তোমাতেই বসবাস পর্ব-০২

0
297

#তোমাতেই_বসবাস
লেখিকাঃনওশিন_আদ্রিতা
পর্বঃ২

চোখ মেলে তাকাতেই দৃষ্টি পড়লো আমার অচেনা এক রুমের দিকে।মাথা যন্ত্রণায় চোখ মেলে তাকাতেও যেনো জান বেরিয়ে আসতে লাগলো।অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকাতেই বুঝলাম এটা হস্পিটাল পাশেই একজন নার্স স্যালাইন ফুরিয়ে যাওয়াই নতুন করে লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি অনেক কষ্টে বলে উঠলাম

—নার্স এক গ্লাস পানি হবে।

আদ্রিতার আওয়াজ পেতেই নার্স স্যালাইন লাগিয়ে তাকে পানি পান করিয়ে দিলো

—এখন কেমন লাগছে আপনার।
—এখন আগের থেকে কিছুটা বেটার ফিল করছি।
—আমি সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকছি আপনি রেস্ট করুন

নার্স চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে ডেকে উঠলো আদ্রিতা
—আমাকে এখানে কারা নিয়ে এসেছেন।
—আমাদের হস্পিটালের একজন সিনিয়র ডক্টর আপনাকে ৭ দিন আগে নিয়ে এসেছিলেন।তিনি এখানে মাসে একবার করে আসেন।

কথাটা বলেই নার্স চলে গেলেন সেখান থেকে।

আদ্রিতা অবাক হয়ে পড়ে রইলো বিছানাই । সাতটা দিন পার হয়ে গেছে।সে কল্পনাও করতে পারছেনা। চোখ বেয়ে না চাইতেও অশ্রুকোণা বেরিয়ে এলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার মায়ের বলা কথা গুলো আবিরের আচরণ লিনার বিশ্বাসঘাতকতা তাকে যতোটা আঘাত দেয়নি তার চেয়ে দ্বিগুন আঘাত তার বাবা মা দিয়েছে তাকে।

সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ফুফিয়ে কেদে উঠলো
—কেন এমন করলে আল্লাহ আমার সাথে আমি ত কখনো কারো ক্ষতি চায়নি তুমি ত জানো। আমি কিভাবে আমার আব্বু আম্মুর সম্মান হানী করতে পারি আম্মু একবার ও বিশ্বাস করলোনা আমাকে। আমাকে নাই বা বিশ্বাস করলো কিন্তু নিজের দেওয়া শিক্ষাকে বিশ্বাস করলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো।

হঠাৎ দরজা খুলার আওয়াজে কান্নারত ঝাপসা চোখ নিয়েই তাকালো।সামনের তাকানো ব্যক্তিটিকে দেখে অবাক হলো কারন সামনের দাঁড়ানো মানুষ টি আর কেউ না তার নানাজান। বিশ বছরের যুবতী যেনো মহূর্তে বাচ্চা হয়ে গেলো এতোক্ষন নিশ্বব্দে কান্না করা মেয়েটি এবার ফুফিয়ে উঠলো। সাথে সাথে শামসুর রহমান দৌড়ে এলেন নাতনির কাছে।আদুরে হাতে জড়িয়ে ধরলেন নিজের কলিজার টুকরোটাকে।তার আরও নাতি নাতনি আছেন কিন্তু তিনি কোন এক বিশেষ কারণেই তার এই ছোট নাতনি টাকে বাকীদের তুলনাই বেশিই ভালোবাসেন।

—কি হয়েছে আমার বুনি টার দেখি দেখি কান্না করেনা চোখ খুলো দেখি নানাজান কে বলো কি হয়েছে।

—না,,,না,, নানা জান ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে না,,নাজান। আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেও না,,নাজান তুমি না ডাক্তার তোমার কাছে না এতোগুলা ডিগ্রি আর ঔষধ আমার অসুখের চিকিৎসা করে দেও নানাজান।

