তোমাকে চাই পর্ব-১৪

0
160

#তোমাকে_চাই ।১৪।
#সাইরা_শেখ

মাস খানেক পর….বাড়ির সবার সাথে মানিয়ে নিয়েছে প্রিয়তা। সুহারাও আজকাল ওকে জব্দ করার চেষ্টা করছে না।সাফাওয়াত সাহেব সামনা-সামনি কিছু না বললেও প্রিয়তা বুঝতে পারছে তিনি প্রিয়তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন।

দুপুরে নাওফিল বাড়িতে ফিরেই চেঁচামিচি শুরু করে দিল। প্রিয়তা সিড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে বাবা-ছেলের তর্ক শুনছে। নাওফিলের ব্যবহারে অত্যধিক উগ্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। বাবা অবশ্য তেমন কিছু বলছেন না,বোঝা যাচ্ছে তিনিও অনুতপ্ত তার ভুলের জন্য।
নাওফিলের উচিত নয় তাকে এতটা কষ্ট দিয়ে কথা বলা। বাড়ির সকলে ভী’তস’ন্ত্র’স্ত অবস্থায় যে যার মত কোণা খুজে আড়াল হয়েছে।প্রিয়তা নিজেও ভয় পাচ্ছে, নাওফিলের এই রা’গা’ন্বিত রূপ প্রিয়তার বেশ অপছন্দ। এজন্যই প্রথমদিকে নাওফিলকেও প্রিয়তার অপছন্দ ছিল। রাগ উঠলে নাওফিলের মাথা কাজ করে না। বেপরোয়া স্বভাবের হয়ে যায়। আজও তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে ডায়নিং টেবিলের জগসহ কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। বাবারও রাগ উঠে গেল, সেও টেবিলের ওপর থাকা প্লেটগুলো ছুড়ে ফেললেন। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে গেল। দুজনের স্বভাবও খানিকটা এক। অনেক ভেবে প্রিয়তা নিচে নেমে একপাশে দাঁড়ায়, তৎক্ষণাৎ নাওফিল ওর দিকে তাঁকিয়ে ধমকে বলল,
– ঘরে যাও।

প্রিয়তা শুনল না। নাওফিল এবার চেঁচিয়ে বলল,
– ঘরে যেতে বলেছি না? কথা কানে যাচ্ছে না? এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, এখান থেকে।

প্রিয়তা শিউরে উঠল, চোখে পানি চলে এসেছে। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে সে খানিকটা উচ্চস্বরে বলে উঠল,
– যাবো না। আপনাদের চেঁচামিচিতে, ভাঙচুরে সারা বাড়ি কাঁপছে। আশেপাশে তাঁকান, দেখুন সবার কি অবস্থা, এসব কোন ধরনের ব্যবহার নাওফিল? বাবা যদি কিছু ভুল করেও থাকে, তাহলে ঠান্ডা মাথায় কথা বলুন। পরিবারের মধ্যে যদি এমন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে বাইরে কিভাবে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবেন? সবাই যাদের দিকে তাঁকিয়ে যাদেরকে ভরসা করে বাঁচছে তাদের যদি এই দশা হয় তাহলে ওদের কি হবে? ঘরের কলহ কমাতে না পারলে গ্রামের কলহ কিভাবে কমাবেন?আমি আছি বলে সমস্যা হচ্ছে? আমি চলে যাবো? তবে সমস্যা কমবে? যদি আমি গেলে সব সমস্যা কমে যায় তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। একটু সময় দিন, সব গুছিয়ে নিচ্ছি এখনই..

সাফাওয়াত সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন,
– বাড়ির বউ কোথাও যাবে না। যেতে হলে ও যাবে।

নাওফিলও সমানতালে চেঁচাল,
– এখন খুব দরদ দেখাচ্ছ। ওকে তো এনেছিলে ফুপির মত মা’রবে বলে।পরিকল্পনাও তো করেছিলে। করোনি? এখন মা’রো আমিও দেখতে চাই আমার বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কে দেখায়। এই মেয়েটা এসে ধরে তোমার বাড়ির মেয়েদের উগ্র আচরণ দেখেছে, নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে।আজ পর্যন্ত আমি কিছু বলেছি? সুহা, বৃষ্টি, সফি, মিরাজ বা সাবা আপুকে আমি একটা কথাও বলিনি।কি ভেবেছ আমি ভেড়া? ভয় পেয়ে চলি? না। শুধু তোমাদের সম্মান করি, ওদের ভালোবাসি, প্রিয়তা অনুরোধ করেছিল বলে, চুপ করে থাকি। কেন ভুলে যায় সবাই, তোমরা যেমন আমার। এই মেয়েটাও তো আমার। আমাকে ভরসা করে এখানে এসেছে। সব সহ্য করে চুপচাপ আমার সঙ্গে থাকছে। একবারও অভিযোগ করেনি, আমার যাতে কষ্ট না হয় তাই সবসময় হাসিমুখ দেখিয়েছে। ওকে চোখের সামনে একটু একটু করে অপমান ও অ’ত্যা’চারে দেখেও আমি চুপ ছিলাম এটা ভেবে যে তোমরা তোমাদের অন্যায় বুঝবে, ভুলগুলো শুধরে ওকে কাছে টেনে নেবে। ওর প্রাপ্ত ভালোবাসা ওকে ফিরিয়ে দেবে।

