#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৩৮
আজ আবরার, আরশির ওয়েডিং রিসেপশন। সেই উপলক্ষে সাজানো হচ্ছে আরশি কে। বেশ সময় নিয়ে আরশি কে সুন্দর করে তৈরি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো পার্লারের মহিলারা।
আজ সম্পূর্ণ শুভ্র রঙে নিজেকে মু*ড়ি*য়ে নিয়েছে আরশি। সাদা গর্জিয়াস শাড়ির সাথে সাদা হীরার অলংকার। দীঘল, কালো কেশ একপাশে সুন্দর করে বিনুনি করে রাখা। আরশি মিসেস বন্যা কে বলতে শুনেছে এই সবকিছু আবরার নিজে আরশির জন্য পছন্দ করে কিনেছে। শুভ্র রঙে কি তাকে খুব বেশি সুন্দর লাগে! প্রশ্ন জাগে আরশির মনে। প্রশ্ন টা মাথায় আসতেই দর্পনে চোখ যায় আরশির। নিজেকে খুঁ*টি*য়ে খুঁ*টি*য়ে দেখতে থাকে সে।
——
ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে আরশি। পাশ থেকে বেশ কয়েকজন মেয়ে ঘিরে রেখেছে তাকে। এই মেয়েগুলোর সাথে কিছুক্ষন আগে মিসেস বন্যা তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এই মেয়েগুলো আবরারের ফ্রেন্ডদের ওয়াইফ। হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা কেউ বিয়ে তে উপস্থিত ছিলো না তবে আজ সবাই চলে এসেছে। মেয়েগুলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এটা ওটা বলে মজা করছে আরশির সঙ্গে। কিন্তু আরশির ধ্যান এসবে নেই। সে তো নিজের শাড়ি সামলে হাঁটতে ব্যস্ত। কখন জানি সবার সামনে উ*ষ্টা খেয়ে পড়ে! তাহলে আর মান ইজ্জত কিছুই থাকবে না। মনে মনে আবরার কে ব*কা দেয় আরশি। কি দরকার ছিলো লোকটার শাড়ি কেনার? লেহেঙ্গা কিনলেও তো পারতো। তাহলে তাকে এমন ভ*য়ে*র মাঝে থাকতে হতো না।
অন্যদিকে সোফায় বসে আরশির জন্য অপেক্ষা করছে আবরার। অপেক্ষার প্রহর গুনছে নিজের শুভ্র পরী কে শুভ্র শাড়িতে দেখার। সিঁড়ির দিকে চোখ যেতেই থমকে গেলো আবরার। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান হলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের শুভ্র মায়াবিনীর দিকে। কি পবিত্র, মায়াবী লাগছে মেয়েটা কে সাদা শাড়িতে। চোখের পলকটাও যেনো ফেলতে ভু*লে গেছে আবরার। বন্ধুদের হাসাহাসির শব্দে হু*শ ফিরলো তার। তবুও ওদের হাসাহাসি কে পা*ত্তা না দিয়ে ফের আরশির দিকে নিজের দৃষ্টি তা*ক করলো সে। দেখলো আরশি স্লথের গতিতে হাটছে। আরশির চোখ মুখের অবস্থা আর হাঁটার গতি দেখে আবরার বুঝে ফেললো আরশির হাঁটতে স*ম*স্যা হচ্ছে। কাল বিলম্ব না করে সে এগিয়ে গেলো আরশির দিকে। আরশির কাছাকাছি গিয়ে হুট করে কোলে তু*লে নিলো আরশি কে। আবরারের কাজে আশেপাশের সকলে হৈহৈ করে উঠলো।
হুট করে কেউ কোলে তু*লে নেয়ায় চমকে উঠলো আরশি। দেখলো আবরার সুন্দর তাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। আশেপাশের কারোর দিকে কোনো ধ্যান নেই তার। আরশি কে তাকাতে দেখে চমৎকার একটা হাসি উপহার দিলো আবরার। অপলক আবরারের দিকে তাকিয়ে রইলো আরশি। লোকটা কে আজ বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে। আরশি আবরারের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার বে*হা*য়া আঁখি জোড়া এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো না বলা প্রিয় পুরুষটা কে। এই অ*সভ্য, নি*র্ল*জ্জ পুরুষ টা তার, শুধুমাত্র তার। কথা টা ভাবতেই মন জুড়ে প্রশান্তি অনুভব করলো আরশি। আরশির মনে হলো সে কোনো স্বপ্ন দেখছে। যেই স্বপ্নে সে কোনো সাধারণ মেয়ে নয় বরং একজন প্রিন্সেস। আর আবরার তার প্রিন্স। আবরার সেই প্রিন্স যে নিজের প্রিন্সেস কে ভালো রাখতে সব করতে পারে, নিজের প্রিন্সেস এর সব স*ম*স্যা না বলতেই বুঝে যায়, যে নিজের প্রিন্সেস কে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে কিন্তু তা কখনো মুখে বলে না। নিজের প্রতিটা কাজের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করে।
