তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-২৩+২৪

0
91

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২৩

” কইলাম না যা ভাগ এহান থে। কেন বিরক্ত করতাছোছ? দূর হ মোর চোখের সামনে থে। ”

মুয়ীযের রাগত, বিরক্তিকর কণ্ঠে উক্তি বড় কষ্ট পেল। আঘাত হানলো মনে। তবুও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সে কাছে এলো। স্বামীর কাঁধে আলতোভাবে হাতটি রেখে ইশারায় বললো,

‘ চলুন খাবেন। ‘

মুয়ীয আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকিয়ে! এ কি মাটির তৈরি নারী? নাকি কোনো লৌহ মানবী? এত রাগ, অপমান, অবজ্ঞা সহ্য করে যাচ্ছে কি করে? সে তো পারছে না। নিজের এই অপারগতা, অক্ষমতা, লোকের বাঁকা দৃষ্টি সহ্য করতে পারছে না। শরমে মরমে কখনো কখনো ভুলক্রমে মৃ ত্যু কামনা করে ফেলছে। যা সম্পূর্ণ অনুচিত। তবে উক্তি কায়সার নামক এ রমণী কি করে পারছে? কেন এত নিঃস্বার্থভাবে ভালো বাসছে তাকে? সে কি এসবের যোগ্য? উহু। যোগ্য নয়। ম রে যাওয়া উচিত তার। কিংবা চিরতরে হারিয়ে গেলেই উত্তম।

.

বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মুয়ীয। ভাবনার সুতা আস্তে করে ছিন্ন হলো। উক্তি তার মুখে পুরে দিলো এক নলা ভাত। ভর্তা বানানো হয়েছে আজ বাড়িতে। আলু ভর্তা, রসুন ভর্তা আর ধনেপাতা ভর্তা। রসুন ভর্তা মেখে উক্তি খাইয়ে দিচ্ছে তাকে। বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হয়না আজ বেশ কতদিন হলো। এই টুকটাক রান্নাই হয়। ভালো মাছ বাড়িতে আনা হয়না আজ প্রায় তিন সপ্তাহ। সে তো অক্ষম হয়ে বাড়িতে পড়ে। সংসারের যাবতীয় দায়ভার এখন বড় ভাইয়ের কাঁধে। ভাই মাস তিনেক হয় এক গার্মেন্টসে চাকরি পেয়েছে। জু`য়া, ম°দের প্রবল নে শা হতে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ ছিল না মারুফের জন্য। সে চেয়েছে। মনেপ্রাণে চেয়েছে পাপের ওই দুনিয়া হতে বেরিয়ে আসতে। এজন্য অদম্য লড়াই করতে হয়েছে বারংবার।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, নে শা উদ্রেককারী প্রতিটি বস্তু ম-দের অন্তর্ভুক্ত। আর নে শা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তু হারাম। যে ব্যক্তি একবার নে শা উদ্রেককারী জিনিস পান করলো সে তার চল্লিশ দিনের সালাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো।

সে যদি তওবা করে আল্লাহ্ তার তওবা কবুল করতে পারেন। সে যদি চতুর্থবার তা পান করে তবে আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামীদের ঘা থেকে নির্গত পুঁ জ খাওয়াবেন। (আবু দাউদ : ৩৬৮০)

রাতের আঁধারে নিজ ঘরে নে শাদ্রব্যের জন্য তুমুল পা`গলামি করতো মারুফ। ছটফট করতো। খামচে ধরতো মাথার চুল। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইতো চুলগুলো। জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতো সে। একটুখানি নে শা করার জন্য আকুতিতে ফেটে পড়তো। ওর এই ভয়াবহ অবস্থা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশে ভয় পেতো জীবন। কাকির কোমর জাপটে ধরে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপতো। উক্তি তৎক্ষণাৎ কোনোরকম বুঝিয়ে শুনিয়ে জীবনকে নিয়ে সেথা হতে চলে যেতো। মুয়ীয ও জান্নাত যথাসম্ভব সামলে নিতো মারুফকে। উক্তি শিক্ষিতা রমণী। ইন্টারনেট দুনিয়ায় সে বেশ অভ্যস্ত। অবসর পেলেই নেট ঘেঁটে ঘেঁটে বিভিন্ন পদ্ধতি বের করতো সে। নে`শার জগত থেকে কিভাবে বের হওয়া যায় সেসব দেখতো। শিখতো। সে-ই অনুযায়ী জান্নাতকে টিপস্ দিতো উক্তি। জান্নাত শুনতো। ঠেলায় পড়ে মানতে বাধ্য হতো। দুই জা মিলেমিশে নিজেদের সেরাটা দিয়েছে। মারুফের সুস্থতায় তাদের অবদান কম নয় বৈকি।

মারুফ আজ মহান রবের সীমাহীন রহমতে নে`শার জগত হতে বেড়োতে সক্ষম হয়েছে। মন দিয়ে চাকরি করছে সে। ছোট ভাইয়ের অসুস্থতায় পুরো পরিবারের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। তাই তো সবটা যথাসম্ভব সামাল দিতে ঘন্টা কয়েক ওভারটাইম করছে সে। এতে মাস শেষে বেতনের পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু অর্থ মিলছে। কঠোর পরিশ্রম করছে সে। চাইছে তার পরিবার একটুখানি ভালো থাকুক।

