#তোতাপাখি_আমার
১৫(ক).
বিকেল পর্যন্ত দেরি সইতে পারলো না ঘুঙুর। ইনিয়ে বিনিয়ে মা’কে ম্যানেজ করে এই ভর দুপুরে ছুটল চৌধুরী নিবাসে। রাস্তা যেন আজ ফুরতেই চায় না। ঘুঙুর হেঁটে এগোতে না পেরে ছুটতে শুরু করল। এতেই লাভ হল। খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল। কিন্তু ছুটে আসায় তার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। খাদিজা বেগম ওকে এভাবে ক্রমান্বয়ে হাঁপাতে দেখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
“এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? কুকুরের তাড়া খেয়েছিস নাকি?”
ঘুঙুর এটাই মেনে নিল। কারণ না বললে চাচি তখন আসল সত্যি জানতে চাইবে। তাই বলল,
“হ্যাঁ কুকুর তাড়া করেছিল। আমাকে একটু পানি দাও তো চাচি। গলা শুকিয়ে গেছে।”
খাদিজা ঘুঙুরের নাজেহাল অবস্থা দেখে পানি নিয়ে এলেন। নিজের হাতে খাইয়েও দিলেন। পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হল ঘুঙুর। তার দৃষ্টি আশেপাশে। খাদিজা বেগম সরাসরি বললেন,
“কাউকে খুঁজছিস?”
ঘুঙুর আমতা আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ। ওই কুহু কোথায়? দেখছি না যে?”
“কুহু তো স্কুলে। তোর পরীক্ষা কেমন হল? কতদিন পর এলি। চাচিকে তো ভুলেই বসেছিস।”
“এভাবে বলো না। তোমাকে কিভাবে ভুলতে পারি? জানোই তো কত পড়া ছিল। এখন ঝারা হাত-পা। রোজ তোমাকে এসে ইচ্ছে মতো জ্বালাব।”
খাদিজা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন।
“যত খুশি জ্বালাস। তোদের জন্য জ্বলতে জ্বলতে জ্বালানি হতেও আমি রাজি।”
ঘুঙুর বসা থেকে উঠে খাদিজা বেগমকে আদুরে ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী স্বরে বলল,
“ইউ আর সো সুইট চাচি। আই লাভ ইউ সো মাচ।”
খাদিজার হাসি আরও চওড়া হল। তিনি ঘুঙুরকে পুনরায় চেয়ারে বসিয়ে বললেন,
“এই ভর দুপুর বেলা এভাবে ছুটে এলি যে? কিছু তো কারণ একটা অবশ্যই আছে?”
ঘুঙুর ধরা পড়ে কথা ঘুরিয়ে ফেলল। বলল,
“কেন কারণ ছাড়া আসতে পারি না বুঝি?তোমাকে দেখি না কতদিন। তর সইলো না আর, চলে এলাম।”
“খুববব ভালো করেছিস। তুই বোস আমি গোসলটা সেরে আসি। তারপর খেতে দেবো তোকে। মাংসের ঝোল করেছি, পোলাও আরও অনেক কিছু। জমিয়ে খাবি।”
“তাই ! এতকিছু কেন? স্পেশাল ডে নাকি আজ?”
“স্পেশালই তো। আজ ইলেকশন যে। কল্পের জন্য করেছি সব। ছেলেটার মনের ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে। তাই একটু চেষ্টা করছি ওকে খুশি করতে।”
ঘুঙুর এবারে সিরিয়াস হল। সবকিছু জেনে বুঝেও অবুঝের ন্যায় প্রশ্ন করল,
“কেন কি হয়েছে তোমার ছেলের? মনের ওপর কি চলছে?”
খাদিজা নিজেও সিরিয়াস হলেন। এগিয়ে এলেন ঘুঙুরের নিকটে। মাথায় হাত বুলিয়ে সেই হাত নামিয়ে আনলেন মুখে। চিবুক তুলে বললেন,
“তুই তো এখন আর ততটাও ছোট নেই, ঘুঙুর। ভালো মন্দ সবই বুঝিস। তবু কেন অবুঝের মতো করিস? আমার ছেলেটা কেন এতকিছু করছে? তোর জন্যই তো। কেন বুঝতে চাস না ওকে? কেন কষ্ট দিস। জানিস তো ছেলেরা হাজার কষ্ট সইবে তবু মুখে কঠিন ভাব বজায় রেখে চলবে। কিন্তু আমি তো মা, সন্তানের মুখ দেখলেই তার মনটা পড়তে পারি। তুই কবে এভাবে আমার ছেলেটাকে পড়তে পারবি? ওপর ওয়ালা কবে তোদের একত্রে দেখার তৌফিক দেবেন?”
