গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ২৯
লেখিকা- রিয়া খান
-আমি বলেছি তুমি ওই পয়েন্ট গুলোর মধ্যে থেকে কিছু একটা ধরে নাও। একটা বারও বলিনি তোমায় সত্যি সত্যি ভালোবাসি। খামোখা সব সময় এক প্রশ্ন ভালোলাগে না, মন মতলবি একটা উত্তর ধরে নাও।
-জানেন আজ অব্ধি আমাকে যারা যারা মন থেকে ভালোবেসেছে তাঁরা প্রত্যেকেই মরে গেছে। আমি যাদের ভালোবেসেছি তাঁরাও মরে গেছে। আমি ভয়ে থাকি মামা, মিমি, দ্বীপ, তাপসিন ওরা যে আমাকে এতো ভালোবাসে ওদের না আবার কিছু হয়ে যায়। আমার বর্তমান পৃথিবীতে তো কেবল ওরাই আছে শুধু।আমার ইচ্ছে করে ওদের থেকে অনেক দূরে চলে যাই, আমার যা ইচ্ছে হোক,ওরা বেঁচে থাকুক। আমি তো একটা কুফা নিজের জীবনটা আঁধার করে দিয়েছি, ওরা তো আমার আপনজন আমার ছায়া ওদের উপর পড়ে কিছু যেনো না হয়ে যায় আবার!
কথা গুলো বলতে বলতে চোখের কোণে পানি জমে গেলো মিশানের,মন মরা হয়ে বললো কথা গুলো।
মিশানের কথার ভেতর না ঢুকে, তীব্র গাড়ি থামিয়ে বললো,
-রাস্তায় নামবে নাকি বাড়িতে দিয়ে আসবো?
-রাস্তায় ই নামিয়ে দিন স্যার,আজ বাড়ি অব্ধি যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।
-যেতে পারবে তো?
-পারবো স্যার, না যেতে পারলেও সমস্যা নেই। আমি মিশান যেখানে রাত, সেখানেই কাত।
মিশান সীট বেল্ট খুলতে খুলতে, তীব্র ওকে ক্রস করে গাড়ির ডোর ওপেন করে দিলো।
মিশান নেমে গিয়ে ঢোলতে ঢোলতে হাঁটতে লাগে, বাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় নামিয়ে দিলেও মিশান রাস্তার ঠিকানা তালগোল পাকিয়ে ফেলে, নেশার প্রভাবটা একটু একটু করে বাড়ছে।
প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ধরে মিশান বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে হেঁটে কোথায় চলে আসে নিজেও জানে না। তবে এতে মিশান একটুও ঘাবড়ে যাচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে এলোপাথাড়ি হাঁটতে।
-ম্যাডাম দেহেন রাস্তা দিয়া তো অইটা মাইয়া মানুষ যাইতাছে!
সিনজিতে চলমানরত এক মধ্যবয়সী নারী আরেক নারীকে বললো কথাটা, মুখ ভর্তি পান চিবাতে চিবাতে অপর নারীটি সি এন জি ড্রাইভারের পাশে বসা একজন পুরুষকে বললো,
-ভাইজান মাইয়াডার মুখে লাইট মারেন দেহি, চেহারা সুরত কেমন।
ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটা মুখের পানের পিক ফেলতে ফেলতে চলন্ত সি এনজি থেকে মিশানের মুখে লাইট মারলো।
মিশানের চেহারা দেখে মহিলাটা সন্তুষ্ট হয়ে বললো,
-ওরে রে লা জবাব! মাইয়া তো না সাক্ষাৎ পরী নাইমা আইছে আকাশ থিকা। ভাইজান দেখছেন আমাগো কয়দিন যেমন খরা যাইতাছিলো আইজ এই মাইয়ারে পাইয়া আমাগো সব খরা কাইটা যাইবো। এই মাইয়ারে দেশি গুলার কাছে দেওন যাইবো না, দেশী কাস্টমার গো অতো ট্যাকা নাই এই মাইয়ারে কেনার মতো।এই মাইয়ারে পাঠামু বিদ্যাশে, চাইরমোর দিয়া বিদ্যাশী কাস্টমার থাকবো আর দামাদামি করবো, এরে পাওয়ার লেইজ্ঞা দাম খালি বাড়তেই থাকবো বাড়তেই থাকবো।দেখছেন নি ভাই কি চেহারা সুরত মাইয়ার!