উক্তি আরেক নলা মুখে পুরে দিলো। মুখে অরুচি। মনে দহনের পীড়া। তবুও অনিচ্ছুক চিত্তে স্ত্রীর হাতে খাবার খেতে লাগলো মুয়ীয। খাওয়া শেষে মুখটা ধুয়ে দিলো উক্তি। শাড়ির আঁচলে মুছে দিলো ভেজা ঠোঁট দু’টো। বাড়িয়ে ধরলো পানির গ্লাস। এক ঢোক পানি পান করলো মানুষটা। গ্লাস তার হাতে। উক্তি হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ হতে ওষুধের বক্স হাতে নিলো। সেখান থেকে ওষুধের পাতা হতে ছিঁড়ে নিলো এ বেলার ওষুধগুলো। মুয়ীয হাত বাড়িয়ে ওষুধ নিলো। বেদনাবিধুর হেসে পানির সঙ্গে ঢক ঢক করে গিলে নিলো ওষুধ। উক্তি জখম হৃদয়ে বসে। উপলব্ধি হলো আরো একবার ‘ ভালো নেই তার মানুষটি। ‘

~

এঁটো প্লেট ও গ্লাস হাতে মাঝের ঘরটিতে পৌঁছালো উক্তি। বাকি সব নোংরা প্লেটের সঙ্গে এটিও রাখতে যাচ্ছিল। সব নিয়ে ধুতে যেতে হবে কলপাড়ে। অকস্মাৎ শোনা গেল মেয়েলি আদেশের কণ্ঠস্বর,

” খাড়ান ভাবী। ”

পরিচিত কণ্ঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল উক্তি। প্লেট হাতে ঘুরে তাকালো ডানে। দাঁড়িয়ে বড় জা জান্নাত। জান্নাত এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। কেমন দৃষ্টি ফেলে তাকালো ওর হাতের এঁটো প্লেটে।

” কি? খাইছে আমনের জামাই? ”

উক্তি হঠাৎ এমন প্রশ্নের হেতু খুঁজে পেল না। তবুও হালকা মাথা নাড়িয়ে বোঝালো হ্যাঁ, খেয়েছে। জান্নাত বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললো,

” আপনে ভার্সিটিতে পড়েন ভাবী। তয় বোধবুদ্ধি এহনো ঠিক মতন হয় নাই। কি লাভ হেইলে এত পড়ালেহা কইরা? খরচা কইরা? ”

উক্তি’র কপালে সরু ভাঁজ সৃষ্টি হলো। হাতের ইশারায় বললো,

‘ ঠিক বুঝলাম না ভাবী। ‘

” হ্যা বোঝবেন ক্যা? বোঝবেন তো খালি নিজেগো স্বার্থডা। ”

উক্তি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ভাবী এমন ওলটপালট বকছেন কেন? আবার কি থেকে কি হলো? সে তো ভুলেও কোনো ভুল করেনি।

” বড় বউ! আবারো ফাও কথা শুরু করছো? ”

জান্নাত কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে শাশুড়ি মায়ের কণ্ঠস্বর তাকে বাঁধা দিলো। দুই পুত্রবধূই ঘুরে তাকালো শাশুড়ির দিকে। উক্তি ভালোমতো সোজা হয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো। জান্নাত অভব্য স্বরে শাশুড়িকে বললো,

” হ। আমার কথা তো খালি ফাও-ই হয়। বাকিরা একছের ভালো কয়। ”

” সন্দেহ আছে নি? ” বাঁকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মোমেনা বেগম।

” শোনেন মা। এইয়া কওনের লেইগ্গা আহি নাই। ম্যালা কাম আছে আমার। ”

” তো কি কইতে চাও? হুনি একটু। ভালা তো আর কইবা না।”

জান্নাত এ প্রসঙ্গে বাকবিতন্ডা সৃষ্টি না করে সরাসরি বলে বসলো,

” আপনার ছোড বউ এমন বিবেক বুদ্ধিহীন ক্যা, মা? জিগান তো হ্যারে। ”

মোমেনা বেগম একঝলক উক্তি’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

” কি করছে অয়? ”

” আপনার বড় পোলায় কাইল কতগুলা রসুন আনছে। হ্যার নাকি রসুন ভর্তা খাইতে মন চাইছে। ভালো কথা। আইজ কতবার কইরা কওনের পর অবশেষে আপনার আদরের বৌমা ভর্তা বানাইছে। ভালো কথা। তয় ভর্তা বানাইয়া নিজেই যদি এতগুলা খায়, জামাইরে খাওয়ায়। আর মাইনষে কি খাইবে? কচু? ”

এমন মিথ্যের ফুল ঝুঁড়িতে উক্তি হতবিহ্বল হয়ে গেল! চোখের কোণে পানি থৈ থৈ। এভাবেও মিথ্যা অপবাদ দেয়া সম্ভব? উক্তি খিদে সত্বেও এখনো খাবার খায়নি। শুধু স্বামীকে খাইয়ে আসলো মাত্র। তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় কম কম ভর্তা নিয়েছে সে। পাছে অন্যের টাকায় খাওয়ার খোঁটা না শুনতে হয়। সে-ই শুনতেই হলো? আর কতকাল মিথ্যা অপবাদে অভিযুক্ত হতে হবে তাকে? জীবনভর কি এমনই কেটে যাবে? দুঃখের অতলে ডুবে?

