তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-২০

0
17

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ২০
লেখিকা- রিয়া খান

‘‘আজ যা কাবু করলে না আপি! ফার্স্ট টাইম তীব্র ভাইয়াকে তোমার কাছে বদ হতে দেখলাম! তা কত খরচ করালে মোটমাট?’’
‘‘হবে লাখ খানেকের মতো।’’
‘‘হি হি হি, এ বছর তোমার শপিং না করলেও চলবে।’’
‘‘আরে ধুর! এতোক্ষণে মনে পড়ল জুতো কেনা হলো না তো! মনে করিয়ে দিবি না একটু?’’
‘‘আমাকে কি আগে থেকে বলে রেখেছিলে? মনে করিয়ে দেবো কিভাবে।’’
‘‘লস খেয়ে গেলাম, কয়টা জুতো নিলেও আরেকটু কাবু করতে পারতাম। গোল্ডেন টাইম যাচ্ছিলো ব্রো, যা চাচ্ছিলাম তাই ই দিয়ে যাচ্ছিলো, মুখের উপর নাও করতে পারলো না।
শালাকে বিয়ে করে ভালোই হয়েছে,টাকা পয়সা শর্ট পড়ার আগেই ফিল আপ হয়ে যায়।’’
‘‘এক জন আরেকজনের প্রয়োজনে আসছো।’’
‘‘বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হবে, কয়েক সেকেন্ড গা ঘেঁষে বসেছিলাম লোকটার, মনে হচ্ছিলো আমার গায়ে সালফিউরিক এসিড ঢেলে দেয়া হচ্ছে। লোকটার কাছে ঘেঁষলে এত্ত জ্বলা জ্বলে!’’
‘‘তীব্র ভাইয়া কেমন জানি, কথার মধ্যে কোনো মাধুর্য নেই। উনার বাড়ির লোক উনাকে সহ্য করে কিভাবে!’’
‘‘উপরওয়ালাই ভালোই জানে বস্!আমারও একই প্রশ্ন।’’
আজকে কেনা ঘড়িটে মিশান বের করে তাপসিনকে দিলো,
‘‘নে তুই রাখ এটা।’’
‘‘আরে তোমার ঘড়ি আমি নেবো কেনো?’’
‘‘পাগল! আমি ঘড়ি দিয়ে কি করবো?সময় দেখার জন্য এসব ঘড়ি টড়ির কোনো প্রয়োজন নেই, পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেই বুঝতে পারি কয়টা বাজে।’’
‘‘তাই বলে তোমার জিনিস আমি নেবো?’’
‘‘এতো কথা লাগাচ্ছিস কেনো? দিচ্ছি নিবি। আর কোনো কথা হবে না।’’
‘‘রাখো বাড়ি গিয়ে নিচ্ছি।’’
‘‘মনে করে নিস, জানিস ই তো আমার মনে থাকে না এসব ছোটোখাটো বিষয়।’’
‘‘ওকে।’’
দ্বীপ বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সবাই ওর দিকে এমন ভাবে তাকালো, দ্বীপ পরিস্থিতি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। সবাইকে সালাম দিয়ে ড্রয়িংরুমের উপর দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো, তখনি বাবা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘‘দ্বীপ!’’
দ্বীপ পিছু ঘুরে উত্তর দিলো,
‘‘হ্যাঁ বাবা?’’
‘‘রুমে পরে যাও, তোমার সাথে কথা আছে।’’
‘‘ফ্রেশ হয়ে আসি?’’
‘‘ফ্রেশ পরে হও, আগে বসো এখানে।
দ্বীপ অফিসের ব্যাগ সার্ভেন্টের হাতে দিয়ে সবার সামনে সোফায় বসতে বসতে বলল,
‘‘মিশান না এসেছে আজ, ওর শব্দ পাচ্ছি না যে? ও কি ঘুমিয়ে গেছে?’’
মা উত্তর দিলো,
‘‘নাহ বাইরে গেছে।’’
‘‘কি ব্যাপার! মিশান এতো রাতে বাইরে সেটা বাবা মা স্বাভাবিক ভাবে বলল!মিনিমাম মায়ের তো ব্ল্যাড প্রেশার হাই হয়ে যাওয়ার কথা! আর এতো আগেই মিশান বেরিয়েছে কেনো? কেস টেস খেলো না তো! তাপসিন কি কিছু বলে দিয়েছে?
