তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-৩৬

0
107

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩৬
লেখিকা- রিয়া খান

আপনাকে হয়তো বলা হয়েছে আমার ট্রেনিংয়ের সময় নিশানকে আমার সাথে থাকা এলাও করা হয়েছিলো। নিশানের অবস্থা জানার পর কেউ আপত্তি করে নি আমার সাথে নিশানের থাকা নিয়ে, আর আপত্তি থাকলেও প্রকাশ করতো না, কারণ মামা ছিলো।
কিন্তু এসবের মধ্যে ঝলকের আপত্তি ছিলো, সিনিয়রদের জানায় রুলস ব্রেক করা যাবে না , আইন অধিকার সবার সমান। বার বার আমাকে খোঁটা দিতো কর্নেলের ভাগ্নি বলে এক্সট্রা ফেভার নিয়ে চলবো এটা হবে না।রুমে এসে একদিন এটা নিয়ে খুব তেঁতো কথাও শোনায় আমায়।আমি চুপচাপ শুনে যাই,কারণ আমার সহ্য করতে হবে।আমার টার্গেট ছিলো, আগে নিজের গোলে পৌঁছাবো এরপর এর সাথে টক্কর নেবো।ঝলককে সিনিয়রদের কেউ বুঝাতে পারছিলো না, আমার সমস্যা টা, নিশানের সমস্যাটা। ও শুধু একটা কথা বলেই থামিয়ে দিতো, “এগুলো সব বাহানা” ওর এই বাড়াবাড়ি গুলো আমি নিতে পারছিলাম না, যেখানে সিনিয়রদের প্রবলেম নেই ওর এতো কিসের প্রবলেম।মানলাম ক্যাডেটের স্টুডেন্ট ছিলো সব সময় রুলস মেনে তাদের বেড়ে উঠা,চাকরী জীবনেও রুলস মেন্টেন করে রুলস তাঁর রক্তে মিশে গেছে, তাই বলে মানুষের বিপদ আপদ বুঝবে না?

তীব্র মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ঝলক ক্যাডেট ছিলো?
-হুম। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, চিটাগাং।
আপনি তো মির্জাপুর ক্যাডেটের স্টুডেন্ট ছিলেন তাই না?
-হুম,তারপর বলো।
-এরপর আর কি, আমি তবুও চুপ থেকে যাই। এক কান দু কান করে যখন ব্যাপারটা নিশানের কানে যায় তখন নিশান সাহস করে ঝলকের সাথে কথা বলতে চায়,আমি ভিতু হলেও নিশান অনেক বেশি সাহসী মেয়ে ছিলো, কোনোকিছু ভেতরে চাপা রাখতো না, যখন যেখানে যেটা বলা উচিৎ করা উচিৎ সেটাই করতো আর বলতো।

ঝলকের সাথে প্রায় দু ঘন্টার মতো সময় ধরে, ও কি কথা বলে, ওকে রাজি করায় সেটা আজও অজানা আমার।এরপর থেকে ঝলককে কখনো দেখতাম না আমার সাথে নিশানের থাকা নিয়ে ভেজাল করতে।
যখনি নিশানের সাথে ঝলকের দেখা হতো, ঝলক নিশানের দিকে অন্যরকম মায়া দৃষ্টিতে তাকাতো ওর সাথে ভালোমতো কথা বলতো, ঝলককে কখনো আমি হাসতে না দেখলেও নিশানের সাথে কথা বলার সময় বেশ হাসতে দেখতাম।এটা আমার কাছে ভালোই লাগতো এট লিস্ট আমার সাথে যেমন ব্যবহার ই করুক নিশানের সাথে ভালো ব্যবহার করছে এটাই সোনা সোহাগা।
আমার সারাদিনের পরিশ্রমের কারণ নিশানের ঠোঁটে হাসি ফুটানো।