-আহা! রূপজান কথা কম কইয়া মাইটারে তুইলা আনার ব্যবস্থা করো আগে, এহন রাস্তায় একা একা আছে,কহন আবার ক্যারা নগে খাড়িয়্যা যাইবো।ঢাকা শহরে গাহেকের অভাব নাই কিন্তু,আমাগো মতো আরো দশটা দল এই গলীতে ঘুরতাছে।তাই কেউ নেওয়ার আগে, আমাগো ভাগে আনো এইডারে।
-ঠিক কইছেন ভাইজান।এডারে এহনি ধরতাছি।গাড়ি থামাও মনু, মালেকা তুই নু আমার লগে।
সি এনজি থামানোর পর পর দুই মহিলা মিশানের দিকে যেতে লাগলো, মিশান তো মিশান ই, কোনো তালে নেই।আশেপাশে দুজন মহিলা যে ঘুরঘুর করছে সেটা খেয়াল করছে না।
মহিলা দুজন বেশ স্বাস্থ্যবানও, মিশানের কাছে যেতেই কোনো শব্দ না বাড়িয়ে একজন মিশানের পেছন থেকে কিছু একটা দিয়ে চোখ বেঁধে দেয় আরেকজন রুমালে ক্লোরোফরম লাগিয়ে মুখে চেপে ধরে।
এরপর মিশানকে তুলে নিয়ে সি এনজির ভেতরে নিয়ে ওদের এলাকায় চলে যায়। আর মিশান যেনো পালাতে না পারে সেজন্য ঘরের বাইরে থেকে তালা মেরে রাখে।
একটা খাটে অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে মিশান।
বেশ কয়েক ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আসার পর মিশান চোখ খুলে চারদিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় সম্পূর্ণ একটা অচেনা জায়গা।
একটা চাপা খুপরির মতো ছোটো ঘর, ঘর ভর্তি বিভিন্ন নায়িকার আপত্তিকর ছবি টাঙানো চারপাশে। কিছুক্ষণ দম ধরে বসে থেকে জায়গাটা আইডিয়া করতে লাগলো ঠিক কোন জায়গায় আছে এই মুহূর্তে।
ঘরটাতে ওকে বন্দী করে রাখা হয়েছে বুঝা গেলো,কোনো মতে ঘরে এনে বিছানায় রেখে চলে গেছে,পায়ের জুতোটা অব্ধি খুলে দেয় নি।
একটা প্যান্টের সাথে টপস পড়ে তার উপর কটি পড়া ছিলো মিশান,জামা কাপড়ের কোনো হেরফের হয় নি।
মাথা দু চারটা ঝাঁকি দিয়ে পরিস্থিতিও আন্দাজ করতে পারলো।কাউকে যে কল দেবে সে অবস্থাও নেই,ভুলে মোবাইল টা বাড়িতে রেখে বেরিয়েছিলো।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বাইরে থেকে দরজার তালা খোলার আওয়াজ পেয়ে মিশান খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো।
সেই দুজন মহিলা ভেতরে প্রবেশ করলো, দেখতে একটু উদ্ভট লাগছে, মুখ ভর্তি পান ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা কাঁজল,ভ্রুঁ গুলো চিকন। সাজসজ্জার পরেও কেমন যেনো দেখাচ্ছে, মিশান বিকৃত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো, মহিলা দুজনের পেছনে আরেকজন পাঞ্জাবী পড়া গলায় মাফলার জড়ানো লোক সেও পান চিবাচ্ছে।মিশান এদের দেখে একটুও ভয় পাচ্ছে না।
পা নাচাতে নাচাতে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
-কি মাইয়া অমন কইরা চাইয়া আছো ক্যান?কাইন্দা দিব্যা নাকি পলিয়া যাইবা?
-একটু আদা চা হবে?
মিশানের চোখে ছুটাছুটির জন্য উত্তেজনা না দেখে উল্টো ওর মুখে চা চাওয়ার কথাটা তাদের চোখে খুবই বেমানান লাগলো। একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললো,
-আদা যা খাইবা?
শান্তস্বরে মিশান উত্তর দিলো,
-দিলে খুশি হবো।
-মালেকা যা তো আদা চা লইয়া আয় ।
মিশানের দিকে ঘুরে রূপজান জিজ্ঞেস করলো,
-শুধু আদা চা ই খাবা?
-ও হ্যাঁ চায়ে একটু লেবুর রসও দিয়েন, আর হ্যাঁ সুগার দিয়েন না।
রূপজান হেসে দিয়ে তাঁর পাশের লোকটাকে বললো,
-দেখলেন ভাইজান, এহনকার যুগের মাইয়া, ডায়েট না কি জানি কি করে চিকন থাকবার লেইগা।
লোকটা মিশানের দিকে তাকিয়ে আতেল আতেল হাসি দিচ্ছে।
একজন চা আনতে গেলো আর বাকি দুজন মিশানের সামনে বসলো,
মিশান আরাম করে বসে চারদিকটায় মাথা ঘুরাচ্ছে। দুজনেই মিশানের দিকে তাকিয়ে ওর হাব ভাব বুঝার চেষ্টা করছে। মিশানকে বেশ ঠান্ডা মেজাজের দেখা যাচ্ছে চোখে মুখে কোথাও এক ফুটা উত্তেজনা ভয় দেখাচ্ছে না, একটাবার জিজ্ঞেসও করলো না কোথায় আছে, ওকে এখানে কিভাবে কেনো আনা হয়েছে, সেসব বিষয়ে মিশানের ভেতর থেকে কিঞ্চিৎ আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে না।
মিশানকে চা এনে দেয়ার পর পা নাচাতে নাচাতে চা খাচ্ছে। মিশানের এমন ঠান্ডা মেজাজ কোনো ভাবেই তাদের ভেতর শান্ত রাখতে পারছে না, প্রতি সেকেন্ডে তাঁরা বিব্রতকর অবস্থায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আজ অব্ধি যতো গুলো মেয়ে ধরে এনেছে তাঁরা প্রত্যেকেই কান্নাকাটি ছুটাছুটি করেছে। এই প্রথম দেখলো কোনো মেয়েকে এভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে।রূপজান মিশানকে প্রশ্ন করলো,
-তা তোমার নাম কি গো?
-মিসাইল।
-হি হি হি এইটা আবার কোনো নাম হইলো নাকি, এইরকম কারো নাম হয় নাহ।
-কারো হয় না বলে আমারও হওয়া যাবে না সেরকম কোনো নিয়ম আইন আছে?
-সে যাক গে,নামটা মানলাম । তা তুমি এতো রাইতে একা একা হাঁইটা কই যাইতাছিলা?বাড়ি থিকা রাগ কইরা বাইরাইছিলা?
