তোতাপাখি আমার পর্ব-১৪

0
23

#তোতাপাখি_আমার

১৪.
দেখতে দেখতে একটা মাস পেরিয়ে গেল। ঘুঙুরের আর মাত্র প্রাকটিকাল এক্সাম বাকি। আগে থেকেই সবকিছু তৈরি করা আছে এখন শুধু পরিক্ষার দিন জমা দিয়ে আসলেই হবে। সুতরাং বলা চলে পরীক্ষার চাপ থেকে এখন সে মুক্ত। এই একমাসে কল্পের সঙ্গে সে টোটালি যোগাযোগ রাখেনি। নুপুরের নম্বরে অনেকবার কল করেছিল কল্প কিন্তু ঘুঙুর প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। বলেছে এক্সামের দিনগুলো সে পুরোপুরি কনসেন্ট্রেশন পড়াশোনায় দিতে চায়। কল্পের সঙ্গে কথা বললেই তার মোটিভ উল্টে যায়, পড়ায় মন বসে না। এজন্যই এই সিদ্ধান্তঃ। কল্প বুঝদার পুরুষ। কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছে। কয়েকটা দিনই তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে এই ভেবে। হলোও তাই। ইলেকশনের কাজকর্মে ব্যস্ত সময় কেটে গেল কল্পের। এতদিন যেমন তেমন গেলেও আজকে সে ভীষণই নার্ভাস। ঘুঙুরের আলিঙ্গন কোথাও একটা তীব্র ভাবে হাহাকার করে ডাকছে তাকে। কারণ আজকেই ইলেকশন। একে তো প্রেয়সীর থেকে দূরত্ব, তারওপর এই ইলেকশনের দুশ্চিন্তা। সবমিলে এতটা অসহায় নওয়াব কল্প চৌধুরী আগে কখনোই হয়নি। ইলেকশন শুরু হয়ে গেছে সকাল দশটা থেকে। এখন বাজে বেলা বারোটা। কল্পের শরীর চলে না আর। এলোমেলো পায়ে হেঁটে সে চলে এলো বাড়ির পথে। খাদিজা বেগম কড়াইয়ে মাংশ কষাচ্ছেন। কল্প সরাসরি চলে গেল কিচেনে। মায়ের পাশে টুল টেনে বসে পরল। খাদিজা ছেলের শুকনো মুখ দেখে বললেন,

“কি রে দুশ্চিন্তা করছিস? করিস না। ওপর ওয়ালা যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন।”

কল্প একদৃষ্টে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা চুলার অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদয়ের মধ্যেও এমনই চাপা অগ্নি জ্বলছে। সেভাবেই শিথিল কন্ঠে জবাবে বলল,

“এই বিজয়টা আমার জন্য খুবই ইম্পর্টেন্ট। যদি হেরে যাই বাকিটা পথ অনেক কঠিন হয়ে যাবে।”

খাদিজা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভরসার সহিত বললেন,
“সব ভালো হবে। চিন্তা করিস না। যা গোসল দিয়ে আয়। রান্না প্রায় শেষ। কিছু মুখে তুলবি আয়। সকালেও কিছু খাসনি।”

কল্প উঠল তবে গোসল সারতে নয়। পুনরায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। মা’কে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি কে খায়। আমি একটু বাইরে যাই। সময় মতো এসে খেয়ে নেব।”

কল্পকে আর পাওয়া গেল না। খাদিজা বুঝলেন ছেলের মনে চলতে থাকা অস্থিরতা। আল্লাহর দরবারে দু-হাত তুলে তিনি ছেলের বিজয় কামনায় দোয়া করলেন। আমির সাহেব বিজয়ী হবেন এটা তিনি চান কিন্তু এই বিজয়ের মধ্যেই তার ছেলের সুখ নিহিত। সেই দর্পে তিনি চান এবারের নির্বাচনে কল্প জিতুক। জুবায়ের চৌধুরীর অবশ্য এসবে মাথা ব্যথা নেই। তিনি বিন্দাস আছেন। ওদিকে বন্ধু, এদিকে ছেলে দুজনই তার একান্ত আপন। তাই কে জিতলো, হারলো না দেখলেও চলবে।