আরশির ভাবনার মাঝে তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো আবরার। আজকের অনুষ্ঠান পার্টি সেন্টারে হবে। এখন তারা সেখানেই যাবে। আরশি কে বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো আবরার। আরশির শাড়ি ঠিকঠাক করে দিয়ে নিচু আওয়াজে বললো,
— শাড়ি পড়ে খুব স*ম*স্যা হচ্ছে তাই না? আমি জানি তুমি শাড়ি পড়ে কমফোর্টেবল ফিল করো না, ঠিকমতো হাঁটতে পারো না। কিন্তু কি করবো বলো? এই শাড়ি দেখার পর তোমাকে এই শাড়িতে দেখার লো*ভ সামলাতে পারি নি। চি*ন্তা করো আমি আছি তো, আমি ঠিক তোমাকে সামলে নেবো।
কথা শেষ করেই আরশির হাত মুঠোয় পুরে নিলো আবরার। আরশি কোনোরকম চেষ্টা করলো না হাত টা ছাড়ানোর। আজ কেনো যেনো কোনো প্রকার অ*স্ব*স্তি, লজ্জা তাকে ছুঁতে পারছে না। সে নীরবে তাকিয়ে রইলো আবরারের পানে।
——-
রিসেপশন পার্টি শেষে আরশিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছে আবরার আরশি। আজ রাত টা তারা আরশিদের বাড়িতেই থাকবে। এতোটা সময় এক টা*না বসে থেকে আরশির অবস্থা না*জে*হা*ল। তার উপর এতো এতো মানুষের ভি*ড়, তাদের চিৎ*কা*র চেঁ*চা*মে*চি, ফটো সেশন সব মিলিয়ে আরশির অবস্থা খা*রা*প। এসবের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয় সে। মাথা ভা*র হয়ে আছে তার। ইচ্ছা করছে একটুখানি ঘুমাতে। আরশির অবস্থা যেনো বুঝে গেলো আবরার। কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টে*নে নিয়ে আসলো আরশি কে। আলতো করে মাথা টা নিজের বুঁকের উপর রাখলো। ছাড়া পাওয়ার কোনো রকম চেষ্টা করলো না আরশি। আবরারের বুঁকে মাথা রেখেই ব্য*থা*তুর চোখে আবরারের দিকে চাইলো সে। আঁখি জোড়া লাল হয়ে আছে তার। আরশির এমন অবস্থা দেখে ভিতরে ভিতরে অ*স্থি*র হলেও বাইরে প্রকাশ করলো না আবরার। আদুরে কণ্ঠে বললো,
— তোমাদের বাসায় যেতে অনেক টা সময় লাগবে। ততক্ষন একটু ঘুমাও মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি। ভালো লাগবে তোমার।
আবরারের বুঁকে মুখ গু*জে আলতো হাসলো আরশি। আবরার প্রকাশ না করলেও আবরারের চোখে ঠিকই নিজের জন্য অ*স্থি*রতা দেখেছে সে। লোক টা তার জন্য অ*স্থি*র হচ্ছে দেখে ভীষণ আনন্দ অনুভব করলো আরশি। সে শান্তিতে আবরারের বুঁকে মুখ গু*জে তার সাথে লে*প্টে রইলো। টের পেলো আবরার তার মাথা থেকে দুপাট্টা খোলার চেষ্টা করছে। পিন খুলছে হয়তো। কিছুক্ষন পর দুপাট্টার পিন খুলতে সক্ষম হলো আবরার। মাথা থেকে দুপাট্টা নামিয়ে ধীরে ধীরে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সে। আরামে একরাশ ঘুম এসে হা*না দিলো আরশির চোখে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গভীর ঘুমে ত*লি*য়ে গেলো সে।
——-
— মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি শুনছো? ওঠো তোমাদের বাড়িতে চলে এসেছি। এই মেয়ে শুনছো?
