তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি পর্ব-৪৮+৪৯

0
22

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৪৮
লেখিকা- রিয়া খান

-আচ্ছা তোমাকে তো বলাই হয় নি, আমি তো বাড়িতে ঢুকে তোমাদের কাজের লোকদের ক্লোরোফরম মেরে সেন্সলেস করে দিয়েছি।
-কোথায় রেখেছো ওদের?
-আরে রেখেছি তো চোখের সামনেই, সিঁড়ির পেছনে।
-সমস্যা নেই, মা না দেখলেই হলো।
-তোমার মা-বাবা কেউ তো বাড়িতে নেই।
-তুমি তো জানো না,আমার মা কিরকম চালাক, দেখতে রোগা শান্ত মনে হলেও আমার মা অতি ধুরন্ধর চালাক।কখনো মায়ের সামনে পড়লে খুব সাবধানে কথা বলো,তোমার অজান্তেই তোমার পেটের কথা টেনে বের করে আনবে।
-উনাকে দেখে তো বেশ বোকা বোকা লাগে।
-একটা কথা বলি,মনে কষ্ট নিও না মিশান।
মা তোমাকে অতোটাও পছন্দ করে না, বিশেষ করে আমার পাশে হয়তো মেনেও নেবে না কখনো। একদিকে মায়ের মাথায় দীপ্তি নাম চেপে আছে,আরেকদিকে তুমি নেশা করে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে তারজন্য মা আরো অনড় থেকে যাবে তাঁর সিদ্ধান্তে । কিন্তু তুমি টেনশন নিও না, সব কিছু ম্যানেজ করা আমার বাঁ হাতের কাজ শুধু সময় সাপেক্ষ ।
-আমি তো সেরাতের জন্য আপনার মায়ের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলাম।
-লাভ নেই।আমার মায়ের প্রচুর জেদ।মা সন্দেহ করে তোমার সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক আছে।মা তোমাকে জিজ্ঞেস করলে স্বিকার করে নিও না,তাহলে ব্যাপারটা আরো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
-আচ্ছা, এখন বের হই আমি,কাজ আছে তো।
-আমিও যাবো সাথে।
-না তুমি থাকো,আমি পারবো।
-জানি তুমি পারবে,কিন্তু ভয় থেকেই যায় ভেতরে, তাই দূর থেকে হলেও তোমার অগোচরে তোমার ছায়ার মতো হয়ে থাকি,যেনো তুমি বিপদে পড়লে এগিয়ে যেতে পারি।
-ব্রো! তোমার মিশান মাতাল হলেও এখন পাকাপোক্ত খেলোয়াড় ওহ সরি, কিলার হয়ে গেছে।
-হুম। সেটা তো নিজের চোখেই দেখছি দিনের পর দিন। ক্যাপ্টেন মিশান খান থেকে সিরিয়াল কিলার মিশান খান!

মিশান হেসে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, পিস্তল টা লুকিয়ে তীব্রর ঘর থেকে বের হয়ে যায়, তীব্রও রুম লক করে মিশানের পিছু পিছু বেরিয়ে যায়।ওদের ধারণা ছিলো বাড়িতে এই মুহূর্তে আর কোনো মানুষ নেই,কিন্তু নিমেষেই ধারণার মাঝে কাঁটা বিঁধল।
করিডোর পেরিয়ে ,নিচে নামার জন্য সিঁড়ির দিকে যাবে, অমনি তীব্রর মাকে দেখতে পায় নিচে বসে পায়ের উপর পা তোলে টিভি দেখছে। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ে, তীব্র মিশানকে চোখ দিয়ে ইশারায় দাঁড়াতে বলে,একা নিচে যায়, মায়ের পাশে বসে টি টেবিল থেকে নিউজ পেপার হাতে নিয়ে ওর মাকে বলে,
-সুগারলেস এক কাপ চা করে আনো তো।
তীব্রর মা টিভির দিকে তাকিয়ে উত্তরে বললো,
-সেই কখন বাড়িতে এসেছি, একটা পোকাকেও দেখতে পাচ্ছি না কাজের জন্য,যত্তসব অপছন্দনীয় কাজের মানুষ আমার ভাগ্যেই আসে।
কেটলিতে মাত্র চা করে এনেছি, কাপে ঢেলে খা।
তীব্র উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির দরজার দিকে যেতে লাগলো,পেছন থেকে ওর মা বলে উঠলো,
-কোথায় যাচ্ছিস?
-বাইরে চা খেতে।
-আহা! রাগ করছিস কেনো?বললেই পারিস এটা খাবি না,আমি করে আনছি এখনি।
-নাহ তোমার কষ্ট হবে আবার,আমি বাইরেই খেয়ে নেবো।

খিটখিটে ভাব নিয়ে তীব্রর মা বলে উঠলো,
-তীব্র!সব সময় মেজাজ দেখাবি না,আমার মন মেজাজ খুব একটা ভালো না। মায়ের দিকে একটু তাকাস,আমারও একটা প্রাণ তোদের মতো।