খাদিজা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। ঘুঙুর কিছু বলতে পারল না চাচির প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে। শুধু উদাসীন হয়ে বসে রইল। আসলেই কি সে বোঝে না মানুষটাকে? ওই কঠিন মুখের আড়ালে নম্র দৃষ্টি সে কি সত্যিই পড়তে পারে না?
–
দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে দুপুর তিনটা নাগাদ কল্প বাড়িতে চলে এলো। চারটা পর্যন্ত ভোট দেওয়ার সময়সীমা। তারপর সন্ধ্যার মধ্যে ডিক্লেয়ার দেওয়া হবে বিজয়ীর নাম। ততক্ষণ পর্যন্ত ওখানে বসে বসে পেইন নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারথেকে ভালো বাসায় এসে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দেওয়া যাবে। এই ভেবে বাড়ি ফিরেছে সে। নিজের ঘরে ঢুকে শার্টটা সবে খুলেছে এরইমধ্যে ঝড়ের গতিতে কেউ এসে পেছন থেকে জাপ্টে ধরল তার ঘর্মাক্ত দেহ। চমকে উঠল কল্প। নিজের উন্মুক্ত উদরে সন্তপর্ণে চেপে রাখা হাতজোড়া দেখে বুঝতে বাকি রইল না মানুষটির পরিচয়। অধর কোণে বক্র হাসি ফুটে উঠল তার৷ পরপরই মিলিয়ে গেল তা। কন্ঠে গাম্ভীর্য টেনে বলল,
“সরে যা। ভীষণ টায়ার্ড আমি।”
ঘুঙুর সরলো না মোটেই। বরং আরও শক্ত হাতে চেপে ধরল। আহ্লাদী স্বরে বলল,
“ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবেন।”
“ধরে রাখতে চেয়েছিস কখনও?”
“খুব করে চেয়েছি। এখনও চাইছি। আপনি বুঝতে পারছেন না। ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না কেন আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে? আপনি না বুঝলে কে বুঝবে আমায়? আপনার সঙ্গে কথা বললে এক্সামে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছিল। আপনার কন্ঠ শুনলে আমি স্থির থাকতে পারি না। মনে হয় সবকিছু ছেড়ে ছুটে চলে যাই। মস্তিষ্ক জুড়ে তখন শুধু আপনিই বিরাজ করেন। নিরুপায় হয়ে দূরে সরে থেকেছি। এবারের মতো মাফ করে দিন। আর কখনও এমন ভুল হবে না। দুনিয়া উল্টে গেলেও আপনার থেকে দূরে থাকার কথা ভাববো না।প্রমিস…..।”
কল্প স্থবির হয়ে আবেগি মেয়েটির প্রতিটি কথা শুনলো। সত্যিই তার তোতাপাখি অনেক বড় হবে গেছে। এতটাই বড় যে তাকেও সামলাতে চেষ্টা করছে। সময় খুব দ্রুত যায়। চোখের সামনে দুই বেনি গেঁথে স্কুলে যাওয়া মেয়েটা কিছুদিন পর থেকে কলেজ যাবে৷ আর এখনই কি সুন্দর ভাবে গুছিয়ে কথা বলছে। এই প্রথম বারের মতো কল্প অনুভব করল নিজের জন্য ঘুঙুরের ব্যাকুলতা। ওই কন্ঠে তখন কোনো দ্বিধা ছুটে না, আর না ছিল সংকোচ। কতটা আত্নবিশ্বাস নিয়ে মেয়েটা স্বীকারোক্তি দিয়ে দিল। ছারখার করে দিল তাকে। কল্প প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। তার আদলে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। আস্তে করে ঘুঙুরের হাত নিজের উদর থেকে ছাড়িয়ে পেছন ঘুরে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। ঘুঙুরের অসহায় দৃষ্টি তাকে নরম হতে আহবান জানাচ্ছে। কিন্তু সে সেটা করল না। বরং সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“সত্যিই তুই কি চাস তার প্রমাণ আজই হয়ে যাবে। তবে সেটা এখানে নয়। বদ্ধ ঘরে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেমালাপ শুনতে