গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩৩
লেখিকা- রিয়া খান
-একটা দিনকে আলোকিত করার জন্য যেমন এক টুকরো আলোর প্রয়োজন হয়, আমার জীবনটাকে আলোকিত করার জন্য এসেছিলো ঝলক।লোকটাকে প্রথম দেখে কখনো ভাবতেও পারিনি ভালোবাসবো।যখন ভালোবাসলাম তখন ভাবতেও পারিনি পথের শুরুতেই তাকে হারিয়ে ফেলবো।
তীব্র মিশানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-সে যদি ফিরে আসে তখন কি করবে মিশান?চলে যাবে তাই না?তুমি তো আমায় এমনিতেই দেখতে পারো না, সে ফিরে আসলে হয়তো আমায় ছেড়ে চলেই যাবে।আমি তো আর ভালোবাসতে জানি না।
মিশান তুচ্ছ হাসি দিয়ে বললো,
-অই যে বললাম না, আমি ভালোবেসেছি, প্রেমও করেছি, কিন্তু প্রেমিকা হতে পারি নি।
প্রেমিকার বৈশিষ্ট্য অব্ধিই যেতে পারিনি কখনো।তার আগেই সব হারিয়ে ফেলেছি।
কখনো ভাবতেও পারিনি,আমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ নামের শব্দ আসবে, অথচ দেখুন দিব্যি বিয়ে করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছি।
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম একজনকে,সেটার প্রতিফলন হলো আরেকজনের সাথে।
কোনো প্রতিশ্রুতিই আমি রাখতে পারিনি।মাকে কথা দিয়েছিলাম নিশানকে প্রোটেক্ট করবো,আমি পারিনি।নিশানকে কথা দিয়েছিলাম ,ওর মৃত্যুর সময়টাকে সুন্দর করে তুলবো,যেনো আমার বোনটা প্রশান্তিময় হাসিমুখে
বিদায় নিতে পারে,আমি পারিনি।
আর অই যে গোরস্তানে কবরে শুয়ে থাকা মানুষটা!তাকে কথা দিয়েছিলাম বিয়ে করে তাঁর বউ হবো, কথা রাখতে পারিনি।
যে নাকি আমার মলিন হাসির প্রেমে পড়েছিলো, সেই একদিন আমায় মলিন করে কাঁদিয়ে চলে গেছে।
সব মিলিয়ে প্রতিশ্রুতি শব্দটার উপর ভয় এসে গেছে।আচ্ছা যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারে, সে তো প্রতারক, তাই না?
আমিও কি প্রতারক? আমি তো দিব্যি নিজের রাস্তা আলাদা করে চলছি, রোজ রাতে অই মানুষটার অতীত বুকে চাপা রেখে মদের ঘোরে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি!
মানুষটাকে কখনো বুঝার চেষ্টাই করিনি পৃথিবীতে থাকতে। কখনো তাঁর বুকে মাথাও রাখা হয়নি,এমনকি নিজের বুকেও তাঁর মাথা রাখার সুযোগ দেই নি।
কি করেছি আমি?প্রতারণা? তবে হ্যাঁ,মন ভরে ভালোবেসেছি ঝলককে। খুব ভালোবেসেছি, কিন্তু সে ভালোবাসার কোনো পরিণত রূপ দিতে পারিনি।
তীব্র অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-ও মারা গেছে?
মিশান মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
-হুম।আজ ওর মৃত্যু বার্ষিকী। আজকের দিনেই ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের শেষ দেখাটা হয় না।
-কি করে মারা যায়?
-পরে একদিন বলবো আজ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
-সারমর্ম টা বলা যাবে একটু, তোমাদের প্রেমের?