মনে মনে ঘাবড়ে গেলো দ্বীপ।’’
দ্বীপ ঢোক গিলে বাবা মার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘‘তাপসিন কোথায়?’’
‘‘তাপসিন মিশান দুজনই বাইরে।’’
‘‘কোনো দরকারে বেরিয়েছে কি? ১২ টার বেশি বাজে এখনো ফিরে নি।’’
মা উত্তর দিলো,
‘‘ওরা বের ই হয়েছে রাত করে, ফিরতে তো দেরি হবেই, মিশান কিছু কেনাকাটা করবে বলল, তুই তো ব্যস্ত ছিলিস তাই তাপসিনকে নিয়ে গেল।’’
‘‘ওহ।’’
কোনো গণ্ডগোল হয়নি জেনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
‘‘বলো কি বলবে, আমার কিছু কাজ আছে ফ্রেশ হয়ে কাজটা কমপ্লিট করব।’’
বাবা, মা আর খালামণি তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কথা কে আগে শুরু করবে সেটা ভাবছে, অত:পর দ্বীপের বাবাই হাল্কা গলায় কাশি দিয়ে কথা শুরু করল,
‘‘দেখো দ্বীপ। আমি তোমাদের সবাইকে এমন ভাবে বড় করেছি, জীবনটা একটা রুটিনের মাধ্যমে সাজিয়ে। হয়তো অনেক সময় রুটিনের বাইরে অনেক কিছু করতে চেয়েছো, বা করতে চাও নি, আমার জন্য শুধু সে কাজ পরিত্যাগ বা করতে হয়েছে।কিন্তু আমি তোমাদের যেভাবে গাইড করে বড় করেছি কেউ বলতে পারবে না, আমার জন্য কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছো তোমরা চার ভাই বোন। কোনো কিছু চাওয়ার আগেই চেষ্টা করেছি সেটা পূরণ করার। যখন যেটা চাইতে সেটা দিয়ে এসেছি। হ্যাঁ এটা ঠিক তোমাদের চারজনের মধ্যে মিশান একমাত্র ছিল যে নিজের জন্য কিছু চাইতো না, কিছু দিতে চাইলেও সহজে নিতো না, ওর মুখের একটাই বুলি ছিলো নিশান যা চায় তাই যেনো নিশানকে দেই,ওর নিজের কিছু লাগবে না।
আমার জানা মতে তোমাদের চারজনের মধ্যে মিশানের পেছনে সব থেকে বেশি কম খরচ হয়েছে। হয়তো এটা ভেবে নিজের চাহিদা কমিয়ে রাখতো যে ও আমাদের নিজের মেয়ে না। কিন্তু আমরা মিশান নিশান দুজনকেই সেই ছোট্ট বেলা থেকে নিজেদের মেয়ে মনে করে এসেছি। সো কলড সমাজের জন্য ওদের মেয়ের পরিচয় না দিয়ে মামা ভাগ্নি পরিচয় তৈরী করে কাছে রেখেছি।’’
‘‘বাবা এক্সাক্টলি, কি বলতে চাচ্ছো সেটা বলো।’’
‘‘দেখো দ্বীপ তোমরা বড় হয়েছো, নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে,তাই আমরা কোথাও জোর করবো না। মিশান আর তোমার সম্পর্কটা ছোটো বেলা থেকেই অনেক ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ, সেটা আমাদের প্রত্যেকের ই জানা। তোমরা এখন বড় হয়েছো, সব বুঝো, হতে পারে তোমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু। যার জন্য আমাদের ভয়ে তোমরা বলতে পারছো না কিছু। হয়তো ভাবছো, আমরা তোমাদের ভুল বুঝবো, ব্যাপারটা অন্যভাবে নেবো। আসলে সেরকম কিছু না। তোমরা দুইজন দুইজনকে যদি পছন্দ করো আমাদের কোনো আপত্তি নেই তোমাদের ব্যাপারে। এটা আরো খুশির ব্যাপার যে, আমাদের ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে। তোমার মা সব সময় আক্ষেপ করে মিশানের বিয়ের পর অন্য ঘরে চলে গেলে ওকে ছাড়া কি করে থাকবে। নিশান মেয়েটা হারিয়ে গেলো ওর শোকেই আমরা অর্ধেক। এখন যদি বিয়ের জন্য মিশানের দূরে যেতে হয়, তাহলে কি করে থাকবো? তাই মিশান যদি আমাদের ঘরেই থাকে এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত খুশির ব্যাপার।’’
দ্বীপ সবার দিকে আশ্চর্যরকম হয়ে তাকিয়ে, থমথমে গলায় বলল,
‘‘বাবা- মা, তোমরা কি ঠিক আছো?
