তোমাকে চাই পর্ব-০৯

0
92

#তোমাকে_চাই ।০৯।
#সাইরা_শেখ

প্রিয়তার বাম পায়ের গোড়ালি ফুলে নীল হয়ে আছে। বাম হাতের তালু কেটে গেছে, ডান হাতের কনুইয়ের নিচে কালশিটে দাগ,কেঁদে চোখমুখও ফুলিয়ে ফেলেছে। নাওফিল অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
– কে রেখে গেছে?

প্রিয়তা নাক টেনে জবাব দিল,
– তেমন কিছু হয়নি। ভুলে স্লিপ খেয়েছি, আর ট্যাপটা মেবি আগে থেকেই ভাঙা ছিল। আমি খেয়াল না করে চালাতে গিয়ে..
– এতকথা শুনতে চাইনি আমি, এঘরে পৌঁছে দিয়েছে কে? সাবা আপু?

নাওফিল উত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াল। প্রিয়তা নাওফিলের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
– অশান্তি কমাতে এসেছি, নতুন করে সৃষ্টি করতে নয়। আপনার যদি আমার জন্য কিছু করার অভিপ্রায় থাকে তাহলে ওয়াশরুম ব্যবহারের উপোযোগী করে দিন। আমাকে দ্রুত পোশাক পাল্টে নিচে যেতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে।

নাওফিল মেঝেতে প্রিয়তার সামনেই বসে পড়ল। তার শক্ত হাতের ছোঁয়া প্রিয়তার গাল স্পর্শ করে। প্রিয়তার চোখের নিচে এখনও পানি জমে আছে, শুকায়নি অশ্রু কণা। তবুও হাসছে মেয়েটা। প্রিয়তা হাসি আটকে বলল,

– কাদের সঙ্গে লড়াই করবেন নাওফিল? আমাদের পরিবার, আমাদের আপনজনের সাথে? তারা তাদের একমাত্র মেয়ে, একমাত্র বোনকে হারিয়েছিল, এই সামান্য কষ্ট তার সামনে কিছু না। ব্যাথা দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ওরা যদি জানে, আপনি ওদের থেকে আমাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাহলে যে ক্ষ’ত ওদের মনে তৈরি হবে তা নিরাময় করবেন কি করে? যেভাবে চলছে চলতে দিন। এতটুকু সহ্যক্ষমতা আমার আছে। তাছাড়া আমি জানি আপনি আমার পাশে আছেন, এটুকুই যথেষ্ট।

নাওফিল কোমলস্বরে বলল,
– মাফ করে দাও প্রিয়। আমি সঙ্গে এলে এমন হত না। ভুল আমারই। আমার জন্য আজ তোমার..
নাওফিলকে থামিয়ে প্রিয়তা হেসে বলল,
– ধন্যবাদ নাওফিল, আমার পাশে থাকার জন্য। এবার এটা নিয়ে আর কথা বাড়াবেন না। প্লিজ..

নাওফিল ওয়াশরুম পরিষ্কার করে দিল। প্রিয়তার হাত টনটন করছে ব্যাথায়। ল্যাহেঙ্গার পেছনের দিকে সকল ফিতা ও বোতাম। পড়ার সময় নিজে লাগাতে পারলেও এখন খুলতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এ বাড়ির কেউ সাহায্য করবে সেটা প্রিয়তা আশা করেনা। একমাত্র নাওফিলই শেষ ভরসা। তাকে বলা কি উচিত হবে? শত হলেও পুরুষ মানুষ। সরাসরি সাহায্য চাইতে লজ্জা করবে প্রিয়তার। থাক নিজেই খুলে নিতে পারবে। চেষ্টা করলে সব হবে। নাওফিল ল্যাগেজ খুলে শাড়ি বের করে। সব একসাথে সেট করে রাখা ছিল। নাওফিলের পাঞ্জাবিও এর ভেতরেই। সেদিন নিয়ে আসেনি এটা। শুধু শেরওয়ানী নিয়ে এসেছিল। বিছানার ওপর শাড়ি রেখে নাওফিল শক্ত গলায় প্রশ্ন করে,
– আর কোনো হেল্প লাগবে? লাগলে বলো।
– না, বাকিটা করে নিতে পারবো।

নাওফিল কিছুটা ইতস্ততোবোধ করে। দ্বিধাজড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
– ল্যাহেঙ্গা একা খুলতে পারবে? নাকি খুলে দিবো?