আরশির কপোলে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে ডাকলো আবরার। আবরারের নরম কণ্ঠস্বর শ্রবণ হতেই ঘুম ভা*ঙ*লো আরশির। পিটপিট করে চোখ খুলে কোথায় আছে তা বোঝার চেষ্টা করলো আরশি। মনে পড়ে গেলো আবরারের বুঁকে মাথা রেখে ঘুমানোর সময় টা। গাড়ির সামনের সিটে চোখ যেতে দেখলো গা*র্ড, ড্রাইভার কেউ নেই। তৎক্ষণাৎ মাথা উঁচু করলো সে। আবরার তার দিকেই তাকিয়ে থাকার দরুন চোখে চোখ পড়ে গেলো। আরশি কে জাগতে দেখে আলতো হাসলো আবরার। আরশি কপালে ছড়িয়ে ছি*টি*য়ে থাকা এ*লো*মে*লো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
— কেমন লাগছে এখন?
আরশি মিনমিন করে জবাব দিলো,
— ভালো…
ঘুম হওয়ার কারণে এখন বেশ ভালোই লাগছে আরশির। মাথা ব্য*থা, ভা*র ভা*র ভাব অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন শুধু শাওয়ার নিয়ে এক কাপ চা খেলেই চা*ঙ্গা হয়ে যাবে সে। হুট করে আরশির মনে প্রশ্ন জাগলো সে কতক্ষন এভাবে আবরারের বুঁকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে! আবরারের কাছ থেকে কিছু টা দূরে সরে আসলো আরশি। জিজ্ঞাসা করে বসলো,
— আচ্ছা আমি কতক্ষন ঘুমিয়েছি?
আরশির প্রশ্নে ঠোঁট বা*কি*য়ে হাসলো আবরার। নিজের ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
— উমম দুই ঘন্টা বিশ মিনিট ঘুমিয়েছো তুমি।
চোখ বড় বড় করে তাকালো আরশি। মুহূর্তেই গাল জুড়ে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো। এতোটা সময় সে ওভাবে আবরার কে ঝা*প্টে ধরে ঘুমিয়েছে! আরশি কে লজ্জা পেতে দেখে বেশ মজা পেলো আবরার। টি*ট*কা*রি করে বললো,
— এভাবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছো কেনো? আমি জানি আমি অনেক হ্যান্ডসাম। তাই বলে এভাবে তাকাবে? এতক্ষন আমার বুঁকে মাথা রেখে আ*ষ্টে*পৃ*ষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমালে আর এখন এভাবে তাকিয়ে আছো। তুমি কিন্তু দিনদিন ভারী নি*র্ল*জ্জ হয়ে যাচ্ছ মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি। সে তো আমি বড়ই দয়াবান মানুষ তাই তোমাকে আমার বুঁকে ঘুমাতে দিলাম। আমার পার্সোনাল বুঁকটা কে নিজের পার্সোনাল সম্পদ ভাবছো নট ফেয়ার।
আবরারের কথায় লজ্জা উ*ধা*ও হয়ে গেলো আরশির। লোকটা নিজে যা ইচ্ছা করতে পারবে আর সে একটু বুঁকে মাথা রেখেছে বলে এখন খোঁ*চা দিচ্ছে! রা*গ হলো আরশির। রা*গে*র ব*শে*ই হুট করে আবরারের দিকে এগিয়ে গেলো সে। ভ*ড়*কে গেলো আবরার। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। আবরার কে আরও অবাক করে দিয়ে আরশি আবরারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
— আপনিও আমার, আপনার বুঁকটাও আমার। এখানে ভাবভাবির কিছু নেই। তাই আমি যখন ইচ্ছা আপনাকে জড়িয়েও ধরবো আর যখন ইচ্ছা আপনার বুঁকে মাথাও রাখবো। বুঝতে পেরেছেন এমপি সাহেব?
