তোমাকে চাই পর্ব-১৭

0
95

#তোমাকে_চাই ।১৭।
#সাইরা_শেখ

স্টেজে বসে আছে প্রিয়তা। আজ তার গায়ে হলুদ। মেহমানে ভরপুর তালুকদার-দের বাড়ি।
প্রিয়তাকে গোলাপি ও হলুদ রঙ মিশ্রণের একটি শাড়ি পড়ানো হয়েছে। সুহা হলুদ নিয়ে এসে মীর্জা বাড়ির সবাইকে ভিডিওকলে প্রিয়তার সাজ দেখাচ্ছে। নাওফিল প্রিয়তার উপহার সুহাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।
সুহা ভাইয়ের দেওয়া ছোট্ট একটি গহনার বক্স প্রিয়তাকে দেওয়ামাত্র, প্রিয়তা সরাসরি উপহার নিতে অসম্মতি জানাল,
– তোমার ভাইকে বলো নিজে এসে না দিলে তার দেওয়া উপহার গ্রহণ করা হবে না।
– কিন্তু ভাবি ভাইয়া কি করে আসবে?গায়ে হলুদের দিন বর, বউয়ের বাড়ি চলে আসলে সবাই হাসবে না?
– তাহলে ফেরত নিয়ে যাও, আমি নেব না।
সুহা নাওফিলকে বলল,
– শুনলে তো?তুমি বরং কোনো একসময় গোপনে এসে দিয়ে যেও।
– নিজের বউয়ের কাছে যাবো, গোপনে যেতে হবে কেন? আসছি আমি।

প্রিয়তা পায়ের ওপর পা তুলে সুহাকে সাথে নিয়ে বসে আছে। বক্সে থাকা বস্তুটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই নাওফিলকে আসতেই হবে।

বাড়িতে ঢোকামাত্র একদল শ্যালক-শ্যালিকাদের সামনে পড়ল নাওফিল। তাদের আবদার তেমন বড় নয়। তাদের বোনের সাথে দেখা করতে হলে লাখ টাকার টোকেন নিতে হবে। খুবই সামান্য ব্যাপার। সিয়ামকে ইশারা করতেই সিয়াম টাকা এগিয়ে দিল। নাওফিল তৃপ্তির হাসি হেসে এগোলো। সে প্রস্তুত হয়েই এসেছে, এবার আর কেউ ওকে আটকাটে পারবে না।

নাওফিল প্রিয়তার পাশে বসতেই প্রিয়তা বলল,
– আগে শুধু আমি জানতাম আপনি বেশরম আজ গোটা গ্রামের মানুষ জানলো।
– তুমি তো জানাতেই চেয়েছ, সবাইকে দেখাতে চেয়েছ তোমার বর কতটা বেশরম।তাই শুধুমাত্র তোমার চাওয়া পূরণ করলাম।

প্রিয়তা মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল, সুহার থেকে বক্স নিয়ে নাওফিল তার ভেতর থাকা ব্রেসলেটটা পড়িয়ে দিল প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা সেটা উচু করে “নাওফিল” নামটি দেখে। এরপর চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,
– সাইদ ভাইরা বলছিল কাপল ড্যান্স হবে। ভুলেও উঠে যাবেন না। আমি কিন্তু আপনার সাথে নাচবো না। কত মানুষ বাড়িতে। সবার সামনে নাচা সম্ভব না।
নাওফিল দুষ্টু হেসে বলল,
– আমার পরিশ্রমের প্রশংসা যখন করলে না, তখন এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো বলে মনে হয়?