প্রিয়তার কান ঝাঁঝাঁ করে উঠলো। লজ্জায় র’ক্তিম হয়ে উঠল মুখশ্রী। বুঝতে পারছে নাওফিল নিরুপায় হয়ে নিজে এগিয়ে আসছে সাহায্য করতে। এখানেই বিব্রত বোধ করছে সে। নাওফিল যতটুকু করেছে সেটা যথেষ্ট। প্রতিটি কাজে সে নাওফিলের সাহায্য নিতে চাচ্ছে না। এমন অনেক সময় আসবে যখন প্রিয়তাকে একাই সব সামলাতে হবে। নাওফিলকে সে পাশে রাখতে পারবে না। এখন থেকে সেই অভ্যাস গড়ে না তুললে পরনির্ভরতা তৈরি হবে। নাওফিলের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে যেটা নানা সমস্যার সৃষ্টি করবে। তাই লাজুকভাবকে কাটিয়ে উঠে প্রিয়তা জানাল,
– না, পারবো আমি।

নাওফিল এগিয়ে এসে বলল,
– পারবে না। আমাকে হেল্প করতে দাও। ভয় নেই, আমি নিজের লিমিটস জানি। লিমিটক্রস করবো না।

প্রিয়তা আর কিছু বলতে পারলো না। নাওফিলের হেল্প নেওয়া আবশ্যক। প্রিয়তার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নাওফিল জড়তা নিয়ে বলল,
– আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি তুমি ঘরে চেঞ্জ করো।

প্রিয়তা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শাড়ি জড়িয়ে কুঁচি ঠিক করতে করতে সে খেয়াল করে, দশমিনিট হতে চলল নাওফিল শাওয়ার নিচ্ছে। শাড়ির কুঁচিগুলো সেফটিপিন দিয়ে সেট করে গুজে নিল প্রিয়তা। এরপর আঁচল ঠিক করলো। চুলগুলো আচড়ে ছেড়ে দিল। মাঝ বরাবর সিথি করে, প্রথমে দুপাশে বেণী করবে। এরপর খোপা করে নাওফিলের আনা বেলী ফুলের মালা গুজবে। মেক-আপের প্রয়োজন আছে, চোখমুখ ফুলে আছে, সেটা ঠিক করতে হালকা মেক-আপ করলো। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিল। চোখে কাজল। হাতে সেই খানদানি বালা, কোমরে স্বর্ণের বিছা এটা প্রিয়তার দাদির তরফ থেকে পেয়েছে। প্রিয়তা ছোটবেলায় বিছা নিয়ে খেলতে, সাজতে পছন্দ করত বলে দাদি এটা বানিয়ে রেখেছিলেন। গলায় একটা স্বর্ণের নেকলেস, দুল, সিথি বরাবর স্বর্ণের টিকলি। প্রিয়তা প্রথমদিন খেয়াল করেনি ওর সাদা শাড়িতে গোল্ডেন স্টোনের কাজ করা আছে যা স্বর্ণের গহনার সাথে নিদারুণভাবে ম্যাচড হয়েছে। সাজ কমপ্লিট করতে আধঘন্টা লেগে গেল। নাওফিল এখনও শাওয়ার নিচ্ছে। প্রিয়তা ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
– নাওফিল? শুনছেন..
– হুমম..
– আর কতক্ষণ লাগবে?
– হয়ে গেছে, আসছি।

প্রিয়তা বিছানার ওপর বসে পুরো বিষয়টা অনুধাবন করে চিন্তিত হলো। নাওফিলের শাওয়ার নেওয়ার কারণ ধরতে পেরে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে বারবার।

ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল প্রিয়তা। ফুলহাতা ব্লাউজে হাতের সকল দাগ লুকিয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু হাটার ব্যাপারে কি করা যায়? ঠিকভাবে দাঁড়াতেই পারছে না হাটবে কি করে সে? পা ফোলা কমতেই একদিন লেগে যাবে, ব্যাথা কমতে কম করে হলেও দুদিন তো লাগবেই। এই ভাবে নতুন বউকে খোড়াতে দেখলে নানা কথা উঠবে। নাওফিল বের হলো। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সে একবার প্রিয়তার দিকে তাঁকায়, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
– রেডি তুমি?
– হুম। সাজ দেখে বলুন ঠিক আছে কিনা।

নাওফিল আয়নায় প্রিয়তার প্রতিবিম্ব দেখে বলল,
– লাল লিপস্টিক তুলে হালকা রঙ ইউজ করো। গোলাপি টোলাপি দাও।
– মানাবে না। লালের সঙ্গে ম্যাচিং করে মেকআপ করেছি।
– মানানোর দরকার নেই, আমার প্রবলেম হচ্ছে লাল রঙের লিপস্টিকে। তাই যেটা বলেছি সেটা করো।

প্রিয়তা কিছু বলল না। স্বাভাবিক ভাবে হাটার প্রচেষ্টা করে, চারবার ব্যালেন্স হারালো। পড়তে পড়তেও পড়ল না। নিজেকে সামলে নিয়ে সে ল্যাগেজ থেকে গোলাপী রঙের লিপস্টিক বের করল। নাওফিল চুল আচড়ে আয়নায় তাঁকিয়ে বলল,
– ব্যাথা তো কম পাওনি। এত গায়ের জোর পাও কোথ থেকে? এ বাড়ির মেয়েরা হলে সহজে বিছানা ছাড়তো না।
– আমার বাড়ির মেয়েরাও বেশ নাজুক।
– তুমি নাজুক নও?
– দেখে মনে হচ্ছে?

প্রিয়তা লিপস্টিক বদলে নিলে নাওফিল ইশারায় প্রশ্ন করে “কমপ্লিট?” প্রিয়তা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতেই নাওফিল ওকে পাঁজকোলা করে তুলে ফেলল। প্রিয়তা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায়। নিজের ভয়কে দমন করে জোরে শ্বাস নিয়ে অসহায় গলায় বলল,
– আমি পারবো হেটে যেতে।

নাওফিল প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে বলল,
– আমার ভালো লাগবে না তুমি হেটে গেলে। আমার বোন ও বউ দুটি নারীই আমার কাছে অনেক দামি প্রিয়। একজনের অনুরোধে অন্যজনের দোষ এড়িয়ে চলছি, কিন্তু তোমাদের এই ননদ-ভাবির সম্পর্কের জন্য তোমাকে কষ্টে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যেটুকু করতে পারছি করতে দাও। বাঁধা দিয়ো না।
– যতটুকু, যেটুকু করে অনেকটা করে ফেলছেন নাওফিল।
নাওফিল হেসে বলল,
– আমার বউয়ের জন্য আমি অনেকটা করবো না তো, অন্যকেউ এসে করবে? চুপচাপ থাকো। বেশি কথা বললে তোমার কথা মেনে-ই যাস্ট ছেড়ে দেবো। দেবো নাকি?
প্রিয়তাকে ঝাঁকুনি দিতেই সে নাওফিলের পাঞ্জাবি ঘামচে ধরল। চোখমুখ খিচে বলল,
– না।