-নাহ ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।
-এতো রাইতে কেউ ঘুরতে বাইর হয় নাকি।
-কেউ হয় না, আমি হই।
-পাগল নাকি এরা!আমি তো নেশা করে মাতাল হয়ে ছিলাম।হুঁশ জ্ঞান কিছুই ছিলো না, দেখে কি কিছুই বুঝে নি নাকি, আমি স্বাভাবিক ছিলাম না।
মনে মনে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে গত রাতে কি হয়েছিলো সেটা আবার মনে করার চেষ্টা করলো।
মিশান যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো তখন ওরা এক প্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যেই ওকে কিডন্যাপ করে, মিশান মাতাল না সুস্থ সেটা দেখার সময় ছিলো না।
চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর মিশান কাপটা সাইডে রেখে দিলো।
-চা টা বেশ ভালো ছিলো,আমি এখানে প্রায় ই আসবো এই চা খেতে। মাথা অনেক হাল্কা লাগছে,
-আরেক কাপ খাবা?
-নাহ!অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। খাবার যতোই মজা হোক, একবার খেলেই ভালো লাগে, বার বার না ।তারপর বলো তো আমি এখানে কি করে এলাম? আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, জায়গাটা কোথায় সেটাও জানি না, তবে চারপাশের পরিবেশ দেখে আন্দাজ করতে পারছি । তোমাদের চেহারা আর বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে প্রস্টিটিউড।
– বাংলায় কও, ইংরাজি বুঝি না।
-পেটের দায়ে শরীর বেচাবেচি চলে।
রূপজান মুখে পান থাকা সত্ত্বেও আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে বললো।
-ভালো বুঝছো মাথায় বুদ্ধি আছে।দুই একের মধ্যে আমাগো মতো তোমার জীবনডাও হইয়া যাবো, দুপুর বেলা খদ্দের আইতাছে দেশের বাইর থিকা।
-ওওও আচ্ছা,তা কোথা থেকে?
-মেলা দেশে থিকা আইবো, যে দাম বেশি দিবো তাঁরাই নিবার পারবো। তোমার দামাদামি হবো, চড়া দামে বেচার উদ্দেশ্য আমাগো।
একটু পরে সাজানের মানুষ আইবো,ভালোমতো সাইজা গুইজা তৈওরী অও।তোমার চেহারা সুরত ভালো, ভালো জায়গায় যাইবার পারবা,আমাগো চেহারা ভাল না তাই এই শহরে ছোট্ট একটা পতীতা পল্লিতে পইড়া আছি।
-আমাকে কি আপনারাই ধরে এনেছিলেন?
-হ।
মিশান কোনো রেসপন্স না দিয়ে, বিছানায় পা তুলে বসে । পা থেকে জুতো খুলে জুতার ভেতর থেকে কিছু জিনিস বের করলো।স্প্রিং, ছোটো বড় স্ক্রু , আরো নানান রকম ছোটো খাটো জিনিস, পায়ের গোড়ালির কাছে প্যান্টের ভাঁজ খুলে আরো কিছু জিনিস বের করলো।
সব কিছু এবার একটু একটু করে সেট করে কিছু একটার রূপ দিতে যাচ্ছে। মিশানের কারসাজী তিনজন মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে, মিনিটের মধ্যেই বস্তুগুলো এক করে পিস্তলের রূপ দিলো, সবার চোখ উল্টে যাওয়ার দশা। কি থেকে কি বানালো।
এরপর মাথার চুল গুলো থেকে মোটা গার্ডার খুলে ফেলার পর ঝরঝর করে বেশ কয়েকটা বুলেট বের হলো।
-এই বুলেট গুলোর ভেতরে যে গান পাউডার গুলো আছে সেগুলো আমার থেকে তেজস্ক্রিয় কেনো জানেন?
আমার মাথা অলটাইম থাকে হট তার ওপর যদি এরকম মাথার মধ্যেই বন্দী থাকে জিনিস গুলো,তাহলে ঘটনা কোথায় দাঁড়াতে পারে?
– মা মা মা মানে! এই মেয়ে এই সব খেলনা দিয়া আমাগো ডর দেহাইবার চাইতাছত?জানস ক্যারা আমি?
এই এলাকার সরদারনী আমি।
– আর আমি কি সেটা আমি কাজের মাধ্যমেই দেখিয়ে দিচ্ছি।
বুলেট গুলো লোড করে। ওদের দিকে তাক করে বললো,
-খুব বেশি ভাল হতো যদি একটা বুলেট একাধিক বার ব্যবহার করতে পারতাম। কতোই না ভালো হতো তাই না? টাকা পয়সার খুব অভাব রে।
সে যাই হোক। ঘটনা সেটা না এখন কথা হলো, আমার গান থেকে যতগুলো বুলেট তোদের পেটে যাবে, ততোগুলোর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আমাকে।
-রাজি?
তিনজনেই হাত উঁচু করে মিশানের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুনোর শক্তি নেই।
-এই পাঞ্জাবী এদিকে আয়!
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে মিশানের সামনে দাঁড়ালো ,
-জি জ্জি ম্যাডাম!
