তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-৪১

0
106

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৪১
লেখিকা- রিয়া খান

তীব্র পেছন ঘুরে ঘরের দরজা লক করে দিয়ে মিশানের সামনে নিজেও হাঁটু গেড়ে বসে, চোখ দুটো লাল আগুনের ন্যায় টগবগে রূপ ধারণ করে আছে। হাল্কা নাক টেনে মিশানের দিকে তাকিয়ে আধ ভেজা কন্ঠে বললো ,

-আমি সত্যিই খারাপ মিশান!মানুষ হয়ে মানুষের খুনি আমি। নিজের রক্তের ভাইয়ের খুনি আমি! আমার পাপের কোনো শাস্তি নেই তবুও আমি প্রতি রাতে শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি। দেখো আমার ঘরে কোথাও একটা আয়না নেই, আমি আয়নার সামনে যেতে ভয় পাই!
তুমিই বলো আমাকে কখনো আয়নার সামনে দেখেছো?অনেক দিন আগে যে তুমি ইয়ার্কির ছলে সেল্ফি তোলার জন্য আমার সামনে ক্যামেরা ধরেছিলে, ফ্রন্ট ক্যামেরায় আমার চেহারার দিকে চোখ পড়তেই আমি সটকে যাই,যার কারণে তোমার ফোনটা সামনে থেকে সরাতে গিয়ে ফেলে ভেঙে দিই।আমার নিজের চোখকে নিজেই ভয় পাই, সাহস হয়না নিজের চোখে চোখ রাখার।
প্রতি রাতে একটা কথাই ঘুরে মাথায় আমি আমার রক্তের ভাইয়ের খুনি! যার ফলে দিনের দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমার মস্তিষ্ক বিকৃত হতে হতে আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি। আমার অবস্থা তোমার থেকেও ভয়াবহ। যতোটা বাইরে থেকে বুঝা যায় না, ভেতরে আমি ততোটাই ক্ষতবিক্ষত। তুমি তো ড্রিঙ্ক করে সব ভুলে থাকো,আমি তো সেটাও পারি না।
আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না মিশান।আমার যে পাপ সে পাপের ক্ষমা নেই।
আমার পাপের জন্য আমি আমার মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারি না, কখন যেনো কথার প্রসঙ্গে মা বলে উঠে তুই তোর ভাইয়ের খুনি!মায়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় লাগে,যেনো আমার চোখের মুভমেন্ট দেখে কিছু বুঝে না ফেলে আবার । সেজন্য রুড বিহেভ করে সব চাপা দিয়ে রাখি।

একজন অপরাধীর জীবনে অভিশাপ একটাই,সারাজীবন খুনির দায় মাথায় নিয়ে চলতে হয়। আমাকে তোমার ক্ষমা করতে হবে না, তুমি শুধু আমার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করো না।না হলে আমি সত্যি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবো মিশান।আমার সব কিছু থেকেও নেই।আমার ভেতরের যন্ত্রণা গুলো এতো অদ্ভুত যে, কারো সাথে আমি এগুলো শেয়ার করে হাল্কা হতে পারিনা। কাউকে যদি বলতে যাই সে আমাকে ভুল বুঝবে আর বলবে আমি পাগল সিনেমার কাহিনী শোনাচ্ছি।

