তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-২৭

0
95

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২৭

” ময়না! তোর কি হইছে মা? ”

অত্যধিক উদ্বেজিত ও দুশ্চিন্তায় কাবু হয়ে মেয়েকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিলেন মোমেনা বেগম। ওনার চোখে অশ্রুজল। অন্তরে ভীতি। তবে এর বিপরীতে নারীমূর্তির ন্যায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে ময়না। ময়নার মেয়ে দু’টো কেয়া ও খেয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছোট মামার কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এত মানুষের ভীড়ে ভয় হচ্ছে বড়। গত রাতের বী’ভৎস স্মৃতি যে এখনো তরতাজা। ঘায়েল করে চলেছে অবিরাম। মুয়ীয স্নেহের সহিত ওদের দুই হাতে আগলে ধরে রয়েছে। নীরবে বুঝিয়ে দিচ্ছে ভয় নেই আর। উক্তি ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে। সবটা দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে। এতক্ষণে অবশ্য বুঝতে বাকি নেই যে ভাবনাতীত কোনো অঘটন ঘটেছে বটে। কিন্তু কি হয়েছে?
.

ময়না আপাতত কিছুটা শান্ত হয়েছে। বসে রয়েছে দেয়াল ঘেঁষে শ্রেণিকক্ষের এক নীরব স্থানে। আশ্রয়কেন্দ্রে কর্তব্যরত চিকিৎসক এসেছিলেন কিছুক্ষণ পূর্বে। ওকে এবং মেয়ে দুটোকে ভালোমতো চেকআপ করে গেছেন। এই মানসিক পীড়া হতে বেড়োনোর জন্য সৎ পরামর্শ দিয়ে গেছেন। উপদেশ দিয়েছেন বেশকিছু। পরিবারের সদস্যরা এতে আশাবাদী যে ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে হয়েছে টা কি তা এখনো জানা যায়নি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ময়না কিংবা তার মেয়েরা বলতে পারেনি তাদের সঙ্গে ঠিক কি হয়েছে। কেন এত ভয়ে অস্থির তারা? অস্থির হবে না? শুধু ওরা এবং এক আল্লাহ্ জানেন গতরাত তাদের জীবনের কতটা ভয়ানক রাত ছিল। প্রতিটি মুহূর্ত ভয়, অস্থিরতা এবং সবশেষে চির নীরবতা। ফলস্বরূপ এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেনি তারা। কেয়া ও খেয়া এই মুহূর্তে চুপটি করে নানির সাথে রয়েছে। নানির কোলে মাথা রেখে শুয়ে ওরা। মোমেনা বেগম আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন নাতনিদের। কপালে, চুলের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে আদরমাখা স্পর্শে ঘুম নামলো দু জোড়া চোখে। ভয়ার্ত-নির্ঘুম রাতের শেষে ঘুমিয়ে পড়লো দুই কিশোরী, তাদের নানির কোলে। নির্ভয়, নিশ্চিন্ত সে ঘুম।

.

ময়না হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মেঝেতে বসে রয়েছে পরিবারের সদস্যরা। ময়না এখনো মূক মুখে বসে। কেয়া, খেয়া মেঝেতে বিছানো ওড়নায় ঘুমিয়ে। উক্তির পরিবারের সদস্যরা হতাশ চিত্তে বিদায় নিয়েছে ঘন্টা দুয়েক হতে চলেছে। উক্তি তাদের অভাবনীয় হতাশায় ডুবিয়ে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য করেছে। চোখে জল নিয়ে বিদায় নিয়েছেন কায়সার সাহেব। মেয়েকে আরেকবার ভেবে দেখার অনুরোধ জানাতে ভোলেননি বয়স্ক মানুষটি। এই মুহূর্তে উক্তি শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর পাশে রয়েছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। মারুফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে।

” এইবার ক ভাই। কোম্বে পাইলি বড় আপারে? ”

মুয়ীয দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসা। ডান পা লম্বা করে ছড়িয়ে রাখা। বাঁ হাঁটু ভাঁজ করে দাঁড় করানো। ভারিক্কি স্বরে বললো সে,

” দুই বাড়ি পরে হ্যার প্রতিবেশীর বাড়িতে পাইছি। ওইদিকের অবস্থা ভালা না। ম্যালা বাড়িঘর ভাইঙ্গা গুঁড়া গুঁড়া। ”

