভেতরে ঢুকলো।
কাজের লোক দরজা খুলে দিতেই মিশান ভেতরে ঢুকতে নিয়েও বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। চিন্তা করলো ভেতরে যা দেখলো তা সত্যি নাকি মিথ্যা।
ড্রয়িংরুমে তাপসিনের বড় খালা, অনেকটাই বয়ষ্ক।
মিশান আবার এদিকে ঘুরে দেখে মামীর বড় বোন ওর দিকে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে।
‘‘আসসালামু আলাইকুম খালামণি। কেমন আছেন?’’
‘‘ওয়ালাইকুম আসসালাম মিশান, তোমার বিয়ে এবার না খেয়ে যাচ্ছিই না। বিয়ে খাওয়ার পর ই বলব কেমন আছি।’’
মিশান ফরমাল একটা হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘‘খালামণি বসেন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’’
‘‘আচ্ছা যাও।’’
মিশান নিজের ঘরে না গিয়ে মামীকে খুঁজা শুরু করল, বুয়ার থেকে জানে রান্নাঘরে আছে।
মিশান রান্নাঘরেই যায়। রান্নাঘরে রান্না করছে, আরেক জন কাজের লোক সাহায্য করছে। মিশান পেছন থেকে ডাক দিলো।
‘‘মিমি!’’
মামী পেছনে ঘুরে মিশানকে দেখে অনেক খুশি হয়ে গেলো, রান্না ছেড়ে মিশানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘‘মা তুই এসেছিস! আজ আসবি, বলে আসবি না? কতদিন ভালোমন্দ খায় নি আমার সোনাটা! আগে থেকে বললে তোর পছন্দের খাবার রান্না করে রাখতাম।’’
‘‘মিমি! তোমার হাতের রান্নাই আমার পছন্দ। যা রান্না করবে তাই ই আমি চেটেপুটে খেয়ে নেবো, এটা নিয়ে এতো আফসোসের কিছু নেই।’’
মামী মিশানের গালে হাত দিয়ে বলল,
‘‘আমার সোনা মা টা! চেহারাটা শুকিয়ে গেছে, এমন মলিন দেখাচ্ছে কেনো মা?’’
‘‘তোমার বোন কবে চলে যাবে?’’
‘‘কাল ই তো এলো, কবে যাবে কি করে বলব বল তো?’’
‘‘শয়তান নিজে আসলেই পারতো, উনাকে কষ্ট করে পাঠানোর কি ছিল!’’
মামী আদুরে কন্ঠে বলে,
‘‘এরকম করে বলে না মা, আত্মীয় হয়।
হাজার হলেও আমাদের গুরুজন।’’
‘‘গুরুজন গুরুজনের মতো থাকবে, হাতে তসবি তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা না হয়ে তিরুজন স্বভাব কেনো?’’
‘‘তিরুজন সেটা আবার কি?’’
‘‘অই তো হবে একটা কিছু, বেস্বভাবের মানুষকে তিরুজন বলে, যারা নিজেদের ঘরের থেকে পরের ঘর নিয়ে বেশি সহানুভূতি ও দুশ্চিন্তায় থাকে।’’
‘‘কি করল আবার?’’
‘‘জানো, আমি বাড়িতে ঢুকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম খালামণি কেমন আছেন?’’
সে আমাকে উত্তরে বলল, মিশান তোমার বিয়ে খেতে এসেছি, এবার আর তোমার বিয়ে না খেয়ে যাবোই না।
এটা কোনো কথা মিমি? তুমিই বলো।
‘‘মুরুব্বী তো একটু শখ জেগেছে হয়তো মনে।’’
‘‘একটু না মিমি অনেকটাই, আমার এসএসসির পর থেকে উনি আমার বিয়ে খাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। দেখো আমার বিয়েতে সবাই দাওয়াত পাবে কিন্তু একে আমি দাওয়াত দেবো না।’’
মামী খলখল করে হেসে দিয়ে বলল,
‘‘পাগল মেয়ে আমার। যা ফ্রেশ হয়ে আয়, আমার রান্না হলেই খেতে বসে পড়বি।’’
মিশান রান্নাঘর ছেড়ে নিজের ঘরে গেল, কিসের ফ্রেশ কিসের কি অমনিই বিছানায় গা ছেড়ে দিলো।
রাত আটটার দিকে মিশান তাপসিনের ঘরে বসে বসে ফোন টিপছিলো, তাপসিন পড়ার টেবিলে বই খাতায় মগ্ন।
‘‘তাপসিন’’
‘‘বলো আপি।’’
‘‘৩০ মিনিটের রাস্তার মধ্যে ভালো পিজ্জা কোথায় পাওয়া যাবে রে?’’
