তোমাতেই রহিব বিলীন পর্ব-১৫

0
888

#তোমাতেই_রহিব_বিলীন
#পর্ব_১৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আআপনি? আআপনি আমার রুমে কি করছেন?”

ঘটনার আকস্মিকতায় জিজু হঠাৎ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ড্রিম লাইটের মিহি আলোতে স্পষ্ট আমি জিজুর ঘর্মাক্ত অবয়ব দেখতে পারছি। অস্থিরতা নিয়ে জিজু দৌঁড়ে রুম থেকে ছুটে পালাতেই মনে হলো রুমের দরজাটায় ভেতর থেকে কেউ খিল আটকে দিলো। হুড়মুড়িয়ে আমি শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতেই রুমের লাইটটা হঠাৎ অন হয়ে গেলো। দরজার দিকটায় উদগ্রীব দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলাম আহনাফ বাঁকা হেসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আহনাফের ঠিক দু ফুট দূরত্বে জিজু অপরাধী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হম্বিতম্বি হয়ে আমি ছুটে এলাম দুজনের মাঝখানে। কৌতুহলী দৃৃষ্টিতে কিছুক্ষন আমি আহনাফের দিকে তাকাচ্ছি তো কিছুক্ষন জিজুর দিকে। আকস্মিকভাবে দুজনই শক্ত মুখ ভঙ্গি নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমি কম্পিত কন্ঠে জিজুকে উদ্দেশ্যে করে বললাম,,

“আআপনি আআমার রুমে কিকিকি করছিলেন জিজু?”

আমার কথায় কোনো রূপ তোয়াক্কা না করে জিজু খড়তড় দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে চেয়ে আছেন। আহনাফ অট্ট হেসে দরজার হেলান ছেড়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর হাত দুটো ঝেঁড়ে আহনাফ জিজুর সম্মুখস্ত হয়ে জিজুকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তো ভাইয়া বলো। প্রভার রুমে তুমি এতো রাতে কি করছিলে?”

জিজু রাগে গজগজ করে ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে আহনাফের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়া আহনাফ। রুম থেকে বের হতে দে আমায়!”

আহনাফ এক রোঁখা ভাব নিয়ে বললেন,,

“স্যরি টু সে ভাইয়া! প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া অবধি তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না ভাইয়া। সো সামনে থেকে সর, সামনে থেকে সর। এসব বলে আমার মাথা গরম করো না।”

জিজু রক্তিম দুচোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে ঝড়ের গতিতে আহনাফকে জোরে এক ধাক্কা মেরে দরজার খিল খুলে দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। আহনাফ হম্বিতম্বি হয়ে জিজুকে ধাওয়া করার পূর্বেই আমি পেছন থেকে উত্তেজিত কন্ঠে আহনাফকে ডেকে বললাম,,

“আহনাফ প্লিজ স্টপ। বাড়ি ভর্তি মেহমান আপনাদের। ফর দ্যা গড সেইক, দু ভাই মিলে কোনো সিনক্রিয়েট তৈরী করবেন না প্লিজ। তাছাড়া এটা আপনাদের খালামনির বাড়ি। নিজেদের বাড়ি নয়। বুঝতে পারছেন তো? আমি কি মিন করতে চাইছি?”

আহনাফ থেমে গেলেন। তাৎক্ষণিক পিছু ফিরে আহনাফ উদয়স্ত রাগ, জেদ সমেত আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। রাগকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে আহনাফ কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“ঘুমানোর পূর্বে যে দরজা লক করে ঘুমাতে হয় জানো না তুমি? দরজাটা ওপেন করে ঘুমুলে কেনো তুমি? মিনিমাম কমনসেন্স টুকু নেই তোমার?”

“আশ্চর্য! আমি কি জানতাম নাকি? কেউ এই মাঝরাতে দরজা খুলে আমার রুমে ইন করবে? তাছাড়া দরজা লক করে ঘুমানোর অভ্যেস নেই আমার। কেমন যেনো ভয় কাজ করে!”

“তুমি আশ্চর্য ওকে? এই প্রথম আমি শুনলাম, কেউ ভয় কাটানোর জন্য দরজা ওপেন করে ঘুমায়! ভয় পেলেই তো মানুষ দরজা লক করে ঘুমায় নাকি? তোমার ক্ষেএেই যতোসব উল্টো নিয়ম!”

“আপনি কি এই রাত বিরাতে আমার সাথে ঝগড়া করতে এসেছেন? আমার খুঁত ধরতে এসেছেন? কে দরজা লক করে ঘুমালো না ঘুমালো এসব খুঁজতে এসেছেন?”