আবরার চোখে মুখে অবাক ভাব ব*জা*য় রেখেই মাথা ঝাঁ*কি*য়ে বুঝিয়ে দিলো সে বুঝতে পেরেছে আরশির কথা। আবরার কে ভ*ড়*কে দিতে পেরে বিজয়ের হাসি হাসলো আরশি।
চলবে?
#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৩৯
ফোনে কথা বলছে আবরার। এমন সময় কেউ শ*ক্ত করে জড়িয়ে ধরায় চ*ম*কে উঠলো সে। আরও বেশি চ*ম*কা*লো যখন দেখলো জড়িয়ে ধরা মানুষ টা আর কেউ নয় বরং আরশি। মেয়ে টা তাকে সজ্ঞানে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে বিশ্বাস হতে চাইলো না আবরারের। আজ বোধহয় তার অবাক হওয়ার দিন। মেয়ে টা বারবার তাকে নিজের কাজ কর্ম দ্বারা অবাক করে দিচ্ছে। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি কে পরে কথা বলবে বলে কল কে*টে দিলো আবরার। বুকে উষ্ণ তরলের স্পর্শ অনুভব করতেই কেঁ*পে উঠলো আবরারের মন। মেয়ে টা কি কাঁ*দ*ছে? কেনো কাঁ*দ*ছে? আরশি তো সহজে কাঁ*দা*র মতো মেয়ে নয়। তাহলে কি তাকে কেউ ক*ষ্ট দিয়ে কিছু বলেছে? মিহি বেগম কিছু বলেছেন কি? অ*স্থি*র হলো আবরারের মন মস্তিষ্ক। হাতে থাকা ফোন টা বেডে ছু*ড়ে আরশি কে জড়িয়ে ধরলো আবরার। আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
— আমার মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালির চোখে পানি কেনো? কি হয়েছে আমার বউটার?
আবরারের আদুরে কণ্ঠে কান্নার মাত্রা যেনো আরেকটু বেড়ে গেলো আরশির। আদুরে ছানার ন্যায় লে*প্টে রইলো আবরারের বুকের সাথে। ফুঁ*পা*তে ফুঁ*পা*তে বললো,
— জানেন কি হয়েছে?
আরশি কে সময় দিলো আবরার। তার এ*লো*মে*লো চুল ঠিক করে দিতে দিতে নরম কণ্ঠে বললো,
— না বললে জানবো কি করে? তুমিই তো বলছো না। কি হয়েছে বলো আমাকে। কেউ কিছু বলেছে?
নাক টা*ন*লো আরশি। কা*ন্না*র কারণে কেঁ*পে কেঁ*পে উঠছে সে। আবরারের বুকে নাক ঘ*ষে বললো,
— জানেন আজ এতগুলো বছর পর আম্মু আমার সাথে কথা বলেছে, আমাকে আরু বলে ডেকেছে, আমাকে নিজের কাছে বসিয়েছে, আমি কেমন আছি তা জানতে চেয়েছে। আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। আমি কি কোনো স্বপ্ন দেখছি, কোনো সুন্দর স্বপ্ন? আমার স্বপ্ন টা কি ঘুম ভা*ঙা*র সাথে সাথে ভে*ঙে যাবে? নাকি এসব সত্যি? সত্যিই কি আমার জীবনের হা*রি*য়ে যাওয়া সুখ ফিরে আসছে? সত্যিই কি আমার এ*লো*মে*লো হয়ে যাওয়া জীবন টা আগের মতো গোছালো, পরিপাটি হয়ে যাচ্ছে?