কথাগুলো ঢোক গিলে গিলে বলতে বলতে তীব্র মিশানের হাত ধরতে যায়,মিশান হাত সরিয়ে নিয়ে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
-খুনি তো খুনিই,সে অপরাধ তো পরের কথা।
যে প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে কাঁদিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তাকে বিপথের দিকে ঠেলে দেয় সে আবার কেমন প্রেমিক?
এই প্রেমিকের মৃত্যুদণ্ড দিলেও কম হবে।
কবে এতো বড় অভিনেতা হলে তুমি ঝলক? কেনো আমার সাথে এমন নাটক চালিয়েছো? এই ঝলক কিনা আমার চোখের কোণে পানি জমার সুযোগ দিতো না!আমার সব ডিপ্রেশনের একমাত্র নিরাময় ছিলো। আর সেই কিনা আজ আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার কারণ!
এই ঝলক কিনা আমাকে হাতে কলমে একজন সিরিয়াল কিলার বানিয়েছে, এই ঝলকের জন্য আমি রাতের পর রাত এলকোহলে ডুবে থেকেছি। আগের ঝলক হলে এসব করতে দিতে আমাকে?
কেনো কেনো কেনো? কেনো এমন নোংরা খেলা খেলেছো আমার সাথে?বলো!
-অপরাধী কি আমি একাই তুমি না?
-আমার কি অপরাধ?
– কেমন প্রেমিকা তুমি যে কিনা প্রেমিকের বুকের কাছে এসেও নিশ্বাস বুঝো না?আমার সাথে তো রাতও কাটিয়েছো, তবুও কি একবার মন বলেনি কিছু?এই চেহারা টাই কি সব? আমার চেহারার সাথে কি আমার কণ্ঠস্বরও বিকৃত হয়ে গেছে?যে বাজপাখি দৃষ্টির প্রতি তুমি অতিষ্ঠ, সেই বাজপাখি দৃষ্টিতেই কত লক্ষ শতাধিক বার তোমার দিকে তাকিয়েছি,একবারও কি মনে আঁচ করে নি?
তোমার কি মনে পড়ে মিশান, বার বার আমি আমার আগে তোমার মৃত্যু কামনা করতাম? সেখানে তুমি কিভাবে এতো সহজে মেনে নিলে তোমার ঝলক তোমায় ছেড়ে এতো জলদিই মরে যাবে?
বলো,তুমি কি অপরাধী না?

মিশান অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে তাঁর অপর পাশের মানুষটাকে। ঠিক প্রথমবার যেমনটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো তেমনটা করে।

মিশান যে লিংক গুলো টাইপ করে সেন্ড করছিলো তাতে যেসব ছবি শো করে সেখানে ঝলক আর তীব্রর একত্রে তোলা ছবি দেখতে পায়, যেটাতে বড় রকমের ধাক্কা খায়, যা এতোদিনে কল্পনাতেও আসেনি।দুজন দু ক্যাডেটে পড়তো, দুজনের ই ক্যাডেটের ইউনিফর্ম পড়ে একসাথে তোলা ছবি, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জেতার পর পুরষ্কার নেয়ার ছবি ওদের।
একসাথে বিভিন্ন সম্মাননা হাতে নিয়ে তোলা ছবি। ওদের বাবা মা বোনের সাথে একত্রে তোলা ছবি।একভাই পুলিশ আরেকভাই সেনাবাহিনী দুজনের কাঁধে হাত রেখে পেছনে দাঁড়ানো ওদের বাবা তিনজনেই তাদের অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পড়া ছবি।
এরকম অনেক গুলো ছবি মিশান দেখতে পায় যেগুলো দেখে কলিজা শুকানোর জন্য যথেষ্ট।

এরপর দীপ্তির সাথে যে রেকর্ডিং ছিলো সেখানে দীপ্তির সাথে কথোপকথনের কিছুটা,
– আমি সবটা জেনে গেছি! আর এসব জেনে মনের কোণে জমে থাকা সমস্ত আফসোস মিটে গেছে। তুমি এতো নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছো যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে তুমি তীব্র না। কিন্তু দেখো আমার মনে ঠিক জানান দিয়েছিলো, কিছু একটা ব্যাপার আছে।আমার তীব্র আর যাই হোক অন্য কারো হতে পারে না । তীব্র চিরকুমার হলেও বিশ্বাস করতাম, কিন্তু সে যে দীপ্তির জায়গা অন্য কাউকে দেবে এটা অসম্ভব ! তীব্র ডিরেক্ট প্রকাশ না করলেও ইন্ডাইরেক্টলি আমাকে বার বার বুঝিয়েছে দীপ্তিকে কতোটা চায়, ভালোবাসে!

সেদিন যখন তুমি মিশানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ও তোমার গার্লফ্রেন্ড, তখনি আমি নিজেকে বুঝাই তুমি আর যাই হও আমার তীব্র হতে পারো না।আর দেখো ঠিক তাই হলো!