ঝলক আমাকে কড়া শাসনে রাখলেও আমি মাথায় রাখতাম না। মাঝে মাঝে যখন পড়ার সময় বই খোলা রেখে নিশানের সাথে কথা বলা শুরু করে দিতাম অমনিই ভেতরে কোনো না কোনো অফিসার এসে পড়তো, তাঁরা পানিশমেন্ট না দিলেও দুর্ভাগ্য বশত যখন ঝলকের কাছে ধরা খেতাম তখন রুমের সামনে করিডোরে এক পা উঁচু করে দাঁড় করিয়ে রাখতো, অন্যান্যদের তুলনায় আমাকে কম পানিশমেন্ট ই দিতো।আমার মতো অনেকেই ছিলো কথা বলার অপরাধী ওদের কেউ কাউকে তো বুক ডাউন দেওয়াতো, ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটতে পাঠাতো, মাঠে দৌড়াতে পাঠাতো,কানে ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে হাঁটতে দিতো, আরো অনেক রকম পানিশমেন্ট, সেসব অনুযায়ী আমার পানিশমেন্ট অতি তুচ্ছ ছিলো। কানের পিঠ দিয়ে বেঁচে যেতাম শুধু,হয়তোবা প্রতিটা পরিক্ষায় হাইস্ট রেজাল্ট করতাম বলে কিংবা কর্নেলের ভাগ্নি বলে।

আমার ট্রেনিংয়ের সময়টা যাচ্ছিলো রুদ্ধশ্বাসময়। এমনিতেই এতো পরিশ্রম করতে হতো তার উপর ঝলকের করা মেন্টালি টর্চার।
তিনটে মাস ঝলকের কবলে থাকতে হয়, দিনে রাতে যে কত অভিশাপ দিতাম ওকে হিসেব নেই।

ট্রেনিংয়ের তিনমাস পর ঝলকের পোস্টিং হয়ে যায়, আমি তো ঈদের চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি।ঝলক চলে যাওয়ার পর পর সাতদিনের ছুটি পাই আমরা তবে কয়েকজন বাদে, যারা ট্রেনিংয়ে পারফরমেন্স খারাপ করে, রেজাল্ট খারাপ করে তাদের ছুটি দেয়া হয় না,ইম্প্রুভের জন্য তাদের আটকে রাখে।

সাতদিন ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরতে হয় ট্রেনিং সেন্টারে।
ঝলকের অন্য জায়গায় পোস্টিং হওয়ার পর আর কোনো অফিসারের ঝাড়ি বকা খেতে হয়নি, ততোদিনে আমি পাকাপোক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, কাজে ভুল খুব কম হতো, হতোই না বলা চলে। আমার ক্লান্তি দূর করার জন্য তো নিশান সাথে ছিলোই, সাথে ওর চেহারাটা যতোবার দেখতাম আমার ভেতরে স্পিড বেড়ে যেতো।

ঝলকের প্রতি এতোটা বিরক্ত ছিলাম ও চলে যাওয়ার পর সব কাজে রিল্যাক্স রিল্যাক্স ফিল হতো অন্য রকম শান্তি অনুভব হতো । কিন্তু সুখ কি আর বেশিদিন টেকে আমার কপালে? দু মাস যেতে না যেতেই ঝলক আবার পোস্টিং পেয়ে এসে পড়ে আমার হাড় জ্বালাতে।আমার কাছে ঝলক কখনো স্বীকার করে নি একটা ব্যাপার, সেটা হলো ওর এই ট্রান্সফার হয়ে আসার পেছনের কারণটা আমিই ছিলাম, ও ইচ্ছে করে ট্রান্সফার নেয়। এটা ঝলক কখনো আমার কাছে স্বীকার করেনি,হয়তো লজ্জা পাবে বলে।

সে সময় আমি ধরে নিয়েছিলাম ঝলক আমাকে জ্বালানোর জন্যই ফিরে আসে। আর ফেরার পর ঠিক তেমনটাই হয়।