মিশান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
জানেন, ঝলকের সাথে আমার পাঁচ মিনিটের উপর কথা হলেই ঝগড়া লেগে যেতো। কিন্তু ঝলক খেয়াল রাখতো যেনো কথা কাটাকাটির পর্যায় কান্না অব্ধি না যায়।যখন অভিমান করে অন্যদিকে ঘুরে থাকতাম,ঝলক উঁকি মেরে দেখতো আমি কাঁদছি কিনা, যদি দেখতো অভিমান করে আছি তাহলে আর মান ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করতো না। কিন্তু কেঁদে দিলেই ও দিশেহারা হয়ে যেতো।
সবার ধারণা আমি নেশা করি নিশানের কারণে ।কিন্তু আমি ড্রিঙ্ক করি ঝলকের মৃত্যুর পর থেকে।আমার না সহ্য হচ্ছিলো না যন্ত্রণাটা,নিশানের মৃত্যুর থেকেও কঠিন ধাক্কা পাই।কারণ নিশান মারা যাবে আমি জানতাম,দিনের পর দিন ওকে হারানোর প্রস্তুতিও নিতাম। কিন্তু ঝলক! হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেলো!কুয়েত থেকে ফিরে আমি বাড়ি না গিয়ে যখন ঝলকের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে ক্যান্টনমেন্টে আসি।আর এসেই আমি ঝলকের মৃত লাশটাকে পাই।একদল সৈনিক মাঠে প্যারড করে ওর মৃত লাশটাকে সম্মান জানাচ্ছে।
আমি চিৎকার করে কাউকে বলতে পারছিলাম না ওটা আমার ঝলক।আমি ঝলককে একটা বারের মতো জড়িয়ে ধরতে চাই।কিন্তু সেদিন আমার ভেতরে সমস্ত যন্ত্রণা মাটি চাপা দিয়ে চুপ করে সয়ে যেতে হয়। মুখ ছাপিয়ে কাঁদতে হয়েছে প্রতিটা সেকেন্ড।আশেপাশে দীনদুনিয়া কিচ্ছু খেয়াল ছিলো না। সেই ছোট্টো বেলায় আমার জীবনে হারানোর সন্ধ্যা নেমে আসে,মাঝরাতে হারাই ঝলককে, শেষ রাতে হারাই নিশানকে।এখন আমার জীবনে হারানোর অন্ধকার শেষ,হারানোর মতো কিচ্ছু নেই। যা হারাবে সব দিনে।
-আমি তো নিজের যত্নই নিতে পারি না, অন্যের যত্ন আর কি নেবো। ভালোবাসতেও জানি না।ভালোকরে কথা বলা তো দূরে থাক।তুমি জানো মিশান, আমার ব্যবহারটা বরাবর ই খারাপ,শুধু তোমার সাথেই খারাপ ব্যবহার করি সেটা কিন্তু না, আমি সবার সাথেই এমন ব্যবহার করি। তোমাকে এখন কি বলা উচিৎ আমি জানি না, নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে।
তীব্র মিশানের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে আস্তে করে বলে,
-সরি মিশান!নিজের জেদ প্রশ্রয় দিতে গিয়ে তোমার এতো বড় ক্ষতি করে দিয়েছি, আমি যদি জানতাম তাহলে কখনোই এরকম ভাবে তোমার মন ভাঙতাম না। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি!
মিশান মলিন হেসে দিয়ে বললো,
-সরি বলে কি হবে স্যার? আপনার সরি তে তো আর আমার ভাগ্য পরিবর্তন হবে না।আর ঝলকের মৃত্যুর পেছনেও আপনার কোনো হাত নেই।মানুষ টা মরে গেছে কিন্তু আমার মনে গেঁথে আছে। আমি জানিনা কখনো ঝলককে সরিয়ে অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারবো কিনা।ভেবেছিলাম পারবো,কিন্তু হয়তো পারবো না। কারণ অনেক চেষ্টা করেছি ওকে ভুলার।আমি বলে বুঝাতে পারবো না কতোটা ভালোবাসি ওকে, যতোটা ভালোবাসলে কাউকে হারিয়ে যায় মানুষ, ঠিক ততোটা ভালোবাসতাম, ভালোবাসি,আর ভালোবাসবো!
এইযে দেখুন না আপনি আমার বর অথচ আপনার জন্য আমার ভেতর একবিন্দু পরিমাণেও জায়গা নেই।আমার ভেতরে পুরোটা জুড়ে আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো।
মিশান নামের পাশে হয়তো তীব্রর নাম বসবে,কিন্তু মিশানের মনে শুধু ঝলক।
ঝলক এমন একটা মানুষ যাকে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব!
