#তোতাপাখি_আমার
১৬.
জুবায়ের চৌধুরীর মুখে হাসি নেই। ছেলেটা এত বেয়াড়া কি করে হল কিছুতেই ভেবে পান না তিনি। তার মতো একজন শান্তিপ্রিয় মানুষের পুত্র এমন ভেজালমার্কা হয় কি করে? আশ্চর্য! একটার পর একটা ঝামেলা এই ছেলে লাগাবেই লাগাবে। এই যে এখন গো ধরে বসে আছে ঘুঙুরের সঙ্গে বিয়েটা এগিয়ে আনতে হবে। বিয়ে না হোক শুধু কাবিন করে রাখলেই চলবে। কিন্তু এই ভয়ানক খবর তিনি আমির সাহেবকে বলবেন কিভাবে? আমির সাহেব তো আগেই বলে দিয়েছেন নুপুরের বিয়ে হলে তারপর ঘুঙুরকে নিয়ে ভাববে। এই মুহুর্তে এই সংবাদ তাকে দিলে তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন এটা নিশ্চিত। জুবায়ের চৌধুরী বন্ধুর ক্রোধকে ভীষণ ভ’য় পান। তিনি কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার নিকট যেতে পারবেন না। এদিকে ছেলেটাও তার নাছোড়বান্দা। সকাল থেকে এই জায়গায় নিজেও বসে আছে তাকেও বসিয়ে রেখেছে। বলেছে– এখানে থেকে উঠলে সরাসরি আহমেদ বাড়িতে যেতে হবে নয়তো উঠতে পারবে না। খাদিজা বেগম ছেলে আর স্বামীর কান্ড দেখে অতিষ্ঠ। দুপুর গড়িয়ে গেল অথচ তাদের ভাবের অদল- বদল হল না! শেষমেশ তিনি মুখ না খুলে পারলেন না। বিরক্তির রেশ ধরে বললেন,
“কি শুরু করলে তোমরা? এভাবে কি বিয়ে হয়? বাবা-ছেলে এক জায়গায় বসে অনশন করলেই সমাধান হয়ে যাবে? একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে তো।”
কল্প বাপের দিকে আঙুল তুললো,
“এটাই তো সকাল থেকে বাবাকে বোঝাতে পারছি না। এবার তুমি একটু বোঝাও না। আমার ডিসিশন ফাইনাল।”
খাদিজা কপাল চাপড়ালেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“নির্লজ্জ ছেলে একটা। আমির ভাই এসব শুনলে কি ভাববেন!”
কুহু পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বলল,
“ভাববেন তোমার তার হবু মেয়েজামাই কত বড় মাপের বেহায়া!”
কল্প হাত উঁচিয়ে কুহুকে তাড়া করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। খাদিজা ছেলের পাশে এসে বসলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
“শান্ত হ। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। সেদিনই কথাবার্তা হল। আমির ভাই কত সুন্দর ভাবে সবকিছু মেনে নিলেন। আজ আবার তুই নতুন ঝামেলা শুরু করতে চাইছিস?”
“তোমরা তার কাছে যাবে কিনা বলো? নয়তো আমিই চললাম…..।”
কল্প সোফা ছেড়ে উঠতে নিলেই হায় হায় করে উঠলেন খাদিজা।
“কি করছিস! এমনটা করে না, বাবা। আমরা যাবো তো, একটু ধৈর্য্য ধর।”
কল্প উঠে দাঁড়াল। একরোখা কন্ঠে বলল,
“সন্ধ্যা সাতটা অব্ধি সময় দিলাম। তারমধ্যে তোমরা গেলে যাবে নয়তো আমি যা ভালো বুঝবো তাই করবো।”
আর কিছু শোনার প্রয়োজনবোধটুকু করল না সে। হনহনিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
খাদিজা বেগম স্বামীর পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জুবায়ের চৌধুরী নিজেও চরম হতাশ।
–
আমির সাহেব ক্রোধে ফোঁসফোঁস নিশ্বাস ফেলছেন। সমানে পায়চারি করে চলেছেন ঘরজুড়ে। সন্ধ্যার পর ঠিকই জুবায়ের চৌধুরী ও খাদিজা এসেছিলেন এ বাড়িতে। জানিয়ে গেছেন কল্পের সিদ্ধান্ত। সেই থেকে উত্তপ্ত হয়ে আছে আমির সাহেবের মেজাজ। কিছুতেই যেন ঠান্ডা হয় না। নলিনা বেগম বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে স্বামীর হাবভাব দেখছেন। অগত্যা বললেন,
“এত রেগে থাকার তো কিছু নেই। বিয়ে যখন হবেই তখন দুদিন আগে হলে ক্ষতি কি? তাছাড়া শুধু তো কাবিন হবে, আমরা ঘরের লোক ছাড়া কেউ তো জানছে না। নুপুরের বিয়ে ঠিক হলে তখন না হয় ধুমধামে একসঙ্গে দুটোকেই তুলে দিলেন৷”
আমির সাহেব তেঁতে উঠলেন,
“তুমি আবার তুই বেয়াদবের পক্ষ নিচ্ছ?”
