তোমাকে চাই পর্ব-০৫

0
99

#তোমাকে_চাই ।০৫।
#সাইরা_শেখ

পরপর তিনটে পরীক্ষা শেষে নাওফিল আবার এসেছে। তবে এবার প্রিয়তার কাছে বা সামনে নয় বরং ক্যান্টিনে তার বিচারসভা বসেছে। তিনি প্রধান বিচারক। সবাই ভীড় জমিয়েছে সেখানে।প্রিয়তা পা টিপে টিপে কৌতুহলী মন নিয়ে সেখানে গেল।

টেবিলের সামনে একজন নতজানু হয়ে বসে আছে। তার সামনের চেয়ারে বসে আছেন খলনায়করূপি নায়ক সাহেব নাওফিল। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, চেয়ারের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা তার লেদারের জ্যাকেটটি, শার্টের হাতা গোটানো। বা-হাত চিরুনির মত চুলে চালান করতেই তার প্রশস্ত কপাল নজর এলো। সেখানে ছোট একটা কাটা দাগ আছে। ঘর্মাক্ত হাতটা বেশ আকর্ষনীয় লাগছে, সঙ্গে ব্যায়ামপুষ্ট শরীর। প্রিয়তা মেনে নিল জনাব নাওফিল মীর্জা বেশ সুদর্শন পুরুষ।

প্রিয়তার চোখ চতুর্দিকে পড়তেই দেখলো কয়েকটা মেয়ে হা করে চেয়ে আছে। ক্যান্টিনে আসার সময় মেয়েদের মুখে নাওফিল নামটা শুনতে শুনতেই এসেছে সে, আজ সচক্ষে দেখবে লোকটা কিভাবে বিচার করে। রূপদর্শনেই তো অর্ধেক দর্শক তার ভক্ত হয়ে যায়, আদৌ সঠিক বিচার করে তো?

যে ছেলেটাকে ধরে আনা হয়েছে সে মেয়েদের ছবি নিয়ে অশালীন ভিডিও বানায়। পরে সেসব দিয়ে ব্লাকমেইল করে। তুহিনরা ভালোমত শায়েস্তা করেছে তবুও ফোনের পাসওয়ার্ড বলেনি। ভেতরের সকল ডেটা ডিলিট করতে হবে, অন্যকোথাও ডেটা থাকলে সেটাও মুছতে হবে তাই সবাই নাওফিলকে অনুরোধ করেছে আসার জন্য। প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে বলল,

– ক্রাইম করেছে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিলেই তো হয়। ওনাকে ডেকে দাম বাড়ানোর কি আছে?
পাশ থেকে এক মেয়ে বলল,
– পুলিশে দিলে লাভ হবে না। আগে দুবার জেলে গেছে, ফিরে এসে আবারও শুরু করেছে এসব।
– ওহ।

নাওফিল শান্তস্বরে বলল,
– তোর পছন্দের ফিল্ম, আমার হাতে এখনও সবগুলো এসে পৌঁছায়নি, এখানে তিন-চারটা আছে। তোর দুটো বোনের, ভাবির আর মায়ের। আগে তুই দেখ তারপর তোর ফোন দিয়ে যেভাবে বাকিদের ভিডিও পোস্ট করিস সেভাবে পোস্ট করা হবে। সিয়াম, হ্যাকার ডেকেছিস না?

সিয়াম তাল মেলাল,
– জ্বি ভাই, আসছে। রাস্তায় আছে।
– আচ্ছা, ওকে দেখা ওগুলো।কিন্তু খবরদার তুই নিজে দেখবি না। নয়তো তোর গার্লফ্রেন্ড আবার হসপিটালে যাবে আর দোষ হবে আমার।

সবাই হেসে উঠলো। অহনা নিজেও হাসছে। প্রিয়তার ব্যাপারটা ভালো লাগলো না। যে বা যারা এগুলো দেখে বা বানায় তাদের কাছে চেহারা আসলেই গুরুত্ব পায়? হয়তো তারও সম্মান যাওয়ার ভয় আছে কিন্তু সে জানে যে নাওফিলের মত মানুষ এমন কাজ করবে না। যতই ভয় দেখাক না কেন।

