তোমাতেই রহিব বিলীন পর্ব-১৩

0
889

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আরিফ। কোথায় যাচ্ছ? আজ তো আমাদের ডক্টরের এপয়ন্টমেন্ট আছে। আমি তো রেডি হয়ে বসে আছি। তুমি যাবে না?”

জিজু দ্রুত বেগে সিঁড়ি টপকে দুতলায় নিজের রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছেন আর শঙ্কিত কন্ঠে পেছন থেকে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,,

“এপয়ন্টমেন্ট আজ ক্যান্সেল করে দাও। হৃদির বিয়ের পর এপয়ন্টমেন্ট ফিক্সড করা যাবে!”

“কিন্তু কেনো আরিফ? আজ তো তুমি ফ্রি আছো তাই না?”

জিজু রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,,

“শরীরটা খারাপ লাগছে আজ। রেস্ট নিতে হবে। কথা না বাড়িয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে আমার রুমে এসো।”

জিজুর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আপু তব্ধ শ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর মাথা নিচু করে মুখমন্ডলে বিষাদের ছাপ ফুটিয়ে কিচেন রুমের দিকে পা বাড়ালেন। পাশ থেকেই মনে হলো আহনাফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। কপাল কুঁচকে আমি আহনাফের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আহনাফ আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে মাএ দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লেন। সন্দিহান কন্ঠে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“কি হলো? কোনো কারণে আপনি চিন্তিত বা আপসেট?”

আহনাফ প্রসঙ্গ পাল্টাতে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললেন,,,

“রাত হয়ে যাচ্ছে। আই থিংক উই হেভ টু গো নাও।”

নেহাল ভাই তনিমা আপুর হাত ধরে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। হাসি খুশি মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যেই কেমন উদাসিনী হয়ে উঠলেন। মাথা নিচু করে তনিমা আপু মুখমন্ডলে নিরাগের ছাপ ফুটিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফ ঈষৎ বিরক্তি বোধ করে তনিমা আপুর কাঁধে হাত রেখে অধৈর্য্য কন্ঠে বললেন,,

“ডোন্ট বি আপসেট ইয়ার। তোকে এভাবে আপসেট দেখতে আমাদের ভালো লাগে বল?”

তনিমা আপু নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। কেবল মুখের আদলে মন খারাপের চিহ্ন এঁকে রেখেছেন। মৌনতা ভেঙ্গে আহনাফ পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললেন,,

“বাইরে চল। মন ভালো হয়ে যাবে!”

নেহাল ভাই ও তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তি মাখা কন্ঠে পাশ থেকে বললেন,,

“প্লিজ তনিমা। একটু হাস। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। এভাবে ভেঙ্গে পড়লে হবে? আমরা তো আছি তোর পাশে তাই না?”

ইতোমধ্যেই আম্মু খানিক সংকোচ বোধ করে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। ইতস্ততবোধ করে আম্মু আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এই ভর সন্ধ্যায় তোমরা কোথায় যাচ্ছ আহনাফ? আসলে আত্নীয়-স্বজনরা প্রশ্ন তুলছেন তো তাই জিগ্যেসা করলাম।”

একবার দম নিয়ে আম্মু পুনরায় বললেন,,

“আসলে আরিফ একটু আগে ঠিকই বলেছিলো। তোমাদের এভাবে মেলামেশাটা সবার দৃষ্টিকটু লাগছে!”

আহনাফ যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকে ম্লান হেসে আম্মুকে বললেন,,

“আন্টি কে কি ভাবল এসব নিয়ে আপনি খামোখা দুঃশ্চিন্তা করবেন না। হৃদির বিয়ের পর আই থিংক আমার এবং প্রভার মেলামেশাটা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না। বাকিটা সময় হলে বাবা আপনাদের অভেয়েসলি জানাবেন। সো আপাতত আমাদের মেলামেশাটাকে আপনি এবং আমাদের আত্নীয় স্বজনরা স্বাভাবিক চোখেই দেখতে পারেন!”