নলিনা বিরক্ত হলেন,
“এতে পক্ষ নেওয়ার কি আছে? কল্প ঠিক সিদ্ধান্তই তো নিয়েছে। নুপুর মাস্টার্স পাশ করে ভালো চাকরি করতে চায়। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে সে বিয়ে করতে চায় না। এখনও গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হতেই তার ঢের বাকি। কতদিন অপেক্ষায় থাকবে কল্প? ওর ও তো বিয়ের বয়স হয়েছে অনেক আগেই। তাছাড়া ঘুঙুরের বয়সও অনেক কম। আবেগের বশে যদি কখনও উল্টোপাল্টা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে! আমিও কল্পের সঙ্গে সহমত। ওদের কাবিনটা অন্তত হওয়া উচিত। আমরা বাবা-মা হয়ে সবকিছু জেনে-বুঝে কতদিন ওদের হারাম রিলেশনে ঝুলিয়ে রাখতে পারি? কল্প তো ভালো কিছুই চাইছে।”
আমির সাহেবকে কিছু বলতে দেখা গেল না। তিনি সেভাবেই পায়চারি করছেন। নলিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পরলেন।
–
“আপনি এসব কি শুরু করলেন? বাবা রেগে আগুন। আপনার এসব বাড়াবাড়ির জন্য শেষ পর্যন্ত আমাদের বিচ্ছেদ না হলেই হয়।”
“থাপড়ে তোমার গাল লাল করে ফেলব, বেয়াদব। যেখানে আমি সম্পর্কটাকে যত দ্রুত সম্ভব একটা পর্যায়ে নিতে চাইছি সেখানে বিচ্ছেদের কথা মুখে আসে কিভাবে তোর?মনে মনে এটাই চাস নাকি? প্রেমের মজা শেষ? আবেগ শেষ? এখন আর ভাল্লাগে না? ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়েতে বাগড়া দিতে চাচ্ছিস?”
ঘুঙুর হতভম্ব নেত্রে চেয়ে রইল। ফোনের ওপাশ থেকে বলা কথাগুলোর মর্মার্থ এতটাই কঠিন ছিল যে তার বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে। সে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“কি বললেন? আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। ওকে ফাইন, আপনার যা খুশি করুন। আমি আর বাঁধা দেব না। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার এসব বাড়াবাড়ির জন্য যদি কোনো রকম ত্রুটি আসে সেই ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র সাফার করব না আমি। তার সম্পূর্ণ দায়ভার থাকবে আপনার। ভালো থাকুক।”
ফোনটা কেটে দিল ঘুঙুর। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। দমবন্ধ লাগছে। কল্প এভাবে বলতে পারল তাকে? সে তো তাদের সম্পর্কের কথা ভেবেই চুপ থাকতে বলছিল। ইচ্ছে করে বিয়ে পেছাতে তো চায়নি। লোকটা সবসময় ভুল বোঝে তাকে। অহেতুক রাগ দেখায়, বকে। একটুও বুঝতে চায় না। ডাগর ডাগর আঁখিজোড়ায় জল থৈথৈ বৃষ্টি নিয়ে বিছানায় গুটিশুটি মে’রে শুয়ে পরল সে। আজ রাতে ঘুম নামবে কি চোখে!