একদিন তীব্রর সাথে কথোপকথনের সময় বলেছিলাম” তুমি যে বিয়ে করছো না, তোমার ভরসায় থেকে তোমার ছোটো ভাই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তোমার পাত্রী তো রেডি তোমার ভাইয়ের পাত্রী পাওয়া খুব মুশকিল হবে ” উত্তরে তীব্র বলেছিলো,
“আমার ভাইয়েরও পাত্রী রেডি আছে, তোমার সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আর আমার ভাইয়ের পাত্রী তোমার থেকেও সুন্দর ”
কিন্তু তীব্র বলেনি কে সে। যদি তখনি বলতো আমাকে তাঁর নাম মিশান, তাহলে আমি এই ব্যাপার টা অনেক দিন আগেই ধরে ফেলতাম।

তবে যাই বলো দেরি করে হলেও সত্যি জেনে মরছি।তুমি যদি একটাবার আমাকে বলতে সব সত্যি তাহলে হয়তো প্রতি রাতের কষ্টটা কমে আসতো, নিজেকে শান্ত্বনা দিতাম, আমার তীব্র মরে গেছে ঠিক কিন্তু অন্য কারো হয়নি,ও আমাকেই ভালোবেসে মরেছে।আজ সব থেকে বেশি প্রশান্তি হচ্ছে এটা ভেবে, আমিও মরে যাচ্ছি আমার তীব্রকে ভালোবেসে।

তোমার কাছে অশেষ ধন্যবাদ ঝলক, তুমি তীব্র হয়ে ওর সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছো ঠিক, কিন্তু আমার জীবন নষ্ট হবে বলে নিজের ভাইয়ের ভালোবাসাটাকে কষ্ট দিয়ে হলেও যত্ন করে দূরে ঠেলে দিয়েছো। যদি এমনটা না করতে তাহলে আমি সারাজীবন ভুল মানুষকে ভালোবাসতাম, আর তুমি নিজের ভালোবাসা কুরবানি দিয়ে আমার সাথে
মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করে যেতে।

তুমি এরকমটা করো নি,এতে আমার আর তীব্রর ভালোবাসা,তোমার আর মিশানের ভালোবাসা টিকে গেলো।

-সরি দীপ্তি! আমি নিরুপায় ছিলাম, হুট করে তোমাকে যদি বলি আমি তীব্র না তুমি বিশ্বাস করতে না, সেজন্য আমি তোমাকে এড়িয়ে গিয়েছি।আমি চাই নি ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষটা আমার স্পর্শে নষ্ট হয়ে যাক। তুমি সেই বাগানের একমাত্র ফুল যে বাগান আর ফুলের মালিক কেবল আমার ভাই ই। আমার এটা ভেবেই কষ্ট কম হচ্ছে জানো দীপ্তি,তোমার মরে যাওয়াই শ্রেয়।তুমি বেঁচে থাকলে অন্যকারো হয়ে যেতে পারো,বেঁচে থাকতে আমি আমার ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারো হতে দিতে পারবো না।আমার ভাইও চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে, তুমিও চলে যাও, তোমরা পরকালে গিয়ে এক হও।
-আমি জানি ঝলক,তুমি পরিস্থিতির স্বীকার, আমি তো বললাম ই সব। তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই তবে তোমার কাছে একটা দাবী তোমার ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ গুলো সম্পূর্ণ করো, দেখো মানুষটার আত্মা শান্তি পাবে। তীব্র তো শহীদ হয়েছে, নিজের জীবনকে বাজি রেখে দেশের জন্য , যদিও তাঁর কোনো ফল পায় নি,কেবলই মৃত্যু ছাড়া!
-রাখো দীপ্তি, ভাইয়ার এই পরোপকারী স্বভাবের জন্যই এতো কিছু হয়ে গেছে। কথায় আছে” যার জন্য করি চুরি সেই কয় চোর!” মরলো আমার ভাই দুনিয়া জানলো মরেছে ঝলক। যারা জানাজা পড়েছে তাঁরাও জানে না, কার জানাজা পড়ছে!ডিপার্টমেন্ট কেবল নিজেদের স্বার্থকতা বুঝে,ওরা আমার ভাইয়ের দিকটা বুঝলো না।
-ঝলক! তুমি তীব্র হয়েই বেঁচে থাকো।ধরে নাও ঝলক সত্যিই মরে গেছে। মিশানকে নিয়ে চিন্তা করো না,ও ঠিক একদিন না একদিন বুঝবে তোমাকে।
তুমি মিশানকে ভালোবাসো বলেই ওকে বিয়ে করে নিজের সাথে বেঁধে রেখেছো যেনো হারিয়ে না যায়।আমার বিশ্বাস কখনো হারাবেও না।মিশান তোমাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে, ওর পুরোটা জুড়ে কেবল ঝলকই।