প্রিয়তা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ঝগড়ার মূল কারণ তাহলে সে নিজে।কিন্তু তাকে নিয়ে ঝগড়া হোক এটা সে চায়নি, চায়নি বলেই নাওফিলকে কিছু বলত না। আজ এমনটা হতে দিলে, অশান্তি বাড়বে বৈ কমকে না। তাই সে দ্রুত নাওফিলের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলল,

– ঘরে চলুন। এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপনার এখন মাথা ঠিক নেই, যা মুখে আসছে তাই বলছেন। প্লিজ ঘরে চলুন।

নাওফিল হাত ঝারা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। নাওফিলের সে শক্তির সাথে না পেরে প্রিয়তা চেয়ারের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেল। নাজনিন এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে ধরে বললেন,
– নাও, তোমার ছেলে বউয়ের গায়ে হাত তোলাও শিখে গেছে। এটাই চেয়েছিলে না? মেয়েটাকে সাজিয়ে এনে শেষ করতে।

সাফাওয়াত এগিয়ে এসে নাওফিলের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। নাওফিল আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
– আমার বউ, আমি মা’রবো কা’টবো যা ইচ্ছে করবো। তোমাদের কোনো রাইট নেই আমাকে কিছু বলার আব্বু।
– তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি আমি?
– না। যে শিক্ষা দিয়েছ তাতে বিয়ের রাতেই ওকে খু’ন করা উচিত ছিল। দেরি হয়ে গেছে, অনেক দেরি হয়নি। আজ ওকে শেষ করে সবার মনের ইচ্ছে পূরণ করবো আমি।

সুহা ও সফি ছুটে এসে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– ভাবি ভালো ভাইয়া। ওকে মে’রো না। আমাদের ভুল, আমাদের শা’স্তি দাও। তবুও ভাবিকে কিছু বলো না।
নাওফিল কাঠখোট্টা গলায় জবাব দিল,
– সরে দাঁড়া, ও ভালো হলেও ওর ভাগ্য খারাপ যে ও তালুকদার বাড়িতে জন্মেছে। এবাড়ির চিরশত্রুর মেয়ে প্রিয়।

নাজনিন চড়া গলায় সাফাওয়াতকে বললেন,
– তোমার ছেলেকে বারণ করো, আমার মেয়ের গায়ে হাত দিলে আমি কিন্তু ওকে ছেড়ে দেবো না।

প্রিয়তা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। নাওফিলকে দেখে মনে হচ্ছে না সে শুধু হুমকি দিচ্ছে। তুষার, মৃদুল এবং তুহিন এসে নাওফিলকে বলল,
– ভাই ঠান্ডা হও। দেখো যা হয়েছে, হয়েছে। এখন আর উত্তেজিত হয়োনা।

ছোটচাচা,মেজোচাচা এসে নাওফিলের হাত ধরে বললেন,
– বাইরে চল। ঘুরে আসি।
নাওফিল কারোর তোয়াক্কা করল না,
– প্রিয় অন্যের হাতে ম’রলে আমার সহ্য হবে না চাচ্চু। তার চেয়ে বরং আমার হাতে ম’রুক। তাহলে রেগুলার ওকে মা’রার প্লান করার প্রয়োজন পড়বে না।

সাফাওয়াত শক্ত গলায় চেঁচালেন এবার,
– কে মা’রতে চাচ্ছে ওকে?হ্যাঁ, মানছি আমি শোধ নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিয়ের পর কিছু বলেছি? কিছু করেছি? সবসময় চেয়েছি সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে। এই মেয়েটার চেহারা যতবার দেখেছি অনুতপ্ত হয়েছি, অনুতাপের আগুনে রাত-দিন জ্বলছি। আর কি করবো? কি করতে বলছিস? আমি আমার একমাত্র বোন হারিয়েও সবটা মেনে নিয়েছি শুধুমাত্র তোর মুখের দিকে তাঁকিয়ে।
– তাহলে গতকাল রাতে যারা প্রিয়তাকে মা’রতে এসেছিল তারা কারা? তারা তোমার নাম কেন বলেছে? তুমি যদি কিছু না বলে থাকো তাহলে ওদের সাহস হবে নাওফিলের বউকে মা’রতে মীর্জা বাড়িতে আসার? বলো কার এত দম আছে?