মেহেক এসে নাওফিলকে টেনে নিয়ে যায়। তুবা এলো প্রিয়তাকে নিতে। প্রিয়তা চোখ রাঙালো। নাওফিল তার পরোয়া করলো না। একহাতে প্রিয়তাকে টেনে নিল নিজের কাছে। সুহারা চেঁচিয়ে উঠল। ভিডিও বানালো মা-চাচিদের দেখাবে বলে।তুষার, মিরাজ গান বদলে নতুন গান চালায়। বিবাহিত ভাইবোনেরা রেডি হয়ে দাঁড়াল। সবার মাঝখানে নাওফিল-প্রিয়তা। প্রিয়তা ফিসফিসিয়ে বলল,
– মানা করলাম না? এলেন কেন?
– একমাত্র শ্যালিকা ডাকলো, না এলে কষ্ট পেত না?

নাওফিল টান দিয়ে প্রিয়তাকে ঘুরিয়ে নাচের স্টেপগুলো অনুসরণ করছে। সাউন্ডবক্সে গান চলছে।
নাচের ফাঁকে প্রিয়তা বলল, ‘কিছু জানতে চাই।’
– বলো, কি জানতে চাও?
– সত্য বলবেন! আপনার জীবনে আগে কোনো নারী কখনও আসেনি? এতবছরে কাউকেই কি পছন্দ হয়নি? আমি অতীত নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না শুধু কৌতুহলের কারণে জানতে চাই। কখনও কাউকে মন থেকে চেয়েছেন? ভালোবেসেছেন? আমাদের বিয়ের আগে।
– তোমার কি মনে হয়? অন্যকাউকে পছন্দ করলে তুমি আমার বউ হতে পারতে? আমি তেমন মানুষ? যে একজনকে ভালোবাসবে আর আরেকজনকে বিয়ে করে সংসার করবে? সব বোঝো, এটা বোঝো না?
প্রিয়তা নিষ্প্রভস্বরে বলল,
– আমি আপনার মুখ থেকে স্পষ্টভাষায় কিছু শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম।

নাওফিল প্রিয়তার মলিন চেহারা অবলোকন করে হেসে বলল,
– যা জানতে চেয়েছ তা বহু আগেই জানিয়েছি প্রিয়। মনে করে দেখো, আমাদের প্রথম আলাপ, ফোনকল, কি বলেছিলাম আমি?
নাওফিলের হাসি ও অস্পষ্ট উত্তরে প্রিয়তা প্রচণ্ড রেগে গেল। তীব্র ক্রোধ নিয়ে বলল,
– জানি না।
– জানো না? আচ্ছা জানতে হবে না আমি নতুন করে আবার জানাবো। তবে এই পরিবেশে নয়, একান্তভাবে বলবো সব।
– আর বলতে হবে না। শুনতে চাই না আমি।
– শুনবে না তো সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করলে কেন? এখন শুনতেই হবে।
– অসহ্য। আপনাকে যাস্ট সহ্য করা যাচ্ছে না। আপনি এমন কেন?
– তোমার সংস্পর্শে এসে এমন হয়ে গেছি। সবাই জানে আমি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলাম।
প্রিয়তা সবার অগোচরে নাওফিলের হাতে চিমটি কাটল। নাওফিল ফিসফিসিয়ে বলল,
– কাল রাতে শোধ তুলবো। আজ কিছু বলবো না। তোমার কি অবস্থা করি দেখো।

প্রিয়তার চেহারা র’ক্তিম হয়ে উঠল। লাজুকতা নেমে এলো সমগ্র মুখশ্রীতে। লজ্জাবতী লতার ন্যায় লুটিয়ে পড়তে লাগল সে। নাওফিল বলল,
– এখনও কিছু করিনি তাতেই নেতিয়ে পড়ছ, কিছু করলে কি করবে?
– আজেবাজে কথা না বলে, চুপ থাকুন।

