#তোতাপাখি_আমার
১২.
খাদিজা বেগমের আহ্লাদের শেষ নেই। কতদিন পর ঘুঙুরকে কাছে পেয়েছেন তিনি। ছুটোছুটি করে এটা আনছেন,ওটা আনছেন। ঘুঙুর শত বাঁধাতেও আজকে তাকে রুখতে পারছে না। খায়িয়ে খায়িয়ে চাচি বোধহয় আজ তার পেটটাকে জয়ঢাক বানিয়ে ফেলবে। ঠিক সেই সুযোগে মায়ের ফোন কব্জা করে নিয়ে কুহু চলল ভাইকে ফোন করতে। দু’বার রিং হওয়া মাত্র রিসিভ হয়ে গেল কলখানা।
“হ্যাঁ বল।”
“ভাইয়া তুমি কোথায় আছ?”
“আছি ক্লাবে। কেন বল?”
“তোমার জন্য গুড নিউজ আছে।”
“ঢং বাদ দিয়ে আসল কথা বল। সময় কম আমার হাতে।”
“ওকে তুমি ব্যস্ত থাকলে শুনতে হবে না। তারপর ঘুঙুর আপু চলে গেলে তখন আবার আমার কান মলে দিয়ে বলো না যেন, ‘আমাকে আগে কেন জানাসনি!’
কল্প সমস্ত ব্যস্ততা মুহুর্তেই গায়েব। শিথিল কন্ঠে সে বলল,
“ঘুঙুর এসেছে? কখন?”
কুহু হেসে বলল,
“এসেছে আরও আগে। এখন বসে বসে মায়ের সব জমানো আদরের অত্যাচার সহ্য করছে।”
কল্প কথা বাড়ালো না। ছোট করে ‘আচ্ছা রাখ’ বলে ফোন কেটে দিল। কুহু রাগে গজগজ করছে ভাইয়ের এমন অকৃতজ্ঞাবোধে। সে এত সুন্দর একটা নিউজ পাচার করল অথচ বিন্দুমাত্র বাহবা পেল না! ইট’স ভেরি ব্যাড।
–
সোফায় গা ছেড়ে শুয়ে পরেছে ঘুঙুর। পেট নিয়ে নড়তেও কষ্ট হচ্ছে। কুহু পায়ের কাছে বসে রাজ্যের গল্প জুড়েছে। খাদিজা বেগম সবে নামাজে গেছেন। এমন সময় সদর দরজায় কড়া নড়ে উঠল। কুহু, ঘুঙুর দুজনেই সতর্ক হয়ে বসল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই দৃশ্যমান হল ঘুঙুরের কল্পনার কল্প পুরুষ ‘নওয়াব কল্প চৌধুরী।’ এলোমেলো চুল, কালো শার্ট, শার্টের আবার ওপরের তিনটা বাটন খোলা, হাতা ফোল্ড করা কনুই অব্ধি, সানগ্লাস অনাদরে ঝুলছে শার্টের বাটনের মাঝে। আহ্ কি এটিটিউড! ঘুঙুর শক্ত হয়ে বসে রইল। একপল দেখেই তার দম শেষ। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে নির্ঘাত ম’র’ণ হত। মাথা নত করে বসে থাকা ঘুঙুরকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল কল্প। পাশ কেটে যেতে যেতে সাবলীল কন্ঠে বলল,
“রুমে আয়।”
ঘুঙুর তড়িৎ চোখ তুললো। পারফিউমের ম্যানলি সুবাসে দেহ আন্দোলিত তার। কিন্তু ‘রুমে আয়’ কাকে বলল লোকটা? তাকে নাকি কুহুকে? কুহুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখলো কুহু মিটিমিটি হাসছে। সে তাকাতেই চোখ টিপ দিয়ে বলল,
“যাও তোমাকেই ডাকছে।”
ঘুঙুর কুহুর মাথায় একটা চাটি মে’রে গাল ফুলিয়ে হেঁটে চলে গেল তার মহারাজের ঘরে।
–
“আমি কি আপনার ঘরের বউ যে এভাবে ডাকেন?”