উ*ত্তে*জিত হয়ে এক দমে কথাগুলো বললো আরশি। কা*ন্না*র মাত্রা আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে তার। তবে আবরারের বুক থেকে এখনো মুখ তু*লে নি সে। অন্যদিকে আরশির কথাগুলো শুনে আবরার বুঝলো কেনো আরশি কাঁ*দ*ছে। মেয়ে টা অতিরিক্ত আনন্দে এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁ*দ*ছে। মুহূর্তেই সকল অ*স্থি*রতা, চি*ন্তা দূর হয়ে গেলো আবরারের। আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বললো,
— তুমি স্বপ্ন দেখছো না মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি। সব টা সত্যি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করেন। দুঃ*খ দিলে সুখ ও দেন। সুখ দুঃ*খ মিলিয়েই তো আমাদের জীবন টা এতো সুন্দর।
নিশ্চুপ থেকেই কিছু টা সময় কে*টে গেলো আবরার আরশির। হুট করে আরশি ধীর আওয়াজে বলে উঠলো,
— ধন্যবাদ এমপি সাহেব।
আবরার কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
— কেনো?
— আমার জীবনে আসার জন্য, আমাকে আপনার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য, আমাকে এতোটা বুঝার জন্য, আমাকে এতো টা ভালোবাসার জন্য।
কথাগুলো মনে মনেই আওড়ালো আরশি। মুখে আর বলা হলো না। এতো সময় বাদে মাথা তু*লে আবরারের দিকে চাইলো সে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবরারের পানে। যেনো চোখ দিয়েই মনের কথা বুঝিয়ে দিতে চায় সে। মনে মনে হাজারবার সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করলো আবরার কে তার জীবনে পাঠানোর জন্য। সে জানে না তার মায়ের স্বাভাবিক আচরণের পেছনে আবরারের কোনো হাত আছে কিনা তবে এতটুকু জানে আবরার আসার পর থেকে তার জীবনের এ*লো*মে*লো জিনিসগুলো ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে আরশির মনের কথাগুলো যেনো বুঝে ফেললো আবরার। সেই আঁখি জোড়া তো তার কাছে স্বচ্ছ আরশি। কেনো বুঝবে না সে সেই আরশির ভাষা! অধর কোণ প্রসারিত হলো আবরারের। আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
— এখন থেকে তোমার চোখে অশ্রু আসলেও সেটা আনন্দের অশ্রু হবে মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি। নিজের সব টা দিয়ে তোমায় আ*গ*লে রাখবো দেখে নিও। আমার ভালোবাসার চাদরে সর্বক্ষন মু*ড়ি*য়ে রাখবো। অন্যদের মতো হাতে হাত রেখে সারাজীবন পাশে থাকার, ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করতে পারবো না তবে মৃ*ত্যু*র আগ পর্যন্ত পাশে থেকে, ভালোবেসে দেখিয়ে দেবো।
কা*ন্না*র কারণে নাক, মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে আরশির। এ যেনো আরশির নতুন আরেক রূপ। আর কতো রূপে মেয়ে টা তাকে পা*গ*ল করবে জানা নেই আবরারের। এই যে অ*শ্রু*সি*ক্ত মুখে পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে কি সুন্দর ই না লাগছে মেয়েটা কে! আরশির গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো আবরার। কেঁ*পে উঠলো আরশি। হুশ ফিরলো তার। এতক্ষন একটা ঘো*রে*র মাঝে ছিলো সে। কি কি