তোমাকে চাই পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
104

#তোমাকে_চাই ।১৮, শেষ।
#সাইরা_শেখ

ছাদের মাঝ বরাবর সাজানো খাটের ওপর প্রিয়তাকে বসিয়ে দিল নাওফিল। দরজা লাগিয়ে সুইচ অন করে আলো জ্বালালো, পুরো ছাদ সাদা রঙের ছোট ছোট লাইট দিয়ে সাজানো, মেঝেতে ফুলের তৈরি হার্ট, মাঝে মোমবাতি দিয়ে নাওফিল-প্রিয়তা লেখা। নাওফিল মোমগুলো দ্রুততার সাথে জ্বালাচ্ছে। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে সবটা দেখছে।

একাই দৌড়ঝাপ করে পুরো ছাদ আলো আলো করে ফেলল নাওফিল। অতিরিক্ত লজ্জায় প্রিয়তার মাথা ব্যাথা করছে। সবাই কি মনে করেছে মাথায় শুধু সেটাই ঘুরছে। এত এত লজ্জা কোথায় রাখবে সে? নাওফিল বিছানার ওপর রাখা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিচে ফেলে দিল। ব্যতিব্যস্ত সে। সবকাজ শেষ করে তবে দম নিল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
– নাও, ইটস কমপ্লিট।

প্রিয়তাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– তুষার ভাইয়ের উপদেশ শোনা উচিত ছিল। বিয়ের আগে যদি জানতাম আপনি এমন মানুষ, তাহলে আরও একবার ভাবতাম বিয়ের ব্যাপারে।
– কি ভাবতে? বিয়েটা করবে না? তাই তো?
– এছাড়া কি? আপনি প্রথমদিন থেকে আমাকে শুধু হেনস্থা করেছেন। লজ্জায় ফেলেছেন। একটাদিনও ঠিক ভাবে কথা বলেননি।আমার সবকিছু আপনার অপছন্দ, তাহলে একজাক্টলি কিসের জন্য বিয়েটা করলেন? সারাদিন বউ বউ কেন করেন? কি চান? হেয়ালি না করে স্পষ্টভাষায় একটু বলবেন নাওফিল?

নাওফিল সময় নিল উত্তর প্রস্তুত করার জন্য।প্রিয়তা বিরক্ত হলো। নাওফিলের বাক্য ও ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যবহার দেখে মনে হয় সে প্রিয়তাকে পছন্দ করে, আর বাক্যপ্রয়োগের কথা ভাবলে মনে হয় সে প্রিয়তাকে শুধু বন্ধু ভাবে। ভালো মানুষ হওয়ায়, বন্ধুকে সাহায্য করা, অভিমান ভাঙানো, সঙ্গ দেওয়া স্বাভাবিক। প্রিয়তার খারাপ লাগবে জেনেই হয়ত এমন ভাব দেখায় যে, সে বিয়েটা মন থেকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রিয়তা সেটা চায়না। সে চায় নাওফিলের মনে যা আছে, নাওফিল সেটাই খুলে বলুক প্রিয়তাকে। উত্তর না পেয়ে প্রিয়তা উঠে ছাদের কার্নিশের ওপর দুহাত ভর দিয়ে দাঁড়াল।

পূর্ণিমা তিথি! স্বচ্ছ আকাশে রুপালি থালার মত গোল চাঁদটি অপূর্ব লাগছে। একধ্যানে সেই চাঁদের দিকে চেয়ে আছে প্রিয়তা। নাওফিল বিছানায় শুয়ে থেকে বলল,

– দাঁড়িয়ে আছ কেন?আর কি দেখছ আমাকেও বলো। আমিও দেখি, একা দেখার থেকে কাউকে সাথে নিয়ে দেখা বেশি প্রশান্তিদায়ক বউ।

প্রিয়তা হতাশ গলায় উত্তর দিল,
– একটু চুপ করবেন? নাওফিল। আমার ভালো লাগছে না।
নাওফিল জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