” আপনার পোলা খিদা পেটে পেটটা ভইরা খাইতে পারে নাই মা। এট্টুখানি ভর্তা। বাকিরা কি খাইবো হেই চিন্তায় শেষ। আপনার পোলা দিনরাত এক কইরা খাটতাছে মা। র ক্ত পানি কইরা কাম করতাছে। মাইনষে তো ঘরে বইয়া বইয়া খাইতাছে। বুঝবো ক্যামনে কষ্টার্জিত উপার্জন কারে কয়? ”

মোমেনা বেগম না চাইতেও হালকা শব্দহীন হেসে ফেললেন। সে হাসিতে ভড়কে গেল জান্নাত। উক্তিও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মোমেনা বেগম আকস্মিক হাসি থামিয়ে সুগম্ভীর স্বরে বললেন,

” কথায় আছে জানো তো ‘ছোডো মাছ গভীর পানিতে লাফায় বেশি।’ দাপায় ছাটায়। তোমার অবস্থা হইছে হেইয়া। ছিলা তো ফ`কিন্নি। বেকার, জু`য়াখোরের বউ। অহন একটু টাহার মুখ দেখতেই সাপের পাঁচ পা দেইখ্যা হালাইছো। অকৃতজ্ঞ বান্দি! ”

অচিন্তিতপূর্ব এমন বাক্যের দাপটে ভিত নড়ে উঠলো জান্নাতের। সে বোধহীন নজরে তাকিয়ে শাশুড়ি ও জায়ের দিকে। এমন সোজাসাপ্টা অপমান! তাদের খেয়ে তাদেরই তুচ্ছতাচ্ছিল্য! রাগে, ক্ষো’ভে মূক হয়ে গেল জান্নাত। ভেতরে জ্বলেপু’ড়ে ছারখার হচ্ছে। তবে মুখ ফুটে বলতে পারছে না কিছুই। জলন্ত আগুনে ঝলসানো দৃষ্টিতে উক্তি’র দিকে তাকালো সে। অতঃপর হনহন করে সেথা হতে প্রস্থান করলো। উক্তি কৃতজ্ঞতায় ভরা চোখে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে। মোমেনা বেগম সেসবে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজ কাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। একাকী দাঁড়িয়ে উক্তি। চোখে সুখদুঃখের মিশ্র অশ্রুবিন্দু জমে। ওদিকে এক ব্যর্থ পুরুষের হাহাকার-আর্তনাদ চাপা পড়লো চার দেয়ালের বদ্ধ বেষ্টনীতে।

গভীর রাত তখন। ঘুমে আচ্ছন্ন গোটা শহর। কেউবা জেগে যান্ত্রিক ডিভাইসে, কেউবা অ`শ্লীলতায়। রবের সন্তুষ্টি অর্জনে ক’টা প্রাণ জেগে? খুঁজে পাওয়া বড় মুশকিল। সংখ্যাটা যে অতি নগন্য। সে নগণ্য সংখ্যক মানুষের ভীড়ে উক্তি কায়সার অন্যতম একজন। বিগত দিনগুলোর ন্যায় আজও সে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে সেজদায়। কাঁদছে অঝোরে। ছোট-বড় সকল গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে, রবের ভালোবাসা পাওয়ার লো ভে, স্বামীর সুস্থতা আশা করে… কাঁদছে সে। কাঁদছে আরো কত কারণে।

মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,

‘আল্লাহ্ তা’য়ালা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’ (বুখারি ও মুসলিম)।

উক্তিও ডাকছে স্রষ্টাকে। তাঁর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। কাঁদছে পূর্ববর্তী গুনাহের জন্য। কান্নার দমকে মেয়েটির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রবের দরবারে ফিসফিসিয়ে কি কি বলে কাঁদছিল উক্তি। যে ফিসফিসানি ও কান্না শুধু পৌঁছায় ওই মহা পরাক্রমশালীর নিকটে। তাহাজ্জুদের সালাতে মগ্ন রমণী। জানলোও না বিছানায় শায়িত পুরুষটির ভেজা চোখ শুধু তার অর্ধাঙ্গীতেই নিবদ্ধ। সে-ও কাঁদছে। নিজ মূর্খতা, গুনাহের জন্য কাঁদছে। মনেপ্রাণে চাইছে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। সহস্রাধিক বার শুকরিয়া আদায় করছে এমন ভাবনাতীত সুন্দর, সরলমনা নারীটির স্বামী হতে পেরে।

মুয়ীয অসুস্থ প্রায় দু’মাস হতে চলেছে। চাকরিচ্যুত হয়েছে সে বেশ আগেই। রাজশাহী ভ্রমণ। এরপর অনাকাঙ্ক্ষিত আ’ক্রমণ। অসুস্থ দেহে হাসপাতালে যখন ভাঙ্গা পা নিয়ে শুয়ে… খবর এলো চাকরিটা আর নেই। এমডি স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন। বড় স্নেহ করতেন ওকে। উনি এখন অবসরে। ওনার জায়গায় এমডি পদে এসেছে ওনার কনিষ্ঠ পুত্র। বয়স কম‌। নিজেকে অধিক বিচক্ষণ মনে করা। কাজে গাফিলতি। অন্যের ওপর অহেতুক হুকুমদারি। সকল গুণই রয়েছে নতুন এমডির। সে আসার পর থেকেই মুয়ীয কেমন তার চক্ষুশূল হয়ে গেল। হয়তো ঈর্ষার বশে কিংবা অজানা কোনো কারণে মুয়ীযকে ওনার সহ্য হয় না। চরম অসহনীয় লাগে ওর সামান্যতম উপস্থিতি। ওর চাকরিটা তো এই বান্দাই কেড়েছে। নামমাত্র কর্মী ছাঁটাইয়ের নামে ওকেও অফিস থেকে বের করে দিলো। এরপর থেকে পঙ্গু, অক্ষম শরীরে ঘরে বসে ধুঁকে ধুঁকে ম`রছে মুয়ীয হাসান।

