তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-২৫+২৬

0
18

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ২৫
লেখিকা- রিয়া খান

তীব্র হন্তদন্ত করে তৃপ্তির কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে নেয়।তৃপ্তির মনে সন্দেহ জেগে উঠে, চোখে সন্দেহ নিয়ে তীব্রকে প্রশ্ন করে,
-কি হলো এভাবে ফোনটা নিলে কেনো?মেয়েটা কে বলছো না কেনো?
তীব্র দাঁত চেপে রাগ দেখিয়ে বললো,
-কারো পারসোনাল জিনিসে পারমিশন ছাড়া হাত দিতে নেই। মানলাম পকেটে ভুলে রেখে চলে যাচ্ছিলাম, তুমি এটা দেখতে পেয়ে বের করেছো, এই অব্ধি ঠিক আছে। কিন্তু ফোন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাচাই করা ফোন নতুন না পুরাতন, আবার সাইড বাটন ক্লিক করে ভেতরের কি আছে সেটা দেখা,এই দুটো কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ।
তুমি ভদ্র মেয়ে হয়েও এমন আতেলের মতো কাজ করলে!

তৃপ্তি কোমরে হাত রেখে ঝগড়াটে স্বরে বললো,
-এতো কিছু আমি জানি না বুঝি না, কে এই মেয়ে এটা বলো? আমাদের থেকে লুকাচ্ছো কেনো?তোমার কি লুকানোর বয়স আছে? বাবা মা কি কেউ বলেছে তোমার পছন্দের কাউকে মানবে না?
-আরে আশ্চর্য! কি ধাচের কথা এগুলো?বিন্দুকে সিন্ধু, সিন্ধুকে গুহা বানানো তোমাদের নারী জাতির স্বভাব।স্বাভাবিক জিনিসকে স্বাভাবিক নিতে পারো না?
-ঠিক আছে তাই ই। এখন বলো এই মেয়ে কে?
তীব্র উচ্চস্বরে বললো,
-কিসের মেয়ে! এটা আমার ছবি,ফেস অ্যাপ দিয়ে মেয়ে বানিয়ে রেখেছি।
-ও তাহলে এটা বলো, তোমার নাক তো হুকড নাক, বাজ পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো, কিন্তু এই মেয়ের নাক তো সোজা লম্বা।এটা তো আমি মেনে নিতে পারছি না।

-এইটুকু সময়ে এতো কিছু খেয়াল করে ফেলেছে, মহা মুশকিলে পড়লাম তো!(মনে মনে)
-তোমার সমস্যা কোথায় তৃপ্তি? মোবাইল দিয়ে এখন কতকিছু করা যায় ধারণা আছে তোমার? তুমিও তো আমার বোন হয়ে বোঁচা, এটা কি আমি মেনে নেই নি?
-তোমার মত নাক হয়নি বলে খোঁটা দিলে?দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।মা…..মা…
জোড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে ডাকতে লাগলো।
-সৃষ্টিকর্তা যখন কোনো ছেলের উপর নারাজ হন তখন তাঁর জীবনে এরকম একটা বোন পাঠায়।

বিড়বিড় করে কথাটা বলে তীব্র নিজের ঘরে ঢুকে গেলো,তৃপ্তি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকেই যাচ্ছে।

তীব্র মোবাইলের সাইড বাটনে ক্লিক করতেই লক স্ক্রিনে ভেসে উঠে ছবিটা, তীব্র ভেবেছিলো মিশানের ছবি ওয়ালে দেয়া, কিন্তু এটা নিশানের ছবি।
কি ছেড়ে কি ভেবেছিলো! ছবিটার দিকে তীব্র পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো, মেয়েটা মরে গেছে সেই কবে।মৃত মানুষের ছবি দেখলে কম বেশি একটু হলেও বুক কাঁপে।
এরকম একটা জীবন্ত ছবি দেখলে তো কথায় নেই।
নিশানের মৃত্যুর সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেলো, কতোটা নির্মম মৃত্যু ছিলো। নিশানকে হসপিটালে নেয়ার পর ওকে আর দেখা হয় নি,নিশানের লাশ দেখার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটাই তীব্রর মধ্যে আসছিলো না। নিশান মারা যাওয়ার পর আজ মিশানের মোবাইলে ওর ছবি দেখা হলো।

স্ক্রিন অফ করে তীব্র ড্রয়ার থেকে আরেকটা ফোন বের করে, ওর ফোনে কল করলো।
মিশান তখন সবজির বাজারে সবজি হাতিয়ে হাতিয়ে দেখছে কিনছে আর ব্যাগে ভরছে ।
এমন সময় ফোন বেজে উঠে, পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে নেয়, একটা বারও খেয়াল করলো না এটা ওর ফোন না, এমনকি নাম্বারটা কার সেটাও দেখলো না।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
-কোথায় তুই?
-বাজারে।
-তুই আমার মোবাইল নিয়ে চলে গেছিস কেনো?ইচ্ছে করে এমন করেছিস তাই না? ফোনের ভেতর কিচ্ছু পাবি তো দূর ওটার লক ই তো খুলতে পারবি না।

মিশান ধমকের স্বরে বললো,
-আরে কি বলছেন!আপনার ফোন আমি নেবো কেনো?
-ওরে মাতালকানা ভালোমতো তাকিয়ে দেখ, যেটা দিয়ে কথা বলছিস ওটা আমার ফোন, তোর মোবাইল আমার কাছে।

মিশান একটু অবাক হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে এনে দেখে এটা ওর ফোন না, তীব্রর ফোন।
-এতো বড় ভুল করলাম কি করে আমি?

একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে খেয়াল করলো, লাস্টে যে তীব্রকে রাগ দেখিয়ে মিশান বের হচ্ছিলো তখনি ভুলে তালে তালে নিজের ফোনের জায়গায় তীব্রর ফোন পকেটে ভরলো।
-স্যার আপনার হোম এড্রেস টা দিন, আমি বাজার করা হয়ে গেলে , মোবাইলটা আপনাকে দিয়ে আসি।
-মদ খাস তুই, মাতাল কি আমি?
যেখানে আছিস সেখানেই থাক।আমি রহমানকে পাঠাচ্ছি ওর কাছে ফোনটা দিয়ে দে।
-আর স্যার আমার ফোনটাও দিয়ে দিয়েন, হ্যান্ড টু হ্যান্ড!
-তোর সাহস তো কম না,আমার সাথে ডিল করিস!তুই জানিস তোর একটা ভুলের জন্য আমি কতবড় সমস্যাই পড়ে গেছি?সামনে পেলে রে সেন্টি তোকে, কি যে করতাম সেটা কেবল আমিই জানি।
-আপনি আমার ব আকার ল টা ফালাইতেন।

মিশান ফোন কেটে দিয়ে পকেটে ভরে রেখে ওর কাজে মন দিলো।
তীব্র রহমানকে পাঠিয়ে দেয় মিশানের থেকে মোবাইল এক্সচেঞ্জ করার জন্য।
রহমান এসে মোবাইল বদলে দিয়ে যায়।