আমার নাইটমের প্রবলেম টা ছোটো বেলা থেকে হলেও ওটা প্রখর ছিলো না, নিশানের অসুস্থতার কথা জানার পর থেকে সব সময় চিন্তিতো থাকতাম ওকে নিয়ে, ভেতরে একটু একটু করে ভয় জায়গা করে নিতে থাকে, আর ঝলক মারা যাওয়ার পর থেকে ওটা প্রখর হয়, নিশান মারা যাওয়ার পর প্রখরতার হার আরো হাজারগুণ হয়ে যায়।
সে যাই হোক সে সময় আমার ঘুম খারাপ হতো না।যেহেতু আমার চোখে ঘুম অনেক বেশি, তাই ট্রেনিংয়ের সময় আর কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হলেও ঘুমের সম্মুখীন হতে হতো আমার।ক্লাসে ঘুমিয়ে যেতাম, মাঠে ঘুমিয়ে যেতাম, যেখানে সেখানে কাজের ফাঁকে একটু স্পেস পেলেই ঘুমিয়ে যেতাম।এমনও হয়েছে অনেক দূরের পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে বসেই ঘুমিয়ে যেতাম।এগুলো ঝলক খুব খেয়াল করতো যার ফলে পানিশমেন্টও পেতাম।

এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বলে ইয়াবা খেলে নাকি ঘুম চলে যায়,আর গায়ে অনেক শক্তি আসে।সরল মনে আমি তাঁর সাহায্যে ইয়াবার আশ্রয় নেই। জিনিসটা খাওয়ার পর কারেন্টের বেগে ফল পেলাম, ঘুম আসতো না আমি চাইলেও, আবার শরীর ক্লান্তও লাগতো না। আমি তো ওটা পেয়ে সেই খুশি।রেগুলার আমি ইয়াবার উপর ডিপেন্ড করতে শুরু করলাম আর আমার এমন ফুরফুরা পরিণতি ঝলকের অই বাজ পাখির মতো চোখে আটকায়,ও আমার এক্টিভিটিস ফলো করতে করতে কিভাবে কিভাবে যেনো আমাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে তো আমি আমার মাঝে নেই। ঝলক আমাকে মারবে না কাটাবে দিশে পাচ্ছিলো না।আমাকে তো ডিসকোয়ালিফাই করে দেবে বলে হুমকি দেয়। আমি ক্ষমা চাইতে চাইতে বেহুঁশ,হাতে ধরবো নাকি পায়ে ধরবো দিশে পাচ্ছিলাম না।
শেষমেশ ও রেগে গিয়ে ডিসিশন নেয় এই ব্যাপারটা আমার মামাকে বলে দেবে, আমি তো ভয়ে আরো শেষ,ঝলকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোর করে বলি
-প্লিজ স্যার! মামাকে বলবেন না।মামা অনেক কষ্ট পাবে। আমি আমার কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি,মামাকে বলবেন না কিছু প্লিজ!
এর বিনিময়ে আপনি আমাকে যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেবো,আমাকে যদি রাতভর ঠান্ডা পানিতে হাত-পা বেঁধেও
রেখে দেন আমি সহ্য করে নেবো স্যার প্লিজ!আপনি যা বলবেন আমাকে আমি তাই ই করবো।
-যা বলবো তাই ই করবেন ?
-হ্যাঁ স্যার!
-ঠিক আছে, আমার সাথে একটা রাত কাটাবেন। পারবেন?
ঝলকের মুখের কথা শুনে আমি একদম শুন্যে ডুবে গেলাম, এরকম কথা শোনার জন্য আমি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলাম, আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না।ঝলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার রিয়্যাকশন দেখে যাচ্ছিলো শুধু ।আমার মনে হচ্ছিলো আমার পায়ের তলায় মাটি আর মাথার উপর আকাশ কোনোটাই নেই!ভয়ার্ত দৃষ্টিতে হ্যাং হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
এরপর ও দাঁড়িয়ে থাকা থেকে আমার সামনে বসে নরম স্বরে বললো,
-দেখুন মিশান খান। মাইন্ড করবেন না, আমি আপনাকে সহজ ভাষায় কিছু ইনফরমাল কথা বলছি। যেহেতু আমার জুনিয়র তাই , তুমি সম্বোধন করায় মাইন্ড না করার অনুরোধ রইলো।

