তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-১৮+১৯

0
106

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_১৮

” একই মায়ের পেটের ছোট বোনটা, তোমার এতখানি শত্রু কবে হলো জাওয়াদ? ”

ভোরের স্বল্প আলোকিত প্রহর। পক্ষিকূলের হালকা কিচিরমিচির গানে মোহিত হচ্ছে অন্তর! ছাদের একাংশে দাঁড়িয়ে জাওয়াদ। পড়নে হাতাকাটা কালো রঙের গেঞ্জি। পেশিবহুল দু হাতে ভারী ডাম্বেল। মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাত দু’টো পরপর উঁচু নিচু করে ডাম্বেলের সহিত শরীরচর্চা করে চলেছে সে। কিছুটা সময় শরীরচর্চায় অতিবাহিত হলো। ছাদের মেঝেতে বিছানো সুশ্রী শীতলপাটিতে উপুড় হয়ে ভর দিয়ে জাওয়াদ। গুণে গুণে শক্তি ব্যয়বহুল বুক ডাউন করে চলেছে। তেমনই মুহূর্তে সহসা কর্ণপাত হলো উপরোক্ত প্রশ্নটি। নারী কণ্ঠ শুনে বুক ডাউনরত অবস্থানেই ডানে ঘুরে তাকালো সে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে সহধর্মিণী নিশাত। ওর পানেই তাকিয়ে। জিজ্ঞাসু ভাব স্পষ্ট চোখেমুখে। জাওয়াদ আস্তে করে নিজ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ফোঁস করে নিশ্বাস ত্যাগ করে উপুড় অবস্থা হতে উঠে দাঁড়ালো। একদম সোজা হয়ে দাঁড়ালো। স্ত্রীকে এমন রূপে পাশ কাটিয়ে গেল যেন নিশাত নামক কেউ এখানে নেইই। নিশাত চেয়ে দেখলো কিভাবে জাওয়াদ ছাদের রেলিংয়ে রাখা প্রোটিন সেক এর আকর্ষণীয় বোতলটি হাতে নিলো। বোতলটি উন্মুক্ত করে সেক পান করতে লাগলো জাওয়াদ। দাঁড়িয়েই পান করছে সে। নিশাত এতবার করে নিষেধ করেছে। বলেছে দাঁড়িয়ে পান করা অনুচিত। ইসলামে এ বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কখনো এমন উপদেশমূলক ভালো কথা শোনেনি, ওই আত্মঅহং এ ভরপুর মানুষটি। দাঁড়িয়ে পান করার বিষয়ে কি বলেছে ইসলাম, সে মোটেও জানতে ইচ্ছুক নয়। জানতে ইচ্ছুক নয়…

বসে পানাহার করা সুন্নত এবং তা রাসুলে করিম (সা.)-এর পবিত্র অভ্যাস। কোনো ওজর ছাড়া দাঁড়িয়ে পানাহার করা মাকরুহ। কেননা হাদিস শরিফে দাঁড়িয়ে পানাহার করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সহিহ মুসলিমে আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন।’ (বর্ণনাকারী) কাতাদা বলেন, ‘আমরা আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে দাঁড়িয়ে খাওয়া কেমন?’ তিনি বললেন, ‘এটা তো আরও মন্দ কাজ’ (মুসলিম : ২০২৪)।

অপর একটি বর্ণনায় আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখে বললেন, ‘বমি করে ফেলে দাও।’ সে বলল, ‘কেন?’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি পছন্দ করো যে তোমার সঙ্গে বিড়াল পান করবে?’ সে বলল, ‘না।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এর চেয়েও মন্দ কেউ? অর্থাৎ শ*য়তান তোমার সঙ্গে পান করেছে।’ (ফাতহুল বারি : ১০/৮৫)

পান করার সময় নবী (ﷺ) তিনবার শ্বাস গ্রহণ করতেন। আর তিনি বলতেন- এই পদ্ধতি হচ্ছে অধিক তৃপ্তিদায়ক, অধিক পিপাসা নিবারক এবং অধিক স্বাচ্ছন্দপূর্ণ।

তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নাবী (ﷺ) বলেন- ‘‘তোমরা উটের ন্যায় এক নিঃশ্বাসে পানি পান করোনা; বরং তোমরা দুই বা তিন নিঃশ্বাসে পান কর। আর যখন তোমরা পান করবে, তখন বিসমিল্লাহ বলে পান করবে এবং পান করা শেষে আলহামদুলিল্লাহ্ বলবে’’। নবী (ﷺ) পাত্র ঢেকে রাখার আদেশ দিয়েছেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন-

غَطُّوا الإِنَاءَ وَأَوْكُوا السِّقَاءَ فَإِنَّ فِى السَّنَةِ لَيْلَةً يَنْزِلُ فِيهَا وَبَاءٌ لاَ يَمُرُّ بِإِنَاءٍ لَيْسَ عَلَيْهِ غِطَاءٌ أَوْ سِقَاءٍ لَيْسَ عَلَيْهِ وِكَاءٌ إِلاَّ نَزَلَ فِيهِ مِنْ ذَلِكَ الْوَبَاءِ

‘‘তোমরা পাত্র ঢেকে রাখো এবং পান পাত্রের মুখ বন্ধ করে রাখো। কেননা বছরে এমন একটি রাত রয়েছে, যাতে বিভিন্ন প্রকার রেসূ ও মহামারি অবতরণ করে। সেই রেসূ বা মহামারি যখনই কোন ঢাকনা বিহীন পাত্রের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে, তখনই তাতে পতিত হয়। [ সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আশরিবাহ, মিশকাত হাএ. হা/৪২৯৮ ]