নওয়াব কল্প চৌধুরী রাজি নয়। তাকে স্বীকার করতে হবে সর্ব সম্মুখে। আজ নির্বাচনে জয় যার ই হোক সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। যদি না তুই নিজেকে প্রস্তুত রাখিস। আমি আজই তোর বাবার কাছে তোকে চাইবো কিন্তু সেই মুহুর্তে তোকেও আমাকে চাইতে হবে। সবার সামনে যদি স্বীকার করতে না পারিস তখন বুঝবো কেমন ভালবাসা তোর। নির্বাচন কোনো ফ্যাক্ট নয়, আমি যদি জীবন যুদ্ধে হেরে যাই ঘুঙুর তবে আই সয়্য়ার চিরদিনের জন্য তুই আমাকে হারাবি।”
স্তব্ধ ঘুঙুরকে ফেলে রেখে গোসল নিতে চলে গেল কল্প। মনে মনে হাসলো বিজয়ের হাসি। তার বোকা পাখি নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেবে না। ঘুঙুরের বাবাকে রাজি করাতে এর থেকে ভালো উপায় কল্পের হাতে দ্বিতীয়টি ছিল না। মেয়েদের তিনি খুব ভালবাসেন। কল্প একপাক্ষিক ভাবে বললে তিনি কিছুতেই এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। কিন্তু ঘুঙুরও যদি সত্যিটা স্বীকার করে নেয় তবে কাজটা আরেক ধাপ সহজ হবে। তাছাড়া এটার মধ্যে কোনো অন্যায় তো কল্প দেখছে না। ভালবাসলে স্বীকার করতে ভয় থাকলে সেটা আবার কিসের ভালবাসা? কল্পও যেমন নির্ভয়ে ঘুঙুরকে ভালবাসে ঘুঙুরেরও তেমনই নির্ভয় থাকতে হবে। তবেই না তারা হতে পারবে ‘মেইড ফর ইচ আদার।’
চলবে,
®নামিহা নিশি
#তোতাপাখি_আমার
১৫(খ)
চারিদিকে বিজয় মিছিল। গ্রামের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। আমির আহমেদকে হারিয়ে জিতে গেছে কল্প চৌধুরী। এটা যেন চরম অবিশ্বাস্যের বিষয়। কেউ কেউ এখনও তো মানতেই পারছে না। কিন্তু এটাই সত্যি। নওয়াব কল্প চৌধুরী জিতে গেছে। বাইরের বাতাবরণে এই সুসংবাদের ঘ্রাণ ছুটলেও ভেতরের পরিবেশ ভিন্নমুখী। আহমেদ বাড়ির ড্রইংরুমে পিনপতন নীরবতা। আমির সাহেবের কাঠখোট্টা মুখের সামনে সকলেই নিশ্চুপ। শান্তিপ্রিয় জুবায়ের চৌধুরী পর্যন্ত চুপ মে’রে আছেন। বন্ধুর ক্রোধের তোপে তিনি পরতে চান না বিধায়। কল্প আরামসে বসে ফোন টিপছে। দুটো পরিবার একত্রে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এতটা নিরবতা আগে কখনও নামেনি। সকলে নিশ্চুপ থাকলেও সকলের মন-মস্তিষ্ক আমির সাহেবের উত্তরের অপেক্ষায়। এই নিরবতা ভাঙল মিনিট পনের পর। সকলের আগ্রহে ইস্তফা দিয়ে আমির সাহেব মুখ খুললেন। গমগমে আওয়াজে বললেন,
“এই বিয়ে সম্ভব নয়।”
কল্প জানত এমনটাই হবে। সময় মতো বেঁকে বসবেন এই লোক। কল্প ফোনটা হাতের মুঠোয় সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে বসে রইল। আপাততঃ সে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু তার আগেই তার হাত চেপে ধরলেন খাদিজা বেগম। ইশারায় বোঝালেন চুপ থাকতে। অতঃপর মুখ খুললেন তিনি। বিনয়ী স্বরে বললেন,
“কিন্তু ভাইজান…..।”
আমির সাহেব হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন। পরপর নিজেই বললেন,
“দেখ বউমা, ঘরে আমার আরেকটা মেয়ে আছে। সে ও বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে। আগে তার বিয়ে হোক তারপর ছোটটাকে নিয়ে ভাববো। এর আগে কিছু বলতে পারছি না।”
খাদিজা আরেকটু নম্র কন্ঠে বললেন,
“তাহলে বলতে চাইছেন নুপুরের বিয়ে হয়ে গেলে ঘুঙুরকে নিয়ে আপনার আর কোনো আপত্তি থাকবে না?”