ঝলক একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে আরো নরম স্বরে বলা শুরু করলো,
-ফার্স্ট অফ অল,
তোমার মামার থেকে বাঁচার জন্য আমার সাথে রাত কাটানোটা অযৌক্তিক, আর বাজে দেখায় ,তোমার জীবন নষ্ট করার জন্য এটাই যথেষ্ট। হয়তো আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দেবে তোমাকে । তেমনটা ঘুম তাড়ানোর জন্য ইয়াবার আশ্রয় নেয়াটাও অযৌক্তিক, জিনিসটা শুধু বাজে দেখায় না এটা তোমাকে ধ্বংস করে দেবে। একদিন দুদিন এটা ট্রাই করতে করতে তুমি এটার উপর এডিকটেড হয়ে যাবে। তোমার রক্তের কণিকা গুলোকে অসুস্থ করে দেবে, যে নিশানকে বাঁচানোর জন্য তুমি রক্ত দাও সে নিশান সময়ের আগেই মরে যাবে, তোমার খারাপ রক্ত ওর ভেতর প্রবেশ করে।ইয়াবা তোমার মস্তিষ্ককে বিকিয়ে দিতেও সময় নেবে না।
তোমার ঘুম তাড়ানোর জন্য অনেক ভালো ভালো টিপস আছে সেগুলো ফলো করো, ওয়ার্কআউট করো,মাঠে দু চক্কর দৌড় লাগাও,সুইমিং পুলে সাঁতার কাটো, প্রয়োজনে চা খাও বেশি বেশি, ৮০% মানুষের চা খেয়ে চোখের ঘুম তাড়াতে সক্ষম হয় । কয়েকটা মাস সহ্য করো, একবার অফিসার হয়ে বের হলে তোমার এই সব পরিশ্রম ত্যাগ বিজয়ের হাসি হাসবে।আর যদি নিজের নিয়মে এভাবে চলতে থাকো তাহলে সফল তো হবেই না উল্টো হেরে গিয়ে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে। সব সময় টেনশনে থেকে ভুল কোনো স্টেপ নিও না, তোমার প্রতিটা কদমে আমার শুধু একটা জিনিসই চোখে বেশি লাগে, নিজের জীবনের প্রতি মায়া বড্ড কম। নিজেকে ভালোবাসতে শেখো, তবেই অন্য কাউকে ভালোবেসে তাঁর জন্য কিছু করতে পারবে।আজ অব্ধি যারা ছোটো বড় কাজে অবদান রেখেছে তাঁরা প্রত্যেকেই সবার আগে নিজেকে ভালোবেসেছে। নিজেকে ভালো রেখেই অন্যের ভালো করা যায়।

তোমার সামনে অনেকটা পথ বাকি আছে,এ জীবনে অনেক কিছু আছে।তুমি চাইলে, তোমার জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তোমার মাঝে যথেষ্ট মেধা আছে, প্রতিভা আছে, চেষ্টা করার মনোবল আছে, জেদ আছে,শক্তি আছে,আর কি চাই?তোমার মাঝে প্রয়োজনীয় সব কটা উপকরণ ই আছে যখন, তাহলে কেনো তুমি নিজেকে গড়ে নেবে না? সুন্দর ভবিষ্যৎ তোমার হবে না তো হবে কার?
মানুষ জীবনে আসবে যাবে তাই বলে অতীত নিয়ে পড়ে থেকে হতাশ হয়ে নিজের ক্ষতি কখনো করো না।
কথা গুলো মাথায় রেখো। ফল পাবে।
আই উইশ তুমি ফার্স্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখো। স্টেডিয়ামের একপ্রান্তে বসা থেকে দাঁড়িয়ে তোমার ফ্যামিলি আর তোমার বোন ঠোঁটে স্বার্থক হাসি নিয়ে বিজয়ের করতালি দেবে,তোমায় নিয়ে গর্ব করবে । এই রকম একটা উজ্জ্বল দিনকে নিজের আয়ত্তে আনো।
এভাবে ভুল পথে এগুলে কিছু হতে পারবে না অভিশাপ ছাড়া।টেক কেয়ার অফ ইউর সেল্ফ মিশান।

