গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৩৭
লেখিকা- রিয়া খান
আগে ঝলকের সাথে তেমন কোনো ইনফরমাল কথাবার্তা না হলেও।ক্যান্টনমেন্টে সেদিন প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে বেশ ভালোই কথা শুরু হলো।ঢাকা থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পর একমাত্র পরিচিত মুখ ছিলো ঝলক,সেজন্যই হয়তো আরেকধাপ আপন আপন লাগছিলো ওকে। মনে হচ্ছিলো নিজের কাছের লোক।
প্রথমদিন ওর সাথে কথা বলতে বলতে এতোটা ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম,আমি ভুলে গিয়েছিলাম ঝলক আমার সিনিয়র। আর ঝলকও বুঝতে দেয় নি ওর কথার মাঝে।অথচ এই লোক একটা সময় আমার দোষ ধরা নিয়ে পিছু লাগতো, বাজপাখি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো সেই কিনা এতো স্পেস করে দিচ্ছে তাঁর সাথে মিশে যেতে!
ব্যাপারটা সেই মুহূর্তে খেয়াল না হলেও বাসায় যাওয়ার পর নিশান যখন হঠাৎ তাঁর কথা তোলে, আমার তখন খেয়াল হয় আসলে কি হচ্ছে।
আমরা যে বাসাটাতে উঠি সেখানে একটা কাজের লোকও পেয়ে গিয়েছিলাম। যে বাসার সব কাজ করে রাখতো, শুধু রান্নাটা বাদে,ওটা আমি আর নিশান মিলে করে নিতাম।বেশিরভাগ সময় আমিই করতাম,সকালে ইউনিটে যাওয়ার আগে রান্না করে রাখতাম আবার রাতে বাসায় ফিরে রান্না করতাম।
নিশান বাসায় একা থাকবে বলে তো হাবিজাবি খাবার অঢেল রেখেই দিতাম, ঘরের ভেতরেই ছোটোখাটো একটা দোকান।
একদিন রাতে কিচেনে আমি রান্না করছিলাম সে সময় হঠাৎ নিশান আমার পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে।আদর মাখা কণ্ঠে ডেকে উঠে,
-আপিইইইইই!
-বল।
-তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হচ্ছে না, জানি না ব্যাপারটা কিভাবে নেবে,রাগ করো না প্লিজ!
-কি এমন কথা, যেটা তোর মুখে শোনা সত্ত্বেও আমি রাগ করবো?
নিশান হেসে দিয়ে বলে,
-আমার মনে হয় না রাগ করবে,তারপরেও ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখলাম আরকি।
-আচ্ছা বল,যাই বলিস, স্বাভাবিক ভাবে নিবো,কিন্তু অবশ্যই সেটা তোর সাইডে পজিটিভ হতে হবে!
নিশান একরাশ আফসোস নিয়ে বললো,
-ওপ্স! আপিইই সব সময় সব কথায় কেনো তুমি আমাকে জড়াও?আমি জানি তুমি নিশান সংক্রান্ত কোনো নেগেটিভ নিউজ নিতে পারো না, তাই বলে সব সময় তুমি কেনো এতো আতংকে থাকো? আতংকে থাকার কথা তো আমার তাই না?
একটু ফ্রি হতে পারো না? অসুস্থ তুমি নাকি আমি?তোমার এই চিন্তিতো মুখ দেখে আমি আরো অসুস্থ হয়ে যাই।
-ওকে সরি বেহেনা!এবার বল কি বলবি।
নিশান আবার হেসে দিয়ে বললো,
-জানো ঝলক ভাইয়া না তোমাকে অন্নেক পছন্দ করে।
-উনার সাথে দেখা না কথা না,সবে দুদিন আগে দেখা হলো।
এই দুদিনে সে আমাকে কি করে পছন্দ করলো?
-এমন ভাবে বললে যেনো দুদিন আগেই তোমাদের পরিচয়!
-দুবছর পড়বে তাঁর সাথে তোমার পরিচয়। আর তুমি অফিসার হওয়ার পর তো ঝলক ভাইয়ার কোনো খোঁজ ই রাখো নি এই এক বছর, তাই এখন দেখে নতুন লাগছে। কিন্তু ঝলক ভাইয়া তো তোমাকে ভালোবাসে বলে এই একবছরে তোমার ঠিক খোঁজখবর রেখেছে।
-কিভাবে খোঁজ খবর রেখেছে?
-আমাকে রোজ এসএমএস দিতো, কল দিতো, তোমার খোঁজ নিতো,ঢাকায় গেলে আমাকে জানাতো,আর তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিতাম।
-আমার সাথে কবে দেখা করালি?
-একটু খেয়াল করোতো আপি।আমি হুট করেই বায়না ধরতাম শপিং করবো,আর শপিংতে যেতাম, মলের এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে কিছু না কিনেই বাড়ি ফিরে যেতাম,আবার পরদিন অন্যকিছুর বায়না ধরতাম,একটানা প্রতিদিন কিছুনা কিছুর বায়না ধরে
আমি তোমাকে নিয়ে বাইরে বের হোতাম বিভিন্ন ছুতোয় । সেসময় ঝলক ভাইয়া ছুটি কাটাতে ঢাকায় ফিরতো, যতোদিন থাকতো ততোদিন তোমায় নিয়ে বের হোতাম। আর সেটুকু সময় ঝলক ভাইয়া তোমাকে দূর থেকে দেখতো। এমনও হয়েছে রেস্টুরেন্টে আমরা খেয়েছি বিল ঝলক ভাইয়া দিয়েছে, আর আমি তোমাকে আটকাতাম এটা বলে, বিল “আমি দেবো”
-ওরি ব্বাবা! কাহিনী তো জলের থেকেও বেশিদূর চলে গেছে।
নিশানের মুখে কথাগুলো শুনে আমি রীতিমতো হ্যাং হয়ে যাই।কিরকম মাস্টার প্ল্যানিংয়ের সাথে আমাকে বোকা বানিয়েছে ওরা, আমি কিছুই টের পেলাম না!