তীব্র ঘুরে এসে আবার সোফায় বসলো, তীব্রর মা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো।
ওর মা রান্না ঘরে প্রবেশ করতেই তীব্র টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো, মিশান বুঝে যায় নিচে ম্যানেজ হয়ে গেছে,এক দৌড় দিয়ে তীব্রর পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। মিশান বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তীব্রও উঠে দাঁড়ায়, এমন সময় তীব্রর মা হাতে কাপ পিরিচ নিয়ে ওর দিকে আসে,
-কিরে আবার কোথায় যাচ্ছিস?
-চা খেতে।
-আমি যে, চা করে আনলাম।
-পাতিলে আগেই চা করা ছিলো,তুমি সেটাই গরম করে এনেছো। অই চা আর কেটলির চাতে কোনো পার্থক্য নেই। এরচেয়ে বরং, আমি চা বাইরেই খাই গিয়ে।

কথাগুলো শেষ করেই তীব্র চটজলদি বেরিয়ে গেলো।
-কাজ পড়ে গেছে বলে বেরুচ্ছে সেটা বলছে না, আমার দোষ দিয়ে যাচ্ছে।
এই কাজের লোক গুলো কোথায় গেলো?সবাই হয়তো ছাদে আড্ডা দিচ্ছে, কি আর করার, জানে না হয়তো আমি এসেছি,নিজেই ডেকে নিয়ে আসি গিয়ে।

তীব্রর মা ছাদে উঠে এদিক ওদিক তাকাতাকি করে খুঁজে পাচ্ছে না কাউকেই।কি মনে করে যেনো ছাদের কিনারায় যেতেই দেখে তীব্র বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রহমান গাড়ি নিয়ে আসে, রহমান গাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে।
তীব্র গাড়ীর অপর পাশের ডোর খোলে দিতেই অন্ধকার থেকে মিশান এসে দৃশ্যমান হয়,মিশান গাড়িতে উঠে বসে, এরপর নিজে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে।

বাড়ির চারদিকে পর্যাপ্ত লাইটিং থাকার কারণে সবটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তীব্র মা উপর থেকে দেখে অনেকটা অবাক হলো, বাড়ির এরিয়াতে মিশান কি করে এলো।
মনে মনে আন্দাজ করে ফেললো মিশান হয়তো বাড়ির ভেতরেই ছিলো তীব্রর সঙ্গে।

বাড়িতে থেকেও কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি বলে নিজের উপর রাগ হতে লাগলো।

মিশান মোবাইলে লোকেশন দেখে দেখে তীব্রকে বলছে আর সে অনুযায়ী তীব্র গাড়ী ড্রাইভ করছে। যাকে মারবে তাঁর লোকেশন ট্র‍্যাক করে নিজের মোবাইলে সেটিং করেছে।লোকটা রাত করে বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছিলো।

-গাড়িটা এখানেই থামাও।বাঁ দিক থেকে আসছে ও।পাঁচ দশ মিনিটেই এদিকটাই এসে যাবে।
তীব্র গাড়ি থামালো।মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমার গাড়ির পেছনের সিটে তোমার রেড ওয়াইন, নিয়ে নাও।

মিশান মুচকি হেসে দিয়ে বললো,
-পুলিশের লোক,তাও আবার সিনিয়র অফিসার হয়ে গাড়িতে করে মদ নিয়ে ঘুরেন,ভয় লাগে না?
-না তো!
-বুঝবেন যেদিন কোনো সাংবাদিকের নজরে পড়বেন।তারপর নিউজ হেডলাইন হবে আপনাকে নিয়ে”দেখুন এসপি হয়ে গাড়ির ভেতর কি নিয়ে চলছে”

এরপর বিস্তারিত খবরে থাকবে,
“এস পি সাফওয়ান রেজা তীব্র।স্পেশাল ব্রাঞ্চের স্বনামধন্য এক অফিসার। যে কিনা চিতা বাঘের মতো থাবা মেরে ক্রিমিনালদের ধরে,আর তাঁরই গাড়িতে পাওয়া গেছে মদের বোতল! প্রতিরাতে বার থেকে মদ নিয়ে বের হোন, সেই মদ প্রেমিকার সাথে ভাগ করে খান দুজনে।
দেশের পুলিশদের ই যদি এই হাল হয়,সাধারণ পাব্লিকের কি হবে?”

এগুলোর সাথে বেরিয়ে আসবে চাঞ্চল্যকর আরো তথ্য,আমার গোষ্ঠী বর্গের পরিচয়,আপনার গোষ্ঠীর পরিচয়।
তাদের সাক্ষাতকার। সব উদ্ধার করে দেবে!
-এতো কিছু ঘটার হলে অনেক আগেই ঘটতো মিশান খান।আর হলেই হলো, ভয় পাই নাকি আমি?তোমার জন্য এইটুকু করতেই পারি ।
-এগুলোর আর প্রয়োজন হবে না।
-এলকোহল ছাড়াই মার্ডার করতে যাবে?
-যেখানে তুমি আছো,সেখানে এলকোহলের প্রশ্নই আসে না।
তোমার থেকে মারাত্মক এলকোহল আর কিসে আছে?

তীব্র হেসে দিয়ে মিশানের গাল ধরে টেনে বললো,
-এতোদিনে হুঁশে এলো এটা?
-প্রচ্চুর পিনিক!