-তোর প্যান্টের বেল্ট খুলে এই দুটোকে পিটাবি।যতক্ষণ না আমি থামতে বলবো,তুই তোর কাজ চালিয়ে যাবি, যদি থেমে।যাস প্রতি সেকেন্ডে তোর পেটে একটা করে গুলি তোর পেটে যাবে ।
চল কাজে লেগে পর।
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের বেল্ট খুলে, মহিলা দুটোকে পেটানো শুরু করলো।মহিলা দুটো একেকটা বেল্টের বাড়ি খেয়ে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে” ওমা, ও বাবা গো বাঁচাও” বলে।
ওদের চিৎকার শুনে আশেপাশে থেকে অনেকে ছুটে এসেছে। মিশান পিস্তল নাচাচ্ছে, আর সামনে সরদারনী রূপজান আর তাঁর এসিস্ট্যান্ট মালেকা মার খেয়ে সাপের মতো আকুপাকু, বেচারা লোকটা না চাইতেও মারধোর করছে প্রাণের ভয়ে।
যাদের কিডন্যাপ করে ধরে এনে জোর করে এই পেশায় আনতে বাধ্য করেছে, তাঁরা যেনো এই দিনটির ই অপেক্ষায় ছিলো। পতীতা পল্লিতে সাধারণত সরদারনী রা অনেক অত্যাচার করে কর্মীদের উপর।একদিন টাকা কম জমা পড়লে তাঁর উপর নির্যাতন ও করা হয়।শারীরিক প্রহার করার হয়।
মার খেয়ে যখন আধমরা হয়ে পড়ে যায়
মিশান তখন উঠে দাঁড়ায়।
অই লোকটাকে বলে এবার নিজের গায়ে নিজে আঘাত করতে, বাধ্য হয়ে এরপর নিজের গায়ে আঘাত করতে লাগলো আর চিৎকার করতে লাগলো। সবাইকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে মিশান বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে,আর সকল কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললো,
-যাদেরকে এখানে জোর করে ধরে আনা হয়েছে, যারা এখানে থাকতে ইচ্ছুক না, নতুন ভাবে বাঁচতে ইচ্ছে যাদের,
তাঁরা চাইলে বেরিয়ে চলে যেতে পারে এখান থেকে,কেউ কিছু বলবে না, শুধু আমাকে ফলো করলেই হবে। শর্ত একটাই শরীর মুখ ঢেকে বের হও যেনো সাধারণ মানুষ তোমাদের দেখে নিচু নজরে না তাকায়।
এটা বলেই মিশান হাঁটতে লাগলো, মিশানের পিছু পিছু সবাই না বেরিয়ে গেলেও, বেশ কয়েকজন বেরিয়ে গেলো, যাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই জীবনের কাছে হেরে গেছে যারা, তাঁরাই রয়ে গেলো এখানে।
যারা নতুন ভাবে বাঁচার তীক্ষ্ণ আশা নিয়ে বেঁচে ছিলো তাঁরাই মিশানের পিছু নিলো ।
বাড়ির কলিংবেল বাজতেই মিশানের মামী গেট খুলে দিয়ে দেখলো
মুখ শুকনো করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিশান।মিশানকে দেখে মিশানের গালে হাত জড়িয়ে বললো,
-মা তোর মুখ শুকনো লাগছে কেনো?রাতে কোথায় ছিলিস?জানিস তোকে কত খুঁজাখুঁজি করেছি?মোবাইলটাও বাড়ি রেখে চলে গিয়েছিস।রাতে হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ছিটকে যাই।ঘুম থেকে জাগানা পাওয়ার পর তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করলো। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দেখি, তুই ঘরে তো নেই ই পুরো বাড়িতেও নেই।কোথায় গিয়েছিলিস মা?
-হাঁটতে বেরিয়েছিলাম রাতে,ভালো লাগছিলো না।
-কোথায় গিয়েছিলিস?ফিরতে এতো দেরি হলো যে?এতো রাতে কেউ বের হয় এভাবে? আমার মাথা শেষ হয়ে গেছে তোর চিন্তায়!
-কিডন্যাপ হয়েছিলাম হয়েছে? এবার আমাকে একটু খেতে দাও কিছু,খিদে পাচ্ছে কেমন জানি।
মামী মিশানকে ভেতরে নিয়ে যেতেই দ্বীপ অফিস যাওয়ার জন্য বের হবে তখন মিশানকে দেখে, ওর মাকে বলে,
-দেখেছো মা , বললাম না মিশান হাঁটতে বেরিয়েছে,সময়মতো ফিরে আসবে। খামোখা তুমি আজে বাজে চিন্তা করছিলে।
তুমি আমার কথা শুনলেই না।বাড়ির সবার মাথা খেয়ে দিচ্ছিলে।
জানিস মিশান মা তোর চিন্তায় এতোটা উদ্বেগ হয়ে পড়েছিলো যে পেশার হাই হয়ে অবস্থা খারাপ,রাতে মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে তাঁর হুঁশ ফিরে।
মিশান মামীর দিকে তাকিয়ে বিকৃত ভাবে বললো,
-কি অবস্থা! মিমি এমন কেনো করো?আমি বড় হয়ে গেছি।কেনো চিন্তা করো আমায় নিয়ে? আর আমাকে ডক্টর বলেছে যখনি ঘরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসবে সোজা খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে,যতক্ষণ না ভেতরে শান্তি অনুভব হচ্ছে ততোক্ষণ অব্ধি আমাকে এলোপাথাড়ি আনমনা গন্তব্যহীন হাঁটতে বলেছে।এতো রাতে তোমায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবো আমি বেরুচ্ছি?আর দ্বীপ তো জানেই আমাকে ডক্টর এই সাজেশন দিয়েছে।এখন বলো আমি কি ভুল করেছি ?
দেখো এতো হাঁটাহাঁটি করে মনটা হাল্কা লাগছিলো,তোমার কথা শুনে আবার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো।আমার শরীর ক্লান্ত লাগছে আমি আর হাঁটতে পারবো না, কিন্তু আমার মন ভালো করার জন্য বেরুতে হবে আবার।
-না না মা তুই এখন বেরুস না, তুই ড্রয়িংরুমে বস আমি তোর মন ভালো করার চেষ্টা করছি, তোর বেরুতে হবে না এখন।আর আমি কথা দিচ্ছি এরকম রাত বিরাত তোকে উধাও দেখলে আর কখনো ঘাবড়ে যাবো না, চিন্তা করবো না, তুই যেভাবে যা করে ভালো থাকবি আমিও সেভাবে তাতেই খুশি। তুই ভালো থাক মা।
(চলবে)
গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩০
লেখিকা- রিয়া খান
– মিমি তোমার কি কোনো কাজ আছে এখন?
-কেনো মা তোর কোনো দরকার?