কল্প কেবলই চশমা, ঘড়িটা রেখে শার্টের বাটন খুলতে শুরু করেছে। তন্মধ্যে রেগেমেগে হাজির ঘুঙুর। ওকে আরেকটু রাগিয়ে তুলতে তার উত্তর,
“আজ বাদে কাল আমারই তো বউ হবি। এখন থেকে ডাকলে ক্ষতি কি?”
“বাহ রে আমার বুঝি লজ্জা শরম নেই? আপনার কান্ডে কুহুটা পর্যন্ত হেসে গড়াগড়ি খায়। চাচা-চাচি দেখলে তো ম’র’ণ ছাড়া গতি থাকবে না আমার।”
ঘুঙুর একনাগাড়ে বলেই চলেছে। সে খেয়ালই করলো না কল্প তার ঠিক কতটা কাছে। যখন দেখল ততক্ষণে সে কল্পের ঘর্মাক্ত বক্ষমাঝে লেপ্টে। পারফিউমের সুঘ্রাণ ঘর্মাক্ত শরীরে আরও তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছে। ঘুঙুর দিশেহারা হয়ে পরছে। হৃৎস্পন্দনের তীব্র কম্পন অনুভব করতে পারছে। তার তোতাপাখির ন্যায় বুলি থেমে গেল সেখানেই। তারপর তার কোমল গালে আঙুল বুলিয়ে চিবুক ওপরে তুলে খুব গভীর ভাবে প্রিয়তমাকে দেখে নিল কল্প। ওই বদ্ধ চোখের পাতা, রক্তিম গাল দুটো, ঘেমে ওঠা নাকের ডগা, সবশেষ তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠজোড়া। আহহ কি মায়া, কি আকর্ষণ। মন ভরে দেখে নিল কল্প। চরম আবেশিত কন্ঠে বলল,
“খোদা তাআ’লা ভীষণ মহান জানিস তো। তিনি কাউকে হতাশ করেন না। আমার একবুক ভালবাসা অপূর্ণ রেখে তিনি তোর ম’র’ণ দেবেন না। তোর ম’র’ণ হলে হবে আমার ভালবাসায়, শূন্যতায় নয়। এখনও বউবেশে তোকে দেখলাম না, বাসর হল না, বাচ্চাকাচ্চা হল না, নাতি-নাতনি হল না, এদিকে তুই চলে গেলি ম’রার চিন্তায়। ধুর এমন ব্যাকডেটেড হলে হবে তোতাপাখি?একটু আপডেট হ। চল তোকে ভালবাসা শেখাই।”
কল্পের মুখের সাথে সাথে আঙুলগুলোও থেমে নেই। পিলপিল করে বিচরণ করছে ঘুঙুরের উষ্ণ দেহে। গলায়, কানের লতি কোনোকিছু বাদ নেই। ঘুঙুর হাসফাস করছে শুধু। কিছু বলা বা বাঁধা দেওয়ার শক্তি পাচ্ছে না। শরীরে এক অজানা ঢেউ কিন্তু মনে মনে তীব্র শঙ্কা দুইয়ে মিলে স্তব্ধ সে। কল্প তাকে স্রোতের টানে যেদিকে নিচ্ছে নিশ্চুপে সে সেদিকে ছুটতে। অতঃপর একটা কাঙ্খিত মুহুর্ত এলো। যখন দুই জোড়া অধর একইসাথে মিলিত হল। একটু রুষ্ট ভাবেই ছুয়ে দিচ্ছিল কল্প তার তোতাপাখিকে। তার ছোট্ট তোতাপাখি সেটুকু রুষ্টতা মুখ বুজে সহ্য করে নিল। তোতাপাখিটা বড় হয়ে গিয়েছে কিনা! ইদানীং কল্পকেও ম্যানেজ করতে শিখে নিচ্ছে। পরম আবেশে সারাদিনের ক্লান্তি ওই পেলব ঠোঁট জোড়ায় দুমড়ে-মুষড়ে ঢেলে দিয়ে মিনিট পাঁচেক পর ক্ষান্ত হল কল্প। ঘুঙুরের দূর্বল শরীরটা এক ধাক্কায় বিছানায় ছুড়ে ফেলে টাওয়াল গলায় পেঁচিয়ে ওষ্ঠ মুছতে মুছতে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। সিক্ত অধরে লেগে ছিল তার চাপা হাসি। এদিকে অভিমানিনী রেগেমেগে লাল হয়ে বিছানার মাঝে গোল হয়ে বসে রইল।
–
“ঘুঙুর কোথায়?”