নাওফিল ভ্রুঁ উচু করতেই, প্রিয়তা নাওফিলকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। সুহা-রা এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে নিয়ে পুনরায় স্টেজে উঠে যায়। নাওফিল হেসে বউকে ইশারায় বলল, সে আজ একা যাচ্ছে। আগামীকাল এসে বউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। সুহা ইশারাটি লক্ষ করে মেহেককে দেখাতেই পুরো বাড়িতে চাপা হাসির রোল পড়ে যায়।
.
.
গেইট ধরার টাকা নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে। টাকা আগে না পেলে শ্যালিকারা নাওফিলকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এদিকে বরের বন্ধু ও ভাইয়েরা হারতে রাজি নয়। ৪ লক্ষ টাকার গেট দিয়ে ঢুকবে না তারা। প্রয়োজনে বিয়েই করাবে না। আগে একবার বিয়ে হয়েছে, এখন না করলেও সমস্যা নেই। নাওফিল কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। ওদিকে তার বউ ছাদে দাঁড়িয়ে তার করুণ অবস্থা দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শেষে সাফাওয়াত সাহেব ৪ লক্ষ টাকার চেক দিলেন মেহেকের হাতে এবং নাওফিলকে বললেন,

– টাকা দ্রুত শোধ করবে।

নাওফিল বলল, ‘কেন? আমি তোমাকে টাকা দিতে বলেছি? যেটা দিয়েছ স্বেচ্ছায় দিয়েছ, পাওয়ার আশা ভুলে যাও।’
কথাগুলো স্বল্পস্বরে বলায় বাকিরা শুনতে পায়নি। তবে হেরে যাওয়ায় বরপক্ষ ভীষণ লজ্জা পেল।

বিয়ের কাবিন,মোহরানা,দেনা-পাওনায় কোথাও কোনো সমস্যা হলো না। প্রথম বাক্যতেই সম্মত সবাই। প্রিয়তা আড়চোখে নাওফিলকে দেখছে।বেচারার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।
দুদিনে ৫ লক্ষ গেছে।শ্বশুড়বাড়ি শুধু বিয়ে করতে এসেই এত যাচ্ছে বিয়ের পর নাওফিলকে ফকির হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।এসব বলে তুহিন, সিয়ামসহ বাকিরা ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। নাওফিল সেসবের তোয়াক্কা না করে বলল,
– টাকা গেলে যাক, টাকা-পয়সা আমি ধুয়ে ধুয়ে খাবো না।

তুবা আপুর বর শোয়েব ভাই বললেন,
– হ্যাঁ, তাই তো। নাওফিল এখন ওসব খাবে কেন? বিয়ের পর সে নতুন, উপাদেয় খাদ্য গ্রহণ করবে।

মুহূর্তেই হেসে উঠল সবাই। নাওফিল লজ্জা পেল এবার। পর্দার আড়ালে থাকা একজোড়া চোখে চোখ পড়ল নাওফিলের। চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফেরালো সে। যাক, অবশেষে স্বস্তি পেল নাওফিল।এতক্ষণ অস্থিরতায় দম নিতে পারছিল না। প্রিয়তাকে এবার নাওফিলের পাশে বসানো হবে।

রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় নাওফিলের হাত কাঁপছিল। প্রিয়তারও একই দশা।শোয়েব ভাই রেজিস্ট্রি পেপার টেবিল থেকে তুলে হাতে নিয়ে বললেন,
– দশমিনিট হতে চলল, কাগজে মেয়ের সই পড়েনি। নাওফিল, তুমি বরং আজ ফিরে যাও। তোমার কপালে এত মিষ্টি বউ নেই। তোমার সাথে সংসার করার কথা ভেবেই আমাদের মেয়ের হাত-পা কাঁপছে ভয়ে। জোর করে আমরা মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না। মেয়ের ভয় কমার পর এসো। তখন সই-সাক্ষর করে বউ নিয়ে যাবে। ততদিন এই রেজিস্ট্রি পেপার আমি নিজের কাছে সযত্নে তুলে রাখবো, চিন্তা করো না।

নাওফিল পেপার নিয়ে বলল,
– আপনাকে এত কষ্ট করতে হবে না ভাইয়া। আপনারা আছেন বলেই সাইন-টা হচ্ছে না। আপনারা বারবার রেজিস্ট্রি পেপার কব্জা করলে আমার বউ সাইন করবে কিভাবে?

