তোতাপাখি আমার পর্ব-০৪

0
24

#তোতাপাখি_আমার

০৪.
নিজের ক্ষত সারিয়ে তুললো যে জন, তাকেই যখম করে বসল!–ভাবতেই অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে ঘুঙুরের ছোট্ট হৃদয়। আড়চোখে কল্পের হাতে স্পষ্ট ভিজিবেল নখের আঁচড়ের ওপর দৃষ্টি চলে যাচ্ছে তার। কল্প এটা নিয়ে কিছুই বলছে না। ভাব এমন যেন সে দেখেইনি। কিন্তু ঘুঙুরের খারাপ লাগছে খুব। একটা সময় হৃদয়ের দহনে পরাস্ত হয়ে মুখ খুললো সে। মিনমিনে স্বরে বলল,

“আপনার হাতে অনেকটা লেগে গেছে। আমি খুবই দুঃখিত। ইচ্ছে করে করিনি। আমি আসলে এটা করতেই চাইনি। আনমনে কখন যে…….।”

কল্প এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। দৃষ্টিতে প্রশ্ন। ঘুঙুরের ব্যগ্রতা দেখে মনে মনে হাসলেও প্রকাশ্যে ধমকে উঠল। বলল,

“এত পাকনামো করতে কে বলে তোকে? আমি বলেছি এটাতে কোনো প্রবলেম হচ্ছে আমার? অহেতুক বকবক করিস কেন?”

ঘুঙুর ব্যথিত কন্ঠে বলল,
“কষ্ট হচ্ছে না আপনার? জ্বালা করছে না?”

কল্প একপল ওর মায়াময় আদলে নিজের নম্র দৃষ্টি ভরে দেখল। মন্থর কন্ঠে বলল,
“নিত্য যে দহনে জ্বালাস আমায়, তার কাছে এই জ্বলন কিছুই না।”

ঘুঙুর বোকার মতো চেয়ে রইল। সে নিত্য জ্বালায় কল্পকে? কিন্তু কখন? কীভাবে?

তার বোকা বোকা চাহনি উপেক্ষা করে ধমকে উঠল কল্প। বলল,
“এভাবে কী দেখিস? হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই চেয়ে থাকতে হবে? এতই যদি আমার যখম নিয়ে অনুশোচনা হয় তাহলে শাস্তি পেতে তৈরি হ। অপরাধের বদলা তো শাস্তিই হয়?”

ঘুঙুর শুকনো ঢোক গিলল। নিজের করা বোকামিতে সে নিজেই ফেঁসে গেল। কী দরকার ছিল ওই লোকের জন্য এত ভাবার। এখন হল তো। সে ভীত কন্ঠে বলল,

“আবার শাস্তি?”

কল্প ভাব নিয়ে বলল,
“হুমম, শাস্তি। তবে ভয় নেই এবারে তোর বাপকে নিয়ে টানাটানি করব না। ও বেচারার টেম্পারেচার এমনিতেই হট হয়ে আছে। তাকে আর গরম করতে চাই না। এবার শাস্তি পাবি তুই।”

ঘুঙুরের ভয় বোধহয় আরও বাড়ল। তুঁতলিয়ে বলল,
“আ আ আমি?”

কল্প বলল,
“তোর ব্যাগে কী আছে দেখা।”

ঘুঙুর চমকে উঠল। ব্যাগে কী আছে দেখাতে হবে কেন? ব্যাগে তো বই-খাতার বাইরে আরও প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই থাকে। সেসব এই লোকের সামনে কীভাবে দেখাবে সে? আশ্চর্য! সে ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

“ব্যাগ কেন দেখাব। ভেতরে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আছে।”

কল্প ভ্রু বলল,
“স্কুল ব্যাগে এমন কী প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে? এই তুই প্রেম-ট্রেম করছিস না তো? ব্যাগে কী চিঠিপত্র নিয়ে ঘুরছিস? কই দেখা দেখি। এখনই বের কর।”

কল্প ব্যাগটা ওর থেকে টেনে নিতে গেলে ঘুঙুর প্রায় কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। কল্প এটা খুললে ভীষণ লজ্জায় পরতে হবে তাকে। সে কান্নামিশ্রিত ভাবেই বলল,

“না না তেমন কিছু না। খুব পারসোনাল কিছু আছে। আপনার দেখা ঠিক হবে না। উমম, আই মিন……..”