মিশান ইগনোর করে বললো,
-নাহ এমনিই,কিছু না বাদ দাও।
-বল না রে, কথা ঠোঁটের আগায় এনে ঘুরিয়ে নিয়ে যাস কেনো সব সময়?
-ছোটো বেলায় যে তোমার কোলে আমার মাথা রেখে মাথায় তেল দিয়ে দিতে আর বিলি কেটে মাসাজ করে দিতে, আমার মাথা টা খুব হাল্কা লাগতো, মনে হতো আমার মাথায় কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
বনিতা বেগম মিশানের দিকে মলিন হেসে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে বললো,
– তোর যদি সময় থাকে তাহলে চল এখন। যতো বড় হচ্ছিস মিমির থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস, আগের মতো পাশে বসে দুটো কথাও বলিস না। একটা সময় লেখা পড়ার জন্য আমার থেকে দূরে যেতে লাগলি,তারপর চাকরি, আর এখন তোর ছন্নমতির জন্য। হ্যাঁ রে কখনো কি মনে হয় না, মিমির সাথে দুটো গল্প করি বসে? দরকার ছাড়া কোনো কথায় বলিস না, ঠিক মতো খেতেও পারিস না, আগে তোর স্বাস্থ্য কেমন ছিলো আর এখন কেমন হয়েছে দেখ।
মিশান আনমনে ভাব দেখিয়ে বললো,
-জানোই তো মিমি,আমার ভুলো মন।মাথায় কিছু ঠিক করে রাখলেও সেটা মনে থাকে না, ভুলে যাই কয়েক সেকেন্ড পর।
মিশানের কথা শুনে বনিতা বেগমের মন খারাপ হয়ে গেলো। মিশানের মাথাটা নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো।
কাজের বুয়াকে ঘর থেকে তেল এনে দিতে বললো, ড্রয়িংরুমে তেল এনে দেয়ার পর মিশান বনিতা বেগমের কোলে শুয়ে পড়লো,বনিতা বেগম মিশানের মাথায় তেল দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো,
-মিমি তোমার মনে আছে এরকম একটা দিনে আমি আর নিশান তোমাদের কাছে আসি।
-থাকবে না কেনো?আমাদের জীবনে দুটো পরীর আগমন হয়েছিলো।তবে আজকের দিনে তো না রে মা।
-আমি তো বলছি না আজকের দিনে, আমার এক্সাক্ট দিনটা মনে নেই মিমি,তবে এই সিজন টা এলে আমার সেই সময়টার কথা খুব মনে পড়ে, মনে পড়ে এই দিনেই আমি পরিবারকে হারিয়ে গেছি।আর তোমাদের পেয়েছি।
-ভাগ্যিস হারিয়ে গিয়েছিলিস,না হলে আমি তোদের পেতাম কি করে বল?
-কিন্তু মিমি, আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে। আমার মা আমাদের নিয়ে কোথায় ছুটছিলো আমি জানি না, কেনো ছুটছিলো তাও জানি না। আমাকে মা যেখানে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, সেটা একটা অন্ধকার জায়গা ছিলো, আশে পাশে কোনো গাড়িও ছিলো না, কেমন একটা জায়গা যেনো, তবে আইডিয়া করা যায় ড্রেজার মেশিংয়ের যে মোটা মোটা পাইপ গুলো আছে না, ওগুলোর স্তুপ ছিলো ওখানে।
আমি সেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এলাম কি করে? সব থেকে বড় কথা আমি মামার গাড়িতে কি করে এলাম?
-জানি না রে মা। হয়তো আল্লাহর কোনো কুদরত ছিলো। বিপদে ছিলিস হয়তো, আল্লাহ চায় নি বিপদ তোদের স্পর্শ করুক তাই হয়তো একটা ঘুমে তোর পৃথিবীটা বদলে গেছে।
-হুম সেটাই ধরে নিয়েছি মিমি।
মিশান চুপ করে গেলো, পুরো বছর পরিবারের কথা মনে না পড়লেও এই সিজনটাতে খুব মনে পড়ে, কারণ এরকম একটা সময়েই ওর জীবনটা আচমকা বদলে গেছে।
একটা ফাইভ স্টার হোটেল থেকে চার মিটার দুরত্বে তীব্র আর আব্দুর রহমান দাঁড়িয়ে আছে।পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো,
-তুমি কি হোটেলে ঢুকে গেছো?
-হ্যাঁ।
-আইডি কার্ড সেকেন্ড টা ইউজ করো।
-ওকে স্যার।
-ওকে বেস্ট অফ লাক।
কল কেটে দিয়ে পকেটে ভরলো ফোন।
-রহমান।
-জি স্যার।
-তোমার কাজটা কি মনে আছে?
-হ্যাঁ স্যার।
সিরিয়াল মেন্টেন করে শুধু বাটন ক্লিক করবো।
-আরেকবার চেক করো আমার লোকেশন ঠিকমতো দেখা যায় কিনা।
-ওকে স্যার।
আব্দুর রহমান গাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।গাড়ির ভেতর বেশ কিছু ডিভাইস ফিট করা ছিলো, রহমান চেকআপ দিলো , একটা ডিভাইসে তীব্র যেখানে যেখানে যায় তার লোকেশন শো করে আর ওর চারপাশের ব্যাকগ্রাউন্ডের কাঠামো শো করে,তীব্র যেদিকে যেদিকে যাবে রহমান এখান থেকে সেদিকের সিসি ক্যামেরা অফ করে দেবে,শুধু মাত্র একটা ডিভাইস বাটন ক্লিকের মাধ্যমে।
-এক্সকিউজ মি স্যার!
-ইয়েস।হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ ম্যাডাম?
-আই নিড এ হেল্প স্যার!