“ঠিক আছে। বাট তোমরা এখন কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বলবে?”

জোরপূর্বক হাসি টেনে আহনাফ বললেন,,

“একচুয়েলি আন্টি। আমি প্রভাকে নিয়ে একটু পার্লারে যাচ্ছি। ১/২ ঘন্টার মধ্যেই আশা করি ব্যাক করব। অযথা চিন্তা করবেন না আপনি। আই থিংক, আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার আমরা আসি?”

আম্মু ইতস্ততবোধ করে মাথা নাঁড়ালেন। আম্মুর সম্মতি পেয়ে আহনাফ আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। পেছনে অবশ্য নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু ও আছেন। পার্কিং লনে পার্ক করে রাখা আহনাফের গাড়িটায় আমরা সবাই একে একে বসে পড়লাম। আহনাফের ড্রাইভিং সিটের পাশে আমি বসলাম। ব্যাক সিটে নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু বসেছেন। দুজনের মধ্যেই অনেকটা দূরত্ব। সেই দূরত্বটায় আরো একজন বেশ আরাম করেই বসতে পারবেন। দুজনই দুজনের বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত। লুকিং গ্লাসে ব্যাক সিটের সম্পূর্ণটাই আমার দুচোখে স্পষ্টত। তনিমা আপুর দু চোখে বিষাদের ছড়াছড়ি। নেহাল ভাই বিদ্বেষি ভাব নিয়ে এক ধ্যানে জানালার স্বচ্ছ কাঁচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে গভীর মনযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছেন। দুজনের দ্বিমুখী আচরন ভীষণ ভাবাচ্ছে আমায়। তাদের আচরণে কিছু সময় মনে হচ্ছে তারা দুজনই খুব ভালো বন্ধু। পরক্ষনে আবার মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যেই কিছু একটা চলছে! আই মিন পেয়ার, মোহাব্বত, ভালোবাসা! কি জানি। আমার ধারনা হয়তো ভুল ও হতে পারে। তবে দুজনের মাঝেই যে বিরাট একটা রহস্য লুকিয়ে আছে তা আমি ভালোই আঁচ করতে পারছি। আমার পাশে বসা লোকটার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই লোকটার তো আপাদমস্তকই অগতিন রহস্যে ভরা। লোকটা দিন দিন এতোটাই রহস্যময় হয়ে উঠছে যে, আমি এই রহস্যের সন্ধান করতে করতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, ক্ষান্ত হয়ে উঠছি! তবু ও মিলছে না রহস্যের কোনো আগা গোড়া!

ইতোমধ্যেই আহনাফ সিট বেল্ট লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু যুগল খানিক উঁচিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“কি হলো? সিটবেল্ট এখনো লাগাও নি কেনো?”

আহনাফের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে সিটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সিট বেল্ট বাঁধার ঠিক শেষ মুহুর্তে আহনাফ ফুল স্পিডে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। এসির হাওয়াটা কেমন যেনো বিরক্তিকর ঠেঁকছে। হঠাৎ বমি বমি পাচ্ছে। ভ্যাপসা গরমের আবির্ভাব হচ্ছে। জানালার কাঁচ উঠিয়ে প্রকৃতির বিশুদ্ধতম বাতাস উপভোগ করতে মনটা ভীষন উদগ্রীব হয়ে আছে। রাতের হিমেল হাওয়ায় গাঁ ভাসাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে, এলোমেলো খোলা চুলে স্নিগ্ধ বাতাসকে আহ্বান করার ইচ্ছে জাগছে, প্রশান্তিতে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটাতে বড্ড ইচ্ছে করছে। জানালার কাঁচ ভেদ করে ব্যস্তময়, কোলাহল পূর্ণ রাস্তা থেকে তিক্ত দৃষ্টি সরিয়ে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে আবদার সূচক কন্ঠে বললাম,,

“জানালার কাঁচটা খুলে দেই? এসির বাতাসটা দম বন্ধ লাগছে।”

আহনাফ মৌন দৃষ্টিতে এক পলক আমার দিকে তাকালেন। চশমার ফ্রেমটা উপরের দিকে টেনে আহনাফ পুনরায় ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিয়ে ম্লান কন্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“ওকে৷ তবে একটা কন্ডিশান আছে!”