সে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল কল্পের দিকে। কল্প হয়তো কিছু বুঝে নিল। সে সরিয়ে নিল ব্যাগের থেকে হাত। কথা ঘুরিয়ে বলল,

“ওকে। তাহলে তুই বের কর। টিফিন এনেছিস না বাড়ি থেকে? ওটাই বের কর। দেখি কী এনেছিস।”

ঘুঙুর কিছুটা স্বস্তি পেল। কল্প ব্যাগটা না নেওয়ায় সে খুব খুশি। ভেতরে কিছু মেয়েলি জিনিস আছে। যেটা কল্পের সামনে পরা মানে ভীষণ লজ্জাজনক হত। ঘুঙুর খুশি মনেই ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বের করল। ভেতরে কী আছে সে নিজেও জানে না। বক্সটা না খুলেই কল্পের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। কল্প হাত বাড়িয়ে ওটা নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,

“কী আছে এতে?”

ঘুঙুর দু’দিকে মাথা নাড়ল। বলল,
“জানি না।”

কল্প খুলল সেটা। ভেতরে দুটো পরোটা, কিছু আলু ভাজা ও একটা ডিম ভাজা। কল্প বেঞ্চের ওপর পা তুলে ঘুঙুরের থেকে ওয়াটার বটল নিয়ে হাত ধুয়ে আয়েশ করে খেতে শুরু করল। একটা পরোটা, একটু ভাজি, অর্ধেক ডিম শেষ করে বাকিটা ঘুঙুরকে ফিরিয়ে দিল সে। অতঃপর হাত ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

“আজ থেকে এটাই তোর শাস্তি। রোজ সকালে স্কুলের জন্য খানিক আগে বের হবি কজ তোর টিফিনটা আমি খেয়ে নিব। স্কুলে গিয়ে তুই না খেয়ে থাকবি। ওকে? এখন যা ভাগ তোদের লেট যাচ্ছে।”

কল্প উঠে চলে গেল জিহানদের ওখানে। ও চলে যেতেই বৃষ্টি এসে ঘুঙুরের কাঁধে হাত রাখল। ইয়ার্কি মে’রে বলল,

“কিহহ বেশ ভালোই তো চলছে।”

ঘুঙুরের কানে সেসব ঢুকল না। সে শুধু ভাবছে এই লোক তো ঘন্টাখানেক আগেই বাসা থেকে নাস্তা করে এলো। এরমধ্যে পুনর্বার খেল কী করে? রা-ক্ষ-স একটা। তা ও তো পুরোটা খেল না, খেল আধেক। এখন এই বাকি আধেক ঘুঙুর কীভাবে খাবে? খবিশটার এঁটো খাবে? নয়তো যে খাবারটার অপচয় হবে।

স্কুলে পৌঁছে কোনো ক্লাসেই মন বসে না ঘুঙুরের। মনটা ইদানীং বড্ড বেহায়া হয়ে পরেছে। অহেতুক, অযৌক্তিক ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। যা নিয়ে ভাবা বারণ তাই ভাবছে অহর্নিশ। এ কেমন অনুভূতি? এ কেমন টান? বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। উদাসীন হয়ে বসে থাকা মেয়েটা টেরই পেল না কখন টিফিনের ঘন্টা পরে গেছে। কুহু এসে হামলে পরল ঘুঙুরের ওপর।

“কী ভাবছ এত মন দিয়ে? আমার ভাইয়ার কথা নিশ্চয়ই?”

ঘুঙুর চমকে উঠল। মেয়েটার আন্দাজে ঢিল সঠিক জায়গায় পরল কীভাবে? মুখে বলল,

“ফালতু বকিস না তো। তোর ভাই এমন কী মহানায়ক যে তার কথা ভেবে সময় নষ্ট করব?”