সংবাদটি শুনে আঁতকে উঠলেন মোমেনা বেগম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজ বাড়ির দুরবস্থা। এখন বড় মেয়েটা? সে-ও গৃহ হারা হলো? আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন। ওরা যদি কোনোভাবে ওই বিধ্বস্ত বাড়ির নিচে চাপা পড়ে যেতো! ইয়া আল্লাহ্! ওদের ধ্বংসাবশেষ মিলতো কিনা সে-ও তো সন্দেহজনক। ইন্না লিল্লাহ! বড় বড় দম ফেলে নিজেকে শান্ত করতে লাগলেন মোমেনা বেগম। কিসব অনর্থক কুচিন্তা করছেন উনি? সৃষ্টিকর্তা প্রাণে বাঁচিয়েছে যে।

জান্নাত কৌতূহলী হয়ে সহসা জিজ্ঞেস করে বসলো,

” ভাইয়া! ওইহানে কামাল ভাই ক্যামন আছেন? ওনার কোনো খোঁজখবর?”

বউয়ের মুখে হঠাৎই ওই দুশ্চরিত্রবান লোকটার নাম শুনে ক্ষে’পে উঠলো মারুফ। ধমকে বললো,

” তুমি চুপ থাহো। ওই হা*লারে দিয়া মোগো কি দরকার? বড় আপা ঠিক আছে‌। ভাগ্নি দুইডা ঠিক আছে। এইয়াই কও শোকর আলহামদুলিল্লাহ্। ওইডার খবর নেওন লাগতো না।”

সবার মাঝে স্বামীর ধমক খেয়ে মুখখানি শুকিয়ে গেল জান্নাতের। মারুফ এভাবে বলতে পারলো তাকে? একটু কি ভালো আচরণ তার প্রাপ্য নয়? সে কি এতটাই খারাপ? দুর্ব্যবহারের যোগ্য? এদিকে উক্তি স্বামীর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। অব্যক্ত মুখভঙ্গি বোঝার প্রয়াস চালাচ্ছে। তবে কতখানি সফলতা মিলবে জানা নেই তার। মুয়ীয যে নিশ্চুপ।

মোমেনা বেগম পরিস্থিতি শান্ত করতে বড় ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

” হয় হয় হইছে। অহন থাম বাপ। এবার শান্ত হইয়া দুই ভাই মিল্লা এইয়া ভাব যে মোগো ভবিষ্যৎ কি! এহানে আর কদ্দিন? বাড়িঘর কি অমনেই শেষ? মোগো মাথা গোঁজার ঠাঁই শেষ? ”

কথাটা শেষ করতেই টুপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ওনার নেত্রকোণ হতে। উক্তি’র ভেতরটাও কেমন শূন্য হয়ে রয়েছে। সেই অপ্রত্যাশিত-ভয়ঙ্কর টিন ভাঙ্গনের দৃশ্যটা স্মৃতিপটে যেন আঠা দ্বারা গেঁথে রয়েছে। গা শিউরে ওঠে স্মরণে এলেই। কতটা ভয়াবহতা ছিল সে রাতে! ইয়া আল্লাহ্!

মুয়ীয মায়ের মনোবেদনা বুঝতে পারছে। সে যে এই মুহূর্তে অপারগ হয়ে পড়েছে। আল্লাহ্’র নাম নিয়ে কিছুটা সময় দরকার তার। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের কথা মুখে উচ্চারিত হলো মুয়ীযের,

” কান্দিস না মা। ইনশাআল্লাহ্ ব্যাবাক ঠিক হইয়া যাইবো। মন থে দোয়া করিস একটু। ”

আবেগী হয়ে মায়ের স্নেহের লোভে মুয়ীয সর্বদা এমন ‘ তুই ‘ সম্বোধন করে থাকে মা’কে। এ ডাকটা তার মায়ের বড় প্রিয় যে। সে-ই পুরনো আদুরে গলায় মোমেনা বেগম আরো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। ওখানে উপস্থিত আরো অনেক মানুষ নীরবে সবটা দেখলো। বর্তমান পরিস্থিতি যে তাদের বোধগম্যতার বাহিরে নয়। সবটাই বুঝতে পারছে তারা। ভেতরে দুঃখের স্ফু°লিঙ্গ জ্বা’লিয়ে পু’ড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। গৃহহীন এই মানুষগুলোর শেষ পরিণতি কি? কোথায় মিলবে তাদের ঠাঁই….?