ওদিকে বেলকনিতে বসে একের পর এক সিগারেটের প্যাকেট শেষ করে ফেলছে কল্প। ফোনটা তখনই রাগের বশে আছড়ে ফেলেছে দূরে। ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে সেটা। সেভাবেই পড়ে আছে। নিজের ওপর চরম বিরক্ত কল্প। ঘুঙুরের প্রতি রাগটা সে কন্ট্রোলে আনতে পারছে না। ইনসিকিউরড ফিলিংস থেকে উল্টোপাল্টা বলে ফেলছে।
রাত গভীর হতে থাকল। কল্পের মনে শান্তি নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার উত্তাপেও যখন মন শান্ত হয় না বরং আরও তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পরছে জ্বালা তখন ভাঙাচোরা ফোনটা তুলে এনে সেখান থেকে সিমকার্ড বের করে নিল সে। অন্য একটি ফোনে সিমটা সেট করে পুনরায় কল করল ঘুঙুরকে। দু’বার রিং হল পরপর। কল্প অপেক্ষায় থাকল। একবার ভাবল নুপুর হয়তো নিজের ফোন নিয়ে গেছে। ঠিক তখনই কলটি পিক আপ হল। কল্প আবারও অপেক্ষায় রইল কাঙ্খিত কন্ঠটি শুনতে। কিন্তু ঘুঙুর মুখ খুলল না। চুপটি করে রইল। অবশেষে কল্পই মুখ খুলল। নিষ্প্রভ, প্রগাঢ় অনুভূতিপূর্ণ কন্ঠে থেমে থেমে বলল,
“তোতাপাখি আমার…….. কথা বল। রেগে আছিস? আমার কিছু ভালো লাগছে না জানিস? তোকে আর দূরে রাখতে পারছি না। তোকে সম্পূর্ণ নিজের করে পেতে মরিয়া হয়ে উঠছি। ইউ নো না ঠিক কতটা নিজের করে পেতে চাইছি? এভাবে যদি কোনো ভুল করে ফেলি সেজন্যই এতটা তাড়াহুড়ো করছি। প্লিজ তুই কো-অপারেট করে নে না। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ ব্যাডলি,
ড্যাম ইট।”
ঘুঙুরের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। কল্পের সিচুয়েশন বুঝতে পেরে লজ্জায় নাকি সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে নিল বোঝা মুশকিল। যেন নিশ্চুপতা তাকে আরও গভীর ভাবে গ্রাস করে নিল। কল্প উত্তরের আশায় নেই। সে জানে তার তোতাপাখিকে। বাকি রাতটুকু দু’জনে সেভাবেই দু’জনের নিঃশ্বাসের আওয়াজে পার করে দিল। কল কাটার মতো দুঃসাহস কারো হল না।
–
বাতাসে মৃদু শৈথিল্যতা। আকাশে ঘন মেঘ। যখন-তখন ঝুম বৃষ্টি নেমে যেতে পারে। আমির সাহেব ছাতা মাথায় রওনা হলেন বাজারের পথে। যতই ঘরোয়া ভাবে কাবিন হোক আয়োজনে তিনি কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। গতকাল রাতে অনেক ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। কল্পের সিদ্ধান্তে সম্মত হয়েছেন। আসলেই হারাম রিলেশনে না রেখে ছেলে-মেয়ে দুটোকে এক করে দেওয়া অবশ্যই বাবা-মা হিসেবে তাদের দ্বায়িত্ব। কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে কাজটি করা হচ্ছে। বৃষ্টি, জিহান আর দুই পরিবার ব্যতীত আর কেউ উপস্থিত থাকবে না। গ্রামের মানুষ তিল থেকে তাল রটিয়ে বেড়ায়। সেখানে বড় মেয়ের আগে ছোট মেয়ের বিয়ে মানে ব্যাপক মুখরোচক সংবাদ। কানাঘুষা, টিটকারি চলতেই থাকবে। এই ভ’য়ে এই লুকোচুরি ব্যবস্থা। নয়তো কত ধুমধামেই না আমির সাহেব নিজের আদরের ছোট মেয়ের কাবিন করাতেন। এখন একেবারে ঘরোয়া ভাবে আয়োজন সাজাচ্ছেন।
“লিনা…..। লিস্টটা বোধহয় ঘরেই ফেলে এসেছি। একটু নিয়ে এসো তো।”
মিনিট খানেকের মধ্যে নলিনা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন। সন্তর্পণে লিস্টটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“সবকিছু দেখেশুনে এনো। কোনো কিছুতে যেন কমতি না থাকে।”
“তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সবকিছু দেখেই আনবো।”
নলিনা ঠ্যাস মে’রে বললেন,
“তা তো দেখলামই। এখনই ভুলে যাচ্ছিলেন।”
“ভুলতে যাচ্ছিলাম ঠিকই, শেষমেশ ভুলি তো নি।”
“হয়েছে হয়েছে এবার যান। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
আমির সাহেব আর কথা বাড়ালেন না৷ তর্কে জিতে গেছেন সেই গর্বতে বুক ফুলিয়ে রওনা হলেন। যাবার আগে নলিনার দিকে একটা ব্যঙ্গাত্নক ভাব ছুড়ে গেলেন। নলিনা হা হয়ে তাকিয়ে। বিড়বিড়িয়ে বললেন,
