তোমাকে চাই পর্ব-০৭

0
146

#তোমাকে_চাই ।০৭।
#সাইরা_শেখ

পরশু মেহেকের বিয়ে। প্রিয়তার বিয়ে আরও কিছুদিন পর আলাদাভাবে দিতে চেয়েছিলেন ইউনুস সাহেব কিন্তু সাফাওয়াত সাহেব যতদ্রুত সম্ভব পুত্রবধুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান। আনুষ্ঠানিক বিয়ে পরে হলেও চলবে। আপাততো কলমা দিয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হোক নাওফিল ও প্রিয়তার। সবাই এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।

আজ নাওফিলদের সাথে বিয়ের শপিং করতে যাবে ওরা। প্রিয়তা, মেহেক, নাওফিল, সাইদ ও মৃদুল নাওফিলের গাড়িতে বসেছে। পেছনের দুটো গাড়িতে বাকিরা। পুরো পথ গাড়িতে কবরস্থানের মত নিরবতা বিরাজ করেছে, মৃদুল ও সাইদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারনে। বাকিরা সেটা পুনরায় আরম্ভের সুযোগ দিতে চায়নি।

শাড়ির দোকানে বসে শাড়ি দেখছে প্রিয়তা। নাওফিলের এসব কেনাকাটার অধ্যায় পছন্দ না। মহিলা মানুষ, দশ দোকান ঘুরে দু-টো জিনিস পছন্দ করে সেটার দরকষাকষি করে দুই ঘন্টা ধরে। এটা চরম বিরক্তিকর, বলে ধারণা নাওফিলের।

গরম পড়তে শুরু করেছে। এত মানুষের ভীড়ে, গরমে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে প্রিয়তা ও মেহেকের। দুই-বোন কোনোরকম টুলের ওপর বসে দোয়া করছে দ্রুত এসব শপিং শেষ হওয়ার।

সাড়ে তিনঘন্টা পর,,,
সবার সবকিছু কেনা শেষ।এবার বর ও বধুর পোশাক কেনার পালা। নাওফিলের অনুপস্থিতিতে সেই কাজ আটকে ছিল। নাওফিল এসে ফেরার তাড়া দিলে তার মা নাজনিন বেগম বললেন,
– প্রিয়তার শাড়ি, ল্যাহেঙ্গা পছন্দ করে দে। তোরটা ওর পছন্দমত হবে।
– ওর পছন্দের জিনিস নাও। যে পড়বে সে ভালো বলতে পারবে তার জন্য কোনটা বেটার।
– বিয়ের দিন যে শাড়ি বা ল্যাহেঙ্গা পড়বে সেটা বাদে প্রিয়তা সব নিজের পছন্দানুযায়ী কিনবে।তোর দাদির হুকুম একে অপরের বিয়ের পোশাক তোরা নিজেরা বেঁছে দিবি।
নাওফিল প্রিয়তার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– কিছু পছন্দ হয়েছে?
– আপনার মনে হয় আমার চয়েজ ভালো?
– অবশ্যই, নাহলে আমাকে বেঁছে নিতে না। তুমি খাঁটি রত্ন চেনো। জলদি আমার জন্য পাঞ্জাবি পছন্দ করো।
– রঙ?
– হোয়াইট।
– ওকে।

নাওফিলের জন্য সাদা পাঞ্জাবির কালেকশন দেখানো হচ্ছে। নাওফিল দোকানের মালিককে ডেকে বিয়ের ম্যাচিং আউটফিট দেখাতে বলল, সবার আড়ালে এবং তা আলাদা আলাদা ভাবে। প্রিয়তা সেটা লক্ষ করে বলল,
– ম্যাচড কেন? আপনার বোনেরা এটা পছন্দ করবে না। আপনাকে ভুল বুঝবে, এই মিথ্যা সম্পর্কের জন্য নিজের মূল্যবান সম্পর্কগুলো নষ্ট করবেন না।

নাওফিল শুনল না। ফন্দিফিকির খাটিয়ে দোকানের সবথেকে সুন্দর পাঞ্জাবি-শাড়ি, শেরওয়ানি ও ল্যাহেঙ্গা কিনে ফেলল। সাবা আপু বিরোধ করেছিল প্রথমে, শুধু কলমার জন্য এত টাকা খরচে তার ঘোর আপত্তি। পরে আনুষ্ঠানিক বিয়ের সময় আবার খরচা হবে। কিন্তু নাওফিল সেসব কথার ধার ধারলো না।

