তোতাপাখি আমার পর্ব-০৮

0
23

#তোতাপাখি_আমার

০৮.
গ্রামের মানুষের কাছে রাত ন’টা মানেই নিশুতি রাত। খুব কম সংখ্যক পরিবার ব্যতিত বেশিরভাগই এতক্ষণে ঘুমিয়ে
কুপোকাত। সেই ক্ষণে দু’জন মানব-মানবী এগিয়ে চলেছে নির্জন রাস্তা ধরে। ঘুঙুর হাঁটছে ধীর গতিতে কল্পের পিছু পিছু। অসুস্থ অথবা সংকোচ তাকে স্থবির করে তুলছে। কল্প নির্বিকার। মায়ের দেওয়া খাবারের ব্যাগটা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছে সে। দৃষ্টি বেশিরভাগ ফোনের মধ্যে ঢুকে আছে। সহসা নিস্তব্ধ পথের নিরবতা ভেঙে কল্প তারস্বরে বলে উঠল,

“শরীর বেশি খারাপ লাগছে? হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”

ঘুঙুর চমকে উঠল। সে হয়তো গভীর ভাবনায় নিমগ্ন ছিল। জবাবে নিচু স্বরে বলল,
“ঠিক আছি।”

ঘুঙুরের মনে সংশয়। শ্বাস আটকে হাঁটছে সে। কল্পের দৃষ্টি সম্পূর্ণ তাকে ঘিরে। এই বুঝি চেপে ধরে অসুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে। কিন্তু না শেষ পর্যন্ত তাকে ভুল প্রমাণ করে কল্প তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করল না বা ধমকা- ধমকিও করল না। নরম কন্ঠে বলল,

“এত শরীর খারাপ নিয়ে আসতে গেলি কেন? বাসায় থাকলেই হতো।”

ঘুঙুর বলল,
“চাচি বুঝতে চাইতো না। না খেয়ে বসে থাকতো।”

কল্প হাঁটার গতি একটু কমিয়ে আনলো। সে এখন ঘুঙুরের পাশাপাশি হাঁটছে। থেকে থেকে সংকুচিত হয়ে চলা ঘুঙুরকে আরেকটু সংকুচিত করে তুলতে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করল। ঘুঙুরের অস্বস্তি এতেই তিনগুণ বেড়ে যায়। এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি দেখছে লোকটা? আগে কখনও তো এভাবে দেখেনি? আজ কল্পের কন্ঠ, চাহনি সবকিছুতেই ভিন্নতা দৃশ্যমান। সেখানে নেই কোনো কঠোরতা, নেই কোনো গর্জন। আছে শুধুই কোমলতা। এই কল্পকে ঘুঙুর চেনে না। আবার নিজেকেও সে চিনছে না। নিজেকেও কেমন অদ্ভুত লাগছে। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে সর্বাঙ্গ। জেনিকে উচিত জবাবগুলো দেওয়ায় কল্পের প্রতি ভাবনারা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে যেন। এভাবেই দেখতে দেখতে, ভাবতে ভাবতে তারা পৌঁছে গেল গন্তব্যে।

সদর দরজা থেকে কল্পের ফিরে যাওয়া নিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফিরলেন নলিনা। পায়েস করেছেন তিনি, এখন সেটা কল্পকে না খায়িয়ে ছাড়বেন না। অগত্যা বাধ্য হয়ে বসতেই হল কল্পকে। নলিনা ঘুঙুরকে বললেন,

“চাচি পেটে জায়গা রেখেছে কিছু? আমার পায়েস ঢুকবে তো?”

ঘুঙুর মাথা নেড়ে ‘খেতে পারবে না’ বোঝাচ্ছিল তন্মধ্যে কল্প বলল,
“একদম কিছুই খায়নি তোমার মেয়ে। অসুস্থতায় পার পেয়ে গেছে আজ। তাইতো মা সবকিছু বক্সে দিয়ে দিয়েছে।
তুমি কিছু খায়িয়ে দিও। খবর্দার খাবার খেয়ে, মেডিসিন নিয়ে শোয় যেন নয়তো তুলে একটা আছাড় মে’রে যাবো।”

নলিনা সায় দিলেন,
“হ্যাঁ তাই ভালো। না খেলে তোকে কল করবো তুমি এসে একটা দিয়ে যাস।”

কল্প আর কিছু বলল না। খাওয়া শেষে উঠে রওনা হল। আড়াল থেকে মুখ ভেঙচি কাটল ঘুঙুর, ‘উমম বললেই হল তুলে আছাড় মে’রে যাবো? হুহ!”

