#তোতাপাখি_আমার
০৫.
দুপুরে খেয়ে ঘুমের বাহানায় বিছানায় গড়াগড়ি করছিল ঘুঙুর। ঘড়ির কাঁটায় খুব সম্ভব চারটা বাজতে চলেছে এমন। তন্মধ্যে বাড়ির বাইরে থেকে শোরগোল ভেসে আসে তার কর্ণে। আলস্য ঝেড়ে ফেলে ততক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে সে। এটা এ বাড়িতে নতুন নয়। বাবা চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে ছোট থেকেই বাড়ির উঠানে এমন বিচার-আচার দেখে দেখে বড় হয়েছে সে। দেখা যাক আজ আবার কার কী হল।
ওড়নাটা পরিপাটি ভাবে গায়ে তুলে বারান্দায় মায়ের পেছনে এসে দাঁড়াল ঘুঙুর। উঠানে বৈঠক বসেছে। আশ্চর্যের বিষয় সেখানে কল্প উপস্থিত। কল্পকে দেখেই ঘুঙুরের গলা শুকিয়ে এলো। লোকটা আবার কী ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছে? ঘুঙুর আরেকদফা আশ্চর্য হলো যখন দেখলো মোল্লা বাড়ির ছোট ছেলে যে তাকে সকালে সাইকেলে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিয়েছিল সে এখানে উপস্থিত। ছেলেটির সঙ্গে তার বাবা, ভাইও আছে। ছেলেটির অবস্থা নাজেহাল। তাকে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে তার। কিছু একটা ভেবে ঘুঙুর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হৃদপিণ্ড কাঁপছে তার। উঠানে উপস্থিত আরও অনেক মানুষ। কল্পের সঙ্গে তার সাঙ্গপাঙ্গ। মোল্লা সাহেবের সঙ্গেও কিছু চেলাপেলা। তন্মধ্যে মোল্লা সাহেবের কথা ভেসে এলো। তিনি কর্কশ কন্ঠে বললেন,
“চেয়ারম্যান সাহেব, এবার আপনেই এর বিচার করেন। দেহেন আমার পোলাডারে মাইরা কি করছে। সারা শরীর ফুইল্লা টগর হইয়া গেছে।”
আমির সাহেব একপল কল্পের দিকে কটমটে দৃষ্টিতে দেখল। ফের তাকালো মোল্লা সাহেবের দিকে। বললেন,
“হুমমম। বিচার হবে। আগে আপনি শান্ত হয়ে বসুন।”
আমির সাহেব সরাসরি কল্পের দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন না। তার দৃষ্টি অন্য দিকে। সেভাবেই জিহানকে ডেকে বললেন,
“জিহান, এসব কান্ড কেন, কীভাবে ঘটল? উপযুক্ত কারণ দর্শাও। দোষের তীর যখন তোমাদের দিকে।”
জিহান আমতা আমতা করে কল্পের দিকে তাকাল যে আপাততঃ টানটান হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মাথা এলিয়ে দিয়ে আছে। জিহানকে নার্ভাস দেখে কল্প নিজেই আগ বাড়িয়ে মুখ খুলল। তবে তা ব্যঙ্গাত্নক ধ্বনি,
“এত্ত পাওয়ারফুল চেয়ারম্যান এই ছোকরা ছেলেকে ভয় পায় নাকি? নাকি সরাসরি কথা বলতে শরম লাগে?”
আমির সাহেব গর্জে উঠলেন,
“থাপড়ে সব দাঁত ফেলে দেব, বেয়াদব। এভাবে ছেলেটাকে কেন মেরেছ? জবাব দাও। ম’রেও তো যেতে পারত ছেলেটা। তাই না?”
কল্পের দায়সারা উত্তর,
“হুম সে তো আপনার মেয়েও যেতে পারত।”
আমির সাহেবের দৃষ্টিতে প্রশ্ন,
“কোথায়?”
“ম’রে। নয়তো বড় কিছু হতে পারত। কপাল ভালো মাবুদ রক্ষা করেছেন।”
“মানে কি বলতে চাইছ তুমি? এরমধ্যে আমার মেয়ে কী করে আসবে?”
ঘুঙুরের মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে থেকে থেকে। কখন জানি চেতনা হারায়। লোকটা শুরু করেছে টা কি! কল্প কোণা চোখে একপল দেখে নিল নলিনা বেগমের পেছনে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুঙুরকে। অতঃপর আমির সাহেবের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলল,
“ঘুঙুরকে ডাকুন। ও নিজেই বলুক কেন আসছে ওর কথা।”
মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইল ঘুঙুর। এটা তার কাছে ভীষণই নতুন। ছোট থেকে বাড়ির উঠানে বৈঠক দেখে বড় হলেও কখনও সেখানে সরাসরি উপস্থিত হওয়া হয়ে ওঠেনি। তারওপর তাকে ঘিরেই সকল কান্ড। সকালের ঘটনাগুলো বাবা জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুব বকবে। আরও আগে তাকে জানায়নি দেখে রেগে যাবে খুব। সেই থেকে কত সাবধানে ছিল সে যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। ওড়নায় ঢেকে রেখে ঘুরছিল হাতখানা। অবশেষে কি হল? সেই তো ওই অসভ্য লোকটার জন্য তার এখন নাস্তানাবুদ হতে হবে সকলের সামনে। ভেবেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো তার। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাবার ডাক পরল,
“ঘুঙুর এদিকে আয় তো।”
নলিনা বেগম নিজের পেছন থেকে টেনে বের করলেন মেয়েকে। ফিসফিসিয়ে বললেন,
“কি এমন হয়েছে যে আমাকেও বলিসনি? যা এখন ডাকছেন যখন। আর হ্যাঁ, উল্টোপাল্টা কিছু না বলে সঠিক তথ্য দিস নয়তো বাবার থেকে ছাড় পেলেও কল্প তোকে গিলে খাবে। তখন কিন্তু আমিও বাঁচাতে আসবো না।”
মায়ের পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে মজলিশে গিয়ে উপস্থিত হল ঘুঙুর। দাঁড়াল বাবার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে। দৃষ্টি তার মাটিতে। আমির সাহেব মেয়েকে আগাগোড়া পরোখ করে নিলেন একবার। গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,
“ও কি বলছে এসব? তুমি এসবের কি জানো?”