মিশান আমার বোনের মতো! ও আমার অনেক ভালো বন্ধু। সারাজীবন ওকে বন্ধু হয়ে পাশে চেয়েছি, বউ হয়ে নয়! আমার ভাবতেই অবাক লাগছে। তোমরা কি করে এটা মাথায় আনলে, মিশানের সাথে আমার আলাদা সম্পর্ক! ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, দ্যাটস ইট। এটা যদি তোমরা আমায় নিশানের সাথে সন্দেহ করতে তাহলেও মেনে নেয়া যেতো, বাট মিশান!
তোমরা সবাই জানো, বাবা মার থেকে হারিয়ে মিশান এমনিতেই অর্ধেক শেষ,
নিশান মারা যাওয়ার পর মিশান পুরোপুরি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে মিশানের খোঁজ করি, যতক্ষণ বাড়িতে থাকি ততোক্ষণ মিশানের সাথে থাকি, তার মানে এই দাঁড়ায় না যে, ওর সাথে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। মিশানকে মেন্টালি সাপোর্ট দিয়ে নরমাল রাখার কিঞ্চিৎ চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। দুটো হাসির কথা বলে যদি মিশানকে দুই মিনিটের জন্য স্বাভাবিক দুনিয়াতে রাখতে পারি তাহরে ওটাই স্বার্থকতা।
আচ্ছা তোমরা কোন এংগেলে মিশানের সাথে আমাকে সন্দেহ করলে? তাপসিনও তো মিশানের সাথে ফ্রি, আমারই মতো। আমার থেকে তো তাপসিন ই বেশি সময় মিশানের সাথে থাকে, কই তাপসিনের সাথে সন্দেহ করলে না কেনো? আমাকে কেনো? এসব চিন্তা আসার আগে আমাকে একটাবার জিজ্ঞেস করতে, না জেনে এভাবে বিয়ে অব্ধি চিন্তা করতে হতো না তোমাদের।’’
‘‘তাহলে তুমি এটা বলো তোমরা বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছো না কেনো?মিশানের কথা বাদ ই দিলাম, ওর মেন্টালি প্রবলেম আছে, ওকে আমরা বিয়ে দিতে চাইও না।ও যদি সারাজীবন এভাবে থেকেই কমফোর্টেবল হয় তাহলে এভাবেই থাকবে।
কিন্তু তোমার কি সমস্যা? তুমি কেনো বিয়ে করতে রাজি হচ্ছো না।’’
‘‘আমার এসব বিয়ে টিয়ে তে মন আসে না বাবা, দয়া করে আমাকে আর বিয়ে নিয়ে প্রেশার দিও না, আমি চুল পেকে বুড়ো হয়েও যাচ্ছি না, বিয়ের বয়সও ছুটে যাচ্ছে না আমার। হাতে অনেক সময় আছে আমার যখন মন চাইবে আমি তখন নিজেই এসে বলবো বিয়ে করবো।ততোদিন আমায় একটু শান্তি দাও, না হলে আমি বাধ্য হবো বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে।’’
একদমে কথা গুলো বলে দ্বীপ গলা থেকে টাই খুলতে খুলতে নিজের রুমে চলে গেল।
সবাই নিরাশ হয়ে বসে রইল, কি ছেড়ে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছুই।
কিছুক্ষণ পর দু হাত ভরে শপিং ব্যাগ নিয়ে ফিরলো মিশান আর তাপসিন।
ভেতরে ঢুকেই দ্বীপের মতো তাপসিন মিশানকেও সবার সম্মুখীন হতে হলো।
খালামণি ওদের হাতে শপিং ব্যাগ দেখে বলে উঠল,
‘‘কি মিশান বিয়ের শপিং করে আনলে নাকি? এতো কি শপিং করলে একা একা? আমাদেরও নিয়ে যেতে।
বলে গেলে না তো কিছু।’’
‘‘আরে খালামণি আমরা তো এমনিই ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, জামা কাপড় পছন্দ হলো তাই নিয়ে এলাম।’’
মামী মিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘‘মিশান মা, দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক শপিং করেছিস, যাওয়ার সময়
তুই তো টাকাও নিয়ে গেলি না।’’
‘‘মিমি আমার কাছে টাকা থাকলে তোমার কাছে চাইবো কেনো? দ্বীপের যে মেডিকেল ক্যাম্পেইনে গিয়েছিলাম সেটার জন্য ওর কোম্পানি থেকে আমাকে অনেক গুলো টাকা দিয়েছে।’’
মামা হেসে জিজ্ঞেস করল,
‘‘তা মামা কি কি কিনলে?’’