প্রিয়তা উত্তর দিল না। নাওফিল এবার উঠে আসে। পেছন থেকে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে, প্রিয়তার কাঁধে চিবুক রাখে। প্রিয়তা বাঁধা দিল না। চোখে পানি চিকচিক করছে। নাওফিল প্রিয়তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো,
– প্রিয়?
– আপনি প্রিয়তাকে চান না, সেদিন বাক্যটি বোঝা উচিত ছিল আমার। আবারও একটা ভুল করলাম।
– মানে?
– পারিবারিক ঝামেলা মেটাতে এক হয়েছিলাম আমরা। ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বামী স্ত্রী নই, এটা স্রেফ সমঝোতার বিয়ে। সব সমস্যা মেটার পর আমাদের আলাদা হওয়ার কথা ছিল।আপনি আমার কারণে পুনরায় এই সম্পর্কের মধ্যে জড়াতে বাধ্য হলেন। এটা অনুচিত। আপনি একবার জানাতে পারতেন আপনার মন কি চায়, আপনি কি চান? আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছি আপনি কোনো উত্তর দেননি। তা নাহলে পুরোটাই আমার ভুল যে আমি-ই কিছু বুঝতে পারিনি। হয়ত সেদিন কল কাটার পর কলব্যাক না করা আপনার সংকেত ছিল।

নাওফিল প্রিয়তাকে ছেড়ে, ওকে মুখোমুখি দাঁড় করায়। নাওফিলের চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট, সে দু-হাতে প্রিয়তার গাল ছুঁয়ে রাগান্বিত গলায় বলল,
– যা বলবো, মন দিয়ে শুনবে প্রিয়।