অন্তরীক্ষে ক্ষুদ্রাকৃতির এক চন্দ্রের উপস্থিতি। থমথমে মুখে যেন আজ উদয় হয়েছে তার। আশপাশের মেঘমালা সে-ই কখন থেকে বিরক্ত করে চলেছে তাকে। বারবার ঢেকে দিতে চাইছে মেঘের অন্তরালে। তবে সে আড়াল হতে নারাজ। জোরপূর্বক জায়গা দখল করে রয়েছে অন্তরীক্ষের বিশালাকার বুকের ছোট্ট এক অংশে।

শ্রেণিকক্ষের সে আশ্রিত অংশে ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে উক্তি। মায়াবী চোখ দু’টো ব্যস্ত কারোর খোঁজে। ঘরে উপস্থিত অতগুলো মানুষের ভীড়ে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। নারী, পুরুষ, শিশু সবার ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে গেল উক্তি। পুরোপুরি নিশ্চিত হলো মানুষটি এখানে অনুপস্থিত। তবে আবার না বলে কয়ে কোথায় চলে গেল সে? রাতের খাবার কি খাবে না? ওকেও অনাহারে রাখবে? এভাবে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ফেলে কি যে আনন্দ পায় মানুষটি, উক্তি’র আজও অজানা। উক্তি ছোট্ট শ্বাস ফেললো। মোমেনা বেগম সে মুহূর্তে আবার ডেকে উঠলেন ওকে। দ্বিতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করলেন মুয়ীয কোথায়? সে কি এই সামান্য নৈশভোজে অংশ নেবে না? উক্তি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভাষায় শাশুড়ি মা’কে আশ্বস্ত করলো। আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল শ্রেণিকক্ষ হতে। মোমেনা বেগম উৎকণ্ঠায় পড়ে যাচ্ছেন আবার। এসব কি আর তার পিছু ছাড়বে না?
.

সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলো উক্তি। পড়নে তার হলদে রঙা এক সুতির সালোয়ার কামিজ। ওড়না দিয়ে মস্তক, কেশরাশি ঢাকা। যথাসম্ভব ওড়নার আড়ালে আবৃত মুখশ্রী। নিচতলার করিডোরে বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষের আনাগোনা। পুরুষদের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেকেই অলস সময় কাটাতে কিংবা ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন বুনন করতে সেথায় হাজির হয়েছে। কারো কারো সঙ্গে বাচ্চা নজরে আসছে। উক্তি যথাসম্ভব দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। যাওয়ার আগে নিশ্চিত হলো মুয়ীয এখানেও নেই। উক্তি দ্রুত পা ফেলে বিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারে এসে দাঁড়ালো। আশেপাশে উৎকণ্ঠিত চোখ দু’টো বুলিয়ে চলেছে। শেষ আশায় রয়েছে যে এই বুঝি দেখা মিলবে স্বামীর। বেশি ধৈর্য ধারণ করতে হলো না মেয়েটির। অল্পক্ষণেই প্রসারিত হলো ঠোঁটের কোণ।

কয়েক দশকের পুরনো সে বৃহদাকার গাছটি। গাছকে কেন্দ্র করে তৈরি কংক্রিটের শক্তপোক্ত গোলাকার এক বেদি। ধূলোমাখা সে বেদিতে আঁধার মাঝে বসে রয়েছে এক ব্যক্তি। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আলো মেখে রয়েছে তার চওড়া পিঠে। একদম চুপটি করে বসে সে। ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে শ্রবণ পথে। খানিক বাদে নিজের ঠিক ডান পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেলো মানুষটি। আস্তে করে ঘুরে তাকালো ডানে। আলো আঁধারির খেলায় স্পষ্ট দেখে নিলো সহধর্মিণী উক্তি’র চিন্তা মিশ্রিত মুখখানি। মেয়েটা ওর ঠিক পাশেই বসে। দু’টো দেহ প্রায় ছুঁইছুঁই। কিছুটা সময় ওদের চোখ জোড়া একে অপরের মাঝে হারিয়ে ছিল। চোখে চোখে মনোভাব আদান-প্রদানের চেষ্টা চলছিল। তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ করতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মুয়ীয। উক্তি অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো ওকে। নিজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে ডাকলো,

‘ উঃ….! ‘

মুয়ীয নরম চোখে ঘুরে তাকালো। উক্তি দু হাতের ক্রীড়ায় ওকে বললো,

‘ পরিবারকে টেনশনে রাখতে খুব ভালোবাসেন, তাই না? ‘

মুয়ীয কিছু বললো না। এ মুহূর্তে নীরবতা তাকে বেশ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

‘ আপনি জানেন আমি কখন থেকে আপনাকে খুঁজে চলেছি? মা-ও খুঁজছিলেন আপনাকে। চলুন। খেতে চলুন। মা অপেক্ষা করছে। ‘