ছেলেটা পাসওয়ার্ড বলল, নাওফিল ভিডিও বন্ধ করতে বলে তুহিনকে সকল ডেটা ডিলিট করতে বলল। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– ইজি ট্রিকস। উচিত ছিল ছেলেটার চোখ উপড়ে ফেলা, আর হাত কেটে ফেলা। যাতে দ্বিতীয়বার এসব করার সুযোগ না পায়।
পাশের মেয়েটা অবাক হয়ে বলল,
– তুমি একটু আগে এসেছ না?
প্রিয়তা সায় দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ। কেন?
– নাওফিল ভাই এই সেইম কথা বলেছে। ভিডিওগুলো দেখিয়ে পোস্ট করে ওর চোখ উপড়ে ফেলবে আর হাত কে’টে ফেলবে।
প্রিয়তা আঁতকে উঠে বলল,
– কি সাংঘা’তি’ক কথাবার্তা। কেউ কিছু বলবে না এমন করলে?
– না, কেন বলবে? ও যা করেছে তার জন্য এটা তো খুবই কম। ওকে তো আরও শাস্তি দেওয়া উচিত। ওর জন্য দুটো মেয়ে সুইসাইড করেছে।
– তাহলে ঠিক আছে। আইনের আওতায় এনে এসব কাজ করলে ভালো হয়। বেআইনিভাবে করলে হিসেব দেওয়ার ব্যাপার আছে। এতগুলো চোখ, এতগুলো সাক্ষী। মুখ খুললেই নাওফিল সাহেব টাটা বাই বাই।
– তুমি কি নতুন?
– না তো, এবার থার্ড ইয়ারে। কেন বলোতো?
– তাহলে এটা জানো না, নাওফিল ভাইয়ের ইশারায় অনেক কিছু হয়। ওনার চুলও বাঁকা করতে পারবে না কেউ। ওনার এত পাওয়ার.. গতসাত বছর ধরে এই ভার্সিটিতে পলিটিক্স করছে। বাইরে অনেক নামডাকও আছে। আর দেখো উনি কি কিউট.. একদম বাচ্চাদের মত। কে বলবে উনি এত ডেঞ্জারাস?
প্রিয়তা সরুচোখে তাঁকিয়ে বিরবির করে বলল,
– বাচ্চাদের মত? যে কোনো সময় বাচ্চার বাপ হয়ে যাবে। আর কিউট? এই চেহারা কিউট? দেখে তো লাভা মনে হয়, অনর্গল আগুণ ঝরছে।

এরমধ্যেই সিয়াম নাওফিলের কানে প্রিয়তার উপস্থিতির খবর জানাল। শোনামাত্র নাওফিল প্রিয়তার দিকে তাঁকায়। সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে কয়েক তরুণির চাঁপা কন্ঠ,
– এদিকে তাঁকিয়েছে।

কে তাঁকিয়েছে? প্রিয়তা দেখার জন্য সামনে তাঁকাতেই দেখল নাওফিল চোখ রাঙিয়ে তাঁকিয়ে আছে। প্রিয়তা সে দৃষ্টির পরোয়া না করে পাশের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত। কথায় কথায় জানতে পারে তারা ব্যাচমেট, কিন্তু ডিফারেন্ট ডিসিপ্লিনের। আস্তে আস্তে দেখা গেল নাওফিলের রাগ কমে আসছে। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করে,পরবর্তী নির্দেশ দিয়ে জ্যাকেট নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়ে গেল সে। কয়েকমুহূর্ত বাদে প্রিয়তার ফোনে কল আসে। অপরিচিত নাম্বার।প্রিয়তা রিসিভ করে স্বভাবসুলভ ভাবেই সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে,

– কে বলছেন?

– তিনমিনিট সময় দিলাম, দ্রুত আমার কাছে আসো। ভার্সিটির পেছনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি।
– তিনমিনিট? আমি কি ট্রেন নাকি?অন্ততো পাঁচ-ছয় মিনিট দিন।
– দুই মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড।

প্রিয়তা ফোন না কেটেই দৌড় লাগাল।পাশের মেয়েগুলো জিজ্ঞেস করে সে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছে, প্রিয়তা বলার সুযোগ পেল না। শুধু বলল, “এক সিংহের গুহায়” যদি সত্য বলতে পারতো তাহলে মেয়েগুলো জানতো তাদের প্রিন্স চার্মিং একজন অপ্রেসর।রিতীমত মানুষকে ডেকে নিয়ে টর্চার করে, হোক সেটা মেন্টালি, টর্চার তো টর্চারই হয়। ওদিকে ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর শুনে হাসলো নাওফিল। যাক মুরগি থেকে এক ধমকেই সিংহে উঠে এসেছে তার পদ। এই পদগৌরব হারানো যাবে না।

প্রিয়তা এলো চারমিনিট সাতান্ন সেকেন্ড পরে। এসেই গাড়িতে হেলান দিয়ে হাঁপাচ্ছে সে। এদিকে তেমন কেউ নেই, দু-একজন পথচারি ছাড়া। নাওফিল কোল্ডড্রিংক এগিয়ে দিয়ে বলল,
– এক মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড লেট।
– নেক্সট টাইম সময়ের সাথে আসার ব্যবস্থাও করে দেবেন।
– মানে কোলে চড়তে চাচ্ছ?
– আশ্চর্য! এত ভালো ভালো মানুষ রেখে আপনার কোলে চড়তে চাইবো কেন?
– কারন এ্যাকুরেট টাইম বলা ও কাজটা শেষ করা কেবলমাত্র আমার পক্ষে সম্ভব।এখন গাড়ি-ঘোড়া তো সাথে নিয়ে ঘুরতে পারবে না, তাদের তো আর কুটনীতি দিয়ে বাঁধোনি, বেঁধেছ তো আমাকে। তাই যত জ্বালা সব আমার।
– বিয়েটা নাকচ করে দিলেই তো মিটে যায়।
– হ্যাঁ, পরে যাতে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নিজের তো বাড়ি নেই, বরের বাড়ি গিয়ে উঠবে। আমি কোথায় যাবো?
– আপনার-ও তো ফ্যান-ফলোয়ার কম না। যে কারোর বাড়ি ঠাই পেয়ে যাবেন।
– তুমি দেখছি আমাকে ক্যারেক্টারলেস হওয়ার জ্ঞান দিচ্ছ। আরে নামে হলেও তো হবুস্বামী হই। এই..টুকু সম্মান তো আমার প্রাপ্য।
– নিজে এমন করে বলছেন, একটু পরেই গিরগিটির মত রঙ বদলে বলবেন… তোমাকে আমার পছন্দ না, বউ হওয়ার চেষ্টা করো না ব্লা ব্লা ব্লা।