আমির সাহেব চেহারায় চরম অসন্তোষ ফুটিয়ে বললেন,
“মেয়ে যখন পঁচা শামুকে পা কেটে নিয়েছে তখন আর কি করার। দেখলে না কেমন নির্লজ্জের মতো সকলের সামনে বলে গেল ‘সে ভালো-টালো বেসেছে।’ দেখেছ এখনই কি অধঃপতন। তোমার নির্লজ্জ ছেলের সঙ্গ পেয়ে এই হাল। ভবিষ্যতে যে কি আছে কপালে আল্লাহ মালুম।”
আমির সাহেব একটু থামলেন। এদিকে তার কথা শুনে সকলের অধরেই চাপা হাসি। তিনি ফের বললেন,
“তোমরা থাকো। রাতের খাবারটা সবাই একসঙ্গে খাবো। আমি বাজার থেকে আসি। ওই আহাম্মক তুই বসে কেন? উঠে আয় শালা।”
শেষোক্ত কথাটি তিনি জুবায়ের চৌধুরীকে মিন করে বললেন। জুবায়ের চৌধুরী উঠে আসতে আসতে একটু ভাব নিয়ে বললেন,
“কে তোর শালা? বেয়াই বল বেয়াই।”
আমির সাহেব তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“আগে আসুক সেই অলক্ষুণে সময় তারপর দেখা যাবে তোর মতো গাধাকে বেয়াই ডাকতে হয় কি না।”
জুবায়ের চৌধুরী হেসে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলেন। দু’জনের যাত্রা কালে কল্প বলে উঠল,
“তোমরা বাড়িতেই থাকো। বাজার আমি করে আনছি।”
সঙ্গে সঙ্গে আমির সাহেব তেঁতে উঠলেন। খাদিজা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
“বউমা তোমার ছোকরাকে বলে দাও একটা নির্বাচনে জিতে সে এমন কিছু হয়ে যায়নি যে বাপ-চাচাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। আমরা এখনও আমাদের জন্য যথেষ্ট। আগে বুড়ো হই তারপর দেখবো তাদের করুণা লাগে কি না।”
অগত্যা দুজনে চলে গেল। কল্প মনে মনে শক্ত কিছু উচ্চারণ করলেও মুখে চুপ রইল। হাজার হোক হবু শ্বশুর বলে কথা, এক ইঞ্চি ছাড় তো দেওয়াই যায়। এদিকে তারা চলে যেতেই নলিনা আর খাদিজার মধ্যে সে কি আনন্দ। মিষ্টি মুখ করাকরি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। নুপুরও খুশি মনে বসে আছে সকলের মধ্যে। কিন্তু বাবার কথায় একটু একটু চিন্তা হচ্ছে তার। এটা বোঝাই যাচ্ছে তার বিয়ের ঘন্টাও খুব শীঘ্রই বাজতে চলেছে। মিষ্টি খাওয়ার এক পর্যায়ে খাদিজা বেগম আড়াল থেকে লুকিয়ে থাকা ঘুঙুরকে টেনে বের করে নিয়ে এলেন। লজ্জায় আপাততঃ যার সর্বাঙ্গ নেতিয়ে আছে। কল্প এতক্ষণ এই অপেক্ষাতেই ছিল। কুহু তো অলরেডি খোঁচানো শুরু করে দিয়েছে তাকে। বৃষ্টিও উপস্থিত। সকলে মিলে আজ খুব সুন্দর একটা ঝকঝকে দিন। কল্পের সামনে আজ এক নতুন ঘুঙুর দাঁড়িয়ে। কল্প মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে। মনে পরছে ক্ষণকাল আগে সর্ব সম্মুখে বলা ঘুঙুরের সেই অকপট স্বীকারোক্তি। ‘আমিও তাকে ভালবাসি’ ব্যস্ তারপরই তো নরম হয়েছেন আমির সাহেব। মেয়েদের চাওয়া-পাওয়া তিনি কখনও অপূর্ণ রাখেন না। কিন্তু কল্প কখনও ভাবতেই পারেনি ঘুঙুর এতটা সাহস রাখতে পারবে। আজ সে অবাক, বিস্মিত, বাকরুদ্ধ। তার তোতাপাখি কত্ত বড় হয়ে গেল।
–