তীব্র হালকা গলায় কাশি দিয়ে বললো,
-তুমি চাইলে আমাকে যেকোনো শাস্তি দিতে পারো।তোমার কষ্টের জন্য আমিই দায়ী। বিয়েটা না করলে হয়তো তোমার কষ্ট টা কম হতো।
-তার কোনো দরকার নেই স্যার।আপনি এমনিতেও আমার উপকার করেই যাচ্ছেন।আর দেখুন আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন ঠিকি কিন্তু কখনো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন নি, তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আমাকে কেনো বিয়ে করেছেন আমি তাও জানি না, এতো করে জিজ্ঞেস করেও যখন উত্তর পাই নি,তাই এখন আর প্রশ্নটাকে প্রশ্রয় দেই না।
তীব্র একটু ডানে বামে তাকাতাকি করে বললো,
-থাকো তাহলে,আমি এখন যাই। কাজ আছে অনেক, হয়তো আজ ঢাকার বাইরেও যাওয়া হতে পারে। আসি এখন,আল্লাহ হাফেজ।
মিশান চুপ করে রইলো,তীব্র চলে গেলো জায়গা ছেড়ে।মিশান আবার নিরব দৃষ্টিতে গোরস্তানের দিকে তাকিয়ে রইলো।লম্বা অন্তিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে রইলো।
-আমার অভিমানের সময় কোথাও ঘুরতে না গিয়ে তুমি আমাকে এই জায়গাটাতে দাঁড় করাতে, আর অই কবর গুলো দেখিয়ে হারানোর ভয়ও দেখাতে,এখন সেই ভয়গুলোকে খুব মিস করে ঝলক। তুমিও হারিয়ে গেলে আমার ভয়টাও হারিয়ে গেলো। আমি বড্ড নিঃশ্ব হয়ে গেছি।
ঝলক তুমি কি আমাকে অনুভব করতে পারছো? কতোটা যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যায় আমার প্রতিটা রাত!
দেখো আমি নেশা করতে করতে এমন মাতাল হয়েছি যে, তোমার দেয়া এই শেষ উপহার গুলো প্রতিবছর পড়ে এখানে দাঁড়িয়ে সেই ভয় গুলোকে অনুভব করতে চাই। আমার ভেতরে কোনো ভয় কাজ করছে না ঝলক! আমি কি বদলে গেছি?
-মিশানের সাথে হয়তো একটু বেশি বেশিই করে ফেলেছি।ইচ্ছা অনিচ্ছাই অনেক কষ্ট দিয়ে দিলাম ।এতো বড় কষ্টের কারণ হবো কখনো ভাবতেও পারিনি। কি প্ল্যান ছিলো, আর কি হয়ে গেলো।সব ই ফ্লপ! মাঝখান থেকে মেয়েটার ভেতরের ক্ষতটাকে বাড়িয়ে দিয়েছি। ওর কথার সুরে এইটুকু স্পট বুঝলাম, ঝলক নামটার পাশে অন্য কোনো নাম বসাতে পারবে না। শুধু তীব্র কেনো পৃথিবীর কোনো ছেলেই হয়তো সেই জায়গা নিতে পারবে না।ব্যাপারটা ভালো লাগলো খুব,মানুষ মরে গেলেও মনে গেঁথে থাকে,ভেবেছিলাম মিশানের জীবনে কারো কোনো দাগ নেই,কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হলো,পাগলী টা মৃত নামটার প্রেমে আজও ব্যাকুল । নাহ, মিশানকে ওভাবে বিয়ে করাটা ঠিক হয় নি,ওকে অন্য ভাবেও লাইনে আনা যেতো।
এখন কি করা উচিৎ তাহলে? মিশানকে কি ডিইইভো….না নাহ ডিভোর্স দেয়া যাবে না।যেভাবে চলছে চলুক, অন্য কিছু ভাবতে হবে।
মিশানের কথাগুলো শোনার পর থেকে মিশানকে নিয়ে নানা রকম চিন্তা তীব্রর মাথায় ঘুরছে।এতো ভাবনা কখনো মিশানকে নিয়ে হয় নি, যতোটা আজ হচ্ছে।