আহনাফ ভীষন ক্ষেপে আমার গাঁয়ের সাথে একদম এডজাস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে তটস্থ কন্ঠে আমায় বললেন,,

“কিপ ইউর মাউথ শাট ওকে? আমি তোমার খুঁত ধরতে আসি নি৷ তোমায় জাস্ট সেইফ করতে এসেছিলাম। আমি আগে থেকেই জানতাম এমন কিছু একটা ঘটবে। তাই আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছিলাম।”

জিগ্যাসু কন্ঠে আমি আহনাফকে বললাম,,

“সিরিয়াসলি? আপনি জানতেন জিজু আমার রুমে প্রবেশ করবেন?”

“তোমার কি মনে হয়? আমি না জেনেই রাত জেগে তোমার রুমের আশেপাশে ঘুড়ঘুড় করছিলাম?”

“তাহলে নিশ্চয়ই এটা ও জানেন, জিজু কেনো এই রাত বিরাতে আমার রুমে প্রবেশ করেছিলেন? কোনো বেড ইন্টেনশান ছিলো উনার?”

“আলবাত ছিলো। তোমার উপর ভাইয়ার ফার্স্ট থেকেই বেড ইন্টেনশান ছিলো। যা তুমি কখনোই বুঝতে পারো নি। আসলে বুঝার চেষ্টাই করো নি। আজ শুধু ভাইয়া বেঁচে গেলেন, বাড়িটা আমাদের নয় বলে। নয়তো ভাইয়ার মুখোশ আজ সবার সামনে টেনে খুলতাম আমি৷ ড্যাম ইট, সুযোগটা ফসকে গেলো হাত থেকে!”

একদম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। কি বলছেন আহনাফ এসব? সত্যিই জিজুর প্রথম থেকে আমার উপর বেড ইন্টেনশান ছিলো? কোনো ভাবে জিজু আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছিলেন? তবে আপু? আমার আপুর কি হবে? জিজু যে আপুর হাজবেন্ড। জিজুর এই খারাপ দিকটার কথা আপু জানতে পারলে ধৈর্য্য নিয়ে সবটা সহ্য করতে পারবেন তো? আমার আপুর কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? আপুর ভালোবাসার সংসারটা ভেঙ্গে যাবে না তো?

নির্জীব অবস্থায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহনাফ আমার দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,

“কি ভাবছ? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো?”

স্তম্ভিত দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“জিজু সত্যিই এতোটা খারাপ?”

“আমার কোনো সাধ নেই জেঁচে নিজের ভাইকে খারাপ বলার৷ কষ্ট হচ্ছে আমার কথা গুলো বলতে৷ তবে না বলে ও থাকতে পারছি না। সম্পর্ক যতোই গভীর হোক না কেনো, সত্যটা থেকে আমি সরতে পারি না!”

উৎসুক দৃষ্টিতে আমি আহনাফের দিকে চেয়ে বললাম,,

“অর্ধ কথা না বলে সম্পূর্ণ বিষয়টা শেয়ার করুন। একদম প্রথম থেকে। আমি ফার্স্ট টু লাস্ট সব শুনতে চাই।”

“পারবে তো সহ্য করতে?”

আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম,,

“পারব। আপনি বলুন।”

“ওকে। তবে বড় সড় একটা আঘাত পাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নাও!”

আমার সম্মুখ থেকে সরে আহনাফ দ্রুত বেগে প্রথমে রুমের দরজাটা লক করে দিলেন। অতঃপর খপ করে আমার হাতটা ধরে আমাকে নিয়ে সোজা ব্যালকনীতে চলে এলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মধ্যরাত ২ঃ৩০ মিনিট বাজছে। সমগ্র ধরা রাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বড্ড শুনশান হয়ে আছে। চারিদিক থেকে কেবল ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে। আকাশে অর্ধ চাঁদ বিরাজ করছে। অতি অল্প জোসনার বিকিরন ঘটছে ধরাতে। চাঁদকে ঘিরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য তাঁরারা তাদের আধিপাত্য বিস্তার করে আছে। নিকষ কালো আকাশের সঙ্গী চাঁদ এবং তাঁরাদের উপস্থিতিতে ও আকাশটা কেমন গুমোট লাগছে। কিছুক্ষন পর পর বৈরী বাতাস শরীরে কাঁটা তুলে দিচ্ছে। উড়নার আঁচলটা সেই বাতাসের প্রকোপে দ্বিধাহীন ভাবে উড়ে আহনাফের চোখে, মুখে ঠিকড়ে পড়ছে। আহনাফ এখনো আমার হাতটা ছোঁয়ে আছেন। নেশাভরা দৃষ্টিতে আমার পানে এক ধ্যানে চেয়ে আছেন। উড়নাটা যতো বারই উনার চোখ মুখ স্পর্শ করছে, ততো বারই উনি উড়নাটা আলতো হাতে মুখ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তবে শেষ বার উড়নাটা যখন উনার ঠোঁট ছুঁলো সঙ্গে সঙ্গেই উনি উড়নাটা খপ করে ধরে উড়না সমেত আমাকে হেচকা টান দিয়ে উনার বুকের পাজরে মিশিয়ে নিলো। মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে আহনাফ আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,,

“আমি চাই নি কোনো ভুল করতে। তবে তুমিই বাধ্য করলে আমার মনকে ডিস্টার্বড হতে। এবার এই বেহায়া মনকে আমি মানাই কি করে?”