নিশান আমার চেহারার অবস্থা দেখে হেসে গলে পড়ছিলো, আমি যতোটা অবাক হয়েছিলাম ততোটাই খুশি হচ্ছিলাম।আমি তো ঝলককে পছন্দ করি সেটা শিউর ছিলাম,কিন্তু ঝলকও আমায় পছন্দ করে সেটা সত্যিই আমার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছিলো না, অপ্রত্যাশারও একটা লিমিট থাকে।নিশান আমার হাত দুটো জড়িয়ে বললো,
-আপিইই ঝলক ভাইয়াকে নিজের জীবনে জায়গা করে দিও। ভাইয়া একটা মাটির মানুষ! অনেক ভালো সে।তোমার জীবনে হাসিটাকে প্রিজার্বেটিভের মতো সংরক্ষণ করার জন্য এই ঝলক ভাইয়াটাকে খুব প্রয়োজন।যে তাঁর জীবনের ঝলক দিয়ে তোমার জীবন আলোকিত করে রাখবে।
আমি মলিন হেসে নিশানের গালে হাত রেখে বলি,
– ঠিক আছে, তোর কথা রাখবো।কিন্তু আমার ছোট্ট একটা শর্ত আছে।
-কি শর্ত?
-ঝলক যদি আমাকে এখন বিয়ে করতে চায়,তাহলে আমি বিয়ে করতে পারবো না।আমি তোর চিন্তা ছেড়ে সংসারের চিন্তা করতে পারবো না।দেখা যাবে বিয়ের পর আমি তোর খোঁজ ই নিচ্ছিনা ঠিক মতো,সময় দিতে পারবো না।দেখা যাবে দায়িত্ব পালনের জন্য আমার ঝলককে ৭০% সময় দিতে হচ্ছে আর ৩০% তোকে।তারপর দেখা যাবে আনফরচুনেটলি কোনো একদিন জানবো আমি প্রেগন্যান্ট, তখন দেখা যাবে যে সময়টুকু তোর জন্য বরাদ্ধ ছিলো, সেটাও থাকবে না।আমার বাচ্চাকে সুস্থ রাখার জন্য সেটুকু সময় আমার নিজেকে দিতে হবে।
আমার পুরোটা জুড়ে তুই নিশান,তুই ছাড়া আমি আমার জীবনের সময়গুলোকে অন্য কাউকে দিতে চাচ্ছি না, তুই ঝলককে বলে দিস আমার ওকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে কোনো আপত্তি নেই,কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না ।
আমি তোর সাথে লেপ্টে থাকতে চাই।
তোর শারীরিক ইম্প্রুভমেন্ট না দেখা অব্ধি আমার ভেতরে শান্তি নেই নিশান। এজীবনে হয়তো তোর সব স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতে পারবো কিন্তু তুই যদি বলিস আমাকে বিয়ে করতে,তাহলে আমার এইটুকু স্বার্থপর হতেই হবে, আমি বিয়ে করতে পারবো না।
-আরে আপি,তুমি এমন মন খারাপ করছো কেনো?তোমাকে বিয়ে কে করতে বললো?ঝলক ভাইয়া একবারও বিয়ের চাপ দেয় নি,তোমরা আগে একে অপরকে চেনো, জানো, নিজের ভেতরে সেই অনুভূতি সম্পর্কে জানান দাও।দ্যাটস ইট! খামোখা সব বিষয়ে প্যারা নাও!
ওফফ নিশান, কেনো যে তুই মিশানের বোন হতে গিয়েছিলিস! মেয়েটার জীবনই নষ্ট করে দিছিস নিশান!
– তুই রাগ করলি নিশান? আচ্ছা কানে ধরছি, আর পেনিক নেবো না। তুই ঠান্ডা হ,আর এই গরম খাবারটা খা।
নিশান খাওয়ার কথায় কান না দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে,
-আপিই, তোমাকে আমি বললাম ঝলক ভাইয়াকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে।তুমি রাজি হয়ে গেলে। তুমি কি শুধু আমার মুখে হাসি ফুটাতে নিজের উপর জুলুম করে রাজি হয়ে গেলে?
-এ না না! একদম ই না। ঝলক স্যার খারাপ কোথায়! আমিও উনাকে পছন্দ করি অনেক,কিন্তু কখনো ভাবিনি উনিও আমাকে পছন্দ করবে। আমি হজম করতে পারছি না উনিও আমাকে পছন্দ করেন, এটা স্বপ্ন না বাস্তব আমি আলাদা করতে পারছি না, সেজন্য আমার রিয়্যাকশন দেখে নেগেটিভ লাগছে।
নিশান কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে গোয়েন্দা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-তাহলে তুমি কখনো বলোনি কেনো আমায়?
-তুই তো কখনো জিজ্ঞেস ও করিস নি,জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই বলতাম।আর ঝলক স্যারের সাথে দেখা হয় নি কথা হয়নি বলে, ব্যাপারটা প্রকাশও পায় নি।
-ঠিক আছে বুঝলাম। তোমরা দুজন দুজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো একে অপরের অজান্তে। যাই হোক তোমার রান্না কতদূর?