আচ্ছা ঝলক তুমি কি জানো, তীব্র কেনো কখনো আমাকে সামনা সামনি ধরা দিতো না?ও তো আমাকে ভালোবাসতো অনেক,তাহলে কেনো চোখে প্রেম নিয়ে মুখে অস্বীকার করতো?আবার আমার বিয়ের নাম শুনতে পারতো না। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিলো ও বলেছিলো,”তাড়াহুড়ো করে বা অভিমানের বশে বিয়ে করে নিও না, আমার ফেরা অব্ধি অপেক্ষা করো।তোমাকে মানান সই একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেবো,যদি ছেলে না পাই,তবে নিজেই দাঁড়িয়ে যাবো তোমার পাশে। এখন হয়তো বলবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুড়ি হয়ে যাচ্ছো।তবে শুনো, তোমার চুল পেকে চামড়া কুঁচকে গেলেও আমার সমস্যা নেই। মনে থাকবে?”আমি সেদিন তীব্রর কথা শুনে মুচকি হেসে হাল্কা মাথা নাড়িয়েছিলাম, খুব ভালো লাগছিলো ওর মুখে কথাগুলো শুনে।হুট করেই কোথা থেকে যেনো সামনে এসে হাজির হতো,প্রশ্ন করলে উত্তরে গম্ভীর স্বরে বলতো, এমনিই ডিউটি এখানে তাই এসেছি!আমি বুঝেও না বুঝার ভান করতাম, তাল মিলিয়ে কথা বলে যেতাম।

আমি বুঝিনা আমাকে সরাসরি বলতে ওর কিসে বাঁধা দিতো!এতো চেষ্টা করেও ওর মুখ ফুটিয়ে কথাটা বের করতে পারিনি”দীপ্তি তোমাকে ভালোবাসি!”হয়তো বা কোনো একদিন বলতোও, কিন্তু সেইদিন টা আর এলো না, তাঁর আগেই চলে গেলো লোকটা! একটু কষ্ট হচ্ছে,ওর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও মনে একবার জানান দেয়নি এটা আমার তীব্র! আর পাঁচজনের মতো আমিও ধরে নিয়েছিলাম লাশটা ঝলকের, ওর চেহারা টা বিকৃত না থাকলে হয়তো চিনতে পারা যেতো, তোমার আর তোমার ভাইয়ের শারীরিক গঠন তো আল্লাহর রহমতে একরম, তাই পার্থক্য করাটা মুশকিল ছিলো। যাই হোক ভাগ্য নিয়ে আফসোস নেই, আপাততো শান্ত্বনা এটাই,এই কঠিন পৃথিবী রেখে তীব্রও চলে গেছে,আমিও যাচ্ছি খুব শীঘ্রই।
ঝলক!
-হুম?
-জানি না সত্যি কিনা, মিথ্যে হলেও মরার আগে শুনতে চাই একটা কথা। তোমার ভাইয়ের মনের আদ্য অন্ত খবর তুমি জানতে, বলো না তীব্রর মনে কি দীপ্তির জায়গা ছিলো?তীব্র দীপ্তিকে ভালোবাসতো?
-তীব্র দীপ্তিকে অনেক অনেক ভালোবাসে,মুখ ফুটে প্রকাশ না করলেও,তীব্রর ভেতরের সবটুকু গভীরতা জুড়ে শুধু দীপ্তি!তীব্র এতোটা ভালোবাসে দীপ্তিকে যে একালে মিল না হলেও পরকালে ঠিক মিল হয়ে যাবে।
– মিশানকে নিয়ে অনেক ভালো থেকো ঝলক, তীব্রর মতো থাকতে থাকতে মিশানকে দূরে ঠেলে দিও না। জানিনা তীব্রর মনে কি ছিলো, কিন্তু তুমি মিশানকে অনেক ভালোবাসো , মিশান তোমাকে, আগলে রেখো ওকে নিজের সবটা দিয়ে।
– তোমার ধারণার বাইরে দীপ্তি,ভাইয়া তোমাকে কতোটা ভালোবাসতো! তুমি যতোদিন ধরে ভাইয়াকে ভালোবাসো তাঁরও আগে থেকে ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে। কিশোর বয়সেই ভাইয়া তোমাকে সরাসরি বলতে চেয়েছিলো,কিন্তু তোমার পড়ালেখায় ক্ষতি হবে বলে বুঝতে দিতো না। ভাইয়া প্রেম করা পছন্দ করতো না,তাই সব সময় নিজেকে পারফেক্ট বানানোর চেষ্টা করেছে যেনো কখনো তোমার পরিবার “না” শব্দ মুখে না আনে।ভেবেছিলো সরাসরি তোমাকে বিয়ে করে সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দেবে । ভাইয়া বুঝতো, বিয়ে মানে একটা বিশাল দায়িত্ব,তাই তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতে চায় নি।
তোমার ধারে কাছে কোনো ছেলের ছায়া পড়তে দেয়নি যেনো তুমি অন্য কারো, না হয়ে যাও।আমি ভাইয়ার মতো হতে না পারলেও ভাইয়া ছিলো আমার রোল মডেল। সব সময় চেষ্টা করতাম ভাইয়া যা করে সেটাকে আয়ত্ত করার,কিন্তু আমি ভাইয়ার মতো হতে পারি নি! ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমি তো কেবল অভিনয় করি ভাইয়ার মতো,মন থেকে আজও ভাইয়া হতে পারিনি!

