তোমাতেই নৈঃশব্দ্য প্রহরে পর্ব-২৮

0
137

#তোমাতেই_নৈঃশব্দ্য_প্রহরে
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্বসংখ্যা_২৮

” আমায় কি কখনো ক্ষমা করা যায় না, মা? আমি এতটাই ঘৃণ্য পাপে পাপিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি? ”

আঁধারাবৃত কক্ষে বিছানায় শুয়ে কায়সার সাহেব। শূন্য চাহনি ওনার স্থির শুভ্র রঙা সিলিংয়ে। চোখের কোণে ভেজা ভাব। নিজের ওপর, নিজ হীন কর্মের জন্য আজ অনুতপ্ত উনি। অনুতাপের ভারে ষাটোর্ধ্ব মানুষটির বয়স যেন একশো’তে গিয়ে ঠেকেছে। কত সুন্দর স্বর্ণালী মুহূর্তে মোড়ানো ছিল ওনার সংসার! উনি এবং ওনার প্রিয়তমা ফাতিমা। কত রঙ বেরঙের স্বপ্ন বুনন করেছিলেন ওনারা একত্রে। আজ সেসব স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সবটাই আজ শূন্য। মিথ্যা অহমিকা, ঘৃণা, অনুতাপে ভরা। বিশাল শূন্যতার ভারে পদদলিত।

ফাতিমা এবং কায়সার হামিদ… উক্তি’র পিতা-মাতা হন ওনারা। ওনাদের বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিক ভাবে। পাত্রী দেখতে গিয়ে একদম প্রথম নজরেই মনের কুঠুরিতে অপরূপা ফাতিমাকে চির বন্দিনী করে ফেলেন কায়সার সাহেব। লাজুক ফাতিমা যেখানে চোখ তুলে আগত মানুষগুলোর দিকে তাকাতেই পারছিলেন না। সেখানে কায়সার সাহেব ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন ওনার সুশ্রী মুখপানে। এ নিয়ে সেথায় উপস্থিত কাজিনবৃন্দ মুখ টিপে হাসতে ভোলেনি কিন্তু। ওনাকে পরবর্তীতে বেশ পচিয়েছে বটে। তাতে কায়সার সাহেবের কি? বেশরমের মতো উনি তো বলে উঠলেন,

” বা রে! আমি কি আর পরনারীকে দেখেছি? নিজের বউকেই তো দেখেছি। এতে এতো হাসির কি আছে পাগলা? ”

” বউ! ”

কাজিন মহলের চোয়াল ঝুলে পড়ার উপক্রম। পাত্রী দেখতে গিয়ে ভাইজান প্রথম দফাতেই বউ বানিয়ে ফেললো! ওরে মধুর সর্বনাশ! এরপরের সময়টা ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর! রসগোল্লার মতো মিষ্টি। মোবাইল তখন অতটাও অ্যাভেলেবল ছিল না ঘরে ঘরে। প্রায় চৌত্রিশ বছর পূর্বের কথা কিনা। চিঠির চলন ছিল বেশ। কোনো এক গোধূলি লগ্নে কায়সার সাহেবের মনটা বেশ ফুরফুরে। উড়ু উড়ু করছে শুধু। হবু বউটার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য বড় আনচান করছে মন। কিন্তু তা যে অসম্ভব। যথেষ্ট রক্ষণশীল পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সন্তান ফাতিমা। বড় বোন ফরিদার বিয়ে হয়েছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। স্বামী সন্তান নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছে সে। ফাতিমা সদা প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে। পড়ালেখা করেছে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। যথেষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার দরুণ মেয়ে হয়েও এতখানি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। এজন্য মা-বাবাকে সমাজের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল বেশ। নবম শ্রেণীতে আর পড়া হলো না। পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেল। বয়স ১৭ যখন পার হবে হবে ভাব। সমাজের মানুষদের চুলকানি বেড়ে গেল অনেকটা। মেয়ে এত বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিচ্ছে না কেন? মেয়ের কি কোনো গোপন খুঁত রয়েছে? নাকি প্রেমের মতো চরম ঘৃণিত কাজে জড়িয়েছে সে? আরো কত কি কটূক্তি মূলক বাক্য! প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হচ্ছিল ফাতিমা। ঠিক সে সময় বাবার পরিচিত এক ব্যক্তির সুবাদে কায়সার হামিদের জন্য সম্বন্ধের প্রস্তাব এলো। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান কায়সার সাহেব। উচ্চ শিক্ষিত। বি.এ পাশ করে বেসরকারি চাকরি করছে এক বছর হতে চললো। বাড়ি থেকে মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন। আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবে পুত্র? এবার তো লাল টুকটুকে একটা পুতুল বউ নিয়ে আসুক। মাতৃ আদেশ শিরোধার্য। মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে পরিচিত এক কাকার মাধ্যমে ফাতিমার খোঁজ পেলেন কায়সার সাহেবের পরিবার। আর পাত্রী দেখতে গিয়ে প্রথম দেখাতেই বিমোহিত হলেন পাত্র সাহেব!