তাই হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক স্বাভাবিক অবস্থায় বসেই পানাহার করতে হবে। অবশ্য বিশেষ পরিস্থিতিতে যেখানে বসে পানাহারের কোনো ব্যবস্থা নেই কিংবা বসে খাওয়া বা পান করতে সমস্যা সে ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পানাহার করা যাবে। কেননা প্রয়োজনবশত দাঁড়িয়ে পান করার কথাও হাদিসে আছে। (মুসনাদে আহমাদ : ৬৬২৭; ফাতহুল বারি : ১০/৮৬)

নিশাত তার দা’ম্ভিক স্বামীর থেকে প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব পেলো না। তাই তো স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নিরাশ হলো। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল স্বামীর পানে। একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। জাওয়াদ নরম তোয়ালে গলায় জড়িয়ে। সে তোয়ালে দিয়ে মুখশ্রী, গলায় বিরাজমান বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্বস্তি মিটিয়ে দিচ্ছে। নিশাত অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললো,

” বাচ্চা মেয়েটা দিনের পর দিন আমাদের থেকে দূরে আছে। শ্বশুরবাড়ি আছে। বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় আড়াই মাস। তোমাকে কিংবা বাবাকে ফোন করার সৎ সাহস ও সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। আসলেই কি তাই? নাকি অভিমানে চিরতরে তোমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ও? ”

” নিশাত! স্টট ইট ইয়ার। সকাল সকাল আলগা প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না। গোটা দিনটাই স্পয়েল করার প্লান করেছো নাকি? ” চোখেমুখে বিরক্তির উদ্রেক হলো জাওয়াদের।

” তোমার এত বিরক্তি কিসের জন্য হা? ও তোমার নিজের আপন ছোট বোন হয়। কোনো অ্যাডপ্টেড সিস্টার নয়। আমি তো ওর ভাবী হই মাত্র। ভাইয়ের বউ। তাতেই দিনরাত ওই মেয়েটার জন্য আমার বুক পোড়ে। নিদারুণ কষ্ট হয়। সেখানে তুমি কিনা আপন ভাই হয়ে এত নির্লিপ্ত! কিভাবে সম্ভব? ”

জাওয়াদ রাগত চেহারায় তাকিয়ে। নিশাত পাল্টা প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বলে চলেছে,

” রাতে ঘুমাতে পারছো কি করে জাওয়াদ? তোমায় কি একটুও.. তিল পরিমাণ অনুশোচনা তাড়া করে বেড়ায় না? মা কি তোমায় স্বপ্নে এসে ধিক্কার জানান না? হুঁ? ”

অকস্মাৎ মায়ের প্রসঙ্গ উঠতেই মানুষটার চেহারা কেমন বদলে গেল। চেহারায় রাগের পরিবর্তে এখন প্রকাশ পাচ্ছে রিক্ততা। মুখভঙ্গিতে বিশালাকার পরিবর্তনের ছোঁয়া। নিশাত বিদ্রুপাত্মক হাসলো ক্ষণিকের জন্য।

” এই তুমি কিনা মায়ের ছেলে? হাহ্! শেইম অন ইয়্যু। আজ যে আচরণ বোনের সঙ্গে করছো না .. একদিন সেই আচরণ পাল্টা তীরের ন্যায় তোমার বুকেই বিদ্ধ না হয়। বি কেয়ারফুল মিস্টার জাওয়াদ কায়সার। ”

সকাল সকাল স্বামীকে এমন তিক্ত বাক্য শোনাতে কষ্ট হচ্ছিল। অনুশোচনা হচ্ছিল। তবুও শোনালো নিশাত। সে যে অপারগ। আর কত সহ্য করবে? ওদিকে ওই মেয়েটা যে জীবন্ত লা’শে পরিণত হচ্ছে। নিশাত অর্ধাঙ্গের দিকে একঝলক তাকিয়ে ধীমি পায়ে সেথা হতে প্রস্থানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। ছাদের দরজা পেরিয়ে নেমে গেল, ছাদ হতে। এতবড় এই ছাদে হুট করেই সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়লো জাওয়াদ। কর্ণ পথে তখনো ভেসে ভেসে উঠছে,

‘ এই তুমি কিনা মায়ের ছেলে? হাহ্! শেইম অন ইয়্যু। আজ যে আচরণ বোনের সঙ্গে করছো না .. একদিন সেই আচরণ পাল্টা তীরের ন্যায় তোমার বুকেই বিদ্ধ না হয়। বি কেয়ারফুল মিস্টার জাওয়াদ কায়সার। ‘

‘ বিয়ে হয়েছে প্রায় আড়াই মাস। তোমাকে কিংবা বাবাকে ফোন করার সৎ সাহস ও সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না। আসলেই কি তাই? নাকি অভিমানে চিরতরে তোমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ও? ‘

এতগুলো প্রশ্নের ভূমধ্যসাগরে হাবি খাচ্ছে জাওয়াদ। কোথায় মিলবে সকল প্রশ্নের স্থায়ী ঠিকানা?!