বৃষ্টি, কুহু তো এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বিয়েতে তারা কি কি করবে,কি কি পরবে, সবকিছু নিয়ে। ঘুঙুর ওদের কান্ড দেখে লজ্জা পাচ্ছে। এতটা বাচ্চামু করছে দুটোয়। এদিকে তার তো লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। ইশ্ এরপর কিভাবে বাবার সামনে যাবে সে? তখন তো পরিস্থিতির চাপে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছিল ভালবাসার কথা। কিন্তু এখন কি হবে? বাবাকে এই মুখ কি করে দেখাবে সে? এই ভ’য়ে তখন থেকে ঘরে ঘাপটি মে’রে বসে আছে। বাবা-চাচা বাজার থেকে ফেরার পর থেকে এক পা ও ঘরের বাইরে বের হয়নি। কিন্তু আর বোধহয় পারা গেল না। কারণ নলিনা বেগম এসে সকললে খেতে ডেকে গেলেন। দুই পরিবার কতদিন পর আজ একসঙ্গে হয়েছে। একটা সুন্দর ডিনার হতে চলেছে। সেখানে সকলকেই উপস্থিত থাকতে হবে। একে একে সবাই চলেও গেল। ঘুঙুর গেল অনেকটা সময় ব্যয় করে। মাথা যতটা পারা যায় নত করে সে গিয়ে বসল একেবারে কর্ণারের চেয়ারটাতে। আশ্চর্য, ঠিক তার পাশেরটাতেই কল্প গিয়ে ধপাস করে বসে পরল। ঘুঙুর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখল তাকে। এতটা নির্লজ্জ মানুষ হয়? এভাবে সবার মধ্যে পাশে এসে বসার মানে কি? নিজের তো লজ্জা শরম নেই অথচ তাকে লজ্জা দিয়ে দিয়ে শেষ করে ফেলছে। সবার সামনে কিছু বলতেও পারল না ঘুঙুর। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। কল্পের ভাবভঙ্গি একেবারে স্বাভাবিক। সে গা ছেড়ে বসে আছে। ঘুঙুরের অস্বস্তি একটু কাটল যখন দেখল খাবার সময়টা কেউ তাদের নিয়ে পড়ে নেই। যে যার মতো খেতে ব্যস্ত। এটা দেখে যেই না একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল ঘুঙুর তখনই তার শ্বাস পুরোপুরি রোধ করে দিয়ে কল্প একটা দুর্দান্ত কাজ করে বসল। ঘুঙুরের পাতে নিজের পাত থেকে এক পিস মাংস তুলে দিল। ঘুঙুর বিস্ফোরিত নয়নে পুরো টেবিলে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ্ কেউ দেখেনি হয়তো। বুকে হাত দিয়ে দম নিল সে। পরপর রাগী দৃষ্টিতে কল্পের দিকে তাকালে কল্প মুচকি হেসে চোখ টিপ মে’রে দিল। তব্দা খেয়ে ঘুঙুর তড়িৎ মাথা নামিয়ে নিল। নাহ্ ওই অসভ্য পুরুষের দিকে আর তাকানো যাবে না। ফের কি করে বসে।
এভাবেই দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটিতে কেটে গেল সেই রাতটি। চৌধুরী পরিবার বাড়ি ফিরল রাত এগারোটার দিকে। বৃষ্টি আগেই চলে গেছে।
এখন মধ্যরাত। ঘুঙুরের চোখে ঘুম নেই। স্বপ্নের মতো ছিল আজকের দিনটা। সময় যে কিভাবে ফুরিয়ে গেল। বিছানায় এপিঠ ওপিঠ করে সে শুধু ভেবে চলেছে যাত্রা কালে কল্পের বলে যাওয়া সেই বাক্যটুকু, “আমার হতে প্রস্তুত হয়ে যা। সময় যে সন্নিকটে। সব নির্ঘুম রাতের হিসেব সুদে-আসলে মিলিয়ে নেব। নওয়াব কল্প চৌধুরী বাকিতে বিশ্বাসী নয়।”
–
চেয়ারম্যান কল্প চৌধুরী হিসেবে আজ কল্পের প্রথম দিন। পার্টি অফিসে আজ তার ব্যাপক কাজ। জিহানও সমান তালে ব্যস্ত তার সঙ্গে। দলের বাকি সদস্যদেরও ব্যস্ততার অন্ত নেই। সবাই নিজেদের মতো কাজ করছে তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সেখানে উপস্থিত হন মকবুল আলম। সাবেক চেয়ারম্যান আমির আহমেদের খোদ লোক হলেন এই মকবুল আলম। ছায়া সঙ্গী বলা চলে। এতগুলো বছরে আমির সাহেবের কাজে সমান সঙ্গ দিয়ে এসেছেন। তাকে এখানে দেখে কল্প হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল,