গোধূলি বেলা। উন্মুক্ত জানালা হতে দেখা মিলছে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের! আকাশের বুকে লাল রঙা তুলির আঁচড়ে অতুলনীয় রূপের বাহার! সূর্য অস্তাচলে গিয়েছে খানিক পূর্বে। পড়ার টেবিলের ওপর রাখা সফেদ সে পৃষ্ঠাটি। চেয়ারে বসে কায়সার সাহেব। মুখশ্রীতে এক অন্যরকম চকচকে ঔজ্বল্য। হাতে বলপেন। স্বচ্ছ, সুন্দর ভঙ্গিতে পৃষ্ঠায় ফুটিয়ে তুলছেন একেকটি মনন শব্দ।

” বধূ তুমি কবে হবে আমার?
তোমারই প্রথম সর্বনা’শা দর্শনে
হারিয়েছি সুখনিদ্রা অলীক সে স্বপনে… ”

গোটা গোটা অক্ষরে ফুটিয়ে তুললেন অন্তরে জ্ব’লন্ত কথাগুলো। লেখার শেষে লাল রঙা বলপেনের পরশে ক্ষুদ্র এক ‘ HEART ‘ চিহ্ন এঁকে দিলেন। লাজুক রঙটা ধীরে ধীরে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়লো যেন। চোখ দু’টো স্থির হয়ে সে-ই ‘ হার্ট ‘ চিহ্নের ওপর। প্রথম প্রেমের সে প্রথম পা:গলামিতে মেতে উঠলেন কায়সার হামিদ। এক বুক সাহস সঞ্চয় করে, লজ্জাকর মনটাকে কোনোরকম দমিত করে চিঠি পাঠিয়ে দিলেন বধূ বাড়ি। হবু বধূ সে চিঠি পেয়েছিল কিনা কিংবা পেয়ে পড়েছিল কিনা জানা হলো না ওনার। কেননা চিঠির কোনো ফিরতি জবাব কিংবা কোনোরকম প্রতিক্রিয়ার দেখা মেলেনি এরপর। তবে ওনার প্রেম প্রেম পা’গলামী ঠিক বজায় রইলো। খালাতো এক ছোট ভাইকে সঙ্গী বানিয়ে শুরু হলো ওনার ভিন্ন মধুরতম যাত্রা।

প্রায় সম্ভব রোজ বিকেলে কাঙ্ক্ষিত রমণীর বাড়ি হতে স্বল্প দূরত্বে এক বিদ্যুৎ খুঁটির পেছনে জায়গা মেলে কায়সার সাহেবের। ভাড়া বাড়ির তিনতলার বাসিন্দা ফাতিমা। রোজ বিকেলে বারান্দায় আসেন অল্প সময়ের জন্য। বারান্দায় রয়েছে ওনার শখের নয়নতারা ফুলের টব। ওড়নায় মাথা ও দেহের ঊর্ধ্ব অংশ শালীনতার সহিত আবৃত করে বারান্দায় আসেন ফাতিমা। বড় আলতো করে ছুঁয়ে দেন নয়নতারা। যত্ন করে পানি ছিটিয়ে দেন গাছে। সে সময় ক্ষণে ওনার ঠোঁটে লেপ্টে থাকা মুচকি হাসি বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে দেয়… অদূরে বিদ্যুৎ খুঁটির পেছনে লুকায়িত মানুষটির বুকে।

‘ হায়! ‘

বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে কায়সার হামিদ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আছড়ে পড়েন ভাইয়ের দেহে। খালাতো ছোট ভাই প্রথমে বিহ্বল হলেও পরবর্তীতে প্রেমিক ভাইয়ের কাণ্ড দেখে শব্দহীন হেসে ওঠে।

রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হবার দরুণ ফাতিমা বাড়ি থেকে তেমন বের হতেন না। তাই ওনাকে একটুখানি দেখার জন্য রোজ বিকেলের ওই স্বল্প সময়টুকু ছিল জাদুকরী কেরামতির মতো। তবে চাকুরিজীবী কায়সার সাহেবের পক্ষে রোজ আসা সম্ভব হয়ে উঠতো না। তবে যেদিন সুযোগ পেতেন সে সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতেন। মোহিত নজরে তাকিয়ে থাকতেন ফাতিমা পানে। ফাতিমা হয়তো জানতেও পারেননি বিয়ের আগেই ওনার হবু বর ঠিক কতটা দিওয়ানা হয়ে গিয়েছে। এভাবেই প্রেম প্রেম খেলায় সময় গড়ালো। এসে গেল সে-ই আকাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত। দুই পরিবারের সদস্য এবং নিকটস্থ আত্মীয়দের উপস্থিতিতে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন কায়সার সাহেব এবং ওনার ফাতিমা।

বিয়ের রাতটা বরাবরই অন্যরকম মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার করে থাকে। ভয়, জড়তা, লজ্জা, আবেগ। সব মিলিয়ে ফাতিমা নত মস্তকে বসে বাসর ঘরে। রজনীগন্ধা এবং গোলাপের মেলবন্ধনে সৃষ্ট সুবাস তীব্র কড়া নাড়ছে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। ঘোমটায় আবৃত মুখখানি। ওদিকে দরজার বাইরে খিমা দিয়ে দাঁড়িয়ে কায়সার সাহেব। অকল্পনীয় আবেগ, আকাঙ্ক্ষী রমণীকে নিজের করে পাওয়ার সুখে কাতর উনি। ভেতরে যাওয়ার মতো সাহস করেই উঠতে পারছেন না যেন। বুক কাঁপছে। ধরফর ধরফর করছে। এত সুখে ম রে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে যে। ভাইবোনেরা ওনাকে ঠেলেঠুলে কোনোমতে ভেতরে প্রেরণ করলো। আপন ছোট বোন কোহিনুর খানম এত ঢঙ দেখে বিরক্ত। বেশিক্ষণ রইলো না সে। চলে গেল সেথা হতে।

প্রথম রাতে নিজের প্রিয় মানুষটিকে প্রথম আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ফেললেন কায়সার সাহেব। ফাতিমা হতবিহ্বল হয়ে শুধু দেখে গেল। অনুভব করে গেল মানুষটিকে। সে রাতে হয়তো ফাতিমা উপলব্ধি করতে পারেননি কায়সার সাহেবের হৃদয়ের ঠিক কতখানি জুড়ে উনি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক বুঝতে পারলেন। লোকটা তাকে উ”ন্মাদের মতো ভালোবাসে। একটু সময়ের জন্য চোখের আড়াল হলেই চেঁচামেচি করে ডাক শুরু হয়ে যায়। বিয়ের পর ফাতিমা বোধহয় দু’দিন একটু শান্তিতে গিয়ে বাবার বাড়ি থাকতে পারেননি। বেলা গড়াতে না গড়াতেই ল্যান্ডফোনে ফোনের পর ফোন। কখন ফিরবে সে। সে কি রওনা হয়েছে। এতটা দেরি হচ্ছে কেন। সে কি নাস্তা পানি কিছু খেয়েছে। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। স্বামীর অভাবনীয় ভালোবাসায় বাবা-মায়ের সামনে প্রতিবার লাজে ম-রতেন ফাতিমা। তবুও আল্লাহ্’র কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করতেন এ মানুষটির স্ত্রী হতে পেরে। এভাবেই ভালোবাসার রঙে মাখামাখি হয়ে বছর গড়ালো কয়েক। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। মা হবার সুখানুভূতি তখনো দেয়নি ধরা। আশেপাশে, আত্মীয় মহলে, যত্রতত্র ফাতিমা কেমন চোখের বি ষ হয়ে উঠলেন। কথায় কথায় খোঁটা শুনতে হতো। বাঁজা, বন্ধ্যা ইত্যাদি প্রায়শ শুনতে হতো। নীরবে চোখের পানি ফেলতেন ফাতিমা। স্বামীকে কখনো কিচ্ছু বলেননি এ বিষয়ে। তবে বিচক্ষণ কায়সার সাহেব ঠিক টের পেয়ে গিয়েছিলাম। কড়া কণ্ঠে আত্মীয়দের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন।

” ফাতিমা বউ হয় আমার। তোমাদের মজার খোরাক নয়। ওর সঙ্গে বুঝেশুনে কথা বলবে তোমরা। নইলে ফলাফল ভালো হবে না কিন্তু। ”