শোয়েব ভাইসহ বাকিরা যারা ঠাট্টা করছিল তারা ঠোঁট চেপে হাসে। নাওফিল প্রিয়তার সামনে কাগজ রাখলো।
প্রিয়তা মুচকি হাসে। এরপর নাওফিলের সাক্ষর দেখে তার পাশে নিজের নামটি লিখে ফেললো নিমিষে।
.
.
মীর্জা বাড়িতে বধুবরণ পর্ব শেষ হতেই নববধুকে কোলে তুলে নিল নাওফিল। এরপর সোজা সিড়ি বেয়ে ছাদের দিকে যেতে লাগলে নিচ থেকে সফি চেঁচাল,
– ভাইয়া খেলা বাকি আছে তো। ভাবিকে নিয়ে সেসব খেলবো না? ভাবিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
– রাখ তোর খেলা। প্রথম বাসরেও বউকে আটকে রেখেছিলি তোরা, এবার কোনো রকম ঝামেলা করবি না। যা খেলার তা কাল খেলবি, কাল খেলে শেষ না হলে পরশু-ও খেলবি কিন্তু আজ না।

গুরুজনেরা নাওফিলের লাগামহীন বাক্য শুনে যে যার মত দ্রুত সরে পড়লেন। তুষার চেঁচাল,
– ভাই দরজার চাবি লাগবে না? সাজিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে এসেছি কিন্তু! টাকা না পেলে চাবি দেওয়া হবে না।

নাওফিল শুনলো না। সত্যি সত্যি ছাদের দরজায় তালা ঝুলছে। ক্ষণিকের মধ্যেই সিয়াম একটি রড নিয়ে হাজির। গলার স্বর কাঁপছে,সে হাপাতে হাপাতে বলল,
– তুষার ভাই চাবি দেবে না। তাই রড এনেছি। ভাবিকে নিয়ে একটু সরে দাঁড়ান ভাই আমি তালা ভেঙে দিচ্ছি।
– গো এ্যাহেড…

প্রিয়তা হতভম্ব, বাকরুদ্ধ! লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে আছে। যা যা হচ্ছে তাতে স্বাভাবিক থাকার সুযোগ একেবারেই নেই। সিয়াম সত্যিই রড দিয়ে তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। শব্দ শুনে তুষার চাবি নিয়ে আসে। চাবি দিতেই নাওফিল বলল,
– লাগবে না, তোর চাবি তুই নিয়ে গিয়ে জাদুঘরে ঝুলিয়ে রাখ।

তুষার চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘শ্যালিকাদের পাঁচলাখ দিতে হাত কাঁপেনি,নিজের ভাইদের পঞ্চাশহাজার দিতে বুক কাঁপছে। এমন বৈষম্যময় লিডারকে ধিক্কার জানিয়ে, ভাবির জন্য শুধুমাত্র চাবি দিয়ে গেলাম। সে বেচারি তোমার মত মানুষকে সহ্য করবে কি করে?’

এরপর প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলল,
– ভাবি বিয়ে করার আগে তোমার দেখেশুনে নেওয়া উচিত ছিল। এই মানুষ কিন্তু সুবিধার না। এখন দেখতে পাচ্ছ তো, কেমন স্বভাব?

নাওফিল দাঁতে দাঁত পিসে বলল, ‘তুষার?’

তুষার সিয়ামকে সাথে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ভাইকে দেখলে সিয়াম? বউ পেয়ে ভাইদের ভুলে গেল। সাবধানে থেকো কখন না জানি তোমাকেও ভুলে যায়। দেখা গেল কোনো এক ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে ফেঁসে আছ, অমনি ভাবির কল এলো। তোমাকে সেই অবস্থায় ফেলেই কিন্তু ভাই চলে আসবে। তার সাথে থাকতে হলে লিগ্যাল চুক্তি করে রেখো, টাকা-পয়সার হিসেবে যেন ছাড় দিও না।’

চলবে…