“আজব! এই লোক দিন দিন বুড়ো হচ্ছে নাকি শিশু? বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার বাচ্চামী বেড়েই চলেছে।”
–
লাল টুকটুকে বেনারসির সঙ্গে হালকা গহনা গায়ে নতুন বউ সেজে ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে ঘুঙুরকে। অবনত মুখে বাধ্য মেয়ের ন্যায় বসে আছে সে। তাকে ঘিরে একপাশে নলিনা বেগম আরেক পাশে খাদিজা বেগম। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে নুপুর, কুহু ও বৃষ্টি। এপাশের সোফায় জুবায়ের ও আমির সাহেবের মধ্যিখানে কল্প বসে। তাদের একপাশে কাজি সাহেব, মকবুল ও জিহান। আমির সাহেবের এত কাছের মকবুল যে তাকে ছাড়া তিনি মেয়ের কাবিনটাও করাতে ইচ্ছুক নন। তাই তাকেও আমন্ত্রণ করা হয়েছে। কল্প সরাসরি ঘুঙুরের দিকে চেয়ে। এতগুলো মুরুব্বির সামনেও তার বেহায়া দৃষ্টি থেমে নেই। প্রিয়তমাকে দেখার প্রয়াসে সমানে আগ্রহী। জিহান তা দেখে দুষ্টু হেসে কল্পের ফোনে একটা মেসেজ পাঠালো। মেসেজের টুংটাং শব্দে ফোনের স্ক্রিনে দেখল কল্প। মেসেজটা ওপেন করতেই ভেসে উঠল জিহানের নটাংকি কথার ঝুরি,
“ভাই সামলে। দৃষ্টিটা একটু তো সামলাও। তুমি তো ছেলে জাতির ইজ্জত লুটে নিচ্ছ।”
কল্প এঙ্গরি রিয়্যাক্টের সঙ্গে লিখল,
“থাপড়ে সব দাঁত ফেলে দেব। চুপচাপ বসে থাক, বেশি জ্বালাস না।”
জিহান থামে না৷ ফের টাইপ করে,
“এত সহজে? খরচা আছে, বস।”
“কি চাই?”
জিহান দাঁত কেলানো ইমুজি পাঠিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না। বন্ধুদের নিয়ে ট্রিপ দিতে চাই।”
“কোথায়?”
“সাজেক।”
“ওকে ফাইন। আগামীকাল ব্যবস্থা করে দেব। এখন অফ যা।”
জিহান তো সেই খুশি। “ওক্কে ভাই” লেখার পর লাভ ইমুজির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। কল্প বিরক্ত হয়ে মেসেজ ফের ধমকায়,
“থামবি তুই? আর একবার বিরক্ত করলে সব ক্যান্সেল।”
জিহান তারপর থেকেই ভদ্র ছেলে হয়ে বসে আছে। এতটা ভদ্রতা তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল ভাবতেই বিষম খায় কল্প।
…
রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। এখন শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে পড়াচ্ছেন কাজি। কল্পকে কবুল বলতে বললে দেখা যায় সে এক চান্সেই বলে ফেলেছে। এদিকে ঘুঙুর সময় নিল কিছুটা। দিনটা তারজন্য রঙিন স্বপ্নময়। ঘুঙুরের কবুল বলার মাধ্যমে শেষ দীর্ঘ অপেক্ষিত প্রহর। কল্প নিজের করে পেল তার তোতাপাখিকে, ঘুঙুর পেল তার কল্প ভাইকে। দু’জনের জীবনের শুভ সূচনা শুরু হল। তাদের খুশিতে সকলে দোয়া পড়লো, শুভকামনা জানাল। কুহু আজ বেজায় খুশি। তার প্রিয় ঘুঙুর আপু আজ থেকে তার একমাত্র ভাবি হয়ে গেল। বৃষ্টিও খুশি। প্রিয় বান্ধবী নিজের মনের মানুষকে নিজের করে পেয়েছে যে। নুপুর খুশি কল্পের এতগুলো বছরের লুকায়িত ভালবাসার শেষ পরিণতির সাক্ষী হতে পেরে। বাবা-মায়েরা খুশি ছেলে-মেয়েদের হৃদয়ে প্রশান্তির ঘ্রাণ পেয়ে। এত খুশির মাঝে বড়দের একটা সিদ্ধান্তে ঘুঙুরের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। আজ রাতে নববধূ ও বর নাকি এক সঙ্গে থাকবে। অর্থাৎ কল্প আজ রাতটা তার সঙ্গে তার ঘরেই কাটাবে। এটাই নাকি নিয়ম। বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে হয়। যতই আনুষ্ঠানিকতা পরে হোক কিন্তু লিগ্যাললি বিয়ে তো আজই হল। হিসেব মতে আজ তাদের বাসর রাত। ঘুঙুরের হাত-পা জমে আসছে। এমনটা না হলেও পারতো। কল্পকে কিভাবে সামলাবে সেটা ভেবে ভেবে বিপি বাড়িয়ে ফেলার জোগাড় হল তার৷ তন্মধ্যে ঘরে ঢুকল আবার বৃষ্টি ও কুহু। ওদের হাতে একটা দুধের গ্লাস। দুজনেই মুচকি মুচকি হাসছে। ঘুঙুর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে? মতলব কি?”