‘‘এইতো কিনলাম কিছু, দেখো সবাই পছন্দ হয় কিনা।’’
তাপসিন আর মিশান সব গুলো শপিং ব্যাগ টি টেবিলে রাখলো।
‘‘তোমরা দেখো, আমি গোসল দিয়ে আসি।’’
‘‘এই ঠান্ডার মধ্যে?’’
‘‘শীত কালে ধুলা ময়লা বেশি থাকে জানোই তো, গা কিচকিচ করছে আমার।গোসল না দিলে রেহাই নেই।’’
‘‘পানি গরম করে দেই?’’
‘‘মিমি তুমি কবে দেখলে আমি গরম পানি দিয়ে গোসল দিই?’’
‘‘এখন তো রাত।’’
‘‘রাখো তোমার রাত, আমি যাবো আর আসবো।’’
বলেই মিশান নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
তাপসিন শপিং ব্যাগ থেকে সব জিনিস বের করে করে সবাইকে দেখাচ্ছে।
‘‘দেখো এই ঘড়িটা আপি আমায় কিনে দিয়েছে, সুন্দর না ঘড়িটা?’’
‘‘কি আজব এজীবনে মিশান এতো টাকা ইনকাম করেছে নিজের জন্য কখনো একটা সুতাও কিনতে দেখি নি। আর আজ শুধু নিজের জন্য এতো কিছু কিনলো! ও মিশান তো?’’
মায়ের মুখে কথাটা শুনে তাপসিন ঢোক গিললো। হাজার হলেও চোরের মন পুলিশ পুলিশ।
‘‘আমিও অবাক হয়ে গেছি জানো মা!
জীবনে কখনো বাইরে নিয়ে নিজের টাকায় আমাকে একটা চকলেট কিনে দেয় না, সে আজ আমাকে ১২ হাজার টাকার ঘড়ি কিনে দিলো। আমার কি মনে হচ্ছে জানো?
মিশান আপির মাথাটা হয়তো ঠিক হচ্ছে, নয়তো আগের থেকে আরো খারাপ হচ্ছে।’’
তাপসিনের দিকে ওর মা চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
‘‘কোথায় মিশানের প্রশংসা করবি সেখানে ওর বদনাম করছিস! ঈদ এলে এতো এতো শপিং করে দিতো তোদের, ঈদ ছাড়াও যখন তখন এটা সেটা নিয়ে হাজির হতো তোর আর নিশানের জন্য। বিদেশ থেকে ফেরার সময় নিশানের জন্য যা যা এনেছিলো, তার থেকে বেশি তোর জন্যই এনেছিলো। আর তুই বলছিস বাইরে নিয়ে গেলে একটা চকলেটও খাওয়ায় না! বদ ছেলে কোথাকার, যা ঘরে গিয়ে পড়তে বস।’’
তাপসিন মনে মনে বলল,
‘‘কি বললাম আর কি হয়ে গেল! আমি কোথায় আপির বদনাম করলাম। এটাও তো ঠিক আপি বাইরে নিয়ে গেলে আমার পকেট উল্টো খালি করে, আজ তীব্র ভাইয়া না থাকলে রেস্টুরেন্টের বিল আমাকে দিয়েই দেওয়াতো।
বেড়ালের মতো চুপচাপ হাতে ঘড়িটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো তাপসিন।
গাড়িতে বসে বিল পেমেন্টের ক্যাশ মেমো গুলো যতবার দেখছে ভেতরটা ততোই পুড়ে যাচ্ছে। দেড় ঘন্টা সময়ে কতগুলো টাকা হাওয়া হয়ে গেলো নিজের চোখের সামনে।
মাঝ রাস্তায় দীপ্তিকে দু তিনবার কল করেছে দীপ্তি ফোনটা উঠায় নি।
বাড়ি ফেরার পর মেয়েটা ঘরে দরজা দিয়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। এ কষ্টটা কাউকে বলে বুঝানোর মতো না, নিজের মাঝেই চাপা ছিল, চাপা থাকবে। তবে এইটুকুতে সে স্থির বাবা মা যদি খুব বেশি প্রেশার করে বিয়ের জন্য, তবে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে আলাদা থাকবে।