দিনরাত রবের তরে প্রার্থনা করতেন ফাতিমা। কাঁদতেন তাহাজ্জুদের নামাজে লুটিয়ে পড়ে। কায়সার সাহেব স্ত্রীর কষ্ট দেখে মুষড়ে পড়তেন। উনি কিংবা ওনার প্রিয়তমা স্ত্রী দু’জনেই শারীরিক ভাবে সুস্থ। শুধুমাত্র ফাতিমার গর্ভ ধারণ ক্ষমতা কিছুটা দুর্বল। সামান্য অসুবিধা রয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ দিলে ওনারাও একসময় প্যারেন্টস্ হবেন। অগাধ বিশ্বাস রয়েছে ওই মহান রবের প্রতি। এভাবে মাস কয়েক অতিবাহিত হলো। এরমধ্যে ননদ কোহিনুর খানমের মৌখিক অত্যাচার বৃদ্ধি পেল অসহনীয় পর্যায়ের। মেয়েটার কথাবার্তা বেশ উগ্র। আচরণে অহং প্রকাশ পায় সর্বদা। ওপরে ওপরে সবার সামনে ‘ ভাবী ‘ ‘ ভাবী ‘ জপ করে ন্যাকা কণ্ঠে। কিন্তু মনে বি;ষ লুকিয়ে। একাকী পেলেই এভাবে সেভাবে ভাবীকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। নরম মনের ফাতিমা সবটা সয়ে যান নীরবে। মাঝেমধ্যে মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কোহিনুর খানম ধূর্ত শিয়াল রাণী যে। এই ধূর্ত শেয়াল যখন পরিবারে নতুন সদস্য আগমনের খবর পেল প্রচুর পরিমাণে আশ্চর্য হলো! ভাবী মা হতে চলেছে! কি করে! এই মহিলা এমনিতেই নরমধরম স্বভাব দিয়ে সকলের মন জয় করে নেয়। বিয়ের পর থেকে সবার মুখে খালি ফাতিমার সুনাম। সহ্য হতো না ওনার। মুখ বুজে কোনোরকম গিলে ফেলতেন হিংসা, ক্রো’ধ। অবশ্য বিগত বছর দুই ধরে এ পরিবারে ফাতিমার অবস্থানে কিছুটা ভাটা পড়েছে। মা হতে পারার ব্যর্থতায় সে এখন পরিবারে কিছুটা অপছন্দনীয়। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভোলেননি কোহিনুর। জায়গামতো গিরিঙ্গি প্যাঁচ ঠিক লাগিয়ে দিতেন। রায় বাঘিনী ননদিনী হবার প্রচেষ্টা তখনো চলমান।

প্রথমবারের মতো বাবা হবার সুখানুভূতিতে প্লাবিত হয়ে গিয়েছেন কায়সার সাহেব। স্ত্রীকে দীর্ঘ এক আলিঙ্গন করে নিভৃতে কাঁদলেন। ফাতিমাও স্বামীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। বিয়ের পাঁচ বছর পর আল্লাহ্ তাদের ডাকে সাড়া দিলেন! তাদের ঘর আলো করে ছোট্ট এক সোনামণি আসতে চলেছে। রবের শুকরিয়া আদায় করে নফল নামাজ আদায় করলেন দম্পতি। কায়সার সাহেব মসজিদে বড় অঙ্ক দান করলেন। এতিমখানায় একবেলা পেট ভরে খাওয়ালেন। এত খুশি, এত সুখ কোথায় লুকিয়ে রাখবেন উনি! এ সুখে কারোর নজর না লেগে যায়।

প্রথমবারের মতো মা হতে চলেছেন ফাতিমা। গর্ভাবস্থায় কিছুটা জটিলতা রয়েছে। গাইনী চিকিৎসক যথাযথ পরামর্শ দিয়েছেন। সে মতোই স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির যত্নে সময় গড়াতে লাগলো। মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি বাবার বাড়ি ভূমিষ্ঠ হয়। তবে বউ পাগলা কায়সার সাহেব তা হতে দিলে তো? উল্টো শাশুড়ি মা’কে নিজের বাড়ি আনার প্রস্তাব পেশ করলেন। এতে কিছু আত্মীয়ের ভ্রু যথেষ্ট কুঁচকে গেল। এত পেয়ার তাদের গায়ে সয় না যে। বউ নিয়ে এত ঢঙ করার কি আছে বাপু? আর মানুষের বুঝি বউ, বাচ্চা নেই? কায়সার একটু না অনেকটাই অতিরিক্ত করছে। অনেকেই সহমত হলেন এতে।