নাওফিল প্রিয়তার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
– তোমাকে আমি কখনও ছাড়বো না প্রিয়। এইযে বউ করে আনলাম, সারাজীবন এভাবেই থাকতে হবে। আমার সব অত্যা’চার সহ্য করতে হবে। সে যতই আমি তোমাকে অপছন্দ করি না কেন।
প্রিয়তা রাগতস্বরে বলল,
– অপছন্দ? অপছন্দ করেন বলেই চল্লিশ মিনিটের শাওয়ার লাগলো। পছন্দ করলে কি করতেন?
– চল্লিশ মিনিট পরপর শাওয়ার নিতাম।কি আর করবো? অপছন্দের মানুষের সৌন্দর্য এমন হলে আকর্ষিত হওয়া দোষের নয়।
– বেশরম পুরুষ।
– বউয়ের সামনে শরমের…
– খবরদার! স্লাং ইউজ করবেন না, নাওফিল।
– ভালো কথাও তো তোমার সহ্য হয়না। আমাকে এমন ভাবে পরিশ্রম ছাড়া সহজে পেয়ে গেছো তো তাই আমার কদর বুঝতে পারছ না। যদি বাকিদের মত কাটখড় পোড়ানো লাগত তখন বুঝতে নাওফিল মীর্জাকে পাওয়া আর চাঁদ পাওয়া একই ব্যাপার।

প্রিয়তা ঠোঁট টিপে হাসে। বাড়ির ভেতরে তেমন মানুষ নেই। কিন্তু চৌকাঠ পেরোতেই মানুষের দৃষ্টি নিক্ষেপিত হলো ওদের ওপর।কারোর মন উল্লাসে আমোদিত তো কারোর মন ঈর্ষায় দিখণ্ডিত হয়ে গেল। নাওফিল সেসব উপেক্ষা করে প্রিয়তাকে সোফায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো।

সাবা এগিয়ে এসে বলল,
– বাড়িটাকে সার্কাস বানাতে চাস?
– যাতে সার্কাস তৈরি না হয় সে চেষ্টা করছি আপু।
– আব্বুর সাপোর্ট পেয়ে, মেয়েটাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছিস। ভুলে যাস না ও তালুকদার বাড়ির মেয়ে। ওরা আমাদের ফুপির খু’নি।
– প্রিয়তা কোন বাড়ির মেয়ে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। বর্তমানে সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী। সুতরাং তার ক্ষতি করার চেষ্টা যে করবে তাকে মনে রাখতে হবে সে আমারও ক্ষতি করার চেষ্টা করছে আর নাওফিল শত্রুতা মন দিয়ে নেভায়, ফাক রাখে না। যারা জানে না তাদের জানিয়ে দিস আপু।
– তুই কি আমাকে থ্রেট করছিস?
নাওফিলের তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন,
– তুই আমার বউয়ের ক্ষতি চাস?

সাবা উত্তর না দিয়ে রেগে চলে গেল। প্রিয়তাও ক্রোধ নিয়ে বলল,
– কি দরকার ছিল এভাবে বলার? বললাম তো আমার জন্য আর কিছু করতে হবে না। শুনছেন না কেন?
নাওফিল কঠিন গলায় বলল,
– কারণ নাওফিল কারোর কথা শুনে চলতে অভ্যস্ত নয়। যেটা অন্যায় সেটাকে অন্যায় বলেই জানতে হবে। সবাই জানে নাওফিল অন্যায়কে সাপোর্ট করে না। নিজের বাবাকেই সমর্থন করিনা সেখানে বোন। তারা সঠিক হলে আমি আমার সকল বেয়াদবির দায়িত্ব নিতে পারবো, কিন্তু ভুল হলে আমার বেয়াদবিকে আমি সংশোধন করার চেষ্টা মনে করবো।
– এত শক্ত হলে, হয়না।
– নরম তো ছিলাম, বিশেষ কোনো লাভ হলো কি?

প্রিয়তার কাছে এর উত্তর নেই। একদিকে সাবার জন্য যেমন খারাপ লাগছে অন্যদিকে গর্ববোধ হচ্ছে নাওফিলের মত একজন স্বামী পেয়ে। স্বামী নির্বাচনে প্রিয়তা ভুল করেনি এটা সে হলফ করে বলতে পারবে।

চলবে…