চেয়ে ও কেনো জানি না আটকাতে পারছিলাম না আহনাফকে। পরম আবেশে চোখ জোড়া বুজে আমি আহনাফের ঠোঁটের স্পর্শ মাখছিলাম সমস্ত ঘাড় জুড়ে। হিম শীতল শরীরটা উষ্ণ হয়ে উঠছিলো আহনাফের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে। শ্বাস পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছিলো। উত্তেজনায় হাত, পা কাঁপছিলো। হার্টবিট টিউ টিউ শব্দে ভেতর থেকে বোধ হয় বেরিয়ে আসছিলো। এর মাঝেই আহনাফের ঠোঁটের বিচরন আচমকা থেমে গেলো। তাৎক্ষনিক আহনাফ আমায় ছেড়ে মোটামুটি ২ ফুট দূরত্বে সরে দাঁড়ালো। আমি আধো চোখে আহনাফের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আহনাফ তার ঘোর কেটে মাএ বেরিয়েছেন। চোখে, মুখে অনুশোচনার ছাপ ফুটে আছে। সামনের চুল গুলো টেনে আহনাফ চশমার ফ্রেমটা উপরে তুলে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললেন,,

“স্যস্যরি।”

লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে ছোট আওয়াজে বললাম,,

“ইট’স ওকে!”

আহনাফ আচমকা আমার কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে বললেন,,

“বিয়ের পরেই আমাদের মিলন হোক। জাস্ট কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরতে হবে আমার। আই হোপ সো, আমি পারব!”

আমি ম্লান হেসে মাথা নাঁড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে মলিন কন্ঠে আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“জানো? তোমার ঐ ফেইক আইডিটা হ্যাকড হয়েছিলো?”

আমি উৎসুক কন্ঠে বললাম,,

“জানি। কিন্তু কে করেছিলো আহনাফ?”

“আরিফ ভাইয়া!”

“হোয়াট? জিজু হ্যাক করেছিলেন আইডিটা?”

“ইয়েস। কজ আরিফ ভাইয়া জানতেন তুমি গোপনে এই আইডিটা ইউজ করো। আর মাঝে মধ্যেই এই আইডি থেকে ছেলেদের সাথে মজা করো!”

“কিন্তু কিভাবে? জিজুর তো জানার কথা নয়!”

“কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন হয়তো!”

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,,

“তারপর?”

“ভাইয়া জানতেন, আমি প্রথম থেকেই তোমাকে ভালোবাসতাম। আই মিন প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।”

হতবিহ্বল কন্ঠে আমি চোখ জোড়া আকস্মিকতা নিয়ে বললাম,,

“সিরিয়াসলি আহনাফ? আপনি প্রথম থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন?”

“শুধু পছন্দই না! ভালোবাসতাম। ভাইয়ার বিয়ের কিছুদিন পরেই তো কিছু দরকারী কাজে আমায় অপারগ হয়ে কানাডায় ব্যাক করতে হয়। দীর্ঘ ৬ টা মাস কানাডায় আমি পাগলের মতো তোমার স্মৃতিচারন করেছিলাম। প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষন, প্রতিটা মুহূর্ত তোমায় ভেবে অবলীলায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম। অনেক বার ট্রাই করেছিলাম তোমার সাথে কন্ট্রাক্ট করতে। তবে ভয়, ভীতি, সংকোচবোধ থেকে তোমার সাথে কন্ট্রাক্ট করার সাহসটা জোগাতে পারি নি!”

“এরপর?”

“এরপর! তোমার ফেইক আইডির সন্ধান পাই আমি৷ আশ্চর্যের বিষয় কি জানো?”

“কি?”

“ফেইক আইডি থেকে তুমিই এট ফার্স্ট আমাকে নক করেছিলে। আই মিন তোমার ছদ্মবেশে থাকা আরিফ ভাইয়া আমাকে নক করেছিলেন। অথচ আমি এতোটাই বোকা যে, কখনো ধরতেই পারি নি ওটা তুমি ছিলে না। তোমার আড়ালে থাকা দু, দুটো কাছের মানুষ, আপন মানুষ আমার ইমোশন নিয়ে ঠাট্টা, বিদ্রুপ করছিলো!”

#চলবে…?