বেশ কিছুদিন চলে যায় মিশানের সাথে তীব্রর দেখা হয় না।
দুজন দুজনের পথে।
কিন্তু সেদিন তৃপ্তি মাকে গিয়ে কি বুঝিয়েছে কে জানে, তারপর থেকে বাড়ির সবাই তীব্রর দিকে কেমন নজরে যেনো তাকিয়ে থাকে।তীব্র বুঝতে পারে এদের মনে কি চলছে। বাড়ির লোকও কিছু বলছে না হাতে নাতে প্রমাণ নেই বলে।
তীব্রর লেভেলের পুরুষরা কম বেশি ক্যারেকটারলেস হয়, সেটা ভেবেই ওকে সন্দেহের নজরে দেখা হচ্ছে।যদি তীব্রর ক্যারেকটার খারাপ পায় বাড়ির লোক, তাহলে এটা তাঁরা স্বাভাবিক ভাবে নিবেন না।
তীব্রর বাবা একজন সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন, চাকরিজীবনে উনি কোনো অসামাজিক অবৈধ কাজ করেন নি।
তাঁর ছেলে হয়ে যদি ক্যারেকটার খারাপ বের হয় তাহলে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

তীব্রকে এরকম প্রখর ভাবে সন্দেহ করার কারণ, ম্যাক্সিমাম টাইম তীব্র শেষ রাতে বাড়ি ফিরে, কিছু কিছু রাতে ফিরেও না। কিন্তু তীব্র তো কাজের জন্য বাইরে থাকে, সেটা ওর পরিবারকে কে বুঝাবে!

তীব্র কখন কি করে সেটার ১০০% কেউ জানে না। একমাত্র আব্দুর রহমানই ওর কাজকর্মের ৬০% জানে।
আব্দুর রহমান অনেকটা বিশ্বস্ত। বডিগার্ড দুদিন পর পর চেঞ্জ করলেও আব্দুর রহমানকে চেঞ্জ করে নি। বিশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি ভরসা , বিশ্বাস কখনোই করে না তীব্র।
ও সবাইকেই সন্দেহের নজরে দেখে।তীব্র ভালোমতোই জানে আব্দুর রহমান চাইলেও কখনো ওর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবে না। তীব্র যাদের নিজের হাতে রাখে তাদের প্রত্যেককে।
সিক্রেট ব্ল্যাকমেইল করে রাখে, সোজা পথে কাউকেই সে বেছে নেয় না। যেনো কোনোভাবেই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে, ভুল করেও বিশ্বাসঘাতকত করলে পরিণতি একটাই সেটা হলো মৃত্যু।
সেজন্যই ওর এই পন্থা অবলম্বন করা,তীব্রর মতে এটা একটা কার্যকরী পন্থা ।

দুপুর থেকে কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে বলে বিকেলের দিকে তীব্র বাড়ি ফিরে যায়,
-স্যার আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?ডক্টরের কাছে যাই চলুন, গাড়ি পুলিশ হসপিটালের দিকে নেবো?
তীব্রর বডি গার্ড জুয়েল তীব্রর উদ্দেশ্যে পেছনে ঘুরে বললো কথাটা, প্রতিউত্তরে তীব্র বললো,
-দরকার নেই,ড্রাইভারকে গাড়ি বাড়িতে নিতে বলো ।
-কিন্তু স্যার!
তীব্র বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
-তুমি কি আমার থেকে বেশি বুঝো?রোগী তুমি না আমি?
-স সরি স্যার!
বাড়ির কাছাকাছি যেতেই তীব্র গাড়ি থামাতে বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়।
জুয়েলও সাথে নেমে আসতে চাইলে তীব্র বারণ করে।

ও হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যায়, রহমান গাড়ি নিয়ে তীব্রর পেছন পেছন যায়।
জুয়েল মনে প্রশ্ন নিয়ে রহমানকে জিজ্ঞেস করে,
-ভাই স্যার সবসময় এরকম খিটখিটে মেজাজে থাকে কেনো?ভালো কথাতেও চেতে খালি।
-উনি এমনই, দেখেন না আমি কথা বলি না বেশি, শুধু জিজ্ঞেস করি কোন দিকে নেবো গাড়ি,আর স্যার কিছু বললে হ্যাঁ না তে উত্তর দেই।আপনিও একই কাজ করবেন, স্যার বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না।যে বেশি কথা বলে তাকেই আউট করে দেয়। আমার মতো চুপচাপ নিরব দর্শক হয়ে থাকবেন তাহলে দেখবেন অল ইজ ওয়েল!
-স্যারের হার্টে ভালোরকম সমস্যা, ডক্টর দেখাচ্ছে না কেনো?
-প্রথমত স্যার কোনো কিছু হলে পুলিশ হসপিটাল ছাড়া অন্য কোথাও ডক্টর দেখায় না।আর উনার এই রোগের চিকিৎসা এখনো পুলিশ হসপিটালে আসে নি। স্যার একমাত্র ইন্ডিয়াতে দেখান।বেঙ্গালুরের টপ কার্ডিয়াক সার্জন ডক্টর দেবি প্রসাদ শেঠি।
স্যারের চিকিৎসা শুরু থেকেই উনি করে আসছেন।
-ওহ! স্যারের সমস্যা টা কি অনেক বছরের?
-না, তবে প্রায় দু বছরের মতো হয়ে আসে,কয়েকটা বুলেট লেগেছিলো বুকে সেখান থেকেই স্যারের হার্টের বিপর্যয় শুরু হয়। মারাত্মক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা আর ডক্টর দেবি প্রসাদ শেঠির জন্যই স্যার সুস্থতার মুখ দেখে।সবাই স্যারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলো।উনার হার্ট চলাচল বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো, উনার প্রাণ ফিরেছে মেডিকেল মিরাকলের মতো।
-পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস। এসব ডিফেন্সের কর্মীদের জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই মাঠে নামতে হয়।কিছু মানুষের নিমক হারামীপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য এই পেশা গুলোর বদনাম হচ্ছে। তাদের পাপাচারের জন্য সত্যিকারের ত্যাগী নিষ্ঠ মানুষদের কর্মের গুঞ্জন চাপা পড়ে থাকে।
-হুম।
-স্যার কি হেঁটেই বাড়ি অব্ধি যাবে?
-হ্যাঁ, হার্টে ব্যাথা অনুভূত হলে হাঁটাহাঁটি করলে নাকি ব্যাথা কমে যায় স্যারের।
-ও আচ্ছা।

তীব্র হেঁটেই বাড়িতে যায়।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে নিজের ঘরে গেলো না, ড্রয়িংরুমেই বসে পড়লো। বাড়িতে কাজের লোক আর মা ছাড়া কেউ নেই।
-আজকে হঠাৎ এতো আগে বাড়ি এলি বাবু,কোনো দরকারে এসেছিস?