“ভাইয়ার ঘরে।”
“কল্প ফিরেছে। আমাকে আগে বলবি না। দেখি কি লাগে ওর।”
খাদিজা বেগম এগোচ্ছিলেন ছেলের ঘরের দিকে। কুহু ততক্ষণাৎ টেনে ধরল তাকে। আস্তে করে বলল,
“মা মা কি করছ তুমি? এখনই ও ঘরে যেও না। এখন গেলে হয় তুমি লজ্জায় পরবে নয়তো ঘুঙুর আপু। যদিও তোমার নির্লজ্জ ছেলের তাতে কিছুই হবে না।”
খাদিজা বেগম মেয়ের কথা বোঝার চেষ্টা করে বললেন,
“মানে কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
কুহু মাকে পাশে বসিয়ে সুন্দর করে বোঝানোর মতো করে বলল,
“ভাবো একবার, ওরা দুজন চুপিসারে কাপল। তো তোমার নির্লজ্জ ছেলে তার হবু বধূকে আমার সামনে থেকেই ধরে নিয়ে গেছে নিজের ঘরে। এখন সেখানে তুমি গিয়ে উপস্থিত হলে বিষয়টা তোমার ছেলের হজম হয়ে যাবে কিন্তু ওই মেয়েটার তো……. ”
কুহু হাসছে মুচকি মুচকি। এতক্ষণে বিষয়টা ক্লিয়ার হলেন খাদিজা বেগম। অতঃপর ছেলের পিছু ছেড়ে তিনি টেনে ধরলেন মেয়ের কান,
“ফাজিল মেয়ে। ভাইয়ের চেয়ে নির্লজ্জ তুমি কম কিসে? ভাইয়ের প্রেমের ফিরিস্তি শোনাচ্ছ মাকে! পাকনা বুড়ী তোকেই আগে বিদায় করবো বিয়ে দিয়ে। দাড়া ছেলে খুঁজছি।”
“আহহ মা লাগছে তো। ছেড়ে দাও না….. আ আ আ।”
মা-মেয়ের খুনসুটির মধ্যে উপস্থিত কল্প-ঘুঙুর। কল্প আগে আগে, ঘুঙুর পেছনে। কল্প স্বাভাবিক ভাবে ডাইনিংয়ে যেতে যেতে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ওর জন্য ছেলে রেডিই আছে। তোমার কষ্ট করে খুঁজতে হবে না। এখন এসে আমাকে ভাত বেড়ে দাও।”
খাদিজা বেগম কুহুকে ছেড়ে ঘুঙুরের দিকে তাকালেন। মেয়েটা সংকোচে নত হয়ে আছে। তিনি উঠে ওকে টেনে কুহুর পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোর এই পাকনা বোন কার কপালে যে আছে কে জানে। এটাকে একটু মানুষ বানা। যেন তোর মতো লক্ষ্মী হয়ে যায়।”
কুহুকে ঘুঙুরের হাতে দিয়ে খাদিজা চললেন ছেলের খাবার দিতে। এদিকে সুযোগ পেয়ে কুহুর পাকনামি আরও বাড়ল। ঘুঙুরকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লজ্জায় উত্তপ্ত করে ফেলল। ডাইনিংয়ে বসে এসবের সবটাই লক্ষ্য করছিল কল্প। সবথেকে উপভোগ্য ছিল তার তোতাপাখির লাজে রাঙা হাসি।
চলবে,
® নামিহা নিশি