তোমাতেই বসবাস পর্ব-০৩

0
266

#তোমাতেই_বসবাস
#লেখিকা:নওশিন_আদ্রিতা
#পর্বঃ৩

গাড়িতে বসতেই চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম আমি চোখের সামনে ভেসে চলেছে আব্বুর মুখটা।যে মুখে সবসময় থাকতো আমাকে নিয়ে গর্ব সে মুখে আজ লজ্জিত ভাবটা কিভাবে মেনে নেই আমি। তুই ভুল করলি লিনা বড় ভুল করলি। আমাকে সে ভুলের শাস্তি দিলি যে ভুল আমি কখনো করিইনি। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়ে তুই নিজেকে যতোটা সুখি মনে করচ্ছিস এই প্রকৃতি তোর জন্য ততোটাই কঠোর হচ্ছে।কথাগুলো ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁট জোড়াই।

আদ্রিতা গাড়িতেই কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে নিজেই বুঝতে পারলোনা। শামসুর রহমান নাতনির দিকে তাকাতেই তার চোখ গেলো তার নাক দিয়ে পড়তে থাকা রক্তে। আৎকে উঠলেন তিনি।তিনি প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট। জীবনের ৬০বছরে কম কেশ তিনি দেখেন নি। কম মানুষকে তিনি বাচার নতুন পথ করে দেন নাই। কিন্তু নিজের আদরের নাতনির এই অবস্থা দেখে তিনি নিজেই যেনো দিক বেদিক শূন্য হয়ে পড়ছে। যতোদ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিলেন তিনি। কারন এই ভাবে রক্তক্ষরণ হলে আদ্রিতার যেকোন মহূর্তে ব্রেন স্টোক করতে পারে।সবার ধারণা ব্রেনস্টোক শুধু বয়স্কদের হয় কিন্তু এমনটা না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এইটা যুবোক যুবতীদের হয়ে থাকে কারন সে বয়সে অতিরিক্ত মানসিক চাপ বহন করা সম্ভব না।

রাতের বেলাই রাস্তাই তেমন জ্যাম না থাকাই খুব দ্রুতই তিনি পৌছে গেলেন। হস্পিটালে নিয়ে যেতেই নার্স ওয়ার্ড বয় এসে আদ্রিতাকে ইমার্জেন্সি রুমে সিফট করে দিলো।শামসুর রহমান সাথে সাথেই একটা নাম্বারে কল দিলেন। কিছুক্ষন কথা বলেই ফোন রেখে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন এতো ধকল তার দ্বারা নেওয়াও সম্ভব হচ্ছেনা নিজের আদরের নাতনির এই অবস্থা যেনো মহূর্তে তার বয়স আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষনের মাঝেই সাদা এপ্রোণ পড়ে হাজির হলো এক যুবোক।শামসুর রহমানে কাধে হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে তাকালেন তাকাতেই দেখলেন তার পরিবার এখানে এসে হাজির। সবার চোখ মুখেই চিন্তার ছাপ।শামসুর রহমান যুবোকটির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলেন

—আমার বুনির ওরা কি অবস্থা করেছে দাদুভাই। আমার বুনিটা অপরেশান থেয়েটারে। আমার হাস্যজ্বল পাগলীটা আজ নিস্তেজ হয়ে আমার সামনে পড়েছিলো দাদুভাই আমি কিছু করতে পারিনি।

—চিন্তা করোনা দাদাজান আমরা এসে গেছিনা সোনাবাচ্চারে আর কিছু হতে দিবোনা তাকে আমাদের কাছেই রাখবো। কিন্তু তুমি ভেংগে পড়লে তো চলবেনা।

শামসুর রহমান এর কিছু বলার আগেই পিছন থেকে উনার বড় ছেলে আফতাব রহমান বলে উঠলেন

—আদ্রিয়ান তুমি নাহয় ভিতরে যাও মেয়েটার অবস্থা কেমন আর তোমার প্যাক্টিস ও যেহেতু শেষ এর দিকে তোমার থাকাটা উচিত সেখানে।

বাবার কথায় সায় জানিয়ে আদ্রিয়ান দ্রুত মাস্ক পড়ে ঢুকে পড়লো।কিছুক্ষনের মাঝেই সেখানে প্রবেশ করলো আরও একটু যুবোক নিস্তেজ হয়ে আসা শামসুর রহমান যেনো আশা পেলেন ভরসার হাত পেলেন। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন

—ইয়্যাং ম্যান

ছেলেটি কাছে এসেই শামসুর রহমান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

