তোমাকে চাই পর্ব-১১

0
82

#তোমাকে_চাই ।১১।
#সাইরা_শেখ

রহিম মামার জ্ঞান ফিরতেই পাগলের মত চেঁচাতে শুরু করলেন। প্রিয়তা দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। নাওফিলকে সে বাড়ি চেক করতে পাঠিয়েছে,এখানে থাকলে এই লোকের গলা চেপে ধরতেও দ্বিধাবোধ করতো না নাওফিল। প্রিয়তা ঠান্ডা গলায় বলল,
– অযথা চেঁচাচ্ছেন কেন? অন্যায় দেখে তো চুপ ছিলেন তখন যদি চেঁচাতেন তবে এই গলা কাজে দিত।
– চুপ থাক।
– আমি ভদ্রভাবে কথা বলছি আপনি তুই-তোকারি করছেন? এজন্যই নাওফিল বলে ভালো কথার দাম নেই। এই যে পাশে তাহের চাচাকে দেখছেন? ওনাকে দেখেও ভয় লাগছে না তাইনা?
– মা** নিজেরে কি মনে করিস?তোদের বংশকে ভালো ভাবিস? মীর্জা সাহেবের কানে যাক একবার, তোরা আমাকে বেঁধে রেখেছিস। তখন দেখিস উনি কি করে। তোর..***
অকথ্য ভাষায় অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন রহিম মামা। কি বিশ্রি সে-সব শব্দ।

প্রিয়তা তড়িৎ গতিতে তার মুখে ঘুসি দিয়ে বসে। নাক ফেটে গলগল করে ঝরতে লাগল র’ক্তিম তরল পদার্থ। রহিম আরও উত্তেজিত হয়ে চেঁচাতে লাগলেন। প্রিয়তা চারপাশে খুজে একটা লাঠি পেল। সেটা এনেই সপাৎ সপাৎ বারি কষলো রহিমের হাতে, পায়ে। প্রিয়তা রাগ সংবরণ করতে পারছে না।সে ক্রোধিতস্বরে বলতে থাকল,
– ভালো মানুষ সেজে পরের ক্ষতি করার সময় এসব ব্যাথার কথা মনে আসেনি। যখন অন্যরা কষ্ট পেয়েছে তখন সেটা মজা নিয়ে দেখেছেন। আজ ভালোমতো মজা নিন। আর আপনি আমার বংশ তুলে কথা বলছেন, সেই বংশের মানুষদের পায়ের নখের যোগ্য আপনি?

নাওফিল এসে প্রিয়তাকে উত্তেজিত অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেল। হাতে লাঠি, সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন রহিম মামা। উত্তেজনায় কাঁপছে প্রিয়তা। নাওফিল ছুটে এসে প্রিয়তাকে জাপটে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। মেয়েটা হয়তো আজ প্রথমবার এতটা এগ্রেসিভ হয়েছে তাই নিজেকে সামলাতে পারছে না। নাওফিল প্রিয়তায় মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল,
– শান্ত হও প্রিয়। কিচ্ছু হয়নি। ঘরে চলো, রেস্ট নেবে।
– উনি কি বেঁচে আছে? আমি কখনও কাউকে মা’রিনি নাওফিল.. দেখুন না ওনার শ্বাস চলছে কিনা।আমি কি খু’ন করে ফেললাম?
– কিচ্ছু হয়নি জান। সেন্সলেস হয়েছে। চলো আমার সাথে। সিয়াম এদেরকে দেখে রাখ। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বি না এখান থেকে। আমি তোর ভাবিকে ঘরে রেখে আসছি।
– জ্বি ভাই।

প্রিয়তার শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। হাটতে পারছে না। নাওফিল প্রিয়তাকে কোলে নিয়ে ঘরে এসে, ওকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিল। এখনও মেয়েটার হাত-পা কাঁপছে। নাওফিল হেসে বলে,
– এই নাকি আমার সাহসী বউ? দেখি হাত দেখাও।
প্রিয়তা হাত দেখাল না, নাওফিল জোর করে হাত টেনে, দেখে বলল,
– স্টিচ লাগবে। বসো, আমি আনছি।

নাওফিল ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে প্রিয়তার হাতের পুরোনো ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করে। প্রিয়তা কম্পিত গলায় বলল,
– ওদের জন্য কত মানুষ ম’রেছে তার কোনো হিসেব নেই। আর ওদের দেখুন,এখনও ক্ষমতার বড়াই করতে চায়। আমার র’ক্তপাত পছন্দ না। কলহ পছন্দ না সেই আমি কলহে জড়ালাম কেবল একটি খু’নের কারন জানতে। এদের কাছে উত্তর আছে তবুও বলছে না। আমি বাধ্য হয়ে,
নাওফিল প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– শান্ত হও প্রিয়। ও কি বলেছে তোমাকে? এত রেগে গেলে কেন?
– বলেছে আমার বংশ খারাপ, গালি দিচ্ছিল, খু’ন করে নাকি ঠিক করেছে, আমার চাচ্চুকেও মে’রে ফেলবে। এর প্লানও নাকি হয়ে গেছে, আর..

নাওফিলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে প্রিয়তাকে ধীরগলায় বলল,
– এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলো। সাংসারিক চিন্তাভাবনা করো। এসবের দায়িত্ব আমাকে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ির সকলের মন জয় করার চেষ্টা করো। সবাই যেন এই অশান্তির মীমাংসা হওয়ার আগে-ই বলতে পারে তুমি তালুকদার বাড়ির মেয়ে, মীর্জার বাড়ির বউ। ওরা যেন তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে এমন কাজে মন দাও, এসব মা’রামা’রি, কা’টাকা’টি তোমার জন্য না। তুমি বউমানুষ শিখবে কিভাবে স্বামীর সেবা করতে হয় তা না স্বামীর সাথে পাল্লা দিয়ে মাঠে নেমেছ। আজ থেকে এসব কাজ বন্ধ, আগ বাড়িয়ে এর মধ্যে ঢুকতে যাবে না। ঠিক আছে?
– হুম।

নাওফিল এগিয়ে এসে প্রিয়তার ললাটে অধর ছুঁইয়ে বলল,
– ঘুমাও। আমি ওদিকটা সামলেই ফিরছি। জেগে থাকবে না। বুঝেছ?
– দ্রুত আসবেন।

নাওফিল হেসে চলে গেল। প্রিয়তাও বালিশে মাথা গুজে শুয়ে পড়ে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কতটা গভীর হয়েছে বুঝতে পারলো প্রিয়তা। পবিত্র সম্পর্ক তাই হয়তো জটিলটা কম। তার উচিত হবে দুই আম্মুর কথা মেনে চলা, নাওফিলের কথা মেনে চলা, নাওফিলের ওপর ভরসা রেখে গোটা একটা জীবন সুখে কাটানো।নাওফিলকে হারিয়ে কোনো ভুল না করা। সুখ হয়তো এভাবেই আসে।
.
.
সকালে নিজের পাশে ঘুমন্ত নাওফিলকে দেখে লজ্জায় কুকড়ে গেল প্রিয়তা। মাঝে একহাতের সমান দূরত্ব, তারপরেও যেন লজ্জা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে। নাকের ডগা লাল হয়ে আসে, কান গরম হচ্ছে। এমনটা এই প্রথম হচ্ছে, রাতে কপালে চুঁমু খাওয়ার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বোধগম্য হওয়ার পরেই প্রিয়তার এই লাজুক দশা শুরু হয়। তখন ঘোরের মধ্যে নাওফিলের কাজটি মাথায় ঢোকেনি। যখন মাথা ঠান্ডা হয়েছিল, তারপর থেকে ঘুম না আসা অবধি নাওফিল পুরো মস্তিষ্কে বিচরণ করে।

প্রিয়তা ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখল সাতটা বাজে। এত দ্রুত ঘুম ভাঙার কথা না, তারপরেও ঘুমটা ভেঙে ভালো হয়েছে। গোসল করে, রান্নাঘরে আসে প্রিয়তা।সবার জন্য আজ সকালের নাশতা বানাবে সে। কে কি খেতে পছন্দ করে? প্রিয়তা এতশত ভাবতে না পেরে পরোটা বানালো, রুটি করল কয়েকটা,খিচুড়ি আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভুনা করলো।দেড়ঘন্টার মধ্যে হয়ে গেছে সবকাজ। এরপর চায়ের পানি বসায়। একে একে সবাই উঠে বসার ঘরে আসছে। নাজনিন আজ রান্নাঘরে ঢুকে প্রিয়তাকে নাশতার ট্রে সাজাতে দেখে অনেক দোয়া করলেন, চাচিরাও বেশ প্রশংসা করলেন। কিন্তু বৃষ্টি, সাবা, সফি, সুহা সবকিছু একটু একটু টেস্ট করে রেখে দিয়েছে। তাদের ভালো লাগেনি। ডায়নিং টেবিলে পরিবেশন করা হয় প্রিয়তার রান্না। সাফাওয়াত সাহেব খেয়ে কিছু বললেন না। বাকিরাও সেটা অনুসরণ করল কিন্তু ছোটচাচা এগিয়ে এসে টাকা দিয়ে নজর কাটিয়ে মৃদুলকে বললেন টাকাটা দান করে দিতে। এরপর প্রিয়তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

– শুনলাম সুহা তোমার হাতে গরম চা ফেলেছে।আমি ওকে শা’সন করবো। তুমি কি হাতে কিছু লাগিয়েছ? না লাগালে সুহার মা’য়ের কাছে যাও। মলম লাগিয়ে দেবে।

– চাচা ওটা অ্যাক্সিডেন্টলি পড়ে গেছে। সুহা ইচ্ছে করে করেনি। আপনি ওকে বকবেন না, ভুল আমার ছিল। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। তাছাড়া একটুখানি লেগেছে, দেখুন। তেমন কিছু হয়নি।