একটা মেয়ে যার রূপ, গুণ, ক্যারিয়ারে সাফল্য, হাই কোয়ালিটি ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, এসব থাকা সত্ত্বেও সে তাঁর ভালোবাসার কাছে একজন পরাজিতা।
কতোই না মিষ্টি ছিলো ছোটো বেলাটা, তীব্র যতোই দীপ্তিকে ইগনোর করতো দীপ্তি মনের মধ্যে সুপ্ত একটা আশা রেখেছিল, কোথাও না কোথাও তীব্রর মনে দীপ্তির জন্য ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, কিন্তু আজ নিজের চোখে এরকম পরিস্থিতি দেখার পর নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে খুব।
‘‘এই শালা তীব্র মালটা না পুরো দু নাম্বার আছে। এর চাল- চলন আমার মোটেও ভালো ঠেকে না। শালা ইমোশন বুঝে না, একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট দেয় কেউ?এর রহস্যটা আমি মিশান খুলতে পারলাম না আজ অব্ধি, কিছু একটা ব্যাপার আছে এই লোকের মাঝে।’’
‘‘তোদের ব্যাপার তোরাই ভালো জানিস।
শুনলাম আজ বেশ পকেট খালি করে এসেছিস।’’
‘‘পকেট খালি কোথায়? ব্যাটা পুলিশ! পকেটে হাত দিলেই গরম টাকা।’’
‘‘সরকারি চাকরীতে এতো টাকা নেই, তুই নিজেও করে এসেছিস কিন্তু।’’
‘‘তোর মনে হয় দ্বীপ,এরকম একটা লোক আর এক টাকাও ঘুষ খায় না? বলবে আর বিশ্বাস করে নেবো? ফিটার খেয়ে বড় হইনি তো, হ্যান্ডশেক করলেও এদের হাতে টাকা উঠে আসে।’’
‘‘হি হি হি তোর জামাই ই তো।’’
মিশান রেগে গিয়ে ধমকের স্বরে দ্বীপকে বলল,
‘‘আর একটাবার এভাবে টিজ মেরে কথা বলবি একটা লাত্থি মেরে ছাদে থেকে ফেলে দেবো তোকে।’’
দ্বীপ মিশানের রাগ দেখে হো হো করে হেসে দেয়,
‘‘আরো জোরে হাস, তোর কুটনীতিবিধ খালাও উঠে আসুক। সবাই মিলে হাসতে থাক।’’
‘‘ও মিশান একটা ঘটনা ঘটেছে ব্রো, মনে হচ্ছে এটার মূলে আমার খালাই আছে ।’’
‘‘সিগারেট দে আগে তারপর বল কাহিনী।’’
দ্বীপ পকেট থেকে সিগারেট বের করে নিজেরটা থেকে আগুন ধরিয়ে মিশানকে
দিলো,
‘‘এখন বল।’’
‘‘বাড়ি ফিরতেই তিনজনে চেপে ধরেছিল, বিয়ের জন্য রাজি করানোর জন্য।’’
‘‘এ আবার নতুন কি!’’
‘‘নতুন আছে, পুরোটা শোন। খালামণিই হয়তো ভেজালটা লাগিয়েছে, বাড়ি ফেরার পর বাবা মায়ের প্রেজেন্টেশন এমন ছিল যে, তোর সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা প্রেমে পরিণত হচ্ছে বলে তাদের ধারণা, আমি লজ্জায় তাদের বলতে পারছি না তোর কথা। এখন তাদের ভাষ্য এই যে,তোর সাথে আমার বিয়েতে তাদের কোনো আপত্তি নেই।বিপরীতে আরো খুশি তাঁরা, কারণ ঘরের মেয়ে ঘরে থাকছে।’’
মিশান হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না, এটা যে মিশানের মামা মামীর মাথার বুদ্ধি না সেটা স্পষ্ট, বাইরের মানুষের ই দেয়া কান পড়া,
‘‘কি জঘন্য চিন্তা!’’