বৃষ্টি দুধের গ্লাসটা ঘুঙুরের হাতে দিয়ে বলল,
“মতলব এটা দু’জন দু’জনকে খাওয়াবি তাহলে মোহাব্বত বাড়বে–আমার কথা নয়, আন্টিরা পাঠিয়েছেন।”
ঘুঙুর লজ্জায় নত হল ফের। কুহু তাকে আরও লজ্জায় ফেলতে ফোঁড়ন কেটে বলল,
“আহা রে মোহাব্বত কি কিছু কম ছিল? এই দুধের আবার কি স্পেশাল পাওয়ার হল? সাধারণই তো লাগছে। এই ঘুঙুর আপু তুই কিছু জানিস নাকি?”
ঘুঙুর কুহুর কান টেনে ধরল। বলল,
“পাজি দুটো এখনই বের হ।”
বৃষ্টি কুহুকে ঘুঙুরের থেকে উদ্ধার করে বলল,
“চল চল এখন এখন আর আমাদের দাম নেই। বিয়ে হলে মানুষ এভাবেই পর হয়। কবুল বলতে না বলতেই বান্ধবী আমার বর ছাড়া চোখে আন্ধার দেখে। যাই বরং তার দৃষ্টির আলো ফিরিয়ে দেই৷”
ঘুঙুর দুটোকেই তাড়া করল। সঙ্গে সঙ্গে দুটোই গায়েব। ওরা দরজা দিয়ে বের হতেই মুহূর্তে অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে কল্পের আগমন। কালো পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠামদেহী, সুদর্শন যুবকটির চলন-বলনে ভীষণ তাড়া। অস্থির হয়ে আছে তার চিত্ত। খট করে দরজাটা লাগিয়ে খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সে তার নববধূর নিকট। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘুঙুর ভড়কে গিয়ে নিজ গতিতে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়াল। দেখা যায় কল্প এতটাই অস্থির ছিল যে ঘুঙুরের কোমর পেঁচিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের বক্ষ মাঝে বেঁধে ফেলল। কল্পের বুকে আটকে গিয়ে ঘুঙুর হাঁপিয়ে উঠল। হৃদপিণ্ডটা ধপধপ করে বেজে উঠছে যেন কোনো থেরেমিনের সুর। কল্পের বুকের ভেতরও সমান তাল। দু’জনের নিঃশ্বাস একে অন্যের সাথে লড়াই করছে। ঘুঙুর ফিসফিস করে বলল,
“কি করছেন? ছাড়ুন।”
কল্প তার মুখটা খুব কাছে নিয়ে এল। চোখদুটো তীব্র কোমলতায় ভরা।
“আজ থেকে তুই আমার আইনসিদ্ধ স্ত্রী। তোকে কাছে টানা এখন আমার অধিকার।”
ঘুঙুর চোখ নামিয়ে নিল। গাল লাল হয়ে উঠেছে। এত মানুষের ভিড়ে, এত আয়োজনের পরে এ এক অদ্ভুত সময়। তার ভেতরটা লজ্জা, ভয় আর অকারণ আনন্দে একসাথে কাঁপছে।
কল্প তার চিবুকে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
“ভয় পাচ্ছিস? আমি তোকে কষ্ট দিব কখনও? তাহলে কিসের ভয়? তোকে শুধু নিজের করে পেতে চাই… তুই-ই আমার প্রশান্তি।”
ঘুঙুর ধীরে মাথা নাড়ল। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। কল্প সেটা বুঝল। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কল্প সমস্ত ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে কাছে টেনে নিল ঘুঙুরকে। দু’হাতে ঘুঙুরের মুখটা আবদ্ধ করে নিল নিজের শক্ত আঁজলে। কপালে গভীর চুমু খেল।
সেই মুহূর্তে বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। মেঘের গর্জন, বৃষ্টির শব্দ আর ঘরের ভেতর নিঃশব্দ আলোকমালা—সব মিলিয়ে পরিবেশটা যাদুকরী হয়ে উঠল।