“কি?”

“জানালা দিয়ে হাত বা ফেইস বের করা যাবে না। এক্সিডেন্টের রিস্ক থাকতে পারে।”

“আমাকে কোন দিক থেকে আপনার নির্বোধ, বোকা বা বাচ্চা টাইপ মনে হয়? ভালো, খারাপ আমি বুঝতে পারি। অন্তত আমাকে আপনার জ্ঞান দিতে আসতে হবে না!”

আহনাফ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার সমস্ত অবয়বে চোখ বুলিয়ে বললেন,,

“আগে তো উড়নাটা ঠিক করতে শিখো। এরপর না হয় নিজেকে খুব জ্ঞানী ভেবো!”

আহনাফের থেকে চোখ হটিয়ে আমি বুকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম উড়নাটা গলার সাথে একদম চিপকে লেগে আছে। বুকের দিকটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। তাড়াহুড়ো করে আমি উড়নাটা ভালো করে বুকে জড়িয়ে আহনাফের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“এই? আপনার নজর এতো খারাপ কেনো? আমি এই নিয়ে প্রায় অনেকবার খেয়াল করেছি, আপনি প্রতিবার আমার শরীরের কোনো না কোনো অংশের দিকে ঠিক নজর দিয়েছেন। একবার বলেছিলেন, শাড়ি ঠিক করতে৷ আরেকবার উড়না। অসব দিকে আপনি তাকান কেনো হুম? দৃষ্টি নুইয়ে রাখতে পারেন না?”

আহনাফ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,,

“এজন্যই লোকজনদের ভালো করতে নেই বুঝেছ? ভালো করেছ তো, ফ্রিতে গাল মন্দ খেতেই হবে। আরে বাবা। আমি যদি অসব দিকে নজরই না দেই, তবে তো বাকিরা অসব দিকে নজর দিবে। আমি জেঁচে কেনো চাইব? আমার ব্যক্তিগত সম্পদে কেউ নজর দিক? এতোটা মহান এই আহনাফ শেখ নয় অভেয়সলি!”

আমি হেয় হেসে বললাম,,

“আমি মোটে ও আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ নই। যদি ব্যক্তিগত সম্পদই হতাম না? তবে দীর্ঘ দেড়টা বছর সেই সম্পদকে ছেড়ে আপনি এতোটা দূরে থাকতে পারতেন না। অন্তত একবার হলে ও আমার খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন।”

আহনাফ ভাবশূণ্য কন্ঠে বললেন,,

“আপাতত আমরা ঐ প্রসঙ্গে না যাই? এখন বলো কোন পার্লারে যাবে? এখানে তোমার কোনো চেনা জানা বা পরিচিত পার্লার আছে?”

আমি মনমরা কন্ঠে বললাম,,

“দুর্গাপুর মেইন রুটের সামনেই একটা পার্লার আছে। একবার এসেছিলাম ওটাতে। আই থিংক ঐ পার্লারটাই বেস্ট হবে!”

আহনাফ লুকিং গ্লাসে নজর দিয়ে ব্যাক সিটের দিকে তাকালেন। ডান দিকে ছিটকে থাকা তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে আহনাফ উচ্চ আওয়াজে বললেন,,

“হেই তনিমা? তুই যাবি পার্লারে? কাজ আছে?”

তনিমা আপু ব্যাক সিট থেকে মাথা তুলে জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়িয়ে বললেন,,

“না। আমার কোনো কাজ নেই!”

“আবারো আপসেট হয়ে আছিস? সিরিয়াসলি, আমার খুব খারাপ লাগে তোকে এই বিমূর্ষ অবস্থায় দেখলে। মনে হয় যেনো তোর এই মন খারাপের জন্য আমি ও দায়ী। প্লিজ আমাকে নিজের বিবেকের কাছে এতোটা ছোট করে দিস না!”