মিশানকে বিয়ে করার জন্য হয়তো ওর ভেতরের ক্ষতটা আরো দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেছে তীব্রর ধারণা ।
বেশ কিছুদিন কেটে যায় মিশান তীব্রর দেখা হয় না, তীব্র নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আর মিশান ওর রুটিনে।
মন খারাপ লাগলে ঘরের ভেতর বসে থেকে কষ্টকে প্রশ্রয় না দিয়ে শহরের অলিগলিতে ঘুরেফিরে যেনো মিশান ওর দুঃখ গুলোকে লাঘব করে নেয়।
ড্রয়িংরুমে বসে দ্বীপের সাথে কথা বলছিলো মিশান, তাপসিন HSC এক্সাম দেয়ার জন্য রেডি হয়ে বের হয়, প্রতিদিন ওর সাথে ওর মা যায়,তবে আজ মিশান যাবে। তিনজন এক সাথেই বের হবে দ্বীপ মাঝপথে নেমে যাবে গাড়ি থেকে।
বনিতা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বের হয়।
তাপসিনকে কলেজের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মিশান, এরপর এদিক ওদিক হাঁটতে থাকে,এক্সাম শেষ হওয়ার আগে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
-এক্সাম কেমন হলো?
-ভালো কিন্তু!
-ফুল এন্সার করিস নি?
-সব এন্সারই ঠিকমতো দেই,প্রশ্ন কমনও পড়ে, সমস্যা হলো আমার হাতের লেখাটা মাত্রাতিরিক্ত খারাপ।মাঝে মাঝে কি ইচ্ছে করে জানো?খাতার উপর কালারিং পেন দিয়ে হেডলাইন করে আসি”ইগনোর মাই হ্যান্ড রাইটিং “।
মিশান তাপসিনের কথা শুনে হেসে দিয়ে বলে,
-থাক ব্যাপার না,তুই তো সাইন্সের স্টুডেন্ট। হ্যান্ড রাইটিং কোনো ফ্যাক্ট না, উত্তর সঠিক হলেই হলো।
-তা হলে কি হবে।বাংলা, ইংরেজি এগুলোতে নাম্বার এগুতে চায় না, এই সাবজেক্ট গুলোতে স্যার রা হ্যান্ড রাইটিং দেখে নাম্বার দেয়।
-ব্যাপার নাহ,বাকি গুলো ভালো হলেই হবে।
-দোয়া রেখো।
তাপসিনের সাথে কথা বলতে বলতে মিশান আনমনে গাড়ির ভেতর থেকে বাইরের দিকে তাকাতেই কেউ একজনকে দেখতে পেলো।
মিশান সাথে সাথে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে,গাড়ি থেকে নেমে তাপসিনকে চলে যেতে বলে।
একজন বয়স্ক মহিলা, হসপিটালের ভেতর ঢুকছে, মহিলাটা তীব্রর মা। মিশান তাকে দেখা মাত্রই বিদ্যুৎ গতিতে চিনে ফেললো।মনে মনে ঠিক করলো কোনো রকম তাঁর সাথে পরিচয় হয়ে সেরাতের জন্য ক্ষমা চাইবে।
তীব্রর মায়ের উদ্দেশ্যে বের হলেও হসপিটালের ভেতর ঢুকে তাকে কোথাও খুঁজে পায় না। এদিক ওদিক ছুটে ছুটে খুঁজতে লাগে, কিন্তু পায় না।অনেক্ষণ পরে হসপিটাল থেকে বের হতেই দেখতে পায় তীব্রর মা গাড়িতে উঠছে,একটুর জন্যই তাকে বরাবর ধরতে পারছে না । দৌড়ে কাছে যাওয়ার আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়, মিশান আবার ব্যর্থ হলো তাকে ধরতে।