কুহু মিটিমিটি হেসে বলল,
“মহানায়ক তো বটেই। তোমার জীবনের মহানায়ক।”

“ওই চুপ। আজেবাজে বকা বন্ধ কর কেউ শুনলে ভুল ভাববে।”

কুহু পাল্টা জবাব দেওয়ার পূর্বেই বৃষ্টি এসে হাজির হল। সে হাত ধুয়ে এসেছে টিফিন করবে বলে। ব্যাগ থেকে বক্স বের করে সেটা খুলতে খুলতে বলল,

“কীসের কথা হচ্ছে আমাকে ছাড়া?”

কুহু মজা করে বলল,
“তুমি নাকি লুকিয়ে প্রেম করছ? সেই টপিকে আলাপ চলছে।”

বৃষ্টি মাছি তাড়ানোর মতো করে বলল,
“লুকিয়ে প্রেম করব? আমি? তা কাদের থেকে লুকাবো? তোদের থেকে? ওহ নো নো নো।”

কুহু বলল,
“আমাদের দাম দিচ্ছ না বুঝি? এই আমরাই তোমার আপন জন মনে রেখো।”

“লাগত না তোদের মতো আপনজন।”

“তাই বুঝি? ওকে। এই ঘুঙুর আপু চল তো আমরা আজ আলাদা টিফিন করবো। ও থাকুক একা। আমি কিন্তু টিফিন আনিনি, তুই ভাগ দিবি।”

ঘুঙুর কিছু বলল না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল শুধু। বৃষ্টি হো হো করে হেসে উঠল। তা দেখে কুহু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,

“হাসছ কেন? পাগল-টাগল হলে নাকি?”

বৃষ্টি হাসি থামিয়ে বলল,
“পাগল আমি না তুই হবি যখন ওর টিফিনটা দেখবি।”

কুহুর মনে সন্দেহ জাগল। সে আস্তে করে ঘুঙুরকে বলল,
“কী বলছে ও? এতই বাজে কিছু এনেছিস নাকি যা মুখে তোলা যাবে না?”

ঘুঙুর এবারেও কিছু বলল না। ব্যাগ থেকে বক্সটা বের করে কুহুর সামনে খুলে দিল। ইশারায় বলল দেখতে। কুহু দেখল এঁটো খাবারটুকু। ওর গাল হা হয়ে গেল। হায় হায় করে বলল,

“কী করেছিস! ক্লাসেই আধেক খেয়ে নিয়েছিস? এখন এই বাকিটা আমার। তোকে একটুও দেব না বলে দিচ্ছি।”

ঘুঙুর কিছু বলার আগেই বৃষ্টি ফের বলল,
“ওটা ওকেই ফেরত দে। ওটা ওর হকের জিনিস। তুই বরং আমারটা থেকে খা।”

কুহু বলল,
“কেন? কেন? ওর হক তো ও আগেই খেয়ে নিয়েছে বাকিটা আমার হক।”

বৃষ্টি কপাল চাপড়ায়,
“ইশ গাঁধি একটা। এদিকে আয় বোঝাচ্ছি তোকে।”

এই বলে কুহুকে ওপাশে টেনে নিয়ে কানে কানে কিছু বলল বৃষ্টি। যেটা শুনে কুহু মিটিমিটি হাসছে। ঘুঙুর ওদের কান্ড শুধু দেখছে। আজ সে কিছুই বলছে না। অকারণে মনটা বিষন্ন লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা শূন্যতা। এমন লাগার কারণ তার অজানা। ওরা দু’জন ফিরে এলো একটু বাদেই। ফিরে এসে কুহু ভাগ বসালো বৃষ্টির খাবারে। ঘুঙুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলল,

“তুই বরং তোরটাই খা। আমি খেতে চেয়েছি বলে ফেলে দিস না আবার। খাবারের অপচয় করা মহাপাপ।”

ঘুঙুর দোটানায় পড়ে গেল। আসলেই কী খাবারটা সে খাবে?

চলবে,

®নামিহা নিশি