তীব্র ফুরফুরে মন নিয়ে প্রজাপ্রতির ন্যায় উড়তে উড়তে ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হল ঘুঙুর। সোফায় আয়েশ করে বসে টিভিটা অন করে গলা ছেড়ে ডাকল মা’কে।

“মা। কি রান্না করছ আজ? খুব জমিয়ে রাখবে আজ। আমার এক্সামের প্যারা শেষ। আজ মন ভরে খাবো।”

নলিনা কিচেন থেকেই মেয়ের কথা শুনে হেসে জবাবে বললেন,
“আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তোর পছন্দের খাবারই তৈরি করছি।”

ঘুঙুরের এত প্রফুল্লতার পেছনে অবশ্য আরেক কারণ আছে। সে ভেবে রেখেছে বিকেলে চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে কল্পকে সারপ্রাইজ দেবে। কতদিন হয়ে গেল মানুষটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। নাহ্ আর পারা যাচ্ছে। আজ সময়টা এত আস্তে যাচ্ছে কেন? বিকেল হতে আর কত দেরি? টিভির চ্যানেল এদিকে ওদিক ঘুরিয়েও কিছুতে মন বসছে না ঘুঙুরের। বেশিরভাগ সময় সে বাবার সঙ্গে টিভি দেখতে বসে। বাবা যেটা দেখে সে ও সেটাই দেখে। নিজে দেখতে বসলে কনফিউজড হয়ে যায়। আজ বাবাকে না দেখে পুনরায় মা’কে জিজ্ঞেস করল,

“মা….. বাবা কোথায়?দেখছি না যে?”

“তোর বাবা তো ভোট কেন্দ্রে। আজ ইলেকশন যে।”

ঘুঙুর হঠাৎ থ বনে গেল। আজ ইলেকশন? অথচ সে জানতোই না। বিকেল পর্যন্ত তো অনেক সময়। তার এখনই কল্পের সঙ্গে কথা বলা দরকার। হার- জিত যেটাই হোক তাকে সাপোর্ট করা দরকার। ঘুঙুর টিভি বন্ধ করে ছুটল নুপুরের ঘরে। নুপুর গভীর মনোযোগে বই পড়ছে। ঘুঙুরকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে বলল,

“কিছু বলবি? এভাবে কেন ছুটছিস?”

ঘুঙুরের অস্বস্তি হচ্ছিল এভাবে সরাসরি আপুর থেকে ফোন চাইতে। তবুও কিছু করার নেই। নির্লজ্জের মতো বলেই ফেলল,

“আপু তোমার ফোনটা একটু দেবে। কথা বলতাম একটু।”

বোনের নত মস্তক আর জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠ শুনেই নুপুর বুঝে ফেলেছে ঘুঙুর কোথায় কথা বলবে। সে কিছু জিজ্ঞেস না করে সরাসরি কল্পের নম্বরে ডায়াল করে ফোনটা ঘুঙুরের হাতে ধরিয়ে দিল। ঘুঙুর হতবাক, আপুকে না বলতেই কিভাবে বুঝে গেল! ফোনটা হাতে কানে চেপে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল সে। প্রথমবারে কল রিসিভ না হওয়ায় হতাশ হল ঘুঙুর। ফের ডায়াল করে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে রইল স্ক্রিনে। কখন যে রিসিভ হবে! বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হল না। রিসিভ হয়ে গেল কলটা। ওপাশ থেকে ভেসে এলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ভারাক্রান্ত কন্ঠ,

“শুনছি বল।”

ঘুঙুরের গলা শুকিয়ে আসে। কতদিন পর শুনলো মানুষটা কন্ঠ। যেন শুকনো মরুভূমির বুকে এক ফোঁটা বারিধারার ন্যায়। ঘুঙুর সন্তর্পনে ঢোক গিলল। নত কন্ঠে বলল,

“আ আমি। ঘু…ঘুঙুর।”