ঘুঙুর অন্যমনস্কভাবে কল্পের বুকে মাথা রেখে বলল,
“এভাবে তো আমি কল্পনাও করিনি… এত তাড়াতাড়ি সবকিছু হয়ে যাবে।”
কল্প মৃদু হেসে তার কানে ফিসফিস করে বলল,
“তাড়াহুড়ো করিনি তো, তোকে হারানোর ভয়ে এতদিন আমি পাগল ছিলাম। আজ থেকে তুই শুধু আমার। আর কোনো ভয় নেই।”
ঘুঙুরের চোখে পানি চিকচিক করছে। সে আর লুকাতে পারল না। আবেগে ভিজে যাওয়া চোখে কল্পকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করল,
“আপনি যদি এভাবেই থাকেন… আমি চিরকাল আপনাকেই চাইব।”
কল্প তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। দু’জনের নিঃশ্বাসের মিলন ঘটল। বাইরের ঝড়ো বৃষ্টি থেমে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো, যেন প্রকৃতিও তাদের মিলনের সাক্ষী হয়ে প্রশান্তি পাঠাল।
সেই রাতে কোনো আনুষ্ঠানিক শব্দ ছিল না, কোনো আড়ম্বরও নয়। শুধু দু’টি মানুষের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা—
জীবন যত কঠিনই হোক, আজ থেকে দু’জন একসাথে থাকবে।
–
একটি সুন্দর ভোর এলো ওদের জীবনে। ঘুঙুর গোসল সেরে নামাজ আদায় করে জানালার পাশে গিয়ে বসল। ভেজা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে রাখল। কল্প ঘুমিয়েই ছিল, তবে বেশিক্ষণ পারল না। জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ধেয়ে আসা আলোয় সে জেগে উঠল। আবিষ্কার করল নতুন এক সকাল। যে সকাল অন্য দিনের মতো নয়, কিছু ভিন্নতা আছে, আছে পূর্ণতা। বিছানা ছেড়ে আলগোছে নেমে সে তার নববধূর নিকট এগিয়ে গেল। ঘুঙুর এখনও টের পায়নি তার উপস্থিতি। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো কল্প। পেছনে থেকে ঘুঙুরের উন্মুক্ত পিঠে মুখ গুঁজে দিয়ে খুব নিকটে জড়িয়ে নিল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কি ভাবছিস?”
ঘুঙুর মৃদু হেসে বলল,
“ভাবছি… তোতাপাখি তো খাঁচায় থাকলে গান করে না। মুক্ত আকাশেই গান গায়। আমি যদি আপনার খাঁচায় বন্দি হই তবে কি গান হারিয়ে ফেলব না?”
কল্প ওকে আরেকটু শক্ত ভাবে জড়িয়ে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“তুই বন্দি হবি না। আমি তোকে উড়তে দেব। শুধু চাই, প্রতিটা উড়ানে আমি থাকি তোর পাশে।”
ঘুঙুরের আদলে ফুটে উঠল এক চিরস্থায়ী হাসি। সে তো জানে তার কল্প ভাই স্বৈরাচারী, অত্যাচারী নয়। সে তাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দেবে। তবুও একটু নিশ্চিত হওয়ার আরকি।
সেদিন থেকেই শুরু হলো তাদের নতুন জীবন। ভালবাসার, ঝগড়ার, অভিমান মেশানো এক রঙিন গল্প। কল্প পেল তার তোতাপাখি, আর ঘুঙুর পেল সেই ডানা, যেটা তাকে নিরাপদে আকাশে উড়তে দেবে।
শেষমেশ দু’জনের গল্পটা দাঁড়িয়ে গেল এক লাইনে—
“তোতাপাখি আমার, আমি আছি তোর আকাশ হয়ে।”
—- সমাপ্তি
®নামিহা নিশি