কথা গুলো বলা শেষ করে ঝলক আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। আমি নির্বাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। ঝলকের মুখে এতো নরমাল ভাবে কথা বলাটা খুবই আনএক্সপেক্টেড ছিলো।অনেকটা ভূতের মুখে রাম নাম।
তবে ঝলকের সেই কথাগুলো একটাও ফেলে দেয়ার মতো ছিলো না, সব সঠিক ও যুক্তিবল সম্পন্ন ছিলো।

আমি শুধু নিরব হয়ে ওর কথাগুলো মাথার ভেতর রিপিট করছিলাম।সেদিন প্রথম ঝলক আমাকে তেঁতো কথা না শুনিয়ে মোটিভেট করে, অথচ সেদিনই আমি পানিশমেন্ট পাওয়ার কাজ ই করেছিলাম।
বিশ্বাস করুন সেদিনের পর থেকে আমি মিশান কোনো স্টেপে ভুল করেও ভুল করিনি।

সেদিনের পর থেকে ঝলকের প্রতি আমার অনুভূতি বদলে যেতে থাকে,একটা সম্মানীয় জায়গায় ওর স্থান হয়। ঝলকও কেনো জানি আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করতো না, প্রতিটা কাজে সাহায্য করতো, ভালোমতো বুঝাতো,সুন্দর করে সতর্ক করতো।

আমার সাথে চোখে চোখ পড়লেই ও একটা ফরমাল হাসি দিতো, যেটা আমার বুকে তীরের মতো লাগে। ধারণার বাইরে ছিলো লোকটা আমার ভেতরে এতো সুন্দর করে জায়গা করে নেবে।একটা সময় যেখানে ঝলক সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রতিটা মিনিটকে কয়েক দিন মনে হতো, সেখানে দিনের পর দিন ঝলককে দেখে সময় সেকেন্ডের গতিতে কেটে যেতো।আমার মনে হতো সময় থেমে থাকুক,আমি এভাবেই থাকি, ভুল করি আর ঝলক আমায় শাসন করুক, পানিশমেন্ট দিক, আমি সেসব বরণ করে নেবো।

আস্তে আস্তে মাসের কাঁটা যেনো সেকেন্ডের গতিতেই কেটে গিয়ে আমার ট্রেনিং শেষ হলো, রেজাল্ট দেবে, আমি নার্ভাস!আর সেই সময় ঝলকের আবার ট্রান্সফার হয়। ও দেখে যেতে পারলো না আমি সফল হোলাম নাকি ব্যর্থ।

স্টেডিয়ামের মাঝখানে ফরমাল বেশে, প্যারড করে সিনিয়র সহ প্রেসিডেন্টকে স্যালুট করে, টিমের প্রত্যেকেই যখন হার্টবিটের সাথে সময় গুণছি আমাদের ভবিষ্যৎ ফলাফলের জন্য, সেই সময় স্টেডিয়ামের চারপাশে আমাদের প্রত্যেকের আপনজনেরা মনে আশা নিয়ে চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের উপর।আমি যতোটা উত্তেজিত আর ভয়ার্ত ছিলাম আমার ফলাফল নিয়ে,আমার চোখ ততোটাই ব্যাকুল ছিলো স্টেডিয়ামের চারদিকে ঝলককে খোঁজায় । মনে হচ্ছিলো যদি আজকের দিনে ঝলককে, একটাবার দেখতে পারতাম! আনমনে হয়ে চোখ আমার ঝলকের দিশারী সে সময় ফলাফল ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে,তৃতীয়তে আমি নেই,দ্বিতীয়তে আমি নেই, প্রথমে এসে গেলাম! নামের পাশে ক্যাপ্টেন মিশান খান বসে গেলো সেদিন থেকে, স্বর্ণপদক নিয়েও আমার মুখ শুকনো ছিলো। কারণ একটাই,আজকের সাফল্যের দিনে ঝলক নেই, যে ঝলক আমাকে এতো দূর এগিয়ে দিলো,সাফল্যের পথ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সেই ঝলক আমার আশেপাশেও নেই,টান্সফার হওয়ার সময় আর পেলো না!