বেশকিছু জটিলতা নিয়েই ফাতিমার গর্ভবস্থার সময় পাড় হতে লাগলো। বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন উনি। অধিকাংশ সময় অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। চিকিৎসকের আনাগোনা বেড়ে গেল বাড়িতে। কায়সার সাহেব এখন পিতা হবার সুখের চেয়ে স্ত্রীর জন্য অধিক চিন্তিত। চিন্তায় চিন্তায় চোখেমুখে তার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। অবশেষে সে-ই ভীতিকর লগ্ন এলো। আট মাস পনেরো দিনের দিন প্রসব বেদনা উঠলো। গর্ভকালীন দুর্বলতায় ফাতিমার অবস্থা তখন বেশ নাজুক। একদম চোখমুখ বসে গিয়েছে। গাল যেন ভেতরে ডেবে গেছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে খুব। মালাকুল মউত বুঝি এই দেখা দিলো। মৃ°ত্যু যন্ত্রনার সঙ্গে হালকা মোলাকাত করে মহান আল্লাহ্’র অশেষ রহমতে পৃথিবীর আলো দেখলো ফাতিমা, কায়সার দম্পতির প্রথম সন্তান। পুত্র সন্তান। পরিবারের সদস্যরা পুত্র সন্তান পেয়ে বেজায় খুশি। তবে উৎকণ্ঠিত কায়সার সাহেব দৌড়ে ছুটে গেলেন কেবিনে। স্ত্রীর কাছে। স্ত্রীর অচেতন, শুকনো মুখখানি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন উনি।

‘ মা হওয়ার যাত্রাটা এত কষ্টকর কেন? ‘

আস্তে ধীরে স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে উঠলেন ফাতিমা। আকিকা করে সন্তানের নাম রাখা হলো ‘ জাওয়াদ কায়সার। ‘ পুত্র সন্তানের সহিত শুরু জীবনের নতুন অধ্যায়। বিবাহিত প্রেমিক, প্রেমিকা থেকে বাবা-মা হবার যাত্রা। সকলের আদরে ভালোবাসায় বড় হতে লাগলো জাওয়াদ। শিশু জাওয়াদের বয়স যখন চার তখন ইন্তেকাল করলেন ফাতিমার মা। মায়ের মৃ°ত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগে গেল ফাতিমার। সে সময় জাওয়াদ তার ফুপি কোহিনুরের সাহচর্য পেয়েছে বেশ। ফুপির সঙ্গে যথেষ্ট খাতির হয় তার। দুজনার মধ্যে বোঝাপড়াটা গাঢ় হতে থাকে। অতঃপর জাওয়াদ বড় হতে লাগলো। মা, খালা, ফুপি সবার আদরের সে। তীব্র ভালোবাসায় সিক্ত। জাওয়াদের বয়স ছয় পেরোতে চলেছে। কেউ কেউ দ্বিতীয়বার সন্তান নেয়ার পরামর্শ দিতে লাগলেন ফাতিমাকে। ফাতিমার মনেও বাসনা হতো। তবে এ ইচ্ছের ঘোর বিরোধী কায়সার সাহেব। একবার যে যন্ত্রনা সহ্য করে এসেছেন দ্বিতীয়বারের মতো তা সহ্য করা সম্ভব নয়। এবার উনি ম°রেই যাবেন। ফাতিমা গাইগুই করতেন। তবে লাভ হয়নি। কায়সার সাহেবের ‘না’ মানে আসলেই ‘ না ‘।