তনিমা আপু কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,

“জানিস? তুই এসব বলে আমাকে কতোটা ছোট করছিস? দোষ শতভাগ আমার ছিলো আহনাফ। আমিই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক, ভুল জাজ করতে পারি নি তখন। হুটহাট করে ভুল মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এখন রিপেন্ড করছি আমি। বিবেকের কাছে প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ হচ্ছি। কাইন্ডলি তুই এসব বলে, নিজের বিবেকের কাছে আমাকে আর ছোট করিস না। নিতে পারছি না আমি এতো পেইন!”

আহনাফ প্রতিত্তুর করার পূর্বেই নেহাল ভাই পাশ থেকে ক্ষীণ কন্ঠে তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“তোকে এতো পেইন নিতে কে বলেছে তনিমা? আমরা কেউ তোকে বলেছিলাম এসব উটকো পেইন নিতে? ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা কর। আগামীতে ভালো কিছুই হবে!”

নেহাল ভাইকে উদ্দেশ্য করে আহনাফ উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“বুঝলাম না। তুই পাশে থাকতে তনিমা এতো আপসেট হয়ে আছে কেনো? আর তোদের মাঝে এতো ডিস্টেন্স কেনো? তুই কি ভাবছিস এতোটা ডিস্টেন্স ক্রিয়েট করে তনিমাকে তুই সামলাতে পারবি?”

আহনাফের কথা শেষ হতে না হতেই নেহাল ভাই চোখের পলকে তনিমা আপুর সাথে একদম চিপকে বসলেন। তনিমা আপু অস্থির দুই টলমল চোখে নেহাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নেহাল ভাই ম্লান হেসে বললেন,,

“ডোন্ট ক্রাই। আমি এবং আহনাফ তোর পাশে আছি। অপরাধী নিশ্চয়ই তার যোগ্য শাস্তি পাবে। আমাদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তকে মন থেকে ফিল কর। তোর মন ভালো করার জন্যই কিন্তু আমরা তোকে নিয়ে বিডিতে ব্যাক করেরেছি। হৃদির বিয়েতে এসেছি। সো চিল ইয়ার।”

তনিমা আপু হেচকি তুলে কেঁদে আচমকা নেহাল ভাইয়ের কাঁধে মাথা ঠেঁকিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,,

“তোরা আছিস বলেই আমি বেঁচে আছি। নয়তো এই অপরাধবোধ নিয়ে বোধ হয় না খুব একটা বেশি দিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। এভাবে নির্জীবভাবে বাঁচার চেয়ে তো মৃত্যু শ্রেয় হতো।”

দম নিয়ে তনিমা আপু এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে নরম কন্ঠে বললেন,,

“স্যরি প্রভা। সব জেনে বুঝেই আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম। তোমার চরিএে আঙ্গুল তুলতে সবাইকে বাধ্য করেছিলাম। আহনাফের মনে তোমার জন্য খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। আমার জন্যই তোমাদের মধ্যে দীর্ঘ দেড় বছরের বিচ্ছেদ ঘটল। আমি সত্যিই খুব অনুতপ্ত এবং লজ্জিত প্রভা। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও প্লিজ।”

সরাসরি আমি আহনাফের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“কি চলছে এসব? একটু ক্লিয়ারলি বলবেন? তনিমা আপু হঠাৎ করে আমার কাছে ক্ষমা চাইছেন কেনো? কাইন্ডলি সবটা আমাকে খুলে বলবেন?”

আহনাফ ড্রাইভিং সিটে এক হাত রেখে অন্য হাতে খপ করে আমার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে উনার বুকের পাজরে মিশিয়ে স্বস্তির একটা শ্বাস ছেড়ে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই দেড় বছরে, যখন তুমি হোস্টেলে ছিলে বড় ভাইয়া কি একবার ও তোমার সাথে দেখা করতে হোস্টেলে গিয়েছিলেন?”

“হুম গিয়েছিলেন। একবার না, প্রায় অনেকবার গিয়েছিলেন। কেনো কি হয়েছে?”