ঘুঙুর বাবার এমন শীতল কন্ঠে শঙ্কিত হল। সে মৃদু আওয়াজে বলল,
“আসলে বাবা…….। এই ছেলেটির জন্য স্কুল যাওয়ার পথে আমি আহত হয়েছি। সে তার বাইসাইকেল খুব উগ্র ভাবে চালায়। যার ফলে এরকম দূর্ঘটনা প্রায়শই ঘটে। আগে লোকমুখে এসব শুনলেও আজ আমি এর ভুক্তভোগী। নিশ্চয়ই ছেলেটির বিচার হওয়া জরুরি ছিল।”
কথাগুলো একদমে বলে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল ঘুঙুর। তার প্রাণপাখি বোধহয় খাঁচা ছাড়া হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে এতটুকু বলতে না পারলে কপালে নির্ঘাত শনি লাগিয়ে দিত কল্প। ঘুঙুর চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে আমির সাহেব বললেন,
“হুমম৷ তুমি এবার ঘরে যাও। তোমার সঙ্গে বাকি কথা পরে হবে।”
ঘুঙুরের শান্ত মন পুনরায় অশান্ত হয়ে উঠলো। বোঝাই যাচ্ছে ফ্রী হয়ে বাবা তার ক্লাস নেবেন। নিরুপায় সে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই প্রস্থান নিল। এই আসা যাওয়ার সন্ধিক্ষণে একটিবারের জন্যও কল্পের দিকে সে চোখ তুলে তাকায়নি। বাবার সামনে তাকে দেখার দুঃসাহস বোধহয় কোনোদিনই হবে না। বারান্দায় উঠে ঘুঙুর পুনরায় আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে পরল। নলিনা বেগম ভেতরে চলে গেছেন। হয়তো কিচেনে। ঘুঙুর আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবার বাকি বিচারটুকু শুনতে মনোযোগী হল।
আমির সাহেবের দৃষ্টিতে আগুন। কন্ঠে গর্জন। সে তেঁতে উঠে মোল্লা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনার এই বেয়াদব ছেলেকে নিয়ে এখনই বিদায় হন। নয়তো একে পুলিশে দিতে সময় লাগবে না আমার। ওর অপরাধ অনুযায়ী কল্প যা সাজা দিয়েছে আমার তা খুবই কম মনে হচ্ছে। নেহাৎ মানবিকতার খাতিরে ছেড়ে দিচ্ছি। এখনই চোখের সামনে থেকে বিদায় নিন।”
মোল্লা সাহেব রাগে গজগজ করতে করতে ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন। এদিকে বাড়ির পরিবেশ ঠান্ডা হতেই কল্প চেয়ারে টানটান হয়ে বসল। হাই তুলে বলল,
“আমার কাজ শেষ। আমি এখন চললাম। ওই তোরা চল সব।”
শেষোক্ত কথাটুকু ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গদের জন্য। সবাই এগোতে নিলে চলতি পথে আমির সাহেব আর কল্প দু’জনে পাশাপাশি হল। আমির সাহেব দাঁড়িয়ে পরলেন তা দেখে দাঁড়াল কল্পও। আমির সাহেব সোজা দৃষ্টি রেখেই অত্যন্ত নিম্ন স্বরে বললেন,
“যত যাই হোক, এভাবে প্রকাশ্যে আইন হাতে তুলে নেওয়া তোমার উচিত হয়নি। এই বুদ্ধি নিয়ে রাজনীতি করতে চাও?”
তার কথায় স্পষ্টত্ব তাচ্ছিল্যের আভাস পেল কল্প। সে ও পাল্টা জবাব দিতে ছাড়ল না। সেভাবেই নিম্ন স্বরে বলল,
“বুদ্ধি আমার কম কি বেশি সেটার হিসাব এখন না হয় তোলা থাক। সময় হলে দেখিয়ে দিব।”
আমির সাহেব মাথা নেড়ে ‘হুমমম’ বললেন। তার ‘হুম’ শব্দে বেশ জোর ছিল। মনে হয় তিনি ভীষণ আগ্রহী দেখতে। এদিকে বাবাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ঘুঙুর এক ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইল। মনে মনে হাজারটা দোয়া-দরুদ পড়ছে সে। আজ নির্ঘাত খবর আছে তার।
চলবে,
®নামিহা নিশি