‘‘খাবে?’’
‘‘হুম, ৪০০ টাকা আছে, তোর কাছে কিছু থাকলে চল খেয়ে আসি, দ্বীপের আসতে ১১/১২ টা বাজবে।’’
‘‘আমার চেনা জানার মধ্যে একটা রেস্টুরেন্ট নতুন হয়েছে, ভেতরে যা সুন্দর দেখতে আপি। যেমন পরিবেশ তেমন তার খাবার আর কর্তৃপক্ষের ব্যবহারও খুব ভালো।’’
‘‘তাহলে ওখানে খরচ বেশি পড়বে ’’
‘‘আরে আপি না, প্রতিটা খাবারের মান হাই কোয়ালিটি, কিন্তু দাম একদন সহজলভ্য, চলো যাই। সুইমিংপুলের সাইডে আধোআধো আলোতে, রোম্যান্টিক টোনের সাথে টেন আউট অফ টেন রেটিংয়ের পিজ্জা!’’
‘‘যেভাবে বললি তাতে যাওয়া উচিৎ ওখানে। যদি এক্সপেকটেশন ভার্সেস রিয়ালিটি হয়ে যায়, তাহলে কি হবে জানিস তো?’’
‘‘আমি ১০০% গ্যারান্টি দিচ্ছি।’’
‘‘কোথায় এটা?’’
‘‘যমুনা ফিউচারের এরিয়াতেই।’’
‘‘চল তাহলে, বই খাতা রেখে বের হ।’’
মামীকে জানিয়ে তাপসিনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
দ্বীপের গাড়ি রেখে বাইক নিয়ে গেছে দ্বীপ। তাই বাধ্য হয়ে ওর গাড়ি নিয়ে বের হলো মিশান আর তাপসিন।
তাপসিনের ডিরেকশন মতো জায়গাটাতে পৌঁছাল। ভেতরে ঢুকে দেখল তাপসিন যেভাবে বলেছিল ঠিক সেরকমই, একটা সুইমিংপুলের চারপাশে বড় বড় কালারফুল টবে ফুল গাছ লাগানো, চারপাশে সবুজ রঙের আলো, আরো নানা রকম সাজসজ্জা, একটা মৃদু সুরের কান জুড়ানো গান ভেসে আসছে। চারপাশের ডেকোরেশন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মতো, বেশ সুন্দর। মিশান ইমপ্রেস হলেও একটু বিব্রত হলো, আশেপাশে সব কাপল এসেছে একমাত্র তাপসিন আর মিশান ই এখানে ভাই বোন।
এদিক ওদিক তাকাতাকি করে দেখছে চারপাশ, এমন সময় তাপসিন হাতে টুকা দিয়ে বলল,
‘‘আপি! আপি! আপি!’’
‘‘কি হয়েছে?’’
‘‘আরে তোমার বাম কাঁধ বরাবর একটা টেবিলে তীব্র ভাইয়া একা একা বসে আছে। উনি কি করে জানে, তুমি কখন কোথায় যাও?’’
‘‘কি বলছিস, এখানেও!’’
মিশান চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তীব্র একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে এক হাত দিয়ে ফোন টিপাচ্ছে আরেক হাত দিয়ে সিগারেট টানছে।
মিশান গলায় ঝুলানো ওড়না দিয়ে মাথার মধ্যে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বলল,
‘‘তোর চেয়ারটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে মুখ করে থাক যাতে দেখতে না পায় আমাদের।
শালা কবরে গেলেও পিছু ছাড়বে না!’’

(চলবে)