তোতাপাখি আমার পর্ব-১১

0
21

#তোতাপাখি_আমার

১১.
খাদিজা বেগম বিছানায় বসে কাপড় ভাঁজ করছেন। এমন সময় কল্প এলো দরজায়।

“মা, আসবো?”

খাদিজা ছেলেকে দেখে উৎফুল্ল হলেন। বললেন,
“আয় আয়। মায়ের কাছে আসতে আবার কিসের অনুমতি?”

কল্প মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকল। সে বরাবরই এমন দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও সর্বপরি অনুমতি চেয়ে যে কারো ঘরে ঢোকে। ছেলের মুখ দেখে খাদিজা কিছু একটা আন্দাজ করে ফেললেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,

“কি হয়েছে, আব্বা? সিরিয়াস কিছু?”

কল্প বিজ্ঞদের ন্যায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
“হুম৷ ভীষণ সিরিয়াস। আমি চাইছি সরাসরি তোমার সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে।”

খাদিজা ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিলেন। বললেন,
“আমিও তো সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। আমার আব্বা তার ডিস্টার্বনেস আমার সঙ্গে কবে শেয়ার করে। তা শুরু করেন শুনি।”

কল্প সটান হয়ে বসল। তার চেহারার ভাব কঠিন।
“প্রসঙ্গটা জেনিকে নিয়ে।”

খাদিজা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন,
“জেনি…?”

কল্প মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল। পরপর ভনিতা ছাড়াই বলতে শুরু করল,
“মা, জেনি তোমার বোনের মেয়ে। তোমার খুব আদরের হবে এটাই স্বাভাবিক। আমিও তার কাজিন হিসেবে তাকে স্নেহ করি, সুনজরে দেখি। কিন্তু তার কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত কার্যকলাপ আমাকে ভীষণই অস্বস্তিতে ফেলছে অথবা ক্রোধিত করছে। আশা করি তোমাকে সেই কাজের বর্ণনা দিতে হবে না। তুমি আমার মা, আমাকে খুব ভালো ভাবেই চেনো-জানো। তোমার ছেলের রুচি, পছন্দের সঙ্গে নিশ্চয়ই তুমি অনেক আগে থেকেই অবগত। সেখানে জেনির এসব পাগলামি নিছকই বাড়াবাড়ি মাত্র। দিনকে দিন নিজের রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরছি আমি। পরে কিছু ঘটে গেলে সেই দায় আমাকেই নিতে হবে। তারচেয়ে ভালো হয় জেনির এবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া। এবং সেটা তুমি করলেই মঙ্গলজনক। আমি করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে।”

এক দমে কথাগুলো বলে লম্বা দম নিয়ে থামল কল্প। খাদিজা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন ছেলের কথা। কল্পের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা বিরক্ত, রাগান্বিত। খাদিজা অবশেষে মুখ খুললেন,

“আমি দেখছি বিষয়টা। এটা নিয়ে ভাবিস না তুই। যা করার আমি করছি।”

কল্প মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাবার আগে আরেকবার সতর্কতাসরূপ মা’কে বুঝিয়ে দিল,

“আজই যেন এ বাড়িতে ওর শেষ দিন হয়। কখনও যদি বোন হিসেবে আমার দরজায় আসে তবে সমাদর পাবে নয়তো আমার বিয়ের আগপর্যন্ত এ বাড়িতে তার পা রাখার দরকার নেই।”

কথা শেষে গটগট পায়ে প্রস্থান করল কল্প। মায়ের ঘর থেকে বেরতেই মুখোমুখি হল জেনির। মাথা নত করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে। কল্পকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে প্রজাপ্রতির ন্যায় উড়ে উড়ে এসেছিল এই অব্ধি। কিন্তু বাকিটা পথ তারজন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে রইল। ওকে দেখে কল্পের মনে কোনো রকম সংকোচ, সংশয় দেখা দিল না। বরং ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল সে। আত্নমর্যাদাহীণ নারী তার চোখে চরম লাঞ্চ্যনার প্রাণী। অশ্রুসজল চোখে কল্পের চলে যাওয়া দেখল জেনি। চব্বিশ বছরের জীবনে এতটা আঘাত তার পাওয়া ছিল কখনও ভাবেনি। ভেবেছিল কল্প ভাই তাকে পছন্দ করে। ধীরে ধীরে ভালবাসাটুকুও আদায় করে নেবে সে। কিন্তু আজ বুঝল সবই মরিচীকা। কল্প কখনোই তাকে চায় না। বুকে পাথর চেপে নিজের জামাকাপড় গোছাতে লেগে পরল সে। বেহায়ার মতো এই বাড়িতে আর একবিন্দু থাকা চলে না। সবচেয়ে বড় কথা খালামনির সামনে এভাবে ছোট হয়ে যাওয়াটা একেবারেই মেনে নিতে পারছে না সে। খালামনি তাকে নিশ্চয়ই খুব খারাপ মেয়ে ভাবছে। কিন্তু সে তো খারাপ মেয়ে নয়। ভালবাসায় পাগলাটে এক রমনী।