প্রিয়তার চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়তেই নাওফিলের রাগ কমে আসে।অসহায়ত্ব ভর করে মুখশ্রীতে। গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে আসে। প্রিয়তার কান্না অসহনীয় লাগছে তার। নাওফিল প্রিয়তার চোখের পানি মুছে বলল,
– আমি পারিবারিক দ্ব’ন্দ্ব ঘোচাতে বিয়ে করিনি প্রিয়। আমি তোমাকে একটি মাধ্যম হিসেবে কখনই ভাবিনি। তোমাকে আমি সে-দিন থেকে চিনি যে-দিন থেকে তুমি আমাকে চেনো। ভার্সিটির প্রথমদিন, নবীনবরণ অনুষ্ঠান, গেট দিয়ে সাদা থ্রিপিচ পড়া, মাথায় ওরনা টানা একটি মেয়ে ব্যাগে কিছু খুজতে খুজতে ঢুকছে। অর্পাকে ডেকে বললাম, ‘মেয়েটার নাম জেনে রাখিস’ অর্পা সাথে সাথেই তোমাকে ডাকল, তুমি এসে পরিচয় জানালেও তোমার নাম শুনতে পাইনি আমি।গ্রামের নাম শুনে এতটাই হতাশ হয়েছিলাম যে অর্পার থেকে পরে নাম জানার মত রিস্ক নেইনি। গ্রামের ঝামেলার কারণে নিজের পরিচয়ও গোপন রেখেছিলাম। তুহিনরা তোমাকে র‍্যাগ হিসেবে গান গাইতে বলেনি, ওরা দেখতে চেয়েছিল তোমার গান শুনে বা তোমাকে দেখার পর আমার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়? আমি স্বাভাবিক ছিলাম। তাই তুমি কারোর নজরে আসোনি। ট্রাস্ট মি প্রিয়, আমি তখনও জানতাম না যে তুমি তালুকদার বাড়ির মেয়ে। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ছিল এটা।
এরপর প্রায়শ তোমাকে ক্যাম্পাসে দেখতাম, কখনও ক্যান্টিনে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছ, কখনও মাঠে বসে গল্প করছ, এক দিন লাইব্রেরিতেও দেখেছি। খেয়াল করেছি, আমাকে তুমি পছন্দ করো না, এড়িয়ে চলো। ভেবেছিলাম তুমিও আমার পরিচয় জেনে গেছো গ্রামের শ’ত্রুর ছেলে হিসেবে।তাই নিজেকে তোমার থেকে গুটিয়ে নিলাম। এমন ভাব নিয়ে থাকতাম যেন তোমাকে কখনও দেখিনি। সেদিন মাঠে তোমার সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম। প্রচণ্ড অবাকের সঙ্গে ভয়-ও পেয়েছিলাম তোমাকে হারানোর।
বিয়ের প্রস্তাবে তুমি যখন রাজি হলে তখন আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ওই সময়ে বিয়ে করে তোমাকে কষ্টের ভেতর ঠেলে দিতে চাইনি। ভেবেছিলাম সবকিছু মিটলে তোমাকে বউ করে আনবো। তোমার সাথে প্রথম সরাসরি কথা বলার সময় কতটা নার্ভাস ছিলাম জানো না। সিয়ামরা ছিল ঘরে, ওদের সামনে অপ্রস্তুত হওয়ার ভয়ে ওদের ঘর থেকে বের করে দিলাম। তুমি জানতে চাইলে কে আমি? কাকে চাই? সেদিন অকপটে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলাম, যে তোমাকে চাই।ওটা স্রেফ একটি বাক্য ছিল না। আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া যেটা তুমি না চাইলে কখনই পূরণ হত না।অথচ তুমি সেটাকে ব্যাঙ্গ হিসেবে নিলে, ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। অনুভূতিকে চেপে সবার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করতে বিয়ে ভাঙার চেষ্টায় লেগে পড়লাম।সে চেষ্টায় আমি নিজেই বারবার অসফল হয়েছি। আম্মু ধরে ফেলল সবকিছু। আমাকে আশ্বাস দিল, ভরসা জোগাল। ভাবলাম এবার তোমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা না করে, বরং তোমাকে পাওয়ার চেষ্টা করি।
প্রথমদিন থেকে তুমি নাটক শুরু করলে বলে আমিও আমার মত নাটক জারি রাখলাম। আমার জীবনে আমি বেশিরভাগ সময় পড়া, পরিবার, আর মানুষের সুখের কথা ভেবেছি। এই দুটি গ্রামকে এক করার চেষ্টা থেকেই রাজনীতি শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। তারপর সেসব নিয়েই দিন কেটেছে। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে তোমার আগে কেউ আমার জীবনে এসেছিল কিনা? কাউকে পছন্দ করতাম কিনা? উত্তর-টা, না। তোমাকে দেখার পর যেমন মনে হয়েছিল, ‘তুমি আমার’ তেমনটা আগে কখনও কাউকে দেখে মনে হয়নি। তোমাকে যে আমার ভালো লাগত এটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। কাউকে জানতে দেইনি, শুধু তোমার সেফটির কথা ভেবে। তোমার সেফটির জন্য আমি সবাইকে দেখিয়েছি আমি তোমাকে অপছন্দ করি। ভেবেছিলাম বিয়ে ভেঙে যাবে, এতে তুমি ভালো থাকবে। কিন্তু এমন হলো না। তোমাকে বিয়ের পরেরদিন এখানে একা ফেলে যাওয়ার উদ্দেশ্য শুধু ইকবাল আঙ্কেলদের মুখোশ টেনে খোলা নয়, এর পরিপ্রেক্ষিতে তোমাকে আমার কাছে সারাজীবনের জন্য বেঁধে রাখা। যত দ্রুত সম্ভব কাজটি করার কারণ, বিয়ে থেকে মুক্তি বা তোমার থেকে মুক্তি নয়। আমার বোনদের দেওয়া কষ্টগুলো যেন তোমাকে বেশিদিন সহ্য করতে না হয় সেজন্য রাতদিন এসবের পেছনে সময় ব্যয় করেছি। যত দ্রুত সম্ভব এসবের সমাপ্তি টানতে চেয়েছি।
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি প্রিয়। তুমি জানো আমি শব্দ দিয়ে সব অনুভূতি বোঝাতে পারিনা।আমার মত মানুষ তোমার সামনে ঠিক কতটা অসহায় হয়ে পড়ি বলে বোঝাতে পারবো না। আজ বেশ কষ্ট করে অনেক সাজিয়ে গুছিয়ে এই কথাগুলোকে জমা করেছি। এর থেকে ভালো করে কিভাবে বলতে হয় তা আমার জানা নেই। তুমি বুদ্ধিমতি, আমি জানি আমাকে তুমি বুঝবে।

প্রিয়তা নাওফিলের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
– আমি আপনাকে ভালোবাসি নাওফিল।

একেবারেই নিঃসংকোচ স্বীকারক্তি প্রিয়তার। পরপরই গলার স্বর কেঁপে ওঠে,
– আমি আপনার কাছ থেকে বেশি কিছু চাইনি, শুধু কয়েকটা শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম। স্পষ্ট, জড়তাহীন ভালোবাসার প্রকাশ।বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক দম্পতিদের মত সম্পর্ক ছিল না। কেমন দায়িত্ব, কর্তব্যের ভার অনুভব করেছি। সে ভারের থেকে মুক্তি চেয়েছি। আপনাকে চেয়েছি। আর আপনি হাসি তামাশা করে সবটা নষ্ট করেছেন।