দুজনেই হাসতে হাসতে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির সামনে উঠে পা ঝুলিয়ে বসতেই তীব্র মিশানকে কাছে টেনে নিয়ে কাঁধের উপর হাত ঝুলিয়ে রাখে।

বসে বসে কিছুসময় কথোপকথনের পর, মিশান স্লিপ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ডিকি থেকে একটা মোটা রডের দন্ড নিয়ে বের হলো,মাস্ক পড়ে হুডিটা পড়তে পড়তে কিছুটা দূরে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে,তীব্র পা ঝুলানো থেকে জোড়াশীন পেতে বসে গাড়ির সামনেই।
গাড়িটা রাস্তার একদম সাইডে অন্ধকারের মধ্যে পার্ক করা হয়েছে।

দূর থেকে গাড়িটা আসতে দেখে মিশান পকেট থেকে একটা লেজার লাইট বের করলো, যার সবুজ রঙের আলো টা তীর্যকভাবে বস্তুর গায়ে লাগে, আবার একটা ক্যাপ পড়ালে জোনাকিপোকার আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে পুরো এরিয়াতে।

ছেলেটা নিজের গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে এদিকে আসছে, মিশান ছেলেটার চোখ বরাবর লেজার লাইট ধরায় ছেলেটা ড্রাইভ করতে পারে না,চোখের মণিতে বিঁধে পড়ে সবুজ আলোটা,যার কারণে এলোপাথাড়ি ড্রাইভ করতে করতে গাড়ির গতি ব্রেক করে।রাগান্বিত মেজাজে গাড়ি থেকে বেরিয়ে মিশানের দিকে এগিয়ে আসে বকতে বকতে।
– এই কেরে তুই? রাস্তার মাঝখানে সং জুড়েছিস?রাস্তা কি তোর বাপের? সাইকো নাকি?এতো রাতে প্র‍্যাংক করতে বেরিয়েছিস?কোথায় তোদের ক্যামেরাম্যান? ডাক দে!প্র‍্যাংক করা শেখাচ্ছি।

কথাগুলো বলতে বলতে মিশানের কাছাকাছি যাওয়ার আগেই মিশানের হাতে একটা বিয়ারিংয়ের মতো বস্তু চারপাশে কাঁটা কাঁটা ডিজাইন, সেটা ছুঁড়ে মারে।সঙ্গে সঙ্গে সেটা লোকটার গলায় গিয়ে বিঁধে পড়ে।
লোকটা গলায় থেকে ওটা ছাড়াতে গিয়ে আরো আহত হয়, কিন্তু ছাড়াতে পারে না। মিশান লোকটার কাছে দিয়ে, মোটা রডের অই লাঠিটা দিয়ে মাথায় আঘাত করলে মাটিতে নুইয়ে পড়ে।

এরপর গলায় থেকে সেই কাঁটাময় বিয়ারিং টা টেনে তুলে। এতে লোকটার প্রাণ বের হওয়ার পেছন খুব একটা সময় ব্যয় হয়নি।

এরপরেও মাথার পেছনে আরো কয়েকটা বাড়ি মারলো।

এই লোকটাকে খুব একটা আঘাত দিয়ে মারলো না, নেশা না করার কারণ ভেতর থেকে হিংস্রতা তেমন ভাবে বেরিয়ে আসছে না মিশানের।

প্রাণ বের হওয়া অব্ধি লোকটার পাশেই বসে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ মৃত লাশটার পাশে থাকার পর মিশান এক হাতে রক্তাক্ত বিয়ারিং আরেক হাতে লোহার দন্ডটা ঘুরাতে ঘুরাতে তীব্রর কাছে গেলো।
-এতো হাল্কা পাতলা ভাবে মারলে?লাস্ট ছিলো তো।
-নাহ!ড্রিঙ্কস করিনি তো তাই ভেতর থেকে খুব একটা স্পীড আসছে না।আরেকটা কথা বলবো?
-বলো,
-কেনো জানি মনে হচ্ছে, এটাই শেষ না। আরো আছে।আর কেনো জানি মনে হচ্ছে এতোগুলো দিন ভরে যাদের খুঁজে খুঁজে বের করে নৃশংসভাবে মারলাম, তাঁরা কেবলই দাবার গুটি,পেছনে কেউ চাল গুলো চেলেছে। জানি না, কেনো জানি মনের মধ্যে এই প্রশ্ন গুলো খুব করে আসছে।এটা বেশ কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিলো,মাঝখানে তুমি মাথায় ঢুকিয়ে দিলে ঝলকের মার্ডার কেস।সব মিলিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিলো,মাথা পাগল হওয়ার উপক্রম।
আজকে তো সবটা ক্লিয়ার হয়েই গেলো।
শুধু এই একটা ব্যাপারে মনের কোণে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তীব্র ফরমাল হাসি দিয়ে মিশানকে বললো,
-চলো জাফর দাদার এরিয়াতে একটু ঘুরে আসি, মনটা হাল্কা হয়ে যাবে।
বড়লোক মানু্ষের বিলাসিতা দেখতেও ভালো লাগে।
এমনিতেই জাফর অনেক সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে চলে।অভিজিৎয়ের মৃত্যুর পর ওর সিকিউরিটি আরো চৌগুণ হারে বেড়ে গেছে।
-অনেক যন্ত্রণা তোমার ভেতরে তাই না?
-নাহ!এখন আর কষ্ট লাগে না,সব যন্ত্রণা এখন প্রতিশোধে কনভার্ট হয়েছে।
-তাহলে এতো দিনে নিশ্চয় ফাঁদ ভালোমতো তৈরী হয়েছে?
-সেতো অবশ্যই, শুধু প্রয়োগের অপেক্ষা।
– কবে নামছি এই মিশনে?
-পরিস্থিতি বুঝে, ঝোপ বুঝে কোপ হবে,সময় অনিশ্চিত।
-বুঝেছি বস! চলুন ঘুরে তাহার রাজ্য খানা।