“মকবুল চাচা যে! আসুন আসুন ভেতরে আসুন।”
মকবুল আলম সন্তর্পণে ঢুকলেন এত বছরের এই চেনাপরিচিত ঘরটিতে। কিন্তু আজ যেন ঘরটি বড়ই অচেনা। এতদিন ওই চেয়ারটায় বসে সদর্পে গ্রাম পরিচালনা করতেন আমির আহমেদ। আর আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। ঘর আছে, চেয়ার আছে কিন্তু মানুষগুলো পাল্টে গেছে। মকবুল আলতো হেসে কল্পের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটাতে বসলেন। চাচা হিসেবে বরাবরই কল্প তাকে সম্মান করে এসেছে। আজ চেয়ারম্যান হয়েও সেই সম্মান অক্ষুণ্ণ হয়নি। মকবুল মনে মনে খুশি হলেন কল্পের নিরহংকার মনোভাবে। কল্প রনি নামের একটা ছেলেকে ডেকে বলল, “চাচার জন্য চা-নাস্তা আনা।”
মকবুল বাঁধা দিল,
“আমি নাস্তা করে এসেছি, বাবা। তুমি ব্যস্ত হইও না। আমি এসেছি অন্য কাজে।”
কল্প প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ছুড়ল,”অন্য কাজে?”
“তুমি নতুন দ্বায়িত্বে এসেছ, তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে-শুনিয়ে দিতে এলাম। যদি তুমি চাও তবেই।”
কল্প বিনয়ী স্বরে বলল,
“অবশ্যই চাচা। আপনি পাশে থাকবেন এটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের। আপনার মতো পরিপক্ব হাত আমার মাথার ওপর থাকলে আমার চলার পথ আরও সুগম হবে এটা ঠিক। কিন্তু…..?”
“কিন্তু..? কি? বলো। তুমি না চাইলে আমি চলে যাই, বাবা।”
“বিষয়টা তা নয় চাচা। আপনি আমার সঙ্গে থাকলে আমির চাচা নিশ্চয়ই অসন্তুষ্ট হবেন৷ আমি কোনোভাবেই চাই না আমার জন্য আপনাদের মধ্যেকার সম্পর্কে টানাপোড়েন আসুক।”
মকবুল কিয়ৎক্ষণ কল্পের মুখাভাব লক্ষ্য করে হো হো করে হেসে উঠলেন। কল্প বিস্মিত তার হাসিতে। বলল,
“হাসছেন যে, চাচা? আমি কি হাসির কিছু বললাম?”
মকবুল হাসি ক্ষীণ করলেন। বললেন,
“বোকা ছেলে বলে কি! তোমার খুশির জন্য যে লোক নিজের এত বছরের সম্মানের জায়গা ছেড়ে দিল তাকেই তুমি চিনতে পারলে না!”
মকবুল আবারও হাসলেন তবে এবার মৌন ভাবে। কল্প কিছুই বুঝল না। অবুঝের মতো প্রশ্ন করল,
“মানে? কি বলতে চাইছেন, চাচা? আমার জন্য জায়গা ছেড়ে দিলেন মানে? আমি নিজের যোগ্যতায় এটুকু আসিনি? গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছায় আমায় ভোট দেয়নি।”
মকবুল প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন। বিস্তারিত বলার আগে সে ঘর ফাঁকা করতে বললেন। কল্প ইশারায় সবাইকে বের হতে বললে সকলে তাদের একা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অতঃপর মকবুল বললেন,
“তোমার কি মনে হয় বাবা তোমার চাচা কি এতগুলো বছর জোর করে চেয়ারম্যানি করে গেছেন নাকি গায়ের লোক স্বেচ্ছায় তাকে সেই সম্মান দিয়েছে?”