-শেষ,শুধু প্লেটে সার্ভ করা বাকি।
-সার্ভ করতে থাকো আমি আসছি।
কথাটা বলেই নিশান বেডরুমে চলে গেলো, এই দফাতেও নিশান আমাকে আবার বোকা বানিয়ে যায়, সেদিন বুঝতে না পারলেও পরে বুঝে উঠি।নিশান আমার সাথে কথা স্টার্ট করার আগেই ঝলককে কলে রেখেছিলো, ওর সাথে আমার যা যা কথোপকথন হচ্ছিলো, ঝলক এ টু জেট ফোনের ওপাশ থেকে শুনে নিয়েছে।যেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঝলক সব জানে, লজ্জাই আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারিনি। কথাও বলতে পারিনি।
ঝলক কখনো আমার সামনে প্রকাশও করেনি,ও যে সব জেনে গেছে। আমিই কিভাবে কিভাবে যেনো বুঝে গেছিলাম নিশানের অঙ্গভঙ্গি দেখে।নিশানকে চেপে ধরার পর যখন স্বীকারোক্তি দেয়,আমি পুরো ঠাসসস! মনে হচ্ছিলো আকাশ থেকে ঠাডা পড়ুক আমি মাটির নিচে ঢুকে যাই!
আমি যখন লজ্জায় ঝলকের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না তখন ঝলক নিজেই বাধ্য হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-বিয়েটা যে এখনি করতে হবে সেরকম কোনো ধরা বাঁধা শর্ত নেই।
আমি কিন্তু একবারও বলিনি, আমাকে বিয়ে করো এখন। অনেকে তো মেজর ঝলক নাম শুনেই ভাবে ছেলের বয়সটা অনেক হয়ে গেছে,কিন্তু কয়জন জানে আমি ক্যাডেট থেকে এসেছি?
আর বড় কথা হলো,আমার পরিবার থেকেও বিয়ের কথা এখনো উঠেনি।
সো আমারও বিয়ের চাপ নেই।তোমার তো বিয়ের প্রশ্নই আসে না।আমার পরিবার থেকে যতদিন বিয়ের কথা না বলছে,ততোদিন আমিও মুখে আনবো না।
একটা সমস্যা আছে আমার ফ্যামিলিতে, ওটা সলভ হতে সময় লাগবে,ততোদিন আমিও তোমার কথা ফ্যামিলির কারো সাথে শেয়ার করতে পারবো না।না হলে সমস্যা আরো বেড়ে যাবে।
তোমার যেহেতু চাপ নেই,আর চাপ হবেও না আমি শিউর, সেজন্য আমি নিশ্চিন্তো।
অনেকের লাইফে এরকম থাকে না যে, প্রেমিক তাঁর পরিবারে প্রেমের কথা জানাতে পারে না, আর ওদিকে প্রেমিকার ফ্যামিলি থেকে বিয়ের চাপ থাকে,প্রেমিক তাঁর পরিবারে জানাতে জানাতে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায়।
তুমি কি জানো তুমি কতো লাকি,এরকম একটা ফ্যামিলিতে বিলং করো,সাথে আমিও লাকি।
-আমাকে বিয়ের প্রেশার দেয় না, আমাকে আমার পরিবার স্বাধীন করে দিয়েছে সেজন্য আমি আসলেই লাকি।কিন্তু আপনি লাকি কি করে?
-অই যে তোমার উপর বিয়ের চাপ নেই,আমারও প্যারা নেই।
-আমি কি আপনার প্রেমিকা?
-নাহ,তুমি আমার ইউনিটের জুনিয়র অফিসার, ক্যাপ্টেন মিশান খান!
-হি হি হি..!
-দুজন মানুষ একসাথে সারাজীবন কাটানোর প্রতিজ্ঞা করলে, সেখানে
একে অপরকে জানার থেকে বুঝাটা বেশি জরুরী। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে একে অপরকে বুঝার জন্য।একে অপরকে বুঝতে বুঝতে যদি বুড়ো বুড়িও হয়ে যাই তাতেও সমস্যা নেই,শেষ বয়সেই বিয়ে করে নেবো।
এখন কথা হলো, আমাকে বুঝার জন্য,বা তোমাকে বুঝানোর জন্য, আমার সামনে তোমার প্রেমিকা সাজতে হবে না,প্রেমিকাদের মতো আচরণও করতে হবে না। তুমি যেমন তেমন ই থেকো, শুধু একটু হাসি খুশি থেকো। তোমার হাসিটা আমার জন্য জরুরী, অক্সিজেনের কাজ করে ভেতরে।
অই যে আশেপাশে দেখো না,প্রেম করার সময় প্রেমিকাকে প্রেমিক কিছু কন্ডিশন দেয়,সেরকম আমারও একটা কন্ডিশন বা অর্ডার ই বলা চলে।সর্বদা হাসিখুশি থেকো,চিন্তামুক্ত থেকো,নিজেকে ভালোবাসতে শেখো।আর কোনো অর্ডার নেই।তুমি তোমার পথে, আমি আমার পথে, শুধু খেয়াল রেখো তোমার পথে যেনো অন্যকেউ সঙ্গী না হয়।
আমি হাল্কা মাথা নাড়িয়ে হেসে দিয়ে ঝলকের কথায় সম্মতি জানাই।
-ওকে, তবে আমারও একটা কন্ডিশন আছে।
-কি?