” আপা, কেয়া খেয়া খাইছে? ” এবার মুখ খুললো মুয়ীয।

উক্তি হালকা করে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। হ্যাঁ, তারা খেয়েছে। মোমেনা বেগম বলে কয়ে কোনোরকম জোরপূর্বক অল্প হলেও খাইয়েছেন। মুয়ীয চুপচাপ বসে। উক্তিও মূক। কিছুটা সময় ওভাবে নীরবে পেরিয়ে গেল।

‘ কামাল ভাইয়ের কি হয়েছে? কোনো বিপদ হয়েছে কি? ‘

স্ত্রীর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে এমনতর প্রশ্ন পেয়ে যারপরনাই অবাক হলো মুয়ীয! সে অবাকতার রেশ দৃশ্যমান চোখেমুখে।

‘ কামাল ভাই কেমন মানুষ আমার জানতে ও বুঝতে বাকি নেই। অল্প হলেও জেনেছি তার সম্পর্কে। ‘

মুয়ীয চুপচাপ শুনছে বউয়ের কথাগুলো। সে আরো শুনতে চায়। উক্তি ভেজা কণ্ঠে বলে চলেছে,

‘ বড় আপাকে আজ দেখেছি। ওনার গলায় স্পষ্ট লাল দাগ। উনি লুকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। তবে ভাগ্যক্রমে দেখে ফেলেছি আমি। ওনাকে.. ওনাকে গলা টিপে ধরা হয়েছিল। আপা এখনো ভয়ে আছেন। কেয়া, খেয়া দুই মা ভয়ে জর্জরিত। ‘

সহসা উক্তি বেশ উদ্বিগ্নতার শিকার হয়ে হাতের ইশারায় বলে উঠলো,

‘ গতরাতে ঠিক কি হয়েছিল বলুন না? কামাল ভাই কি এরচেয়েও গুরুতর কিছু করেছে? এখন কোথায় আছেন উনি? উনি কি কখনোই ওনার পাপের শাস্তি পাবেন না? ‘

” পাইবো না ক্যা? চির জনমের লেইগ্গা পাইছে। ”

মুয়ীযের মুখভঙ্গি আকস্মিক এমনভাবে বদলে গেল যে ভড়কে গেল উক্তি। অতিরিক্ত ক্রো’ধে শ্যামবর্ণ মুখখানা র’ক্তলাল রূপ ধারণ করেছে। দু চোখে আগুনের হলকা। উক্তি ভীত স্বরে শুধিয়ে উঠলো,

‘ কি হয়েছে ওনার? আপনি… আপনি কিছু করেননি তো? মুয়ীয? ‘

মুয়ীয নির্বাক হয়ে রইলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসির উপস্থিতি। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে এক রহস্যের অগ্নিকুণ্ড। কি হয়েছে কামাল নামক ন*রপশুটির সঙ্গে? এই মুহূর্তে কোথায় কোন অবস্থানে রয়েছে সে? আর গতরাতে কিইবা হয়েছিল? উত্তর যেন চাপা পড়েছে ধরনীর বুকে।

আঁধারিয়া রজনী। খোলা-উন্মুক্ত ছাদের এক কিনারে দাঁড়িয়ে মুয়ীয। চিন্তার ভারী আস্তরণে বুকে হচ্ছে পীড়ন। আজ দু’দিন হলো তারা এখানে। এই বিদ্যালয়ের সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রে। কাল কিংবা পরশু জানা নেই। এখান থেকে যেকোনো মুহূর্তে তাদের চলে যেতে হবে। শুরু হবে বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম। তবে তারা যাবে তো যাবে কোথায়? ছাদ বিহীন ওই ভগ্ন বাড়িতে? সে রাতের ঝড়ে তো উড়ে গিয়েছে টিনের চাল। বাড়ির ভেতরেও তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবটা পূর্বের ন্যায় করতে বেশ অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এ মুহূর্তে এতগুলো টাকা মিলবে কোথায়? তার তো আগের মতো সে-ই রমরমা অবস্থা নেই। চাকরিটা চলে গিয়েছে। বর্তমানে তার পরিচয় সে এক দরিদ্র রিকশাচালক। পেটের দায়ে যে অলিগলি রিকশা চালিয়ে বেড়ায়। ব্যাংক ব্যালেন্সও অতটা শক্তিশালী নেই। তবে? সে একাকী সবটা সামাল দেবে কি করে? চিন্তিত-বিধ্বস্ত মুয়ীয দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অন্ধকার ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো,