কল্প অকপটে জবাব দিল,
“অবশ্যই তাকে ভালবেসে সেই জায়গা গায়ের মানুষ তাকে দিয়েছে। তার কাজে সবাই সন্তুষ্ট ছিল বলেই তাকে প্রতিবার বিজয়ী করেছে।”
“তাহলে এবার এমন কি কারণ আছে যার জন্য গ্রামের মানুষ তার প্রতি বৈমুখ হবে?”
কল্প উত্তর খুঁজতে লাগল। দিশেহারা সে শেষমেশ কিছুই খুঁজে পেল না বলার মতো। আসলেই তো কেন এইবারেই মানুষ তার প্রতি নারাজ? সত্যিই কি মানুষ তাকে চায়নি নাকি সে নিজেই চায়নি? মস্তিষ্ক হাতড়ে উত্তর মিলতেই কল্প হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল মকবুলের দিকে। তার কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসছে। কিছু বলার ভাষা নেই। মকবুল যেন বুঝে নিল তার চোখের ভাষা। নিজে থেকেই বলল,
“নির্বাচনের দিন তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখলাম। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল,’মকবুল আজ আমার অবসরের সময় চলে এসেছে। কাল থেকে কল্পই হবে এই গ্রামের মাথা। তুমি এতকাল যেভাবে আমায় সঙ্গ দিয়েছ তাকেও ঠিক সেভাবেই আগলে রাখবে। গার্জিয়ান হয়ে গাইড করবে। এটা তোমার প্রতি আমার অনুরোধ। গ্রামের মধ্যে শত্রুর অভাব নেই। তুমি ছাড়া আমার ভরসার জায়গা খুবই ক্ষীণ।’ অতঃপর আমি তখন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। বললাম, ‘এখনই কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন? এমনটা কখনোই হবে না। গায়ের মানুষ আপনাকে ঠকাবে না।’ তিনি তখন বললেন, ‘কিন্তু আমি তাদের ঠকাবো।’ আমি তখন হতবিহ্বল। সে পুনরায় বলল, ‘ভোট গণনার সময় বাক্স অদলবদল হবে এবং এটা তুমি নিজ দ্বায়িত্বে করবে। আমি তখন দ্বিগুণ হতাশা নিয়ে শুধালাম,’এসব কেন করছেন?’ তিনি অকপটে বলে দিলেন,’ছেলের খুশির জন্য।”
কল্পের চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা। সে ও পিছিয়ে নেই কিভাবে অশ্রুগুলো আড়াল করা যায় সেই চেষ্টায় সচেষ্ট। মকবুল আলম তার কাঁধে হাত রাখলেন। শান্ত কন্ঠে আরও কিছু মধুর বানী শোনালেন,
“সন্তানদের বাবা-মা তাদের হৃদয় নিংড়ে ভালবাসে। কিন্তু আফসোস সন্তানেরা তাদের ভেতরটা না দেখে শুধু বাহ্যিক ব্যবহারের খোঁজ রাখে।”
কল্পের আর কিছু ভালো লাগল না। সে উঠে দাঁড়াল। কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“চাচা আজকের মতো আপনি সবকিছু সামলে নিন। আমি পরে এসে দেখে নেব৷”
মকবুল আলম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তার ভেতরটা এখন হালকা লাগছে। যদিও আমির সাহেব এসব শুনলে তাকে ভীষণ রাগ করবেন কারণ তিনি বারংবার হুশিয়ারী দিয়েছিলেন কল্পের কানে যাতে এই বিষয় না পৌঁছায়। কিন্তু তিনি নিজ দ্বায়িত্বে এসে জানিয়ে দিলেন। এটাই হওয়ার ছিল। যার জন্য আমির সাহেবের এত স্যাক্রিফাইস সে ই যদি না জানবে তাহলে হবে কি করে? সম্পর্কের দৃঢ়তা বাড়বে কি করে? এতবড় সত্যি কিছুতেই মকবুল নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারছিলেন না। অগত্যা তাকে বলতেই হল।
.
চলবে,
®নামিহা নিশি