নাওফিল প্রিয়তার অভিমান টের পেল। এই অভিমানি পরিবেশ ঠিক করতে, নিজেও বাচ্চাদের মত অভিমানের ভান ধরে বলল,
– এখন তো বলেছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।এবার অতিতের কথা ভুলে যাও প্লিজ…
– ইচ্ছে করে আমাকে ঘুরিয়েছেন।আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। এসব জানানোর আগ-পর্যন্ত নাটক করেছেন। আমার এমন ড্রামাবাজ নাওফিলকে চাই না।

নাওফিল তার পুরোনো স্বভাবে ফিরে এসে বলল,
– না চাইলেও আমি আমার আমি-কে তোমায় দিয়ে দিয়েছি। বউকে যদি এইটুকু দিতে না পারি তাহলে কিসের স্বামী হলাম, তারওপর আমার মন অনেক বড়। বউ কিছু চাওয়ার আগেই আমি তাকে সবকিছু বিনাবাক্যে দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকি। বুঝলে?

অকস্মাৎ নাওফিল প্রিয়তাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিল। প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে বলে,
– কথায় কথায় কোলে তুলবেন না তো। বিশাল মনের সাথে বিশাল শক্তির প্রদর্শন করছেন এখন? আপনার এই খোঁচামা’রা স্বভাব কবে যাবে?
– তোমার সামনে আমি নিতান্তই দুর্বল প্রিয়। তুমি এটা কেন বুঝোনা?
প্রিয়তা কপোট্ রাগ দেখিয়ে বলল,
– এখন কোলে তুলছেন কেন? চার-পা হেটে আসলে আমার পা ক্ষয় হয়ে যাবে না।
– আমি আমার বউকে হাটিয়ে আনতে চাইনি।

প্রিয়তাকে বসিয়ে নাওফিল নির্নিমেষে তাঁকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা স্বল্পস্বরে জিজ্ঞেস করল,
– কি দেখছেন?
নাওফিলের তরফ থেকে জবাব এলো না। প্রিয়তা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
– কথা বলছেন না কেন?
সঙ্গে সঙ্গে ছাদের ছোট লাইটগুলো অফ হয়ে গেল। পূর্ব দিকের লাইট ও মোম জ্ব’লছে। নাওফিল হাতে থাকা সুইচটি নিচে ফেলে প্রিয়তার পানে এগিয়ে আসে। প্রিয়তা আকন্ঠ স্বরে আওড়ায়,”নাওফিল?”

নাওফিল প্রিয়তার কাছাকাছি এসে বলল, ‘শব্দে তো অনেককিছু বললাম প্রিয় এবার অন্যভাবে বলতে চাই। তাই এই মুহূর্তে তুমি আমাকে একদম বিরক্ত করবে না। আমাকে আমার ২ মাসের বউ থাকতেও ব্যাচেলর জীবনের ইতি টেনে বউয়ের সাথে বিবাহিত জীবনের সূচনা করতে দাও। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে যথেষ্ট ভালো বর হওয়ার পরীক্ষা দিয়েছি। আজ যখন তোমাকে সব বললাম, তুমি সবকিছু জানতে পারলে তখন চুপ করে, হাত গুটিয়ে বসে থাকার কার্যক্রম দীর্ঘয়ত করতে পারছি না। তুমি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করলে আমি তোমাকে জিতে নিতে পারবো, সেই বিশ্বাস আমার আছে। তবে আমি তোমাকে বাধ্য করলে তুমি সেটা সামলাতে পারবে না। তাই বলছি, আমার অর্ধাঙ্গিনীকে আমার কাছে দ্রুত ফিরিয়ে দাও..’

দরজায় টুংটাং শব্দ হয়। অয়ন ও তুষারের গলা ভেসে আসছে। তারা বলছে, ছাদের পূর্বপাশের লাইট অফ করে নিতে নয়ত সব রেকর্ড হবে ক্যামেরায়। ছাদে কোনো ক্যামেরা নেই, এটা ওদের শয়তানি বুঝতে বাকি রইল না নাওফিলের। কিন্তু প্রিয়তা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারলো না। প্রথমে ভয় ও পরে লজ্জা পেল সকলের উপস্থিতিতে। নাওফিল ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। স্বল্প আলোয় নিজের লাজুক বউয়ের দিকে তাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত পিসে বলল,