-আমাকে হাসানোর দায়িত্ব টা কিন্তু আপনারই।
-যদি বেঁচে থাকি,তবে বিনাপারিশ্রমিকের এই চাকরী আমি আজীবন করে যাবো।
-আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক বছরের হায়াত দিক।
-ধন্যবাদ এতো বড় প্রার্থনা করার জন্য।
-আপনার পরিবারে কে কে আছে?
-কে কে থাকলে খুশি হও?
আমি ভেবে চিন্তে উত্তর দিলাম,
-ওম্মম্মম্মম, আমি তো ছোটো বেলা থেকে বাবা-মায়ের অপেক্ষা করি,তাই বাবা-মা থাকলে আর একটা নিশানের মতো বোন,যার মাঝে আমি নিশানকে খুঁজে পাবো।আর ভাই তো নেই আমার, থাকলে ভালো, না থাকলে সমস্যা নেই।
– ঠিক আছে বুঝলাম, তোমার চাহিদা।কে কে আছে সেটা আমি বলবোনা, একদম বিয়ের পর ই নিজে দেখে নিও।
-এতোদিন অপেক্ষা করবো?
-অপেক্ষার ফল সর্বদা সুমিষ্ট। জানো না?
-ঠিক আছে মানলাম,তাই ই হবে।
একের পর এক দিন যাচ্ছিলো,দিন গুলো এতো ভালো যাচ্ছিলো যে সেগুলো মনের মাঝে খুব শক্তপোক্ত হয়ে গেঁথে আছে,সেখান থেকে সরাতে চাইলে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবো।
রাঙামাটি থেকে ঝলকের সাথে আমার একসাথে পথ চলা শুরু।
ঝলকের জন্য আমার নিজেকে নতুন করে বা আলাদা সাজে সাজাতে হয় নি।আমি যেমন তেমন ই ছিলাম।শুধু ওর কথামতো আমি হাসিখুশি থাকতাম। ঝলক প্রতিটা কথায় খুব হাসাতো আমাকে । সব সময় প্রতিটা কাজে খুব যত্ন করে সাহায্য করতো।
জীবনে ঝলক আর নিশান শব্দ গুলো এমন ভাবে গেঁথে আছে!ঝলক আমার জীবনে আসার পর থেকে মনে হতো আমি পরিপূর্ণ, আমার জীবনে কিছু পাওয়ার বাকি নেই।
যেখানে আমি নিশানের অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে দিনের পর দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিলাম সেখানে ঝলক এসে আমাকে সতেজ করে তুলে, আমাকে কখনো চিন্তিতো থাকতে দিতো না।
সময় পেলে অনেক ঘুরাঘুরি করতাম আমরা।কিন্তু একা একা নয়,সাথে নিশান মাস্ট থাকতোই।আমার মনে পড়েনা নিশানকে ছাড়া আমি একা কখনো ঝলকের সাথে ঘুরতে গিয়েছি কিনা। মাঝে মাঝে দ্বীপ এসেও যুক্ত হতো আমাদের সাথে।
সেবছর আমরা রাঙামাটিতেই খুব হেসে খেলে দিন পার করছিলাম।দূর দেশে প্রিয়জনদের সাথে থাকাটা খুবই মজার অনুভূতির ছিলো। মাঝেমাঝে এমনও হয়েছে ঝলক আমাদের বাসায় এসে আমাকে আর নিশানকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতো।
ঝলকের সাথে থাকা প্রতিটা মুহূর্ত ও সোনালী সময়ের রূপ দিয়েছে।
এরমধ্যে ঝলক যতোটা আমাকে হাসিখুশি রাখতো,তাঁরচেয়ে বেশি হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতো নিশানকে, ও জানতো নিশানে ঠোঁটে হাসি ফুটলে তাঁর দ্বিগুণ হাসি আমার ঠোঁটে দেখা যায়।
রাঙামাটিতে একবছর থাকার পর আমাদের ইউনিট বদলি হলো সাভার ক্যান্টনমেন্ট। সাভারে আসার পর ঢাকা থেকেই রোজ আসা যাওয়া করতাম, আলাদা করে আর বাসা নেই নি।ঝলককে পেয়ে যতোই ভালো থাকি না কেনো।দিন শেষে বাসায় ফিরে, মামা-মিমি, দ্বীপ,তাপসিন ওদের ছাড়া শুন্য শুন্য লাগতো।
সাভারে আসার পর পর ই দ্বীপ বায়না ধরে নিশানকে বিয়ে করবে, আমি রিস্কটা নিতে চাচ্ছিলাম না,এরপর ঝলকের সাথে শেয়ার করার পর ঝলক বলে বিয়েটাতে রাজি হয়ে যেতে,আমি রাজি হয়ে গেলাম। কাজী অফিসে ওরা বিয়ে করে নিলো, আমি আর ঝলক সাক্ষী দিলাম।
নিশানের ইচ্ছে ছিলো ওয়ার্ল্ড ট্যুর করার,তাই সেই স্বপ্ন পূরণের একটা ছোট্ট প্রচেষ্টা ছিলো আমার। সেজন্য মাঝে মাঝেই ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম ট্যুরের জন্য। ঝলক, আমি, নিশান, দ্বীপ।
এই চারজন মিলে অনেক ঘুরাঘুরি করেছি।
ভাববেন না ঘুরতে গিয়ে ঝলকের সাথে রাত কাটিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি হোটেল বা রেসোর্টে তিনটে করে রুম নেয়া হয়েছে।একটাতে দ্বীপ নিশান থেকেছে,আর দুটোতে আমি আর ঝলক।
আমি তো মাঝেমাঝে ভুলে যেতাম ঝলক আর আমি প্রেমিক প্রেমিকা।ঝলক কখনো আমাকে ফরমাল ভাবে প্রপোজ করেনি, আমিও চাইনি সেরকম কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। বার বার কানের কাছে এসে বলা ভালোবাসি তোমায়, এরকম কোনো ছন্দও ছিলো না।হয়তো ঝলক বুঝতো এসব শব্দ শুনতে আমার হিচপিচ লাগবে,আন ইজি ফিল হবে।রাত জেগে ফোনে কথা বলার রেওয়াজও ছিলো না, চব্বিশ ঘন্টার পনেরো ঘন্টা তো আমার ঝলকের সাথেই থাকতে হতো।
ঝলক খুব সুন্দর করে আমাকে সব পরিস্থিতে মানিয়ে চলতো, কখনো ওর মাঝে কোনোকিছু নিয়ে অভিযোগ ছিলোনা,আমার তো প্রশ্নই আসে না।
একবার কি হয়েছে জানেন, আমার তো ছোটো বেলা থেকেই একটা বদ স্বভাব। হুটহাট কখন যেনো নিজের অজান্তে আমি গান গাওয়া শুরু করে দিই।এরকম ই একদিন কাজের সময় হুট করেই আমি গুণগুণ করে গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছি।
আমার গান শুনে ঝলক যেনো কেমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়,ভ্রু দুটো কুঁচকে জোড়া লেগে গেছে, আমি ওর তাকানো দেখে নিজেও অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম,
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?