এরকম কথাবার্তাই দীপ্তির সাথে হচ্ছিলো।
দীপ্তি আর ঝলকের কথোপকথনে । এগুলো শুনেই মিশানের গায়ের রক্ত পানি হওয়ার উপক্রম। মাথা ঝিঁ ঝিঁ করে উঠে।এরপর নিশানের সাথেও একই রকম কথাবার্তা হয়।
নিশান মৃত্যুর পূর্বে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে বলে,
-ভাইয়া আপনাকে একটা কথা বলবো , এটা বলা খুব জরুরী, আপির জন্য জীবনে কিছু করতে পারিনি, আপনি আমাকে কথা দিন একটা কথা রাখবেন আমার।
-কি কথা নিশান?
-আমার আপির অনেক কষ্ট, আমাদের বাবা মা নেই,আমি তো ছোট্ট ছিলাম তাই আমি বাবা মা হারানোর কষ্ট বুঝিনি, কিন্তু আপি বুঝতো।এরপর কয়েক বছর আগে আপির জীবনে একটা প্রেম আসে,ঝলক ভাইয়া, সেও সেনাবাহিনী ছিলো।ভাইয়া আপি দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু নিয়তির পরিহাস!
ভাইয়া একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তাঁরপর আপি একদম নিঃশ্ব হয়ে যায়,ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আজ আমারও সময় শেষ, আমি মরে গেলে আপি ভেঙেচুড়ে গুঁড়িয়ে যাবে। ভাইয়া আপনার কাছে অনুরোধ, আমার আপিকে দেখে রাখবেন।
জানিনা আপনার আসল পরিচয় কি, আপনার সাথে ঝলক ভাইয়ার অনেক মিল আছে,আপনার মাঝে আমি ঝলক ভাইয়াকে দেখেছি।আপনি যখন কাছে থাকতেন, আমার বার বার মনে হতো আমি ঝলক ভাইয়ার সাথে আছি।
আপিকে ঝলক ভাইয়ার মতো করে ভালোবেসে সব কষ্ট বুলিয়ে দেবেন।আমি বেঁচে থাকলে হয়তো বলতে পারতাম ঝলক ভাইয়া কেমন ছিলো,সেটা আপনি ফলো করতে পারতেন।একটু কষ্ট করে আপির কাছে থেকে ঝলক ভাইয়ার বর্ণনা শুনে নিয়েন।
আমার আপি অনেক ভালো মানুষ, আপিকে ভালো রাখবেন ভাইয়া প্লিজ! কথা দিন!
-নিশান!
-বলুন ভাইয়া।
-তোমার আপি তো বদ্ধ উন্মাদ, কখনো আমাকে খেয়াল করে দেখেও নি, তুমি তো একটু আধটু খেয়াল করেছো।তুমিও কি বুঝতে পারোনি, আমি ঝলক ভাইয়ার মতো না, আমি স্বয়ং ঝলক!যার লাশ দেখেছো সেটা আমার ভাই তীব্র।
একটা এক্সিডেন্টের কারণে আমি আমার ভাইয়ের রূপ নিয়ে ভাইয়ের ক্যারেকটারে বাস করছি।আমি সবটা পরিস্থিতির স্বীকার। আমার জীবনের সত্যিটার কোনো প্রমাণও নেই আমার কাছে।
নিশান হেসে দিয়ে বলে উঠে,
-সত্যি? ঝলক ভাইয়া?
-কত পার্সেন্ট গ্যারান্টি চাও?
-আমি বিশ্বাস করলাম ভাইয়া। আমার মনে খচখচ করতো সব সময় শুধু,তোমাকে দেখলে মন কেমন যেনো অশান্ত লাগতো,
আজ তুমি সেটা বুঝিয়েই দিলে।
মৃত্যুর আগে আমার আত্মা ঠান্ডা হয়ে গেলো।আমার আপির ভালোবাসা বেঁচে আছে,আপির ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য তুমিই যথেষ্ট ভাইয়া।ভাইয়া আমি কি আপিকে বলবো, তুমিই ঝলক ভাইয়া?তোমার কাছে প্রমাণ নেই তো কি হয়েছে, আমি বললে আপি বুঝবে।
-না না, এটা করা যাবে না। তাহলে তোমার বোন ভাববে আমি তোমাকে চাপে ফেলে এগুলো বলাচ্ছি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।উল্টো ও আমাকে ভুল বুঝবে।
-তাহলে কি করবে ভাইয়া?
-সময় সব পথ দেখাবে নিশান !