বর্তমানে বাড়ির উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি মারুফ। মুয়ীযের বড় ভাই। তার টাকাতেই ঘরসংসার চলছে। ওর ওষুধপত্র চলছে। এই নিয়ে কম অশান্তি হয়নি বিগত দু’মাসে। জান্নাত সময় নেই অসময় নেই দিবারাত্রি কোনো না কোনো বাহানায় অশান্তি করেছে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করেছে। সে ঝগড়ায় চরম অসহায় হয়ে পড়েছে মুয়ীয, উক্তি দম্পতি। জান্নাত চায় না তার স্বামীর কষ্টার্জিত পয়সায় বাইরের কেউ একবিন্দুও ভাগ বসাক। ওই টাকায় শুধুমাত্র তার ও তাদের একমাত্র সন্তানের অধিকার রয়েছে। অন্য কারো নয়। তবে পুরো গুষ্টি কেন ওদের অন্ন ধ্বংস করবে? কেন ওদেরটা খাবে, পড়বে? এতে কি ওদের অর্থসম্পদ দ্রুত শেষ হয়ে যাবে না? সঞ্চয়ে ভাটা পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। এই নিয়েই তো যত অশান্তি।

মুয়ীয অক্ষম। তবুও ঘরে বসে সে প্রতিনিয়ত কাজের খোঁজ চালিয়ে গেছে। প্রথম একটা মাস জোরপূর্বক ভাইয়ের টাকা গিলতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর আর সহ্য করা গেল না। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মুয়ীযের জন্য দিনের পর দিন ওই টাকা ছিল, বি`ষ গেলার মতো যন্ত্রণাদায়ক। তাই তো নিজের ব্যাংকে সঞ্চিত সামান্য অর্থ ভাঙতে বাধ্য হলো। ব্যাংকে তো বেশি টাকা রাখার সৌভাগ্য হয়নি। ও-ই হাজার ষাটেক বোধহয়। এত বছরে এর বেশি হবে কি করে? সংসারের ঘানি টানতে টানতে আর সম্ভব হয়নি যে। জীবনের চরম বিপর্যয়েয় সময়ে ওই টাকাটুকু কাজে এলো। খুবই সীমিত অর্থ পাই টু পাই হিসাব করে সংসারে ব্যয় করতে লাগলো ওরা। খাবারে, চলনবলনে এলো বিস্তর পরিবর্তন। কোনোমতে খেয়ে খিদে নিবারণ করছিল তারা। ঝোঁকের বশে পুরোটা অর্থ শেষ করার মতো অবিবেচক কাণ্ড করেনি।

উক্তি! সে-ও তো অক্ষম। মূক। টিউশনি করে যে দু’টো পয়সা উপার্জন করবে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কোনো বোবা মেয়েকে কে জেনেশুনে টিউটর হিসেবে রাখবে শুনি? কেউই রাজি হচ্ছিল না। শিক্ষা ছাড়া উক্তি’র অন্য কোনো পুঁজিও ছিল না। কি করবে, কি করবে ভেবেই দিশেহারা। স্বামীর এই দুর্দিনে হাত-পা গুটিয়ে থাকবে? এতটাই অক্ষম, অকর্মণ্য সে! রবের দরবারে কাঁদলো উক্তি। সাহায্য ভিক্ষা চাইলো। অবশেষে দেখা মিললো এক চিলতে আলোর। এলাকার এক বড় ভাবী কিভাবে যেন ওদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে। উনি এলেন। স্বেচ্ছায় এক প্রস্তাব পেশ করলেন। অপ্রত্যাশিত সে প্রস্তাবে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো উক্তি। মুয়ীয পাশেই বসে। ছলছল চোখে তাকিয়ে স্ত্রী পানে। এতটাই অক্ষম, অপরাগ সে…?

চলবে।

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২৪

” ভাবী! আপনার তাইলে কি মতামত? কাজ শিখবেন? ”

উক্তি অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে স্বামীর শুকনো মুখে। মুয়ীয নিশ্চুপ। সুস্থ, সক্ষম অবস্থায় সে-ই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী বাইরে গিয়ে কাজ করবে, অতিরিক্ত পরিশ্রম করবে এমন ভাবনা কখনোই ছিল না তার। তার উক্তি, তার ঘরের রাণী। রাণীর মতো বাঁচবে সে। রাজ করবে শুধু ওই কাঠখোট্টা, বেপরোয়া হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। এ-ই তো ছিল সামান্য চাওয়া। অথচ আজ? পরিস্থিতির শিকার হয়ে পঙ্গু সে পড়ে বিছানায়। আর স্ত্রী? তাকে এখন দুর্দিনে এই স্থানীয় ভাবী সহায়তা করতে এসেছে। ভাবীর এলাকায় নিজস্ব এক ছোট সংস্থা রয়েছে। সেখানে গরীব, অসহায়, নি`র্যাতিত নারীদের বিনামূল্যে বিভিন্ন রকমের কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। সেলাই মেশিন চালানো, পুঁতি-সুতা দিয়ে হস্তশিল্প, পাটের জিনিস তৈরি, মাটির জিনিস তৈরি ইত্যাদি কাজকর্ম শেখানো হয়। বানানো হয়। সেখানকার নারীরা এ সকল কাজ শিখে আজ স্বাবলম্বী। বিনামূল্যে তাদের এই কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। এরপর তারা সফলতা অর্জন করলে ওই সংস্থায় মনের ইচ্ছেতে টাকা প্রদান করে। স্বল্প ডোনেশন দেয়। স্থানীয় এই বড় ভাবী কোনোভাবে উক্তি’র দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই দুর্দিনে উক্তি’র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, ওর সংগ্রাম ওনার মন ছুঁয়েছে। তাই তো অন্য কাউকে না পাঠিয়ে সরাসরি নিজে এলেন। সাক্ষাৎ করলেন উক্তি কায়সার নামক এই বড় মনের অধিকারিণীর সঙ্গে। আজকের দুনিয়ায় স্বামীর প্রতি এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সম্ভব? অত বড় ঘরের মেয়ে হয়েও পঙ্গু, অক্ষম, বেকার স্বামীর সঙ্গে দারিদ্রতা বরণ করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়। আজকের দুনিয়া যে বড় স্বার্থপর। এখানে স্বার্থ ছাড়া কিছুই চলে না। সকলে নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে বাঁচে। সে-ই নিয়েই ভাবে। উক্তি তবে কেন এমন ব্যতিক্রম? জানতে খুব ইচ্ছে হলো ভাবীর। তবে লজ্জায় পড়ে জিজ্ঞেস করা হলো না।