অনেকটা পথ যাওয়ার পর, তীব্র হঠাৎ মিশানকে বললো,ড্রাইভিং সীটে বসে ড্রাইভ করতে।মিশান ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ী চালাতে থাকে,পাশে তীব্র বসে বসে গান লোড করতে থাকে।

(চলবে)

গল্প- তেজস্ক্রিয় রক্তধ্বনি
পর্ব- ৪৯
লেখিকা- রিয়া খান

পিস্তল লোড করার পর সাইলেন্সার লাগিয়ে , বাম হাতে পিস্তল নিয়ে জানালার গ্লাস খুলে বাইরে বের করে সামনের একটা গাড়িকে টার্গেট করতে লাগলো।
প্রথমে তো উপরের দিকে শ্যুট করতে যাচ্ছিলো,পরক্ষণেই গাড়ীর টায়ারে গুলি করতেই গাড়ি এঁকে বেঁকে সামনের দিকে একটু এগুতেই থেমে যায়।

-কে ওটাই?
-কাদের মোল্লা।
-কি করে শিউর হলে?
-কোথায় মরা গরু আছে তার জন্য শকুনের কাছে গিয়ে দেখতে হয় না।তাছাড়া ধারণাও ছিলো এমন কিছু হবে,সবটা একটু পরে এক্সপ্লেইন করছি,
তুমি ভেতরে থাকো আমি আসছি।

তীব্র গাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই কাদের মোল্লা তাঁর গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির টায়ার দেখতে থাকে।

এতো রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছিলো জাফরের সাথে দেখা করতে, সঙ্গে ড্রাইভার পর্যন্ত আনেনি। তীব্র গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর দূরে থেকেই তীব্রর কায়া দেখেই ভয় পেয়ে যায়।
গাড়ি ঠিক করার মতো সময় তো দূর, নিজেকে বাঁচানোর সময়ও নেই।তীব্র ওর দিকে এগুতেই উল্টো ঘুরে দৌড় দেয়, তীব্র পেছন পেছন না দৌড়িয়ে স্বাভাবিক গতিতেই হেঁটে যাচ্ছে।কারণ কাদের মোল্লার বয়স যথেষ্ট হয়েছে,একটু পরই হাঁপিয়ে যাবে।রাস্তা দিয়ে কেবল উত্তরবঙ্গের গাড়ি চলছে শুধু, যেগুলোর নিচে পড়ে পিষে মরলেও গাড়ি থামবে না। কাদের মোল্লা যতোই শরীরের শক্তি প্রয়োগ করে সামনে এগুনোর চেষ্টা করছে ওর বেগ ততোই যেনো কমে আসছে।

জাফরের মতো একটা লোকের সাথে যদি দিনের আলোয় খোলা আকাশের নিচে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দেখা করতে যাওয়া আসাটা দশজনের কাছে স্বাভাবিক লাগবে না। তাই এভাবেই চোরের মতো রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে জাফরের সাথে দেখা করে যেনো একটা পিঁপড়াও টের না পায়।

যেদিন দীপ্তি মারা যায়, সেদিন ঘটনাস্থলে এই কাদের মোল্লা আর মোনায়েম ছিলো।

হলিক্রসে টিচার্সদের একটা মিটিংয়ে এটেন্ডের পর রাত হয়ে যায় অনেক, মাথা যন্ত্রণার কারণে দীপ্তি একটা ক্যাফেতে যায় এক কাপ কফি খেতে, কফি খেয়েই বাড়িতে চলে যাবে ভেবেছিলো।

রাত অনেকটা হওয়ার কারণে ক্যাফেতে মানুষের সংখ্যা খুব ই কম,হাতে গোণা দু এক টেবিলে, দু চারজন মানুষ।

দীপ্তি কফি খাচ্ছিলো। ঠিক এমন সময় পাশের টেবিলে শুনতে পায় ঝলক তীব্র টপিক,দীপ্তি কান পেতে শুনতে থাকে সবটা।
কাদের কোনো ভাবে জেনে গেছে তীব্রর ক্যারেকটার প্লে করা মানুষটা ঝলক,তীব্র আসলে মরে গেছে। এটা নিয়ে মোনায়েমের সাথে আলোচনা করছিলো এমন একটা জায়গাতে।

