তোমাকে চাই পর্ব-০৮

0
88

#তোমাকে_চাই ।০৮।
#সাইরা_শেখ

নাওফিল চেহারায় কপোট্ রাগ এনে বলল,
– দেখুন আম্মু, আপনার মেয়ে এখানেও চলে এসেছে। আমার নামে ভুলভাল কথা বলে আপনার মন বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেন না।

বলেই জিভ বের করে ভেঙাল নাওফিল। প্রিয়তা রেগে বলল,
– দেখেছ আম্মু? আমাকে ভেঙাল..

প্রেমা নাওফিলের দিকে তাঁকাতেই নাওফিল প্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলল,
– কখন ভেঙালাম?দেখছেন আম্মু,আমার মত নিরীহ বর পেয়ে কেমন অমানবিক অত্যা’চার করার পরিকল্পনা করছে। আমাকে কি বলেছে জানেন? শুধু ওই বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষা। তারপর আমাকে নাকেদড়ি দিয়ে ঘোরাবে। এমন মেয়ে আপনার মত মায়ের কি করে হতে পারে? এই মেয়ে দত্তক নেওয়া নয় তো? হতে পারে। আপনারা এত ভালো মানুষ। দু-একটা ড্রেনে পড়া বাচ্চা তুলে এনে যত্ন নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

প্রিয়তা তেড়ে গেল নাওফিলের দিকে,
– এই আপনি কি বললেন? আমি ড্রেনে পড়ে ছিলাম? তাহলে আপনি সেই ড্রেনের পাশের ড্রেনে ছিলেন। এজন্য আপনার স্বভাবও এমন।
প্রেমা খানিকটা উচুস্বরে বললেন,
– আহ, প্রিয়। নাওফিল তোমার স্বামী। তার সাথে তুমি এভাবে কথা বলতে পারোনা।

প্রিয়তা প্রায় কেঁদে উঠে বলল,
– উনি যে বলল..
প্রেমা হেসে বললেন,
– পাগল মেয়ে, নাওফিল তো মজা করছে।

কিছুটা থেমে প্রেমা পুনরায় গম্ভীর স্বরে বলতে আরম্ভ করলেন,
– কিন্তু আজ তোমার যে ব্যবহার দেখলাম তা আমার পছন্দ হয়নি প্রিয়। আজকের পর থেকে নাওফিলের কথার অবাধ্য হবে না। ও যা বলবে, তাই শুনে চলবে। ওটা তোমার বাবার বাড়ি নয়,শ্বশুড়বাড়ি। ওখানে তোমাকে মানিয়ে,গুছিয়ে,ভালোবেসে থাকতে হবে। আজ থেকে মীর্জা পরিবার তোমার পরিবার, নাওফিলের বাড়ি তোমার বাড়ি, নাওফিল তোমার প্রতি যতটা দায়বদ্ধ তুমিও ওর প্রতি ততটাই দায়বদ্ধ। কখনও যেন ও বাড়ি থেকে আমার মেয়ের নামে অভিযোগ না আসে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার। বুঝেছ?

প্রিয়তা মাথা নাড়ে। প্রেমার কান্নায় জড়িয়ে আসা কন্ঠ শুনে নাওফিল দ্রুত মা-মেয়ের কান্নার সূচনা থামাতে বলল,
– শুনেছ সব? আম্মুর উপদেশ যেন মাথায় থাকে।
প্রিয়তা মুখ ভেঙচি দিল। প্রেমা প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে নাওফিলের দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
– তোমরা থাকো, আমি নিচে গেলাম।
নাওফিল সায় দিল,
– আচ্ছা।
প্রিয়তা মায়ের সঙ্গে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
– আমিও যাবো।

অমনি নাওফিল ওর হাত টেনে ধরল,
– তুমিও গেলে আমি এখানে একা কি করবো বউ? মনে মনে না মানলেও শরিয়তমতে তিনকবুল বলে বিয়ে করা বউ আমার। এত সহজে যেতে দিচ্ছি না।
– আমি নিচে যাবো, ছাড়ুন আমাকে।
– সব আদর একা নিতে চাও?এতক্ষণ নিলে না? এবার ছোট-বোনকে সুযোগ দাও। সেদিন তাহের আঙ্কেলের ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ পাইনি। এখন সুযোগ, সময় দুটোই আছে।তাই টাইম ওয়েস্ট না করে সময়কে কাজে লাগাও। তাহের আঙ্কেল কি জানে?