‘ আল্লাহ্ আছেন। ইনশাআল্লাহ্ ব্যাবাক ঠিক হইয়া যাইবো। ‘

অকস্মাৎ কাঁধে ভরসার একখানা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘোর ভঙ্গ হলো। কাঁধে হাত রাখা মানবী এসে দাঁড়ালো পাশে। মুয়ীয নির্বিকার সে-ই পূর্বের ন্যায়। উক্তি ম্লান বদনে দাঁড়িয়ে। স্বামীর কাঁধে রাখা হাতটি আলতো করে বুলিয়ে নিম্নে নামতে লাগলো। কাঁধ ছেড়ে জায়গা করে নিলো পেশিবহুল বাহুতে। বাহুতে ডান হাতটি পেঁচিয়ে অর্ধাঙ্গের কাঁধে মাথা রাখলো উক্তি। শান্তিময় সে পরশে হৃদয় হালকা হলো মুয়ীযের। আবেশে বুঁজে এলো চক্ষু। মাথাটা আস্তে করে হেলিয়ে দিলো সঙ্গিনীর মাথার সাথে। দু’জনার অন্তর তখন সুখকর অনুভূতির প্লাবণে তলিয়ে। অক্ষিপুট বন্ধ তাদের। এই স্বপ্নমধুর মুহূর্তে নিম্নোক্ত দু’টো বিশেষ উক্তি যেন বড় মানানসই লাগছে…

“Had life not given me reasons to grieve, I would never have known the healing power of a hug.” — Richelle E Goodrich

“A hug is the bridge between two souls.” ―
Anoir Ou-Chad

মানসিকভাবে চরম অসহায় হয়ে পড়েছে মুয়ীয হাসান। এ মুহূর্তে তার কাছের মানুষদের একটুখানি সাহচর্য, ভরসা, ভালোবাসাই পারে তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের একটু উপশম হতে। উক্তি তার সহধর্মিণী। অর্ধাঙ্গিনী। যার প্রতিটি স্পর্শে লুকিয়ে পবিত্র অনুভূতি। হৃদয় জুড়ানো সুখ। এক ভিন্নতর অব্যক্ত আবেশ। এতকাল বাদে স্ত্রী সান্নিধ্য পেয়ে মুয়ীয মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। সেই অসুস্থকালীন সময় থেকেই তাদের মধ্যে এক সুক্ষ্ম দূরত্বের সূত্রপাত। মানসিকভাবে তারা সংযুক্ত হয়ে থাকলেও শারীরিকভাবে যোজন বিয়োজন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অসুস্থতা, অক্ষমতা, মনোপীড়া সব মিলিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ মুহূর্ত কাটানো হয়না বহুকাল। আজ যেন মন বাঁধনছাড়া পাখির ন্যায় উড়তে চাইছে। চাইছে ক্ষুদ্রতম হলেও কিছু আদর, সোহাগ। স্ত্রীর হালাল পরশে মুগ্ধতা। স্বামীর মনোবাসনা বুঝে উঠতে সময় লাগলো না উক্তি’র। তবে এই সময়, এই পরিস্থিতি, এই স্থান কোনোটাই যে তাদের অনুকূলে নয়। স্বামীর মনের ইচ্ছে এ মুহূর্তে পূরণীয় নয় বলে অন্তঃস্থলে দুঃখিত হলো উক্তি। সে-ও যে মনপ্রাণ হতে চাইছে স্বামী সোহাগে সোহাগিনী হতে। কোনোরূপ নিজেকে সংবরণ করে উক্তি স্বামীর কপাল কার্নিশে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডব্যাপী স্থায়ী হলো সে স্পর্শ। সেথা হতে ঠোঁট নেমে এলো গালে। আদর মেখে দিলো সময় নিয়ে। জ’ লাইনেও পরশ বুলিয়ে দিলো ক্ষণিকের জন্য। স্ত্রীর অবিরাম-আকাঙ্ক্ষিত নরম ঠোঁটের পরশ পেয়ে চরম অবাধ্য হয়ে উঠলো মুয়ীয। চকিতে বুকে আগলে নিলো সঙ্গিনীকে। উক্তি বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পূর্বেই… চোখের পলকে দু জোড়া ঠোঁট বন্দি হলো এক অভিলষণীয় সম্মোহনে। আঁধার ঘেরা আকাশ নামক চাদরতলে, উন্মুক্ত ভূতুড়ে সে ছাদে… এক জোড়া মানব- মানবী ব্যস্ত মধুসূধা পান করতে। নিজ পিপাসু চিত্ত শান্ত করতে। সে এক মনোরম-অপূর্ব-সুন্দর মুহূর্ত!

চলবে।