প্রিয়তা হাতটা এগিয়ে দিল। চাচা দেখার আগেই আবার হাত টেনে নিয়ে বলল,
– দেখেছেন?
– তুমি তোমার দাদির মত হয়েছ।
সাফাওয়াত সাহেব ফিরে এসে বললেন,
– প্রিয়তা একটু আমার সাথে এসো। তোমার দাদিজান তোমাকে ডাকছেন।
– জ্বি বাবা, আসছি।

সাফাওয়াত সাহেব কয়েকমুহূর্তের জন্য থমকালেন। পরে চলে গেলেন। দাদির ঘরে পৌঁছাতেই দাদি কাছে ডাকলেন প্রিয়তাকে। এরপর তিনিও টাকা দিয়ে নজর কাটিয়ে বললেন,
-এটা বকশিশ হলেও রেওয়াজ অনুযায়ী তোমার কল্যাণের জন্য দান করা হবে। তোমার শ্বশুর দিয়েছে। নিজে দিতে পারছে না, বুঝতেই পারছ ওর জন্য এসব সহজ না। আমার জন্যও সহজ না কিন্তু তোমার কোনো দোষ নেই। যখন ওসব ঘটেছিল তখন তোমার জন্মও হয়নি তাই তোমার ওপর রাগ করে থাকতে চাইনা আমি।
– তাহলে বাকিদের মত আমাকেও তুই বলে ডাকবে দাদিজান? আমার দাদিজানও তুই বলে ডাকে। ভালো লাগে শুনতে।
– মিতা? ও কখনও তুমি বলে ডেকেছে কাউকে? ওর তুই-তোকারি স্বভাব ছোটবেলা থেকে। তোমার দাদার সাথে প্রেম যখন, তখনও তুই-তোকারি করতো বিয়ের পর ঠিক হয়েছে।
– তাই নাকি? কিন্তু সে যে বলে দাদাকে সে প্রচণ্ড সম্মান করত। আমাকে মিথ্যা বলেছে?
– ও তো মিথ্যুকই। ও যে আরও কত মিথ্যা বলেছে তা তুমি জানো না।
– তুই করে বলো, নয়তো পরপর লাগছে।
– আচ্ছা,নিচে গিয়ে টাকা তুষারের হাতে দিবি। বলবি আমি দান করতে বলেছি। আমার কথা বললে তোকে অসম্মান করবে না।

প্রিয়তা মাথা দুলিয়ে টাকা নিয়ে চলে আসে। উপরের দুই জেনারেশন যতটা ক্ষোভ মনে পুষেছে, তাদের পরের জেনারেশন তার থেকেও বেশি ঘৃণা করতে শিখেছে। দাদিজান, চেয়ারম্যান সাহেব, চাচা, চাচি, মা সবাই প্রিয়তাকে মানতে পারছে কিন্তু ননদ আর দেবররা? প্রিয়তা তুষারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তুষার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। প্রিয়তা কপোট্ রাগ দেখিয়ে বলল,
– কোথায় যাচ্ছ তুষার ভাই?
– তা দিয়ে তোমার কাজ?
– দাদিজান টাকাগুলো দান করতে বলেছে।
– তো করো, আমাকে বলছ কেন?
– তোমাকে দান করতে বলেছে। নিয়ে যাও।
তুষার টাকা নিল। প্রিয়তা পুনরায় বলল,
– সুহা কি খেতে পছন্দ করে?
– আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
– তোমার তো ওর ওপর নজর পড়েছে। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। আমি জানি ওর খবর তোমার থেকে ভালো কেউ জানবে না।
তুষার কটমট করে উঠল,
– আজেবাজে কথা বলবে না।
– ভালোবাসো না বলছ? আমার তো তা মনে হয়না।
– ভুল মনে হয়।
– ওকে। নাওফিলকে বলে রাখবো ব্যাপারটা। পরে যদি জানা যায় কিছুমিছু ছিল তখন বুঝবে মজা। নিজের ওই তাঁড়ছেড়া ভাইকে তো চেনো..
তুষার দ্রুত যেতে যেতে বলল,
– ওর ডাবচিংড়ি, বিরিয়ানি আর বিফকারি পছন্দ।

প্রিয়তা মুচকি হাসে। এবার নওফিলের কফি নিয়ে ঘরে যেতে হবে। নাওফিল কফিতে দু-চামচ চিনি নেয়। আম্মু জানিয়েছে সেটা, তাই তার কথানুযায়ী কফি বানিয়ে ঘরে চলে এলো সে। নাওফিল সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে বসেছে। বেলা বাজে দশটা। দরজা ঠেলে প্রিয়তা ঢুকল। বিছানার পাশে, টেবিলের ওপর কফিমগ রেখে সে বিছানার চাদর ভাজ করতে করতে বলল,

– আজ আমি রান্না করেছি, চাচা আর বাবা খুশি হয়ে বকশিশ দিয়েছে, সেটা দান করা হয়েছে। সবাই প্রশংসা করেছে আমার রান্নার। আপনার জন্য বেড়ে আনি?

চলবে…