-একটা জিনিস মনে করার চেষ্টা করছি।
-কি?
-তোমার গানের সুরটা যেনো কোন শিল্পীর সাথে হুবুহু মিলে যায় সব সময়।
আমি তো এই কথা শুনে মহা খুশি,মনে মনে পাখা গজালো,আর আমি উড়তে শুরু করলাম,ঝলক আমার গানের প্রশংসা করছে,আবার বলছে কোনো এক শিল্পীর সাথে মিলে গেছে।আমি কৌতুহল নিয়ে আবার জিজ্ঞের করলাম,
-কার মতো সুর?কোন শিল্পীর সাথে কন্ঠ মিলে যাচ্ছে? নিশ্চই আশা গাঙ্গুলী?কিংবা মোনালী ঠাকুর?
-আরে নাহ! এরা কিছুই না তোমার গানের কাছে।
-সত্যিই?এতো ভালো?
-অই যে একটা শিল্পী আছে না,যার গান শুনে কেউ হাত তালি না দিয়ে থাকতে পারে না।
-কোন শিল্পী? সব শিল্পীই গান গাইলেই তো মানুষ হাত তালি দেয়।
এরপর ঝলক ভ্রু সোজা করে, স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-পেয়ে গেছি,মনে পড়েছে।তোমার গানের সুর মশার মতো!
ঝলকের এই কমপ্লিমেন্ট শোনার জন্য আমি একদম ই প্রস্তুত ছিলাম না। মনে মনে গজানো পাখা দুটো হাওয়া হয়ে গেলো আর আমি ঠাসস করে মাটিতে পড়ে গেলাম।
ওর কথা শুনে অবাক হলেও পরক্ষণেই আমি ফিক করে হেসে দিই,জানিনা আমার জায়গায় অন্য কোনো প্রেমিকা থাকলে কি করতো,তবে সেদিন আমার খুব হাসিই পেয়েছিলো, কতক্ষণ ভরে আমি হেসেছিলাম আমার খেয়াল নেই,তবে আশেপাশের লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিলো আমার হাসির শব্দে।
আমার হয়তো একটা রোগ ই হয়ে গিয়েছিলো, ঝলকের ছোটো খাটো কথাতে আমি অনেক বেশি হেসে ফেলতাম।
আমি বার বার কৃতজ্ঞ হোতাম ওর কাছে আমার জীবনটা এমন হাসিতে ভরিয়ে দেয়ার জন্য।
দেখতে দেখতে সে বছরটাও কেটে যায় আমাদের।পরের বছর আবার পোস্টিং হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।ঢাকা টু সাভার জার্নির ঝামেলাটা কেটে যায়। তবে সাভার ক্যান্টনমেন্টে থাকার সময় ঢাকা থেকে রোজ আসা যাওয়ার ব্যাপারটা মজার ছিলো। দ্বীপের বাইকটা আমি দখলে নিয়ে নিই, গাড়ি নিয়ে চলাচল আমার ভালো লাগতো না, রাস্তায় জ্যামে পড়লে কিছু করার থাকতো না, কিন্তু বাইক থাকলে এসবের প্যারাই পড়তে হতো না।
ইউনিফর্ম পড়ে, হেলমেট পড়ে বাইক চালিয়ে যেতাম আসতাম, কারো ধারণাই হতো না আমি মেয়ে। আর ঝলক মাঝে মাঝে আমার বাইক রাইডের সঙ্গী হতো। অও আমার মতোই ঢাকা থেকে যাওয়া আসা করতো, এতে বুঝতে পেরেছিলাম ঝলকের বাড়ি ঢাকাতেই কিন্তু কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করিনি কখনো।আমার তো ঝলককে প্রয়োজন ছিলো,ওর কি আছে কি নেই সেটা দিয়ে আমি কি করবো?এরকম চিন্তা ছিলো আমার।
বছরের পর বছর কেটে যেতে থাকে দিনকাল অতিমাত্রায় ভালো যেতে থাকে।
কিন্তু হঠাৎ করে একটা পর্যায় এসে
নিশানের অসুস্থতা বেড়ে যেতে থাকে।তার সাথে আমার দুশ্চিন্তাটাও।ডক্টর বলে দেয় সময় খুবই সংক্ষিপ্ত হতে চলেছে,অনেক দিন তো বাঁচলো আর কতো!