—কিহ ওল্ড ম্যান আজ তো তোমাকে সত্যিই ৭০ বছরের বুড়ো লাগছে।আমার বউ বুঝি পালিয়ে গেছে।
—ইয়্যাং ম্যান আমি তো জানি আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তোমাদের মতো আর শক্তি নেই তাই তো তোমাকে ডাকা।
—কি করতে পারি ওল্ড ম্যান তোমার জন্য তো জান টাও দিতে রাজি খালি আমাকে তোমার বুড়ি বউটারে দিয়ে দেও তাহলেই হবে।

শামসুর রহমান হাসলেন তিনি জানেন ছেলেটা এই মহূর্তে এইসব তাকে হাসানোর জন্যই বলছে।ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু গুন আছে তার এতো এতো স্টুডেন্ট দের মধ্যে তার ফেবরেট স্টুডেন্ট নির চৌধুরী। সাইকোলজিস্ট ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে ট্যালেন্টেড স্টুডেন্ট। রাগী হলেও বুঝক্ষমতা তার অসাধারণ। আর এক বছরের প্যাক্টিস শেষ করলেই সেও সাইকোলজিস্ট হয়ে যাবে। শামসুর রহমান তার দায়ভার তার এই স্টুডেন্ট দিবে বলেই ঠিক করেছে তার আগে নিরকে দিতে হবে সবচেয়ে কঠিন পরিক্ষা

—ইয়্যাং ম্যান আজ অব্দি সব চ্যালেঞ্জ এক্সামে তুমি টপ করেছে আরও একটা চ্যলেঞ্জ তোমার সমুক্ষে আমার নাতনি আমার কলিজা বলতে পারো আমার অর্ধেক দুনিয়া সে।তাকে তোমার সুস্থ করতে হবে ইয়্যাং ম্যান। আমার পুরনো আদুবুড়িকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবা না। ধরে নেও এটা আমার গুরুদক্ষিনা।

—আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট ওল্ড ম্যান।
আমার যে পারতেই হবে। তুমি নিজেও জানোনা ওল্ডম্যান তুমি আমাকে কি দিয়েছো।(মনে মনে)

(আদ্রিতার নানুবাড়ি তেমন বড় না। শামসুর রহমানের দুই ছেলে তিন মেয়ে। তিন মেয়েই বিয়ে করে শশুড় বাড়িতে আছে।আর দুইছেলেই বিজনেস ম্যান। এই হস্পিটাল শামসুর রহমানের নিজের বানানো। ব্যবসা তিনিও করেন কিন্তু ডাক্তারি তিনি ছাড়তে পারেন না।উনার কাছে মানসিক রোগ সবচেয়ে ভয়ংকর শারিরীক রোগে বাচার চান্স থাকলেও মানসিক রোগ এ বাচার চান্স খুবই কম। নিজের সাথে যুদ্ধ করে বাচতে সবাই পারেনা।উনার বড় ছেলে আফতাব রহমানের দুই ছেলে আদ্রিয়ান,আর ছোট ছেলে আদ্রফ রহমান। আদ্রিয়ান নিউরোলজিস্ট (বয়স ২৬) আর ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে(বয়স ২৩)।আর ছোট ছেলে আকিব রহমান তার দুই মেয়ে নওমি রহমান এবং রুহি রহমান।দুইজনেই এবার অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।আর শামসুর রহমানের তিন মেয়ে বড় মেয়ে ইরিনা চৌধুরী তারই ছেলে নির চৌধুরী উনার আরও একটি ছেলে রিয়াজ চৌধুরী আর মেঝো বোন ঐশি হাসান উনার এক মেয়ে। আর সবার ছোট রেনু মানে আদ্রিতার মা)

সকাল হতেই হস্পিটাল মাথায় উঠিয়ে ফেলেছে আদ্রিয়ান।তার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নার্স। রাগে চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।আদ্রিতা ভয়ে চুপচাপ বসে আছে।

—আপনাদের মিনিমাম কমসেন্স নেই একটা পেসেন্ট অজ্ঞান অবস্থায় আছে এর মানে এই না সে মা*রা গেছে।আপনি কিভাবে তাকে রুমে একা ফেলে রেখে যেতে পারেন কতোখানি রক্ত ক্যানোলার সাথে উঠে গেছে আপনাদের কোন আইডিয়া আছে।আপনাদের সবার চাকরি আমি আজকেই শেষ করবো জাস্ট গেট লস্ট।