শামসুর রহমান নাতনির এমন কান্নাই হতবুদ্ধ হয়ে পড়লেন। তিনি তো খান বাসায় ছুটেছিলেন নাতনির বিয়ের কথা শুনে। মাঝরাস্তাই আদ্রিতাকে ওই ভাবে পেয়ে দিক বেদিক শূন্য হয়েই ছুটে এসেছিলেন হস্পিটাল। নিজের মেয়েকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলেন কিন্তু অপরপাশ থেকে কোন প্রকার জবাব আসেনি আর আদুরের নাতনিকে এই অবস্থাই হস্পিটালে ফেলে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।

অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন আদ্রিতার কান্না থামানোর নাম গন্ধ না দেখে তিনি না পেরে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন অতিরিক্ত চিন্তা কান্না আর গাড়ির আঘাতে আদ্রিতার মাথায় এমনিতেই গাঢ় আঘাত সৃষ্টি হয়েছে এতো কান্না তার শরীরের জন্য মৌটেও ঠিক না।

শামসুর রহমান নাতনিকে ঠিকভাবে শুয়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়লেন খান বাড়ির উদ্দেশ্য এইসবের কারণ তিনি জানতে চান পরে আবার কি মনে করে নাতনির পাশে বসেই কাউকে কল দিলো।কিছুক্ষন কথা বলে যেনো হালকা হলেন তিনি তবুও নিজের মেয়ের প্রতি রাগের রেশ কমলোনা।

সন্ধ্যার দিকে আদ্রিতার জ্ঞান ফিরলো। শামসুর রহমান তাকে উঠতে দেখেই ধরে ফেললেন যত্ন সহকারে বসিয়ে দিলেন

—বুনি কষ্ট করে তৈরি হয়ে নেও নার্স তোমাকে সাহায্যে করবে(মাথায় হাত বুলিয়ে)
—কই যাবো নানাজান??
—ঢাকা ফিরে যাবো আমরা সেখানের হস্পিটালেই তোমার বাকি চিকিৎসা পূরণ হবে।

শহর ছাড়ে যাওয়ার কথা শুনেই আৎকে উঠলো আদ্রিতা। এই রাজশাহী শহর টা যে তার জান এর আনাচে কানাচে কতো সৃতি তার এখানে তার পরিবার এই পরিবার ছেড়ে কিভাবে যাবে সে। কিন্তু পরের মহূর্তে নিজের মনকে শক্ত করলো তাকে যে এখান থেকে যেতেই হবে। আদ্রিতা আর কিছু না বলেই নার্সের সাহায্য উঠে যেয়ে তৈরি হয়ে নিলো। একটা কথাও বললোনা কিন্তু গাড়ি খান বাড়ির সামনে থামতেই অবাক হলো

—নানাজান আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছো আমি যাবোনা এখানে আমাকে নিয়ে চলো এখান থেকে।

হঠাৎ আদ্রিতার এমন হাইপার হয়ে যাওয়াই শামসুর রহমান যত্ন সহকারে আদ্রিতাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো

—তোমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়েই আমরা বেরিয়ে পরবো সোনা আমার। তুমি চিন্তা করোনা নানাজান আছে না কেউ কিছু বলতে পারবেনা। চলো।

আদ্রিতা তবুও মানতে নারাজ অনেক কষ্টে শামসুর রহমান তাকে নিয়ে নামলেন আর নামতেই হতবাক হয়ে গেলেন কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেললেন যে বাড়ির মেয়ে একসপ্তাহ ধরে বাড়ি আসেনি সে বাড়ি আজ নতুন বউ এর মতো সেজে আছে নানানরকম ঝাড়বাতি ফুল দিয়ে গান বাজনার সুরে যেনো চারপাশ মুখরিত।

ভিতরে প্রবেশ করতেই আদ্রিতা আরও জোড়ে খামচে ধরলো তার নানাজানের কোর্ট।ভিতরে ঢুকতেই চোখ পড়লো হলরুমের একসাইডে স্টেজে বসে থাকা আবিরের দিকে।সোনালি পাঞ্জাবিতে থাকা সুদর্শন যুবোককে দেখে পুনরায় আদ্রিতার চোখ জোড়া থমকে গেলো ভারি হয়ে আসলো আখিপল্লব। বাতাস ও বিষাক্ত ঠেকলো। আবিরের হাতের মাঝেই লিনার হাত স্পষ্ট। হঠাৎ লিনার চোখ পড়লো আদ্রিতার উপরে সাথে সাথেই চিল্লিয়ে উঠলো সে। সাথে সাথে গান বন্ধ হয়ে গেলো সবার চোখ পড়লো আদ্রিতার উপরে।