তীব্র কিঞ্চিৎ অস্থিরতার সাথে উত্তর দিলো,
-নাহ,আজ আর বের হবো নাহ।
-শরীর খারাপ লাগছে বাবু?
-নাহ,পানি পিপাসা পেয়েছে, এক জগ নরমাল পানি আনতে বলো।
তীব্রর মা নিজেই গিয়ে পানি এনে দিলো, তীব্র একটু একটু করে অনেকটুকু পানি খেয়ে নিলো।
-তোর না ডক্টর দেখানোর ডেট ছিলো। এখনো যাচ্ছিস না কেনো?
-যাবো দু একের মধ্যে। কাজ আছে কিছু, শেষ দিয়েই যাবো।
-মানুষ নিজের প্রতি এতোটা অযত্নশীল কি করে হয় কে জানে! যদি বেঁচেই না থাকিস তাহলে কাজ করবি কি করে?দিন নেই রাত নেই শুধু ছুটাছুটি করতে দাও,পুলিশের চাকরী মানুষ আর করে না। তোর বাবাও তো চাকরি করেছে, তোর থেকে বড় পোস্টেই ছিলো, বিয়েও করেছিলো অনেক আগে, কই তাকে তো এতো ব্যস্ত দেখি নি? তুই তো বিয়েও করিস নি, অথচ তোর বাবা যখন তোর সমান পোস্টে ছিলো তখন তোর বয়স ছয় বছর।
-ওমহু,আমি যখন হই তখন ই তো বাবার প্রমোশন হয়।বাবা তখন এসপি থাকে না, মনে করে দেখো।
তোমার হিসেব ভুল আছে, বাবাও অনেক দেরিতে বিয়ে করেছিলো।
-আমাদের বিয়ের সময় কি তুই ছিলিস?আমাদের থেকে তুই জানিস বেশি?
বিয়ের সাড়ে সাত বছর পর তুই জন্মেছিস।

বিরক্তিকর ভাবে তীব্র বলে উঠে,
– একটু চুপ থাকবে?আমার অস্থির লাগছে। নিশ্বাস নিতে দাও,কথা বলতে গেলে নিশ্বাস নেয়া হচ্ছে না ঠিক মতো।
-ওষুধ খেয়েছিস?
-হুম।
-কিছু শুকনো খাবার দেবো?
-কিছু দরকার হলে বলে নেবো।তুমি এখান থেকে যাও প্লিজ!

তীব্রর মা সরে গেলো। তীব্র সোফায় হেলান দিয়ে মাথা উপুড় দিক করে চোখ বন্ধ করে পায়ের উপর পা তুলে নিরব হয়ে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই ঝিম ধরে বসে রইলো। এরমধ্যে খেয়াল করলো, তৃপ্তির বা ওর বাচ্চাকাচ্চা কারোর ই কোনো শব্দ পাচ্ছে না।হয়তো চলে গেছে , আগ্রহ করে আর জিজ্ঞেস করলো না কিছু।

কিন্তু ধারণা ভুল হলো,কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি ওর দুই বাচ্চা বাড়িতে আসে,ওদের শব্দ পেয়ে তীব্র চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে,তৃপ্তির সাথে দীপ্তিও এসেছে।
তৃপ্তি আর দীপ্তি দুজনে সম বয়সী। ওরা যখন হয়, ওদের নামটা মিলিয়ে রাখা হয়। একসাথে কোথাও গেলে ওরা বোনের পরিচয় দিতো। দীপ্তি ক্লাস সিক্স অব্ধি তৃপ্তির সাথে এক স্কুলেই পড়েছে, এরপর দুজনে একসাথে ক্যাডেটের জন্য কোচিংও করেছে দীপ্তি ক্যাডেটে চান্স পেলেও তৃপ্তি পায় না।

অনেকদিন পর দুজনের দেখা হওয়াই তৃপ্তি ওকে জোর করে নিজের সাথে বাড়িতে এনেছে।দীপ্তি কোনোভাবেই আসতে চায় নি,কিন্তু তৃপ্তিও নিজের জেদ ছাড়েনি।তৃপ্তি জানে দীপ্তি তীব্রকে পছন্দ করে ছোটো বেলা থেকে, দীপ্তি প্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ না করলেও তৃপ্তি বুঝে যায়। কিন্তু তীব্রর মাঝে আজ অব্ধি কোনো কিছু দেখতে পায় নি।

তীব্রর মা দীপ্তিকে দেখে অনেক এক্সাইটেড হয়ে যায়, অনেকদিন পর দেখা হলো ওর সাথে।মেয়ে হিসেবে উনার দীপ্তিকে খুব পছন্দ, তীব্র রাজি থাকলে দুবার ভাবতো না ওদের বিয়ে দিতে।
দীপ্তিকে দেখে জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানায়।
এদিকে তীব্র দীপ্তিকে দেখে চোখ কপালে উঠে যায়।ও ভয় পাচ্ছে, তৃপ্তির সাথে যেরকম ভাল সম্পর্ক দীপ্তির, তাতে দীপ্তি ওকে তীব্রর কথা বলে দিয়েছে কিনা কে জানে।
এতোক্ষণ চুপচাপ থেকে যতোটুকু সুস্থতাবোধ করছিলো, এখন দীপ্তিকে দেখে হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
মম, মাশুক এসে তীব্রর ঘাড়ে চড়ে বসলো।বাচ্চা কাচ্চা দুষ্টুমি করে বলেই তীব্র বাচ্চা দেখতে পারে না, বোনের ছেলেমেয়ে বলে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না, বড় হলে দু একটা ধমক দেয়া যেতো, কিন্তু ছোটো বলে কিছু বলে না। এমনিতেও তীব্রর ভাগ্নেভাগ্নি ওকে জ্বালানোর জন্য কাছে পায় না।

দীপ্তি তীব্রর বরাবর বসলো,তীব্রর মা তৃপ্তি সবাই ওর পাশে বসে গল্প করতে লাগলো। এদের কথার জ্বালায় খুব বিরক্ত লাগছে তীব্রর কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে বসে আছে চুপচাপ। একটু পর পর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকের ভেতরের কথা চোখের মাধ্যমে পড়ে নিচ্ছে।কিন্তু দীপ্তি তীব্রর দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না,যতোবার তাকাচ্ছে নিজের অজান্তে।