জেনি বাদে বাদবাকি সব মেহমান চলে গেছে। জেনি দিনকয়েক বেড়াবে। বেলা বাজে তিনটা, কল্প এখনও ঘুমিয়ে। নির্বাচনের কাজ সেরে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি। সকাল আটটায় এসে ঘুমিয়েছে এখনও ওঠেনি। জেনি অপেক্ষা করতে করতে একটা সময় বিরক্ত হয়ে ওর ঘরের দিকে পা বাড়াল। চলতি পথে কুহু তাকে কয়েকবার বলল,’ভাইয়ার ঘরে যেও না। ঘুমের মধ্যে ডাকলে ভীষণ চটে যাবে।’ কে শোনে কার কথা। সে গেলোই ডাকতে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্য একটু ভ’য় কাজ করছিল শেষমেশ ভয়কে জয় করে ঢুকেই পরল ঘরে। কল্প উবুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। উন্মুক্ত কোমরের ওপর পর্যন্ত কম্বল টানা। দুই হাত বালিশের তলে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে শুয়ে আছে। জেনির বুকের মধ্যে তোলপাড় চলছে। অনুভূতিরা লাগামহীন। সে কোন ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেল নিজেও বুঝল না। সম্মোহনীর ন্যায় এগিয়ে গেল কল্পের শিয়রে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে স্পর্শ করল কল্পের চুল, চোখ, গাল। স্পর্শ আরেকটু গাঢ় হয়ে ঠোঁট বরাবর যেতেই চোখ খুলে ফেলল কল্প। প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতিতে উঠে বসল। চমকে উঠল জেনি। আমতা আমতা করে দূরে সরে দাঁড়াল। নিজের কাজে নিজেই আশ্চর্য সে। ক্ষেপে উঠল কল্প। চিৎকার করে ডাকল খাদিজা বেগমকে,

“মা, মা, মা। এখনি এদিকে এসো।”

জেনির গলা শুকিয়ে কাঠ। শঙ্কিত দৃষ্টিতে দরজায় তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“খালামনিকে ডাকছ কেন? ডেকো না প্লিজ। আমি তো শুধু এমনিই…..।”

কথা শেষ করার আগেই সপাটে চড় পরল তার গালে। উত্তেজনায় খেয়ালই করেনি জেনি কখন কল্প তার দিকে তেড়ে এসেছে। চড় খেয়ে বেকুব বনে তাকিয়ে রইল সে। ততক্ষণে ছুটে এসেছেন খাদিজাও। ছেলের রণমুর্তি দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন,

“কি হয়েছে, বাবা? এতো রেগে আছিস কেন?”

কল্প দ্বিগুণ তেজি কন্ঠে বলল,
“সেটা ওকে জিজ্ঞেস করো।”

জেনি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো। খাদিজা ওর বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,

“কি রে কি করেছিস? কথা বল।”

জেনি আমতা আমতা করে দু একবার খাদিজার দিকে তাকাল। অতঃপর কিছু বলতে না পেরে সুযোগ বুঝে দৌড়ে বেরিয়ে গেল এ ঘর থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় খাদিজা হতভম্ব। তিনি ভাবেননি জেনি এভাবে চলে যাবে। ছেলের দিকে তাকাতেই আরেকদফা চমকে উঠলেন। ক্রোধে কপালের রগ স্পষ্ট ভুলে উঠেছে কল্পের। তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু ঘটিয়েছে জেনি। তিনি আলগোছে নরম সুরে বললেন,

“শান্ত হ বাবা। কি হয়েছে বল আমায়। না বললে বিচার করবো কি করে বলতো?”

কল্প ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস টেনে মাথা ঠান্ডা করার ট্রাই করে বলল,
“নেক্সট টাইম আমার ঘরে তুমি, বাবা ও কুহু ব্যতীত কোনো ব্যক্তি যেন না ঢোকে। আর ঢুকলে কিন্তু সেটাকে এখানেই গেড়ে রেখে দিব। মনে রাখবে এবং সতর্ক থাকবে। পরে যেন আমাকে দোষারোপ করবে না।”

খাদিজা বুঝলেন জেনির জন্য এই নিষেধাজ্ঞা। তবে তিনি ছেলের মাথা ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে একটু ছোট্ট রসিকতা করে বসলেন। কৌতুকের স্বরে বললেন,

“তা এই নিষেধাজ্ঞা কি ঘুঙুরের জন্যও প্রযোজ্য? না মানে তবে ওকেও জানি দিতে হবে তো।”

কল্প রাগ কমার বদলে চেঁচিয়ে উঠল আরও,
“ওর প্রসঙ্গ আসছে কোত্থেকে?”

খাদিজা বুঝলেন ছেলের রাগ এত সহজে কমার নয়। তাই সে আলগোছে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,

“আচ্ছা তাই হবে। কেউ আসবে না আর। আমি সবাইকে বলে দেবো।”

খাদিজা চলে যেতেই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল কল্প। ফোনটা হাতে নিয়ে গ্যালারি ওপেন করে সেইভ ফোল্ডারে ঢুকল। ‘তোতাপাখি আমার’ পেজটি ওপেন করতেই সম্মুখে উন্মোচিত হল ঘুঙুরের শত শত ছবি। সেই দুই ঝুঁটির ঘুঙুর থেকে দুই বিনুনির ঘুঙুর অব্ধি। কল্প সন্তর্পণে একটা ছবির ওপর বুড়ো আঙুল ছোঁয়াল। ততক্ষণাৎ মায়ের প্রশ্নটি মনে পরল তার। আলতো করে আঙুল ঘষতে ঘষতে মনে মনে ভাবল,

“যার বিচরণ গোটা হৃদয় জুড়ে, তাকে ঘরে ঢোকার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আমি কে?”

চলবে,

®নামিহা নিশি