– একটু অপেক্ষা করো প্রিয়,আমি ওদের একটা ব্যবস্থা করে এক্ষুনি আসছি।

প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইল নাওফিলের দিকে। আজ পরিপূর্ণ লাগছে সবকিছু। তুষারদের টাকা দিয়ে নাওফিল বিরক্তিমাখা চেহারা নিয়ে ফিরছে। প্রিয়তার মনে পড়ল, নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আগে যেদিন ভর্তির লাস্ট ডেট ছিল, সেদিন ভার্সিটিতে ঢুকেই একটি ছেলেকে বেধড়ক মা’র খেতে দেখেছিল সে। এরপর হঠাৎ কারোর আগমণে, পরিবেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এভাবেই সাদা পাঞ্জাবি পড়ে একজন বিরক্ত চেহারায় এগিয়ে আসছিল। সবাই চেঁচাল, ‘নাওফিল ভাই আসছে।’ প্রিয়তা কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষে তাঁকিয়ে ছিল সেই সুদর্শন পুরুষটির দিকে। নাওফিল জানে না, সে প্রিয়তাকে অনেক দেরিতে লক্ষ করেছে। প্রায় এক সপ্তাহ পর দ্বিতীয়বার দুজনের দেখা হয় নবীনবরণের দিন। কেবল নাওফিল ওদের সঙ্গে ছিল বলেই গান গেয়েছিল প্রিয়তা। কে জানত? সেই মা’রকুটে, তেজি, রাগি নেতা যাকে দেখলে প্রিয়তা ভয় পেত তাকেই সৃষ্টিকর্তা প্রিয়তার জন্য নির্বাচন করে রেখেছেন।

প্রিয়তা আকাশের চাঁদের দিকে তাঁকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি জানো চাঁদ? এই নাওফিল নামের মানুষটি আমাকে যতটা চেয়েছে, তার থেকেও বেশি আমি তাকে চেয়েছি। কারণ আমি তাকে তখন থেকে পছন্দ করি যখন সে আমাকে চিনত না,জানত না,এমনকি দেখেওনি। আমি তাকে এই অব্যক্ত সত্য জানাতে চাই না। নাওফিল শুধু এটা জানুক, ভালোবাসার অধ্যায়ে সে আমার থেকে এগিয়ে আছে। আমাদের সম্পর্কে তার ভূমিকা-ই সর্বাধিক।আমি তাকে একটুখানি ভালোবাসি, শুধুমাত্র পরিবারের জন্য তাকে স্বামীরূপে মেনে নিয়েছি, তারপর ভালোবেসেছি। নয়ত এই মানুষ যদি জানে আমি প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়েছিলাম তাহলে তার অতিরিক্ত কথা বলার রোগ কখনও যাবে না, কারণে অকারণে আমাকে লজ্জায় ফেলবে। তাই শুধু তোমাকে বলছি, আমার কথাগুলো গোপন রাখবে।’

প্রিয়তা থামল। লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মুখখানি নাওফিলের দিকে ফেরালো। নাওফিলের চোখে চোখ পড়ল তার। পরক্ষণেই দৃষ্টি চাঁদে নিবদ্ধ করে, লাজুক ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে, নিঃশব্দে কিছু একটা বলল।
নাওফিল কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে প্রশ্ন করে,
– আকাশের দিকে তাঁকিয়ে কি বিরবির করছ?
– চাঁদকে আমার একটা সিক্রেট বলছি।
– তোমার সিক্রেট? তাহলে তো আমারও জানা উচিত। কি সিক্রেট বললে চাঁদকে? আমাকেও বলো।
– আপনাকে বলা যাবে না।
– তবে রে..
নাওফিল প্রিয়তার দিকে তেড়ে আসে। প্রিয়তা হাসতে হাসতে সরে যায়। দুজনের খুনসুটির সাক্ষী আকাশের ওই চাঁদও যেন হেসে উঠল প্রিয়তার সুখের মুহূর্ত দেখে।

চাঁদ যদি কথা বলতে পারত, তাহলে সে নিশ্চই নাওফিলকে জানাত প্রিয়তার বলা শব্দগুলো। প্রিয়তা চাঁদকে বলেছে,
‘নাওফিল আমার একমাত্র দোয়া যাকে আমি পাবোনা জেনেও সবসময় পেতে চেয়েছি, সৃষ্টিকর্তার রহমতে আজ সে আমার। একান্তই আমার ব্যক্তিগত পুরুষ, যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।’

সমাপ্ত।