তবুও হতাশ না হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে পিছু লাগলো।তীব্রর মায়ের গাড়ি থামাতেই
মিশানও সিএনজি থামাতে বলে।
রাস্তায় তৃপ্তি দাঁড়িয়ে ছিলো ওর দুই বাচ্চা নিয়ে,ছেলে মেয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে আবার স্টার্ট দিলো,মিশান আবার পিছু নিলো।কড়া জেদ চেপেছে মিশানের, আজ যেভাবেই হোক উনার সাথে কথা বলেই বাড়ি ফিরবে।
একটা স্থানে বিশাল জায়গা জুড়ে মেলা হচ্ছে , সেই মেলাতে যাওয়ার জন্য তীব্রর মা বোন একত্র হয়েছে। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে উনারা, পেছন পেছন মিশানও
ঢুকে যায়, তাদের একদম কাছে গিয়ে পেছন থেকে ডাক দেবে তার আগেই কেউ একজন পেছন থেকে মিশানের চুলের ঝুটি ধরে টান দিয়ে মুখ ছাপিয়ে ধরে একটা স্টলের পেছন নিয়ে নেয়। মিশান ছুটার চেষ্টা করার আগেই ওকে ছেড়ে দেয়া হয়, পেছন ঘুরে দেখে ওর জীবনের খলনায়ক তীব্র।
-কিরে সেন্টিখোর, শুনেছিস আমি শহরে নেই আর মিশনে নেমে গেছিস?ভালো বুঝে তোকে কিছু দিনের জন্য ছাড় দিয়েছি আর তুই এই প্রতিদান দিচ্ছিস?
-আমি আবার কি করলাম?
-সেই কখন থেকে দেখছি মায়ের পিছু নিয়েছিস,একদম মেলার ভেতর অব্ধি এসে গেলি।মায়ের কাছে যাচ্ছিলি?কি দরকার?কোনো কাজ আছে মায়ের সাথে?
-আপনার মা? কোথায়?দেখালেন না তো! আপনার মাও আছে আবার?মেলাতে এসেছে উনি? কোথায় মাদার ইন ল?পরিচয় করিয়ে দেবেন না স্যার?
তীব্র রাগীস্বরে বললো,
-এই সেন্টি,এই!খবরদার নাটক করবি না, তোর সমস্ত এক্টিভিটিস আমি ফলো করেই ধরেছি, তুই কি ভাবিস এতো সহজ সব?তীব্রর একটা অদৃশ্য স্পাই ক্যামেরা আছে সেটা সব সময় তোর পিছু লাগানো থাকে।
-আরে স্যার এভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছেন কেনো?লোকে কি ভাববে বলুন তো?আমি তো মেলাতে এসেছি এমনিই ঘুরতে।
-অই যে আবার নাটক করছে! মিশান তাতলামো করো না। এখান থেকে সোজা বাড়ি চলে যাবে।আর কখনো যেনো মায়ের পিছু লাগতে না দেখি।
মিশান তীব্রর দিকে ডেভিল স্মাইল দিয়ে তীব্রর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো, তীব্র ভ্রুঁ বাঁকিয়ে মিশানের দিকে তাকালো,মিশানের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখনি জড়িয়ে ধরবে ।
-এটা আবার কোন নাটক?
মিশান তীব্রকে জড়িয়ে ধরার মতো করে ওর কাছে গিয়ে সোজা তীব্রর পকেটে হাত দিলো, আর দুই মুঠি ভরে টাকা বের করে।পাব্লিক প্লেস বলে তীব্র কোনো সিনক্রিয়েট না করে চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলো।
-আহা! র্যাব হোন আর পুলিশ হোন, পকেট ভরতি টাকা আর টাকা!মেলায় যখন এসেছিই কিছু কেনাকাটা করবো না তাই?
কিন্তু স্যার এগুলো তো কম পড়ে যাবে!এগুলো তো ঝুরা টাকা,আপনার ওয়ালেট থেকে কিছু বড় টাকা দিন না!