করেছে ভাবতেই র*ক্তি*ম আভা ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখশ্রী জুড়ে। আবরার আরশির অ*শ্রু*সি*ক্ত লাজুক মুখশ্রীর দিকে নে*শা*র্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সেই নে*শা*লো চোখে আর চোখ রাখতে পারলো না আরশি। মুহূর্তেই দৃষ্টি নত হয়ে আসলো তার। হুট করে আরশির ললাটে অধর স্পর্শ করালো আবরার। সর্বাঙ্গে মৃদু ক*ম্প*ন অনুভব করলো আরশি। পরম আবেশে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসলো তার। পরমুহূর্তেই নিজের আঁখি জোড়াতেও আবরারের অধরের স্পর্শ পেলো আরশি। এবার আবরারের দৃষ্টি গেলো আরশির মসৃন, কোমল অধরের দিকে। আলতো করে আরশির অধরে আঙ্গুল ছোঁয়ালো সে। আবরারের এমন স্পর্শে হৃদস্পন্দন দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো আরশির। আবরারের কাছ থেকে দূরে সরার প্রয়াস করলো সে। কিন্তু সফল হলো না। আবরার এক হাতে তার কোমর শ*ক্ত করে আঁ*ক*ড়ে ধরে আছে যার ফলে সুবিধা করতে পারলো না আরশি। আবরার আরশির অধরে অধর স্পর্শ করবে এমন মুহূর্তে দরজা ন*ক করলো কেউ। আবরারের কাছ থেকে ছি*ট*কে দূরে সরে গেলো আরশি। দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেলো রিফার আওয়াজ।
— আপু মনি একটু বাইরে আসবে প্লিজ? দরকার ছিলো…
মাথা চু*ল*কালো আবরার। বিড়বিড় করে বললো,
— শ্যালিকা আর আসার সময় পেলো না। রোমান্স এর সময় ই আসা লাগলো।
আবরার বিড়বিড় করে বললেও কাছাকাছি থাকায় শুনতে পেলো আরশি। মিটমিট করে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো সে। ভাবতে লাগলো এই বাড়িতে আসার পরের ঘটনা।
——
শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে আসলো আরশি। বাড়িতে ঢুকে কোনোরকমে রিফার সাথে দুটো কথা বলেছে সে। তারপর চলে এসেছে ফ্রেশ হতে। রুমের বাইরে এসেও আবরার কে কোথাও দেখতে পেলো না আরশি। রুমেও নেই, বাইরেও নেই। ভ্রু কুঁ*চ*কে আসলো তার। আবরার কোথায় চলে গেলো সেটাই ভাবতে লাগলো সে। আরশির ভাবনার মাঝে রিফা এসে তার হাত জড়িয়ে ধরলো। নিজের হাতে থাকা কতগুলো চকলেট আরশি কে দেখিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
— দেখো না আপু মনি ভাইয়া আমার জন্য কতগুলো চকলেট নিয়ে এসেছে।
রিফার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো আরশি। গালে হাত রেখে বললো,
— অনেক খুশি হয়েছিস মনে হচ্ছে!
রিফার ঠোঁটের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। চোখ মুখ চকচক করছে তার। যেনো অনেক মূল্যবান কিছু পেয়েছে। আরশির প্রশ্নে রিফা আনন্দের সাথে বললো,
— খুশি মানে অনেক অনেক অনেক খুশি হয়েছি। আবরার ভাইয়া অন্নেক ভালো।
রিফার অ*ঙ্গ*ভ*ঙ্গি দেখে কিছু টা শব্দ করেই হাসলো আরশি। কিছু একটা মনে পড়তেই হাসি থেমে গেলো তার। কপাল কুঁ*চ*কে রিফা কে জিজ্ঞাসা করলো,
— তোর ভাইয়া কোথায়? তাকে তো দেখছি না।
রিফা খুশি মনেই জবাব দিলো,
— ভাইয়া তো মায়ের রুমে। মায়ের সাথে কথা বলছে।