দীপ্তির সামনে নানান রকম খাবার রেখেছে,কিন্তু দীপ্তি শুধু মাত্র চা ছাড়া আর কিছু খাচ্ছে না।
দীপ্তি আগে তীব্রর মায়ের হাতের বিরিয়ানি খুব পছন্দ করতো,আজ অনেক দিন পর আসায় ওকে জোর করেই বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবে বলে ঠিক করে।কিছুক্ষণ গল্প করে কিচেনে চলে গেলো ওর মা, এদিকে তৃপ্তিও কি কারণে যেনো একটু নিজের ঘরের দিকে গেলো,ড্রয়িংরুমে তীব্র দীপ্তি আর ওর ভাগ্নেভাগ্নি।
তীব্র দীপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,
-তোমাদের দুজনের কি আজ রাস্তায় দেখা হয়েছে?
-না তো।
-ওহ।
-তৃপ্তি সকালে কল দিয়ে বলছিলো অনেক দিন ধরে দেখা হয় না আমাদের, তাই আজ দেখা করতে। সেজন্য ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমরা।ঘুরাঘুরি শেষে বাড়ি চলে যাবো তখন ও আমাকে জোর করেই নিয়ে এলো এখানে।
-এসেছো ভালো করেছো।মা তোমাকে অনেক মিস করে।মাঝে মাঝে আসতেই পারো। মা একাই থাকে, অই একমাত্র তৃপ্তিই মায়ের কথা বলার মানুষ।
-তাহলে তুমি বিয়ে করে নিচ্ছো না কেনো?একটা বিয়ে করলে তোমার বউ আন্টির সাথে সময় কাটাতে পারবে।
-বিয়ে করবো সময় হলে,
-এখনো সময় হয় নি?
-নাহ!
-প্রেম তো করছোই, বিয়ে করতে সমস্যা কি?এমন না যে মেয়ে পাচ্ছো না।
– ওটাই সমস্যা,যার সাথে প্রেম করি,সেই বিয়ে করতে রাজি না,বিয়ের জন্য আরো
সময় লাগবে।
-তোমার গার্লফ্রেন্ড কি করে?
-সেনাবাহিনীতে ছিলো।
-এখন নেই?
-নাহ, বাদ দিয়েছে।
-তুমিই কি চাকরী টা ছেড়ে দিতে বলেছো?
-অই রকম ই।মেয়ে মানুষ চাকরি করে কি করবে,আমার টাকা দিয়েই চলবে।
দীপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-ভালোহ।
তোমাদের মানিয়েছে ভালো,তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার মতোই লম্বা, শুধু একটু বেশি শুকনা।তবে দেখতে মাশআল্লাহ!
– থ্যাংকস। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার আগে ওর স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো।
-ওহ বুঝেছি।

দীপ্তি চুপ হয়ে গেলো।তীব্রও চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর তীব্র দীপ্তিকে আবার বললো,
-দীপ্তি!
-হুম?
-তুমি কি আমার প্রেমের কথা তৃপ্তিকে বলেছো কিছু?
-কই না তো!
-ওহ থ্যাংকস! ওকে বলো না কিছু,আমার মাকেও না।
-তোমার বাড়ির লোক জানে না, তোমার প্রেমের কথা?
-নাহ।
-কিন্তু কেনো?
-জানলেই তো বিয়ে করতে বলবে, তাই জানাই নি।তুমি প্লিজ কাউকে বলো না।
বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে বলে আমার প্রেমিকাকে নিয়ে কখনো ডেটিংয়েও যাই না।
হুটহাট রাস্তাঘাটে একটা একটু দেখা হয়,অই অব্ধিই।
-হুম বুঝেছি তোমার সমস্যাটা।
-আচ্ছা আমি উঠি তাহলে কেমন?কাজ আছে আমার।
-বাইরে যাবে?
-নাহ ঘরে যাবো।
সামান্য একটা প্রশ্নের জন্য তীব্র এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলো সু্যোগের জন্য।

দুদিন ধরে ড্রিঙ্কস একদম ই করতে পারছে না মিশান,গায়ে হাল্কা জ্বর জ্বর। ড্রিঙ্ক করলেই বমি এসে যাচ্ছে । যার ফলে রাতে ঘুমোতেও পারছে না,দু চোখের পাতা এক করলেই অতীত এসে জড়ো হচ্ছে। বার বার ছিটকে উঠছে, সময় খুবই খারাপ কাটছে।

স্বপ্নে অনেক কেঁদেছে যার জন্য চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, ওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে গুটিশুটি মেরে চুপচাপ বসে আছে,শরীর টা কাঁপছে। একটু পর পর চিৎকার দিয়ে উঠলে মামী দৌড়ে আসে বলে, মিশানের ভেতরে গিল্টি ফিল হয়, না চাইতেও বাড়ির লোকদের ঘুমে বিরক্ত করছে।
তাই দরজা আটকে দিয়ে রেখেছে।

এমন সময় তীব্র ফোন করে বের হতে বলে,
মিশান জামার উপর জ্যাকেট পড়ে একটা চাদর মুড়িয়ে বেরিয়ে গেলো।

রাস্তার নিরিবিলি স্থানে গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে গাড়ির উপর বসে বসে সিগারেট টানছে, মিশান বাড়ি থেকে বেরিয়ে তীব্রর কাছে আসে,
-কি বলবেন বলুন।
-বসো তারপর বলছি।
মিশান তীব্রর পাশে বসতে যাবে তীব্র বলে উঠে,
-দাঁড়াও আগেই বসো না, গাড়ির ভেতর দেখো বোতল আছে নিয়ে বসো।
মিশান উত্তর না দিয়ে তীব্রর পাশে বসলো,
-কি হলো, আমার কথা শুনতে পাও নি?
-খাবো না।
-ভালো হয়ে গেলে নাকি অসুস্থ?
-কোনোটাই না, ভালো লাগছে না।
-সানগ্লাস খুলো, মাস্ক তো পড়েই আছো।
-আপনার প্রবলেম হবে না তো?
-আমার প্রবলেম তো আগে থেকেই, যাতে অন্য কারো প্রবলেম না হয় সে জন্য সানগ্লাস পড়ে থাকতে বলি।
মিশান মাথা নিচু করে নরম স্বরে বললো,
-আমার চোখ টা কি দেখতে অনেক বাজে?
-নাহ, বাজে না ঠিক।কিন্তু তোমার চোখ আমার ভালো লাগে না।
-ওহ।
তীব্র ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে মিশানের চোখে দিকে ধরতেই মিশান চোখ বন্ধ করে নেয়।
-চোখটা কেমন লাল হয়ে আছে, ড্রিঙ্কস ছেড়ে ড্রাগস ধরলে নাকি?

তীব্র আবার কড়া স্বরে বললো ,
-এই মিশান ওয়ার্নিং দিচ্ছি। ড্রিঙ্কস করো, সেটা মেনে নিয়েছি বলে ভেবো না ড্রাগস নেয়া মেনে নেবো।তোমাকে কি পরিমাণে স্পেস দিয়েছি ধারণা আছে?
-আরে কি সব বলছেন, ওসব আমি নিই না। চোখ লাল দেখাচ্ছে কারণ আমার ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না।

তীব্র ওর জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা বক্স বের করে মিশানকে দিলো।বক্সটা র‍্যাপিং করা।
-নাও।
-কি এটাই?
-খুলে দেখলে কি চোখ খুলে পড়ে যাবে?