নিশুতি রাত। শীতাংশু জ্বলজ্বলে রূপে উপস্থিত অন্তরীক্ষের বক্ষ গহ্বরে। গোটা শহরের আজ এ মুহূর্তে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকার কথা‌। কিন্তু নয়। বিশেষ এ রজনীতে ঘুমকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সজাগ মুসলিম বিশ্ব। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠেছে আলোর উৎস। ব্যস্ত সময় পার করছে প্রতি ঘরের মা ও বোনেরা। পুরুষেরা কেউ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। কেউবা আধঘুমে জাগ্রত। উঠবে উঠবে এমনতর ভাব।

জনাব মুয়ীয হাসানের বাড়িতেও একই চিত্রের দেখা মিলছে। মোমেনা বেগম, জান্নাত ও উক্তি ইতিমধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। মোমেনা বেগম মাঝের ঘরটিতে প্লাস্টিকের স্বল্প উঁচু মোড়ায় বসে। খাবার সামগ্রী গুছগাছ করে দুই পুত্রবধূর হাতে তুলে দিচ্ছেন উনি। ওরা খাবারের বাটি হাতে নিয়ে রাখছে স্বল্প দূরত্বে মেঝেতে বিছানো মাদুরে। কর্মরত মোমেনা বেগম একপর্যায়ে ছোট পুত্রবধূকে শুধোলেন,

” ছোডো বউ? মুয়ীয উঠছেনি? ”

উক্তি ঘুরে তাকালো। হাতের ইশারায় বললো,

‘ ডেকে এসেছি মা। এতক্ষণে উঠেছেন বোধহয়। ‘

মোমেনা বেগম এই শব্দহীন ভাষা ঠিক বুঝলেন না। তবে আন্দাজ করতে পারলেন মুয়ীয ওঠেনি এখনো। উনি আদেশের স্বরে বললেন,

” মোর বাপ এহনো ওঠে নাই। তুমি বইয়া করতাছো ডা কি? যাও। ওরে জলদি ডাইকা লইয়া আহো। ”

উক্তি আস্তে করে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। চঞ্চল পায়ে অগ্রসর হলো নিজেদের ঘরের উদ্দেশ্যে। জান্নাত মাদুরে রাখলো ডাল ভর্তার স্টিলের বাটি।
.

দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো উক্তি। এসেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। বিছানায় বসে মুয়ীয। হাতে মোবাইল। মোবাইল স্ক্রল করছে কিন্তু ঠিক অনুভব করেছে স্ত্রীর উপস্থিতি। তাই তো মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো,

” খাওন বাড়ছে? ”

উক্তি’র মুখনিঃসৃত হলো ‘ আঃ ‘ সূচনা শব্দ। হ্যাঁ বোধক উত্তর গণনা করে উঠে দাঁড়ালো মুয়ীয। মোবাইল রাখলো বাঁ হাতের শক্ত মুঠোয়। ঘুরে তাকালো স্ত্রীর পানে। লাল রঙা শাড়ির আবরণে আবৃত তার টুকটুকে লাল বউটা। বউকে দৃষ্টিবন্দী করতেই মনের মাঝে একফালি সুখের হাওয়া ছড়িয়ে গেল। পলক ঝাপটে পা বাড়ালো মুয়ীয। দৃষ্টি একদম স্থির স্ত্রীর ছোট আদর আদর অবয়বে। মানুষটির সম্মুখে ধাবমান পদযুগল, প্রগাঢ় চাহনি… ধীরে ধীরে অবশ করে দিচ্ছিল উক্তি’র অস্তিত্ব। কম্পনের চঞ্চল পারদে ওঠানামা করছিল স্পন্দন। হৃদস্পন্দন। লাজে নিম্নমুখী হয়ে গেল চক্ষুপল্লব। মুয়ীয এলো। একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সুখকর চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড। হাতে যে সময় কম। তাই তো নিজ অনুভূতিতে লাগাম পড়ালো। আস্তে করে বাড়িয়ে দিলো ডান হাতটি। সে হাতের অগ্রগামী ভাবভঙ্গিতে কেমন শিউরে উঠলো উক্তি। বাম গালের ত্বকে আলতো করে বুলিয়ে গেল প্রিয়’র বৃদ্ধাঙ্গুল। উক্তি’র শ্বাস প্রশ্বাস অস্থির করে মিটিমিটি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হাসান সাহেব। এদিকে অনুভূতির সুগভীর তটিনীতে নিলীন হয়ে চলেছে রমণী!

.

পবিত্র মাহে রমজানের আগমন ঘটেছে। আজ রহমতের প্রথম রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সেহরীতে উঠেছে মুসলিম বিশ্ব। মুয়ীয ও তার পরিবারের সদস্যরা সেহরী খেতে বসেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে খাচ্ছে মুন্নি। এই রোজা রাখা তার মোটেও পছন্দ নয়। সারাটা দিন না খেয়ে থাকতে হয়। একদম অসহ্য লাগে। পেটে অসহ্য যন্ত্রনা হয়। খিদে বৃদ্ধি পায়। মজাদার সব খাবার খালি চোখে পড়ে। লোভে লকলক করে ওঠে জিভ। স্রেফ ছোট ভাইয়ার ভয়ে সেহরির জন্য উঠতে হয়। গত রমজানে যে ভেলকি দেখিয়েছিল না..! আজও মনে পড়লে আঁতকে উঠে আত্মা। তাই তো ভয়ার্ত মনে সেহরি খেতে, একদম কচি ভদ্র মেয়ের মতো উঠে পড়ে সে। নইলে ভাইয়া ছাড়বে না যে। হায় রে বোকা বান্দি! রবের ভয়ে নয়, বরং ভাইয়ের ভয়ে সেহরি খেতে উঠেছে সে। সে কি জানে না সেহরির গুরুত্ব ও ফজিলত..?!

মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে রোযার জন্য সেহরী খাওয়া মুস্তাহাব এবং যে ব্যক্তি তা ইচ্ছাকৃত খায় না সে গোনাহগার নয়। আর এ কারণেই যদি কেউ ফজরের পর জাগে এবং সেহরী খাওয়ার সময় না পায়, তাহলে তার জন্য জরুরী রোযা রেখে নেওয়া। এতে তার রোযার কোন ক্ষতি হবে না। বরং ক্ষতি হবে তখন, যখন সে কিছু খেতে হয় মনে করে তখনই (ফজরের পর) কিছু খেয়ে ফেলবে। সে ক্ষেত্রে তাকে সারা দিন পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে এবং রমাযান পরে সেই দিন কাযা করতে হবে।

সেহরী খাওয়া যে উত্তম তা প্রকাশ করার জন্য মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উম্মতকে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি সেহরীকে বরকতময় খাদ্য বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা সেহরী খাও। কারণ, সেহরীতে বরকত আছে।’’ (বুখারী ১৮২৩, মুসলিম ১০৯৫নং) ‘‘তোমরা সেহরী খেতে অভ্যাসী হও। কারণ, সেহরীই হল বরকতময় খাদ্য।’’ (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৪০৮১নং)

ইরবায বিন সারিয়াহ বলেন, একদা রমাযানে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাকে সেহরী খেতে ডাকলেন; বললেন, ‘‘বরকতময় খানার দিকে এস।’’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে হিববান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৭০৪৩নং)

সেহরীতে বরকত থাকার মানে হল, সেহরী রোযাদারকে সবল রাখে এবং রোযার কষ্ট তার জন্য হাল্কা করে। আর এটা হল শারীরিক বরকত। পক্ষান্তরে শরয়ী বরকত হল, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পালন এবং তাঁর অনুসরণ।

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) এই সেহরীর গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তা দিয়ে মুসলিম ও আহলে কিতাব (ই**য়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) রোযার মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি অন্যান্য ব্যাপারে তাদের বিরোধিতা করার মত তাতেও বিরোধিতা করতে আমাদেরকে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া।’’ (মুসলিম ১০৯৬, আবূ দাঊদ ২৩৪৩, ফাসিঃ মুসনিদ ৯৮পৃঃ)

সেহরী খাওয়ার সময় হল অর্ধরাত্রির পর থেকে ফজরের আগে পর্যন্ত। আর মুস্তাহাব হল, ফজর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না হলে শেষ সময়ে সেহরী খাওয়া। আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, যায়দ বিন ষাবেত তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে সেহরী খেয়ে (ফজরের) নামায পড়তে উঠে গেছেন। আনাস বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেহরী খাওয়া ও আযান হওয়ার মধ্যে কতটুকু সময় ছিল?’ উত্তরে যায়দ বললেন, ‘পঞ্চাশ অথবা ষাটটি আয়াত পড়তে যতটুকু লাগে।’ (বুখারী ৫৭৫, ১৯২১, মুসলিম ১০৯৭, তিরমিযী ৭০৩নং)

এখানে আয়াত বলতে মধ্যম ধরনের আয়াত গণ্য হবে। আর এই শ্রেণীর ৫০/৬০টি আয়াত পড়তে মোটামুটি ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে। অতএব সুন্নত হল, আযানের ১৫/২০ মিনিট আগে সেহরী খাওয়া।

‘ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবাগণ খুব তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন এবং খুব দেরী করে সেহরী খেতেন। ‘ (বাইহাকী ৪/২৩৮, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৮৯৩২নং)

সুতরাং সেহরী আগে আগে খেয়ে ফেলা উচিৎ নয়। মধ্য রাতে সেহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া তো মোটেই উচিৎ নয়। কারণ, তাতে ফজরের নামায ছুটে যায়। ঘুমিয়ে থেকে হয় তার জামাআত ছুটে যায়। নচেৎ, নামাযের সময় চলে গিয়ে সূর্য উঠার পর চেতন হলে নামাযটাই কাযা হয়ে যায়। নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক। আর নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় মসীবত; যাতে বহু রোযাদার ফেঁ*সে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত করুন। আমিন।

তমস্র রজনী। পবিত্র মাহে রমজানের আজ তৃতীয় রোজা অতিবাহিত হয়েছে। তারাবীহ নামাজ আদায় করে বিছানায় বসে উক্তি। মাথা আবৃত হিজাবে। সতর ঢাকা তার। একনিষ্ঠভাবে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছে সে। সময় তখন রাত নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। কিছুটা সময় তিলাওয়াতে কেটে গেল। ঘরে আগমন হলো স্বামী মানুষটির। চোখ তুলে তাকালো উক্তি। দেখলো তার একান্ত মানুষটিকে। সারাটা দিন শেষে প্রিয় মানুষটির উপস্থিতিতে উৎফুল্ল হলো তনু মন। সম্মানের সহিত কুরআন শরীফ বুকে আগলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো উক্তি। কুরআন শরীফ যথাস্থানে রেখে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে সালাম জানালো।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”

ক্লান্ত কণ্ঠে সালামের জবাব দিলো মুয়ীয। এসে ধপ করে বসলো বিছানায় এক কিনারে। উক্তি এক গ্লাস পানি হাতে ছুটে এলো। মুয়ীয বাঁ হাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ডান হাতে নিলো পানির গ্লাস। তিন ঢোকে পানি পান করলো। উক্তি উপলব্ধি করতে পারছে স্বামী তার কতটা ক্লান্ত। এ মুহূর্তে বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই তো দুরন্ত পায়ে সরে গেল। আলনা হতে নিয়ে নিলো ধোয়া লুঙ্গি, গামছা ও স্যান্ডো গেঞ্জি। সেসব নিয়ে স্বামীর কাছে এলো। বাড়িয়ে দিলো। মুয়ীয স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই হাতে নিলো ওসব। ততক্ষণে শার্টের সকল বোতাম খোলা হয়ে গিয়েছে। দু হাত নড়িয়ে শার্টকে দেহ হতে মুক্ত করলো। ঘর্মাক্ত শার্টটা ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। উঠে দাঁড়ালো মুয়ীয। গলায় গামছা জড়িয়ে নিলো। লুঙ্গি পড়ে নিলো এবং খুলে ফেলল পরিহিত প্যান্ট। হাত বাড়িয়ে সে প্যান্ট হাতে নিলো উক্তি। মুয়ীয ধীরপায়ে ঘর হতে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য হাতমুখ ধুয়ে সতেজ হওয়া। পুরোটা সময় উক্তি ছিল একপ্রকার উহ্য। অবহেলিত। সে যেন সশরীরে উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত। স্বামী হতে অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রাপ্ত এ অবহেলা রমণীর হৃদয়ে গাঢ় আঁচড় এঁকে দিলো। আঁধারে তলিয়ে গেল গৌর মুখখানি।