-প্লিজ টেল মি ইউর প্রবলেম ম্যাডাম।
-আসলে ম্যানেজার স্যারের সাথে দরকার ছিলো উনার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো।
-ঠিক আছে,আপনি বসুন।আমি স্যারকে জানাচ্ছি।
-ওকে।
-ম্যাডাম আপনার নামটা?
-অরবিন্দশ্রী
-ওকে ম্যাডাম,কাইন্ডলি বসুন স্যারকে আমি এখনি জানাচ্ছি।
-থ্যাংক ইউ।
স্টাফের সাথে কথা শেষ করে মিশান একটা সোফাতে পায়ের উপর পা তুলে বসলো।
স্টাফ ম্যানেজারকে কল দিয়ে মিশানের ব্যাপারে জানালো, ম্যানেজার সিসি টিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণের রুমে ছিলো।স্টাফের কাছে শোনার পর ফুটেজে মিশানকে দেখতে পেয়ে ওকে তাঁর কাছে পাঠাতে বললো।একজন স্টাফ এসে মিশানকে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যায়।ম্যানেজারের সামনে মিশান দাঁড়াতেই ম্যানেজার ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
-ছবিতে তুমি যতোটা সুন্দর, বাস্তবে তার থেকে হাজারগুণ বললেও কম হবে! এতোটা নিখুঁত তোমার রূপ!
মিশান লাজুক লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
-ইশ!এভাবে বলবেন না আমার লজ্জা লাগে তো!
-লজ্জা পেলে তোমায় আরো সুন্দর লাগে।
-আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমায় চিনবেনই না।
-আমার ধারণা ছিলো তুমি ছবিতে যতোটা সুন্দর বাস্তবে তার থেকে কম হবে, কিন্তু এখানে তো অন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছি! সত্যি তোমার রূপের প্রশংসা যতোই করি, কমই হবে।
তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো বসো।
-এখানেই বসবো?
ম্যানেজার একটু বিব্রতভাবে বললো,
-আসলে একটু কাজ আছে।যদি কিছু মনে না করো এখানে বসো,কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ফ্রি হয়ে যাবো।
-অনেক ব্যস্ত মনে হয় আজকে?
-হ্যাঁ মানে, আজকে একটা ভি আইপি গেস্ট এসেছে। হোটেলের যে মালিক সে আমাকে কড়া অর্ডার করেছে যেনো কোনো প্রকার অসুবিধায় না পড়তে হয় গেস্টের। আর সিকিউরিটি যেনো অনেক স্ট্রং থাকে।
যদিও গেস্টের জন্য অনেক গার্ড আছে তবুও সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আমাকে সিসি টিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণের রুমে থাকতে হচ্ছে, কোনো প্রকার সমস্যা হলে জবাবদিহি আমাকেই করতে হবে।
-তাহলে তো আমার আজ আসাটা ঠিক হয় নি,অন্যদিন আসতাম।
– না না, তুমি বসো।গেস্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হবে, ফিরতে অনেক লেট হবে। ততোক্ষণ আমি ফ্রি। একটু ওয়েট করো। আর তুমি তো বলেছিলে আমাদের রুমটা ফুল দিয়ে সাজাতে।আমি কনফিউজড ছিলাম তুমি আসবে কিনা। আমি এখনি লোক পাঠাচ্ছি,তোমার আমার স্পেশাল মোমেন্টের জন্য স্পেশাল ভাবে সাজানোর জন্য।
-ইশসস্!তাই ?
-হ্যাঁ গো! কখন যে তোমাকে নিয়ে একটু প্রাইভেট টাইম কাটাবো!সে জন্য যেনো আমার অপেক্ষা আর ফুরাবেই না।
-তবে যাই করুন, একটু তাড়াতাড়ি করবেন কেমন?আমার হাজবেন্ড অফিস থেকে ফেরার আগে আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।
-হবে হবে,চিন্তা করো না।
সব কিছু সময় মতো হয়ে যাবে। ততোক্ষণ আমরা খোশ গল্প করতে থাকি।
মিশান মিষ্টি হেসে বললো,
-ঠিক আচ্ছে!
উৎফুল্লতার সাথে ম্যানেজার মিশানকে বললো,
-শাড়িতে তোমাকে যা লাগছে না! উফফফ!একটু কোমর বেরিয়ে থাকলে, শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুটে ফুটে থাকলে আরো যা লাগতো না!
-আগে বললেই পারতেন।আপনি শুধু বলেছেন, লাল রঙের শাড়ি পড়ে আসতে।একটাবারও তো বলেননি শাড়ি পড়ার পর আমাকে এরকম দেখাতে হবে।
-ঠিক ঠিক আছে, সমস্যা নেই,পরের বার এমন একটা শাড়ি পড়বে, যেনো শাড়ির নিচের ব্লাউজ, তোমার পেট, নাভির সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়।
-শালা মাদারচো*! একটা কিক মারলে তোর ছটফটানি দিয়ে আত্মা বেরিয়ে যাবে, বুইড় ব্যাটা তোর এতো গ্যাড়া!তোকে তো আমার বাটে মারবো!