মিশান কিছু না বলে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইলো, বক্সটা সাইজে ছোটো হলেও অনেকটা ভারী, বুঝতে পারছে না কি এটাই।কিছুটা আন্দাজও করতে পারছে।
ভেতরে আগ্রহ নিয়ে র‍্যাপিং পেপার খুলতে লাগলো।

(চলবে)

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ২৬
লেখিকা- রিয়া খান

র‍্যাপিং পেপার আলাদা করে বক্সটা বের করে খুলে দেখলো ভেতরে।
ভেতরের জিনিসটা দেখে চোখ জ্বলজ্বল করছে মিশানের, তীব্রকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বললো,
-থ্যাংক ইউ স্যার!আমি আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না জিনিস টা দিয়ে কত্ত বড় উপকার করলেন, আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।
তীব্র গম্ভীর মেজাজ দেখিয়ে বললো,
-এএএহ ওভার এক্টিং বাদ দে।
-ওভার এক্টিং আমি করলে আপনিও করছেন।
তীব্র চোখ গরম করে তাকালো,
-তেজ দেখাবেন না স্যার,বিষয়টা আমি ক্লিয়ার করছি,আপনার প্রেজেন্টেশন যেরকম আমার রিয়্যাকশনও তেমন।
সামান্য কটা বুলেট একটা সুন্দর বক্সে এনেছেন ভালো কথা, এটা র‍্যাপিং করার কোনো মানে হয়?
-র‍্যাপিং করার যথেষ্ট উদ্দেশ্য আছে, তুমি বুলেট যেভাবে শেষ করো তাতে মনে হয় রেশনের ডাল ভাত।বুলেট গুলো যে আমার বেতন আর ঘুষের টাকা সব মিলিয়ে কিনতে হয় সেটা বুঝানোর জন্যই র‍্যাপিং করা হয়েছে। হাওয়াই গা ভাসিয়ে খাও তো বুঝো না টাকা কামাই করা কত ধার।১৫ টা বুলেট যেনো অন্তত পক্ষে দুটো মাস যায়, আগামী দু মাসে আমি এর দায়িত্ব নিয়ে পারবো না, ফুরিয়ে গেলে নিজে নিজে কিনে নিও।

-এসপিদের আবার টাকার অভাব হয় কি করে?টাকায় পকেট ভরা ছাড়া এদের আর কি কোনো কাজ আছে নাকি! শুধু পেট ভাসিয়ে বসে থাকবে চেয়ারে আর বড় বড় ডিল সাইন করবে,ওদিকে ক্রেডিট কার্ড, এটিএম কার্ড, ডেবিট কার্ড যা যা আছে সব ফুলে ফুলে উঠবে।

মিশানের কথায় তীব্র ক্ষিপ্ত না হয়ে লম্বা হতাশাময় শ্বাস ছেড়ে বললো,
-নারেহ মিশান, আজকে আর ঝগড়া করবো না।ঝগড়ার মুড নেই আজ।
-মরণ ব্যাধি ধরেছে নাকি?শুনেছি মৃত্যুর আগে মানুষ ভালো হয়ে যায়। আপনার কথার মধ্যে ভালো ভালো আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
-হ্যাঁ ওরকম ই।
মিশান ইয়ার্কির ছলে বললো,
-দোয়া করি, পরকালে আপনার প্রাপ্য শাস্তিগুলো পান।
-কাল তোমার মামা মামির থেকে পারমিশন নিয়ে বের হতে পারবে? দু চারদিনের জন্য?
-একটা জায়গায় যাবো।বাসায় ম্যানেজ করে বিকেল চারটার আগে এয়ারপোর্টে এসে পড়ো। রহমান টিকিট দিয়ে দেবে,সোজা প্লেনে গিয়ে বসে থাকবে।সো প্লেনের ভেতরে আমাদের দেখা হচ্ছে।
-কোথায় যাবো?
তীব্র রহস্যমাখা হাসি দিয়ে, মিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো।
-পাকিস্তান।
-পাকিস্তান কেনো?
-তোমার মা বাবাকে খুঁজতে।
মিশান চোখ কুঁচকে বললো,
-কে আপনি সত্যি করে বলুন তো?
-মানুষ। আরেকটা পরিচয় আছে বলবো?
-কি?
-তোমার জামাই!
কথাটা বলেই তীব্র কিটকিটে হাসি দিলো।

মিশান নাক ফুলিয়ে দাঁত চেপে বললো,
-পিস্তলটা সাথে আনি নি, নাহলে এই বুলেট সবগুলো আপনার পেটে ঢুকিয়ে দিতাম।
-আচ্ছা আনো নি যখন আফসোস করে প্যারা নিও না।
বাড়ি চলে যাও ,কাল সময় মত এসে পড়ো।
-আমি যাবো না কোথাও।
তীব্র কড়া স্বরে বললো,
-আমি অপেক্ষা করতে পারবো না, প্লেনে উঠে যেনো দেখতে পাই।
-………………
তীব্র গাড়ি থেকে নেমে শরীর মুচড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-যাও বাড়ি যাও।এগিয়ে দিয়ে আসবো?
-নাহ দরকার নেই, বাড়ি যাবো না এখন হাঁটবো।

তীব্র মিশানের দিকে তাকিয়ে রইলো,মিশানকে একটু রুগ্ন দেখাচ্ছে,
মিশানের কপালে তীব্রর হাত চেপে ধরলো।,তীব্রর হাত ঠান্ডা ছিলো বলে মিশান একটু কাঁপুনি দিয়ে উঠে।
-জ্বর খুব একটা আসে নি, এটাকে জ্বর বলে না কেউ, কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে অনেক অসুস্থ।

মিশান স্লিপ মেরে গাড়ির উপর থেকে নেমে পড়ে।
-এগিয়ে দিয়ে আসবো?
-দরকার নেই, একা এসেছি একাই যেতে পারবো।
মিশান তীব্রকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন সময় ঘুরে দাঁড়ালো, তীব্র পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-স্যার!
-বলো
-সত্যি করে বলুন না, আপনি কি করে এতোকিছু জানেন আমার সম্পর্কে?
-তুমি কুয়েত থাকা কালীন আমি আর নিশান অনেক ঘুরেছি, তখন নিশানের থেকে জানতে পেরেছি এই আর কি।
-কই নিশান তো আমায় কখনো বলে নি, ও আপনার সাথে ঘুরেছে।
-তুমি তো আমাকে দেখতে পারো না, তোমাকে বললে তুমি যদি রাগ করো তাই বলেনি।

মিশান তীব্রকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে দূরের কুয়াশাতে মিলিয়ে গেলো।
তীব্র কথা গুলো মিশানের প্রশ্ন থামানোর জন্য বলেছে। মিশানের মনে অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন করলো না।
হতে পারে নিশান তীব্রর সাথে ঘুরাফেরা করেছে।কিন্তু
নিশান মিশানের অতীত সম্পর্কে স্বয়ং নিশানও অবগত নয়। নিশান জানতো দ্বীপের বাবা মা ওর আপন মামা-মামী, ওর বাবা মা মারা গেছে একটা এক্সিডেন্টে।
যদি ওদের রহস্যময়ী অতীতটা নিশান জানতো তাহলে বার বার সে বিষয় নিয়ে নিশান নানা রকম প্রশ্ন মিশানকে করতো, আর মিশান না চাইতেও বার বার অতীতে ডুবে যেতো, পরিস্থিতিই অন্য রকম হয়ে যেতো।
সেসব কিছু বিচার করে দ্বীপের বাবা, মা,দ্বীপ,মিশান সবাই মিলে এই অতীতের অংশটুকু নিশানের থেকে হাইড করে নতুন গল্প সাজিয়ে বলেছে।