ওদের মুখে আলোচনা শুনে দীপ্তির
গায়ে লোম দাঁড়িয়ে যায়,নিজের অজান্তেই হাতে কাঁপুনি উঠে যায়,কফির কাপটা হাতে নিতে গিয়েও থরথর করে কাঁপতে থাকে, একদিকে তীব্রর মৃত্যুর সত্যিটা আরেক দিকে এতো বড় গল্প সাজানো হয়েছে ঝলককে ঘিরে, এগুলো জানার পর ভেতরে বাইরে শান্ত না থাকাটাই বাস্তব।

পরিস্থিতি সাপেক্ষে কফিটা মুখের কাছে নেয়ার আগেই হাত থেকে কাপটা পড়ে যায়।দীপ্তি সটকে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরে,মোনায়েম বা কাদের কেউ ওকে দেখার আগেই মুখ ছাপিয়ে জায়গা পরিত্যাগ করে, উঠে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে গিয়ে বিল আর জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে যায় ক্যাফে থেকে।কিন্তু দীপ্তির দূর্ভাগ্য সেদিন ওর কাপটা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা ওকে নোটিস করে, আর ভেবে নেয় হয়তো দীপ্তিকে এখানে পাঠানো হয়েছিলো ওদের ফলো করে আড়ি পেতে কথা শোনার জন্য।দীপ্তিকে চিনতে ওদের দেরি হয়নি এক সেকেন্ড।এরকম চিন্তা মাথায় আসার কারণ কিছুদিন আগেই ওদের খেলার বড় এক গুটি অভিজিৎ মারা গেলো অমন ভাবে,সেখানে দীপ্তির মতো মেয়েরাই সাহায্য করবে এসব কাজে এটাই স্বাভাবিক।

এরপর কাদের মোল্লা দীপ্তির পেছনে লোক লাগিয়ে দেয় আর ওরাই দীপ্তিকে তোলে নিয়ে টর্চার করে গুলি করতে গিয়েও থেমে গিয়ে একটা ফ্ল্যাটের উঁচু তলায় নিয়ে উপর থেকে ফেলে দেয়।

দৌড়াতে দৌড়াতে উঁচু নিচু কংক্রিটের ঢালাইয়ের সাথে কাদের হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।উঠে দাঁড়ানোর পর আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করে।

তীব্র পেছন থেকে কাদেরের ডান পায়ের হাঁটু বরাবর একটা গুলি করতেই কাদের আবার উপড়ে পড়ে যায়।
তীব্র কাছে যেতেই, কাদেরের পাশে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-চিন্তা করবি না,তোকে এতো তাড়াতাড়ি মারছি না।মৃত্যু কি সেটা বুঝে যেতে হবে না?
প্রতিটা সেকেন্ডে বুঝাবো তোদেরকে, মৃত্যু কতটা কঠিন আর সত্যি। কতটা তুচ্ছ তোদের পাপের কামানো পাওয়ার প্রোপার্টি এই মৃত্যুর কাছে।চল তোকে পৃথিবীটা ঘুরিয়ে আনি।

কাদেরের যে পায়ে গুলি করা হয়েছে সেই পা দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিজের গাড়ির দিকে নেয়।কাদের চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে,কিন্তু ওর আর্তনাদ শোনার জন্য রাস্তায় একটা কুকুরও নেই।

হাত দুটো পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে, মুখটা সিল করে দেয়,পা দুটো কষে বেঁধে শরীরের সাথে এক করে বেঁধে গাড়ির ডিকিতে ভরে।

গাড়িতে উঠে বসার পর মিশান তীব্রকে বললো,
-তুমি তো বস, জিপিএস ট্র‍্যাকারের চেয়েও ফার্স্ট!শুধু ধারণার প্রেক্ষিতেই ওকে পেয়ে ধরে আনলে!
-কাদের কিভাবে জেনেছে সত্যিটা, আমি জানি না। অভিজিৎ মারা যাওয়ার পর জাফর অভিজিৎয়ের লাশ নিয়ে সেই যে দেশ ছাড়ে এর মধ্যে আর দেশে ফিরেনি,এমনকি কাদের বা মোনায়েম ওদের সাথেও কোনো গোপন আলাপ করেনি ফোনে । আবার ওদেরকে বারণও করেছিলো যেনো জাফরের সাথে দেখা করার জন্য ওরাও দেশ না ছাড়ে।
অভিজিৎ আগে কাতারে থাকতো ঠিকি,ভাইয়া মোটা অংকের বাঁশ দেয়ার কারণে কাতারের সরকার অভিজিৎকে বের করে দেয় দেশ থেকে,চোরের থাকে সাত গাছি পথ,এরপর অন্যদেশে চলে যায় ও।অভিজিৎয়ের ফার্স্টক্লাস বিজনেসের এলাকা হলো আফ্রিকা, সেজন্য ও আফ্রিকা বাদ দিয়ে অন্যান্য দেশে থাকতো।
সে যাই হোক,জাফরের সাথে গোপন কথা একমাত্র সামনাসামনি বলার কথা ছিলো বলে, আমার ব্যাপারে কাদের বা মোনায়েম কেউ জাফরকে কিছু বলেনি।

জাফর আজকে সকালে দেশে ফিরেছে,আর এই নিউজ পাওয়ার পর কাদের পিঁপড়ার মতো যাচ্ছিলো জাফরের কাছে,আমার ব্যাপারটা জানাতে।তাঁর আগেই মাঝ রাস্তায় আমি সুতা কেটে দিলাম!