প্রিয়তা থামল। শর্ত মোতাবেক নাওফিলের সঙ্গে তাকে সমঝোতা করতে হবে। প্রিয়তা নিজেকে গম্ভীরস্বভাবে রূপান্তর করে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
– বছর তিনেক আগে একটা ব্যাগ পুকুরে ফেলে নানা কথা বলছিলেন তিনি। তার মধ্যে সুফিয়া ফুপির নামও ছিল। সব প্রমাণ শেষ, এই টাইপের কিছু।
– আর কাউকে বলেছ এসব?
– না। পরেরদিনই তো আপনাদের সাথে আমাদের ঝগড়া লেগে গেল। তুষার ভাই আর রিয়াজ ভাইয়ের মাঠদখল নিয়ে দ্বন্দ্ব হলো না? সেবারের ঘটনা। ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন মনে পড়ল।
– তুমি এত মিথ্যা বলো কেন? এই কেসে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা না হলে সমাধান আসবে না। এটা কেন বুঝতে চাইছ না?
প্রিয়তা এবার নাওফিলের চোখে চোখ রেখে বলল,
– সেই ব্যাগটা আমি তুলেছিলাম। সেখানে কিছু ছিল না। মনে হয় তাহের চাচা আমাকে দেখানোর জন্য এমন করেছিল।
– তোমাকে কেন দেখাতে চাইবে? তুমি প্রকাশ্যে প্রমাণ জোগাড় করছিলে নাকি?
– না। মেজচাচ্চুর কাছে যখন গল্প শুনছিলাম তখন উনি আমাকে দেখেছিলেন। বাড়ির অনেক সমস্যা মেটাতে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। হয়তো তাই উনি আমাকে অত্যধিক বুদ্ধিমতি মনে করেন। সেজন্যই ভুল পথে চালিত করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন।
– তুমি নিশ্চিত হলে কি করে, তাহের আঙ্কেল এসবে জড়িত?
– তার প্রতিক্রিয়া দেখে। ব্যাগটা আমি ইচ্ছে করে তার ঘরের সামনে বাঁধিয়ে রেখেছিলাম তাকে দেখানোর জন্য। তিনি ব্যাগ এবং আমাকে একসাথে দেখে ভয় পেয়েছিলেন, পরবর্তী বেশ কিছুদিন আমাকে এড়িয়ে-ও চলেছেন।
– এজন্যই চাননি বিয়েটা হোক। গ্রামের মানুষকে উস্কে দিয়েছিল পঞ্চায়েতের দিন কিন্তু শুধু তাহের আঙ্কেল নয়। কাঁদের চাচা, মৌসুমি চাচি, রহিম মামা সহ অনেকে, অনেককিছু জানেন।
– যেমন?
– পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাদের মুখ যে বন্ধ করেছে সে আমাদের আপনজন হবে, নয়তো এত সাহস পাবে না। বাড়িতে আমি তেমন থাকিনা তাই বাড়ির ভেতরের প্রমাণ খোজার সুযোগ পাবো না। তুমি একা নিজেকে সামলে নিতে পারবে?
– পারবো।
– আমার বাড়ির কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে তার শাস্তি তাদের না দিয়ে তুমি আমাকে দিয়ো প্রিয়। তারা স্বজন হারিয়ে বিভ্রান্ত, ঠিক-ভুলের জ্ঞান নেই তাদের, দীর্ঘ সময়ের শত্রুতা তাদের বদলে যাওয়ায় সফল হতে দিচ্ছে না। যখন সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে ওরা অতটা খারাপ না যতটা দেখছ।
– আপনি কি নিজের পরিবার নিয়ে শঙ্কিত? আমার জন্য ভয় পাচ্ছেন? যে আমিও পাল্টা প্রতিশোধ নিতে পারি.. তাদের ক্ষতি করতে পারি?
– উহু, চিন্তা তোমাকে নিয়ে।সব নিজের মধ্যে রেখে একা কষ্ট না পেয়ে আমাকেও সেই অনুভূতিতে শামিল হতে দাও। এর থেকে বড় শাস্তি আমার জন্য আর কিছু হতে পারে না। স্বামী না ভাবলেও বন্ধু ভেবে আমাকে এই সুযোগটা দাও প্রিয়।
– দিতে পারি, একটি শর্তে।
– কি শর্ত?
প্রিয়তা দুষ্টু হেসে বলে,
– আমাকে নির্বোধ ভেবে যতটা জ্বালিয়েছেন তার জন্য মন থেকে ক্ষমা চান,অবশ্যই শুকনো সরিতে আমি মাফ করবো না। দামি কিছু পেলে মাফ করলেও করতে পারি।