হুট করে আহনাফ রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে আতঙ্কগ্রস্থ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“ভাইয়া তোমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেন নি তো?”

কপালের ভাঁজে বিরক্তি ভর করল আমার। রাগী দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“হোয়াট? জিজু আমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করবেন কেনো? কি যা তা বকছেন আপনি?”

ইতোমধ্যেই রাস্তায় জ্যাম লেগে গেলো। ছোট, বড় সব গাড়ি উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বাজাতে লাগাল। আশেপাশের সব গাড়ির মালিকরা চোখ লাল করে আহনাফকে হুমকি দিচ্ছেন। নেহাল ভাই ব্যাক সিট থেকে উত্তেজিত কন্ঠে আহনাফকে বললেন,,

“গাড়িটা স্টার্ট কর আহনাফ। লোকজন ক্ষেপে যাচ্ছেন!”

আমার থেকে হতভম্ব দৃষ্টি সরিয়ে আহনাফ পরিস্থিতি সামালাতে তাড়াহুড়ো করে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলেন। মিনিট একের মধ্যে আহনাফ আচমকা আমাকে হেচকা টান দিয়ে উনার বুকের পাজরে একাত্নভাবে মিশিয়ে উদ্বিগ্নভরা কন্ঠে বললেন,,

“ভাইয়ার থেকে যথেষ্ট দূরে থাকার চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে ভাইয়া যে পথে হাঁটবে সে পথে হাঁটা তুমি বন্ধ করে দিবে। কথাটা এমনি এমনি বলি নি আমি। কাইন্ডলি সিরিয়াসলি নেওয়ার চেষ্টা করো।”

আহনাফের বুকের সাথে মিহিভাবে মিশে আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“কেনো? একটু ক্লিয়ারলি বলবেন? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কাইন্ডলি একটু বলুন। আপনাদের মধ্যে কি চলছে!”

“আচ্ছা তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছ না? ভাইয়ার ইন্টেনশান? ভাইয়ার কু- দৃষ্টি, যেনো তেনো বাহানায় তোমাকে ছুঁতে চাওয়া, ভাবীর বিপক্ষে গিয়ে তোমাকে হোস্টেলে দেখতে যাওয়া। কিছুই বুঝতে পারছ না তুমি?”

“কি বুঝব আহনাফ? আমি তো উনাকে শুধু জিজু নয়, আমার বড় ভাইয়ের চোখে ও দেখি। উনার ছোঁয়ায় কোনো পাপ খুঁজে পাই নি আমি।”

“বিয়ের এতো গুলো বছরে ও ভাবী কেনো মা হতে পারলেন না, তোমার ফ্যামিলির এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ তৈরী হয় নি? কারো মনে কোনো দ্বিধা দ্বন্ধ তৈরী হয় নি?”

“আপু তো প্রায় অনেক বারই মা হয়েছিলেন। তবে ভুল বশত মিসকারেজ হয়ে গেলে এইখানে আপু বা জিজুর কি দোষ? আমরা কাকে দোষারোপ করব বলুন?”

“সত্যিটা এখনো বুঝতে পারো নি তোমরা। কিছুদিন পর ঠিকই বুঝবে। তবে এই কয়েকটা দিন তোমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। ভাইয়ার থেকে এনাফ ডিস্টেন্স মেন্টেইন করে চলতে হবে। আই হোপ তুমি বুঝতে পেরেছ?”

ইতোমধ্যেই আহনাফ গাড়িটা দুর্গাপুর মেইন রুটের পাশ ঘেঁষে দাঁড় করালেন। আমি নিজীর্ব অবস্থায় শরীরের সমস্ত ভার আহনাফের বুকের পাজরে নিবদ্ধ করেছি। হিসবে মিলাতে পারছি না আমি মোটে ও। আহনাফ কি বললেন এসব? জিজুকে হঠাৎ সন্দেহ করছেন কেনো? জিজুর ব্যবহার আচরনে তো কখনো আমি খারাপ কিছুর আভাস পাই নি! উল্টে ফ্রি ভাবে চলেছি জিজুর সাথে। জিজু ও আমার সাথে খুব ফ্রি ভাবে মিশেছিলেন। সবকিছু ঠিক থাকতেও আহনাফ হঠাৎ কেনো নিজের বড় ভাইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলছেন?