মিমি মামা এটা কি করে মাথায় আনলো!
দ্বীপ হাসতে হাসতে চোখ কুঁচকে মিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘‘তুই তো আমার জেইঠাস লাগিস, যদি নিশানের ছোটো হতিস, তাহলে শালী লাগতি সম্পর্কে। শালীকে বিয়ে করা যায়, চান্স নেয়া যেতো একটা।’’
মিশান মুখ বাঁকিয়ে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘‘ছি ছি ছি ছিহঃ! তোর মন এতো অপরিষ্কার আগে জানলে একটা ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে ভিক্সল আর একটা টয়লেট ক্লিনার এনে পরিষ্কার করতাম।’’
‘‘মিশান আমার ব্যাপারটা চাপা রাখার কারণটা তো জানিই, তুই এটা বল তোর বিয়ের কথাটা এভাবে চাপা কেনো রেখেছিস? বাবা মাকে বললেই তো পারিস।’’
‘‘তোর মাথায় সামান্য এইটুকু ধরে না দ্বীপ? উনার মতো একটা ছেলেকে বিয়ে করলে যে কেউ সহজে মেনে নেবে। আর মামা মিমি খুশিতে নাচবে, এরকম ছেলেকে আমি বিয়ে করেছি জানলে তাঁরা সাদরে তাকে বরণ করে ঘরে ঢুকাবে।তারপর বাধ্য হয়ে উনার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে, সংসার পাততে হবে, বছর গেলে বাচ্চা সাপ্লাই করতে হবে। আমি বাপু খাল কেটে কুমির আনবো না কোনো ভাবেই। উনাকে আমি কখনো নিজের ভেতরে জায়গা দিতে পারবো না, জায়গা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। উনার আর আমার মাঝে বিয়ে একটা শব্দ মাত্র, এটা কোনো সম্পর্কের কাতারেই নেই।’’
‘‘তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দে না।’’
‘‘আমি চাইলেই পারবো না ডিভোর্স দিতে,উনিও দেবেন না। যেখানে আমায় বিয়ে করার কারণটা একটা রহস্য, যেটা আমার নিজেরই অজানা, সেখানে বিচ্ছেদ কি করে নেবো?
এছাড়া আমি এমনিতেও উনাকে ডিভোর্স দেবো না, যেভাবে চলছে চলুক। উনি আমার সামনে খারাপ ক্যারেকটার, কিন্তু নিশানের সামনে একটা হিরোর ক্যারেকটার ছিল, নিশান আমায় বার বার বলতো যেনো কখনো আমি কোনো ভাবেই উনাকে ছেড়ে না দেই, যদি পারি তাকে মেনে নিতে।
আমি উনাকে মেনে নিতে পারবো না ঠিক, কিন্তু কখনো ছাড়বো না।
উনাকে যতোবার মারার চেষ্টা করেছি সেটা কেবলই রাগের মাথায়। কিন্তু আমার মাথায় থাকতো উনাকে আমি মারতে পারবো না, কোনো না কোনো ভাবে বেঁচে যাবেই সে।’’
‘‘কতোদিন চলবে এভাবে?’’
‘‘যতোদিন চলে।’’
দ্বীপ তুচ্ছ হাসি দিয়ে নিরব হয়ে বসে রইল।
‘‘চিলেকোঠার চাবি এনেছিস?’’
‘‘হুম।’’
‘‘দে।’’
দ্বীপ পকেট থেকে চাবি বের করে দিতেই মিশান চাবি নিয়ে চিলেকোঠার দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
ঘরটার ভেতরে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই, ওয়ালের একপাশে বেশ কয়েকটা ইট রাখা, তার পাশেই দুটো বালির বস্তা দুটো ভাঙা ইটের বস্তা, আর বেশ কিছু বড় সাইজের বাঁশ, কাঠের খন্ড।
মিশান ভেতরে যাওয়ার পর ঘরের এক কোণের কাঠের তাকে থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে, দেয়ালের সাথে রাখা ইট গুলোর মাঝ বরাবর সারি থেকে পনেরো বিশটা ইট সরিয়ে নিলো, এরপর সেখানে একটা কারেন্টের বোর্ড দেখা গেল, স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে বোর্ড খুলতেই দেখা গেল ভেতরে কোনো তারের কানেকশন নেই, বরং যতোটুকু ফাঁকা জায়গা ততোটুকু জুড়ে মিশান ছোটো ছোটো মদের বোতল সাজিয়ে রেখেছে। সেখান থেকে একটা বোতল নিয়ে সব কিছু আগের মতো সেট করে রাখল।
চিলেকোঠাই তালা দিয়ে বেরিয়ে আবার দ্বীপের পাশে বসলো।
‘‘খাবি?’’