নাওফিল রাগে কিড়মিড় করে উঠল,
– তুমি ভালো কথার মেয়ে নও। তোমাকে বলেছিলাম শব্দপ্রয়োগে সচেতন হতে, পরীক্ষা শেষে সোজা হলে ফিরতে। ক্যান্টিনে কি করছিলে? কেন গিয়েছিলে?

প্রিয়তা চুপসে গেল। গিরগিটি তার আসল রূপ দেখিয়ে দিল। তাই আমতা আমতা করে বলল,
– দেখতে..
– কি দেখতে?
– দেখতে না, খেতে। খেতে গিয়েছিলাম।
নাওফিল এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে, নরমসুরে বলল,
– খেয়েছ?
– সুযোগ দিয়েছেন?
নাওফিল গাড়ির দরজা খুলে বলল,
– চলো। আমিও খাইনি।
প্রিয়তা ছ্যাত করে উঠল,
– আপনার সাথে কেন যাবো? আমার টাকার অভাব আছে? নিজে কিনে খেতে পারি না? আপনার টাকার খাবার আমার হজম হবে না। তাই আমি যাবো না। ইজ ইট ক্লিয়ার?
নাওফিল প্রিয়তাকে জোর করে টেনে গাড়ির ভেতরে বসিয়ে বলল,
– ওকে। আমি খাবো তুমি বসে বসে দেখবে। খেতে হবে না। কিন্তু এইমুহূর্তে তুমি আমার সঙ্গেই যাবে। নো মোর ওয়ার্ডস প্রিয়। চুপচাপ বসো।

গাড়ি চলছে আপনগতিতে। ভেতরে পিনপতন নিরবতা। প্রিয়তার এমন নিরব পরিবেশ ভালো লাগে না। নাওফিল স্পিড বাড়িয়ে দিল, ধীরে ধীরে তা বেড়েই চলেছে। এবার ভয় পেল প্রিয়তা। গাড়ির বেগের সাথে ভয়ের, চিন্তার বেগও বাড়ছে। চুপ থাকতে না পেরে সে বলেই বসল,
– মাথা খারাপ হয়ে গেছে? স্পিড কমান।
– তোমার জন্য রাগ হচ্ছে। আমার রাগ বাড়লে স্পিড কমিয়ে গাড়ি চালাতে পারি না। যদি রাগ কমাতে পারো তাহলে স্পিড কমবে। নয়তো আজ কিছু একটা ঘটে যাবে।

প্রিয়তা দ্রুত সিটবেল্ট চেপে ধরল,
– কিছু ঘটবে মানে? আমি এত দ্রুত, আর আপনার কারনে একদম-ই ম’রতে চাইনা।
স্পিড বাড়ছে। নাওফিলের চেহারাও আগের তুলনায় শক্ত হলো প্রিয়তার কথা শুনে। সেটা লক্ষ করে প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠল,
– কি করলে রাগ কমবে? দ্রুত বলুন।
– এমন কিছু বলো বা করো যা শুনলে, দেখলে রাগ বাড়বে না।
প্রিয়তা কাঁপতে কাঁপতে বলে,
– স্পিড একটু কমান। গান শোনাবো, ভয়ে তো কথাই বের হচ্ছে না গলা দিয়ে গান কি করে বের হবে? কমান স্পিড।
স্পিড একটু কমে আসতেই প্রিয়তা সোজা হয়ে বসে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। এরপর র’ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে নাওফিলের পানে। নাওফিল তৎক্ষনাৎ বলল,
– চোখ রাঙাচ্ছ? গুড। এতে রাগ তরতর করে বাড়বে মনে হচ্ছে। নাইস ট্রাই।
– না, না। সরি, সরি।

প্রিয়তা নিজেকে সামলে, শান্ত করে, গলা ছেড়ে গাইতে আরম্ভ করলো,
♪♪আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাসো,
যদি আর ফিরে নাহি আসো,
তবে, তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও,
আমি যত দুঃখ পাই গো॥
আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়।♪♪

চলবে..