সাফাওয়াত সাহেব নিজে নাওফিলকে সমর্থন করছেন, যেচে টাকা দিচ্ছেন। তাহলে সস্তা জিনিস কিনে সবার সামনে মান খুইয়ে কি লাভ? প্রিয়তা হতাশ হলো, নাওফিলের এমন নিজস্ব চিন্তা-চেতনা কেউ দেখছে না। ওরা ভাবছে প্রিয়তা নাওফিলের মাথা খাচ্ছে। প্রিয়তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ওই ডেভিলের মাথা সে ফ্রিতে পেলেও খাবে না। তাদের ভদ্র ছেলেকে প্রিয়তা নষ্ট করছে না। সে আগে থেকেই ঘাড়ত্যারা, রগকা’টা,জেদি ধাঁচের মানুষ। ভদ্রতা,সভ্যতা কেবল একটি মুখোশমাত্র, সে তো প্রিয়তাকে গুটি করে নিজের কার্যহাসিল করার তাগিদে ব্যস্ত, মহাবদ নাওফিল।

গাড়িতে ওঠার সময় প্রিয়তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে, নাওফিল ব্যাগগুলো গাড়িতে রেখে, মৃদু হেসে বলল,
– আমার কাছে আমার পরিবার যেমন মূল্যবান, ঠিক তেমন তুমিও মূল্যবান হতে চলেছ প্রিয়। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে তোমার কথা ভাবতে ভুলি কি করে? তোমার জন্য তো শুধু এতটুকুই করতে পারবো।তাই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। বাকি যুদ্ধ তোমাকে একাই লড়তে হবে। শুধু মনে রাখবে আমরা শান্তির জন্য মিলিত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা করবো, যতটুকু করবো তা দুই পরিবারের শান্তি বজায় রাখতে করবো।তুমি ঘর সামলাও আমি বাকিটা সামলে নিবো। একটুখানি সময় দাও সব ঠিক করে ফেলবো প্রিয়।

– তাহের চাচা কিছু একটা জানেন ফুপির ব্যাপারে।
নাওফিল হেসে বলল,
– অবশেষে মুখ খুললে। রাতে এই বিষয়টা নিয়ে কথা হবে।
– কারন আজ মনে হয়েছে আপনি অতটাও ভ’য়’ঙ্ক’র নন।

নাওফিল ডান ভ্রু তুলে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। প্রিয়তা হেসে বলল,
– আগে একটু ভয় লাগতো, এটা অসত্য নয়। হাতের যা গতি আপনার, মুখের লাগামের অবস্থা তো আরও গুরুতর। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রপার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।

নাওফিল সহজ, স্বাভাবিক স্বরে রসিকতা করে বলল,
– মিষ্টি বউয়ের সংস্পর্শে এলে আমার সব বদঅভ্যাস পরিবর্তিত হবে। তার..
নাওফিলকে বাকি কথা শেষ করতে না দিয়ে, প্রিয়তা কপোট রাগ দেখিয়ে বলল,
– ওয়ান সেকেন্ড, যেখান থেকে এসব ডাইলগ মুখস্থ করেছেন, ফিরে গিয়ে সেটা চেক করে দেখবেন।
– কেন?
– কেন, কোথায়, কিভাবে, কাকে এসব বলতে হয় সেটা জেনে বলা উচিত। মন চাইল বলতে আর বলে দিলেন? এসব ঠাট্টার বিষয় নয়, যে বললেই হয়ে যাবে।
নাওফিল সন্দিহান গলায় বলল,
– আসলেই?
প্রিয়তা বিরক্ত চেহারা নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। মানুষটা অহেতুক রসিকতা করছে। এমন ভাব করছে যেন সে প্রিয়তাকে নিয়ে কত চিন্তা করে, বিয়েটা-ও মন থেকে করছে, প্রিয়তাকে নিজের বউ ভাবছে। অথচ সব নাটক। ড্রামাবাজ একটা।
.
.
– আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

বাক্যটি নির্গত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র গ্রামে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। সকল শত্রুতা ভুলে একে অপরকে আলিঙ্গন করে মিত্রতার সূচনা করল গ্রামবাসী। প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে সে খুশির প্রতিবিম্ব দেখছে। ইউনুস সাহেবের শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না, গ্রামের এই অবস্থা তার মনেও খানিকটা তৃপ্তি এনে দিল।