গাড়ির দরজা খোলার উচ্চ আওয়াজে আমার ধ্যান ভাঙ্গল। নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু গাড়ি থেকে নেমেছেন মাএ। নেহাল ভাই শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে হেয়ালী কন্ঠে তনিমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“কাঁধটা ভেঙ্গে গেলো আমার। তোর ১০০ মন ওজনের বিশাল মাথার ভারটা আমার এই নাজুক কাঁধ নিতে পারে বল?”

তনিমা আপু ভীষণ রেগে নেহাল ভাইয়ার পিঠে অনবরত কিল, ঘুষি বসিয়ে বললেন,,

“ইউ ইডিয়ট৷ আমার মাথার ভার ১০০ মন না? উল্টে তোর হাতের ভার ১০০ মন বুঝেছিস? আমার এই নরম হাত যে তোর ঐ ১০০ মন হাতের ভার নিয়েছে এই অনেক!”

আনমনেই হেসে আমি মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাকালাম। আহনাফ নেশা ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। লোকটার এই নেশাক্ত চাহনীতে আমি ভালোবাসার অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম ঠিকি তবে নির্বোধ মনকে প্রশ্রয় দিতে চাইছিলাম না একরত্তি। হুড়মুড়িয়ে আহনাফের উত্তাল বুক থেকে মাথা তুলতেই আহনাফ রাগান্বিত ভঙ্গিতে পুনরায় আমায় বুকের মাঝে চেঁপে ধরে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“এই? তুমি কি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারো না? এতো ছটফট করো কেনো?”

“আপনার কি লাজ লজ্জা নেই? দেখছেন, নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু বাইরে আছেন, আমাদের জন্য ওয়েট করছেন। আর আপনি এখানে বসে লুতুফুতু করছেন?”

আহনাফ অট্ট হেসে বললেন,,

“ইট’স নট লুতুফুতু। ইট’স কল্ড রিয়েল লাভ। ওকে?”

“হাহ্। ভালোবাসেন আমাকে?”

“কেনো? কোনো সন্দেহ আছে?”

“ষোল আনাই সন্দেহ। বিশ্বাস নেই আপনার সাথে। আগের বারের মতো হয়তো আবারো আমায় প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সারাজীবনের জন্য কোথাও একটা হারিয়ে যাবেন। আপনার পাশাপাশি, কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত আমি আবারো আপনার প্রেমে পড়ে যাবো! বার বার এভাবে আঘাত পেয়ে সেই আঘাত হজম করার ক্ষমতাটা আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। তাই আপনার থেকে দূরে থাকাটাই আপাতত ব্যাটার মনে করছি।’

জানালার কাঁচে কয়েক দফা টোকা পড়তেই আমি ডান পাশের জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। নেহাল ভাই বাঁকা হেসে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলছেন,,

“গাড়িতেই সংসার বাঁধার ডিসিশান নিয়েছিস নাকি? ফুল, ক্যান্ডেল, পানি, লাগবে? আদার’স কিছু লাগলে ও বলতে পারিস। এনে দিবো!”

আহনাফ ক্ষীপ্ত দৃষ্টিকে নেহাল ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নেহাল ভাই শুকনো কন্ঠে বললেন,,

“আরে ভাই। ঠান্ডা মাথায় বললেই তো হয় ডিস্টার্ব হচ্ছে। এভাবে রাগ দেখানোর কি আছে?”