আর মোনায়েমকে তো সেই বিকেলেই ধরেছি,দুটোকে এখন আমাদের অই রহস্যময় দালানের নিচ তলায় উল্টো ঝুলিয়ে রেখে পেটের কথা বের করবো।

-তাহলে গাড়ি কি ঘুরাবো এখন?
-হুম ঘুরাও।

মিশান গাড়ি ঘুরিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গাটাতে নিয়ে যায়, মোনায়েমকে অলরেডি তীব্র উল্টো ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে, এখন কাদেরকেও ঝুলিয়ে রাখলো, মুখ দুটো সিল করা দুজনের ই, হাত পা এনন ভাবে বেঁধে রেখেছে নড়াচড়াও করতে পারছে না।

-মিশান।
-হুম।
-আজকের মতো বাড়িতে চলে যাই,রাত হয়েছে অনেক।এরা উল্টো ঝুলে কিছুক্ষণ পরামর্শ করুক।আমাদের উচিৎ ওদের একটু সময় দেয়া।
-রাইট তীব্র। আর এমনিতেও মানুষের মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে হয়, ওদের শেষ ইচ্ছা এখন এটাই ওরা বাঁচতে চায়,তাই ওদের কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখাটা আমাদের উচিৎ।
-চলো এদের মুখ দেখে রাত নষ্ট না করি।

মিশান তীব্র দুজনেই চলে যায় বাড়িটা থেকে।তীব্র মিশানকে মিশানের মামার বাড়িতে দিয়ে নিজের বাড়িতে যাবে।
-মিশান!
-হুম?
-তুমি যে মদ খাও কখনো বাড়িতে ধরা খাও না?
-নাহ,দ্বীপ আর তাপসিনের কারণে ধরা খেয়েও খাই না। উপরওয়ালা আমাকে দুটো ভাই দিয়েছে রক্তের চেয়েও আপন!

তীব্র বাঁকা হেসে বললো,
-দ্বীপ আর তাপসিন ছাড়াও একজন আছে যে জানে তুমি ড্রিঙ্কস করো,রাত বিরাত কখন কখন বের হও সব জানে।

মিশান তীব্রর দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-মিমি?
-নাহ, তোমার মামা।
মিশান চোখ বড় বড় করে বলে,
-মামাহ!
-হুম,
-মামা এতো কড়া,আমি ড্রিঙ্ক করি সেটা জেনেও কিছু বলে না আমাকে?হিসেব অনুযায়ী তো আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কথা,আর মামা কি করে জানলো?
-দ্বিতীয় উত্তর, তোমার রোজ রাতে নেশা করে বাড়িতে ফেরাটা তোমার মামা নোটিস করে।এরপর একদিন বাড়ির বাইরে তাকে তাকে থাকে, তুমি নেশা করে বাড়িতে ফেরো বাড়ির গেট ইউজ না করে ওয়াল ডিঙিয়ে বিভিন্ন কৌশলে বাড়িতে ঢুকো,আবার বের হও একই ভাবে, সে রোজ রোজ দেখতে পায় তোমার একই কর্মকান্ড।ড্রিঙ্ক করার ব্যাপারটা নিয়ে খুব আপসেট হয়ে পড়ে তোমার মামা, এরপর আমাকে জানালে আমি তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে স্বাভাবিক ভাবে নিতে বলি।
-এক মিনিট, মামা কেনো তোমার সাথে এটা শেয়ার করলো?
-কারণ তোমার মামাও জানে আমি কে, এবং আমি যে তোমাকে বিয়ে করেছি তোমার মামার পারমিশন নিয়েই।তোমার সাথে যে আমার আগে প্রেম ছিলো সেটাও জানতো সেসময় থেকেই।সো তোমার স্বামী হিসেবে এটা আমাকে জানানো দায়িত্ব বলে তাঁর মনে হয়েছিলো,যার কারণে তৃতীয় কাউকে না বলে আমার সাথেই শেয়ার করেছিলো।
– এতো কিছু! আমি কিছুই জানি না।
-ইট’স ওকে মিশান, সব কিছুই পরিস্থিতির স্বীকার।

মিশান নিরব হয়ে গেলো, ওর ভেতরে প্রচন্ড গিল্টি ফিল কাজ করছে।
তীব্র বাড়ির সামনে নামিয়ে দিতেই মিশান চুপচাপ বাড়িতে যায়, আজকে আর কোনো প্রকার পেছনের রাস্তা ব্যবহার করেনি, বাড়ির সামনে দিয়েই ঢুকে, কলিংবেল চাপতেই সঙ্গে সঙ্গে মিশানের মামা দরজা খুলে দেয়,মিশান একদৃষ্টিতে মামার দিকে তাকিয়ে থাকে থাকে।ড্রয়িংরুমে ড্রিম লাইট জ্বলার কারণে সাদেক খান খেয়াল করে মিশানের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

সাদেক খান গম্ভীর স্বরে বললো,
-ডিনার কি বাইরে করেছো? নাকি মিমিকে বলবো খাবার সার্ভ করে দিতে।
-না মামা , খিদে নেই খাবো না।
– ঠিক আছে, যেটা ভালো বুঝো।

সাদেক খান নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো মিশান ড্রয়িংরুমে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো,
-মামাহ!