তীব্র রিয়্যাক্ট না করে, উল্টো চাল মেরে বললো,
-টাকা দিয়ে কি করবে।একমাত্র বউ তুমি আমার, চলো তুমি যা কিনবে আমি কিনে দেবো।
কথাটা বলেই মিশানের কোমর আর হাত ধরে সামনের দিকে নিয়ে যায়। রহমানকে ইশারা করে,ওর মা কখন কোন দিকে যায় সেটা দেখে দেখে ওকে জানানোর জন্য।
তীব্রর এভাবে জড়িয়ে ধরাটা মিশানের মাঝে আতংক এনে দিলো । এভাবে যদি তীব্র ওকে ধরে হাঁটতে থাকে তাহলে মিশানেরই প্রেজটিজ যাবে। কোনো রকম তীব্রর হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে মারলো এক দৌড়, তীব্র ওর দৌড় দেখে কিটকিটে হাসি দিলো।
অফিস টাইমে হঠাৎ করে তীব্রর ফোনে কল আসে তৃপ্তির নাম্বার থেকে,রিসিভ করে কানে নিতেই তৃপ্তি খুব উত্তেজিত ভাবে বলে উঠে,
-ভাইয়া তুমি কোথায়?তুমি কি অফিসে?
-কেনো কি দরকার?
-আদিব ভাইয়া কি অফিসে আছে?
-জানি না,কেনো?
-আদিব ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। দীপ্তি এক্সিডেন্ট করেছে ওর অবস্থা খুবই খারাপ। তোমার নাম্বারটা আদিব ভাইয়া ছাড়া দীপ্তির ফ্যামিলির আর কারো কাছে নেই, আদিব ভাইয়াকে পাওয়া যাচ্ছেনা বলে তাঁরা আমাকে বললো তোমাকে বলতে যেনো আদিব ভাইয়াকে বলতে পারো।
দীপ্তির এক্সিডেন্টের কথা শুনে তীব্র থ হয়ে গেলো। পায়ের তলার মাটি যেনো বাঁধছে না।
-এই রাত করে দীপ্তির এক্সিডেন্ট হলো কি করে?
-আমি কিছু জানিনা ভাইয়া। আমি মাত্র শুনলাম এটা।এক্সিডেন্ট নাকি দু ঘন্টা আগে করেছে।
আমি হসপিটালে যাচ্ছি এখন, মা বাবাও যাচ্ছে। তোমার সময় থাকলে দেখতে যেতে পারো।এখন শুধু একটা কাজ কষ্ট করে করো, আদিব ভাইয়ার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা।
-আদিব তো ডিউটিতে আছে,ওর ফোন সুইচড অফ।ওর ডিউটি মেবি চারটাই শেষ। তৃপ্তি তুমি যাও দীপ্তির ওখানে, আমি আসছি।
হসপিটালের নামটা জেনে ফোন টা কেটেই তীব্র অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
হসপিটালে পৌঁছাতেই দেখে দীপ্তির পরিবারের লোকজন বসে বসে কাঁদছে। দীপ্তির মা তীব্রর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অনবরত,তীব্রর মাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, দীপ্তি কেমন আছে কেউ বলছে না ।
ICU থেকে একজন নার্স বের হবে তখন তাঁর সামনে তীব্র দাঁড়ালো, তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো দীপ্তি লাইফ সাপোর্টে আছে।
তীব্র দীপ্তির সাথে দেখা করতে চাইলে ডাক্তার নার্স সবাই বারণ করে,কিন্তু তীব্র না শোনার বান্দা না, জোর পূর্বক ভেতরে প্রবেশ করে দেখে দীপ্তির মাথা থেকে শুরু করে ওর দেহের একাংশ ব্যান্ডেজ করা, অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে বেডে, নিশ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেন মাস্কটাও লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
-সরি দীপ্তি! এ জীবনে তুমি সুখের মুখ দেখে যেতে পারলে না। আই উইশ তুমি মরেই যাও।রোজকার যন্ত্রণা সহ্যকরার থেকে মরে যাওয়া অনেক বেটার।
আমার হাত পা বাঁধা। আমি আবারও বলছি,তোমাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে আমি তোমার কাছে ঘৃণার পাত্র হতে চাই না, তোমার জীবনটা খাদে ফেলতে চাই না।
(চলবে)