উক্তি ভাবীর উপরোক্ত প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মুয়ীয অবনত মস্তকে পাশেই বসে। ভাবনা শেষ করে উক্তি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। হাতের ইশারায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় আস্তে আস্তে বললো,

‘ হ্যাঁ, আমি শিখবো। ‘

ভাবী উক্তি’র শব্দহীন ভাষা বুঝলেন না। তবে ওর অশ্রুভেজা হাসি দেখে বুঝলেন উত্তরটা ইতিবাচক। সে ইতিবাচক উত্তরে উনিও সংক্রমিত হয়ে হালকা হেসে উঠলেন। মনপ্রাণ হতে দোয়া করলেন মুয়ীয, উক্তি দম্পতি আল্লাহ্’র রহমতে শীঘ্রই এই দুর্দিনের সময়টুকু পার করে সফলতা অর্জন করুক। উক্তি ভেজা চোখে স্বামীর পানে তাকালো। মানুষটা তখনো নিশ্চল বসে।

দুর্দিনের সময়কাল আরো এক মাস অতিবাহিত হলো। উক্তি শেষ দুপুর নাগাদ ঘরের কাজকর্ম সেরে নিয়মিত যাচ্ছে সে-ই সংস্থায়। বিনামূল্যে হাতের কাজ, মাটির জিনিস তৈরি করা শিখছে। ইতিমধ্যে সে কুইক লার্নার হিসেবে ভালোই পরিচিতি পেয়েছে। মেয়েটার মধ্যে আলাদাই এক জেল্লা আছে। সফলতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। জোশ রয়েছে অন্তরে। সেটারই সদ্ব্যবহার করছেন ওর প্রশিক্ষক মহিলাটি। ওকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। রকমারি শিক্ষা প্রদান করছেন। শিক্ষার্থী হিসেবে উক্তি’র পারফরম্যান্স নজরকাড়া। ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে স্বনামধন্য কায়সার সাহেবের একমাত্র কন্যা উক্তি কায়সার। বড় ঘরের রাজকন্যা সে। ওর এখন একটাই পরিচয়। মুয়ীয হাসানের ঘরের রাণী সে। এক সাধারণ গৃহবধু। অন্যদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে, ওর নিঃশব্দ ভাষার মাধ্যমে বেশ মিশে গিয়েছে উক্তি। দু’জন অল্পবয়সী ভাবী তো ওর মতো ‘ উ ‘ ‘ আ ‘ শব্দ করে ওর সঙ্গে উল্টোপাল্টা কিসব বলেন। শব্দহীন আলাপণ করতে চান ওনারা। উক্তি তাদের এই প্রচেষ্টা, অকৃত্রিম আচরণে মুগ্ধ! আবেগতাড়িত! সকলের ভালোবাসায় সিক্ত সে। এই জীবনে এত মানুষের ভালোবাসা লেখা ছিল তার তাকদীরে?! সে যে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি। কে বলেছে উক্তি কায়সার কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়? অপয়া, অলক্ষ্মী সে? আজ গোটা পৃথিবী দেখুক উক্তি’র মতো বোবা মেয়েটাও ভালোবাসার দাবিদার। সে-ও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে। হ্যাঁ, জানে সে….

সময়টা তখন শেষ বিকেল। ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা সেসময় তুঙ্গে। শহরের যত্রতত্র ঘরে ছুটছে কর্মজীবী নারী ও পুরুষের দল। রাস্তায় রাস্তায় যানজট লেগে। সূর্য মামার অদম্য তেজ ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। অর্ধ ঘন্টার মধ্যে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাবে সে। শহরের একপ্রান্তে কালো রঙা এসি গাড়ির মধ্যে বসে মানুষটা। যানজটে আটকা পড়ে বিরক্ত সে। কপালে অসন্তোষের ফলস্বরূপ সৃষ্ট রেখা দৃশ্যমান। পাশেই বসে পি.এ। তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট বুলবুল। বুলবুল ভীত স্বরে আস্তে ধীরে বলে চলেছে,

” স্যার। গত দু সপ্তাহ ধরে মুয়ীয হাসান আমাদের নেটওয়ার্কের বাইরে। সে কোথায় যাচ্ছে, কি করছে জানা যায়নি। আমাদের চোখে একপ্রকার ধূলো দিয়ে গায়েব হয়ে গেছে সে। সে-ই সকাল সকাল বেড়োয়। আর বেশ রাত করে ফেরে। মাঝের সময়টা কোথায় যায়, কি করে জানা যায়নি। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছি। ধারণা করছি মুয়ীয হাসান কোনো অপকর্মে জড়িয়ে গেছে। তাই তো এত লুকোচুরি করছে। আমাদের ধোঁকা দিতে চাইছে। কিন্তু স্যার! প্রশ্ন তো একটা থেকেই যায়। সে জানলো কি করে যে আমরা তার পিছু নিচ্ছি? ফলো করছি? সে কি.. ”

বুলবুলের কথার মাঝে ফুলস্টপ বসিয়ে জাওয়াদ কায়সার নিশিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

” তোমাদের ম্যাডামের লাস্ট আপডেট কি? ”