‘‘নাহ!’’
‘‘থাকিস কি করে? আমার তো না হলে না।’’
‘‘আমার তো একটা ক্ষত, তোর অনেকগুলো। তাই তোর মতো আমার যন্ত্রণাটা এতো জুড়ালো না।’’
মিশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘‘হতে পারে! এটা খেলে সব কিছু ভুলে থাকা যায় ঠিকি,বকিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষতিও হচ্ছে। বুঝতে পারছি কিন্তু কিছু করার নেই, স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এই রেড ওয়াইন ই আমার আসল জীবন।’’
মলিন হাসি দিয়ে মিশান বোতল ছিপি খুলে ঢকঢক করে গিলতে লাগল।
দুজনেই ছাদের কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে, অন্ধকারের সাথে নিজেদের শোকটাকে তুচ্ছরূপে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।
এতো রাত হয়েছে ঘরের ভেতর বসে বসে তীব্র কয়েকটা কাগজ নিয়ে কিছু একটা মেলাতে ব্যস্ত। চারপাশে খবরের কাগজের ছোটো ছোটো টুকরো ছড়ানো ছিটানো,
ল্যাপটপ নিয়ে কয়েকটা এইচ টি এম এল কোড দিয়ে লিংক বানাচ্ছে, একটা বক্স বের সেখানে কিছু খুঁজাখুঁজি করছে পাচ্ছে না কিছু,
মোবাইল টা নিয়ে মিশানকে কল দিলো, ওপাশ থেকে মিশান ফোন রিসিভ করে মাতাল স্বরে বলল,
‘‘হ্যালোওওও!’’
‘‘মিশান!’’
‘‘স্যা…..র!’’
‘‘তুমি যে অইদিন শসার ভেতর মেমোরিটা দিয়েছিলে ওটার কপি তোমার কাছে আছে?’’
‘‘আমাকে কি আপনার দাদীর কেয়ার টেকার মনে হয়?’’
তীব্র কড়া মেজাজে বলল,
‘‘ফালতু কথা বাদ দিয়ে সোজা উত্তর দাও।’’
‘‘এইইইই স্যা….র.. গরম দেখাবেন না বললাম! না হলে কিন্তু আমি মোবাইল ভেঙে ফেলবো, আপনি চাইলেও আমায় কল দিয়ে গরম মেজাজ শুনাতে পারবেন না। ভদ্র ও মার্জিত ভাষা ব্যবহার করুন, প্রয়োজনে বাংলা ব্যাকরণ বই দেখে শুদ্ধ ও মার্জিত ভাষা শিখে তারপর কথা বলুন। ’’
তীব্র দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
‘‘মাতাল কোথাকার!’’
মাথা গরম করে মোবাইল টা রেখে দিলো।
মিশানকে এখন কিছু বলে কোনো লাভ নেই ও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।
কিন্তু এদিকে তীব্রর ধারণার বিপরীতে মিশান আছে, নেশা করেছে ঠিকি কিন্তু এখনো নেশা লাগে নি, স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। বেশি ড্রিঙ্ক করলে মিশান সত্যি সত্যি বেতালের মতো কারসাজি করে।এখন তীব্রর সাথে অভিনয় করল, কারণ স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে হয় তীব্রর বকা খেতে হতো নয়তো মেমোরি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতো।
তীব্রর মেমোরিটা খুব জরুরি ছিল, সচারাচর কোনো কিছু হারায় না। জিনিসটা কোথায় রেখেছে তাও মনে পড়ছে না, নাকি রিফাত ই সরিয়ে নিয়েছিল মাথায় ধরছে না।

(চলবে)