মেজচাচ্চু দুই-তিনবার ঘুরে গেলেন। চাচাত ভাই প্রীতম ইমতিয়াজের সঙ্গে বসা। তার পায়ের ওপর ঝুলছে দীপ্ত। মেজচাচ্চুর দুই রত্ব, হুবহু তার কার্বনকপি। চোখ জুড়িয়ে যায় ওদের দিকে তাঁকালে। মেজচাচ্চুকে নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি আজ। মীর্জাসাহেব তার কথা রেখেছেন। নতুন সংঘা’তের সূত্রপাত ঘটতে দেননি।
মাহমুদ সাহেব তার সঙ্গে বসে ছেলে-মেয়ের খুশির মুহূর্ত উপভোগ করছেন। আজ রাতেই প্রিয়তাকে নিয়ে যাবেন তারা। বাড়ি থেকে একই দিনে দু-দুটো মেয়ে এক সাথে চলে যাবে। বিচ্ছেদের বেদনায় যেন সকলে পাথর হয়ে আছে। বিশেষ করে প্রিয়তাকে নিয়ে চিন্তিত সবাই। মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারবে তো ওই পরিবারে? কোনো অসুবিধা হবে না তো? এত দ্রুত নিয়ে যাওয়ার কি খুব দরকার ছিল?প্রিয়তার মা প্রেমা বেগম আঁচলে মুখ গুজে ছাদে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছেন। নাওফিল তার পাশে এসে দাঁড়াতেই উনি দ্রুত চোখ-মুখ মুছে বললেন,
– কিছু লাগবে বাবা?

– আমি থাকতে আপনার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন। আমি নাওফিল, আজ আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ের সুখের দায়িত্ব আমার। প্রিয়তার জন্য যেমন সংসারের স্বপ্ন দেখেছেন আপনারা, ও তেমনটাই পাবে। এখন গিয়ে ওর কাছে একটু বসুন। ও আপনাকে খুজছে।

– তুমি বাড়ির জামাই, কিন্তু আজকের পর তুমি আমার সন্তানসম নাওফিল। তাই জামাই হিসেবে নয় ছেলে ভেবে কথাটা বলছি, কিছু মনে করো না। দুই পরিবারে যথেষ্ট তিক্ততা আছে। আমি জানি আমার মেয়ে সবার মন জয় করতে পারবে। সকল উত্থান-পতনে সে শক্ত থাকতে পারবে। মা হয়ে একটাই অনুরোধ করছি, তুমি ওর হাত কখনও ছেড়ো না। ওই বাড়িতে ও শুধু তোমার জন্য, এই পারিবারিক দ্ব’ন্দ্ব ও গ্রামের জন্য যাচ্ছে। মুখে না বললেও ও সবসময় তোমাকে পাশে চাইবে। আমার বড়মেয়েটার রাগ অনেক, কিন্তু প্রকাশ করে না। নিজেকে কষ্ট দিয়ে রাগ কমায়, কেউ জোর করে না খাওয়ালে খায় না, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে নিজের শারীরিক অসুস্থতা ডেকে আনে। তখন ওর একটু খেয়াল রেখো। ও হয়তো নানা কথা বুঝে-না বুঝে বলে। সব কথা ধরে মেয়েটাকে ভুল বুঝো না। এবাড়ির প্রতি ওর ভালোবাসা বেশি, হয়তো তর্কে জড়িয়ে যাবে তখন ওকে একটু বুঝিয়ে, মানিয়ে চলতে সাহায্য করো। প্রতি মাসে না হোক তিন-চারমাস পরপর মেয়েটাকে সাথে নিয়ে এ বাড়িতে এসো। ওকে একনজর দেখার জন্য সকলে ছটফট করবে।

নাওফিল প্রেমার হাতে হাত রেখে বলল,
– চিন্তা করবেন না আম্মু। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আর তিন-চারমাস কেন?পাশের গ্রামে বাড়ি, আধঘন্টার পথ, ওর যখন মন চাইবে আসবে। তবে হ্যাঁ, আপনার মেয়ে একটু বেশি কথা বলে। সমস্যা নেই আমি অত্যন্ত ধৈর্যশীল। সবটা মানিয়ে নিতে পারবো। সহ্য করা ছাড়া আর উপায় কি?

প্রিয়তা মাত্রই ছাদে এসেছে। বাক্যটি কানে পৌঁছাতেই সে ছ্যাঁত করে উঠল। মায়ের কাছে আহ্লাদি স্বরে অভিযোগ করে বলল,
– আমি বেশি কথা বলি? না আম্মু, উনি আমাকে দিয়ে বেশি কথা বলান। আমি তো সবসময় চুপই থাকি। তুমি তো জানোই আমি কেমন।

চলবে…