নিশানের অবস্থা দেখে আমি এতোটা চিন্তিতো থাকতাম কারো সাথে ঠিকমতো কথাও বলতাম না, আমার মেজাজ অতিরিক্ত টেনশনের কারণে খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলো দিনের পর দিন। আর সেই খিটখিটে মেজাজ এতোটা বিস্তার করছিলো আমার মাঝে যে আমি ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে ঝলকের সাথে রাগারাগি শুরু করে দিতাম,দেখা যেতো ওর কোনো দোষ নেই তারপরেও আমি ওর উপর দোষ জুলুম করতাম।ঝলক যথাসাধ্য চেষ্টা করে আমাকে স্বাভাবিক করার,কিন্তু পেরে উঠছিলো না। আমার রাগ গুলো ও যথাসাধ্য চেষ্টা করতো সামাল দেয়ার।
কিন্তু আমার যেনো কেনো একটুতেই মেজাজ চওড়া হতো। একটা সময় ঝলক আমার ব্যাবহারে ফেড আপ হয়ে যায়,অও আমার মতো দূর্ব্যবহার না করলেও আমার রাগ ভাঙাতে আসতো না। অতিরিক্ত রাগ উঠলে যখন কান্না করে দিতাম তখনি ও আমাকে শান্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তো।
এরপর ঝলক একটা টেকনিকে আমাকে আয়ত্তে আনতে নিলো,
যখন ই আমার মন মেজাজ ভালো থাকতো না, তখন ও আমাকে নিয়ে গোরস্তান থেকে ৪০ কদম দূরে নিয়ে দাঁড় করাতো,আর বলতো,
-বর্তমানে আমরা মানুষ সর্বোচ্চ আয়ু নিয়ে আসি ধরো একশো কি দেড়শো বছরের, এর উপরে না।সেখানে আমাদের বাঙালীদের আয়ু তো আরো কম, গড়ে ৬০/৬৫ বছর।
এই ৬০/৬৫ বছর বয়সে আমাদের কতকিছু করতে হয়।ভালোভাবে থাকার জন্য একটা বাসস্থান, ভালো খাওয়ার জন্য একটা আর্থিক উপার্জনের রাস্তা।” কাজ হোক ছোটো বা বড় সব ই সমান” । এটা একটা প্রচলিত প্রবাদ বাক্য।কাউকে দেখাতে পারবে , যে এই কথাটা মানে বা বিশ্বাস করে?আমাদের কিন্তু উচিৎ এই চিরন্তন শব্দটাকে বিশ্বাস করা ও মেনে নেয়া।কিন্তু আমরা মানুষ এই বাক্যের বিকৃতি ঘটিয়ে কাজকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছি। একটা সম্মানীয় আরেকটা সম্মানহীন । এক শ্রেণীর মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করছে, আরেক শ্রেণির বুদ্ধির।
দেশের উন্নয়নের জন্য দুটোই জরুরী।কিন্তু আমরা আমাদের নজরগুলো ভিন্ন করে একটাকে সম্মান দেই আরেকটা সম্মান দিই না। এই ধরো সুইপার রাস্তা ঝাড়ু দেয়,কখনো দেখেছো সে ঝাড়ু দেয়ার সময় তাকে কেউ সালাম দিয়েছে? অথচ অই রাস্তা দিয়ে তুমি বা আমি হেঁটে যাই, শুধু সালাম ই পাবে না স্যালুট ও করা হবে।
ওই সুইপার কি দোষ করেছে? ওকে কেনো সালাম দিলো না? ও তো আমার থেকে ভালো কাজ করছে।ওর গায়ে ভালো জামা নেই, লেখাপড়ার সার্টিফিকেট নেই সেজন্য ওর সম্মান নেই?
ফলাফল কি দাঁড়ালো?
মানুষ অর্থ আর প্রভাবের পূজারী! একজন সৎ, পরিশ্রমী ভালো মানুষের কোনো দাম নেই।অথচ আমাদের মনুষ্যধর্ম আমাদের সৎ ও পরিশ্রমীই হতে বলে।
লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলো মনুষ্যধর্মকে জাগ্রত করা,কিন্তু আমরা লেখাপড়া করি মনুষ্যত্বকে বিক্রি করার ফর্মুলা খোঁজার জন্য। প্রতিটা মানুষের ভালো লেখাপড়া করার উদ্দেশ্য দেখবে একটাই,ভালো চাকরীর জন্য, ভালো চাকরী মানেই তো মোটা টাকা পাবো।
আমরা টাকা উপার্জন করতে থাকি,টাকার নেশায় পড়ে যাই, এরপর টাকার লোভে যে পেশায় থাকি সেই পেশাটাকে লাঞ্ছিত করি,অন্যের চোখে ছোটো করে দিই পেশাটাকে। এতো এতো অর্থ সম্পদ হওয়ার পর মানুষ কত কিছু করে,কত ভাবে উড়ায়,কিন্তু কাউকে পাবে না যে আয়ু কিনতে সক্ষম ।
কি লাভ এতো টাকা দিয়ে যদি আমার মেয়াদের সময়সীমা বাড়াতে না পারি?