অনেকদিন হল ঘুঙুর চৌধুরী বাড়িতে যায় না। খাদিজা বেগম সকাল-বিকাল ফোন করে হাসফাস করছেন। জেনির প্রতি অস্বস্তি থেকেই এই না যাওয়া। কিন্তু আজ আর কোনো উপায় রইল না। সকালে কুহু এসেছিল। কড়া করে বলে গেছে ঘুঙুর যেন আজ ও বাড়িতে যায়। এটা খাদিজা বেগমের নির্দেশ। অগত্যা বিকেল হতেই ঘুঙুর চলল সেখানে। কালো রঙের একটা থ্রি-পিস পড়ে। নিজেকে খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়ে, বরাবরের মতো মাথায় ওড়না টেনে বের হচ্ছিল সে। বসারঘর পর্যন্ত আসতেই সহসা নুপুর ডেকে বসল।

“ঘুঙুর এদিকে আয় তো।”

ঘুঙুরের বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠল। সে রাতের ঘটনার পর থেকে কল্প বা চৌধুরী পরিবার নিয়ে নুপুরের সামনে কথা বলতে সংকোচ হয় তার। না জানি এখন আবার তাকে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কাঠের পুতুলের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে বোনের সামনে। নত কন্ঠে বলল,

“কিছু বলবে আপু?”

নুপুর আপাদমস্তক ওকে দেখে নিয়ে বলল,
“কোথাও বেরচ্ছিস?”

ঘুঙুর থতমত খেয়ে বলল,
“ওই কুহুদের বাড়ি। চাচি অনেক দিন ধরে ডাকছেন।”

নুপুরের মুখভঙ্গি কঠিন হয়ে এলো। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো বোনের সামনে। ঘুঙুর কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেনে এক চড় বসানোর উদ্দেশ্যে হাত জাগালো। আচমকা আক্রমণে ঘুঙুর দু’পা পিছিয়ে গেল। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রইল। কিন্তু অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন কোনো আঘাতের চিহ্ন তার গালে পরেনি তখনই সে ভ’য়ে ভ’য়ে চোখ খুলল। নুপুর হাত উঁচিয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে। ঘুঙুর শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“আ আমি ই ইচ্ছে করে যেতে চাই নি, আপু। চাচি খুব করে বলছেন।”

বোনের ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে বেশিক্ষণ নিজের অভিনয় ধরে রাখতে পারল না নুপুর। ঘুঙুরকে অবাক করে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। ঘুঙুরকে আঘাতের উদ্দেশ্যে ওঠা হাতটা এখন নিজের মুখে চেপে ধরে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। ঘুঙুর আহাম্মক বনে দাঁড়িয়ে। বোনটা কি তার অকালে পাগল হয়ে গেল! সে বিস্ময়াবহ কন্ঠে শুধাল,

“এভাবে হাসছ কেন? হাসির কি বললাম আমি?”

নুপুর সোজা হয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। ঘুঙুরকে হাতে ইশারায় কাছে ডাকল। ঘুঙুর একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসতেই সে ছ্যাঁত করে উঠল,”কাছে আয়। এত দূরে কেন?”

ঘুঙুর ভ’য়ে ভ’য়ে আরেকটু এগোয়। নুপুর ওর সারা মুখে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলল,

“যেখানে খুশি যা এত ভ’য়ের কি আছে? আমি জানি কল্প ভাই থাকতে আমার বোন কোনো ভুল করতেই পারবে না।”

ঘুঙুর আরেকদফা অবাক হয়ে শুধাল,
“তারমানে তুমি সবটাই জানতে?”

নুপুর চোখ টিপ দিয়ে বলল,”হুমম জানতাম। আরও তিন বছর আগে থেকেই।”

ঘুঙুর চোখ বড় বড় করে বলল,
“তাহলে সেদিন রাতে…… ”

নুপুর ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ইচ্ছে করে করেছিলাম। বাবা-মার ঘর থেকে শব্দ আসছিল। বাবা কিছু জেনে যাওয়ার ভ’য়ে তোকে খুঁজতে বাইরে চলে আসি। আর এসেই অমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরতে হয় সকলকে। জানি কল্প ভাই কতটা সুপুরুষ। কোনো ভুল তার দ্বারা হবে না। কিন্তু তুই এখনও অনেক ছোট। এসব অনুভূতির কথাও তোর তখন অজানা ছিল। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে অতটুকু নাটক করতে হয় আমাকে। কল্প ভাই অবশ্য বাড়িতে গিয়েই ফোন করেছিলেন আমাকে কেন এমন করলাম বিস্তারিত জানতে। কিন্তু তুই গর্দভ কিছুই বুঝলি না।”

নুপুর আবারও হেলেদুলে হাসছে। ঘুঙুরের খুব ভালো লাগে ওই হাসি দেখতে। কে বলে তার আপু একগুঁয়ে, ঘরকুনো মেয়ে? তার আপু তো একটা জীবন্ত গোলাপ। যার স্নিগ্ধ সুবাদে মো মো করে আহমেদ বাড়ি।

চৌধুরী বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। মুখোমুখি হয়ে গেল ঘুঙুর- জেনি। একজন প্রবেশ করছে আরেকজন প্রস্থান। ঘুঙুর ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য থমকে রইল জেনি। ব্যাগপত্র হাতে এক ঝলক পেছনে ঘুরে দেখল কি অবলীলায় তার স্বপ্নের রাজ্যে অন্য কারো বিচরণ চলছে। আর তাকেই ফিরে যেতে হচ্ছে অদূরে। এটাই হয়তো নিয়তি। ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন।

চলবে,

®নামিহা নিশি