ম্যাডাম! সে প্রসঙ্গ আসতেই আকস্মিক বিলাই হয়ে গেল বুলবুল। মিউমিউ চেহারাটা। কি বলবে, কতটুকু ধামাচাপা দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। মনে মনে হিসাব কষতে ব্যস্ত। জাওয়াদ ঠিক তা অনুধাবন করতে পারলো। তাই তো হুমকির স্বরে জানান দিলো,

” মিথ্যা বলার ইচ্ছেটা গিলে ফেলো বুলবুল। নইলে চাকরি যাওয়াটা শুধুমাত্র সেকেন্ডের ব্যাপার। ”

এই রে! স্যার ঠিক বুঝে গেছেন। ওর অভিসন্ধি ধরে ফেলেছেন। এবার কি করবে সে? কোথা থেকে কোন শব্দ, বাক্যটা চতুরতার সহিত সরাবে? সব বললে যে কপালে দুঃখ আছে।

” গলা থেকে ব্যাঙ সরিয়ে মুখ খোলো বুলবুল। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে কিন্তু। ”

ত্বরান্বিত বলে উঠলো বুলবুল,

” এই না না। বলছি স্যার। বলছি। আসলে নিশাত ম্যাডাম… ”

জাওয়াদ পুরো কথা শোনার অপেক্ষায়। বুলবুল চোখ পিটপিট করে বলেই ফেললো,

” নিশাত ম্যাডাম কালও গিয়েছিলেন উক্তি ম্যামের বাড়ি। সাহায্য স্বরূপ টাকা অফার করেছিলেন। কিন্তু… ”

বুলবুল অতিরিক্ত ভয়ে বোবা হয়ে গেল যেন। ফিসফিসিয়ে কি যে বলতে লাগলো নিজেও জানে না। কতটা সময় পেরিয়ে গেল। ঘূর্ণিঝড় ‘ ক্যাটরিনা ‘ এখনো আঘাত হানছে না কেন? ভুল করে পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর দিয়ে চলে গেল নাকি? ভয়ে, আতঙ্কে আস্তে ধীরে চোখ মেলে তাকালো বুলবুল। মুখখানা ভয়ে লাল টুকটুকে রূপ নিয়েছে। চোখ মেলেই তড়িৎ বিহ্বল হয়ে গেল বুলবুল! স্যার ওকে তুলোধুনো না করে গাড়ির জানালা গলিয়ে বাহিরে কি দেখছেন? তা-ও এমন গাঢ় নজরে? মনে মনে বিশাল কৌতূহল জন্ম নিলো। ভয়ডর ফিক্কা মে রে সরিয়ে বুলবুল নিজেও স্যারের কাঁধের ওপর দিয়ে হালকা মাথা উঁচু করে, উঁকি দিলো। যানজটে সব গাড়িঘোড়া দাঁড়িয়ে। স্যার দেখছেন কোন কঁচুটা? বুঝেই উঠতে পারছিল না বুলবুল। হুদাই ইতিউতি করছিলো। এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। আকস্মিক যা দেখলো তাতে নড়েচড়ে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো তার গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড….! বিশালাকার হা করে তাকিয়ে বুলবুল। চক্ষু কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ঘনঘন চোখের পল্লব ফেলতে লাগলো সে। এ-ও দেখার ছিল শেষমেষ? নাকি অকালে চোখটাই গেল? কালই ‘ মক্কা আই হসপিটাল ‘ যেতে হবে। চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে। চোখের চিকিৎসা দরকার। এ অকল্পনীয়! অবিশ্বাস্য! অসম্ভব দৃশ্য যে!

রাত্রি তখন গভীর। নিজ ঘরে আরামকেদারায় শুয়ে জাওয়াদ। কৃত্রিম আলো নিভিয়ে রাখা। জ্বলছে শুধু হালকা আলোর ডিম লাইট। সে আঁধারে দৃশ্যমান মুখভঙ্গি কেমন নিষ্প্রভ। নিশাত স্বল্প দূরত্বে বিছানায় বসে। পড়নে কৃষ্ণাভ নাইট গাউন। একাকী বলে চলেছে,

” উক্তিটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। এতটা অসহায়ত্ব, দুর্দশা ও ডিজার্ভ করে না। তোমার বোন হয় ও। বাবার একমাত্র মেয়ে। এই বাড়ির মেয়ে হয়ে উক্তি কিনা দারিদ্রতায় জর্জ্জরিত? এই দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়। কালও গিয়েছিলাম ও বাড়ি। ইনিয়ে বিনিয়ে হেল্প করতে চাইলাম। উক্তি কিছুতেই সে হেল্প নিলো না। মেয়েটা বরাবরই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন গো। এখন তো দ্বিগুণ আত্মসম্মান। আফটার অল মুয়ীয হাসানের বউ হয়েছে কিনা! স্বামীর গুণাবলী ওর মধ্যেও দিনকে দিন ট্রান্সফার হচ্ছে। কিছুতেই টাকাগুলো নিলো না। ফিরিয়ে দিলো আমায়। ”

জাওয়াদ সবটাই শুনলো। তবে নিশ্চুপ। কিছুই বললো না। ভালো-মন্দ কোনোরূপ মন্তব্য পেশ করলো না। নিশাত এতক্ষণে স্বামীর দিকে তাকালো। ম্লান কণ্ঠে বললো,

” মুয়ীয ভাই দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কোনো সুরাহা মেলেনি। জানো? উক্তি বলছিলো। মুয়ীয ভাই সম্ভবত এখন কোনো কাজ পেয়েছেন। সে-ই সকালে যান। রাত করে ফেরেন। ওনায় বড্ড ক্লান্ত দেখায়। উক্তি জিজ্ঞেস করেছিল উনি কি কাজ পেয়েছেন। কোথায় যান ইত্যাদি কোয়েশ্চেন। কিন্তু মুয়ীয ভাই বলেননি নাকি। এড়িয়ে গেছেন। ”