নেহাল ভাই চেঁপে গেলেন। আহনাফ হুট করে আমার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কোনো কারণ ছাড়াই আমার ঘাঁড়ের দিকে জোরে এক বাইট বসিয়ে বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললেন,,

“নেক্সট টাইম অহেতুক আমাকে সন্দেহ করতে ১০০ বার ভাববে। ফার্স্টে এই বাইটের দাগটা চোখে পড়বে৷ তখন আমাকে সন্দেহ করার চিন্তাটা ও মাথায় আসবে না।”

রাগে কটমট করে আহনাফ আমাকে ছেড়ে তড়িৎ বেগে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। আমি বাইটের দিকটায় হাত রেখে নাক, মুখ কুঁচকে তীব্র ব্যাথায় কুঁকিয়ে আহনাফের যাওয়ার পথে তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বললাম,,

“আস্ত রাক্ষস এই লোক। আচ্ছা? লোকটা আবার ভ্যাম্পায়ার নয় তো? ভ্যাম্পায়ারের সাথে প্রেম করছি আমি? যদি এই ভ্যাম্পায়রকেই বিয়ে করতে হয়?”

জানালায় অর্ধ মুখ ঢুকিয়ে আহনাফ রাগে গজগজ করে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“এক্সকিউজ মি ম্যাম। হাত ধরে নামাতে হবে আপনাকে? আর কি কি সার্ভিস দিতে হবে আপনাকে কাইন্ডলি একটু বলবেন?”

দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি তেজর্শিনী কন্ঠে আহনাফের চার চোখের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“শুধু হাত ধরে নামালে চলবে না ওকে? কোলে তুলে নামাতে হবে! সার্ভিস ইজ সার্ভিস।”

দম নেওয়ার সুযোগটা ও পেলাম না। সাইক্লোনের বেগে আহনাফ গাড়ির দরজাটা খুলে ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে আমাকে হেচকা টানে সিটের একদম শেষ প্রান্তে নিয়ে এলেন। কম্পিত দৃষ্টিতে আমি বুকে ধুকপুক নিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে আছি। মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফ আমাকে কোলে তুলে সোজা পার্লারের দিকে মোড় নিলেন। আমি স্তম্ভিত ভঙ্গিতে আহনাফের কাঁধে দুহাত ঝুলিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আহনাফকে অবলোকন করছি৷ নেহাল ভাই এবং তনিমা আপু মুখে হাত দিয়ে আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে আমাদের পিছু পিছু হাঁটছেন৷ নেহাল ভাই তো পেছন থেকে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে ইয়ার্কির স্বরে বলে উঠলেন,,

“ওহ্ মাই গড৷ হিন্দি মুভির শুটিং দেখছি আই থিংক। জিয়ো আহনাফ, জিয়ো। দম আছে তোর বলতে হবে!”

আহনাফ পিছু ফিরে অট্ট হেসে নেহাল ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“চাইলে তুই ও তনিমাকে কোলে নিতে পারিস। আমরা মাইন্ড করব না!”

নেহাল ভাই হঠাৎ হাসি থামিয়ে তনিমা আপুর দিকে ম্লান দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,,

“উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড৷ কোনো প্রশ্নই আসে না!”

তনিমা আপু জোরপূর্বক হাসি টেনে সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা নিচু করে নিলেন। আহনাফ কথা না বাড়িয়ে পুরো দমে সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। আমি দাঁতে দাঁত চেঁপে আহনাফের কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,

“এই? আমি কি আপনাকে সত্যি সত্যি কোলে তুলতে বলেছি? রাস্তাঘাটের লোকজন দেখছেন। আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন। এভাবে মেলো ড্রামা ক্রিয়েট না করে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিন বলছি!”

“উহু। কোনো কথা হবে না। চুপ করে আমার সাথে মিশে থাকো। মন থেকে আমায় ফিল করো!”

“আজব তো! আপনি কি আমাকে কোলে নিয়েই পার্লারে ইন করবেন?”

“ইয়েস। আই হেভ নো ডাউট!”

ইতোমধ্যেই আহনাফ পার্লারের বদ্ধ দরজাটা ওপেন করে পার্লারে প্রবেশ করলেন। সাথে সাথেই পার্লারের ১০ থেকে ১২ জন মেয়ে আমাদের দিকে হা করে তাকালেন!

#চলবে…?