রাত্রি তখন। বিছানায় পাশাপাশি বসে বিল্লাল ও বাবা তোফায়েল সাহেব। পিতা পুত্র ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামে পুরনো দিনের কিছু স্বর্ণালী মুহূর্তের ছবি দেখছে। পারিবারিক অসংখ্য মুহূর্ত এ অ্যালবামে বন্দি রয়েছে। ফটো দেখতে দেখতে একটি ফটোতে এসে থামলো বিল্লাল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘ বছর দেড় এর এক শিশু কন্যা বিছানায় বসে। হাতে একটি প্লাস্টিকের তৈরি পাতিল। একদৃষ্টিতে পাতিলের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি। ঠোঁটে অকৃত্রিম এক সোনা রোদ ঝলমল করে চলেছে। ‘

” মাশাআল্লাহ্! মাশাআল্লাহ্! কি কিউট লাগছে আমার বনুটাকে! কারো নজর না লেগে যায়। ”

পুত্রের কথায় সশব্দে হেসে উঠলেন তোফায়েল সাহেব।

” হা হা হা। কি যে বলো না বেটা। কার নজর লাগবে? ”

” কেন? তোমার একমাত্র বউ। রাক্ষসী রাণী কোহিনুরনী। ”

ছেলের অকপটে স্বীকারোক্তি শুনে স্তব্ধ বয়স্ক তোফায়েল!

” এসব কি বলছো বেটা? ”

” ঠিকই তো বলছি। বলি বাবা। দুনিয়াতে এত এত ইনোসেন্ট মেয়ে থাকতে তোমার নজর ওই কটকটি’তে গিয়ে আটকালো কি করে? হাউ? ”

তোফায়েল সাহেব বেদনাবিধুর হেসে বললেন,

” তখন ওই কটকটি যে ইনোসেন্ট ই ছিল। তাই। ”

অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলো বিল্লাল,

” হুঁ। বলছে তোমারে। মা আর ইনোসেন্ট! অসম্ভব। দিনরাত খালি কিভাবে ভেজাল লাগাবে সে ধান্দায় থাকে। ”

প্রসঙ্গ বদল করতে তোফায়েল সাহেব বলে উঠলেন,

” ছাড়ো না বেটা এসব। দেখো উক্তি মা’কে কি কিউট লাগছে! খেলনা সেটটা পেয়ে সেবার খুউব খুশি হয়েছিল। ”

” হবে না। ওটাই তো প্রথমবার ওর জন্য উপহার স্বরুপ ফুল সেট খেলনা ছিল। এর আগে কেউ কখনো দিয়েছে নাকি? দিলেও নামমাত্র খেলনা দিয়েছিল। তুমিই তো ফার্স্ট টাইম কোনো খেলনা সেট উপহার দিলে। একদম মনের মতো। ”

” কি করবো বলো? সবার মতো আমি তো আর অন্ধ হয়ে যাইনি। চোখ থাকতেও কি করে না দেখা করতাম? ”

বিল্লাল মৃদু কণ্ঠে বললো,

” সবাই এমনটা কেন করছে বাবা? আমাদের উক্তি কি করে অপয়া, অলক্ষ্মী হতে পারে? এ সম্ভব? ”

” জানি না বেটা। সবাইকে বলে বোঝাতে বোঝাতে আমি ক্লান্ত। ” তোফায়েল সাহেব দুঃখ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন।

অকস্মাৎ বিল্লাল কিছু একটা ভেবে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো,

” ইয়াহু! ”

” কি হয়েছে? কি হয়েছে? ” কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে তোফায়েল সাহেব।

” কি হয়েছে? তুমি শুধু দেখো বাবা। কি করি আমি। ”

মিটিমিটি হাসছে বিল্লাল। ছেলের ভাবগতিক ঠিক সুবিধার ঠেকছে না তোফায়েল সাহেবের নিকটে। ছেলে এমন বিটকেল হাসি হাসছে কেন? কি করতে চলেছে ও? হুঁ…?

চলবে।

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_১৯

” হ্যালো আসসালামু আ’লাইকুম। কে বলছেন? ”

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোর কাছাকাছি। ঘুমের প্রস্তুতিতে মগ্ন শহরবাসী। বাড়ির বাইরে এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে সে। বাঁ হাত ঠেকে গাছের দেহে। অপরিচিত এক ব্যক্তিকে সরাসরি মেসেঞ্জারে কল করে বসলো মুয়ীয হাসান। ওপাশ হতে সে ব্যক্তি অত্যন্ত বিনম্র কণ্ঠে সালাম দিয়ে পরিচয় শুধালো। মুয়ীযের শ্বাস প্রশ্বাস তখন অস্থির। বুকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠছে। করছে অবিরাম চঞ্চলতায় ভরপুর ওঠানামা। মুখশ্রী রাগে র*ক্তজবা। সে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুই কেডা? আগে হেইয়া ক। ”

” আজব কাণ্ড ভাইজান! রাতদুপুরে নিজে ফোন করে নিজেই আবার পরিচয় জানতে চাইছেন? কেন! এখনো বুঝে উঠতে পারেননি আমি কে হতে পারি? আপনার ওয়ান অ্যান্ড অনলি বউয়ের খুব কাছের একজন হই। সে-ই জন্ম লগ্ন থেকেই ওর সাথে আছি। পাশে আছি। ইনশাআল্লাহ্ চিরকাল থাকবো। ” মধুমাখা কণ্ঠে এক কেজি চিনি মিশিয়ে বললো অজ্ঞাত ব্যক্তি।

” আর মুই? হারা জীবন বাসন মাজতাম? ” অত্যন্ত ত্যাঁছড়া প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মুয়ীয।

ফোনের ওপাশে থাকা বিল্লাল এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বাউন্সে কেমন বোকা বনে গেল। চোখেমুখে হালকা অবাকতার রেশ!