উদ্বিগ্ন হয়ে নিশাত শুধিয়ে উঠলো,

” হ্যাঁ গো! আমার না চিন্তা হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় মানুষ কখনো কখনো আর মানুষ থাকে না। অমানুষে পরিণত হয়। আল্লাহ্ না করুক, মুয়ীয ভাই কোন অসৎ পথে জড়িয়ে যাননি তো? ”

” নাহ্! অসম্ভব। ”

জীবনে এই প্রথমবার বোধহয় মুয়ীয হাসানের সপক্ষে বুলি ফুটলো জাওয়াদের মুখে। আত্মবিশ্বাসী সে শব্দগুচ্ছ। নিশাত আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকিয়ে স্বামীর দিকে! তার স্বামী মানুষটি মুয়ীয ভাইয়ের পক্ষে বললো?! নাকি সে ভুল শুনলো? হু? নিশ্চিত হতে নিশাত বলে উঠলো,

” কি বললে তুমি? মুয়ীয ভাই কোনো অসৎ পথে জড়িয়ে যাননি?”

জাওয়াদ নিচু কণ্ঠে বললো,

” না। ”

নিশাত আগ্রহী হয়ে উঠলো। জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি কি করে বলছো একথা? আর তুমি জাওয়াদ কায়সার… কিনা বোন জামাইয়ের সপক্ষে কথা বলছো?! এ যে আশ্চর্যজনক দৃশ্য গো! জীবনে প্রথমবার দেখছি। শুনছি। ”

মিটিমিটি হাসছে নিশাত। সে হাসিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে জাওয়াদ। মুখ ফসকে কেন যে ওই ব্যাটার সপক্ষে বলতে গেল? বউ তো এখন মজা লুটে নিচ্ছে। বিরক্তিকর এক মূহুর্ত। ফোঁস করে দম ছাড়লো জাওয়াদ। নিশাত আস্তে ধীরে হাসি মুছে স্বাভাবিক স্বরে বললো,

” তুমি কি কথাটা আন্দাজে বললে নাকি নিশ্চিত হয়ে? কণ্ঠে তো আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠলো। ”

” জানি না। ”

” উঁহু। কথা লুকাবে না। তুমি কি জানো মুয়ীয ভাই কি কাজ করেন? কোথায় যান? ”

জাওয়াদ নীরব। সে কিছু বলতে ইচ্ছুক নয়। নিশাত উত্তরের অপেক্ষায় খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরলো। তবে উত্তর মিললো না। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,

” অ্যাই বলো না। তুমি কি জানো মুয়ীয ভাই কি করেন? বলো না গো। উনি.. উনি কোনো অন্যায় করছেন না তো? ”

জাওয়াদের চক্ষু বুঁজে এলো। বদ্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটি! তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো সে। দৃঢ় কণ্ঠে বললো,

” মুয়ীয কোনো অন্যায় করছে না। তোমার ননদকে অহেতুক দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করো। ”

কথাটি শুনে বেশ স্বস্তি পেল নিশাত। সে স্বস্তি প্রকাশ পেল নিশ্বাসে। হালকা হাসিমাখা মুখে নিশাত বললো,

” চিন্তামুক্ত করলে গো। মেনি মেনি থ্যাংকস! ”

জাওয়াদ বোধহয় মনে মনে সন্তুষ্ট হলো। আজ ঠিক কতগুলো দিন, মাস পর তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা হচ্ছে। বউ হাসিমুখে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। তারা শেষ কবে এমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে তা স্মরণ করা কিছুটা জটিল বটে। অতীতের পাতা হাতড়ে হাতড়ে উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। এই যে তারা স্বামী-স্ত্রী কথা বলছে স্বাভাবিক টোনে। কোনোরূপ বাকবিতন্ডা নেই। উচ্চ স্বরে হৈচৈ নেই। নেই মন কষাকষি। দু’জনেই ভালোভাবে বলছে। একে অপরের কথা শুনছে। কথা বলে শান্তি পাচ্ছে, স্বস্তি পাচ্ছে। এ-ই তো দাম্পত্যের চিত্র হওয়া উচিত। কোনো অশান্তি মোড়ানো দৈনন্দিন জীবন নয়। অপরদিকে নিশাত মনে মনে ভেবে চলেছে কি এমন কাজ করেন মুয়ীয ভাই যা নিয়ে এত লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা?