আমি কনফিউজড ছিলাম আমি কি এই দিনটার অপেক্ষাই ছিলাম নাকি এই দিনে ঝলককে সামনে থেকে দেখতে চেয়েছিলাম,ওর দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে বলতে চেয়েছিলাম” স্যার আমি পেরেছি বিজয়ের দিনটাকে আয়ত্ত করতে!”
সেদিন ছিলো না ঝলক, কেনো জানি সেদিনের পর থেকে আমার প্রতিটা সেকেন্ডে ঝলকের কথা মনে পড়তো, ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে যখন হাঁটতাম মনে হতো এই বুঝি ঝলক পেছন থেকে ডেকে উঠলো, কিংবা সামনে এসে দাঁড়ালো।
ট্রেনিং সেন্টারের প্রতিটা স্থানে দিনে একবার হলেও যেতাম যদি ঝলকের সাথে দেখা হয়ে যায়, সেই আশায়।
যে ট্রেনিং সেন্টার একটা সময় প্রকন্ড বিরক্তির নাম ছিলো সেটাই সব থেকে বেশি আপন মনে হতে লাগলো,মনে হতো এই খানেই পড়ে থাকি,এই জায়গাগুলোতে থেকে আমার সাফল্যযাত্রা শুরু, এই খানটাতে আমার ঝলকের সাথে দেখা।

ভেতরটা এতো অশান্ত ছিলো যে মনটা ঝলকের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো।
যেখানে একটা মানুষ প্রেমে পড়লে তাঁর প্রেমিকের কথা মনে পড়লে লজ্জা পায়,সেখানে আমার দশা ছিলো চিন্তিতো, শুধু মনে হতো কবে দেখা হবে!

রাস্তা ঘাটে গাড়ি ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করতাম, যদি একটাবার দেখা হয়ে যায় ওর সাথে,গাড়িতে থাকলে তো আর দেখা হবে না।

এভাবেই চলে যাচ্ছিলো আমার দিনকাল। প্রথম বছর আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। এই একটা বছর ঝলকের জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি, কখনো ওর দেখা মিলেনি।

একবছর পর আমার ট্রান্সফার হয় রাঙামাটির কাপ্তাই ক্যান্টনমেন্টে ।
আমার সেখানে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো,এদিকে নিশান আমার পিছু ছাড়ছিলো না, ও আমাকে ছাড়া থাকতে নারাজ হয়।আমি ওকে শান্ত্বনা দেই প্রতি বৃহস্প্রতিবার নাইট পাশে বাড়ি আসবো, কিন্তু ও শোনার বান্দা না । এরপর মামা মামীও বললো নিশানকে তাহলে সাথে নিয়ে যেতে, আমি সেখানে একটা একরুমের বাসা ভাড়া নিই। আমি তো আনম্যারিড ছিলাম তাই কোয়াটারে বাসা পাই নি,আর লেডিস ম্যাসে চাইলে নিশানকে নিয়ে থাকতে পারতাম কিন্তু ওটা আমার পছন্দ ছিলো না।তাই ক্যান্টনমেন্টের নিকটেই একটা বাসা ভাড়া নিই।
নিশানকে নিয়ে সেখানে উঠি।
এরপর ক্যান্টনমেন্টে প্রথমদিন গিয়েই আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আমাকে যে ইউনিটে দেয়া হয় সেখানে গিয়েই দেখি ঝলক! ঝলকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো এটা আমার মস্তিষ্কের বিভ্রম! সব সময় ঝলকের কথা চিন্তা করতে করতে হয়তো এখন চোখে ভুল দেখাও শুরু করেছি। তখন ঝলক আমার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে চুটকি বাজায়, আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে দেখি এটা আসলেই ঝলক। সৌভাগ্যবশত আমি ঝলকের ইউনিটের মেম্বার হই সেদিন থেকে। একটাবছর পর আমার জন্য এতো ভালো কিছু অপেক্ষা করছিলো যে আমি কখনো কল্পনাও করে উঠতে পারিনি।