দুটো রেকর্ডিং শুনেই মিশান নিশ্চিত হয়ে যায় এটা তীব্র নয় ঝলক! সেজন্যই মিশান সংক্রান্ত আদ্য অন্ত সমস্ত খবর জানে তীব্র বেশধারী ঝলক।দুটো রেকর্ডিং ই যথেষ্ট ছিলো মিশানের সমস্ত হিসেব মিলানোর জন্য।

ঝলক চাপে পড়ে সবটা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। এই রেকর্ডিং শুনে যে মিশান সবটা বিশ্বাস করে নেবে এতো সহজে, এটাও ঝলকের ধারণার বাইরে ছিলো। প্রমাণ ছাড়া মিশানকে সরাসরি কিছু বললে মিশান ভুল বুঝতে সময় নিতো না। তখন রাগের বশে ওর ছায়াতেও পা রাখতো না মিশান।

-আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমার ভেতর শান্ত হচ্ছে না। তোমার সাথে এমনটা কি করে হলো? এভাবে নিজের ভাইয়ের রূপ নিয়ে আছো কেনো? যতোই তুমি ঝলক হও, তোমার দিকে তাকালে শুধু চোখ দেখেই আমি তোমাকে আগের ঝলকের জায়গায় বসাতে পারবো না।

তীব্র মিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
– শুধু নামটা আর চেহারাটাই তো বদলে গেছে, মানুষটা আমি একই আছি । নিজেকে শান্ত্বনা দাও তোমার ভালোবাসা মরে যায় নি।তবে আমি বাকি জীবন তীব্র হয়েই কাটাতে চাই মিশান,ভাইয়ার অনেক কাজ বাকি আছে যেগুলো আমার সম্পূর্ণ করতে হবে।নিজের ভাইয়ের জানাজার শামিল হতে পারিনি, ওকে শেষ দেখাও দেখতে পারিনি। ওর এই চেহারাটা নিয়ে বেঁচে আছি। আমি আয়নার সামনে সেদিনই দাঁড়াবো যেদিন আমার ভাইয়ের অসম্পূর্ণ কাজ গুলো শেষ দিতে পারবো । ভাইয়ার সাথে সাথে আমি ঝলককেও মেরে দিয়েছি, আমি তীব্র হয়ে গেছি।
আমার সম্পূর্ণ ব্যবহার অব্ধি বদলে দিয়েছি যেমনটা আমার ভাই ছিলো। রোজ ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া অব্ধি আমার নাটক করতে হয়,রোজকার নাটকে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যেটা আমি না সেই রোলটা রোজ প্লে করতে হয়।অতীত গুলো ভাবলে অনেক কষ্ট হয় কিন্তু মানিয়ে নিই সবটা,এটা ভেবে তুমি আছো তো। না জেনেও আমার পাশে আছো।