সেই তো ৬০/৬৫ বছর পর আমাকে অই গোরস্তানের মাটিতে চাপা পড়তে হবে কিংবা তাঁর আগে। টাকা গুলো সাথেও যাবে না, যাদের জন্য টাকা ইনকাম করি তাঁরা কেউ যাবে না। এমনকি মৃত লাশটাকে তাদের ঘরে জায়গাও দেবে না।
কি লাভ হলো নিজের মনুষ্যত্বের উপর জুলুম করে অবৈধ পথে এতো টাকার পাহাড় বানিয়ে?
যেখানে নিজের একটা দিনের আয়ু বানাতেও অক্ষম সেখানে এতো কিসের বড়াই?
যে মানুষ টা সৎ পথে কম উপার্জন করলো,সেও যে বয়সে মরলো আমিও সেই বয়সেই মরলাম,তফাৎ কোথায়?তাঁর পাপের পাল্লা হাল্কা আমার ভারী।
অই যে গোরস্তান টা দেখছো? ওখানে আমার মতো হাজার হাজার মানুষ মাটিতে চাপা পড়ে আছে।যাদের অনেক মানুষ ভালো অনেকেই খারাপ।
এখানে কেউ চিরস্থায়ী নয়,যার পয়সা আছে সেও অস্থায়ী, যার পয়সা নেই সেও অস্থায়ী।
দিন শেষে এটাই সত্যি আমরা কেউ চিরস্থায়ী বা অমর না, মৃত্যুটাকে আমাদের বরণ করতেই হবে।হতে পারে কাল সকালটা আমার ভাগ্যে নেই, ফজরের আজানের পর আমার মৃত্যুর শোক সংবাদ মাইকিং করা হবে। এতে কি আমার কোনো দোষ আছে?
আমার হায়াত আজকের সূর্য অব্ধিই ছিলো তাই কালকের সূর্য আমি দেখতে পাই নি।
মানুষের জন্ম যতোটা সত্য মৃত্যুও ততোটাই সত্য।এটা মেনে নেয়া শিখতে হবে। ভাবছো এতোগুলো অপ্রাসঙ্গিক কথা আমি কেনো বলছি। এতোগুলো কথা বলার কারণ একটাই। তুমি যে বলোনা,”আমার কাছে যদি বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা থাকতো আমি হয়তো নিশানকে বাঁচাতে পারতাম।ওর দেহের ভেতরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমি চেঞ্জ করে দিতাম।অমর রাখতে না পারলেও ওর আয়ুটা বাড়িয়ে দিতাম। “মিশান! তোমার এই কথাগুলো ভুল।যদি এমনটা সম্ভব হতো তাহলে মানুষ তাঁর আয়ু বাড়াতে সক্ষম হতো,আর প্রভাবশালী রা হতো অমর।কারণ ওদের টাকা আছে,ধরো হার্টে প্রবলেম হলো,হার্ট চেঞ্জ করে একটা দীর্ঘ মেয়াদী হার্ট লাগিয়ে ঠিক হতো, আবার সেটার মেয়াদ শেষ হলে আবার চেঞ্জ করতো।
সেরকম করা যায় না।হয়তো কিছুদিন সুস্থ থাকবে লোকটা, কিন্তু মৃত্যুকে গ্রহণ করতেই হবে।
সত্যি এটাই, আমার আয়ু যতোদিন লিখা আছে, আমি সুস্থ দেহে ততোদিন ই বেঁচে থাকবো।নিশানের আয়ু যতোদিন আছে অসুস্থ দেহে ও ততোদিন ই বাঁচবে।
আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারি নিশান যতোদিন বেঁচে আছে ততোদিন ওকে ভালো রাখার,বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারবো না।
সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে মিশান।আজ আমি মরলে তোমার যেমন মেনে নিতে হবে নিশান মরলেও মেনে নিতে হবে।আবার তুমি মরলেও আমার মেনে নিতে হবে। সত্যি মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো অপশন নেই মিশান।
তাই এভাবে চিন্তিতো থেকে নিজের সময় গুলো নষ্ট করো না।জীবনে যতোগুলো দিন সময় পাও উপভোগ করো মন ভরে।
জীবন অতি সংক্ষিপ্ত, ভালো কিছু করো,মৃত্যুর পর গর্বের সাথে দশজন মনে রাখবে তোমায়, এরকম কিছুর চিন্তা করো।
এভাবেই ঝলক আমাকে সব সময় বুঝাতে থাকতো “মৃত্যু সত্য এটাকে মেনে নাও।”
এভাবেই আমার মন খারাপের সময় মৃত্যুকে মেনে নেয়া শেখাতো গোরস্তানের কাছে দাঁড়িয়ে।
কুয়েতে মিশনের জন্য যখন ডাক আসে আমাদের ইউনিটের ম্যাক্সিমামের ই নাম আসে।দূর্ভাগ্যবশত আমার নামটাও আসে,কিন্তু ঝলকের নামটা আসেনা। নিশানকে ছেড়ে ঝলককে ছেড়ে এতো দূরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না কোনো ভাবেই, তবুও ঝলক আমাকে প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে শান্ত করে। আর ঠিক সেই সময় নিশানের ডক্টর জানায় নিশানের চিকিৎসাক্ষেত্রে একটা আপডেট এসেছে,একটা নতুন ট্রিটমেন্টে নিশানের অসুস্থতার হার কমানো যাবে একটু হলেও,কিন্তু সেটা ব্যয়বহুল। সেখানে প্রতিমাসে যে পরিমাণে টাকার কথা বলা হয় সে টাকা আমার বেতনও ছিলো না,যদিও মামা আমাকে মানি সাপোর্ট দিতে রাজি হয় কিন্তু আমি হেল্প নিতে রাজি হই না,কারণ মামা আর কতো করবে আমাদের দু বোনের জন্য? তাঁরও দুটো ছেলে আছে, পরিবার আছে,সব যদি আমাদের ই দেয় নিজের সন্তানদের কি দেবে? আমি মিশনে যাওয়ার প্রস্তুতিই নিই। মিশনে যাওয়ার জন্য বেতনটা মোটা অংকে আসে সে জন্যই আসলে যাওয়া।
কুয়েতে যাওয়ার আগে, ঝলকের সাথে শেষ দেখা হয় গোরস্তানের অই রাস্তাটাতে।ঝলক আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
-কাউকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার নাম জীবন না, নিজেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার নাম ই জীবন।
আজ তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলে, কাল যখন আমি মরে যাবো পরশু থেকে তোমার জীবনে তীক্ততা নেমে আসবে, বেঁচে থাকার প্রতি অনিহা চলে আসবে। তাই মেনে নেয়া শেখো,নিজেকে শক্ত করো।আজ তুমি মরলে আমি কিন্তু কাল কাঁদবো না, কারণ আমি নিজেকে সব সময় বুঝিয়ে রাখি, Everything was normal.Everything is normal. Everything will be normal.