ওপাশের মানুষটিও বোধহয় আটকে গেল এবার। এই এক মাসে কতবার যে নুপুরকে ফোন করেছে একটিবার ঘুঙুরের সঙ্গে কথা বলার জন্য কিন্তু ঘুঙুর বলেনি। প্রতিবার ফিরিয়ে দিয়েছে। যতই বুঝদার মানুষ হোক প্রেমিক-প্রেমিকা সর্বদাই নিজেদের কাছে অবুঝ। কল্পের ক্ষেত্রেও তাই হল। মস্তিষ্ক বুঝলেও মন বুঝতে নারাজ তার। ঘুঙুর ঠিক ছিল বুঝেও একটা চাপা অভিমান তৈরি হয়েছে তার ওপর। সেই ফলস্বরূপ এখন সে নিজের মধ্যে দ্বিগুণ ভারাক্রান্ত ভাব বহন করে বলল,

“কি চাই?”

ঘুঙুরের কান্না পাচ্ছে ভীষণ। মানুষটা তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে কেন? সে কি বুঝতে পারছে না ঘুঙুরের কষ্ট হচ্ছে। আহত সুরে সে বলল,

“আ… আপনাকে চাই।”

“আমাকে কেউ চায় না। সবই নাটক। তুই না পড়াশোনায় খুব ব্যস্ত? পড়ে একদম দুনিয়া উল্টে ফেলছিস। তো যা না আরও বেশি বেশি পড়। আমাকে কেন জ্বালাচ্ছিস?”

ঘুঙুর সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল এবার। হেঁচকি তুলে তুলে বলল,
“আপনি এভাবে কেন বলছেন? আমি কি ভুল করেছি?

কল্পের কন্ঠে তাচ্ছিল্য ভেসে উঠল,
“কিচ্ছু করিসনি তুই। সব ভুল আমার। ফোন রাখ কাজ আছে আমার।”

ঘুঙুর ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল। বলল,
“দেখা করবো। প্লিজজ…. একবার আসুন।”

কল্প কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,
“নো ওয়ে।”

ব্যস্ খট করে কল কেটে গেল। ঘুঙুর পরবর্তীতে এতবার চেষ্টা করল আর কাজ হল না। ফোন সুইচড অফ। কল্প ইচ্ছে করে এটা করেছে বুঝতে পারছে ঘুঙুর। ফোনটা নুপুরকে ফিরিয়ে দিয়ে এসে দরজা আটকে কাঁদতে বসে গেল সে। একটু আগের প্রাণোচ্ছল মেয়েটা এখন সর্ববিষাদ মেখে কাঁদতে বসেছে। কল্পের ইগনোর তাকে তীব্র ভাবে আঘাত করছে। তবে সে কল্পকে দোষ দিচ্ছে না। কারণ এতদিন সে নিজেও তো কল্পকে কঠোর ভাবে ইগনোর করেছে। তারও নিশ্চয়ই এতটাই কষ্ট হয়েছে। কোন মুখে এখন সে কল্পের দোষ খুঁজবে? আপুও তাকে অনেকবার বলেছিল একটাবার কথা বলতে কিন্তু সে বলেনি। কীভাবে বলবে তার সঙ্গে কথা বললেই যে মন অন্য জগতে হারিয়ে যায়। দিনদুনিয়া ভুলে উতলা হয়ে ওঠে একটাবার দেখা পাবার। আপুর থেকে শুনেছে কল্প নাকি তার সঙ্গে কথা বলতে স্কুলের গেটেও গিয়েছিল। কিন্তু বোর্ড পরীক্ষায় সিট প্ল্যান অন্য স্কুলে বিধায় বাবার সঙ্গে যাতায়াত করেছে ঘুঙুর এজন্য এই সুযোগটাও হাত ছাড়া হয়ে গেছে কল্পের। নিজের করা ছোট্ট ভুলে নিজেই পস্তাচ্ছে ঘুঙুর। কিভাবে দেখা করবে মানুষটার সঙ্গে? কিভাবে মান ভাঙাবে?

চলবে,
®নামিহা নিশি