জাওয়াদের বয়স আট বছর হয়েছে কয়েকমাস পূর্বে। আকাঙ্ক্ষিত খুশির খবরে উদ্ভাসিত গোটা পরিবার। দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে চলেছেন ফাতিমা। তোফায়েল পত্নী কোহিনুর এ সংবাদে খুশি নয়। শিশুপুত্র বিল্লালকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে সে। অন্তরে ঈর্ষা। সবার ভালোবাসায় আর কত সিক্ত হবে এই ফাতিমা? এ যে সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। সকলে যেখানে সুখবরে আনন্দিত। সেখানে ভীত কায়সার সাহেব। প্রথমবারের সে-ই দুঃস্মৃতি আবার না হানা দেয় জীবনে! আস্তে ধীরে ভয় ভাবটা হ্রাস পেতে লাগলো। স্বাভাবিক ভাবেই গর্ভকালীন সময় কেটে যাচ্ছে। ফাতিমা তখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক সে সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন শাশুড়ি মা। মাতৃসম শাশুড়ি মা’কে হারিয়ে ভেঙে পড়লেন ফাতিমা। শোক সংবাদটি ওনার শরীরে ও মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে লাগলো। মাতৃশোকে বিপর্যস্ত কায়সার সাহেব স্ত্রী-সন্তানের কল্যাণ বিবেচনায় কোনোমতে বুকে পাথর চেপে শোক সয়ে নিলেন। আগলে রাখলেন স্ত্রী, পুত্রকে। অনাগত সন্তান এ পৃথিবীর আলো দেখার পূর্বেই আত্মীয় মহলে কারো কারো কাছে ‘ অপয়া ‘ উপাধি পেয়ে বসলো। জন্মের আগেই কিনা এ বাচ্চা সুস্থ সবল দাদীকে খেয়ে নিলো? না জানি ভবিষ্যতে আর কি কেড়ে নেয়।

দিন গড়াচ্ছিল। ফাতিমার অবস্থা সে-ই প্রথমবারের মতো নাজুক রূপ ধারণ করছে। অজানা ভয়ে গা শিউরে উঠতে লাগলো কায়সার সাহেবের। সকলের অগোচরে রবের তরে কাঁদতেন উনি। স্ত্রী, সন্তানের সুস্থতা কামনা করতেন। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেন এ-ই শেষ। আর সন্তান চাই না ওনার। দু’টো বাচ্চা এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়েই বাঁচতে চান হাজার বছর ধরে। তবে ওপর ওয়ালার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন কিছু। প্রসবের নির্দিষ্ট তারিখের বেশ কিছুদিন পূর্বেই আকস্মিক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফাতিমা। দ্রুত ওনাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। চিকিৎসকের পরামর্শে ভর্তি করা হলো। ব্যথা-যন্ত্রনায় পেরিয়ে গেল পুরো একটা দিন। একটা রাত। কায়সার সাহেবের শরীর হিম হয়ে আসছে আশঙ্কায়। এই পুরোটা সময় উনি স্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। কাছছাড়া হননি আবশ্যক কর্ম ব্যতীত। ফাতিমা বেদনাবিধুর চোখে ওনার মুখপানে তাকাতেন মাঝেমধ্যে। আলতো করে ওই মানুষটাকে ছুঁয়ে দিতে চাইতেন। তবে দুর্বল শরীর তা হতে দিতো না। ভালোবাসার দু’টো মানুষ কাছাকাছি থেকেও যেন শত মাইল দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। কায়সার সাহেব শুধু কাঁদতেন। ফাতিমাকে শক্ত করে বুকে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন। এত ভয় হচ্ছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই স্বপ্নময় সংসার জীবনের ইতি ঘটতে চলেছে? কেন?

অত্যধিক বেদনার শিকার ফাতিমা শেষ হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সিজারিয়ান করানো হবে। ফাতিমা কিছুতেই তাতে রাজি ছিলেন না। রাজি তো ছিলেন না কায়সার সাহেব নিজেও। তবে করার কিছু ছিল না। প্রিয়তমার যন্ত্রনা লাঘবের আশায় সিজার সিদ্ধান্তে সায় দিলেন উনি। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার পূর্বে কায়সার সাহেব দীর্ঘ এক চুমু এঁকে দিলেন স্ত্রীর কপালে। আবেগাপ্লুত ফাতিমা ভেজা চুমু দিলেন স্বামীর ঠোঁটে। ক্রন্দনরত সে যুগল একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। ওদের এই আলিঙ্গন, ক্রন্দন সেথায় উপস্থিত মানুষগুলোর হৃদয়ে দাগ কেটে গেল। বালক জাওয়াদ ফুপির পেটে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা।

দীর্ঘসময় ধরে সিজারিয়ান চললো। অবশেষে শোনা গেল অতি মৃদু এক শিশু কণ্ঠে কান্নার শব্দ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো পরিবারের সদস্যরা। নতুন অতিথি চলে এসেছে। কায়সার সাহেব উদ্বেগ ভরা বুকে দাঁড়িয়ে। চিকিৎসক বেরিয়ে আসতেই ছুটে গেলেন উনি।

” ডাক্তার। আমার স্ত্রী? আ.. আমার ফাতিমা কেমন আছে?”