সাফাওয়াত অসহায় গলায় বললেন,
– আমি সত্যিই কিছু জানি না।

নাওফিল ফোন করে সিয়ামকে আসতে বলল। সিয়াম দুজন লোককে নিয়ে আসে। নাওফিল তাদের প্রশ্ন করে, জবাবে তারা সাফাওয়াতকে দেখিয়ে বলল,
– মীর্জাসাহেব বলেছেন আপনার বউকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে।
তুষার ক্ষেপে লোকটার চোয়াল চেপে ধরে,
– কুত্তা*** এখানে এসে আমার পরিবারে ঝড় তুলতে চাচ্ছিস?
সিয়াম বলল,
– ভাই যে নাম্বার থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেটার লোকেশন বের করেছে পুলিশ।
– কোথায়?
– গ্রামেই। এ্যাকুরেট কোথায় বলতে পারেনি।

নাওফিল বলল, ‘এবার কি বলবে আব্বু?’
এরপর প্রিয়তার দিকে তাঁকিয়ে বলল,
– গুছিয়ে নাও। তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি রেখে আসবো। নাওফিলের বউয়ের তকমাও দ্রুত ঘুচিয়ে দেবো। কয়েকদিন সময় দাও, তালাকনামা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
ছোটচাচা চেঁচালেন,
– এসব কি কথা নাওফিল? সুহা, প্রিয়তাকে ঘরে নিয়ে যা। ভাবির কাছে থাকবি এখন।
– হুম।
নাওফিল বলল,
– কি করবো চাচা?আমি দিনরাত এত চিন্তা নিয়ে পারছি না। বাইরের মানুষকে ঠেকানোর সামর্থ্য থাকলেও ঘরের মানুষকে কিভাবে আটকাবো? প্রিয়তাকে আমি পছন্দ করে বিয়ে করেছি, সংসার করছি। ওর কিছু হলে গোটা গ্রামে আগুণ জ্বা’লিয়ে দিতে পারি কিন্তু এই বাড়িতে থাকা মানুষগুলো? তাদের কিভাবে ছাড় দেবো? তাদের প্রতি কিভাবে নিষ্ঠুর হবো? তার থেকে যাদের মেয়ে তাদের কাছে ফিরে যাক। ওখানে ও সুরক্ষিত থাকবে।
– পাগল হলি? কে কি বলল, তা শুনে বউকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দিবি?
– প্রশ্ন যখন পরিবার ও বউয়ের মধ্যে একজনকে বেঁছে নেওয়ার তখন বউকে ছেড়ে দিচ্ছি। তোমাদের তো খুশি হবার কথা।
সাফাওয়াত তার মেজোভাইকে বললেন,
– ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বল নওশাদ। আমি ওর মুখ দেখতে চাইনা।
নাওফিল তেজ নিয়ে বলল, ‘বাড়িটা আমারও।’

নওশাদ চাচা নাওফিলকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন। বাকি ভাইয়েরা পিঁছু নিল।এদিকে নাজনিনও প্রিয়তাকে নিয়ে সোজা নিজের ঘরে গেলেন। ছেলের মেজাজ ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটাকে তিনি নিজের কাছেই রাখবেন। সুহারাও থেকে গেল , প্রিয়তাকে সঙ্গ দিতে।
.
.
দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরল নাওফিল। প্রিয়তা তখন নাজনিনের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। সাফাওয়াত সাহেব ইজি চেয়ারে বসে ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বউ-বউমার গল্প শুনছেন। এমন সময় নাওফিল এসে রূঢ়কণ্ঠে বলল,
– ঘরে এসো।
নাজনিন বললেন,
– আজ রাতে আমার কাছে থাকুক।
নাওফিলের কঠিন উত্তর,
– আমার বউ কোথায় থাকবে সেটা আমি ঠিক করবো। প্রিয়তা, ঘরে এসো।
প্রিয়তা ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে। সাফাওয়াত সাহেব বললেন,
– প্রিয়তার যখন ইচ্ছে হবে ও তখন যাবে। কেউ যেন জোর করে ওকে নিয়ে না যায় নাজনিন।
নাওফিল সেসব গুরুত্ব না দিয়ে প্রিয়তার দিকে তাঁকিয়ে বলল,
– এখন না আসলে, ও ঘরের দরজা তোমার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ভাবার সময় নেই, এক্ষুনি উত্তর চাই আমার। আসবে? নাকি আসবে না?
প্রিয়তা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নাজনিন ধমকে উঠে বললেন,
– নিয়ে যাচ্ছিস ভালো কথা। কোনোরকম উচু গলাও যেন না শুনি।

নাওফিল চলে গেল। নাজনিন কোমলস্বরে বললেন,
– যাও, কিছু বলবে না। রাগ পড়ে গেছে। তাই নিতে এসেছে।
প্রিয়তা মাথা দুলিয়ে যেতে যেতে শুনল,
– এই মেয়েটাকে মা’রতে চেয়েছিলে?ছি! মেয়েটা বৃষ্টির বয়সী। ওর দিকে তাঁকিয়ে নিজের মেয়ের কথা একবার ভাবলে না? কি একগুঁয়ে জেদ ধরে বসে আছো? এতদিন কিছু বলিনি কারণ তুমি বলেছ এটা তোমার বোনের বিষয়। কিন্তু আমি আমার বউমার বেলায় চুপ থাকবো না। আমার ছেলের জীবন আমি এসব প্রতিশো’ধের আগুণে জ্ব’লতে দেব না। কথাটা মনে রেখো।

চলবে…