তীব্রর মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার আছে যার জন্য ও মিশানের ব্যাপারে এতো কিছু জানে।
মিশান তীব্রর ব্যাপারটা মাথায় ই নিতে পারছে না।কিছু একটা কানেকশন আছে তীব্রর সাথে মিশানের অতীতের। কিন্তু কি সেই কানেকশন সেটাই মাথায় ধরছে না।
এতোগুলো দিন তীব্রর সাথে পরিচয়, অথচ মিশান তীব্রর সম্পর্কে কিছুই জানে না, যতবার তীব্রকে ফলো করে ওর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করেছে ততোবারই তীব্রর কাছে ধরা খেয়ে যায়, তীব্রর বাড়ির ঠিকানা জানার জন্যেও চেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু কোনোভাবেই পারে নি সেটা, তীব্র কিভাবে কিভাবে যেনো সব বুঝে যায়।

সকাল বেলা ঘরের ভেতর রাউন্ড দিতে দিতে দাঁত ব্রাশ করছে এমন সময় তীব্রর ফোনে কল আসে, তীব্র ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে এসবি থেকে কল এসেছে। নাম্বার টা মোশারফ স্যারের।
মোবাইল টা রেখে বেসিংয়ের সামনে গিয়ে কুলকুচি করে হাতমুখ ধুয়ে আসে ।
টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছার সময় আবার ফোন রিং হলো,এবার ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করলো,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।তীব্র কেমন আছো?
-আপনার ফোন রিসিভ করার আগেও ভালো ছিলাম। এখন কেমন আছি বলতে পারলাম না তবে আপনার কল টা কেটে দেয়ার পর বুঝতে পারবো কেমন আছি।
-রেগে আছো এখনো?
-রেগে থাকবো কেনো স্যার?
-কতোদিন হয়ে গেলো এসবি থেকে চলে গেছো, একটা বার এসে দেখা তো করোই না খোঁজখবরও নাও না।
-স্যার আপনার মেয়ে আমার মায়ের ছেলের বউ না, যে উইদাউট এনি রিজন আপনাদের খোঁজখবর নিতে যাবো।
-তীব্র তুমি ছেলে ও মানুষ হিসেবে যথেষ্ট ভালো কিন্তু একটা মেয়ের স্বামী হিসেবে কখনোই ভালো হতে পারবে না, সেরকম সম্ভাবনা থাকলে আমি অবশ্যই আমার মেয়েকে তোমার সাথে দেয়ার চিন্তা করতাম।
-কেনো স্যার আমাকে কি এতোটাই ফিজিক্যালি আনফিট লাগে? বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দিতে পারবো না?
-আমি সেরকম কিছু বলিনি। তুমি যথেষ্ট ফিট সব দিক দিয়েই। শুধু শারীরিক সামর্থ্য আর আর আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই একজন যোগ্য স্বামী হওয়া যায় না। ব্যবহারের ও ব্যাপার স্যাপার আছে। মেয়ে মানুষ অত্যন্ত নমনীয় মেজাজের, এরা একটুতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, তোমার যে ব্যবহারের নমুনা,তাতে তোমাকে যে বিয়ে করবে তার কাঁদতে কাঁদতে জীবন পার হয়ে যাবে।
তীব্র স্বর নরম করে বললো।
-কি যে বলেন স্যার, এতোটাও নিকৃষ্ট না আমি। বউকে যথেষ্ট আদর করবো। আপনার মেয়েকে দিয়েই দেখেন।
-আমার দিন এতোটাও খারাপ আসে নি যে তোমার কাছে আমার মেয়ে দিবো।
-স্যার চেতেন কেনো?ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, আপনার মেয়ের আগের কোনো প্রেম থাকলেও সমস্যা নেই আমার। আপনি চাইলে আমার আপনার সম্পর্কটা জামাই শ্বশুর সম্পর্কে বদলাতে পারে,বিশ্বাস করুন স্যার আমি শুধু আপনার মেয়ে না আপনার সাথেও ভালো ব্যাবহার করবো।
-তীব্রওওও.এসব কথা রাখো এখন। কাজের কথায় আসো।
-ওকে স্যার, কিন্তু একটা প্রশ্ন স্যার আপনার মেয়ের এলএলবি টা কি এখনো কমপ্লিট হয় নি?একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন স্যার আপনার মেয়ের সাথে ঝগড়া লাগলে জমবে ভালো সেও তর্কের উপর শিক্ষাগত ডিগ্রীধারী, আমিও প্র‍্যাক্টিক্যালি ডিগ্রিধারী।বেশ মাখা মাখা সম্পর্ক জমবে স্যার।
-ওপস তীব্র তুমি থামো তো একটু, কাজের কথায় আসো প্লিজ।
– কাজ কিসের স্যার? আপনার সাথে তো এখন কোনো কাজ নেই।আপনি কি আমার খোঁজখবর নেয়ার জন্য ফোন দেন নি?

মোশারফ স্যার অনুনয় স্বরে বলতে লাগলো,
-তীব্র একটু অফিসে আসতে পারবে?দরকার ছিলো খুব।
-ইয়ে হুইয়ি না বাত! তীব্রর কাছে কেউ দরকার ছাড়া আসে না। যারা দরকার ছাড়া আসে তাদেরকে তীব্র পছন্দ করে না।
কিন্তু স্যার আই এম এক্সট্রিমলি সরি স্যার।আমি বাংলাদেশে নেই,
-তীব্র বাংলাদেশের সিম দিয়ে অন্য কোনো দেশ থেকে কথা বলা যায় না।
-স্যার আমি বাংলাদেশের বাইরের সীমানাতে আছি বর্ডারের কাছে ওপাশের টাওয়ার থেকে সিমে সিগনাল পাচ্ছে তাই এখনো কথা বলা যাচ্ছে, দুই এক সেকেন্ডেই কল কেটে যাবে।
ডক্টর দেখাতে কর্ণাটক যাচ্ছি ।
-তীব্র প্লিজ একটু দেখা করো, বেশি সময় নিবো না তোমার। তুমি যদি এয়ারপোর্টেও থাকো ফ্লাইট ক্যান্সেল করে আসো, পরবর্তী ফ্লাইটে যাও, টিকেট আমি দেবো।
-ঠিক আছে আপনি টিকেটের ব্যবস্থা করুন আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছি।
-থ্যাংকস তীব্র, আসো আমি এক্ষুণি তোমার জন্য পরের ফ্লাইটের টিকিট কাটিয়ে রাখছি।

তীব্র ফোন কেটে দিয়ে, বাঁকা হাসি দিলো।ওয়াল কেবিনেট থেকে কয়েকটা জামা বের করে আর মেডিকেল পেপারস গুলো একটা ট্রলিতে ভরে নিলো।
রেডি হয়ে একবারে বেরিয়ে গেলো।
এসবির অফিস থেকে বের হয়ে নিজের অফিসে যাবে সেখান থেকেই এয়ারপোর্টে যাবে।