” হা*লার পো হা*লা! হাছা কইরা ক। তুই কেডা? মোর বউরে চিনোছ ক্যাম্বালে? ”

তোফায়েল সাহেব আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে! ভাতিজি জামাই এমন মুখ খারাপ করছে কেন? পিতা ও পুত্র বসে ছিল পাশাপাশি। বিল্লালের হাতে মোবাইল। লাউডস্পিকার চালু করা। বিল্লাল অসহায় কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো বাবাকে,

” বাবা। গালি দেয় তো। ”

উনিও ফিসফিসিয়ে বললেন,

” একদম ঠিক আছে। আরো করো রাতবিরেতে প্র্যাঙ্ক। ”

” আমি আবার কি করলাম? শুধুমাত্র বেবি দুষ্টুমি তো। ”

কাঙ্ক্ষিত জবাব তো মিলছেই না। উল্টো ফোনের ওপাশ হতে ফুসুরফুসুর গুজুরগুজুর শোনা যাচ্ছে। মেজাজ চড়ে গেল হাসান সাহেবের।

” আব্বে ওই! কথা কছ না ক্যা? মোর বউয়ের ছোডোকালের ছবি তুই কোম্বে পাইলি? ক্যামনে চিনোছ ওরে? ”

বিল্লাল এমনতর বিনোদনদায়ক মজা নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। মিটিমিটি হেসে বললো,

” এত অবুঝ সাজবেন না ভাইজান। আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন। আপনার মন ঠিক বুঝতে পেরেছে। হ্যাঁ, আমি সে-ই। ”

” শ্লা! তোরে সামনে পাইলে পাড়া দিয়া এক্কারে নড়লী ছুডাই হালাইতাম। মোর লগে মশকরা করোছ? ”

এত এত গালিগালাজের ভারে নুয়ে পড়ছিল পিতা ও পুত্র। বিল্লাল হাত কামড়ে কেঁদে দেবার উপক্রম। জীবনে আর কোনোদিন রাতদুপুরে প্র্যাঙ্ক করতে যাবে না সে। এই প্রমিস। পাক্কা ওয়ালা প্রমিস। তোফায়েল সাহেব ছেলেকে ইশারায় বললেন,

‘ কল কেটে দাও বেটা। নইলে রাতভর গালির বর্ষণ হবে। কার বউ নিয়ে প্র্যাঙ্ক করতে গিয়েছো তুমি, বুঝতে পেরেছো কি? ‘

‘ জ্বি আব্বা বুঝছি। ‘

রমজান মাসে মজুদে থাকা সকল গালি একে একে চালান করতে লাগলো হাসান সাহেব। ওদিকে কান দিয়ে ধোঁয়া বেড়োচ্ছো বাকি দু’জনের। মুয়ীয উপহার দিলো জঘন্য এক গালি,

” ** ”

আর সইতে পারলো না ওরা। চট করে কল কেটে দিলো বিল্লাল। ফোঁস করে ইয়া লম্বা এক শ্বাস ছাড়লো। কাঁদো কাঁদো চেহারায় তাকালো বাবার দিকে।

” আব্বা! দুনিয়ার কোন দুলাভাই তার আপন শা*লাকে এভাবে মুখের ওপর হা*লার পো হা*লা বলে? বলো না? ”

তোফায়েল সাহেব ঘন শ্বাস ফেলে বললেন,

” জানি না বেটা। আমি কিছু জানি না। ভাগ্যিস রোজা রেখে এই ফোন কলে কথা হয়নি। নইলে নির্ঘাত রোজা হালকা হয়ে যেতো। গালির কি ছিড়ি! ”

হতাশাজনক কণ্ঠে বিল্লাল বলে উঠলো,

” সে আবার বলতে? আমার তো এখন নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে মন চাইছে। কোন দুঃখে যে ভাইয়ার সাথে মেসেঞ্জারে আঁতলামি করতে গেলাম। এখন বোঝো ঠ্যালা। কান রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করছে। ”

” হুঁ। ”

ছোট্ট করে বললেন তোফায়েল সাহেব। উঠে দাঁড়ালেন বিছানা ছেড়ে। বিল্লাল আনমনে একাকী বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

” উক্তি বোন আমার! তোর ট্যালেন্টেড বরের এমন সুন্দর ট্যালেন্ট সম্পর্কে তুই জানিস কি? এত সুন্দর, মনোরম গালি! আহা! কান দু’টো এখনো অঝোরে কাঁদে! ”