নাওফিল ভাবার চেষ্টা করে,
– দামি কিছু?বাপের সম্পত্তি লিখে দেওয়া পসিবল না, আমার নামেই এখনও হয়নি। তারওপর আমি বেকার মানুষ, রাজনীতি করতে গিয়ে শুধু ব্যয়ই করেছি, আয় একআনাও হয়নি। গোটা আমি ছাড়া আমার আর কিছু নেই ম্যাডাম। এই আমিটাও বড্ড মূল্যবান, বেশ দামি। নিতে চান আমাকে? চাইলে নির্দ্বিধায় বলুন দিয়ে দিচ্ছি।

প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে তাঁকায়। নাওফিল গম্ভীর মুখে বলল,
– দুটো কিডনি, একটা হার্ট, দুটো চোখ, আর যা যা অর্গান আছে তা কি কম দামি মনে হচ্ছে? যদি চাও জান দিয়ে দেবো তোমার জন্য। এবার খুশি?
প্রিয়তা বুকের ওপর হাত গুজে বলল,
– ওকে দিন। জান দিলে আমি ক্ষমা করতে রাজি।

নাওফিলের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাঁপ। সে মিটিমিটি হেসে একনাগাড়ে বলল,
– বোকা মেয়ে, জান তো যখন তখন দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তা পেতে তো তোমার দশমাস সময় লাগবে। আগে ঝামেলা মিটুক, জান যতগুলো চাইবে ততগুলো দেবো। শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করে বসে আছো। আমাকে খারাপ মনে করছ, দেখেছ আমি কত চিন্তাশীল তোমাকে নিয়ে। এখন ভাবো কবে, কখন, কিভাবে পেতে চাও? আমি ততক্ষণে নিচে গিয়ে বাড়ির অবস্থা যাচাই করি।

নাওফিল চলে যাচ্ছে। ওর দ্রুত বলা কথাগুলোর অর্থ বুঝে রাগে জ্বলে উঠল প্রিয়তা। চেঁচিয়ে বলল,
– আপনি একটা অসভ্য নাওফিল।

প্রত্যুত্তরে নাওফিলের ঠোঁটে ফুটল প্রশান্তির হাসি। স্বামীদের যতটা অসভ্য হতে হয় বউদের সামনে ততটা প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি তাতেই প্রিয় রাগে জ্বলে যাচ্ছে। নাওফিলের প্রকৃত রূপ দেখলে মেয়েটা বাপের বাড়ি থেকে নড়বে বলে মনে হয়না। সমস্যা নেই বাপের বাড়ি থাকুক বা শ্বশুড়বাড়ি, আলাদা একটা ঘর হলেই সেটা যথেষ্ট নাওফিলের জন্য। বউয়ের রাগ ভাঙানোর টোটকা শাশুড়িমায়ের থেকে কিছুটা জেনেছে বাকিটা নিজে বানিয়ে নেবে। চিন্তা একটাই নাওফিলের লাজুক প্রিয় তা সহ্য করতে পারবে তো?
.
.
নাওফিলদের বাড়ি সুন্দর করে লাইটিং করা হয়েছে। নাওফিলের ভাই-বোনেরা আজ রাত জাগবে। সারারাত চলবে আড্ডা,নাচ-গান।নাওফিল এটা জেনে প্রিয়তাকে ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে চাইলে, সাবা এসে প্রিয়তাকে নিয়ে গেল। নাওফিলের বউ আজ তাদের দখলে থাকবে। আগামীকাল রাতের আগে সে তার বউকে পাবে না, এটা স্পষ্টভাষায় জানানো হয়েছে। তাই বাড়ির উঠানে বসে সে বাকিদের আনন্দ দেখায় মশগুল হলো। সবাই কত খুশি ওদের বিয়ের জন্য। এভাবেই যেন গ্রামটা হাসিখুশি থাকে সবসময়।