-বলুন স্যার কি এমন মহামারী প্রয়োজন পড়লো আমাকে?
মোশারফ হোসেন স্যার মাথা নিচু করে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
-তীব্র…. গেছো তো গেছো একটা খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধও করলে না, ডিপার্টমেন্ট কিছুই করতে পারছে না তোমাকে ছাড়া। ইরফান শেখ শুধু মুখেই চপচপ করতে পারে ওনার কাজের কোনো আওয়াজ নেই।
-মার্ডারের সংখ্যা কি বেড়ে গেছে স্যার?
– না, সেরকম কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছি না। কিলার বেঁচে আছে নাকি আত্মগোপন করেছে সঠিক বুঝতে পারছি না। যদি আত্মগোপন করে থাকে তবে সে কঠিন ভাবে আহত হয়েছে।সে হয়তো আমাদের আশেপাশেই লুকিয়ে আছে।আর যাই হোক বাংলাদেশের বাইরে যেতে পারে নি।
আমরা যদি ভালো মতো চেষ্টা করি তাহলে হয়তো খুব সহজেই পেয়ে যাবো।
-ঘোড়ার ডিম পাবেন কিন্তু কিলার পাবেন না স্যার ! সে বান্দা আত্মগোপন করার বান্দা না, আপনাদের মাঝেই ঘুরাফেরা করছে।আর জানও শক্ত আছে এতো সহজে মরবে না (মনে মনে)
-কি ভাবছো তীব্র?
-ভাবছি আপনারা সবাই উঠে পড়ে লাগুন।মানে অই যে কথায় আছে না, আদা জল খেয়ে লাগা। ব্যাপারটা হবে সেরকম আদা জল খেয়ে লেগে পড়ুন।এভাবে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে ভাবলে কিচ্ছু হবে না স্যার। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে হবে, তারপর কোমর বেঁধে ছুটতে হবে।

ডি আইজি স্যার তীব্রর কথায় মাইন্ড না করে, নিজেকে শান্ত রেখে তীব্রর দিকে ঝুঁকে হাতের উপর হাত রাখলো,
-তীব্র….! প্লিজ বাবা, তুমিই পারো এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে। এডিশনাল আইজি স্যার আমাকে বার বার জোর দিয়ে বলেছে তোমাকে কনভেন্স করতে। আর আইজি স্যার তো জানেই না, আমরা সামান্য একটা কিলারকে ধরতে এতো হিমশিম খাচ্ছি, এডিশনাল আইজি স্যার উনাকে কোনোমতে সাত পাঁচ বুঝিয়ে চুপচাপ রেখেছে। বাঙালী ছোটো খাটো ভুলেই ধরা
খায়, এই সামান্য একটা কেসের জন্য শেষ কালে আবার সাসপেন্ড হয়ে না বসি। আর কটা বছর পর ই আমার পেনশন। সবাই আমার উপর চাপ দিচ্ছে তোমাকে বুঝানোর জন্য, কারণ তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা ভালো। সবাই জানে তোমাকে আমি ভালোমতো কনভেন্স করতে পারবো।
তীব্র মোশারফ হোসেন স্যারের দিকে তাকিয়ে তুচ্ছ হেসে বললো,
-আপনার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক! স্যার! অবশেষে আপনার মেয়েকে আমার কাছে দিতে রাজি হয়েই গেলেন?
-তীব্র প্লিজ!ইয়ার্কি করো না।
-আপনার সাথে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক? আমি বলেছি আপনি চাইলে আমাদের সম্পর্কটা জামাই শ্বশুরে রূপান্তর হতে পারে।

মোশারফ হোসেন নার্ভাস মুডে তীব্রকে বললো,
-তীব্র প্লিজ, এখানে আমার মেয়েকে টেনো না।
-স্যার! আপনি আমার সিনিয়র, কেনো আমাকে তেল মেরে রিকুয়েস্ট করেন?আপনি করবেন অর্ডার! গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে আমার দিকে চোখ গরম করে ভারী গলায় বলবেন,”তীব্র ইট’স এন অর্ডার, এটা তোমার করতেই হবে, করতে হবে মানে করতেই হবে। “আমি আপনাদের অই গরম দৃষ্টির দিকে চোখ ফেলে ভয়ে কাঁপতে থাকবো, চাকরী ছুটে যাওয়ার ভয়ে আমি আপনাদের কথায় নাচবো।
তা না করে কি প্লিজ প্লিজ করছেন!
কি এমন রহস্য লুকায়িত আছে স্যার?যার জন্য আপনারা সিনিয়র আমাকে অর্ডার না করে রিকুয়েস্ট করেন?
-তীব্র এমন করে বলো না, তোমার বাবা এক সময় আমাদের সিনিয়র ছিলেন, প্রমোশনের জন্য পরিক্ষা দিলে উনি এতোদিনে আমাদের উপরেই থাকতো। মিনিমাম তাকে আমরা এডিশনাল আইজির স্থানে দেখতাম, কিন্তু উনি এডিশনাল ডি আইজি অব্ধিই রয়ে গেলেন, উল্টো নিজের পেনশনের আবেদন করে ফেললেন।
তুমি আমাদের নিজেদের ছেলের মতো।তোমার সাথে কি জোরাজুরির সম্পর্ক? আমারও একটা ছেলে আছে, হতে পারে তোমার থেকে ছোটো কিন্তু তুমিও আমার ছেলের মতোই ।
-ও আচ্ছা আপনার নিজের ছেলেকে কি যখন তখন বিপদের মুখে ফেলে দেন?
-……………………

মোশারফ স্যারকে থামিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে তীব্র কিছু একটা ভাবতে লাগলো।এরপর ঠান্ডা মেজাজে বললো,
-ঠিক আছে স্যার আমি আপনাদের একটা সুযোগ দিচ্ছি আমাকে নাচানোর।

তীব্রর কথা শুনে উনার মুখে হাসি ফুটলো,উনি কিছু বলার আগেই তীব্র বলে উঠলো,
-তবে আমার একটা শর্ত আছে। আমার যে পেপারস গুলো আপনারা সিনিয়ররা সিন্দুকে ভরে রেখেছেন সেখান থেকে বের করে আমাকে দিয়ে দিন, আমি প্রমিস করছি, যা বলবেন তাই ই করবো।

মোশারফ হোসেন হতাশাময় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
-তীব্র এটা হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না, কাজটা তোমার বাবার বুদ্ধিতে করা হয়েছিলো ঠিকি এখন তোমার বাবা বললেও ওগুলো ফেরত দেয়া সম্ভব না।পেপারস গুলো আইজি স্যারের কাছে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে।
-তাহলে আর কি আপনারা আপনাদের পথ দেখুন আমি আমারটা, এনি ওয়ে আমার লেট হয়ে যাচ্ছে স্যার।এক জায়গায় যেতে হবে।
-ব্যাপার টা ভেবে দেখো তীব্র । তুমি চাইলে তোমার প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে পারি।
-ধন্যবাদ স্যার, কিন্তু দরকার নেই।উঠি আজকে, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।

তীব্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,
-একটু অপেক্ষা করো, তোমার বারোটার ফ্লাইটের টিকিট টা আসছে। এসে পড়েছে প্রায়।
-দরকার নেই স্যার। আমার ফ্লাইট বিকেল পাঁচটাই। আর টিকিটও কাটা আছে।আসি আমার অফিসে যেতে হবে।আল্লাহ হাফেজ।
অফিস থেকে তীব্র বেরিয়ে গেলো।