মাথার ওপর দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। বিনা দ্বিধায় তিন চারটে বারবিকিউ সুন্দর মতো তৈরি হয়ে যাবে। মুখখানা এমন লাল হয়েছে যেন কোনো চিত্রশিল্পী অপটু হাতে লাল রঙের আঁকিবুঁকি এঁকেছে। ঘামে ভেজা দেহটা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মুয়ীয। এসেই চক্ষু জোড়া ব্যস্ত হয়ে পড়লো সঙ্গিনীর খোঁজে। বেশি খুঁজতে হলো না। চট করে চক্ষু দৃষ্টি খুঁজে পেল তারে। বিছানায় শুয়ে উক্তি। বুকে ভর দিয়ে কোমল দেহ। মেঘবরণ কেশরাশি ছড়িয়ে পিঠের ত্বকে। পড়নে মেজেন্টা রঙের সুতি শাড়ি। ব্লাউজ। শাড়ি পরিহিতা উপুড় হয়ে শায়িত রমণী নিঃসন্দেহে একান্ত পুরুষের দৃষ্টিতে লাস্যময়ী! তবে আজ আর মতিভ্রম ঘটলো না। সশব্দে দরজার ছিটকিনি ভেতর হতে আটকে দিলো মুয়ীয। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে গেল বিছানায়। উঠে পড়লো সেথায়। ডান হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো। একটুও কালক্ষেপণ না করে একদম নির্দয়তার সহিত টেনে ধরলো উক্তির বাম কনুই। হেঁচকা টানে শোয়া হতে তুলে ফেললো। ধড়ফড়িয়ে উঠলো মেয়েটা। লহমায় তীব্র গতিতে আছড়ে পড়লো স্বামীর চওড়া প্রশস্ত বক্ষ সীমায়। নয়নে বন্দী হলো দু জোড়া নয়ন। অশ্রুমাখা চোখ দুটোয় উপস্থিত সীমাহীন অভিমানের ছোঁয়া। আর সে মানুষটির অন্তরে ঈর্ষার কূয়া। স্ত্রীর দু হাত শক্ত করে চেপে ধরলো মুয়ীয। চট করে কোমল নরম হাত, স্বীয় শক্ত দু’টো মুঠোয় বেঁধে চেপে ধরলো উক্তির পিঠে। দুজনার বক্ষদেশ ছুঁয়ে। উক্তি ব্যথায় মৃদু গুঙ্গিয়ে উঠলো। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মুয়ীয অভব্য স্বরে শুধালো,

” পোলাডা কেডা? তোর ছোডোকালের ছবি কোম্বে পাইলো?”

উক্তি তো ভাই বিল্লালের দুষ্টুমি সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। জানে না সেসবের বিন্দুবিসর্গও। এছাড়াও মনে জমেছে কৃষ্ণকালো মেঘ। তাই তো দৃষ্টি সরিয়ে বামে স্থির করলো উক্তি। অভিমানে ফুলেছে ঠোঁট। ফুলেছে গাল। এত আদর আদর লাগছে কেন? এভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ায় ক্ষেপে গেল বুনো ষাঁড়। নিজের বুকে আরো শক্ত রূপে চেপে ধরলো স্ত্রীকে। ফলস্বরূপ উক্তি ব্যথা পেয়ে স্বামীর দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। মানুষটি হিসহিসিয়ে শুধালো ওকে,

” পোলাডা কেডা? হাছা কইরা ক। আর মটকা গরম করিস না ছেমড়ি। ”

উক্তি’র ঠোঁটজোড়া স্বল্প কেঁপে উঠলো। মুখনিঃসৃত হতে লাগলো গরম শ্বাস। চক্ষু গড়িয়ে গালে নামলো বারিধারা। অকস্মাৎ কি হলো কে জানে! মুয়ীয হাসান নামক নির্দয় পুরুষটির ক্ষ্যা’পা মস্তিষ্ক একদম শান্ত হয়ে গেলো। নদীর জলের ন্যায় শান্ত। স্থির। স্ত্রীর দু চোখে নোনাজলের উপস্থিতি। তা-ও কিনা শুধুমাত্র ওর জন্য? এ কেমন স্বামী সে? যার জন্য স্ত্রীর চোখে জল? সে যে মস্ত বড় অধম। তৎক্ষণাৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল পুরুষটা‌। ঢিলে হলো শক্ত হাতের বাঁধন। ডান হাতটি স্থাপন করলো স্ত্রীর বাঁ গালে। নমনীয় স্বরে আকুল হয়ে প্রশ্ন করলো,

” অ্যাই? কি হইছে তোর? কান্দোস ক্যা? ”

এত নমনীয় স্বরে অভিমানের পাহাড় চড়চড় করে ভেঙ্গে গেল বোধহয়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি গড়িয়ে নামছে দু’চোখ বেয়ে। উক্তি জোরপূর্বক নিজেকে স্বামীর বাহুবেষ্টনী হতে মুক্ত করতে উদগ্র হয়ে উঠলো। এতে অসহায়ত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল মুয়ীয। বউ এমন করছে কেন? কেন ওর থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে? সে কি এতটাই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছে? যার জন্য ওর উপস্থিতি, স্পর্শ সে সইতে নারাজ। না না না। মুয়ীয বিন্দুমাত্র দূরত্ব সইতে নারাজ। সে আরো সযতনে নিজের বুকে আগলে নিলো সঙ্গিনীকে। আকুলতম স্বরে ডেকে উঠলো,

” অ্যাই বউ? কান্দে না। মুয়ীয স্যরি তো। ”