সাদেক খান ঘুরে তাকালো।
-কিছু বলবে মিশান?
চোখ ভরা পানি নিয়ে মিশান মামার কাছে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
-স স সরি মামা!আ’ম সরি! আমি তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি মামা!তোমার ভালোবাসা গুলোকে অপমান করেছি,তোমার দেয়া শিক্ষা গুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারিনি,তোমার শিক্ষার মূল মন্ত্র ছিলো ভালো মানুষ হওয়া আর আমি ভালো মানুষ বাদে সব হয়েছি।
আমি অনেক খারাপ মামা,তুমি যা ইচ্ছা শাস্তি দাও আমায়,আমি মাথা পেতে নেবো।আমি তোমাকে প্রমিস করছি মামা,আমি আর কোনোদিন ভুল করেও ড্রিঙ্ক করবো না মামা।তোমাকে আর কষ্ট দেবো না মামা,তুমি আমাকে শাস্তি দাও।
– এই মিশান!মা আমার কাঁদছো কেনো? আমি কি কিছু বলেছি? দেখো মা, যা হয়েছে সব ই পরিস্থিতি,যা তোমাকে ওদিকে ঠেলে দিয়েছে,এটা নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই। তোমার সাথে যা হয়েছে দিনের পর দিন, তাতে যে তুমি বেঁচে আছো এটাই বেশি। এই ড্রিঙ্ক করাটা তো ছিলো তোমার যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ মাত্র।অপরাধী তো আমি রে মা, তোমার প্রাণ ভ্রমর টা আমার কাছে আমানত রেখে তুমি কুয়েত চলে গেলে, আর আমি সে আমানতের খিয়ানত করেছি, আমি রক্ষা করতে পারি নি তোমার প্রাণ ভ্রমর, আমাদের আরেকটা মেয়েকে।
পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।

সব চেয়ে বড় অপরাধী তো আমি তোমার মায়ের কাছে, সে এতো কাকুতিমিনতি করে বলার পরেও আমি তাঁর দু মেয়ের এক মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। যদি কোনোদিন তোমার মা আমার সামনে দাঁড়ায় আমি কি উত্তর দেবো?
-মামা তুমি কেনো অপরাধী হবে? তুমি আমাদের দু বোনের জন্য কম করোনি,যতো বলবো তোমার নামে ততোই কম হবে মামা।তোমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে কি হতো আমাদের সাথে জানা নেই।যে মামা বাবার চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে সে মামা কখনো অপরাধী হতে পারে না।যদি এমনটা হতো তুমি আমাদের দু বোনের একজনকে নিজের হাতে মেরে ফেলতে, তবুও কোনো আফসোস হবে না মামা।কারণ তোমার উছিলাই সৃষ্টিকর্তা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যদি তোমার উছিলাই ই মরি কোনো আফসোস রবে না।
তোমার নামে কোনো অভিযোগ নেই মামা।
তুমি অনেক ভালো, আমি ব্যর্থ তোমার দেয়া শিক্ষা গুলো আমি নিজের মাঝে ধারণ করতে পারিনি।

মিশান অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে মামাকে জড়িয়ে ধরে।
কান্না আওয়াজ পেয়ে মিশানের মামী নিজের ঘর থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে এসে লাইট জ্বালাতেই দেখে মিশান মামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মিশানের কান্না দেখে মামী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
– মিশান!মা কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো মা?
মিশান মামাকে ছেড়ে দিয়ে মামীর গলা জড়িয়ে ধরে হেচকি তোলে কাঁদতে লাগলো।
-কি গো মেয়ে কাঁদছে কেনো?
-তেমন কিছু না, বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল মিশানের তাই ওর মনটা খারাপ।
-মিশান! বাবা মায়ের কথা কেনো হঠাৎ মনে পড়ছে মা? কি লাগবে তোর?
তুই তো কখনো মা বাবার কথা মনে করে কাঁদিস না। মা বল কি লাগবে তোর?
আমরা কি তোর বাবা মায়ের থেকে কম? মামা মিমি বলে ডাকিস বলে কি আমাদের বাবা মা মনে করতে পারিস না?
-তোমরা যতোটা অসাধারণ ,বাবা মাও এমন হয় না মিমি।
বাবা মায়ের উর্ধ্বে যদি কিছু থাকে তবে তোমরা সেটাই।না হলে কি করে অই ছোট্ট বয়সে একদেশ থেকে আরেক দেশে এসে অচেনা তোমাদের সাথে জীবন জোড়া দেই?
জানি না কি করে তোমাদের কাছে এসেছি , হয়তো সৃষ্টিকর্তার কোনো মহিমা ছিলো, আমাদের দু বোনের ভালো থাকার জন্য তোমাদের জীবনটাকেই বেছে দিয়েছেন।
-তাহলে কাঁদছিস কেনো?
-এমনিই!কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
-তাহলে চল তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই,এতো রাতে মেয়েটা কাঁদছে, মাথা ব্যাথা করবে তো,এমনিতেই তোর মাথায় সমস্যা।চল।