এয়ারপোর্টে এসে সমস্ত ফর্মালিটি পালন করে প্লেনে উঠে যায়, তীব্রর আগেই মিশান জায়গামতো উপস্থিত। জিন্স টাইপের একটা হুডি পড়ে আছে চোখে লাল রঙের সানগ্লাস।
তীব্র দুষ্টুমি করেই নাকি রিয়েল মুডেই, ব্লাশিং ব্লাশিং মুডে নিজের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে মিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।
-দাঁড়িয়েই থাকবেন?বসবেন না?
তীব্র মৃদু হেসে বসতে বসতে বললো,
-তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগাতে পারলে না? দেখতে আরো সুন্দর লাগতো।
মিশান ভ্রুঁ বাঁকিয়ে তীব্রর দিকে তীর্যকভাবে তাকিয়ে রইলো।
-আমি কি আঠারো প্লাস কোনো কথা বলেছি?
-আমরা ইন্ডিয়া কেনো যাচ্ছি?
-হানিমুন করতে।
-সোজা কথা কি আপনার থেকে আশা করা যাবে না?
-আমরা ইন্ডিয়া ল্যান্ড করে ঝগড়া করছি,এখানে যারা আছে সবাই ভদ্রলোক, সিনক্রিয়েট করাটা মানাবে না।

পুরো জার্নিতে মিশান একটা কথাও বললো না। মিশান তীব্রর উপর যতোই ক্ষিপ্ত হোক, তীব্র যখন যা বলে তাই ই করে কারণ তীব্র আর যাই হোক কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া মিশানকে ডাকে না। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে হলো ওর সাথে এই কারণেই।
বেঙ্গালুর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতেই ওরা নিকটবর্তী একটা হোটেলে আসে, যেহেতু তীব্রর এখানে প্রায় ই আসতে হয় তাই এখানকার হোটেলও গাইড পরিচিত ছিলো। একপ্রকার রেগুলার কাস্টমার বলা যায় ওকে।
একটা রুম বুক করায় মিশান অনেকটা ক্ষিপ্ত হলো তীব্রর উপর, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মুড ঠিক হলো, রুমে দুটো সিংগেল বেড ছিলো।

পরের দিন তীব্র মিশানকে হোটেলে রেখে একাই হসপিটালে চলে যেতে নেয়, একা একা থাকতে হবে ভেবে মিশান তীব্রর সাথেই গেলো।
তীব্র ডক্টরের চেম্বারে ঢুকার পর মিশান ওয়েটিংরুমে বসে থাকে।
যেহেতু দুজনের দু রকম ভাষা, তীব্র আর ডক্টর ইংরেজীতেই কথোপকথন করছেন।
কয়েকটা টেস্ট দেয়ার পর সেগুলোর রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের সামনে বসে আছে, ডক্টর রিপোর্ট দেখছেন।
– মিস্টার তীব্র, আপনার রুটিনে সব ই ঠিক আছে বাট তিনটে কারণে আপনার অবনতি ঠেকছে না। সিগারেট আর রাত জাগার কারণে কোনো ইম্প্রুভ হচ্ছে তো না ই । আর ওষুধের অনিয়মের জন্য অবনতি হচ্ছে।
বুঝতে পারছি আপনার ঘুম না হওয়ার কারণ টা, এমনকি সিগারেট খাওয়ার কারণটা।
-স্যার আমি আগের থেকে সিগারেট এখন অনেক কম খাই, আর কিছুদিনের মধ্যেই বাদ দিয়ে দেবো, সব কিছুই তো সময় সাপেক্ষ।
-তা ঠিক, সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মনে হয় না আপনি ওষুধটা ঠিক মতো খাচ্ছেন। ওষুধ ঠিক মতো না খেলে তো আমি কিছু করতে পারবো না, আপনি আমার সাথেও ঠিক সময় দেখা করেন না। আপনার আসার কথা ছিলো আরো পঁয়তাল্লিশ দিন আগে, আপনি এলেন কবে?
-কাজের চাপে থাকি স্যার, যার জন্য নিজের দিকে সময় দেয়ার কথা মনেই থাকে না।
-আপনি আত্মবিশ্বাসী ঠিকি কিন্তু জীবনের মায়াটা খুব কম, নেই বললেই চলে।
-হতে পারে।
ডক্টর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললো,
-আপনাকে যে ডক্টর শ্রীনারায়ণকে দেখাতে বলেছিলাম দেখিয়েছেন?
-না আজ ই দেখাবো।
-আপনার ওয়াইফ এসেছেন?
-হ্যাঁ।
-দুজনেই দেখিয়ে নিন তাহলে। আর আমি এবার স্ট্রিক্ট অর্ডার দিচ্ছি আগামী তিন মাস এই ওষুধ গুলো রেগুলার খাবেন, একদম অনিয়ম করা যাবে না। কাঁটায় কাঁটায় তিন মাস পর আসবেন একদিন আগেও না পরেও না।পরেরবার যদি অনিয়ম করেন তাহলে বাঁচার আশা বাদ দিন। এবার অনিয়ম করার কারণে শুধু বুকে ব্যাথা দেখা দিয়েছে, নেক্সট টাইম কি হয় বুঝবেন হাড়ে হাড়ে। তাই দয়া করে আমার কথা রাখবেন।
-ওকে স্যার।
-হুম প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি। আর আমি এখান থেকে ডক্টর শ্রীনারায়ণকে জানিয়ে দিচ্ছি।উনি যে সময় দেখা করতে বলে দেখা করে নেবেন। ও চেষ্টা করবে আপনাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার।
শ্রী নারায়ণ আমার বন্ধু আর আপনি আমার রেগুলার পেশেন্ট, আপনার সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য কাম্য করা আমার দায়িত্ব।
-জি ধন্যবাদ স্যার, উঠি তাহলে ।
-দেশে ফেরার আগে দেখা করে যাবেন। আমি তো এখন ব্যস্ত, তাই বলছি না, নেক্সট টাইম আপনার ওয়াইফকে সাথে নিয়ে আসবেন।
-শিউর স্যার।

তীব্র উঠে বেরিয়ে গেলো।মিশান বাইরে চেয়ারে বসে একটা ছোট্ট পিচ্চির সাথে খেলা করছে।তীব্র মিশানের পাশে বসলো।
-হয়ে গেছে আপনার?
-হুম, আবার সন্ধ্যা বেলা আসতে হবে।
-ওহ।
-চলো তাহলে হোটেলে ফেরা যাক। আবার আসতে হবে তো।এতোক্ষণ এখানে বসে থাকাটাও সম্ভব না।

মিশান বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে তীব্রর সাথে চলে যায়।
আবার সন্ধ্যা বেলা আসে ডক্টর শ্রীনারায়ণের শরণাপন্ন হতে ।
মিশান ওয়েটিংরুমে বসবে তখন তীব্র বলে উঠে,
-বসো না, আমার সাথে ভেতরে চলো।
-ভেতরে কেনো? পেশেন্ট আপনি আমি গিয়ে কি করবো?
-আমরা দুজনেই পেশেন্ট তুমি চলো ভেতরে।
-আশ্চর্য আমি কেনো যাবো? পাগল, মাথা খারাপ?
তীব্র চোখ গরম করে বললো,
-তোমার সমস্যা কোথায় আমার সাথে গেলে?আমি বলছি চলো।
-আমার কোনো রোগ থাকলে তো আমি যাবো!আপনি যান।

(চলবে)