আদ্রিয়ান এর চিৎকারের আওয়াজে সবাই শুরুশুর করে বেরিয়ে গেলো।আদ্রিয়ান রেগে গজগজ করতে করতে টুলের উপর বসে পড়লো।এই বোনটা তার জান। তার নিজের বোন না হলেও নিজের বোনের থেকে কম ভালোবাসেনা সে আদ্রিতাকে।

—ভাইয়ু আমি ঠিক আছি তুমি অযথা হাইপার হচ্ছো।
—তোর অযথা মনে হচ্ছে একবার হাতটার দিকে তাকিয়েছিস তুই এদের একটাকেও আমি ছাড়বোনা বলে দিলাম।

আদ্রিয়ানের রাগ কমছেনা দেখে আদ্রিতা এবার মুখটা কাদো কাদো করে বলে উঠলো
—ভাইয়ু খাবো খুদা লেগেছে। তুমি আমাকে কি না খাওয়াই রেখে শাস্তি দিবা।

আদ্রিয়ানের টনক নড়ে দাদাজান তাকে বলেছিলো জ্ঞান ফিরলে যেনো আদ্রিতাকে খাওয়াই দেয়। এইজন্যই সে এসেছিলো আদ্রিতার কেবিনে আর এসেই দেখে আদ্রিতা পানি খাওয়ার জন্য হাত বাড়াতে যেয়ে টান লেগে ক্যানোলাতে রক্ত উঠে গেছে আর তা দেখেই আদ্রিয়ান এর দিন দুনিয়া ঘুরে উঠেছিলো।

—এই দেখ আমি তো ভুলেই গেছি আমি তো খাবার এনেছি দ্বারা নিয়ে আসছি।

বলেই সুপ এর বাটি আদ্রিতার সামনে নিয়ে আসতেই আদ্রিতা নাক মুখ কুচকে ফেলে।

—কি হলো এমন করিস কেন
—আমি এইসব খাবোনা এইসব কোন স্বাভাবিক মানুষ খাইতে পারে নাকি আজব।
—কিন্তু বনু এইসব ই তোকে খেতে হবে।
—নাহ আমি খাবোনা।
—এইভাবে কেউ জেদ করে নাকি। এখন তোকে ভারি খাবার দেওয়া যাবেনা সোনা বাচ্চা।
—উফফ আমি কিছু জানিনা।
—দে,,,,

আদ্রিয়ানের কথার মাঝেই রুমে প্রবেশ করে নির।তাকে দেখেই তো আদ্রিতার হেচকি উঠে আসে।ভয়ে তার অন্তরআন্তা কেপে উঠে।মনে পরে যায় তিন বছর আগের ধমক। সাথে সাথেই চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে।

—কি হচ্ছে এতো চেচামেচি কিসের জন্য(রাগী স্বরে)
—দেখনা কখন থেকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু খাবেনা বলে জেদ করছে।
—দে দেখি কিভাবে না খাই। আদর করে শাসন করলে কোন মানুষ টা শুনবে বুঝা আমাকে।
—হু নে দেখি কিভাবে এই জেদি বাচ্চাকে খাওয়াস।
—বাচ্চা আজ বিয়ে দিলে কাল তিনবাচ্চার মা হয়ে যাবে সে নাকি বাচ্চা(মনে মনে)

নির আদ্রিতার সামনে বসতেই আদ্রিয়ান বলে উঠে

—তাহলে তুই ওকে খাওয়া ওর কিছু ঔষধ আনা লাগবে আমি নিয়ে আসছি।

আদ্রিয়ান এর কথা শেষ হতে না হতেই আদ্রিতা চেচিয়ে উঠলো
—নাহ ভাইয়ু।

আদ্রিয়ান নির দুইজনেই চমকে উঠলো।
—আমি এখুনি চলে আসবো প্রমিজ যাবো আর আসবো।৫ মিনিট

আদ্রিতা বিরবির করে বলে উঠে।
—সেদিন দুইমিনিট সামনে থাকাতেই হাফ মার্ডার করে দিচ্ছিলো আজ তো পাচ মিনিট। নির্ঘাত আজ আমার জীবনের শেষ দিন হবে বিদায় পৃথিবী।

আদ্রিয়ান দূরে থাকায় সে না শুনতে পেলেও নির ঠিকই শুনে নিলো আদ্রিতার কথা চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই আদ্রি মনে মনে বলে উঠলো

“ও আল্লাহ তুমি মাটি ফাক করো আমি ঢুকে যায় তাও এই রাক্ষস রাজার হাত থেকে রক্ষা করো”

চলবে?