—এই মেয়ে তুই আবার এসেছিস কেন সেদিন না খুব ঢং করেই বেরিয়ে পড়লি একসপ্তাহ যেতে না যেতেই ফিরে এলি ছ্যাছড়া মেয়ে।নাকি তোর কোন আশিক তোকে জায়গা দেয়নি। দিবোও বা কি করে তোর মতো গাইয়া মেয়েকে ইউজ করা ছাড়া আর কি বা করবে না আছে স্টাইল না আছে অন্যকিছু চেহারাও রঙ টাও ত শ্যমলা।সে আসেছিলো আমার আবিরকে বিয়ে করতে যতোসব ছ্যাছড়া।

লিনার কথায় চোখ জোড়া আপনা আপনি নেমে গেলো নিচে।আসলেই রুপ বলতে তার কাছে কিছুই নেই উজ্জ্বল শ্যামা মেয়ে সে যেখানে লিনা দুধে আলতা আজকাল কার আধুনিক মেয়ে চলাফেরা স্টাইল কথাবার্তা সব দিক দিয়েই যেকোন ছেলেই তার প্রেমে পড়বে নিশ্বব্দে।শামসুর রহমান বাকশক্তিই যেনো হারিয়ে ফেললেন।

—এইসবের মানে কি এই মেয়ে তোমার সাহস,,,,

শামসুর রহমানের কথার মাঝেই মিসেস খান এগিয়ে এলেন।

—তুমি ওকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছো বাবা। আর তুই বেরিয়ে যা এই বাসা থেকে।

সাথে সাথেই শামসুর রহমান মেয়ের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।পরিবেশটা আগের থেকেও নিরব হয়ে গেলো।সবার মাথায় নিচু।

—আমার নাতনি আমার সাথেই যাবে থাকবেনা তোমাদের মতো মানুষদের সাথে যাও বুনি তোমার কাগজ পত্র নিয়ে আসো দ্রুত।

আদ্রিতার পা যেনো আসার হয়ে আসছে। চোখের পানি গুলো যেনো ফুরানোর নামই নিচ্ছেনা। আশেপাশে চোখ খালি খুজে চলেছে তার আব্বুকে।আদ্রি কোনরকম পা বাড়িয়ে রুমে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো তার আব্বু তার ঘরে তার ছবির ফ্রেম নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

আদ্রিতা কাপা কাপা গলাই ডাক দিলো
—আ,, আব্বু

মেয়ের ডাক কানে আসলেও চোখ মেলে তাকালেন না তিনি।অন্ধকার ঘরে আদ্রিতার টের পেলোনা তার আব্বুর চোখের কোনার পানি

—আ,,আব্বু তুমি তাকাও না আমার দিকে।তুমিও কি বাকিদের মতো ঘৃণা করো আমাকে আব্বু।আব্বু তোমার প্রিন্সেস এর খুব কষ্ট হচ্ছে আব্বু একবার তাকাও

আদ্রিতা নাহিদ খানের হাত ধরে অনেকক্ষন ঝাকানোর পরেও যখন তার জবাব এলোনা তখন ছোট মনটাই অভিমানের পাহাড় জমে উঠলো সব কিছু সুটকেশ এ ভরে বেরিয়ে আসার সময় তার আব্বুর কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলো।এই কাজটা সবসময় নাহিদ খান করতেন যখন ই বিজনেস এর কাজে কোথাও যেতেন তখন ই মেয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।

আদ্রিতাকে বের হতে দেখেই লিনা বলে উঠলো
—কি খুব খারাপ লাগছেনা এটা ত কেবল শুরু খুব শখ জেগেছিলোনা আবিরকে আমার সত্যি জানানোর নে দেখ এবার সব কেরে নিয়েছি তোর থেকে তোর পরিবার তোর আবির তোর সম্মান এমনকি শহর থেকেও তোকে বেরিয়ে যেতে হবে।

আদ্রিতা হাসলো লিনাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। যেখানে তার বাবা মা তাকে বিশ্বাস করছেনা সেখানে অন্যকারো সাথে কি নিয়েই বা লড়বে।

চলবে?