চিকিৎসকের লঘু স্বরে বলা সে জবাব প্র°লয়ঙ্কারী ঝড় তুললো কায়সার পরিবারে। যে ঝড় বিদ্যমান বিগত দুই দশক ধরে। কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অপারেশন টেবিলে ইন্তেকাল করেছেন ফাতিমা। মৃ°ত্যুর পূর্বে শিশু কন্যার মুখ পানে তাকিয়ে বেদনাময় এক টুকরো হাসি উপহার দিয়েছিলেন। সে-ই শেষ। ফাতিমা নামক নারী চির বিদায় নিলেন। কায়সার হামিদ হারালেন ওনার উ’ন্মত্ত ভালোবাসার নারীটিকে। জন্মের পূর্বে দাদীর মৃ ত্যু। জন্মের সময় মা। সমাজের কথিত মানুষগুলোর নিকটে নবজাতক উক্তি হয়ে উঠলো অপয়া, অলক্ষ্মী, বিনাশিণী। জন্ম থেকেই অধিক লাঞ্ছনা, অবজ্ঞার শিকার হতে লাগলো উক্তি। স্ত্রী বিয়োগে কাতর কায়সার সাহেব ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। বি*ধ্বস্ত। সে সময়কালে আশপাশের মানুষগুলোর কথাই ওনার মস্তিস্কে অধিক প্রভাব বিস্তার করেছে। মা ও স্ত্রী হারানোর দ্বৈত শোক একত্রে মনের ঘরে আঘাত হানতে লাগলো। বাকি সবার মতো ওনার স্বীয় র ক্ত, নিজের মেয়ে হয়ে উঠলো চক্ষুশূল। মেয়েকে জন্মের পর মাত্র একবার কোলে নিয়েছিলেন উনি। ঘৃণার আধিপত্য ছিল সে ক্ষণিকের মূহুর্তে। এরপর আর কখনো মেয়েকে কোলে নেননি। এই দুঃসময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করলেন কোহিনুর খানম। অতীতের সকল ঈ’র্ষার শোধ একত্রে তুললেন। ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগলেন ফাতিমার সাজানো গোছানো সংসার। ভাইজান তো ইতিমধ্যে মেন্টালি সিক। বাকি রইলো জাওয়াদ। বাচ্চা ছেলেটা বহু আগে থেকেই ফুপির মায়ার বশে ব’শীকরণ হয়ে গিয়েছে। এই যে বোন হয়েছে, সে তো এই বোন চায়নি। কারণ ভাই-বোন হলে ওর ভাগের আদর কমে যাবে। বাবা-মা ওকে অবহেলা করবে। আর ভালোবাসবে না। নতুন বাবু পাবে সব ভালোবাসা। ফুপি তো মায়ের গর্ভকালীন সময়ে তা-ই বুঝিয়েছে ওকে। ম্যানুপুলেট করেছে বারংবার। সে-ই থেকেই অনাগত বোনের প্রতি ওর বিতৃষ্ণা। এরমধ্যে এই বোনটা দুনিয়ায় আসার বিনিময়ে ওর প্রিয় দাদী, ওর মা’কে কেড়ে নিয়েছে। এই বাচ্চাটা খু*নি। বালক জাওয়াদ ছিল অবুঝ প্রাণ। ওকে ব’শ করা ছিল কোহিনুরের স্রেফ বাঁ হাতের খেল। চোখের পলকে নবজাতক উক্তি কায়সার হয়ে উঠলো বাবা, ভাইয়ের চোখের বি*ষ। নানী নেই। দাদী নেই। বড় খালা ফরিদা ভালোবেসে উক্তির দায়িত্ব নিলেন। উক্তির শৈশবের বছর দুই কাটলো খালার ভালোবাসায়। তবে খালা তো অন্যের ঘরণী। যখন তখন আসার সুযোগ ছিল না। সময় পেলেই ছুটে আসতেন। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখতেন ওকে। যত্ন করতেন। ও যে ওনার ছোট বোনটার বড় আদরের, শখের সন্তান। দীর্ঘ কয়েক বছর বাদে এই সন্তান নিয়ে বোন ফাতিমার ছিল বহু স্বপ্ন। বরাবরই মেয়ে সন্তান চেয়ে এসেছিলেন উনি। মেয়ে সন্তান ঘরের রহমত স্বরূপ আসে। প্রথম সন্তান তো ছেলে হলো। দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে অনেক আশা ছিল। মেয়েই চেয়েছিলেন উনি। মেয়ের নামটাও ওনার নির্বাচন করা। স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘ উক্তি কায়সার। ‘ সে-ই শখের সন্তান আজ সবার অবহেলায় বড় হচ্ছে। উক্তি তো সাধারণ কোনো শিশু নয়। বিশেষত্ব রয়েছে ওর। ওর যত্ন, ভালোবাসা অধিক প্রয়োজন। জন্ম থেকেই অবহেলিত উক্তি চুপচাপ স্বভাবের। কাঁদে কম। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কথার অনুপস্থিতি। পরিবারের সদস্যরা তো ওর থেকে মুখ ফিরিয়েই নিয়েছিল। সেভাবে কেউ লক্ষ্য করেনি। ওর নীরব স্বভাবকে গুরুত্ব দেয়নি। তবে ওর বয়স যখন তিনে উপনীত হলো তখন বিষয়টা স্বচ্ছ পানির ন্যায় পরিষ্কার হয়ে উঠলো। ভোকাল কর্ডে সমস্যাজনিত কারণে জন্মগতভাবে বোবা হয়ে জন্মেছে উক্তি। বোবা সে তবে বধির নয়। কানে শুনতে পায়। বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর এক মূহুর্তের জন্য বোধহয় থমকে গিয়েছিলেন কায়সার সাহেব। ফরিদার সে কি কান্না। উনি বারবার বলতেন উক্তি একটু বেশিই চুপচাপ। কারো সঙ্গে তেমন একটা ইন্টারেক্ট করে না। ওর কোনো অসুবিধা রয়েছে কিনা দেখা দরকার। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। কেউ ওনার কথায় পাত্তা দেয়নি। আজ যখন নিশ্চিত হলো তখন করার কিছুই নেই। মূক হয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে অপয়া, অলক্ষ্মী উক্তির।