আর শালা তীব্র তোর হিসেব তো আলাদা ভাবে মেটাবো। কে জানে, এই ব্যাটার সাথে ও কি কি কথা বলেছে। আমাকে শুধু সারমর্মটা বলে পাঠিয়ে দিলো ভেতরে।
হায়রে ফেসবুক! এভাবেই তুই মানুষকে ধোঁকা দেস।
মনে মনে কথা গুলো বলতে বলতে মিশান ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দিলো।
মিশানের এক কানে মিনি ব্লুটুথ ইয়ারফোন লাগানো ছিলো, কানের উপর দিয়ে চুল দিয়ে ঢেকে এমন ভাবে রেখেছে যেনো কেউ দেখতে না পারে।
ওপাশ থেকে মিশানের সমস্ত কথোপকথন শুনতে পাচ্ছে তীব্র। মিশানের এপাশের অবস্থার প্রেক্ষিতেই তীব্র এগুচ্ছে।
মাথায় একটা স্পোর্টস ক্যাপ পড়ে চোখ ঢাকা ঢাকা করে,নাক মুখ মাস্ক পড়ে ঢাকা। পরিচিত লোক ছাড়া তীব্রকে কেউ চিনবে না এখন।আগে থেকে হোটেলের একটা রুম বুক করা ছিলো।ফর্মালিটিস পালন করে ভেতরের দিকে যায়, তীব্রকে রুম দেয়া হয়েছিলো আট নাম্বার ফ্লোরে।
একটা ফেইক আইডি খুলে তীব্র ম্যানেজারের সাথে মেয়ে সেজে প্রেম করেছে, আর আজ মিশানকে পাঠিয়েছে ম্যানেজারের সাথে ডেট করার ছলে যেনো, সিসিটিভি রুমে বসে তীব্রর কাজ শেষ না হওয়া অব্ধি ম্যানেজারের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে।এতে বাইরে থেকে আব্দুর রহমান যে সিসিক্যামেরা অফ করে দেবে সেটা ম্যানেজার খেয়াল করবে না, আর পরে যখন ফুটেজ খুঁজতে যাবে তখন কিছু খুঁজে পাবে না।
কাজ শেষ হলেই সব কিছু প্ল্যান মতো গুটিয়ে যাবে।
ম্যানেজারের সাথে মিশান কথা বলছে এমন সময় একজন স্টাফ এসে কোল্ড ড্রিঙ্কস আর কিছু স্ন্যাক্স ফুড দিয়ে দিয়ে যায়।ম্যানেজার তাকে বলে দেয় কেউ যেনো তাকে বিরক্ত না করে এখন।
ম্যানেজার একটা গ্লাসে ড্রিঙ্কস ঢেলে মিশানের দিকে দেয়, মিশান মিষ্টি হেসে ড্রিঙ্কস্টা নিয়ে চুমুক দেয় ।
– উফফ! তোমার অই নরম ঠোঁটের ছোঁয়ায় এই ঝাঁঝালো ড্রিঙ্কস গুলোও মনে হয় মৃদু হয়ে গেছে, মিষ্টির তীক্ষ্ণতা হয়তো বেড়ে গেছে!
-আপনি চাইলে আমার ঠোঁটে ছোঁয়ানো এই পানি পান করে নিজেকে স্বার্থক করতে পারেন।
-এতো আমার পরম ভাগ্য হবে গো!দাও দাও খেয়ে দেখি এক চুমুক।
মিশান হাতের গ্লাসটা ম্যানেজারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই ম্যানেজার লম্বা চুমুক বসায় তাতে,
-যতোক্ষণ মন না ভরে, খেয়ে যান। পুরোটা খেলেও সমস্যা নেই।
-ম্যানেজার মিশানের দিকে তাকিয়ে বোকা হাসি দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস চুমুকে চুমুকে পান করে যাচ্ছে। আর একটু একটু করে কেমন যেনো মাতাল মাতাল হয়ে যাচ্ছে।
মিশান ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে ডেভিল স্মাইল দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যানেজারকে কোল্ড ড্রিঙ্কস দেয়ার আগে মিশান হাল্কা করে ওর হাতের একটা আঙুল ডুবিয়ে দেয়,আঙুলের নখে এলকোহল মিশ্রিত এক ধরনের মেডিসিন লাগানো ছিলো,যেটা সাধারণ কোনো কোল্ড ড্রিঙ্কসের সাথে মিশিয়ে খেলে ক্ষণিক সময়ের জন্য মানুষের বুদ্ধিলোপ পায় আর মাতালের মতো বিহেভ চালায়,একটু ঝালটক মিশ্রিত কিছু খেলেই মানুষ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ওদের প্ল্যান মতো ম্যানেজারকে কাত করা হয়ে গেছে।
মিশান এবার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করছে আর তীব্রকে বলে দিচ্ছে কোথায় কে আছে, কোন দিক দিয়ে যাবে।
রিসেন্টলি হোটেলের সেই ভি আইপি গেস্টের রুম থেকে অর্ডার আসে কফি আর স্ন্যাক্স পাঠানোর জন্য।ভি আইপি গেস্ট টা ছিলো সাত নাম্বার ফ্লোরে।
মিশান কনট্রোল রুমে বসে বলে দেয় একজন স্টাফকে, স্টাফ ভি আই পি গেস্টের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়ার পথে তীব্র তাকে পেছন থেকে সেন্সলেস করে নিজের রুমে রেখে ড্রেস আপ চেঞ্জ করে স্টাফ সেজে খাবার নিয়ে নিজে যায়।
গেস্টটার রুমের চারপাশে অনেকগুলো গার্ড হাঁটাহাঁটি করছে।
তীব্র তাদের সামনে যেতেই তাঁরা কোনো প্রশ্ন করলো না, হাতে খাবারের ট্রলি দেখে ভেবে নিয়েছে স্টাফ এসেছে খাবার নিয়ে।
তীব্র ভেতরে নক করলো।
ভেতর থেকে উত্তর এলো প্রবেশ করার জন্য। খাবারের ট্রলি নিয়ে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়।
লোকটা একটা ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে আর মোবাইল স্ক্রল করছে।
তীব্র পেছন থেকে বললো,
-স্যার আপনার খাবার কি রেখে দেবো নাকি সার্ভ করবো?
লোকটা গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
-সার্ভ।
-ওকে স্যার।
খাবার সার্ভ করার টুংটাং আওয়াজ হলো, এরপর একটা কাপ লোকটার দিকে এগিয়ে দিলো, লোকটা কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই মুখের ভেতর থেকে ফিক্কে মারলো।
রেগে গরম মেজাজে বলে উঠলো,
-হোয়াট রাবিশ! এটা কোনো কফি?