এই তিনটে বাক্য সব সময় নিজের সাথে রাখি। যেকোনো বিপরীত পরিস্থিতে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করি বারবার। তোমার জন্য উপদেশ তুমিও সব সময় এই তিনটে বাক্য নিজের সাথে রেখো।দেখো একদিন অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে তোমার মন।
-আজকের দিনেও তোমার মৃত্যু বিষয়ক ক্লাস নিতে হবে?কতদূর যাচ্ছি আমি, ভেবে দেখেছো?জানি না আবার কবে দেখা হবে। অন্তত আজকে অন্য কথা বলো।তুমি বলো আমি বদলে গেছি,ভেবে দেখো আমি না তুমিই বদলে গেছো,আগে তো কথায় কথায় হাসাতে আর ইদানীং শুধু এই গোরস্তানের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে মৃত্যুর ক্লাস নাও।
ঝলক আমার কথার তোয়াক্কা না করে মন ভার করে বললো,
-মিশান! সময় বদলায়, আমাদের নানান পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।আমরা কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকি না।হতে পারে এটাই আমাদের শেষ দেখা কিংবা এর থেকেও ভালো দিন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, তুমিও জানো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আর দুজনের জানাটাই চিরন্তন সত্য। তাই একে অপরকে ছাড়া জীবন মানিয়ে নেয়া অনেক বেশি কষ্টের হবে। জানিনা আগামী দিন গুলো একসাথে কাটানোর জন্য তুমি বা আমি থাকবো কিনা।ভেতরে একটা অতৃপ্ততা থেকেই যাবে না বলা কথা গুলোর জন্য। তোমাকে অনেক ভালোবাসি মিশান, এতোটা ভালোবাসি যে তোমাকে ছাড়া……
এইটুকু কথা বলতে বলতেই ঝলকের গলা ধরে আসে,যে লোকটা আমাকে শক্ত হওয়া নিয়ে এতো জ্ঞান দেয় তাঁর আজ গলা ধরে আসছে! আবার চোখের কোণে পানিও চলে আসে ওর।সেদিন আমি ওর চোখের কোণের জলকণা দেখে আরো ভেঙে পড়েছিলাম।সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ছিলো, সব কিছু হারিয়ে গেলেও যেনো এই ঝলক আমার জীবনে অবশিষ্ট থেকে যায়। ঝলক না থাকলে আমার জীবনে সত্যি অন্ধকার নেমে আসবে, যে অন্ধকারে আমার যা কিছু হয়ে যেতে পারে।বুঝতে পারিনি সৃষ্টিকর্তা সেদিন আমার প্রার্থনার বিপরীতটা গ্রহণ করবে। যে ঝলককে আমি সারাজীবনের জন্য চেয়েছিলাম, সেদিন ই ছিলো ঝলকের সাথে আমার শেষ দেখা!
ভাবা যায়?বছরের পর বছর আমি নিশানের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম,কখনো কল্পনাও করিনি ঝলকও চলে যাবে আমার জীবন থেকে।
রাতের বেলা বাড়ির থেকে একটু দূরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে ঝলক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,আমি ওর থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।কয়েক কদম হেঁটে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঝলক আমার পথ চেয়ে দেখছে,আমার ভেতরটা খুব ছটফট করছিলো,কি মনে করে যেনো আমি এক ছুটে ওর দিকে দৌড়ে, আমি শক্ত করে ঝলককে জড়িয়ে ধরি,এতোগুলো বছরে কখনো ঝলককে জড়িয়ে ধরিনি, সেদিন খুব বেশি খারাপ লাগছিলো বলে নিজের অজান্তে ঝলককে আমি জড়িয়ে ধরে কান্না করি,সেদিনই ওকে প্রথম জড়িয়ে ধরা সেদিনই শেষ। জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছিলাম, ঝলক নিরব হয়েছিলো। ভোর বেলা আমার ফ্লাইট ছিলো, মানে আগামীদিনও ওর সাথে দেখা হবে না।
কুয়েত পৌঁছানোর কিছুদিন পর জানতে পারি,মিশনের লিস্টে ঝলকের নামও এসেছিলো,ঝলক কিভাবে কিভাবে যেনো ওর টা ক্যান্সেল করেছে। কেনো অই কাজ করেছে তাঁর উত্তর আমার কাছে রহস্য!
ওর পেট থেকে উত্তর বের ই করতে পারিনি।
(চলবে)