-তুমি কেনো আমাকে একটা বার বলো নি।এতোগুলো দিন আমি তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায় বিপথে চলে গেছি।
-তোমার সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনো প্রমাণ আমার কাছে ছিলো না, আমি নিজেই একটা চক্রান্তে ফেঁসে গেছি। তাই ভেবেছিলাম সব হিসেব চুকিয়ে আমি তোমার সামনে দাঁড়াবো। এখন আমি চাইলেও ঝলক হতে পারবো না, আমাকে তীব্র হয়েই বাঁচতে হবে।তীব্র হয়েই তোমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে হবে।তোমাকে সেই আগের মতো ভালোবাসতে গেলে আমার ঝলক হতে হবে,যেটা আমি পারবো না। আমার ধারণা ছিলো প্রমাণ ছাড়া তুমি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করবে না, এইসব দুর্বল ভিত্তিহীন প্রমাণে যে তুমি বিশ্বাস করে নেবে সেটা বুঝতে পারিনি।
আবার এটাও বিশ্বাস ছিলো আমার,তুমি ঝলকের জায়গা অন্য কাউকে কোনোদিন দেবে না, তাই আমিও তোমার সামনে কখনো নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সম্পর্ক নষ্ট না করে সারাজীবন এই তীব্রর অভিনয় করেই তোমাকে একটু একটু করে ভালোবাসার জালে আটকাবো ভেবেছিলাম। তুমিই বলো মিশান, আজ যা যা দেখলে শুনলে, এগুলো আমি নিজে থেকে বললে আদৌ বিশ্বাস করতে?
যতোবার আমি তোমার সামনে যেতাম ততোবার আমি দুর্বল হয়ে পড়তাম, আর এই দুর্বলতাকে ঢাকতে আমি সব সময় বাজে ব্যাবহার করে ভেতরের অবস্থাকে ছাপিয়ে রাখতাম, নাটক করতাম প্রতিনিয়ত।তুমি যেনো অন্য কারো না হও সেজন্য হারানোর ভয় চাপে ভেতরে প্রচন্ড রকমের, আর সেজন্য তোমাকে আমি অই পরিস্থিতে জোর করে বিয়ে করি।
শুধু বিয়ে করেই তোমাকে রেখেছি, কখনো অধিকার ফলাতে যাই নি। কেনো জানো?
কারণ আমি সেই তীব্র হয়ে তোমার কাছে যেতে চাই নি যে তীব্রকে তুমি চেনো না জানো না ভালোবাসো না।

এগুলো করা কি আমার খুব দোষের কিছু হয়েছে?
তোমার ড্রিঙ্ক করা নিয়ে আমি বাঁধা দেই নি কেনো জানো?কারণ আমি বুঝি হারানোর যন্ত্রণা কি,তুমি তো আমার থেকে বেশি হারিয়েছো, তাই তোমার যন্ত্রণাও অমায়িক। আর আমি নিজেই তো একটা সাইকো, তোমাকে আর কি সঠিক পথ দেখাবো!আমি সেই ঝলক নেই মিশান, যাকে তুমি জানো।দিন শেষে আমি একটা খুনি,নিজের ভাইয়ের খুনি,এটাই আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায় মিশান।সময়ের কাছে আমি তোমার চেয়েও অসহায়।

মিশান আবারও কান্না জড়িত অবস্থায় জড়িয়ে ধরলো।দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।
হারিয়ে যাওয়া সম্পদ ফিরে পাওয়া, যে কারোর জীবনের হাসির কারণ হতে পারে।হারিয়ে যাওয়া জিনিস হয়তো আগের মতো থাকে না, একটু বিকৃতি ঘটিয়ে ফিরে আসে আমাদের জীবনে, তবুও একটাই প্রশান্তি হারানোকে ফিরে পাওয়া গেছে।

(চলবে)