তীব্র উত্তর না দিয়ে একদম সামনে দাঁড়িয়ে একটা প্লেট এগিয়ে দিলো,প্লেটে কয়েকটা বুলেট, গান, চাকু।
এগুলো দেখে লোকটা ঘাবড়ে গেলো।
তীব্র মাথা থেকে ক্যাপ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তীব্রর চেহারা দেখে রীতিমতো ঘাম ছুটে ফেলো এসি রুমে বসেও।
-তু তু তুমি!
তীব্র ফরমাল হাসি দিয়ে টি টেবিল টান দিয়ে সেটার উপর বসলো।
-যাক চিনতে পারলে অবশেষে!
একটা টিস্যু পেপার লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-ওটা কফি ছিলো না, একটা জন্তুর গরম করা টগবগে রক্ত।নাও টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে নাও, মুখে রক্ত লেগে আছে, লোকে দেখলে ভাববে তুমি জন্তু খেকো।
কি একটা অবস্থা হয়ে যাবে বলোতো?
-…………
লোকটা তীব্রর দিকে পলকবিহীন তাকিয়েই আছে।
-কি ভাবছো আমি ভূত?
তুমি হয়তো খোঁজখবর নাও নি আমার।ভেবেছো তীব্র মানুষ টা তো দূরে থাক, নামটা স্বর্ণদ্বীপের মাটিতে মিশিয়ে গেছে।
কাম অন! আই এম কাইন্ড অফ ফিনিক্স বার্ড!যার বিনাশ নেই, প্রতিটা মৃত্যুতে যে নতুন করে জন্ম নেয়!
তুমি যেটা করেছিলে দুবছর আগে সেটা ছিলো মৃত্যু নামের মাত্র খেলা। যেখানে তীব্রর বিনাশ হয়েছিলো মিছেমিছি। অভিজিৎ তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো, যেখানে তোমদের গুটির দান শেষ হয়,সেখান থেকে তীব্র ভাবে গুটি কিভাবে সাজাবে।
জীবন অনেকটা দাবা খেলার মতো, যার ব্রেইন আছে সেই জিতবে, আর যার নেই
(তীব্র বুড়ো আঙুল দেখালো)
সব থেকে বড় কথা এই খেলায় ধনী গরীব, পাওয়ার, প্রোপার্টি কিচ্ছু যায় আসে না। শুধু একটা জিনিস লাগে সেটা খেলার মতো “ব্রেইন “!
সো! খেলা কি শুরু করা যাক তাই নাকি?
-তুমি কিছুতেই তীব্র হতে পারো না, তোমাকে আমি এই আমি নিজের হাতে এই বুকে গুলি করেছি,ঠিক বাঁ পাশটাতে গুলি করেছি।
-সে হিসেব তো আছেই অভিজিৎ। বললাম না তুমি হয়তো আমাকে গণনা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছো, কিন্তু আমি দেই নি। দেখো না এইযে দু বছর পর তুমি বাংলাদেশে এসেছো, নিশ্চয় রাত এগারোটার সময় জাফরের সাথে দেখা করতে যাবে।
দেখো আমার সব নিউজ এসে গেছে এই কানের কাছে ।
এখনো আমি তোমাদের পিছু ছাড়ি নি কেনো জানো?এইযে বুকের মধ্যে যখন ব্যাথা উঠে আমার(বুকের বাঁ পাশে দেখিয়ে) সে দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। যতোবার চিনচিন করে ততোবার আমার গায়ের প্রতিটা শিরা উপশিরার রক্ত প্রচণ্ড বেগে ছুটাছুটি করে, আর মস্তিষ্কটা বার বার আমাকে বলে,তীব্র কবে অই পশুদের মারবি!
আমার চোখ আমায় ঘুম দেয় না, এই চোখকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। কতোটা যন্ত্রণা হয় আমি বলে বুঝাতে পারবো না তোমায়,প্রতিটা সেকেন্ডে শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা কবে আমার বাটের সময় আসবে! আর আজ সেই সুযোগের কিঞ্চিৎ সময় পেয়ে গেলাম।
লোকটা এদিক ওদিক তাকাতাকি করছে, হয়তো বাইরের গার্ডদের জানানোর চেষ্টা করবে।
-এদিকওদিক তাকাতাকি করে লাভ নেই,রুমটা ভেতর থেকে লক করা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ খুলতে পারবে না। সাউন্ড বক্সের হাই ভলিউম দিয়ে গান বাজালেও বাইরে থেকে কেউ শুনবে না। আজ এই ঘর থেকে হয়তো তুমি বের হবে নয়তো আমি।
জানোতো তীব্র মানেই তেজস্ক্রিয়, তীব্র মানেই ফিনিক্স বার্ডের বৈশিষ্ট্য!
বিনাশ নেই আমার ততোক্ষণ যতোক্ষণ আমি তোমাদের বিনাশ করতে পারবো।
তীব্র কিটকিটে হাসি হেসেই যাচ্ছে।
আর অভিজিৎ ঘাবড়ে গেছে কি করবে না করবে। ও ভালো করেই জানে তীব্র কতোটা ভয়ানক। অনেক কষ্টে তীব্রকে বিনাশ করায় সফল হয়েও অসফল হয়ে গেলো।
কিন্তু আজ কি করবে!আজ তো এই ঘরে একা, নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজেকেই লড়তে হবে।অপর পাশে তীব্র রিল্যাক্স হয়ে পায়ের উপর পা তুলে অভিজিৎকে বিভ্রান্ত করে তুলছে প্রতি সেকেন্ডে।
(চলবে)