মিশানকে নিয়ে মিশানের মামী ওর রুমে নিয়ে যায়, মিমির কোলে মাথা রেখে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সাদেক খান মিশান চলে যাওয়ার পর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে মিশানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে,মেয়েটার জন্য ভীষণ কষ্ট হয়।

বেশ কয়েকদিন যেতে থাকে তীব্র সেই যে মোনায়েম কাদেরকে বেঁধে রেখেছে এখনো সেই অবস্থাতেই।বেশ কয়েকদিন যাওয়ার কারণ ওদের মুখ কোনো ভাবেই খোলা যাচ্ছে না, মরবে তবুও সত্যিটা বলে যাবে না।
তাই তীব্রও ওদের মৃত্যু যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে রেখে দেয় অমনিই, কখনো উল্টো ঝুলিয়ে কখনো গরম পানিতে ডুবিয়ে আবার কখনো বরফ যুক্ত ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে রাখে, গুলিবিদ্ধ জায়গাটাতে কোনো প্রকার প্রাথমিক চিকিৎসা অব্ধি দেয়া হয়নি, সেখানে ইনিফেকশন ধরে গেছে।

এতো যন্ত্রণা সহ্য করছে তবুও মানুষ দুটো মুখ খুলছে না, আবার মরছেও না। খারাপ মানুষের প্রাণ শক্ত হয় এদের দেখলেই বুঝা যায়।

শেষ বিকেলের দিকে মিশান দ্বীপকে নিয়ে বাইরে বের হয়, দ্বীপ ড্রাইভ করছে আর মিশান পাশে বসে আছে মুখ গম্ভীর করে।সন্ধ্যার দিকে ওরা পদ্মার তীরে এসে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে বেরিয় দুজনেই গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
-এই জায়গাটা নিশানের বেশ পছন্দের ছিলো,রাত বিরাত এখানে আসার বায়না করতো খুব।
-হুম।আমি ওকে প্রায় ই এখানে আনতাম।
-শেষ সময়টাতেও এখানেই এনেছিলি তাই না?

মিশানের মুখে এই কথা শোনার পর দ্বীপ থমকে যায়।
-এই জায়গাটাতেই যদি তোকে মেরে ভাসিয়ে দেই,এই নদীর মাছ ছাড়া আর কোনো জীব প্রাণীকুল জানবে না , এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে মানুষের আনাগোনা,তুই বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ এক কিলোমিটার দৌড়াতে পারবি এর পরেই তোকে আমি ধরে ফেলবো।

দ্বীপ ইতস্ততভাবে চোখ ছোটো করে উত্তর দিলো,
-মি মিশান কি বলছিস তুই এসব?এমন ইয়ার্কি ভালো লাগে না।
-জীবনে অনেক রকম ধাক্কা খেয়েছি,কিন্তু কখনো বিশ্বাস ঘাতকতার সম্মুখীন হই নি।এতো নিখুঁত অভিনয়! কি করে পারলি বছরের পর বছর কন্টিনিউ করতে? মুখোশ মানুষ থাকে শুনেছি কিন্তু কখনো নিজের চোখের সামনে দেখবো কল্পনাও করিনি,অন্ততো তোকে নিয়ে!রক্তের ভাই ভাবতাম তোকে আমি।তোর ই বাবা করুণা করে আমাদের দু বোনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো,আর সেই বাবার সন্তান হয়ে তুই আমার বোনকে মেরে দিলি।কি দোষ ছিলোরে আমাদের?কেনো মারলি আমার বোনটাকে?
-মিশান কিসব বলছিস!আমি কেনো নিশানকে মারবো? এসব কথা তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে অই তীব্র তাই না? ওর কথায় তুই আমাকে কিভাবে ভুল বুঝছিস?যে ছেলেটা তোর জীবন নষ্ট করে দিয়েছে,অই কালপ্রিট রাস্কেলটার কথায় তুই আমাকে ভুল বুঝছিস?
নিশান আমার বউ!ভালোবাসি আমি ওকে, আমি ওকে মারবো কেনো?
-তীব্র আমার হাজবেন্ড, ওর নামে খারাপ কথা বললে আমি মানবো না। আর আমি তো একবারও বলিনি তীব্র আমাকে এসব বুঝিয়েছে।তুই কেনো তীব্রর নাম নিলি?ব্যাপার টা এমন হলো না? ঠাকুর ঘরে কে রে,আমি তো প্রসাদ খাই নি!
চিন্তা করিস না, আর সবার মতো তোকে মারবো না,তুই নোংরা হলে কি হবে,আমার বোন তো তোকে ভালোবাসতো,নাহয় মৃত্যুর আগে জানতে পেরেছিলো তোর নরপিশাচ রূপ।
ভাগ্যিস আমার বোনটা সব জেনে মরেছে,আর মরার আগে জানিয়েও গিয়েছে,নাহলে সারাজীবন তো আমি তোর এই রূপটাকে বিশ্বাস করে যেতাম।
কি শাস্তি দেবো তোকে?ছেড়ে দেবো আমার বোনের ভালোবাসার মানুষকে? নাকি মেরে ফেলবো আমার বোনের খুনিকে?

(চলবে)