অবাক হলো আরশি। সাথে একরাশ অ*ভি*মা*ন ভ*র করলো মনে। তার মা আবরারের সাথে কথা বলছে অথচ সে এসেছে জানার পরও একবারও তার খোঁজ নিলো না! মুহূর্তেই ম*লি*ন হলো আরশির চোখ মুখ। রিফা আনন্দে নাচতে নাচতে চলে গেলো রান্না করতে। আরশি তাকিয়ে রইলো তার মায়ের রুমের দিকে। এর মাঝেই ফোনে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো আবরার। এক পলক আরশির দিকে তাকিয়ে আরশির রুমে চলে গেলো সে। পা টি*পে টি*পে মিহি বেগমের রুমের কাছে গেলো আরশি। উদ্দেশ্য একবার উঁ*কি দিয়ে মা কে একটুখানি দেখা। মিহি বেগমের রুমের কাছে গিয়ে দরজা একটু ফাঁ*ক করলো আরশি। উঁ*কি দিতেই মিহি বেগমের চোখে চোখ পড়ে গেলো আরশির। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো সে। মিহি বেগমের সামনে গেলে উনি চি*ল্লা*চি*ল্লি করবেন এমনটাই ধারণা আরশির। সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ভেতর থেকে মিহি বেগম উচ্চ শব্দে বলে উঠলেন,
— কোথায় যাচ্ছিস আরু? ভেতরে আয়।
পা জোড়া থেমে গেলো আরশির। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। মনে হলো তার কান ভু*ল শুনেছে। আজ কত গুলো বছর পর মায়ের মুখে আরু ডাক টা শুনলো সে। চোখে জল ট*ল*ম*ল করে উঠলো তার। নিজের শোনার ভু*ল ভেবে পুনরায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মিহি বেগম ফের বলে উঠলেন,
— কি হলো শুনতে পাচ্ছিস না? রুমে আসতে বললাম তো। রুমে আয়।
ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কা*ন্না টা কোনোমতে গি*লে পেছন ফিরলো আরশি। ট*ল*তে ট*ল*তে রুমে প্রবেশ করলো সে। হাঁটার শক্তিটাও যেনো হা*রি*য়ে গেছে তার। মিহি বেগমের কাছ থেকে কিছু টা দূরত্ব ব*জা*য় রেখে মাথা নিচু করে বসলো আরশি। কিছু টা সময় নীরবতায় কে*টে গেলো। আরশি মাথা নিচু করে রাখলেও বুঝতে পারলো তার মা তাকেই এক ধ্যানে দেখে যাচ্ছে। চোখ ভ*রে আসলো আরশির। ইচ্ছা হলো অ*ভি*মানী কণ্ঠে মা কে অনেক কিছু বলতে, তার বুকে আ*ছ*ড়ে পড়ে মন ভ*রে কাঁ*দ*তে। কিন্তু এর কিছুই করতে পারলো না সে। যদি মিহি বেগম রা*গ করে! চুপটি করে বসে রইলো আরশি। নীরবতা ভে*ঙে মিহি বেগম ই আগে মুখ খুললেন। এতদিন পর মেয়ের সাথে কথা বলতে উনার মাঝেও হয়তো জ*ড়*তা কাজ করছে। কোনোমতে আ*ট*কে আসা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
— কেমন আছিস আরু?
কা*ন্না সং*ব*রণ করে ভা*ঙা গলায় জবাব দিলো আরশি,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মু।
আর বসে থাকতে পারলো না আরশি। দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। আজ সে কাঁ*দ*তে চায়, খুব করে কাঁ*দ*তে চায়। তবে এই কা*ন্না ক*ষ্টে*র নয় বরং হঠাৎ অনেক বড় কিছু প্রাপ্তির আনন্দের।
সেই চাওয়া থেকেই তো আবরারের বুকে আ*ছ*ড়ে পড়ে কেঁ*দে*ছে আরশি। বিশ্বস্ত একটা বুক পেয়েছে সে। যেই বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিজের সকল সুখ, দুঃ*খ, ভালো লাগা, খা*রা*প লাগা ব্যক্ত করতে পারবে সে। ভাবতেই মন টা আনন্দে ভ*রে উঠলো আরশির। আজকের দিন টা তার জীবনের অন্যতম সুন্দর একটা দিন। এই দিন টা সে সারাজীবন মনে রাখবে।
চলবে,