সকালের হালকা রৌদ্র কাটিয়ে এলো দুপুর। নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত জনজীবন। বিস্তর দিগন্ত জুড়ে আস্তে ধীরে দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। সূর্য ঢাকা পড়ছে কালো মেঘের আড়ালে। ধরনী তলিয়ে যাচ্ছে আঁধারে। অশান্ত হয়ে পড়ছে বৃক্ষরাজি। পশুপাখি সব উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছোটাছুটি করছে। বাহিরে অবস্থানরত প্রতিটা মানুষ ভীত হয়ে পড়ছে। প্রকৃতির এই বী`ভৎস রূপ দেখে তারা বিস্মিত! ভীত! বাতাসের শোঁ শোঁ তীব্র হুঙ্কারে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। মংলা সমুদ্র বন্দর, কক্সবাজারে মহা বিপদ সংকেত জানালো আবহাওয়া অধিদপ্তর। উপকূল ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়। সমুদ্রের জল আজ অবাধ্য। অস্থির। তেড়েফুঁড়ে আছড়ে পড়ছে স্বচ্ছ বালুময় সমুদ্র তটে। সমুদ্র তীরবর্তী নারকেল গাছগুলো বাতাসের দাপটের সঙ্গে টিকে থাকার সর্বোচ্চ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এঁকেবেঁকে যাচ্ছে গাছের দেহ। মাটি ফুঁড়ে উল্টে পড়বে বুঝি দৈ`ত্যাকার একেকটি গাছ। শহুরে জনপদে শক্তিশালী বাতাসে সব কেমন এলোমেলো রূপ ধারণ করেছে। কর্মব্যস্ত মানুষগুলো কাজকর্ম ফেলে নিজ নিজ বাড়ি ছুটছে। আর বাড়িতে অবস্থানরত মানুষগুলো আতঙ্কিত প্রকৃতির এই ভ’য়ঙ্কর রূপ দেখে। হ্যাঁ, গতকাল থেকে আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্কবার্তা জানিয়েছিল। তাই বলে এত ভয়াবহ ঝড় আসতে চলেছে বুঝতে পারেনি কেউ। উক্তি ও পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে ঘরে বসে। উক্তি অনবরত স্মরণ করে চলেছে মহান আল্লাহ্’কে। মারুফকে একটু আগে ফোন করা হয়েছে। সে শীঘ্রই বাড়ি ফিরছে। ওদিকে মুয়ীযকে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। কল ধরছে না সে। কিংবা নেটওয়ার্ক প্রবলেম। উক্তি এতেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। বারবার রব’কে ডেকে চলেছে। ভয় হচ্ছে। কুচিন্তা হানা দিচ্ছে মনে। বাতাসের পৈ`শাচিক নি’র্যাতনে তাদের বাড়ির টিনশেডে গা হিম করা শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। সিনেমার সে-ই গা ছমছমে পরিবেশের মতো রূপ ধারণ করেছে আশপাশ। বাতাস ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। এবার বাতাসের সঙ্গী রূপে উপস্থিত হলো বৃষ্টি। অদম্য বাতাস ও বৃষ্টির মেলবন্ধনে অ`ত্যাচারী তুফান উঠলো ধরনীর বুকে। উক্তি মাঝের ঘরটিতে শাশুড়ি মা, বড় জায়ের সঙ্গে বসে। মনে মনে পড়ে চলেছে,

حَوَالَيْنَا، وَلاَ عَلَيْنَا
“হে আল্লাহ্ আমাদের আশপাশে (জনবসতির বাহিরে) বৃষ্টি দাও, আমাদের উপর নয়।’’ (বুখারী: ৯৩৩)

চলুন বন্ধুগণ! আজ এ বৃষ্টিস্নাত লগনে জেনে নিই বৃষ্টির সময়ের ৬টি সুন্নাহ ~

{১} বৃষ্টির দোয়া পাঠ করা।

দোয়াটি হলো- اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا “হে আল্লাহ্ কল্যাণকর বৃষ্টি দাও” (বুখারী: ৬৯১)

অতিবৃষ্টি বা ক্ষতিকর বৃষ্টি হলে এই দোয়া পাঠ করা- اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا، وَلاَ عَلَيْنَا “হে আল্লাহ্ আমাদের আশপাশে (জনবসতির বাহিরে) বৃষ্টি দাও, আমাদের উপর নয়।’’ (বুখারী: ৯৩৩)

{২} আল্লাহ্’র ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকা।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, ” আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে এবং ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘাবড়ে যেতেন যে, এটি আল্লাহর আ*যাব কিনা। ” (সহীহ মুসলিম: ১৯৫৭)

{৩} বৃষ্টিকে আল্লাহর রহমত বলে অভিহিত করা।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, ” প্রিয়নবী (সা.) যখন বৃষ্টি দেখতেন তখন বলতেন, “এ তো আল্লাহর রহমত।” (সহীহ মুসলিম: ১৯৫৭)

{৪} বৃষ্টি-বাদল সংক্রান্ত কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহ্’র প্রতি বিশ্বাসী হওয়া।

প্রিয়নবী (সা). হাদীসে কুদসীতে বলেন, “যে বলে, আল্লাহ্’র করুণা ও রহমতে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে হল আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের (শক্তির) প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী।” (সহীহ মুসলিম: ৮৪৬)

{৫} বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো।

রাসুলুল্লাহ ( সা.) বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতেন। (সহীহ মুসলিম: ১৯৫৬)

{৬} বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়, তাই এ সময়ে দোয়া করা।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “দুই সময়ের দো’আ প্রত্যাখ্যাত হয় না কিংবা কম প্রত্যাখ্যাত হয়। (এক) আযানের সময়। (দুই) বৃষ্টির সময়।” (সহীহুল জামে: ৩০৭৮)

উক্তি দোয়া দরুদ পড়ে চলেছে। ভীত মনে স্বামীর সুস্থতা কামনা করছে। ওদিকে মুন্নি? সে তো নিজ ঘরে কোনো গোপন কর্মে লিপ্ত। হাতে অল্প দামী বাটন ফোন নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সে। কানে ঠেকানো সে ফোন। কারোর সঙ্গে ফুসুরফুসুর আলাপে ব্যস্ত। এসব ঝড়বৃষ্টিতে মন দেয়ার মতো সময় নেই তার। বৃষ্টি হচ্ছে। এ আর তেমন কি? আগে কখনো কি বৃষ্টি হয়নি? যত্তসব।

ভ’য়ংকরী তা-ণ্ড-বে লণ্ডভণ্ড জনজীবন। আকস্মিক ঘটে গেল এক অভাবনীয় অঘটন। অস্ফুট বোবা স্বরে চিৎকার করে উঠলো উক্তি,

‘ আঃ…..! ‘

চলবে।