কেনো যেনো উনাকে দেখে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে পড়েছিলো,এতো বেশি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি কাঁপা গলায় বলছিলাম,
-স্যায়ায়ায়ায়ার আপনি!
-কেনো এক্সপেক্ট করো নি?আমি কিন্তু জানতাম তুমি এখানে আসবে।সো স্যাড ক্যাপ্টেন মিশান খান ! তুমি আবারও আমার আন্ডারে চলে এলে, আবার আমার টর্চার সহ্য করতে হবে! মনে মনে অনেক গালী দিচ্ছো তাই না?

আমি মুচকি হেসে বলি,
-একদম ই না স্যার! আমি খুবই খুশি হয়েছি আপনার সাথে দেখা হওয়াই। হাজার হলেও আপনি পরিচিত মুখ।
-হুম্ম,তোমার চেহারা দেখে কথাটা বিশ্বাস ই হলো যে তুমি খুশি।
আজ অব্ধি আমি তোমার ঠোঁটে হাসি দেখিনি কখনো, আগের কথা না হয় বাদ ই দিলাম,তখন না হয় ক্যারিয়ার নিয়ে টেনশনে ছিলে।গত একবছরে একটাবারও হাসি দেখিনি তোমার, এমনকি তোমার সেই প্রতিক্ষাময় সাফল্যের বিজয়ের দিনেও তোমার হাসি আমার চোখে পড়লো না! কি আজব!

ঝলকের কথাটা শুনে রীতিমতো অবাক ই হোলাম,
-স্যার আপনি সেদিন স্টেডিয়ামে ছিলেন?
-হুম, কেনো তুমি আমাকে দেখোনি?
-কই না তো!আমি আপনাকে সেদিন কতো খুঁজলাম একটা নজর ও দেখিনি।আপনি একটাবার আমার সামনে আসবেন না? কাজটা ঠিক হয়েছে কি স্যার?
-এতোগুলো মানুষের ভীড়ে আমাকে খুঁজলে পাবে কি করে?আমি তো অফিসারদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর
আমি অনেক ব্যস্ত ছিলাম, দেখা করতে চেয়েছিলাম করতে পারিনি।
-সেদিন না হয় ব্যস্ত ছিলেন, এরপর কি আর ফ্রি হোন নি? তখন দেখা করা যেতো না?পুরো একবছরে আপনার ছায়াও মেলেনি।
-আসলে কি বলোতো,তোমাকে দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে, কারণ দূর থেকে বুঝা যায় না তোমার মন খারাপ নাকি ভালো, কাছে এলেই বুঝা যায় তুমি চিন্তিতো,মন মরা,ঠোঁট থেকে হাসি শুকিয়ে গেছে।তোমার সাথে মন খারাপ মানালেও মন মরা মানায় না। বিরহীনি বিরহীনি ভাব নিয়ে চলো,যেনো ছ্যাকা খাওয়াই সেঞ্চুরি করে ফেলেছো। একটু হাসিখুশি থাকতে পারোনা?
-হাসির মতো কোনো ঘটনা ঘটলে তো হাসবো।অকারণে হাসবো কেনো?
-তাহলে এখন হাসছো কেনো?কি এমন হাসির ঘটনা ঘটলো যে হাসছো,আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না।
-হাসির কারণ তো আপনিই।
-মানে কি!আমাকে কি জোকারের মতো লাগছে?
– না না এরকম কিছু না।
-আমি আবার নানা হোলাম কবে তোমার?