এ প্রথমবারের মতো নিজ কোনো আচরণের জন্য স্ত্রীর নিকটে সে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আজ যে ক্ষমা করতে নারাজ মিসেস উক্তি। এই মানুষটি পঁচা। তার সুন্দর ফুরফুরে মেজাজ নষ্ট করে দিয়েছে। অবজ্ঞা করেছে তাকে। কষ্ট দিয়েছে খুব। সে আর থাকবে না এই লোকটির সাথে। লোকটা ভালো না। পঁচা। খুব খুব পঁচা। উক্তি ছটফটিয়ে চলেছে। নিজেকে ছাড়াতে চাইছে। বারংবার মুখনিঃসৃত হচ্ছে ‘ আঃ ‘ সূচক দুর্বোধ্য ধ্বনি। স্ত্রীর এমনতর প্রতিক্রিয়ায় ভড়কে গেল মুয়ীয। স্ত্রীর এই রূপ তার নিকট অচেনা। নয়া। তবুও ঠাণ্ডা মাথায় সবটা সামাল দিতে হবে। আর একফোঁটাও কষ্ট দেয়া যাবে না তার প্রিয়তমাকে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শক্ত বাঁধনে স্ত্রীকে নিজের সনে আগলে রেখেছে মুয়ীয। উক্তি দু হাত এলোপাথাড়ি সঞ্চালন করে চলেছে। নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। চোখমুখের অবস্থা বেহাল। অঝোরে কেঁদেকেটে রক্তজবার রঙে রেঙেছে সে। দু’জনের মধ্যে যেন অদৃশ্য হুড়োহুড়ি লেগে গেল। আকস্মিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো উক্তি। বিছানায় ধপাস করে আছড়ে পড়লো সে। আর তার কমনীয় দেহবল্লরীতে ঠাঁই মিললো জনাব হাসানের। উক্তি কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। এই সামান্য প্রচেষ্টার বিনিময়ে যে প্রতিক্রিয়া এলো তা ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়! অভাবনীয়! পুরুষালী অধরোষ্ঠের অন্তরঙ্গতায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লুণ্ঠিত হতে লাগলো উক্তি’র গোমড়া মুখোভাবের প্রতিটি ফোঁটা। উক্তি কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ পেল না। পেল না নিজেকে এই আকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, মায়া হতে সরিয়ে নেয়ার। তার শরীরে বহমান উষ্ণ র”ক্ত যেন এ আদর সোহাগের আতিশয্যে হিমায়িত হয়ে যাচ্ছে। রমণীর চক্ষু ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। চোখের পাতায় নামলো আঁধার। আনমনেই নিজের সঙ্গে আগলে নিলো স্বামীকে। প্রায় মিনিট বিশেক কাটলো তাদের স্বপ্নপুরীর মতো নান্দনিক মূহুর্তে!
.

বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে মুয়ীয, উক্তি। একে অপরের দিকে ঘুরে শুয়ে তারা। মুয়ীযের চোখেমুখে দুষ্টু আভা। লজ্জা মিশ্রিত অবনত চাহনিতে উক্তি। গাঢ় আদরমাখা স্বরে ডেকে উঠলো মানুষটি,

” বউ! ”

আহা! হৃদয় শীতলীকরণ করা সে ডাক। অন্তর ভেদ করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। উক্তি একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। ওই দুষ্টু চাহনি তাকে যে শান্তি দিতে নারাজ।

” ও বউ? কেমন লাগলো মান ভাঙ্গনের বিশেষ পদ্ধতি? পুরা আগুন না? ”

লজ্জার চরম বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হয়ে উক্তি। তপ্ত হয়ে উঠছিল দুই কান। লালিমায় রঙিন মুখশ্রী। মুয়ীয নয়ন জুড়িয়ে সে মুখশ্রী দেখলো! হলো মুগ্ধ! লোকটা আসলেই খুব পঁচা। মুয়ীয আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হলো। ওকে বললো,

” বহুত মন কেমন করতাছিল? ক্যান? কি হইছে? ”

উক্তি সত্যিটা বলতে চাইলো না। ইশারায় বোঝালো কিছু হয়নি। কথাটা ঠিক মনঃপুত হলো না মুয়ীযের। সে বললো,

” উহু। মিছা কথা কবি না। হাছা কইরা ক, কি হইছে। ”

উক্তি চট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মিথ্যা ভাব লুকোতে বললো,

” কিছু হয়নি তো। ”

মুয়ীয অকস্মাৎ ওর হাত ধরে টেনে নিলো। একদম নিজের বাহুবন্ধনে। শিহরণে রমণীর শ্বাস প্রশ্বাস উথালপাথাল। প্রিয় নারীর কপালের ঠিক মধ্যিখানে ক্ষুদ্র চুমু এঁকে দিলো পুরুষটি। অনুরোধের স্বরে বললো,

” মোর ধারে কবি না বউ? মুই তো তোর জামাই লাগি। সবচে আপন জন। মোর লগে আবার কিয়ের লুকোচুরি? ক না বউ, কি হইছে? ”

এমন অনুরোধের স্বর আসলেই চমকপ্রদ ছিল! উক্তি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না ওর আপত্তি সত্ত্বেও মানুষটি কিভাবে এত ধৈর্য ধরে আছে? ওকে সত্যি বলতে অনুরোধ করছে। আজ এখানে অন্য কেউ হলে কি, সে মানুষটি রাগে গজগজ করে উঠতো না? অবশ্যই উঠতো। নিঃসন্দেহে উঠতো। উক্তি এবার সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়লো। আর লুকোচুরি করা সম্ভব নয়। সে আস্তে ধীরে গলনালী সিক্ত করে নিলো। নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। ধীরে ধীরে হাতের ইশারায় বলতে লাগলো,

” আপনি আজ… ”

মুয়ীয জিজ্ঞাসু, কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে।

” বাহির থেকে এসে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিলেন। আমার দিকে একবারের জন্য ফিরেও তাকাননি। কথা বলেননি। আজকের আগে তো কখনো এমনটা হয়নি। আজই প্রথম হলো। তাই জানিনা কেন.. খুব অভিমান হলো। খারাপ লেগেছিল। অবশ্য খারাপ লাগার কথা নয়। সব দিন তো আর এক নয়। সবসময় কি আর সবাইকে প্রাধান্য দেয়া যায়? ”

শেষের কথাটিতে মিশে ছিল অফুরন্ত অভিমান। সে কি মুয়ীয হাসান উপলব্ধি করতে পারলো?

চলবে।