প্রিয়তাকে নাওফিলের ঘরে পৌঁছে দিল সাবা এবং দ্রুত পোশাক বদলে নিতে বলল। প্রিয়তা নম্রগলায় জিজ্ঞেস করল,
– আমার ল্যাগেজ কোথায় আপু? জামাকাপড় সব ওটার ভেতরে।
– আলমারিতে তোমার জন্য জামাকাপড় কিনে রাখা হয়েছে। আমি একটা বের করে বিছানার ওপর রাখছি। ফ্রেশ হয়ে পড়ে নাও।
– আচ্ছা।

সাবা চলে যায়। প্রিয়তা ওয়াশরুমে ঢোকামাত্র স্লিপ খেয়ে পড়ে গেল। মেঝেতে সাবান-পানি, নাকে সাবানের গন্ধ এসে লাগতেই প্রিয়তা বুঝলো সংসার তার কেমন হতে চলেছে। পায়ের ব্যাথায় চোখে পানি চলে এসেছে, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে প্রিয়তা,কিন্তু সক্ষম হলো না। পড়ে গিয়ে ল্যাহেঙ্গা ভিজিয়ে ফেলেছে। ট্যাপ ছাড়তেই সেটা ভেঙে হাতে চলে আসে। অকস্মাৎ দুর্ঘটনা এভাবেই ঘটে, সম্পূর্ণ ভিজে কোনোরকম ট্যাপ জোড়া দিল সে, এরপর আয়নার পাশে ঝোলানো একটা টিশার্ট দিয়ে বেঁধে ফেলল ট্যাপটি।

চোখের পানি,অস্থিরতায় বেহাল দশা প্রিয়তার। কাউকে যে ডাকবে সে উপায়ও নেই। ভেজা শরীরে কোনোরকম ঘরে এসে বিছানার ওপর সাধারণ থ্রিপিচ দেখে বিপদে পড়ে গেল। সাবা ইচ্ছে করে এমন করছে, যাতে প্রিয়তা সাফাওয়াত সাহেবের প্রকোপে পড়ে। কোনো উপায় না পেয়ে সে নাওফিলকে ফোন করল। প্রথমবার রিং বেজে কেটে গেল, পরপরই নাওফিল কলব্যাক করে। প্রিয়তা কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলল,

– আমার ল্যাগেজটা একটু নিয়ে আসবেন?
– পাঠিয়ে দিচ্ছি।
প্রিয়তা আঁতকে উঠে বলল,
– না, নাহ, আপনি নিজে নিয়ে আসুন।
– আচ্ছা।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নাওফিল এসে পড়ে। দরজায় কড়া নেড়ে প্রিয়তার নাম ধরে ডাকতেই প্রিয়তা দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিল। নাওফিল গম্ভীর স্বরে বলল,

– এসেছি যখন, তখন ড্রেস বেঁছে দিয়ে সেটা পড়িয়ে, দেখে তারপর যাবো। দরজা খোলো, ভেতরে ঢুকতে দাও।
– শাড়ি পড়বো,আপনি যেটা পছন্দ করেছিলেন ওটাই। একবারে দেখবেন, এখন দেখতে হবে না।

নাওফিল প্রিয়তার হাতে কালশিটে দাগ দেখতে পেল। বিকেলে এটা ছিল না। নাওফিলের স্পষ্ট মনে আছে এই হাত কত যত্ন করে এনেছিল। মেহেদীর রঙ ছাড়া এমন নীলচে দাগ গাড়িতে থাকাকালে দেখেনি সে।তাই চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,
– হাতে কি হয়েছে? প্রিয় দরজা খোলো।
– পরে, আমি ভেজা কাপড়ে আছি।

নাওফিল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
– তোমার স্বামী আমি, কোনো পরপুরুষ নই। ভেজা কাপড় কেন কাপড়ছাড়া দেখলেও সমস্যা হবেনা। তুমি সরে দাড়াও, আমাকে ভেতরে আসতে দাও।

প্রিয়তা কিছু বলার সুযোগ পেল না। দরজা নিজের দিকে আসতেই সে পড়ে গেল। নাওফিল ভেতরে ঢুকে প্রিয়তাকে এমতাবস্তায় দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। মেয়েটা সবেই বাড়িতে পা রেখেছে এরই মধ্যে এ কি দশা হলো? নাওফিলের আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল। তার ভুলেই মেয়েটাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে, ভাবতেই সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে।

চলবে…