আমি খলখল করে হেসে দিয়ে বলি,
-স্যার আপনি কিন্তু বেশ হাসাতে জানেন।এতোদিনে বুঝতে পারিনি।
-তাহলে কি এখন সেনাবাহিনীর চাকরী ছেড়ে দিয়ে কমিডিয়ান হবো?

আমি আর কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না, হেসেই যাচ্ছিলাম।
-আচ্ছা হাসো,তোমার হাসি দেখতে ভালোই লাগছে।এইটুকু সময়ে তোমার তিন রকমের হাসি দেখে ফেললাম।
-কি কি হাসি?
-ঠোঁট টিপে হাসি, মুচকি হাসি,হাসির উপর খই ফুটা হাসি মানে খলখল শব্দময় হাসি।
-হি হি হি! তারপর বলুন স্যার,ট্রিট কবে নিচ্ছেন?

ঝলক চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-কিসের ট্রিট?
-আপনার শাসন, মোটিভেশন, সাপোর্ট এসবের কারণে আমার নামের পাশে ক্যাপ্টেন বসেছে।আপনি না থাকলে হয়তো নামের পাশে নেশাখোর বসতো। ক্যাপ্টেন মিশান খান না হয়ে নেশাখোর মিশান খান হতো।আমার জায়গা ক্যান্টনমেন্টে না হয়ে রিহ্যাবে হতো।

ঝলক মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
-তোমার মাথায় বুদ্ধি প্রচুর, কিন্তু সমস্যা কোথায় জানো?
তোমার বুদ্ধি গুলো সঠিক জায়গায় খাটাতে পারো না।
তাই তোমার গাইড লাইন হয়ে সঠিক পথ দেখানোর কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টা আমার।
মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও তুমি আমার আন্ডারেই থাকবে, আর এই মেজর ঝলক তোমার হাড় জ্বালানোর জন্য সদা প্রস্তুত।
-আর ক্যাপ্টেন মিশান খানও সদা প্রস্তুত আপনার টর্চার টলারেট করার জন্য স্যার।
-নিশান কি বাসাই একা?ওকে সাথে করে আনতে ক্যান্টনমেন্টে।
-আপনি জানলেন কি করে স্যার,নিশান আমার সাথে এসেছে?

ঝলক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
-খোঁজখবর রাখতে হয় তো!
-ব্যাপার টা স্বাভাবিক লাগলো না স্যার।
-তুমি কি জানো নিশানের সাথে আমার রেগুলার কথা হয়?
-কই না তোহ!নিশান তো আমাকে একটাবারও বলেনি এ কথা।
-কিজানি তাহলে আর কি।তোমাদের বোনের ব্যাপার তোমরাই বুঝো।
নিশান মেয়েটা সত্যিই অনেক ভালো, তোমার মতো বোকা না।
-হতে পারে! আল্লাহ তো আমার বোনটার হায়াত কম দিয়েছে তাই হয়তো সর্বগুণ সম্পন্ন হয়েছে।
-মন খারাপ করো না, তোমার মন খারাপ ভালো লাগছে না।এতোদিন পর তোমার হাসি দেখছি,হাসতে থাকো।
-তাহলে আপনি হাসির কথা বলুন।
-চলো ওদিকটাই ঘুরিয়ে নিয়ে আসি তোমাকে,কত হাসবে চলো।
-চলুন।
– আর শুনো কেউ জিজ্ঞেস করলে বলো না তুমি আমার পূর্ব পরিচিত।
-ওকে স্যার।

(চলবে)