এভাবেই বাবা, ভাইয়ের অবহেলায় বড় হতে লাগলো উক্তি। বোবা মেয়েটির জীবন কাটছিল অবজ্ঞায়, অপমানে। বোবা হবার ফলস্বরূপ বন্ধু ছিল না কোনো। বোবার সঙ্গে কিসের বন্ধুত্ব! বরাবরই শ্রেণিকক্ষের প্রথম বেঞ্চে একাকী বসতো মেয়েটা। সহপাঠী, অভিভাবকদের ওকে নিয়ে সে কি আপত্তি! বোবা মেয়েটা প্রতিবন্ধী স্কুলে না পড়ে ওদের সঙ্গে কি করছে। ও কি পড়া বলতে পারে, না কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে! ওকে নিয়ে সহপাঠীদের আপত্তির শেষ ছিল না। কিছু শিক্ষক অবধি ওকে বাঁকা চোখে দেখতেন। অপছন্দ করতেন। আর বাকিদের আদরের ছিল ও। একটু বেশিই স্পেশাল। মেধাবী শিক্ষার্থী উক্তি এভাবেই অন্য সবার সঙ্গে পড়ালেখা করে স্কুল সমাপ্ত করলো। শিখে নিলো সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। সেই ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করতো সে। অনেকে বুঝতো না শব্দহীন ভাষাটা। হাতেগোনা কয়েকজন বুঝতো। এই একাকীত্বে ভরপুর স্কুল জীবনেই এক টুকরো স্বস্তি হয়ে আগমন হলো বান্ধবী শিমুর। সে-ই থেকে মানিকজোড় বন্ধন আরম্ভ। আজও রয়েছে অটুট। ভাবী নিশাতের সঙ্গে উক্তির পরিচয় বছর কয়েক পূর্বে এক প্রতিবন্ধী স্কুলে। উক্তি অবুঝ সেই শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসে। সেখানে মাঝেমধ্যে যায় সময় কাটাতে। বাচ্চাদের সঙ্গে খুনসুটি করে। টুকটাক কিনে নিয়ে যায়। সেথায় শিশুদের নিষ্পাপ আনন্দে আত্মিক শান্তি লাভ করে। সেই প্রতিবন্ধী স্কুলে নতুন শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে নিশাত। মিষ্টভাষী নিশাত এবং বোবা উক্তি অজান্তেই এক আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুললো। দুজনার বন্ধন চোখে পড়ার মতো। অপূর্ব টান তাদের মধ্যে! কাকতালীয় ভাবে এই নিশাত ই তাদের পরিচয়ের ঠিক বছর বাদে ওর ভাবী হয়ে বাড়ি এলো। অসমবয়সী বন্ধুত্ব থেকে গড়ে উঠলো ননদ, ভাবীর সুমধুর সম্পর্ক।

চলবে।